পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩ মে, ২০১৭

রাডার বিজয় দিবস সংখ্যা (সম্পূর্ণ)


* পিডিএফ কপি পেতে ক্লিক করুন এখানে

[ব্লগ সম্পাদকের নোট: রাহুমুক্তি সংখ্যা আপলোড করার দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর  অবশেষে রাডারের বিজয় দিবস সংখ্যা তুলে দেয়া সম্ভব হলো। নানা কারণে এতদিন এ বিষয়ে কাজ করা যায়নি, এজন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।

রাহুমুক্তি সংখ্যার পরই ১৯৯১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। অনিয়মিত ম্যাগাজিনটির ৩২-পৃষ্ঠার এই সংখ্যাটিও অন্যান্য সংখ্যাগুলোর মতো সে সময় ব্যাপক প্রাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আমরা এখানে এই সংখ্যার সব লেখা আগা থেকে গোড়া বহুবহু তুলে দিয়েছি। কিছু বানান সংশোধন করা ছাড়া কোন লেখা এডিট করা হয়নি। আশাকরি লেখাগুলো এ সময়ের পাঠকদেরও ভালো লাগবে।]


রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৬ই ডিসেম্বর’৯১
বিজয় দিবস সংখ্যা


বিজয় দিবস ও আজকের বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্র ও জনগণের প্রত্যাশা

তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি পার্বত্য জনগণের দুর্ভোগ

খালেদার প্রতি CHT Commisson -এর চিঠি

এম. এন. লারমাকে যেমন দেখেছি

পেরুর গণযুদ্ধই বিশ্ব বিপ্লবের নতুন অগ্রযাত্রা

তিন জন ছাত্র নেতার সাক্ষাতকার


পৃষ্ঠা - ২

চিঠি পত্র

“রাডার”-কে অভিনন্দন
প্রিয় সম্পাদক,
নিপীড়িত নির্যাতিত জুরাছড়ি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আপনাকে ও “রাডার” প্রকাশনা কমিটিকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। রাডারের “রাহুমুক্তি” সংখ্যা আমার খুব ভালো লেগেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান দঃসময়ে আপনাদের এই সাহসী পদক্ষেপকে আমি স্বাগত জানাই। আমাদের ছাত্র সমাজকেই জেগে উঠতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। “রাডার” জুম্ম ছাত্র সমাজের মধ্যে সংগ্রামী চেতনার অগ্নিমশাল জ্বেলে দিক -এ কামনা করছি।                                                                                                       
জে. পি. চাকমা / জুরাছড়ি।

“আমরাও আছি রাডারের প্রতিবাদী ব্যানারে”
কাপুরুষের মতো সব সহ্য করছি আমরা। দেখেও না দেখার ভান করছি, শুনেও না শুনার মতো, জেনেও না জানার মতো অভিনয় করছি। যেন সবাই নির্জীব জড় পদার্থ হয়ে গেছি। সব সওয়া হয়ে গেছে আমাদের। কখনো শান্তিবাহিনীর লেবাস দিয়ে, কখনো তাদের সাথে গোপন সম্পর্ক থাকার সন্দেহে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় আমাদের ওপর। বিনা পারিশ্রমিকে রুটিন মাফিক প্রতিদিন বেগার খাটতে হয় সেনা ক্যাম্পে। বিশ্রী গালিগালাজ, কটুক্তি-সেতো কিল, ঘুষি আর বুটের লাঠির তুলনায় ভদ্র ব্যবহারই বটে। তবুও যেন হয়রানীর শেষ নেই। সারাদিন খাটুনির পর অবসন্ন দেহ এলিয়ে দিয়ে একটু নিরিবিলি ঘুমোবার যো নেই। স্যারদের হুকুম, পাহারা দিতে হবে সারা রাত - যাতেশান্তি সেনারা ক্যাম্প এট্যাক করতে না পারে।                                                    
কিন্তু আর কতদিন সহ্য করবো আমরা? চিরদিন কি হুকুমের গোলাম হয়ে থাকা ?   
শেষে রাডারকে সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি - এসব মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদের জন্য। ভয় নেই। এগিয়ে চলো। আমরাও আছি “রাডার”-এর প্রতিবাদী ব্যানারে।                                                                          
রাসেল / খাগড়াছড়ি।

“চলার পথের সঙ্গী হতে চাই”
সংগ্রামী সম্পাদক, অভিনন্দন।                                                                                       
“কন্ঠরুদ্ধ কোন সুগায়কের অমর কবিতা
নিজেই প্রকাশ করে - আমি যেন তার
সুধা কন্ঠ হই, সুধা কন্ঠ হই।
রক্তিম যেন এক উত্তাপ হই।”
আপনারা কন্ঠরুদ্ধ পারিজাত ধবল মনের অধিকারী পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাসমূহের মনের কবিতা প্রকাশ করেছেন। প্রতিবাদ করেছেন অন্যায় অত্যাচারের। তাই আপনাদের রক্তিম উত্তাপের সাথে আমার মনের রক্তিম উত্তাপ আমি মিশিয়ে দিতে চাই। আমি আপনাদের চলার পথের সঙ্গী হতে চাই। হোক সে দুর্গম, বন্ধুর।
আমি “রাডার”-এর রিপোর্টার কিংবা সংবাদাতা হতে চাই। যদি হতে পারি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবো।
প্রদীপ তালুকদার / রাউজান।

“সংবাদাতা হতে আগ্রহী”
প্রিয় সম্পাদক
আমি পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার একজন জুম্ম জাতির সদস্য। সম্প্রতি প্রকাশিত “রাডার” -এর রাহুমুক্তি সংখ্যা পেয়েছি। আপনাদের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে “রাডার” -এ সংবাদাতা হতে ইচ্ছুক। পাহাড়ি জনগণ তথা জুম্ম জাতির সুখ-দুঃখ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও শোষণের কথা দেশবাসীর সম্মুখে তুলে ধরার লক্ষ্যে আপনাদের অন্যতম প্রকাশনা জুম্ম মুক্তির পথ “রাডার” -এর সংবাদাতা হিসেবে যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেলে আমার মানব জীবন স্বার্থক বলে মনে করবো।
মানিক ত্রিপুরা (মথুরা) / মাটিরাঙ্গা।

“রাডার” পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে
প্রতিবাদের আলো ছড়িয়ে দিক”

শ্রদ্ধেয় সম্পাদক, “রাডার”                                                                                                                       শুভেচ্ছাসহ লিখছি। আপনাদের প্রকাশিত ২৫ শে সেপ্টেম্বর ’৯১ -এর “রাহুমুক্তি সংখ্যা” পেয়েছি। পার্বত্য অঞ্চলের ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে এ ধরনের আলো ছড়িয়ে পড়–ক এটাই আমরা চাই। কিন্তু একটা বড় পরিতাপের বিষয় যে, এযাবত যে সব সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল, এবং যত সংখ্যা পাঠিয়েছিলেন তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। যার কারণে গ্রামের ব্যাপক জনসাধারণের কাছে পৌছানো সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র কয়েকজন শিক্ষিত ব্যক্তি এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল। সেজন্য আমি “রাডার” প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেসব আলো ছড়িয়ে দেবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে এজেন্ট এবং সংবাদাতা হতে আগ্রহী। পরিশেষে আপনাদের পত্রিকার বহুল প্রচার কামনা করছি। 
সুভাষ দত্ত চাকমা / মারিশ্য।

“এখন আর জনগণ সেনাবাহিনীর আশ্রয় চায় না”
শ্রদ্ধেয় সম্পাদক “রাডার”,  
শুভেচ্ছা নিবেন। গত ২৫শে সেপ্টেম্বর ’৯১ - এ প্রকাশিত “রাডার” আমার খুব ভাল লেগেছে। প্রত্যেকে চায় অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। তাই আমাদের শিক্ষিত ছাত্র সমাজকেই এই প্রতিবাদের দায়িত্ব নিতে হবে। এত কিছু অন্যায় অবিচার হওয়া সত্ত্বেও আমরা নিরবে নিস্তব্ধে বসে আছি। তারা (সেনাবাহিনী) আমাদেরকে পুতুলের মত ব্যবহার করছে। আপনারা হয়ত জানেন, জুরাছড়ির মত উশৃংখল উপজেলা হয়ত অন্য কোথাও নেই। এ এলাকার জনগণকে সেনাবাহিনীরা দু’বছর আগে “গুচ্ছগ্রাম” নামক বন্দীশালায় বন্দী করে রেখেছে। সেনাবাহিনীরা যাকে তাদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেছে বলে দাবী করে। কিন্তু এ এলাকার জনগণ আর সেনাবাহিনীর আশ্রয় চায় না। যেতে চায় তাদের নিজ নিজ বাসস্থানে। এখানে আগে অনেক নির্যাতন নিপীড়ন হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো আমার মনে নেই। কারণ তখন আমি ছোট ছিলাম। আমি এখনও অংকুরিত বীজ মাত্র। আমাকে বলতে আমার মত তরুণদেরকে যদি আপনারা শিক্ষা দেন তাহলে আমরাই একদিন জাতিকে শিক্ষা দেবো। আমি এখনও মাত্র ১৫ বছরে পা দিয়েছি। এই পনেরটি বসন্ত যেন পার্বত্য এলাকার নির্যাতনের স্বাক্ষী। পরিশেষে “রাডার” পরিবারের শুভ কামনা করে-

জয় গোপাল চাকমা / জুরাছড়ি।

পৃষ্ঠা - ৩

নিজের ঢোল নিজে বাজাই - ২
আমরা পাহাড় চিরে বেরিয়ে আসা
দুর্দান্ত ঝর্ণার মতো একঝাঁক প্রতিবাদী তরুণ।
তারুণ্যের অমোঘ শক্তিতে ছিন্ন করতে চাই
শত প্রতিকুলতা-জঞ্জাল-বাধাবন্ধন। 
ভাসিয়ে নিতে চাই সকল অন্যায়-অত্যাচার-শোষন-বঞ্চনা। 
প্রগতির উজান বেয়ে পৌঁছে যেতে চাই মুক্তির মোহনায়।
স্থান নেই এখানে সুবিধাবাদ ও শক্তির লেহী দালালদের।
আমরা নিপীড়িত মেহনতি মানুষের শত্রুদের
অকাতরে মৃত্যু কামনা করি।
বিরোধীতা করি সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা,
স্বৈরাচার আর সামরিক আধিপত্যের অশুভ শক্তির।
নিষ্কৃতি চাই নিয়ন্ত্রণের করাল থাবা থেকে।
ভাঙতে চাই জরাগ্রস্থ এই অপুংসক সমাজদেহকে। 
ইতিহাসের রক্ত ফেনিল পথ বেয়ে পৌঁছে যেতে চাই
শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার স্বর্ণাভ জগতে।
অতএব, প্রগতির মন্ত্রে বিশ্বাসী 
টগবগে তারুণ্যের আপোষহীন সংগ্রামী
বন্ধুদের খুঁজে বেড়াচ্ছি সন্তর্পনে।
বেরিয়ে এসো অচলায়তন -
প্রতিক্রিয়াশীলতার পাহাড় ভেঙে।
মহাকালের নতুন স্বপ্ন নিয়ে এসো
হাতে হাত মেলাই।
এগিয়ে যাই দুঃসাহসী অভিযাত্রায়। 
রুঢ় বাস্তবতার কষাঘাত চিরে অনিবার্য
বিজয় অর্জনে যায় যদি জীবনটা যাক।


যোগাযোগ (বার্তা ও চিঠি) :-
৩২০, পূর্ব বাড়ী, জগন্নাথ হল, ঢা, বি।
৩০৯, শান্তি নিকেতন, চ, বি।

প্রাপ্তিস্থানঃ-
পাঠক সমাবেশ, মুজিব হলের বিপরীতে, ঢাকা।
দীপ্র প্রকাশনী, ৬৮/২ পুরানা পল্টন, বাসস-এর নীচে।
কারেন্ট বুক সেন্টার, চট্টগ্রাম।
বুক স্টল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
৩৫৬, নবাব আব্দুল লতিফ হল, রা, বি।

রাডার
সম্পাদকীয়
সুপ্রিয় পাঠক, প্রাণঢালা রক্তিম অভিবাদন। আপনাদের ব্যাপক সাড়া আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। স্রেফ “রাডার” কেনা অথবা  বেচার জন্যে অনেককে নিগৃহীত হতে হয়েছে। অনেককে পরতে হয়েছে শারীরিক নির্যাতনের মতো সহজলভ্য অলংকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঐ দানবীয় হিংস্রতা আপনাদের “মার্ডার হলেও রাডার কিনবো” - এই বুকফাটা বজ্র উচ্চারণকে রুদ্ধ করতে পারেনি। পারেনি রাডারের প্রতি আপনাদের অকৃত্রিম ভালোবাসাকে মার্ডার করতে। আমরাও আপনাদের অদম্য সাহস ও ভালোবাসাকে আমাদের বুকে ধারণ করে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে চাই - “মার্ডার হলেও রক্ত-অক্ষরে নিপীড়িত-নির্যাতিত জনতার কথা লিখে যাবো রাডারের পাতায় পাতায়।”
তাই প্রিয় পাঠক, শ্যোন দৃষ্টির রোষানলে পড়েছি আমরা। শত্রুর সন্দেহজনক গতিবিধি রাডারে স্পষ্ট। সম্মুখে কর্কটের অশুভ রাহু উদ্যত। যে কোন মুহুর্তে ’৭৪ এর মরণাস্ত্র আবার আঘাত হানতে পারে রাডারকে। অসহ্য নরক যন্ত্রনায় গোঙাতে পারে আমাদের প্রচ- প্রতিবাদী কন্ঠ। তবুও আমরা শংকিত নই। কারণ তারুণ্যের মহাশক্তির কোনো মৃত্যু নেই। আমরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছি রাডারের রাহুমুক্তিতে। প্রয়োজনে যে কোন অশুভ শক্তির অগ্নিকুণ্ডে তারুণ্যের সতীত্ত্ব পরীক্ষা দেবো অধিকারহারা দুর্ভাগা জনতার কথা বলতে। প্রিয় পাঠক, আমাদের সুখে, দুঃখে, বেদনাতে আমরা শুধু আপনাদের ভালোবাসার উঞ্চ উত্তাপ বুকে নিবিড়ভাবে অনুভব করতে চাই।
গণঅভ্যুত্থানের পর এক বছর পেরুলো। সামরিক স্বৈরাচার সরে গেছে শাসন কাঠামো থেকে। আজকের বিংশতিতম বিজয় বর্ষেও তো গণতন্ত্রের প্রাণখোলা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। গণতন্ত্রের আদ্যাক্ষরও ভাবা যায় না আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে। অলিখিত সামরিক শাসন চলছে সুদীর্ঘ কাল থেকে। এভাবে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এ দেশের জওয়ান সেনাদের ভাবমূর্তিকে ধ্বংস করছে। হীন স্বার্থে সেনা ভাইদের অবতীর্ণ করানো হচ্ছে হানাদারের ভূমিকায়। একাত্তরে যারা দুর্ভাগা জনতার মুক্তির জন্য লড়েছিল জীবন বাজী রেখে, আজ তারাই পার্বত্য জনতার (অস্তিত্বের) সংগ্রামকে দমন করতে ব্যস্ত। কি বিচিত্র আমাদের এই দেশ।
আমরা সেনাবাহিনীর নয়, সেনাশাসনের বিরোধী। তাই আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অচিরেই সেনাশাসনের অবসান কামনা করি। এই বিংশতিতম বিজয় বার্ষিকীতে নির্বাচিত সরকারকে অবশ্যই গণতন্ত্রের পরীক্ষা দিতে হবে।
প্রিয় পাঠক, সামনে ইংরেজী নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা।

“হিল লিটারেচার ফোরাম” -এর পক্ষে “রাডার” প্রকাশনা কমিটি ও সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত


পৃষ্ঠা: ৪

ঘটনা প্রবাহ

১০ই নভেম্বর মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সহ বিভিন্ন এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের উদ্যোক্তা, প্রাক্তন সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয়। উল্লেখ্য, মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর জনসংহতি সমিতির বিভেদপন্থীদের দ্বারা নৃশংসভাবে নিহত হন।
এই মহান নেতার স্মরণে ছাত্ররা বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। ঢাকায় অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীরা জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ কক্ষে প্রয়াত নেতার জন্য এক স্মরণ সভার আয়োজন করে। স্মরণ সভার শুরুতে ছাত্ররা প্রয়াত নেতা ও তার সাথে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করে। তারপর আলোচনা সভা শুরু হয়। আলোচকগণ প্রয়াত নেতার মৃত্যুকে জুম্ম জাতি সহ সমগ্র বাংলাদেশের অপুরণীয় ক্ষতি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। ছাত্র-ছাত্রীরা এই মহান নেতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে। আলোচনা সভা শেষে জগন্নাথ হল মন্দিরে প্রয়াত নেতার উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালানো হয়।                                                                                                                                      
খাগড়াছড়ির স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ঐ দিন খালি পায়ে স্কুল কলেজে যায় এবং কালো ব্যাজ ধারণ করে। বিকালে মহান নেতার উদ্দেশ্যে জনবল বৌদ্ধ বিহারে ফানুচ উড়ানো হয় এবং হাজার বাতি জ্বালানো হয়। কমপক্ষে ৪০০ জন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও যুবক-যুবতী এ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে।

রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি ছাত্ররা কলেজ প্রাঙ্গনে প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার মৃত্যু বার্ষিকী পালনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাঙ্গালী ছাত্র গণপরিষদ এতে বাধা প্রদান করে এবং সেখানে তারা সভা অনুষ্ঠিত করবে বলে তক্ষণাভাবে ঘোষণা দেয়। অনেক বাদানুবাদের পর কলেজ প্রাঙ্গনে কোন সভা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ফলে পাহাড়ি ছাত্ররা লারমার স্মরণে একটি শোক মিছিল বের করে।                                                                                               
রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঙ্গামাটি জেলখানার পাহাড়ি কয়েদীরাও ১০ই নভেম্বর প্রয়াত নেতার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেন।

পদত্যাগ না করা পর্যন্ত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের সাথে এক টেবিলে বসা সম্ভব নয়
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত তিন এম.পি. পাহাড়ি গণপরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও ঢাকায় অবস্থানরত বিশিষ্ট পাহাড়ি বুদ্ধিজীবীগণ গত ৯/১১/৯১ দীর্ঘ আলোচনার পর এই মত ব্যক্ত করেন যে, পদত্যাগ না করা পর্যন্ত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের সাথে এক টেবিলে বসা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, রাঙ্গামাটি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য বাবু দীপংকর তালুকদার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ, বুদ্ধিজীবী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন চীফদের বৈঠকের ব্যাপারে অনেক দিন আগে এক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জেলা পরিষদের সাথে আলোচনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পাহাড়ি ছাত্র নেতা রাডারকে বলেন, “গণধিকৃত জেলা পরিষদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব একটি কুটচাল ছাড়া আর কিছুই নয়।” বস্তুতঃ স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া জেলা পরিষদ পার্বত্য জনগণের দুর্বার আন্দোলন, আন্তর্জাতিক চাপ এবং জেলা প্রশাসক ও সেনা প্রশাসনের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ফলে বর্তমানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এই দ্বন্দ্বের সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা সম্পর্কে গৌতম দেওয়ানের বিবৃতি প্রদান এং সরকারের কাছে তিন জেলা পরিষদের হুঁশিয়ারীযুক্ত ১১ দফা দাবী পেশ করার মধ্য দিয়ে। এই সকল বিষয় বিবেচনা করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণপরিষদ, বুদ্ধিজীবী ও পার্বত্য এম.পি. গণ উক্ত বৈঠকে ঐক্যমত ব্যক্ত করেন যে, আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে তিন জেলা পরিষদের সকল চেয়ারম্যান ও পাহাড়ি সদস্যদের পদত্যাগ করতে হবে।

তিন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ১১ দফায় পাহাড়ি গণপরিষদ ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের তীব্র প্রতিবাদ
গণধিকৃত তিন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ১১ দফা ৭/১১/৯১ ইং তারিখ পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশিত হবার সাথে সাথে পাহাড়ি গণপরিষদ ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ এক বৈঠকে বসেন। বৈঠকের পর পাহাড়ি গণপরিষদ ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ যুক্তভাবে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের যুক্ত ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ ব্যক্ত করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, পাহাড়ি গণপরিষদ ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ মনে করে মূল সমস্যায় না গিয়ে তথাকথিত ২২ টি বিষয়ের হস্তান্তর, গণবিরোধী জেলা পরিষদের সাংবিধানিক গ্যারান্টি দাবী এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের তিন জেলা পরিষদের পরামর্শ নেয়ার দাবী সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অবাস্তব। কারণ এই জেলা পরিষদ হচ্ছে পার্বত্য জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে কয়েজন গণবিচ্ছিন্ন তথাকথিত নেতার মাধ্যমে প্রহসনমূলক সমাধান, যে কারণে কোটি কোটি টাকার বাজেট দিয়েও এই পরিষদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, যে সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনবরত লোকক্ষয় ও রক্তপাত ঘটছে সে সময়ে চেয়ারম্যান ত্রয়ের এই যুক্ত ঘোষণার ১১ দফা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে দীর্ঘায়িত করার হীন কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই পাহাড়ি গণপরিষদ ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ অবিলম্বে এই জেলা পরিষদ বাতিলের মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে নতুন প্রক্রিয়া শুরু করার সাথে সাথে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানত্রয়কে তাদের দ্বিমুখী চরিত্র পরিহার করে পদত্যাগের মাধ্যমে জনতার কাতারে সামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

দুই অধিনায়কের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জনগণের নাভিঃশ্বাস

কুতুকছড়ি, রাঙ্গামাটি। এখান থেকে খাগড়াছড়ি যাবার সড়ক চেঙ্গীভেলী রোড নামে পরিচিত। কুতুকছড়ির ৫ মাইল পরেই ঘিলাছড়ি। এই দু’টো জায়গাতে রয়েছে আর্মি ক্যাম্প। রাস্তার দু’পাশে রয়েছে অনেক চেকপোষ্ট। বর্তমানে এই দুই এলাকায় মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। কুতুকছড়ি ও ঘিলাছড়ি ক্যাম্পের দুই অধিনায়ক নিজেদের ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে একই তারিখে দু’টো বাজারে বাজার মিলানোর নির্দেশ দিয়েছে। এক কমা-ারের আওতাধীন এলাকায় কোন ব্যক্তি অন্য কমা-ারের এলাকাধীন বাজারে যাওয়া-আসা করতে পারছে না। অর্থা কুতুকছড়ি ক্যাম্পের অধীন কুতুকছড়ি বাজার ফেলে কেউ ঘিলাছড়ি বাজারে যেতে পারবে না। অনুরূপভাবে ঘিলাছড়ি ক্যাম্পের অধীন ঘিলাছড়ি বাজারে না গিয়ে কেউ কুতুকছড়ি বাজারে যাওয়া-আসা করতে পারবে না এবং কেনা-বেচা করাও বন্ধ। এর অন্যথা হলে জনসাধারণকে মারধর করা হচ্ছে। এতে জনসাধারণের দুর্ভোগ বেড়েছে। উপাদিত পণ্য সামগ্রী এই দুই এলাকার মানুষ অন্য কোথাও নিতে পারছে না। ফলে সস্তায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া বাজারে প্রবেশের জন্য ক্যাম্প কর্তৃক অনুমোদিত পাস লাগে। পাস ছাড়া কেউই বাজারে ঢুকতে পারে না।


পৃষ্ঠা: ৫-৮

মানবাধিকার
পার্বত্য চট্টগ্রাম মানবাধিকার লংঘনের স্বর্গপুরী

[সুষ্টু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে কথিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। জেল-জুলুম, শারীরিক নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি-সংযোগ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হামলা-ইত্যাদি ঘটনার খবর আমাদের হাতে অহরহ আসছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের খবরগুলো এই কলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। - সম্পাদনা পরিষদ]

মাটিরাঙ্গা
মাটিরাঙ্গায় দুর্গাপূজা উসব পণ্ড দুর্গাদেবী প্রতিমাসহ গনেশ-কার্তিকের মূর্তি ভাঙচুর ঠাকুরবাবা প্রহৃত
মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। ১৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার ৯১ ইং। “গোমতী সর্বজনীন কালি মন্দির কমিটি” কর্তৃক বিপুল উসাহ উদ্দীপনা ও ভক্তি সহকারে যে “সারদীয় দুর্গা পূজা” আয়োজন করা হয় তা ভন্ডুল হয়েছে।
দুর্গোসবের ৮/১০ দিন পূর্বে প্রতিমাগুলো রঙ করানোর উদ্দেশ্যে রৌদ্রে শুকোতে দিলে স্থানীয় অনুপ্রবেশকারীরা রাতের অন্ধকারে সেগুলো ভাঙচুর করে দেয়। এতে দুর্গাদেবীর প্রতিমাসহ গনেশ-কার্তিক প্রভৃতি মূর্তিগুলোর হাত-পা ভেঙ্গে যায়। উক্ত ঘটনার সুবিচার পাবার আশায় পূজা উদযাপনকারীরা স্থানীয় ক্যাম্পের অধিনায়কের শরণাপন্ন হলে তাদেরকে ৫০০/৬০০ টাকা দিয়ে ফের দেয়া হয়। সুবিচার না পেয়ে তারা বিফল মনোরথে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ক্ষোভে-দুঃখে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তারা আবারও মূর্তি নির্মাণ করে কোন মতে উসবের আয়োজন সম্পন্ন করেন।
কিন্তু অত্যাচার উপীড়নে তাদের সমস্ত আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যায়। পূজা মহোসব চলাকালে মোঃ দুলাল মিয়া নামের এক বেআইনী অনুপ্রবেশকারী পাণ্ডা সন্দেহজনকভাবে মন্দির এলাকায় সারাদিন ঘোরাফেরা করে। সন্ধ্যায় মদ্যাসক্ত অবস্থায় সে প্রাক্তন ওয়ার্ড মেম্বার বিপ্র কুমারের বাড়ীতে যায় এবং বাসরিক পূজার আহার আয়োজনকালে মহোসবের উপাসক ঠাকুরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে অবমাননাকর কথাবার্তা বলে মিথ্যা সংবাদ দেয়। মহোসবের উপাসক ঠাকুর শান্তিবাহিনীদের সাথে বসে খাওয়া-দাওয়া করছে বলেও ষড়যন্ত্রমূলক রিপোর্ট দেয়। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন সহসা বিপ্র কুমারের বাড়ীতে চড়াও হয়ে ঠাকুরবাবাকে নির্বিচারে মারধোর করতে থাকে। এলাকার জনৈক ব্যক্তি তাতে আপত্তি জানালে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন তাকেও নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করে।
উক্ত ঘটনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়াও এলাকাবাসীদের মনে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে যেভাবে ধর্মীয় উপীড়নের মাত্রা বেড়ে চলেছে তাতে পাহাড়িদের মন বিষিয়ে উঠছে। নিজেদের আচার-প্রথা ও রীতি অনুসারে কোন সামাজিক অনুষ্ঠান করতে গেলে যেভাবে প্রতিবন্ধকতা আসছে তাতে মাটিরাঙ্গা উপজেলার পাহাড়ি জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ। জানা গেছে, অনুপ্রবেশকারী দুলাল মিয়া নাকি স্থানীয় ক্যাম্পে মিথ্যা বানোয়াট রিপোর্ট দিয়ে এলাকাবাসীদের হয়রানী করছে। এ ব্যাপারে এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছে।  [সংবাদটি মাটিরাঙ্গা থেকে প্রেরিত]

বুড়িঘাট
গণভোটের তিন দিন পূর্বে ৬ বছরের নিরপরাধ শিশুর জীবন অকালে ঝরে গেল
কাঠালতলী। রাঙ্গামাটির নানিয়াচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের এক নিভৃত শান্ত পল্লী। গণভোটের আয়োজনে সারা দেশবাসী সে সময় ব্যস্ত। সংসদীয় ব্যবস্থার সমর্থনে রায় দিতে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল দিনটির। তার ৩ দিন পূর্বে ১৪ই অক্টোবর এই কাঠালতলীর নিভৃত পল্লীতে অত্যন্ত নির্মমভাবে ৬ বছরের নিরপরাধ শিশু খুন হয়েছে।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গণভোটের নিরাপত্তা বিধানের অজুহাতে বুড়িঘাট ক্যাম্প কমা-ারের নেতৃত্বে ৮ম ইঃ বেঙ্গলের একদল সেনা কাঠালতলীতে মোতায়েন করা হয়। ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টায় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে হতভাগিনী শিশু সেবিকা চাকমা তার মা’র সাথে বাড়ীর বাইরে আসলে ডিউটিরত সেনাদের নির্বিচার গুলি বর্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একটি নিষ্পাপ শিশুর জীবন এভাবে জিঘাংসার নেশামত্ত সেনাদের হাতে অকালে ঝড়ে গেল।
সেবিকা চাকমা নিহত হলে ঐ গোলাগুলির শব্দে ভীত সস্ত্রস্ত গ্রামবাসী আশ্রয় খোঁজার জন্য এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকলে, তাদেরও ডিউটিরত নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন ধরে ফেলে এবং নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করে ছেড়ে দেয়। নিহত শিশুর লাশও তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
ঘটনার পরের দিন নিহত শিশুর শোকাহত পিতা জয় কুমার চাকমা, নিকট আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসী মৃত সকারের উদ্দেশ্যে লাশ আনতে গেলে তাদেরকে কড়াভাবে শাসানো হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন তাদের সামনে লাশ দাহ করার জন্য চাপ দেয়। অন্য কোথাও নিয়ে গেলে সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং আর্মি ক্যাম্পের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ঢুকিয়ে রাখার হুমকি দেয়া হয়। এমনকি গ্রামশুদ্ধ মেরে ফেলারও ভয় দেখায়। ইতিপূর্বে নিরাপত্তা বাহিনীরা ঐ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে বলেও দম্ভোক্তি করে এবং বাড়াবাড়ি না করার জন্য গ্রামবাসীকে সাবধান করে দেয়।
পরে ইলেকশন ডিউটিরত প্রিসাইডিং অফিসার ও বুড়িঘাট ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে “সেবিকা চাকমা নিরাপত্তা বাহিনী ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়ের সময় নিহত হয়েছে”-এই মর্মে জোরপূর্বক লিখিত আদায় করে। এ ধরনের মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক ও বর্বরোচিত ঘটনায় কাঠালতলী গ্রামবাসী নিজেদের জীবন নিয়েও শংকিত হয়ে পড়েছে। আইন শৃঙ্খলাহীন এদেশে কিভাবে যে মানুষ থাকবে তাতে গ্রামবাসী উদ্বিগ্ন। [সংবাদটি নানিয়াচর থেকে প্রেরিত]

উল্টাছড়ি
একই সাথে মা ও মেয়ে ধর্ষিতা, নারী নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে
গোলক্যাপাড়া, মহালছড়ি উপজেলা। ২৪ অক্টোবর ৯১ইং। মহালছড়ি জোনের ২৪ ইঃ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ২৭ ইঃ বেঙ্গল রেজিমেন্ট যৌথভাবে এক অপারেশন চালাতে গেলে সমস্ত বর্বরতাকে ছাড়িয়ে একই সাথে মা ও মেয়ে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পাশবিক হামলার শিকার মিসেস্ রংপতি চাকমা (৩২) স্বামী বৈকুন্ত চাকমা ও তার কিশোরী মেয়ে মিস্ চঞ্চলা চাকমা (১৫) বর্তমানে মানসিক ও শারিরীকভাবে বিপর্যস্ত বলে জানা গেছে।
উক্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনার সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মান-ইজ্জত নিয়ে মানুষ যখন সমাজে চলতে-ফিরতে পারছে না স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে ক্ষোভ ও বিদ্রোহের আগুন ধুমায়িত হচ্ছে। রিপোর্টটি উল্টাছড়ি প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে “রাডার” -এ চিঠি লিখে পাঠানো।
ইতিপূর্বে ২৭/৭/৯১ইং মহালছড়ি বাজারে আসার পথে মিস্ স্বপ্না চাকমা (১৬), পিতাঃ সুভাষ চন্দ্র চাকমা, গ্রামঃ লেমুছড়ি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা-মহালছড়ি জোনের অধীন একজন ভি,ডি,পি জোয়ান কর্তৃক ধর্ষিতা হয়েছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, পাশবিক লালসার শিকার স্বপ্না চাকমা জেলা পরিষদ সদস্য রইথি মারমা ও বিভূতি রঞ্জনের কাছে বিচারপ্রার্থী হলে ঐ স্বার্থবাজ দালালরা কোন কিছুই করে দিতে পারেনি। পরে, সুবিচারের আশায় ুড়হব ঙভভরপব -এ শরণাপন্ন হলে তা কাকস্য পরিবেদনায় পর্যবসিত হয়। অদ্যাবধি ঐ ভি,ডি,পি -র বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। [মহালছড়ি থেকে রিপোর্টটি পাঠানো]

উল্টাছড়ি
বুদ্ধ মুর্তি ভাঙচুর বিহারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ
উল্টোছড়ি, মহালছড়ি উপজেলা। ২৪ শে অক্টোবর ৯১ ইং। নিরাপত্তা বাহিনীর ছত্রছায়ায় বেআইনী অনুপ্রবেশকারীরা এখানকার “জনবল সুদর্শন বৌদ্ধ বিহার”-এ উন্মত্তভাবে ঢুকে বুদ্ধ মুর্তি ভাঙচুর করে এবং মূল্যবান সামগ্রী তচনছ করে দেয়। বিহারের বড় বুদ্ধ মূর্তির গলা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সিমেন্টের প্লাষ্টার করা ও মূর্তির ভেতরের দিকটা কাপড় দিয়ে তৈরী বলে কোনমতে তা বসিয়ে রাখা হয়েছে। বুদ্ধ মূর্তির নাকের প্লাষ্টারও উঠে গিয়েছে। পিতলের মূর্তি (গুয়াই) ভারী জিনিসের আঘাতের ফলে নীচের দিকটা ভেঙ্গে যায় এবং মূর্তিতে ভাঙ্গার চির ধরেছে। বিহারে টাঙ্গানো সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তের) আয়না বাঁধানো ছবিও মাটিতে আছড়ে ফেলে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বিহারের দু’টি আলমিরার তালা ভেঙ্গে বহু মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নেয়া হয়েছে।

মাইসছড়ি
নির্বিচারে ধরপাকড় ও প্রহার
মাইসছড়ি, মহালছড়ি উপজেলা। ২৬ শে অক্টোবর ’৯১ইং। বাজারে যারার পথে ধারাস চাকমাকে (পিতাঃ বিরেন্দ্র চাকমা) পথিমধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন আটক করে এবং নিষ্ঠুরভাবে মারধোর করে। বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজারে নিয়ে যাওয়া ৫/৬ টি কলাছড়া ও মুরগী জোর করে কোন দাম ছাড়াই নিয়ে নেয়।
 লাংধা চাকমা (পিতাঃ আলিয়া চাকমা) নামে অপর একজন রাখাল পর্যন্ত ঐদিন রেহাই পায়নি। ঐ নিরাপরাধ রাখালকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে মারধোর করা হয়েছে।
অপর এক খবরে প্রকাশ ঐ দিন অপারেশন থেকে ফেরার পথে দাতকুপ্যা এলাকা থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন অনেক নিরপরাধ মানুষজনকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্বিচারে মারধোর করে ছেড়ে দেয়। এই নির্বিচার মারপিটের শিকার হয়েছেন-
১) তীর্থ মেম্বার (মাইসছড়ি) 
২) চির জ্যোতি চাকমা পিতাঃ সুরেন্দ্রদাল চাকমা।                                                                                ৩) লিটন চাকমা পিতাঃ প্রমোদ রঞ্জন চাকমা।
৪) সাপো চাকমা পিতাঃ কমোদ রঞ্জন চাকমা।
জানা গেছে শুধু পাইকারী মারধোর করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। বাড়ীতে ঢুকে গোলক্যাপাড়া এলাকার নিরীহ জনসাধারণের বাড়ীতে ঢুকে জিনিসপত্র পর্যন্ত তছনছ করে দিয়েছে। [সংবাদটি মহালছড়ি থেকে পাঠানো]

মহালছড়ি
হিন্দু ও বড়ুয়া পরিবার উচ্ছেদ অভিযান
পাহাড়তলী, মহালছড়ি উপজেলা। ১০ আগষ্ট ৯১ ইং। এই গ্রামে বসবাসরত হিন্দু ও বড়–য়া পরিবারদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে উপজেলা সদরের হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী এক নোংরা বিল্ডিং-এ গাদাগাদিভাবে জড়ো করা হয়েছে। বর্তমানে তারা নিজেদের জমিতে চাষ-বাস করতে ভীষণ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ইতিমধ্যে ঝঝঈ পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে কোন পাহাড়ি পরীক্ষার্থী হিন্দু-বড়–য়া ঘরে থাকতে পারবে না বলে জোন থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এলাকায় হিন্দু-বড়–য়া অধিবাসীদের ধারণা- পাহাড়িদের সাথে তাদের আন্তরিকতা যাতে গড়ে না উঠে এবং পরীক্ষার্থী রাখার মাধ্যমে তাদের যে কিছু আয় হয় তা থেকে বঞ্চিত করার জন্যই ঐ নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল।

ঘাগড়া
বেআইনী অনুপ্রবেশ অব্যাহত
ঘাগড়া, রাঙ্গামাটি। ২৪ অক্টোবর ৯১ ইং। ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩০ জনের অধিক একটি বেআইনী অনুপ্রবেশকারী দল আশ্রয় নেয়। স্কুলে অবস্থানকালে অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীদের কাছে সাহায্যের জন্য গেলে গোমর ফাঁস হয়ে পড়ে। উত্তরবঙ্গ থেকে ঐ অনুপ্রবেশকারীরা মারিশ্যায় সেটেল হবার জন্য যাচ্ছিল। এভাবে প্রতিনিয়ত লোকচক্ষুর আড়ালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেআইনী অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকায় এই বেআইনী অনুপ্রবেশ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রুমা, লামা, আলিকদম, থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়িতে প্রতিদিন অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ছে বলে জানা গেছে। খাগড়াছড়ি জেলার অবস্থাও করুণ। রামগড় হয়ে প্রতিদিন খাগড়াছড়িতে বেআইনী অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ছে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা- রামগড় উপজেলা ফেনীর সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় এই বেআইনী অনুপ্রবেশ ঘটানো সরকারের সুবিধে হয়েছে। বর্তমানে মানিকছড়ি, মাটিরাঙ্গা, তবলছড়ি, তাইন্দং, কাচালং -- প্রভৃতি এলাকায় বেআইনী অনুপ্রবেশকারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে- ইতিপূর্বে ফেনী হত্যাকাণ্ডের পর উক্ত এলাকাসমূহের পাহাড়িরা বাস্তুভিটা হারিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। ইত্যবসরে অনুপ্রবেশকারীরা তাদের জায়গা জমি দখল করে নিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ- রামগড় থেকে প্রতিদিন বিশেষ বিশেষ বাস-ট্রাক ভর্তি সমতলবাসী খাগড়াছড়িতে ঢুকে পড়ছে। খাগড়াছড়ি কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে সন্ধ্যার দিকে এক চক্কর দিলেই কাঁথা-কম্বল নিয়ে অসংখ্য অনুপ্রবেশকারী চোখে পড়ে। কলেজিয়েট স্কুলের মাঠ, ভাঙ্গা জায়গাগুলোই হচ্ছে তাদের বিশ্রামাগার।
সন্ধ্যা হতে না হতেই খাগড়াছড়ি প্রশাসনের প্রভাবশালী মহল ও বাজারের জনৈক তথাকথিত জনপ্রতিনিধি নাকি অভ্যর্থনা জানাতে কলেজিয়েট স্কুলে আসে। রাতের অন্ধকারে ঐ অনুপ্রবেশকারীদের দীঘিনালা, মেরুং ও পানছড়ি প্রভৃতি এলাকায় চালান দেয়া হয় বলে স্থানীয় জনসাধারণের ধারণা। এধরনের বেপরোয়া অনুপ্রবেশের কারণে স্থানীয় পাহাড়ি জনসাধারণ ও পুরাতন অধিবাসী বাঙালিরাও শংকিত বলে জানা গেছে। কারণ, বেআইনী অনুপ্রবেশকারীরা যে ধরনের সরকারী সুযোগ-সুবিধা ও আনুকূল্য পাচ্ছে সে অনুপাতে পুরাতন বসতিরা পাচ্ছে না। এবং পাহাড়িদের সাথে তাদের সম্ভাবের কারণে প্রশাসনের উর্ধ্বতন মহলে তাদের সন্দেহের চোখে দেখে বলেও জানা গেছে।

খাগড়াছড়ি
পুজগাঙ এলাকায় দু’জন পাহাড়ি যুবক নিখোঁজ
পানছড়িতে ৬ জন বাঙালি নিহত হলে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কালানাল ঘটনাস্থল হতে ব্রজমোহন কার্বারীর ছেলেকে অনুপ্রবেশকারীরা ধরে ইচ্ছেমতো মারধোর করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সে অনুপ্রবেশকারীদের ভয়ে গাছে উঠে লুকিয়ে থাকতে চেয়েছিল। পরে লাফ দিয়ে পালাতে গিয়ে নাকি ধরা পড়ে যায়।
অপর এক যুবককে মির্জাবিল এলাকা থেকে সেনাবাহিনীরা ধরে নিয়ে যায়। পানছড়ি স্কুলে নিয়ে তাকে নাকি ভীষণ মারধোর করা হয়। এলাকার লোকজন দু’জন যুবককে আধমরা অবস্থায় স্কুলে পড়ে থাকতে দেখেছে। পরবর্তীতে তাদের আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায় নি।

রাজস্থলী
প্রহরার জ্বালাতনে রাজস্থলী উপজেলাবাসীর নাভিশ্বাস
রাজস্থলী উপজেলার নিরীহ খেটে-খাওয়া মানুষকে প্রবল শীতের রাতে পাহারা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনীর পর আবার রাত জেগে পাহারাদাসে বাধ্য করায় এলাকাবাসীদের দুর্ভোগের সীমা নেই।
বিগত কয়েক মাস ধরে রাজস্থলী জোন কর্তৃক এই প্রহরা দানের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পাহাড়িদের রাতের বেলায় গাছের লাঠি ছাড়া কিছুই রাখতে দেয়া হয় না। কিন্তু তাতেও পাহারাদারদের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনী সন্দেহমুক্ত নয়। এক রাতে সেনাবাহিনীরা পাহারাদারদের অস্ত্র আছে কিনা তল্লাসী করতে গিয়ে অশোভন উপায়ে লুঙ্গী পর্যন্ত খুলে দেখে। সহজ-সরল গ্রামবাসী এতে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়েছে।

বুড়িঘাটের সাম্প্রতিক ঘটনা
১৫ নভেম্বর ৯১ইং। শুক্রবার। রাঙ্গামাটিতে কঠিন চীবর দান উসব। অমানুষিকভাবে প্রহৃত ঃ 
(১) শান্তানু চাকমা (৩৫), গ্রামঃ বড় কলগ, ডাকঃ বুড়িঘাট, উপজেলাঃ নানিয়াচর। ৮ম বেঙ্গল কর্র্তৃক ধৃত ও নির্মমভাবে প্রহৃত।
(২) রমণী রঞ্জন চাকমা (৩২), গ্রামঃ হাতিমারা, ৪ নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন, নানিয়াচর উপজেলা। প্রহৃত এবং আটকাধীন।                          

ধর্ষণের প্রচেষ্টা ও শ্লীলতাহানিঃ ১৫ নভেম্বর ৯১ ইং।    
(১) রূপায়নের মা (৩১), রবিভূষণ চাকমা। গ্রামঃ বড় কলগ। সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়, পরে কোন মতে টানাহেঁচড়া করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। (২) বসেন্তরী চাকমা (১৪), গ্রামঃ হাতিমারা। শ্লীলতাহানি করা হয়েছে।

দিঘীনালার ঘটনাবলী
নিষ্ঠুরভাবে মারধোর :
(১) ২৫/১১/৯১ ইং। জ্ঞান জ্যোতি চাকমা। রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের ছাত্র। বাড়ী- বড়াদাম। সে উদোলবাগানে চিকিসা করতে গেলে তাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ না করেই বিনাদোষে মারধোর করা হয়েছে। সে ভীষণ জখম হয়েছে বলে জানা গেছে। সেনাদের প্রতিহিংসার আক্রোশে একজন নিরীহ ছাত্র পর্যন্ত রেহাই পেল না।   
(২) ২৪/১১/৯১ ইং। ধানক্ষেতে কাজ করার সময় বাবুছড়া হাইস্কুলের একজন ছাত্রসহ মোট ৭ জনকে বাবুছড়া ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অমানুষিকভাবে শারিরীক নির্যাতন করা হয়। ইতিপূর্বে ধারাস চন্দ্র চাকমাকেও সাংঘাতিকভাবে মারধোর করা হয়েছে।
(৩) বর্তমানে দিঘীনালায় আবল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার জন্য আইডি কার্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটা নাগরিক অধিকার লংঘন।

গুইমারায় নিরীহ গ্রামবাসী গুলিবিদ্ধ
পাইন্দং পাড়া, গুইমারা। রামগড় উপজেলা। ১ অক্টোবর ৯১ ইং। ৩৪ ইঃ বেঙ্গলের সেনারা গুইমারা এলাকায় ব্যাপক অপারেশন চালিয়ে ফেরার পথে নিরীহ গ্রামবাসী রাম কমল চাকমাকে (পিতা নোয়ারাম চাকমা) সেনাবাহিনীরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করেছে।

নিরপরাধ মানুষ গুলিবিদ্ধ
১২ আগষ্ট ৯১ ইং। শান্তিবাহিনীর গোয়েন্দা সন্দেহে মিঃ গোলাধন চাকমা (৫০) কে (পিতাঃ বৃজ কুমার চাকমা) গুইমারা ক্যাম্পে (৩৪ ইঃ বেঙ্গল) জনৈক ক্যাপ্টেন গুলি করে খুন করেছে।

মহালছড়ি
রাডার কেনায় প্রহৃত
মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। ১৫ অক্টোবর ৯১ইং অনিয়মিত সাময়িকী রাডার কিনে পড়ার দায়ে এখানে অনেকে নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। এমনকি শারীরিকভাবে পর্যন্ত নির্যাতিত হয়েছেন। এখানকার জোনের ২৪ ইঃ বেঙ্গল এর মেজর কর্তৃক ৩ জন স্থানীয় পাহাড়ি অমানুষিকভাবে প্রহৃত হয়েছেন। নিগৃহীতারা হচ্ছেন-
১) মং চাই মারমা (সিনিয়র নার্স, মহালছড়ি হাসপাতাল)।
২) প্রতুল বিকাশ খীসা (হোমিও ডাক্তার) পিতাঃ সুধাংশু বিকাশ খীসা, হেডম্যান - কেরেঙ্গানাল।
৩) প্রেমলাল চাকমা (সিনিয়র নার্স, মহালছড়ি হাসপাতাল)। যে পত্রিকার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে, তা কিনে পড়তেও যে ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন তা পূর্বের স্বৈরাচারী শাসনকেই মনে করিয়ে দেয়। নাগরিক অধিকারের ছিটেফোটাও যে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়নি উক্ত ঘটনা তারই প্রমাণ। শুধু পত্রিকা ম্যাগাজিন কিনতে বিধি নিষেধই নয়, মহালছড়ি বাজারে প্রবেশ করতেও বিধি নিষেধ রয়েছে। জোন কর্তৃক ইস্যুকৃত কার্ড ছাড়া কেউই বাজারে প্রবেশ করতে পারে না। জোন এর অনুমতি ছাড়া নিজের ধান-চাল পর্যন্ত কোথাও আনা-নেয়া করা যায় না।
[গ্রন্থনা মিঃ অপ্রিয়]                                                                                                                       
পৃষ্ঠা: ৯ - ১০

বিশেষ রচনা
বিজয় দিবস ও আজকের বাংলাদেশ
-মিঃ সুপ্রিয়

এবার আমরা বিশতম বিজয় বার্ষিকী পালন করছি। একুশে পা দেবে বাড়ন্ত যৌবনা এই বঙ্গ ললনা। পেছনে ফেলে এলো সে ধূসর অতীত। সমুখে নিরাশায় কুঁকড়ে যাওয়া অনুজ্জ্¦ল ভবিষ্যত। বর্তমানে চলছে এই প্রিয় মাতৃভূমির বুক জুড়ে তীব্র ক্ষুধা, দুর্যোগ, রাজনীতির বেসাতি আর অবিরাম সন্ত্রাসের রক্তাক্ত নৈরাজ্য। অবাধ ন্যাকামী নৃত্যের আস্ফালনে স্বাধীনতা বিরোধী কালো শকুনেরা অবজ্ঞা করছে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দ্রুত বিকাশে বিষিয়ে যাচ্ছে সামাজিক পরিবেশ। রাষ্ট্রীয় মঞ্চে অভিনয় করছে তারাই যারা একাত্তোরে বিজয় চায়নি। যারা হাত রাঙিয়েছে আমার মুক্তিযোদ্ধা পিতা কিংবা ভাইয়ের রক্তে। অসুরে চাহিদা মিটিয়ে নিয়েছে আমার স্নেহময়ী মা-বোনের ইজ্জত হরণ করে। সাধের সংসদীয় গণতন্ত্রের মহেন্দ্রকালে তারাই ভীড় জমিয়েছে খোলস পরে। তর তর করে উঠে গ্যাছে গণতন্ত্রকামী শত মানুষের লাশের সিঁড়ি ভেঙে ক্ষমতার লোভনীয় মোহনায়। পল্লী বাংলা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ে উদঙ্গ বাজিয়ে নাচানাচি শুরু করেছে তারা। বস্ত্র হরণ পর্ব শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন স্রেফ লুটেপুটে নেয়ার আনন্দ আয়োজন। লক্ষ মুক্তিকামী জনতার রক্ত ভেজা পথ বেয়ে যে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে এই সুজলা, সুফলা নারীর পৃথিবী কাঁপানো জন্ম, তার হৃপিণ্ডেই চলছে নখর অস্ত্রোপচার। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারীর মত আজন্ম পাপে ভারী হয়ে আসছে মাটি। রূপসী বাংলার চোখে বিস্ময়, হৃদয় তার অসহনীয় বেদনায় বিক্ষত। ক্লান্তিকর এ পদযাত্রা।

একাত্তোরের মুক্তি পাগল যুদ্ধাহত যুবক এখন আধপ্রৌঢ়। বার্ধ্যক্যজনিত রোগে আমার যুদ্ধাহত পিতা আজ নিশ্চল। কিন্তু যে নরশিশুর জন্ম সেদিনের রণক্ষেত্রে সে তো আজ তগবগে যুবা। হতে পারে তার অপ্রতিরোধ্য শক্তি। সুন্দর স্বপ্ন দেখে সুখী হতে পারত সে। তারও নেই ভবিষ্য, নেই বর্তমানও। তাই আজকের প্রজন্মের প্রশ্ন পূর্বসুরী মুক্তিযোদ্ধার কাছে, তোমরা কিসের যুদ্ধ করেছিলে একাত্তোরে ? মুক্তির ? নাকি শুধু বিজয়ের ? আমরা তো জানি লক্ষ শহীদের রক্তিম আত্মাহুতির গৌরব গাঁথা। হাজার মায়ের কোল খালি হবার নির্মম সাহিত্য। শত শত রমণীর ইজ্জত খুইয়ে যাবার বিভস ইতিহাস। এ সবিই তো মুক্তির জন্য। পাকিস্তানী বেনিয়াদের শাসনের কালো হাত গুড়িয়ে দেবার মুক্তি, বিজাতীয় শোষণের ঘৃণ্য কাঠামোকে বিকল করে দেবার মুক্তি। সর্বোপরি বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ। আদতে আমরা কী পেয়েছি ? দিনের আলোর মতই পরিস্কার একাত্তোরের যুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম, মুক্তি নয়। শাসকের গোষ্ঠী বদলিয়েছে। শ্রেণী রয়ে গেছে এক ও অভিন্ন। শোষণের হাত বদলেছে। শোষণের চরিত্র রয়েছে পূর্বেকার মত। এখানেই খুঁজে নিতে পারি বিজয় আর মুক্তির পার্থক্য। হাতড়ালেই পথ খুঁজে পাবো গন্তব্যের।

সুতরাং এক শাসকের শেকড় উপড়িলেও আরও এক জঘন্য স্বজাতীয় শাসক জেঁকে বসেছে এ দেশ জুড়ে। সাড়ে দশ কোটির এ জনারণ্যে সাড়ে দশ সহস্র ধনী পরিবারের আংশিক মুক্তি হয়েছে হয়তো। বাকী বিশাল জনমানুষ নিষ্পেষণের ঝাঁতাকলে মানবেতর শিকার। এ নিষ্পেষণের মাত্রা ও আকৃতি আরও তীব্র। ভয়ংকর। এ শাসক শ্রেণীর নিষ্পেষকদের একবিন্দু রক্তেরও লেখা নেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সোনালী ইতিহাসের পাতায়। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাত, শোষণ, দুর্নীতি নোংড়া গালিচা পেরিয়ে তারা আজ বিলাসী জীবন নিয়ে তামাশা করছে। অথচ যারা অকাতরে রক্ত ঢেলেছে বাংলা মায়ের পবিত্র জমিনে তাদের উত্তরসূরীরা আজ নিঃস্ব। যে যোদ্ধা আমরণ পঙ্গুত্বের দুঃসহ স্থবিরতাকে আলিঙ্গন করেছে, যে মা/বোন তার সব খুইয়ে কলংক ধারণ করেছে তিল তিল যন্ত্রণায় তারা কী পেয়েছে ? এদেশের গরীব ক্রমাগত গরীব, ধনীরা আরও ধনী হয়। শোষিতের দ্রুত পতন, শোষকের অনায়াস উত্তরণ ক্রমশ বিস্তৃতি বাড়ায় পরস্পরের। উভয়ের এ বিপরীতমূখী অগ্রযাত্রাকে থামাবে কে ! দুর্ভিক্ষের নিয়ত পদধ্বনি শুনা যায় সর্বত্র জনপদে। বিবিধ মাত্রায় দুর্যোগের ঘনঘটা সর্বদা হামলে ধরতে চায় কংকালসার দেশবাসীকে। দুর্ভিক্ষের অভিশাপ ও মৃত্যুর হীম শীতল স্পর্শ বাংলাদেশের মানুষের পায়ে পায়ে ঘোরে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অনিবার্য উপজাত কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের ভয়াল আক্রমনে কিছু দিন আগেও উত্তরাঞ্চল হাহাকারের প্রেতপুরীতে পরিণত হয়েছে। বিবদমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে ক্ষুধার সঙ্গে বাঙালির চিরকালীন সহাবস্থান। দারিদ্র্য-পীড়িত বৃহত্তর জনমানুষকে অনাহারের দুঃস্বপ্ন তাড়িত করেছে বার বার। বৈষম্যের বিষাক্ত গর্ভজাত এই দুর্ভিক্ষই বিস্মৃতি পরায়ণ জাতির নির্মম ইতিহাসের উপজীব্য।

এভাবেই বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো পেয়ে যায় পুজি। অবলীলায়। বেশরম দুভিক্ষের গণমৃত্যুকে নিয়ে তারা চেচামেচি করে বেধরক। বস্তা বস্তা করুণা নিয়ে সাহায্যের নাম করে দুর্গত এলাকায় নেতা নেত্রীরা তাদের লোক দেখানো সফর করেন। অভাবী মানুষের অভাব মোচন, ক্ষুধাকাতর মানুষের ক্ষুধা নিবারণ কিংবা অর্ধনগ্না কিশোরীর লজ্জা ঢাকা, কোনটাই তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের আপাতঃ উদ্দেশ্য রাজনৈতিক সেন্টিমেন্ট। চুড়ান্ত লক্ষ্য ক্ষমতা নামক পাগল ঘোড়ায় আরোহন আর শাসন শোষণের আকাক্সক্ষা পূরণ। গণতন্ত্রের মুখোশ পরে তারা সহজেই জনগণকে বিভ্রান্ত করে। ক্ষমতার সোনালী মসনদে যেতে কিংবা তা পোক্ত করতে তারা অনেক সময় নারকীয় হত্যালীলার উসব পালন করে। কমরেড সিরাজ শিকদার, তার অনেক কর্মী, জাসদের অসংখ্য ত্যাগী যোদ্ধাকে নির্লিপ্ত হত্যার মত নিষ্ঠুর অপকর্মের মাধ্যমেও তারা ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের জগাখিচুরী উপহার দিতে চেয়েছে। তাজউদ্দীন সহ চার জাতীয় নেতার রক্তে তারা গদি ধৌত করে, তারা কর্নেল তাহেরদের ফাঁসি দিয়ে সামাজিক ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং বসুনিয়া, নুর হোসেন, ডাঃ মিলন সহ শত নাম না জানা গণতন্ত্রী, স্বৈরাচারী শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তিকামী মানুষের রক্তে পিচ্ছিল পথ নির্লজ্জ পাড়ি দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ে। একটি শব্দ বেরিয়ে যায়। কি বিচিত্র সেলুকাস। তবুও কেন অহেতুক দৌড়াতে থাকে শোষিত জনতা তাদের পিছু পিছু ? রক্তের অক্ষরে গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরী করে সংগ্রামী জনগণ যখনই মুখোশধারী স্বৈরাচারীদের ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে যায় তখনই তো এক করে খসে যায় ওদের খোলস। ন্যাংটো হয় তাদের বিকৃত চেহারা। তবুও মানুষ বুক ভরা আশা নিয়ে চেয়ে থাকে অপেক্ষায় গর্দভের আদলে। বুঝতে পারি না কেন এ রাষ্ট্রযন্ত্র কিছুই দিতে পারে না শোষিত মানুষের কাছে। সংকটে সংকটে এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা জর্জড়িত। তবুও কেন খামাকা রক্ত দেবো নরসুন্দরীদের বেশরম আহ্বানে।

তৃতীয় দুনিয়ার কোটি জননীর জরায়ু চিরে যে মানবশিশুই জন্ম নিক না কেন তাদের অস্তিত্বই মৃত্যু, ক্ষুধা, শোষণ, ধর্ষণ, উচ্ছেদ, অত্যাচার আর অনিশ্চিতের অতল গহ্বরে অসহায়। সাম্রাজ্যবাদীর একচ্ছত্র একাধিপত্যে আজ পৃথিবীব্যাপী নৈরাজ্যের বিকৃত থাবার আক্রমণ জন জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলছে। আমাদের মত চামচিকে ক্ষীণ রাষ্ট্র যন্ত্রকে কব্জা করে সে সর্বস্ব শুষে নেয় তার অপ্রতিরোধ্য পুজির ধারালো সুচে। এই রক্তশোষা প্রভুরা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বীজ বুনে দেয় আমাদের সমাজ দেহের পরতে পরতে। সদম্ভ খবরদারীতে। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না অনন্তকাল। বিজয়ের যুদ্ধ নয় চুড়ান্ত মুক্তি যুদ্ধের দামামার পদধ্বনী শুনাতে হবে নব প্রজন্মের চেতনার কানে কানে। লক্ষ কোটি অভুক্ত শোষিত শ্রেণীর দুর্দমনীয় দ্রোহের ঘুমন্ত আগ্নেয়াগিরিতে জ্বালাতে হবে বিপ্লবের শিখা। এভাবেই প্রকৃত বিজয়। চুড়ান্ত মুক্তি।

----------------------------------------


আগাম সংবাদ
১) আগামী ফেব্রুয়ারী নাগাদ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কমিশন একটি সর্বশেষ ঘটনার রিপোর্ট প্রকাশ করবে। এরই ভিত্তিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশন সমূহে এক সমন্বয় প্রক্রিয়া চলবে যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের জন্য সরকারকে বিশেষভাবে অবগত করানো হবে। এছাড়াও আগামী এপ্রিলে প্যারিসে সাহায্যতদাতা দেশসমূহ প্যারিস কনর্সোটিয়াম বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন অবসানের লক্ষ্যে সরকারকে চুড়ান্তভাবে শর্তারোপ করবে।

২) পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন পর আবার চেষ্টা চলছে। এ জন্য যে যোগাযোগ কমিটি গঠন হবার কথা তা চুড়ান্ত হয়েছে। এই যোগাযোগ কমিটির মাধ্যমেই আলোচনার সময়, তারিখ, বিষয়বস্তু, স্থান সহ বিভিন্ন পদ্ধতিগত বিষয়সমূহ স্থির করা হবে। আশা করা যাচ্ছে আগামী জানুয়ারী শেষ অথবা ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিকে বৈঠক শুরু হতে পারে।

৩) এ মাসের শেষান্তে লণ্ডন থেকে বাংলাদেশের আদিবাসীদের উপর একটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। The Adibashis in Bangladesh নামের এ বইটি প্রকাশ করছে Minority Rights Group. ঐ বইয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের উপর সরকারী নির্যাতনের একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন থাকছে।

৪) আগামী ৪র্থ পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের দুটি সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারী সহযোগীতা অব্যাহত থাকলে এ সম্মেলন ঢাকাতে অনুষ্ঠিত হবে। অন্যথায় এ সম্মেলন ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত হবে।

ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সম্পর্কে সেমিনার অনুষ্ঠানের জন্য উদ্যোগ চলছে। অনেক বেসরকারী সংস্থা এ সংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে যেমন গণতান্ত্রিক চর্চা কেন্দ্র (Democratic Practice Centre), বাংলাদেশ গণ ঐক্য সংস্থা, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি।
------------------------------------------

 পৃষ্ঠা: ১১ - ১৩

প্রচ্ছদ নিবন্ধ
তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি : পার্বত্য জনগণের দুর্ভোগ
- মিঃ মানবমিত্র ।

১.প্রাক-কথনঃ  রক্তাক্ত সংঘাতময় এক জনপদের নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। একদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য সশস্ত্র গণসংগ্রাম এবং অন্যদিকে সেই সংগ্রামকে দমন করার জন্য সামরিক প্রচেষ্টা- পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিণত করেছে এক অগ্নিগর্ভ রণক্ষেত্রে। এখানে উগ্র বারুদ অত্যাচারে জনজীবন হয়েছে দুর্বিসহ। তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির যাঁতাকলে পিষ্ঠ পাহাড়ি বাঙালী নির্বিশেষ। দীর্ঘ অত্যাচার, নির্যাতন আর যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত পার্বত্য জনতার আজ বেদনার্ত উচ্চারণ - “জীবন আমাদের নয়”। সত্যিই সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ এক “অপারেশন থিয়েটার”। কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি নামক বেয়নেট দিয়ে জনজীবনের ওপর চালানো হচ্ছে আনকোরা ডাক্তারের অপারেশন সার্জারী। পার্বত্য জীবন আজ কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির হাতে জিম্মি।

২.কেন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি?: কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির আক্ষরিক অর্থই হলো সামরিকভাবে বিদ্রোহ দমন। পার্বত্য চট্টগ্রামে একজন সামরিক অফিসারের ভাষায়, “Our aim is to gradually finish the insurgency" কিন্তু কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির আপাতঃ উদ্দেশ্য বিদ্রোহ দমন হলেও এর চুড়ান্ত লক্ষ্য পাহাড়ি জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেয়া। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা তথা অস্তিত্ব সংরক্ষণের সমস্যা। অন্য কোন কারণে নয়, একমাত্র জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এই বিদ্রোহের সূত্রপাত। কাজেই পাহাড়ি জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের গ্যারান্টি না দিয়ে সামরিক উপায়ে অর্থা কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির মাধ্যমে উদ্ভুত বিদ্রোহ দমন করার অর্থই হলো জাতীয় অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেয়া।

৩.কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির জন্য নিয়োজিত বাহিনীঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে বিশাল সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। Chittagong Hill Tracts Campaign and Information Network এর একটি প্রচারপত্র অনুযায়ী দেশের নিয়মিত বাহিনীর এক তৃতীয়াংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত। অপরদিকে CHT কমিশনের রিপোর্ট মতে যদি প্রতি দশজন পাহাড়ির জন্য একজন সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকে তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাসংখ্যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০,০০০। কিন্তু কেন এই বিশাল সামরিক বাহিনী বা এই সামরিক বাহিনীর কাজ কি ? CHT কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী " The justification for the massive military buildup in the CHT is that it needed to counter and contain insurgency activities of the Shanti Bahini (SB). Counter-insurgency is their main task." বর্তমানে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম এরিয়া কমাণ্ডারের নেতৃত্বে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি চালাচ্ছে নিয়মিত সেনাবাহিনী, BDR, পুলিশ, আনসার, VDP, এবং একটি   Naval Base.

৪.কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির ট্রেনিং : কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির ট্রেনিং দেয়ার জন্য ঢাকায় Defence Staff College নামে একটি সামরিক কলেজ রয়েছে। সেখানে বৃটেনের সামরিক বাহিনীর অভিজ্ঞ অফিসারগণ প্রশিক্ষণ দেন। তাছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারগণ বিদেশ থেকেও কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির ট্রেনিং নিয়ে থাকেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের US Army Intelligence Centre  Military Staff College Fort Lavenworth, যুক্তরাজ্যের  Aldershot and Camberley, পাকিস্তানের  National Defence College এবং মালয়েশিয়ার Staff College ইত্যাদি।
৫.পার্বত্য চট্টগ্রাম - কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির মডেলঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিদেশীদের  কাছে বর্তমানে নিজেই একটি কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির মডেল হিসেবে বিবেচিত। বস্তুতঃ কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির বাস্তব শিক্ষাক্ষেত্র হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন, USA, কেনিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসমূহের সামরিক অফিসারগণ Counter Insurgency -র পার্বত্য চট্টগ্রাম মডেলকে বাস্তবে অধ্যয়ন করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে থাকেন।

৬.কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির কলাকৌশলঃ কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির কলাকৌশলকে চার ভাগে করা যেতে পারে। যেমন- সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কৌশল। এই কৌশলসমূহ আবার পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ও একে অপরের ওপর প্রভাবিত। সব ধরনের কৌশলই সামরিক বাহিনী কর্তৃক প্রয়োগ করা হয়। এই সব কৌশলসমূহ আলোচনার মধ্য দিয়েই প্রতিভাত হবে পার্বত্য জনগণের ভোগান্তির চিত্র। নিম্নে এই কলাকৌশলসমূহ আলোচনা করা হলোঃ-
ক) সামরিক কৌশলঃ কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির Vital technique হচ্ছে সামরিক। এর একমাত্র উদ্দেশ্য জনগণের মধ্যে অব্যাহত সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করা। এই কৌশল প্রয়োগের প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে (১) সামরিক অভিযান (২) গণহত্যা ও (৩) “আঙ্গুল” বাহিনী ব্যবহার।
(i) সামরিক অভিযানঃ শান্তিবাহিনী অনুসন্ধান করার নামে পাহাড়ি জনগণের গ্রাম ঘেরাও করা, তাদের ঘর বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়া, ধন সম্পত্তি লুট করা, গ্রেফতার, নারী ধর্ষণ, হত্যা ও অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালানো ইত্যাদি সামরিক অভিযানের অংশ।
(ii) গণহত্যাঃ সন্ত্রাস সৃষ্টির আর এক পদ্ধতি হচ্ছে পাহাড়ি জনগণের ওপর গণহত্যা চালানো। এ ক্ষেত্রে বসতিস্থাপনকারী বাঙালিদেরকেও ব্যবহার করা হয়। ১৯৮০ সালের কাউখালী গণহত্যা থেকে আরম্ভ করে ১৯৮৯ এর লংগদু গণহত্যা পর্যন্ত কমপক্ষে ৭/৮ টি গণহত্যায় শত শত পাহাড়ি প্রাণ হারায়। সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। ফলে হাজার হাজার পাহাড়ি প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
(iii) “আঙ্গুল” বাহিনী ব্যবহারঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তথাকথিত গণপ্রতিরোধ কমিটি (ঘুঘ্রুক), টইগার বাহিনী, লায়ন বাহিনী ইত্যাদি মাস্তান বাহিনীকে “আঙ্গুল বাহিনী” আখ্যা দিয়েছে। এরা পাহাড়ি জনগণের মধ্য থেকে সংগৃহীত এবং সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত ও ভাতাপ্রাপ্ত। এদের সন্ত্রাসী উপাতে পার্বত্য জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। তাদের কাজ হলো মূলতঃ শান্তিবাহিনীর অবস্থান ও বিভিন্ন ব্যক্তি সম্পর্কে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট দেওয়া।
মূলতঃ সামরিক সন্ত্রাসের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রতি মুহুর্তে রয়েছে জীবনের ওপর গ্রেফতার, দৈহিক নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুর শীতল পরশ নেমে আসার ভয়। নিঃশ্বাস ফেলতেও এখানে কষ্ট হয়।

খ) রাজনৈতিক কৌশলঃ রাজনৈতিকভাবে জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্য সামরিক সন্ত্রাসের পাশাপাশি রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ- কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। রাজনৈতিক কৌশল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম। যেমন বর্তমানে অকেজো হলেও তকালীন জিয়া সরকার জেএসএসকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য ট্রাইবেল কনভেনশন গঠন করেছিলেন। বর্তমান রাজনৈতিক কৌশলসমূহ নিম্নরূপঃ-
(i) বাঙালি বসতিস্থাপন ও তাদের গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহারঃ রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে এ পদ্ধতিকেই সবচেয়ে জঘন্য বলা যেতে পারে। প্রধানতঃ জিয়ার আমল থেকে হাজার হাজার নিরীহ গরীব বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুনর্বাসিত করা হয়। CHT Commission লিখেছে, " The settlement of Bengalis is also an aspect of Counter-insurgency through population control, as explained to the Commision by an army officer," বর্তমানে পাহাড়ি ও বাঙালির অনুপাত পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬০ঃ৪০। এই বাঙালিদের দিয়ে Population control করে insurgency দমন করা হলেও তারা নিজেরাই কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নির্মম শিকার। তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। CHT কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙালিরা তাদের নিজস্ব সমতল ভূমিতে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু সরকার তাদেরকে জোরপূর্বক আটকে রাখছে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদেরও কোন স্বাধীনতা নেই। সামরিক ক্যাম্পের চারপাশে গুচ্ছগ্রাম নামক বন্দী শিবিরে আটক রেখে তাদেরকে মানবদুর্গ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে - যাতে শান্তিবাহিনীরা সেনাক্যাম্প আক্রমন করতে না পারে বা আক্রমণ করলেও সেনাবাহিনীর কোন ক্ষতি না হয়ে বরং civilian দের ক্ষতি হয়।
(ii) Devide and Rule পলিসি ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারঃ সরকার পাহাড়ি জনগণের ঐতিহ্যগত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়ার জঘন্য অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে সে “ভাগ কর ও শাসন কর” ফর্মূলাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রয়োগ করার জন্য ইতিমধ্যে তথাকথিত চাকমা উন্নয়ন সংসদ, মারমা উন্নয়ন সংসদ, ত্রিপুরা উন্নয়ন সংসদ ইত্যাদি প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনের জন্ম দিয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনী ইদানিং ধর্মকেও ব্যবহার করছে তাদের রাজনৈতিক হীন স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তারা এক্ষেত্রে বনভান্তে -কেও ব্যবহার করছে।
(iii) জেলা পরিষদঃ J. S. S. এর ওপর রাজনৈতিকভাবে সুপিরিয়রিটি অর্জন করার মানসে এরশাদ সরকার জেলা পরিষদ গঠন করে এবং তা রাজনৈতিক সমাধান হিসাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। CHT কমিশনের মতে, " it (commission) assesses the implementation of the District Councils also in terms of Counter-insurgency strategy."
(iv) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাঃ বিদ্রোহীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির একটি পুরোনো কৌশল। এযাবত বেশ কয়েকবার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। এর উদ্দেশ্য বিদ্রোহীদেরকে কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিস্ক্রিয় করা ও তাদের সামরিক শক্তিকে খর্ব করা।

গ) অর্থনৈতিক কৌশলঃ কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির ষ্ট্র্যাটেজি হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো প্রয়োগ করা হচ্ছেঃ
(a) পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং যৌথ খামার, আদর্শগ্রাম, গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তরঃ অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা দান ও শান্তিবাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচানোর নামে সেনাবাহিনী পাহাড়িদেরকে তাদের স্ব স্ব বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে যৌথখামার, আদর্শগ্রাম, গুচ্ছগ্রাম ও শান্তিগ্রাম নামক বন্দী শিবিরে স্থানান্তর করা হলেও এর উদ্দেশ্য হলো শান্তিবাহিনীকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। CHT কমিশনের রিপোর্ট " Life is not Ours " এ উল্লেখিত একজন সামরিক অফিসারের বক্তব্য হচ্ছে- " the main aim (of the Counrer-insurgency) is to cut the line of supplies to the Shanti Bahini." এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হওয়াতো দূরের কথা; বরং অনেকেই এই বন্দীশালা থেকে পালিয়ে এসে সর্বস্বান্ত হয়ে ভিক্ষাবৃত্তির মত ঘৃণ্য পেশা অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। Concentration Camp আখ্যা দেয়া এই গুচ্ছগ্রাম, যৌথখামারে কোন স্বাধীনতা নেই। জনগণকে সেখানে বন্দীর মত জীবন যাপন করতে হয়। অনেক গুচ্ছগ্রামে তাদেরকে সন্ধ্যার সময় দা, কুড়াল ইত্যাদি কাজ করার হাতিয়ার সেনা ক্যাম্পে জমা দিতে হয় এবং সকালে কাজে যাওয়ার জন্য আবার সংগ্রহ করতে হয়।
(b) কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে দুই ভাবে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হচ্ছেঃ-
(i) নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় বিক্রয়ে অবরোধঃ সেনাবাহিনী কর্তৃক সংজ্ঞায়িত তথাকথিত “লাল অঞ্চলের” প্রত্যেক পাহাড়িকে একটি পরিচয়পত্র ও একটি মার্কেট পাস বাধ্যতামূলকভাবে বহন করতে হয়। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী চাল, কেরোসিন, তেল, লবণ, ঔষধপত্র প্রভৃতি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ করে। গত ২৭/১০/৯১ ইং মহালছড়ি জোনের জোনাল কমাণ্ডারের নির্দেশ, “পাহাড়িরা পরিবার প্রতি মাত্র ২ কেজি চাল কিনতে পারবে।” উপাদিত দ্রব্যের বিক্রয়ের ওপরও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। CHT কমিশনের রিপোর্ট -এ বলা হয়েছে, One hill youth in Dighinala Upazilla told the Commisson that his family wanted to sell rice so he could pay the fees for his studies. When the permission came they were allowed to sell only one maund (about 40kg) which were not enough to pay for his studies." এই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রয় বিক্রয়ের অবরোধ সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হলো শান্তিবাহিনীরা যাতে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাজার থেকে সংগ্রহ করতে না পারে। এ ব্যাপারে CHT কমিশনেরও একই মত, " The reason behind these measures is the army's fear that people will give food and other necessaries to the SB (Shanti Bahini)."
(ii) গাছের পারমিটের ওপর নিয়ন্ত্রণঃ শান্তিবাহিনীরা টাকা সংগ্রহ করে - এই অজুহাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন গাছ ও বাঁশ কাটা ও ক্রয় বিক্রয় বন্ধ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। ফলে যাদের জীবিকা গাছ বাঁশের ওপর নির্ভরশীল তাদের অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় গত ৫/৬ মাস যাব দুর্ভিক্ষ চলছে। এতে প্রায় ২০/২৫ জন লোক মারা গেছে।

ঘ) সামাজিক কৌশলঃ সামাজিক কৌশলকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ
(i) চলাচল ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানাদির নিয়ন্ত্রণঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যেককে পরিচয় পত্র বাধ্যতামূলকভাবে বহন করতে হয়। প্রতি মাইল অন্তত সামরিক চেকপোষ্টে ব্যাগ-বডি চেক করা হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতেও সামরিক বাহিনীর পূর্বানুমতি বাধ্যতামূলক। এমন কি কোন গ্রামের কারো বাড়িতে মেহমান আসলেও তা পার্শ্ববর্তী সামরিক ক্যাম্পে জানিয়ে অনুমতি নিতে হয়।
(ii) ফ্রেইণ্ডশীপ প্রোগ্রাম বা মৈত্রী প্রকল্পঃ সামরিক বাহিনীর ওপর পাহাড়ি জনগণের আস্থা অর্জন অর্থা পাহাড়ি জনগণের হৃদয় মন জয় করার জন্য সেনাবাহিনী কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির কৌশল হিসাবে “ফ্রেইণ্ডশীপ প্রোগ্রাম” বা মৈত্রী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের অধীন কাজগুলো হচ্ছে ক্ষুদ্রায়তন আয় সংস্থান প্রকল্প সৃষ্টি, মন্দির, স্কুল সংস্কার ও নির্মাণ, খাদ্যদ্রব্য বিতরণ, চাকুরী প্রদান ইত্যাদি। “মৈত্রী প্রকল্প” খাতে সরকার এখন বিরাট পরিমাণ অর্থ খরচ করছে। ১৯৮৮/৮৯ সালে খাগড়াছড়িতে ব্রিগেডিয়ার ইব্রাহীম পাহাড়িদের কাছে অকাতরে নোট বিলিয়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে। এই জন্যই CHT কমিশনের কাছে একজন সামরিক অফিসারের উক্তি, " We deserve a Nobel Prize for what we are doing." দুঃখ হয়, তবুও কেন Nobel কমিটির পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর এতটুকু নজর পড়ে না।

৭.তবুও কেন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি?: সরকার স্বীকার করেছেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিকভাবেই তা সমাধান করবেন। কিন্তু মুখে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বললেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো চলছে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নগ্ন থাবা। এই কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি হলো মূখ্যতঃ একটি সামরিক প্রক্রিয়া। তাই সঙ্গত কারণেই আজ দেশবাসীর প্রশ্ন - রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করা হলে তবুও কেন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির প্রয়োজনীয়তা ?


৮.উপসংহারঃ তিন বছর আগে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ভবিষ্যবাণী করেছিলেন যে, যেভাবে তারা কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি চালাচ্ছিলেন, তাতে দু’বছরের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ নির্মূল হবে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, তিন বছর পরও বিদ্রোহ দমন হয়নি। বরং নিরীহ পাহাড়ি বাঙালি জনসাধারণই এই কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নির্মম শিকার হচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই কাউন্টর ইন্সার্জেন্সির প্রতি পার্বত্য জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষ বেড়েই চলেছে। এটা এখন পরিস্কার যে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির মাধ্যমে কিছুতেই বিদ্রোহ দমন করা যাবে না। সরকারের অনুধাবন করা উচিত; যে কারণে বিদ্রোহের জন্ম, একমাত্র সেই কারণগুলি দুরীভূত করার মাধ্যমেই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব। [সহায়তাঃ Life is not Ours', Land and Human Rights in Chittagonh Hill Tracts]


পৃষ্ঠা: ১৪ - ১৫

এম, এন, লারমাকে যেমন দেখেছি
-আব্দুল্লাহ সরকার

সত্তোর দশকের কথা। আজ দীর্ঘ প্রায় দেঢ় যুগ পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার অনেক কথাই বেশ মনে পড়ছে। তকালীন জাতীয় সংসদে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এবং আমি নিজের এলাকা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই। সমসাময়িক রাজনৈতিক জীবনে আমরা পরস্পর খুবই কাছাকাছি ছিলাম। এতে করে তার চিন্তা, চেতনা, রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে কাছ থেকে জানার সুযোগ আমার হয়েছে। তখন সারা দেশের নানাবিধ সমস্যাসহ পার্বত্যাঞ্চলের সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগণের ন্যায্য অধিকার নিয়েও আমরা বিস্তারিত আলাপ করেছি। তিনি বরাবরই নিপীড়িত নির্যাতিত মেহনতি শ্রেণীর দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে জাতীয় সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করতেন। বাংলাদেশের মত একটি অনুন্নত পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কোন রাজনৈতিক ধারণায় সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় তা তিনি গভীরভাবে ভাবতেন। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার সমস্যাকে জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসার গুরুত্ব সম্পর্কে আমি প্রায়ই লারমাকে বলতাম। যেহেতু পাহাড়িয়া এলাকার জনগণ বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোন বিচ্ছিন্ন অংশ নয়, কাজেই তাদের সমস্যা অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণেরই সমস্যা। ৭২ সালে তিনি পাহাড়ি জনগণের চার দফা দাবী শেখ মুজিবর রহমানের নিকট পেশ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, তকালীন সরকার তার দাবী সমূহের মীমাংসা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও বাঙালী জাতীয়তা থেকে ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বকীয় বৈশিষ্টের অধিকারী পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের অস্তিত্বের প্রশ্নে এম, এন, লারমা সুস্পষ্টভাবে যুক্তি দেখিয়েছেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের পর যে সরকারসমূহ ক্ষমতাসীন হয়েছেন তারাও পার্বত্য এলাকার ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতি অনুসরণ করেছে। যেহেতু তাদের শ্রেণীগত চরিত্র অভিন্ন, সুতরাং তাদের শাসন শোষণের প্রকৃতিও এক। এটাই বাস্তব। তাই স্বাধীনতাত্তোর প্রতিটি সরকারই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে একইভাবে চিহ্নিত করে তারই ভিত্তিতে দমন পীড়নের কৌশল অবলম্বন করেছে। ফলে সংখ্যালঘু জনগণের মনে মূল ভূ-খন্ডের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ক্রমেই অবিশ্বাস আর সন্দেহ বেড়েছে বই কমেনি।
আমার ধারণা লারমা কখনোই পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘুদের সমস্যাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে চাননি। তার রাজনৈতিক বক্তব্যে বা আচরণে আমি বিচ্ছিন্নতাবোধের পরিচয় পাইনি। ৭৫ -এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দেশের অবস্থা তখন অস্থিতিশীল ছিল। মূলতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের সমস্যার সাথে একই সূত্রে গাঁথা। সমগ্র বাংলাদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের দাবী দাওয়ার সাথে পার্বত্য জনগণের অধিকারের প্রশ্নও সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং এ সমস্যা একটি জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যু। তাই অবিচ্ছেদ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের অধিকারের সংগ্রামকে অবশ্যই গোটা দেশের মেহনতি জনতার সংগ্রামের অংশে পরিণত করতে হবে। আর এই উপলব্ধি এম, এন, লারমা করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়েছিল। তিনি অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে গিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন নিজের সমস্যার কথা। আশির দশকে তিনি মর্মান্তিভাবে নিহত হন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অনেকটা বদলে যায়। তকালীন এম, পি, জাসদের উপন্দ্রে লাল চাকমার সাথেও আমার কথা হয়। আশি সালে কাউখালীর কলমপতিতে পাহাড়িদের উপর যে হত্যাকা- চালানো হয় সে ঘটনার সত্যানুসন্ধানী দলের (শাহজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন, উপন্দ্রে লাল চাকমা) সাথে আমারও যাবার কথা ছিল কিন্তু নানা অসুবিধার করণে আমার যাওয়া হয়নি।

এম, এন, লারমা খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। তার মধ্যে কোন প্রকার বিলাসিতা আমি দেখিনি। বেশ পড়াশুনা করতে দেখেছি তাকে। মোদ্দা কথা Plain living, high thinking যাকে বলে। পাহাড়ি জনগণের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি সংস্কৃতি এবং স্বতন্ত্র জাতিগত জীবন যাত্রা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভোমত্বের আওতায় এই অবহেলিত জনগণের স্বকীয় অস্তিত্ব, কৃষ্টি, সংস্কৃতি কিভাবে রক্ষা করা যায় তাই ভাবতেন লারমা। পশ্চাদপদ মানুষের একজন সাচ্চা কল্যাণকামী প্রতিনিধি হিসেবে তাদের ন্যায্য দাবী দাওয়ার ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আপোষহীন। শুধু পাহাড়িয়া এলাকার জনগণ নয় দেশের সমগ্র খেটে খাওয়া মানুষের দুরবস্থার কথা তিনি ভাবতেন। সংসদ অধিবেশনে তার বিভিন্ন বক্তব্যে নির্যাতিত, মেহনতি শ্রেণীর মানুষের অধিকারের কথাই ফুটে উঠত। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শোষিত মানুষের দঃখ দুর্দশার প্রশ্নে সহমর্মী এবং উদার প্রকৃতির ছিলেন। স্বাধীনতার পর বিপর্যস্ত অর্থনীতি এ দেশে পুরুষের পাশাপাশি শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নারী সমাজের প্রতি অবহেলার কথা, শোষণ নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে সংসদে তিনি আবেগে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলেন। বাজেট অধিবেশনের সময়ও তার ভাষণে তিনি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের পক্ষেই কথা বলেছেন। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে তিনি বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ করতেন। আমাদের মত পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। এ অব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সেই মানুষদেরই সংগঠিত করে একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সংগ্রাম করতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি সজাগ ছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ভাষাভাষি অনেকগুলো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ন্যায়সংগত দাবী আদায়ের সংগ্রামে এম, এন, লারমা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তার সময়ে সেখানকার অধিকাংশ জনগণের বঞ্চনার কথা তিনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। এ কারণে তিনি পার্বত্য জনগণের অত্যন্ত পরিচিত এবং প্রিয় অবিসংবাদিত নেতাতে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তাই তাকেই তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতধারায় দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন।

পার্বত্য এলাকায় এখনো অব্যাহতভাবে অশান্তি চলছে। ধরপাকড়, সাজা, অমানুষিক নির্যাতন, হত্যা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আমরা সকল প্রকার জাতিগত নিপীড়নের বিরোধীতা করি। অবসান কামনা করি মানবাধিকার লংঘনের। সকল প্রকার নির্যাতনের পথ পরিহার করে শীগ্রই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করে সেখানে সংখ্যালঘু জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রদান করা উচিত। কোন প্রকার অবহেলা আরও প্রাণহানীর জন্য দায়ী  হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অপাহাড়ি জনগণকে হত্যা করেও সমস্যার কোন মৌলিক সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। এতে সরকার জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পারবে। একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করে পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে দীর্ঘ দিনের সমস্যা নিষ্পত্তি করার উদ্দ্যোগ নিতে হবে। এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক উপায়ে এ সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের দায়িত্ব সরকারকে বহন করতে হবে।

(জনাব আব্দুল্লাহ সরকার বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য। জাতীয় সংসদেও একজন সদস্য ছিলেন তিনি। শোষিত, বঞ্চিত সর্বহারা শ্রেণীর পক্ষে তিনি নিরন্তরভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, অনেক দুরত্বে অবস্থান করলেও তার মত সংগ্রামী মানুষেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ পাহাড়ি জনগণেরও নিকটজন। আমরা তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন কামনা করি। “রাডার” প্রকাশনা কমিটি)।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
---------------------------------------------------------------------------------------------------


 পৃষ্ঠা: ১৬ - ১৭

চালচিত্র

“মার্ডার হলেও রাডার কিনবো”
রাডারের রাহুমুক্তি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সংখ্যাটি খুবই সমাদৃত হয়। অনেককে রাডার পড়ার জন্য নিগৃহীত হতে হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়িতে প্রতুল বিকাশ খীসাকে রাডার কেনার দায়ে জনৈক আর্মি কর্তৃক উরুতে লাঠি খেতে হয়েছে। পরে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “লাঠি নয়, মার্ডার হলেও রাডার কিনবো।”

কাশীরাম চাকমা-র জীবনের মূল্য ৫,০০০ টাকা
গত ১০ই মে ’৯১ রাতে কাউখালী উপজেলার মিদিঙ্গ্যাছড়ি গ্রামের কাশীরাম চাকমা নামক জৈনক কৃষককে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। দৈহিক নির্যাতনের ফলে তিনি শেষ পর্যন্ত মারা যান। ১৩ তারিখ তার লাশ ফেরত দেয়া হয় এবং তার সকারের জন্য ৫,০০০ টাকা প্রদান করে বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য এলাকাবাসীকে বিশেষভাবে হুমকি দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ১৯৮০ সালে এই কাউখালীতেই সংঘটিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে কলংকময় ঘটনা “কলমপতি হত্যাকাণ্ড”।

সহানুভূতি চাওয়ার শাস্তি ৪০০ ঘনফুট কড়ই গাছ
খাগড়াছড়ি জেলার ভাইবোনছড়া আর্মি ক্যাম্প কমা-ারের কড়া নির্দেশ- “গুচ্ছগ্রামবাসীদের সপ্তাহে অন্ততঃ দুদিন বিনা পারিশ্রমিকে ক্যাম্পে কাজ করে দিতে হবে। অবহেলা করলে চরম দণ্ড।” লাঠি ছাড়া কথা বলতে তিনি অভ্যস্ত নন। “অসহায় গ্রামবাসী সপ্তাহে একদিন ক্যাম্পে কাজ করবে এবং কমাণ্ডার সাহেব তার লাঠি ব্যবহার করবেন না”- এই মর্মে জনৈক জেলা পরিষদ সদস্যের মাধ্যমে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। কিন্তু বিধি বাম। সদয় দৃষ্টি বর্ষিত হলো না। বরং কমা-ার সাহেব আরো বেশী ক্ষেপে গেলেন। তার বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল! এত বড় ধৃষ্টতা! অতএব, গ্রাসবাসীদের ডেকে কড়া নির্দেশ এই ধৃষ্টতা দেখানোর বাড়তি সেলামী হিসেবে ৪০০ ঘনফুট কড়ই গাছ সংগ্রহ করে দিতে হবে। অনন্যোপায় হয়ে সন্ত্রস্ত গুচ্ছগ্রামবাসী হুকুম মানতে বাধ্য হয়।

“বিশ্বজি আর সুবোধকে আটক করতে পারে না”
গত ৯ই জুলাই ঢাকার টি,এস,সি - তে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসনের চিত্র তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য ৫ দফা দাবী সম্বলিত একটি লিফলেট প্রচার করে। এজন্যে খাগড়াছড়ি ক্যান্টম্যান্টে ডাক পড়ে পদলেহী লেজুরদের, যারা “জেলা পরিষদ” নামক প্রতিষ্ঠানে পুতুল নাচ দেখান। স্যারেরা গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে সামনে বসা। বার বার উক্ত লিফলেটটি পড়ে শুনানোর পর স্যার বললেন- “তোমাদের আমরা কী জন্য বানিয়েছি ? তোমাদের ছেলেরা ঢাকায় গিয়ে এগুলো কি করছে ? তোমরা এদের নিষেধ করতে পার না?” ইত্যাদি ইত্যাদি। জেলা পরিষদ নেতারা বাকশক্তিহনি। তারা স্যারদের সামনে কিছুই বলতে পারলেন না। শেষে বেরিয়ে এসে পুরুষোত্তম, পূর্ণজ্যোতি, অরুণোদয় পরস্পরকে বলাবলি করতে লাগলেন- “খালি আমাদের উপর খবরদারী। বিশ্বজি আর সুবোধ -কে আটক করতে পারে না?” উল্লেখ্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বাবু সুবোধ বিকাশ চাকমা এবং সভাপতিত্ব করেছিলেন বাবু বিশ্বজি চাকমা। তাই তাদের উপর লেজুড়দের এত আক্রোশ।

“বুয়েট; বি,আই,টি; কৃষি কলেজে পাহাড়ি ছাত্রদের ভর্তি অনিশ্চিত”
বুয়েট; বি,আই,টি; মেডিকেল ও কৃষি কলেজে যে কোটা সিষ্টেম চালু আছে তার সিলেকশন দিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জি,ও,সি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এবার যথা সময়ে পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীরা দরখাস্ত দাখিল ও পরীক্ষা দেয়ার পরও জি,ও,সি, ভর্তি অনুমোদন দিচ্ছেন না। অথচ ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির শেষ সীমা অতিক্রান্ত হয়ে ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। এভাবে পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্য চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জিম্মি হয়ে আছে।

“রাডার বিক্রির দায়ে মুচলেকা আদায়”
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত দেওয়ান রাজুকে রাডার বিক্রয় করার জন্য পুলিশ ১লা অক্টোবর ৯১ ইং আটক করে। পরে তাকে “পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে সংশ্লিষ্টতা পরিত্যাগ করবে” -এই মুচলেকা আদায় করে মুক্তি দেয়া হয়। বর্তমানে রাঙ্গামাটির লাইব্রেরীগুলোতে “রাডার” বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

“ষ্টাইপেণ্ড প্রদানে ক্যাপ্টেন হারুন ও দীপালোর অবৈধ প্রভাব”
গত ২৪/৯/৯১ ইং তারিখে মহালছড়ি উপজেলা পরিষদের ষ্টাইপেণ্ড প্রদানের জন্য বাছাই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেব যোগ্যতার ভিত্তিতে বৈধ ছাত্র- ছাত্রীদের ষ্টাইপে- প্রদানের পক্ষপাতি। কিন্তু বাঁধ সাধলেন ক্যাপ্টেন হারুন ও তার অনুগত লেুজুড় উপজেলা চেয়ারম্যান দীপালো। তাদের অভিমত হলো সেনাবাহিনীর অনুগত লোকদের ছেলেমেয়েদেরকে ষ্টাইপে- দিতে হবে। অবশেষে তাদের মতই প্রাধান্য পেল। ষ্টাইপে- দেয়া হলো (১) বিপুল খীসা পীং সুধাংশু খীসা, (২) জ্ঞানেশ্বর চাকমা ও (৩) মঞ্জু বিকাশ চাকমা - পীং ধৃতরঞ্জন চাকমা-কে, যদিও তাদের ছাত্রত্ব নেই। উল্লেখ্য, কথিত দীপালো চাকমা গত উপজেলা নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উলঙ্গ হস্তক্ষেপে প্রতিদ্বন্দ্বী আদি শংকর খীসাকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই এখন সেনাবাহিনীর পদলেহনই তার ক্ষমতার ভিত্তি, জনসমর্থন নয়।

“শান্তিবাহিনী আত্মসমর্পনের কেচ্ছা”
খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের মাথায় ভূত চেপে বসলো, যেভাবেই হোক শান্তিবাহিনী যে আত্মসমর্পন করছে তা দেখাতে হবে। অতএব, ৬/১১/৯১ ইং তারিখ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার আয়োজন। খাগড়াছড়ি কলেজিয়েট হাইস্কুলের ছাত্রাবাস “শান্তিনিকেতন কটেজ” থেকে ৮/৯ জন স্বাস্থ্যবান পাহাড়ি ছাত্রকে ব্রিগেড অফিসে ডেকে এনে শান্তিবাহিনীর পোশাক পরিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর তাদের হাতে অস্ত্র দিয়ে ছবি তোলা হয় এবং ভি,ডি,ও -তে ধারণ করা হয়। ছবি তোলার সময় ছাত্রদের মধ্যে নন্দিত নামের একজন আত্মসমর্পনকারীকে বসানো হয়, যাতে এই বানোয়াট ঘটনা সম্পর্কে জনগণের মনে বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করা যায়। এই ঘটনার দু’দিন পর প্রায় সব পত্রিকায় “১১ জন শান্তিবাহিনীর আত্মসমর্পণ” শিরোনামে উক্ত ঘটনাটি পরিবেশন করা হয়।

“মুখ লুকানো ছবি এবং .... ”
সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় হঠা কয়েকজন উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা খাগড়াছড়ি নতুন কুঁড়ি কেজি স্কুলে পদধূলি দিতে যান। সেখানে শিক্ষয়িত্রীদের সাথে চা-নাস্তা ও গল্প-গুজবের পর পাহাড়ি শিক্ষয়িত্রীদের ছবি তোলার অনুরোধ করা হয়। শিক্ষয়িত্রীরা এতে রাজী না হলে অনুরোধ আদেশে পরিণত হয়। অগত্যা শিক্ষয়িত্রীরা ক্যামেরার সামনে দাড়ালেন। তাদের হাতে দেয়া হলো “শান্তিবাহিনী নিপাত যাক”, “আমরা বাংলাদেশকে ভালবাসি” ইত্যাদি শ্লোগান সম্বলিত ব্যানার। অপমানে, দুঃখে, ক্ষোভে শিক্ষয়িত্রীরা ব্যানারের আড়ালে মুখ লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। এই মুখ লুকানো ছবি সেনা অফিসারদের কতটুকু কাজে লেগেছে তা জানা যায় নি, তবে এই ঘটনার পর পাহাড়ি শিক্ষয়িত্রীরা পদত্যাগ করেন বলে জানা গেছে।

“ভূবনের উপাতে বাঁশ বিক্রেতারা অতিষ্ঠ”
ব্রিগেডিয়ার ইব্রাহিমের আমলে গঠিত তথাকথিত টাইগার বাহিনীর প্রধান কুখ্যাত ভূবন চাকমার দাপতে এখন নানিয়ারচরের বাঁশ বিক্রেতাগণ অতিষ্ঠ। বিক্রেতাদের কাছ থেকে সে ট্যাক্স আদায় করছে এবং না দিলে “শান্তিবাহিনী” বা “শান্তিবাহিনীর সহযোগী” বলে আর্মির হাতে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। ফলে বেচারা বাঁশ বিক্রেতাদের বাধ্য হয়ে দাবীকৃত ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। অধিকন্তু পাহাড়ি বাঁশ বিক্রেতাদেরকে এক কিস্তিতে দাম পরিশোধ না করার জন্য ব্যবসায়ীদেরকে আদেশ দিচ্ছে, যাতে বিক্রেতারা বারে বারে বাজারে এসে দাম নিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং সেও বার বার ট্যাক্স আদায় করতে পারে। ব্যবসায়ীদের প্রতি তার বক্তব্য- “তোমরা যদি সব টাকা একসাথে দিয়ে দাও, তাহলে ওরা অর্ধেক টাকা শান্তিবাহিনীকে দিয়ে দেবে।”

“পাহাড়িদের জমি অনুপ্রবেশকারীদের দখল”
বর্তমানে পানছড়ি, দিঘীনালা ও কমলছড়ি এলাকার পাহাড়িদের ব্যাপক জমি-জমা সমতলবাসী অনুপ্রবেশকারীদের দখলে চলে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে এর মদদ দিচ্ছে বলে জানা গেছে। পানছড়ি ও দিঘীনালা এলাকার অধিবাসীরা বর্তমানে অনেকে ভারতে শরণার্থী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আর যারা দেশে রয়েছেন তারা “গুচ্ছগ্রাম” নামক বন্দী শিবিরে দিন যাপন করছেন। গুচ্ছগ্রামবাসীদেরকে তাদের নিজ নিজ জায়গা-জমিতে সেনাবাহিনী চাষাবাদ কিংবা ঘর-বাড়ি করতে দিচ্ছে না। অথচ এসব পাহাড়িদের জায়গা-জমিতে এখন প্রতিনিয়ত অনুপ্রবেশকারীদের বসত বাড়ি গড়ে উঠেছে এবং এভাবে পাহাড়িরা তাদের জায়গা-জমি হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে।

“প্রতি পরিবার মাত্র দুই কেজি চাল কিনতে পারবে”

২৭/১০/৯১ ইং মহালছড়ি জোনের জোনাল কমা-ার নির্দেশ দিয়েছেন যে, পাহাড়িরা পরিবার প্রতি মাত্র ২ কেজি চাল কিনতে পারবে। অধিকন্তু, তার নির্দেশে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ২৫/১০/৯১ ইং তারিখে পাহাড়িদের কাছ থেকে বাজার থেকে ফেরার সময় সমস্ত চাল কেড়ে নেয়। এভাবে প্রায় ১০/১২ মন চাল কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে যা আর ফের পাওয়া যায় নি।

 পৃষ্ঠা: ১৮ - ১৯

সংসদীয় গণতন্ত্র ও জনগণের প্রত্যাশা
-         মিঃ পারদর্শী

অবশেষে জনগণের চাপে ক্ষমতাসীন সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা হলো সরকার পদ্ধতির প্রশ্নে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন চুড়ান্ত রূপ লাভ করলো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস এবং সর্বোপরি সংবিধানের বিধানানুযায়ী গণভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। যদিও স্বৈরাচারী এরশাদের আস্তানা রংপুরের জনগণ পাইকারী হারে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির বিরুদ্ধে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির গালে চপেটাঘাত লাগায়। দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচারী শাসন-শোষণে পিষ্ট জনগণ বুঝি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এবার বুঝি বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে চললো। দারিদ্য-পীড়িত বাংলার জনতা পাবে গণতন্ত্রের সোনালী আভা। তাদের ভাত-কাপড়-বাসস্থানের সমস্যা বুঝি দূর হবে। কিন্তু এ স্বপ্ন দেখতে না দেখতে জনতার মোহভঙ্গ হলো যখন বি,এন,পি, সরকার প্রেসিডেন্টের আসনে বসালো রাজাকার আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে। এবপর একের পর এক শুরু হলো রাজাকারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে ক্ষমতায় বসিয়ে পুনর্বাসন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জনাব পন্নীকে করা হলো দেশের প্রাণকেন্দ্র আইন সভার ডেপুটি স্পীকার। সর্বোপরি দেশের উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষাবস্থা সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। কমনওয়েলথ সম্মেলন থেকে ফিরে এসেই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বললেন, দেশে কোন দুর্ভিক্ষাবস্থা নেই। অথচ জনগণ জানে দেশের উত্তরাঞ্চল এবং পার্বত্যঞ্চলে দারুণ খাদ্যভাব বিরাজ করছে এবং অনাহারে অর্ধাহারে মানুষ দিন গুণছে। মৃত্যুর সংবাদও কম আসেনি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে যদি এ ধরনের মন্তব্য শুনতে হয় তাহলে সংসদীয় সরকারের ভবিষ্য যে কী হবে তা সচেতন জনগণ ভাল করেই জানেন। তদুপরি দেশের প্রধান তিনটি বৃহ রাজনৈতিক জোটের রূপরেখা (যে রূপরেখার ভিত্তিতে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিলো) এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফা দাবী বাস্তবায়নের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। তিন জোটের রূপরেখা এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফার অন্যতম প্রধান দাবী ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের সহযোগীদের কোন দলে আশ্রয় না দেয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেশের প্রধান দুটি দল (ক্ষমতাসীন বি,এন,পি এবং বিরোধী আওয়ামী লীগ) তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একের পর এক এরশাদের সহযোগীদের নিজের দলে আশ্রয় দিয়ে পুনর্বাসন করতে থাকলো। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে ? সবচেয়ে জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে ৯০ -এর ছাত্র-গণ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অপরাধী নীরু, অভিদেরকে শুধুমাত্র দলের স্বার্থে নিজের দলে আশ্রয় দেয়া। স্বৈরাচারী এরশাদের সহযোগীরা ক্ষমতাসীন সরকারী দল এবং প্রধান বিরোধী দল উভয়ের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। এরা একে অপরকে দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দোষ ঢেকে রাখার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। সর্বোপরি এরশাদ পতন আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফা দাবীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অগ্রাহ্য করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করলো এই সংসদীয় সরকার জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। রংপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সারা দেশে যখন মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে মারা যাচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে সংসদে আলোচনা হচ্ছে সাংসদরা লাল পাসপোর্ট কিভাবে পাবেন, প্রধান মন্ত্রীর সুযোগ সুবিধা কী হবে, কোন মন্ত্রীরা কত টাকা বেতন পাবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের অবরোধ-হামলা সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে সরকারী দল এবং প্রধান বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন সমূহের মধ্যে গুলি পাল্টা গুলির কারণে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ ছাত্র, টোকাই। দোষ চাপানোর চেষ্টা চলছে একে অন্যের উপর। জনগণের টাকায় পোষা পুলিশ পালন করছে নীরব ভূমিকা। এজন্য পুলিশ প্রশাসনকে প্রশ্ন করা হলে তারা স্পষ্টভাবে জবাব দিচ্ছে “আমাদের উপর নির্দেশ না থাকলে আমরা কী করবো।” সরকারী কর্মচারীদের বেতন স্কেল নিয়ে আন্দোলন হলে সরকার তা দমন করে নির্মমভাবে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর পুলিশ এবং মাস্তানদের লাঠি চার্জ করা হয়। স্বৈরাচারী ভঙ্গীতে শ্রমিকদের উপর আক্রমণের ফলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রি। ফলে বেকার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক এবং গার্মেন্টস শিল্পের মত একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হচ্ছে ধ্বংসের মুখোমুখী। ভাঙচুরের প্রতিবাদে বুয়েটের শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ মিছিলেও পুলিশ বাধা দান করে। মুদ্রাষ্ফীতির পরিমাণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে জনজীবন বিপর্যস্ত করেছে। মোদ্দাকথা, সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করার পরও জনগণের এই দশা ! এসবের মূল কারণ হচ্ছে, সরকার পদ্ধতিতে পরিবর্তন হলেও শাসন কাঠামো পূর্বের মতই রয়ে গেছে। কাজেই রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তনের ফলে দেশের শাসন ব্যবস্থায় বড় ধরনের আশা করাটা বোকামী। জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধান করতে হলে দরকার এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙ্গে নতুন করে সাজানো। অর্থা বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধানের পথ নিহিত রয়েছে।

সংসদীয় সরকার প্রবর্তনের ফলে দেশের শাসন ব্যবস্থায় যে কোন পরিবর্তন হয়নি বা হতে পারে না তা সবচেয়ে বেশী স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয় বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্যাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে যে শাসন ব্যবস্থার ধরণ সেখানে প্রবর্তিত ছিল তা আজ অবধি বহাল তবিয়তে বিদ্যমান রয়েছে। বলতে গেলে আরও অবনতি ঘটেছে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জাতীয় সংসদের তিন তিনটি অধিবেশন হয়ে গেলো কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মত একটি জাতীয় এবং রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে সরকারী  দল ও বিরোধী দলগুলো কোন আলোচনাই করলো না। ফলে স্বৈরাচারী সরকারের আমলে প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থার অবসান তো দূরের কথা বরং দিন দিন আরও নৈরাজ্যের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দীনের আমলে দেশের ৬১ টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদেরকে অপসারণ করা হলো কিন্তু পাহাড়ি জনগণের প্রাণ প্রিয় দাবী পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি জেলা পরিষদ আশ্চর্যজনকভাবে বাতিল করা হয়নি। তদুপরি বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের মুখ থেকে পার্বত্যবাসীকে শুনতে হল পার্বত্য চট্টগ্রামের (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান) তিনটি জেলা পরিষদ বাতিল করা হবে না (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩১ শে ডিসেম্বর ১৯৯০)। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এইসব জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নাকি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু পার্বত্য জনগণ ভাল করেই জানে এই সব জেলা পরিষদের চেলা-চামু-ারা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে নাকি ভোটারবিহীন পাতানো নির্বাচনী খেলায় জয়ী হয়েছে। সেদিন থেকে পার্বত্যবাসীর মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য দিয়ে জনগণের বিশ্বাস ভাঙ্গানো যায় বটে কিন্তু আস্থা মোটেই অর্জন করা সম্ভব নয়। সর্বোপরি নির্বাচিত সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেত্রী খালেদা জিয়া ১৪ই এপ্রিল ৯১ সামরিক বাহিনীর কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তার সাথে বৈঠক করে ঘোষণা দিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বৈরাচারী এরশাদের গৃহীত নীতিমালা চালু থাকবে। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। কারণ স্বৈরাচারী এরশাদের নীতিমালা চালু রাখা মানেই হচ্ছে তার প্রণীত নীতিমালাকে স্বীকৃতি দেয়া। অথচ বাংলাদেশের অপরাপর জনগণের ন্যায় পাহাড়ি জনগণও স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিলো যে, এরশাদীয় স্বৈরাচারের অবসান ঘটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার একটা সম্মানজনক রাজনৈতিক সমাধান করা হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী কর্মসুচীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথাও ছিল। কিন্তু নির্বাচন উত্তরকালে তাদের মুখ থেকে কোন কথাই শোনা যাচ্ছে না। এভাবে দেখা যাচ্ছে যে, সমস্যা কেবল বেড়েই চলেছে বৈ কমছে না। স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে অত্যাচার-নিপীড়নের ফলে বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নেয় ৫০ হাজারের অধিক পাহাড়ি শরণার্থী, যারা, এখনও মানবেতর জীবন যাপন করছে বিদেশের মাটিতে। মানবেতর জীবন যাপনে অতিষ্ঠ হয়ে কিছু সংখ্যক শরণার্থী দেশে ফিরে আসলেও তাদের সমস্যার কোন সমাধান করা হয়নি। তারা শুধুমাত্র বিদেশের শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে এসে দেশের আরেক বন্দী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই বন্দী শিবিরগুলোর নাম হচ্ছে গুচ্ছগ্রাম, শান্তিগ্রাম ও বড়গ্রাম। ফিরে যেতে দেয়া হচ্ছে না তাদের নিজ নিজ গ্রামে যেখানে তাদের বাস্তুভিটা এবং চাষের জমি রয়েছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে যাদেরকে সমতল এলাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে তাদের অবস্থাও শোচনীয়। তারাও একই ধরনের গুচ্ছগ্রামে রয়েছে। জীবনের নিরাপত্তা তাদেরও বিঘ্নিত এবং অনিশ্চিত। হিংসা এবং প্রতিহিংসার অনলে পড়ে জীবন হারাচ্ছে নিরীহ পাহাড়ি এবং বাঙালি মেহনতি জনগণ। “সরকারের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পগুলোতে অবস্থানরত উপজাতীয়-অউপজাতীয়দের স্বাভাবিক জীবন থেকে সরিয়ে তাদের জন্যে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে পর্যবেক্ষক মহলে” (দৈনিক আজকের কাগজ ২৬ শে অক্টোবর ১৯৯১)। অন্যদিকে, সামরিক কমা-াররা যুক্তি দাঁড় করেছেন যে, নিরাপত্তা দেয়ার জন্য জনগণকে ঐসব শিবিরগুলোতে নেয়া হয়েছে। স্বাভাবিক জীবন থেকে বন্দী শিবিরে এনে জীবনের নিরাপত্তা ? সামরিক বাহিনীর এ নীতি পাহাড়ি জনগণকে পঙ্গুত্বে পরিণত করার সামিল। সামরিক বাহিনীর মনগড়া নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কাঠ এবং বাঁশ ক্রয় বিক্রয়। অথচ পার্বত্যবাসীদের অন্যতম প্রধান আয়ের উস হচ্ছে এই কাঠ এবং বাঁশ। অপরপক্ষে, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যাহত হচ্ছে এশিয়ার বৃহত্তম কাগজের কল চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের কাগজের উপাদন। রাস্তাঘাটে চলা ফেরায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ, সেনা ক্যাম্পের পাসপোর্ট নেয়া, যখন তখন গ্রেফতার করা, বিভিন্ন প্রকার বাধানিষেধ এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহত রয়েছে। পার্বত্যবাসীদের চোখের পানিতে গড়া পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই লেকের মস্য উপাদন শোচনীয় পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে হ্রদাঞ্চলের মস্যজীবী মানুষের আর্থিক জীবন হয়েছে বিপর্যস্ত। “কর্পোরেশনের ইচ্ছা অনুসারে হ্রদ সৃষ্টির পর অদ্যাবধি ৬০ কোটি মাছের পোনা ছাড়ার স্থানে ২ কোটি ২৫ লাখ পোনা ছাড়া হয়েছে। এর ফলে এ হ্রদে মাছের বংশ বৃদ্ধি কতটুকু সম্ভব হয়েছে তা এ পরিসংখ্যান থেকেই অনুমান করা যায়” (সাপ্তাহিক “দিক চিহ্ন” ১ বর্ষ ৬ সংখ্যা)। কাপ্তাই হ্রদের জলসীমা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে বলে সম্প্রতি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। পূর্ব সংকেত ব্যতীত এ ধরনের ইচ্ছাকৃতভাবে পানির লেভেল বাড়ানো সন্দেহের অবকাশ রাখে।

প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পার্লামেন্টারী সরকারকে তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সেনানায়ক মেজর জেনারেল জনাব মাহমুদুল হাসান পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণার পর জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ দেশে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় কেন জেনারেল হাসান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীদের প্রতি ? তাহলে কি জেনারেল হাসানরা নির্বাচিত সরকারের উর্ধ্বে রয়েছেন ? দেশের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কি এখনও সামরিক বাহিনীর হাতে রয়েছে ? আর যদি তা না হয়, তাহলে এসবের মানে কি ? পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার জন্য ভারতকে এই বলে দোষারোপ করা হয় যে, ভারত শান্তিবাহিনীদের উস্কানী এবং সাহায্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জিইয়ে রাখছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তির মূল কারণ এই শান্তিবাহিনীরা, শান্তিবাহিনীর অত্যাচারে জনজীবন আজ বিপর্যস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা কি ভারতের সমস্যা না বাংলাদেশের সমস্যা ? বাঙ্গালী হওয়ার উপদেশ কি ভারত দিয়েছিলো না বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দিয়েছিলেন ? পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সমতলবাসী অনুপ্রবেশ ভারত ঘটিয়েছিলো না বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঘটিয়েছিলেন ? পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে জেলা পরিষদ ভারত চাপিয়ে দিয়েছিলো না স্বৈরাচারী এরশাদ চাপিয়ে দিয়েছিলেন ? এরশাদের গৃহীত নীতিমালা চালু থাকবে বলে ভারত ঘোষণা দিয়েছিলো না বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দিয়েছিলেন ? নিজের দোষ অন্যের ঘারে চাপিয়ে দিয়ে কি দায়িত্ব শেষ ? নিজের দোষ অন্যের ঘারে চাপিয়ে সমস্যার সমাধান তো সম্ভবই নয় বরং নিজের ব্যাপারে অন্যকে নাক গলানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়। ভারত জুজুর ভয় দেখিয়ে জনগণকে বেশী দিন বিভ্রান্ত করা যাবে না। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ এ ধরনের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবে না। তদুপরি সরকারের মনে রাখা উচিত যে, জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে পাশ কাটিয়ে সমস্যার সমাধান মোটেই সম্ভব নয়। এতে দেশ ও জাতির সম্মান বাড়ে না বরং মুখোশ উন্মোচিত হয় স্বৈরাচারী মনোভাবের। অন্যদিকে, সমস্যা সমাধান না হয়ে তা আরো গভীরতর হয় জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে। হামলা-পাল্টা হামলার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় শান্তিপূর্ণ জনপদ। উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় বারে বারে। দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যায়। জীবনের নিরাপত্তা হয় বিঘিœত। জনগণের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ফলে সৃষ্টি হয় গণ আন্দোলন। গণ আন্দোলন নিশ্চিত করবে শাসক-শোষক শ্রেণীর পতনকে। তাই শাসক শ্রেণীকেই চিন্তা করতে হবে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে। অন্যথায় জনগণ বাঁচার তাগিদে লড়াইয়ের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে। এতে অন্যের উপর দোষ চাপানোর কোন মানে নেই। সুতরাং বর্তমান সংসদীয় সরকারকে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য উচিত এসবের দিকে নজর দেয়া। নইলে সংসদীয় সরকারের দৌড় সংসদেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কারণ, সংসদীয় গণতন্ত্রের ভেলকীবাজী দেখিয়ে জনগণকে কিছুদিনের জন্য ভোলানো যাবে বটে, কিন্তু তাতে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর যতদিন না জনগণের মৌলিক চাহিদা-খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি পূরণ না হবে, ততদিন জনগণ আন্দোলনের মাঠ ছাড়বে না।
-----------------------------------
প্রকৃতি গড়ে যায় নিপুন হাতে
যে শিশু আজ ভূমিষ্ঠ হয়
পার্বত্যে, দেখে বারুদে ধূমায়িত
পৃথিবী, দমন পীড়নের লেলিহান
শিখা, শুনে নিয়ত আগ্রাসন
আর সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের
দামামা। স্বভাবতই বেড়ে উঠে
সে প্রতিবাদী চেতনার অগ্নি 
স্ফুলিঙ্গ নিয়ে দমবন্ধ হয়ে আসা
পরিবেশে। তাকে আমি 
কিভাবে বলি, “হে প্রজন্ম 
নিশ্চুপ থাক, সয়ে যা সকল
অন্যায়, বর্বর অত্যাচার, বিলীন
হয়ে যা হে মানব শিশু এ 
ধরণীর মায়া ছেড়ে।” প্রকৃতি
নিজেই বিদ্রোহের বহ্নি জ্বেলে
দেয় পুত পবিত্র মানব সন্তানের 
ধমনীতে। এতো পরিস্থিতির
হাতে গড়া সৃষ্টি।
-------------------------------------------


পৃষ্ঠা: ২০ - ২২

সাক্ষাতকার
[পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা। সঙ্গত কারণেই আমরা মনে করি এ সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের সচেতন ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিকর্মীসহ সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকাকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে কে কী ভাবছেন তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সচেতন মহলের সাক্ষাতকার ছাপাবো। এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে গত সংখ্যায় (রাহুমুক্তি সংখ্যা) আমরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী জনাব বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাতকার ছেপেছিলাম। এ সংখ্যায় তিনজন বিশিষ্ট ছাত্র নেতার সাক্ষাতকার ছাপানো হলো]

প্রশ্নসমূহ নীচে দেয়া হলোঃ-
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগণের যে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চলছে তাকে আপনার সংগঠন কিভাবে মূল্যায়ন  করে ? এ সমস্যার ব্যাপারে আপনাদের সংগঠনের কি কর্মসূচী আছে?
(খ) পার্বত্য এলাকায় যে ব্যাপক সামরিকীকরণ এবং সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে যে বিপুল অ-পাহাড়ি পুনর্বাসন করা হচ্ছে সে সম্পর্কে আপনাদের কী বক্তব্য?
(গ) পাহাড়ি ছাত্ররা বরাবরই তাদের দাবী দাওয়া নিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক মূল স্রোতধারায় মিলিত হবার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। তাদের আন্দোলনের প্রবাহকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে আপনারা কী ভূমিকা নিতে পারেন ?
(ঘ) বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীনে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের আন্দোলনের ফলাফল কি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর সাথে আপনি কি একমত ?
(ঙ) পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি অন্যতম জাতীয় সমস্যা। অথচ এ সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় রাজনৈতিক দলসমূহ দুর্ভাগ্যজনকভাবে উদাসীন। এর সমাধানের দাবী শুধু সেখানকার অধিবাসীদের আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। তাই এ ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার জন্য আপনাদের ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করুন।

পাহাড়ি জনগণের সাথে দেশের ব্যাপক অ-পাহাড়ি জনগণের কোন বিরোধ নেই।
ফয়জুল হাকিম, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন

ক) পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগণের যে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চলছে তাকে আমাদের সংঠন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে। এ সমস্যার ব্যাপারে আমাদের সংগঠনের কর্মসূচী মূলতঃ আমাদের রাজনৈতিক জোট, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের নেতৃত্বে জাতিগত সংখ্যালঘু ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করেছে।

খ) পার্বত্য এলাকায় যে ব্যাপক সামরিকীকরণ এবং সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গোপন সার্কূলারের মাধ্যমে যে বিপুল অ-পাহাড়ি পুনর্বাসন করা হচ্ছে সে সম্পর্কে আমরা অবহিত। এ কাজ এ দেশের শাসক সংখ্যালঘু লুটেরা ধনিক-বণিক শ্রেণীর সরকারসমূহ করে আসছে উগ্র জাতীয়তাবাদের আবরণে এবং পাহাড়ি জনগণের উপর শোষণ-শাসন বলব রাখতে অ-পাহাড়িদের ধারা অব্যাহত রেখে পাহাড়ি জনগণের সাথে অ-পাহাড়ি জনগণের “বিরোধ” সৃষ্টির মাধ্যমে। এই “বিরোধ” কে সামনে রেখে এরা সামরিকীকরণের প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য করবার অপচেষ্টায় লিপ্ত। আমরা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, মনে করি পার্বত্য এলাকাসহ দেশের যে-কোন স্থানে সামরিকীকরণের বিরোধীতা করা ছাড়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এক কদমও অগ্রসর হতে পারে না।

আমরা পার্বত্য এলাকায় বিপুল অ-পাহাড়িদের তথাকথিত পুনর্বাসনের প্রতারণার বিরোধীতা করি। কেননা অ-পাহাড়ি, সমতলের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের উপর এই সংখ্যালঘু লুটেরা ধনিক-বণিক শ্রেণী ও তাদের সরকারসমূহ এক স্বৈরতান্ত্রিক, শোষণ-নির্যাতনমূলক শাসন ব্যবস্থা কায়েম রেখে বাঙালি স্বার্থরক্ষার নামে গরীব বাঙালিদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছে।

গ) পাহাড়ি ছাত্রদের দাবী-দাওয়া নিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক মূল স্রোতধারায় মিলিত হতে গেলে দেশের জনগণের, বিশেষতঃ শ্রমজীবী জনগণের দুশমন, সাম্রাজ্যবাদ ও বিদেশী শক্তির খেদমতগার দেশীয় লুটেরা ধনিক-বণিক শ্রেণী, তাদের সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের বিরুদ্ধে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। পাহাড়ি জনগণের সাথে ব্যাপক অ-পাহাড়ি জনগণের কোন বিরোধ নেই। শাসক গোষ্ঠী সৃষ্ট “বিরোধ”কে সামনে এনে ব্যাপক জনগণকে বিভ্রান্ত, প্রতারিত ও বিভক্ত করছে। মেহনতি জনগণের মুক্তির রাজনীতিই বাংলাদেশের জনগণের মূল স্রোতধারার রাজনীতি। এ রাজনীতির অংশীদার বাঙালি শ্রমজীবী জনগণ ও পাহাড়ি শ্রমজীবী জনগণ। শ্রমজীবী জনগণের রাজনৈতিক শক্তির বিকাশে আমরা সক্রিয় রয়েছি।

ঘ) বিদ্যামান রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীনে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের আন্দোলনকে মেহনতি জনগণের মুক্তির রাজনীতির অধীনস্ত করবার দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়েই আন্দোলনের ফলাফল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। সংখ্যালঘু জাতিসমূহের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর সাথে আমরা একমত।

ঙ) পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি অন্যতম জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা। এর সমাধানের দাবী সক্রিয়ভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের বিষয়টি উপরেই বলা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জাতিসমূহের এই সমস্যা শুধু তাদের সমস্যা নয়। এটি একটি অন্যতম জাতীয় সমস্যা।
বেলাল চৌধুরী, সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট।

ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড়ি জনগণ আমাদের দেশ এবং জনগণের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীর্ঘ দিন ধরে পাহাড়ি জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই করছে। আমরা তাদের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করি। আমরা মনে করি, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সর্বতোভাবে রাজনৈতিক। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় সুযোগ সৃষ্টিসহ তাদের সকল সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উপায় খুজে বের করা দরকার। কিন্তু অতীতের বিভিন্ন সরকার পাহাড়ি জনগণের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ বিবেচনায় না রেখে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক পন্থা অনুসরণ করার ফলে সমস্যা ক্রমাগত জটিল রূপ ধারণ করেছে।

আমাদের জনগণ দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গৌরবমণ্ডিত বিজয় অর্জন করেছে। বর্তমানে নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করছে। অতীতের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ও শক্তি প্রয়োগের পথ পরিহার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার বাস্তব সমাধানের লক্ষ্যে বর্তমান নির্বাচিত সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে-এটিই আমাদের সংগত প্রত্যাশা। 

আমরা আমাদের সংগঠন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নিজস্ব কর্মসূচী ও গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের ১০ দফা কর্মসূচীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানিয়েছি।

খ) আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক তপরতার নিন্দা করি। অগণতান্ত্রিকভাবে পার্বত্য এলাকায় অ-পাহাড়ি জনগণের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ারও আমরা বিরোধীতা করি। আমরা মনে করি, দমননীতি কিংবা দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপ পাহাড়ি এবং অ-পাহাড়ি জনগণের মধ্যে মানসিক বিচ্ছিন্নতা এবং বৈরী সম্পর্ক তৈরি করছে।

গ) জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতধারায় মিলিত হবার পাহাড়ি ছাত্রদের এই প্রচেষ্টাকে আমরা বরাবরই স্বাগত জানিয়ে আসছি। আমরা আশা করি ভবিষ্যতে তাদের এই প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালি হবে এবং সকল গণতন্ত্রকামী শক্তি তাদের সহায়তা যোগাবে। 
আমরা সাংগঠনিকভাবে, ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্র থেকে এবং পাহাড়ি ছাত্রদের সাথে থেকে তাদের এই প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সম্ভাব্য সহযোগীতা প্রদানে আগ্রহী।

ঘ) পাহাড়ি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর সাথে আমরা একমত পোষণ করি। আমরা মনে করি বিদ্যামান রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের স্বায়ত্তশাসনের দাবী মেনে নিয়ে তাদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

ঙ) আমরা মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জাতিসমূহের এই সমস্যা শুধু তাদের সমস্যা নয়। এটি একটি অন্যতম জাতীয় সমস্যা। সুতরাং এটি সমাধানের জন্য সারা দেশের জনগণ বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিত। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক দল যারা অতীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল ও বর্তমানে আছে তারা এ সমস্যা সমাধানে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে তাদের গৃহীত ভুল পদক্ষেপের কারণেই এ সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। পাহাড়ি জনগণের এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার জন্যে আমরা এ দেশের সকল বাম-প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা এ ব্যাপারে সব সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাব।

এই সমস্যার সমাধান খুব কঠিন বলে মনে করি না।
নাসিরুদ্দোজা, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী দীর্ঘ দিন যাব তাদের ন্যায়সংগত দাবী দাওয়া নিয়ে যে সংগ্রাম করে আসছে আমাদের সংগঠন তাদের দাবী-দাওয়ার সাথে একমত। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে বসবাসরত সকল জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও বিকাশের পথ উন্মুক্ত থাকা উচিত। একটি বৃহ জাতি-গোষ্ঠী দ্বারা ভিন্ন সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীসমূহের উপর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণ বা কী নিপীড়ন আজকের যুগে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন পরিচালনা করা হচ্ছে। যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

আমাদের সংগঠন এই সমস্যার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন এবং সমগ্র জাতিকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছে। এ প্রথম বারের মত আমাদের সংগঠনের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর সমস্যা এবং তার সমাধান প্রসঙ্গে একটি বিশেষ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। তাছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাহাড়ি ছাত্রদের সমস্যাসমূহ তুলে ধরার জন্য আমরা সব সময় সক্রিয়।

খ) পার্বত্য অঞ্চলে দেশের অন্যান্য এলাকার মত সাধারণ নাগরিকরা বসবাস করলেও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে এই অঞ্চলের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অত্যন্ত সীমিত। দীর্ঘ দিন ধরে এই অঞ্চলে চলছে অলিখিত সামরিক আইন। আজকের এই গণতান্ত্রিক দিনে যা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।

গ) পাহাড়ি ছাত্রদের সংগঠন “বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ” দীর্ঘ দিন ধরে তাদের দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। এটি পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি ছাত্রদের একটি আঞ্চলিক সংগঠন। আমরা তাদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে সবসময় সহযোগীতা প্রদান করেছি।
তাদের কার্যক্রম এবং দাবী-দাওয়াসমূহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার জন্য সব সময় সচেষ্ট। আমাদের প্রচেষ্টা এবং সহযোগিতার মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই এই সংগঠনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেছে এবং সারা বিশ্বের ছাত্র সমাজের একমাত্র সংগঠন IUS -এর Consultative সদস্য পদ অর্জন করেছে।

ঘ) সংখ্যালঘু জাতিসত্তার স্বাভাবিক বিকাশ এবং উন্নয়নের জন্য আমাদের ভৌগলিক সীমানার মধ্যেই সাংবিধানিকভাবে এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যেতে পারে। আন্দোলনরত গোষ্ঠীসমূহ এবং আমাদের সরকার আন্তরিক গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করলে এই সমস্যার সমাধান খুব কঠিন বলে আমরা মনে করি না।

ঙ) এটি একটি অত্যন্ত দুঃখজনক সত্য এ ধরনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে উদাসীন। অবশ্য শুধু এ বিষয়েই নয় আরো অনেক অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল যে উদাসীন তাই নয় তারা এ সমস্ত বিষয়ে কোন কিছুই জানেন না এবং চিন্তাও করেন না। তারা শুধু চিন্তা করেন কিভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায় এবং ক্ষমতায় গেলে অস্ত্র দিয়ে হোক আর মাস্তান দিয়ে হোক কিভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়। এ পর্যন্ত কেবল আমাদের সংগঠনই এ বিষয়কে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে এসে জাতীয় সম্মেলনে একটি বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।

---------------------------------------------------------------
শ্যেন চোখের দৌরাত্ম্য
আমার চারপাশ ঘিরে থাকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি। চোখ মুখ হাতে পায়ে বেঁধে রাখে সে আমার মুক্ত বিচরণে। আমার হৃপিণ্ড বন্ধ হয়ে আসে এভাবে। অন্যায় তো কিছুই করছি না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করছি কারণ এর প্রতিকার চাই আমি। তাই কি পিছু নেয় ঐ শ্যেন চোখ ? দোহাই, অর্থহীন এ চর্চ্চা। এভাবে নয়। স্বাধীন মত প্রকাশের মাধ্যমেই তুমি দ্যাখে নিও আমার ভেতর বাহির।
-------------------------------------------------------------

 পৃষ্ঠা: ২৩ - ২৬


 দৈনিক গিরিদর্পনে প্রকাশিত হাতেম তাই-এর কিছু কথার জবাবেঃ
-  মি. গণমুক্তি

দৈনিক গিরিদর্পনের ২২/১০/৯১ ইং তারিখের “হিল লিটারেচার ফোরামের ‘রাডার’, আজকের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আমাদের কিছু কথা” শীর্ষক লেখাটি আমাদের দৃষ্টি গোচর হয়েছে। আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছিলাম মত-পথ নির্বিশেষে আমাদের সমালোচনা করার অধিকার সবার। পাশাপাশি আমরাও আমাদরে লেখার অধিকার চেয়েছি। মতামত প্রকাশ ও আলোচনা-সমালোচনার ব্যাপারে এই হচ্ছে আমাদের পরিস্কার বক্তব্য। তাই যে কোন গঠনমূলক, সৃজনশীল, দিক নির্দেশনামূলক সারগর্ভপূর্ণ আলোচনা-সমালোচনা আমাদের কাছে বেশ আদরণীয়। আমরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে সে ধরনের লেখা দেখতে চাই।

দৈনিক গিরিদর্পনে প্রকাশিত হাতেম তাই সাহেবের লেখা আমরা যে মনযোগ ও আগ্রহের সাথে দেখতে চেয়েছি, দুঃখজনক হলেও সত্য, তার লেখায় আমরা মনযোগ দেবার মতো কোন কিছুই পাইনি। আগ্রহের পরিবর্তে তার লেখা পড়তে অনীহা এসেছে এবং ঘৃণা জেগেছে।

তিনি পরিণত মন ও কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে লিখতে পারেননি। আবেগের বশবর্তী হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। অনেক অসংলগ্ন, অশোভন ও কুরুচিপূর্ণ উক্তি করে ফেলেছেন। সচরাচর আমরা কোন উদ্ভট ও অন্তসারশূন্য লেখাকে আমল দিই না এবং পরোয়াও করিনা। হাতেম তাই সাহেবের কাণ্ডজ্ঞানহীন সমালোচনাকেও আমরা মোটেই আমল দিতাম না। অহেতুক কাগজ-কালি খরচের বিলাসিতা করতে যেতাম না। কিন্তু তিনি সমালোচনা করার নামে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে যেভাবে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন তা কোন অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না।                                                                  
দেশের এত পত্র-পত্রিকা থাকতে কিসের তাড়নায় তিনি দৈনিক গিরিদর্পনের মতো একটা বিশেষ (?) পত্রিকায় রাডারের সমালোচনা করতে গেলেন ? এটা কি ঐ পত্রিকার কাট্তি বাড়াবার একটা বাণিজ্যিক কৌশল ? রাডারের Good will থেকে কিছু ফায়দা লুটার ন্যাকামীপনা ? নাকি আবার অন্য কিছু ? হাতেম তাই সাহেব যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ঐ সমালোচনা লিখে থাকুন- আমরা তার প্রতিটি লাইন ও বাক্যের জবাব দিতে পারি। উদ্ভট সমালোচনার পেছনে কাগজ ও কালি অপচয়ের কথা ভেবে আমরা শুধু নীচের কিছু বিষয়ের উপর আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছিঃ

ক) হাতেম তাই সাহেব যে না জেনে - না বুঝে কথা বলেন, সেটা তার লেখাতেই প্রমাণ মিলছে “এ সংখ্যা ছাড়া (রাহুমুক্তি সংখ্যা) ইতিপূর্বে আর কখনো রাডার পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। যতটুকু মনে হচ্ছে জন্মলগ্ন থেকেই রাডার এভাবেই বিতর্কিত, উগ্রসাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বিরোধী লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।”
পুরোপুরি না জেনে শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে যে তিনি মনগড়া মন্তব্য করতে পারেন- সেটা তো তার কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।
খ) “প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয় সবই রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর স্বার্থে। রাডারের প্রসঙ্গেও একথা প্রযোজ্য ... ”      
দেশে স্বৈরশাসনকালে “যায় যায় দিন”, “মানচিত্র”, “বিচিত্রা” সহ অনেক পত্রিকার মতো “রাডার”ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীতে স্বৈরশাসনের পতন ঘটলে অন্যায়ভাবে জারীকৃত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। রাডারের নিষেধাজ্ঞাও অন্যায় ছিল বলে সে সময় প্রত্যাহার করা হয়েছিল। অথচ আশ্চর্য, হাতেম তাই সাহেব স্বৈরচারী সরকারের জারীকৃত নিষেধাজ্ঞাকে “রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর স্বার্থে” বলে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছেন। এতে বুঝতে আর বাকী নেই তিনি যে এখনো স্বৈরাচারী সরকারের নীতির পক্ষে ওকালতি করে যাচ্ছেন।
এজন্য দেশের পত্র-পত্রিকায় অহেতুক লেখা হচ্ছে না যে - স্বৈরচারের পতন হলেও তাদের দোসর-দালালরা দেশের আনাচে-কানাচে রয়ে গেছে। উপরোক্ত মন্তব্যকারী ব্যক্তিও যে স্বৈরচারের দোসর-দালাল নন তার নিশ্চয়তা কোথায় ?
গ) (১) রাডার-এর অভ্যুদয় লেখাটি সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি নিজের কপালকে দায়ী করে এভাবে বিলাপ করেছেন - “আমাদের (পার্বত্যবাসীর) দুর্ভাগ্য, রাডার ... খুঁজে বের করতে পারেনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত কারণ। ... কেবল পেরেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে, সার্বভৌমত্বকে কটাক্ষ করতে, পেরেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করতে।”
রাডার কতটুকু পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত কারণ তুলে ধরতে পেরেছে- সেই বিচারের ভার সচেতন সম্মানিত পাঠক মহলের। তারাই রায় দেবেন রাডার কতটুকু সফল, আর কতটুকু ব্যর্থ। আমরা তো দাবী করিনি যে- রাডার সবকিছু নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে পেরেছে। উক্ত প্রবন্ধের নিবন্ধকার এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন “রাডার প্রকাশনা সবে তিন বছর হয়ে গেলো। সময়ের নিরিখে এই তিন বছর কিছুই নয়। তাই এখনও সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান নিয়ে কিছু বলার সময় হয়নি।”
আর “হিল লিটারেচার ফোরাম” তো এদশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান প্রদর্শন করেই একটি সৃজনশীল সাহিত্য সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কটাক্ষ ও চ্যালেঞ্জ করার তো প্রশ্নই আসে না এবং হিল লিটারেচার ফোরাম সে ধরনের কিছু করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। কোনরূপ যুক্তির ধারে কাছে না গিয়ে হাতেম তাই সাহেব এত অসংলগ্ন কথা কিভাবে বলতে পারেন অবাক হতে হয়। আসলে উনি নিজে সে সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখেন কিনা সন্দেহ আছে। “প্রগতিশীলতা” হিল লিটারেচার ফোরামের অন্যতম মূলমন্ত্র। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতার মতো পশ্চাপদ মানসিকতার বিষবাষ্প ছড়াবার মতো কোন পরিবেশ ও সুযোগ হিল লিটারেচার ফোরামে নেই।
গ) (২) রাডারকে বিদ্রুপ করে হাতম তাই লিখেছেন “... এরই প্রেক্ষিতে বলতে হয় রাডার বিকল, প্রকৃত পূর্বাভাস ধারণ করতে রাডার ব্যর্থ হয়েছে।”
উনি আসলে হোচট খেয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তাই বুঝতে না যে- রাডার বিকল হয়নি। বরং পার্বত্যবাসীর দুঃখের কথা অবিকলভাবে তুলে ধরেছে। আর না হলে উনি এত ব্যতিব্যস্ত কেন ? লেজে পা পড়লে তো লম্ফঝম্ফ হবেই। আমরা তো সেটাই দেখতে পাচ্ছি।
ঘ) (১) “জলপাই স্বৈরাচার, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রেক্ষিত” নিবন্ধটি সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন-“এ প্রবন্ধটিতে লেখক আসলে কি বুঝাতে চেয়েছেন বুঝা মুশকিল।”
লেন্স অপরিচ্ছন্ন থাকলে ক্যামেরায় তো ভালো স্পষ্ট ছবি আসবে না, তাতে অবাক হবার কি আছে ? হাতেম তাই নিজে বুঝতে পারেননি বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। নিজের বুঝার অক্ষমতাকে ঢাকার জন্য তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীকে জড়িত করে বলছেন “পার্বত্যবাসী বিষ্মিত”। নিজের মন কলুষিত বলে তিনি বুঝতে পারেননি তাতে আমরা অবাক হচ্ছি না। কিন্তু পার্বত্যবাসীকে তিনি মিছামিছি জড়ালেন কেন ?
ঘ) (২) “পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে জলপাই স্বৈরাচার বলা হয়েছে, আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে এযাবকাল আর কেহ এভাবে কটাক্ষ করতে পারেনি।”
দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে কটাক্ষ করা নয়, সেনাশাসনের অকার্যকারীতা ও ব্যর্থতাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক জনগণ এত বছর হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধি করেছেন এবং উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারাও তা মানেন। এজন্য এরশাদের পতনের পর তার আহ্বান সত্ত্বেও দেশে সেনাশাসন কায়েম হয়নি। সেনাশাসন যদি উত্তম কিছু হতো, তাহলে জনগণ গণতন্ত্র চায়তো না এবং রাস্তায় প্রাণও দিত না।
ঘ) (৩) “এ নিবন্ধটিতে পুরো বাঙালী জাতিকে কটাক্ষ করা হয়েছে, অমানবিক বাঙ্গালীর উগ্রতা হিসেবে উল্লেখ করে”
 এটা ভালোভাবে না পড়ে না বুঝে মনগড়া মন্তব্য ছাড়া আর কিছুই নয়। হাতেম তাই নিবন্ধটি পড়ে নিজেই তো বলেছেন, “লেখক আসলে কি বুঝাতে চেয়েছেন বুঝা মুশকিল।” তিনি বুঝতে পারেননি বলেই নিবন্ধটিতে ভিন্ন একটা অর্থ আবিস্কার করে সম্ভবতঃ বিরাট (?) একটা কিছু করে ফেলেছেন। মাছিকে হাতি দেখছেন। কই এত লেখক-বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা রাডার পড়েছেন, তারা তো হাতেম তাই-এর মতো মনগড়া অর্থ আবিস্কার করেননি ? তার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে দেয়া দরকার যে- হিল লিটারেচার ফোরাম এমন ধরনের একটা সংগঠন যা কোন জাতির উপর কটাক্ষ বা বিদ্বেষ প্রসূত মন্তব্য করার কথা চিন্তাও করে না। সে ধরনের হীন প্রবৃত্তি হিল লিটারেচার ফোরামের নেই এবং তা ফোরামের রীতি বিরুদ্ধও। বাংলাদেশের অনেক বরেণ্য লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সাথে ফোরামের ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক রয়েছে এবং গড়ে উঠেছে।
ঘ) (৪) “অথচ বাঙ্গালীদের মানবিক আচরণের কারণেই পাহাড়িরা উন্নতির মুখ দেখেছে, চাষবাস থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রী পর্যন্ত বাঙ্গালীরাই পথ দেখিয়েছে। পাহাড়িদেরকে নেংটি থেকে নেকটাই বাঙ্গালীরাই পরিয়েছে।”
তার ঐ উক্তি যারপর নেই কুরুচিপূর্ণ, অশোভন ও আক্রমণাত্মক এবং পুরো পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাসমূহের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত ও অবমাননাকর। তাকে আমরা পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাসমূহের প্রতি ঐ অবমাননাকর উক্তি প্রত্যাহার করার এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য আহ্বান করছি। অন্যথায় পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাসমূহের প্রতি অবমাননার দায়ে আইনের আশ্রই নেবার চিন্তাভাবনা করা হবে।                                                                                                                                      বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী কিংবা নেকটাই .... এসব তো পশ্চিমারাই এ উপমহাদেশে প্রচলন ঘটিয়েছে সে কথা কে না জানে। হাতেম তাই-এর মতো একজন কুপমণ্ডুক-গণ্ডমূর্খ তো ইউরোপিয়ানদের উন্নত শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর পোদ্দারি দেখাতে পারেন না।
ঘ) (৫) “এরশাদ স্বৈরাচারী হলেও স্থানীয় সরকার পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাংবিধানিকভাবে।”
এটা অজ্ঞতাপ্রসূত উক্তি। তথাকথিত  স্থানীয় সরকার পরিষদ যে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং সাংবিধানিক কোন গ্যারান্টিও নেই সে সম্পর্কে আপনি আরো ভালোভাবে খোঁজখবর  এবং পড়াশুনা করুন। এ নিয়ে উদাহরণ দিয়ে লেখা দীর্ঘ করতে চাই না।
ঘ) (৬) পার্বত্যবাসী একে (জেলা পরিষদকে)স্বাগত জানিয়েছে। এবং আরো ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে।”
জেলা পরিষদকে স্বাগত ও সমর্থন জানাবার কী কী লক্ষণ তিনি দেখতে পেয়েছেন তা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারেন নি। তবে, হাতেম তাই-এর জেলা পরিষদের প্রতি এত কেন দরদ ? এবং এত কেন মায়া ? জেলা পরিষদ ঠিকিয়ে রাখতে কেন এত ওকালতি- বুঝতে অসুবিধা হয় না। জেলা পরিষদের মতো ভণ্ডামীপূর্ণ ব্যবস্থার ফলে বেআইনী অনুপ্রবেশকারীরা যে বৈধতা পেতে পারে - সেই মোক্ষম লাভের তাড়নায় জেলা পরিষদের স্বপক্ষে হাতেম তাই-এর এত প্রচারণা ? জেলা পরিষদ ভাঙলে হালুয়া-রুটি খাবার স্বপ্ন ভেসে যাবে –- কপাল ভাঙবে এ কারণেই কি এত নাচানাচি ?
ঘ) (৭) “স্থানীয় সরকার পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ... হিল লিটারেচার ফোরামের মত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে ... পার্বত্যবাসী নিক্ষেপ করেছে আস্তাকুঁড়ে।”
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তব অবস্থা তিনি বুঝতে পারছেন না। তাই উল্টাপাল্টা বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলা শুরু করেছেন। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে এই- হিল লিটারেচার ফোরামের রাডার প্রকাশিত হওয়ায় তথাকথিত স্থানীয় সরকার পরিষদের গোমর ফাঁস হওয়ায় পার্বত্যবাসী তাদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে এবং পরিষদের উচ্ছিষ্টভোগীরাও অনুগ্রহ লোভীদের মুখে চুনকালি লাগিয়ে দিচ্ছে। তাই মতিচ্ছন্ন হয়ে অনেকে প্রলাপ বকতে শুরু করেছে।
ঙ) (১) “সেনাবাহিনী যদি সমস্যা দীর্ঘায়িত করে তাহলে সমস্যাকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য ... হিল লিটারেচার ফোরামের মিঃ মানব মিত্র-রা বা অন্যান্যরা এগিয়ে আসেননি কেন ?”
এগিয়ে যাবার সুযোগ ও ক্ষেত্র কোথায় কিভাবে ছিল সেটা সে সময় হাতেম সাহেব কেন দেখিয়ে দেননি ? সে সময় না বলে এখন অবেলায় কেন সে সব কাসুন্দির অবতারণা করছেন ? পান থেকে চুন খসলে সে সময় যেভাবে লোকজনকে নির্বিচারে ধরে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মাসের পর মাস ঢুকিয়ে রাখা হতো, তাতে কি কোন যুক্তি প্রদর্শনের সুযোগ ছিল ? ? ? তাছাড়া হিল লিটারেচার ফোরামের লক্ষ্য হচ্ছে লিখে কোন সমস্যার স্বরূপ উন্মোচন করা এবং ভুল-ভ্রান্তিকে চিহ্নিত করা। এই নীতিগত অবস্থান থেকে হিল লিটারেচার ফোরাম তখনও এগিয়ে গেছে এবং এখনও এগুচ্ছে।
ঙ) (২) “... অসহায় মানুষ তাদের (মানবমিত্রদের) অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গুচ্ছগ্রামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে।”
কি নির্লজ্জ বেল্লেলাপনা ! মিথ্যাচার ও বিকৃতিরও একটা সীমা আছে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে মানবমিত্ররা মানুষের দুঃখ-কষ্টের ছবি তুলে ধরছেন, সেটাই কি তিনি অসহায় মানুষের উপর অত্যাচার মনে করছেন ? হাতেম সাহেবের মূল্যায়নের ধরণ দেখে তার মানসিক সুস্থতার উপর সন্দেহ জাগছে।
ঙ) (৩) “... নেতৃত্বের দুর্নীতির কারণে (?) জনকল্যাণ সাধন করতে না পারে তাহলে এর বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে তা দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে নেতৃত্বকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করে স ও যোগ্য লোককে নেতৃত্বে আনা যায় তাই বলে স্থানীয় সরকার পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া যায় না।”
তাহলে হাতেম সাহেব পরোক্ষভাবে হলেও জেলা পরিষদের দুর্নীতির কথা ও জনকল্যান না হবার কথা স্বীকার করে ফেলেছেন। কিন্তু তিনি আবারও ভূল করে ফেলেছেন। তার বক্তব্য মনে হয় তিনি নতুন বোতলে পুরাতন মদ ঢালতে চান। তা তিনি চাইতে পারেন, কিন্তু জনগণ পারে না। ত্রুটিপূর্ণ জেলা পরিষদকে মুলোপাদন করে জনগণ তার ধ্বজাধারীদেরও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে চায়।
চ) (১) “সামরিক ও স্বৈরাচারে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জনগণ যতটুকু পিষ্ট হয়েছে পাহাড়ি জনগণ ততটুকু হয়েছে বলে মনে হয় না।”
না জেনে মনগড়া মন্তব্য করা ঠিক নয়। হাতেম সাহেবকে " Life is not ours" রিপোর্টখানি ভালোভাবে পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি।
চ) (২) “পাহাড়িদের হজম করার শক্তি আছে স্থানীয় সরকার পরিষদ। আর তারা হজম করতে চায় জুমল্যা-। সুতরাং পেটের পীড়া  অনিবার্য।”
অত্যন্ত নীচুমানের ও অশোভন উক্তি। এটা মন্তব্যেরও অযোগ্য।
চ) (৩) “মিঃ পল্লব ও তাদের রাডারে কি গণতন্ত্রের কোন ছোঁয়া আছে ? সবই অগণতান্ত্রিক।”
কি ধরনের অগণতন্ত্র তিনি রাডারে দেখতে পেয়েছেন তা তো পরিস্কারভাবে তুলে ধরতে পারেননি। গণতান্ত্রিক দেশের অধিবাসী হিসেবে রাডারের সংশ্লিষ্টরা গণতান্ত্রিক উপায়ে ও অধিকারে লিখতে চেয়েছে। এতে রাডারে অগণতান্ত্রিক বলে তো কোন ব্যাপারই থাকতে পারে না। আদতে তিনি নিজেই বোধহয় গণতন্ত্র সম্পর্কে বুঝেন না। তাই কোনটা অগণতান্ত্রিক সেটাও ধরতে পারেননি। তার এহেন লেজে গোবরে অবস্থার জন্য আমাদের দুঃখ হচ্ছে। আমাদের পরামর্শ- উনি গণতন্ত্র সম্পর্কে ভালোভাবে পড়ুন।
ছ) “পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীদের বসবাসের অধিকার সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৬ নং অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে সে কথা।”
সংবিধানের ৩৬ নং অনুচ্ছেদটি পড়ে হাতেম সাহেব তাহলে এতটুকু বুঝেছেন ? ঐ অনুচ্ছেদে যে “জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে” কথাটিও সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, তার মর্মার্থ কি তাহলে তিনি বুঝতে পারেন নি ? ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতেও সংবিধানের ৩৬ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত অনুরূপ “যুক্তিসঙ্গত বিধি নিষেধ” আরোপিত ছিল। এবং সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত অনুপ্রবেশ ও বসতিস্থাপন বেআইনী এবং অবৈধ। বর্তমানেও সংবিধানের ৩৬ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত “জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ” কথাটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় প্রযোজ্য।
জ) “ইতিমধ্যে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মুখোশ পার্বত্যবাসীর কাছে উন্মোচিত হয়েছে। তাদের গণতান্ত্রিক দাবী হজম করতে না পেরে এর বিরুদ্ধে হরতাল করেছে।”
কেমন হরতাল করেছে নীচের ছবিটা দেখুন। বাড়তি মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। 

আর হাতেম সাহেব পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি কলেজ শাখার সাঃ সম্পাদকের পদত্যাগের কারণ ও যে বিবৃতি উল্লেখ করেছেন- তা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। যেভাবে জোরপূর্বক মিথ্যা বিবৃতি আদায় করা হয়েছে তা সবার জানা। বেশী ব্যাখ্যার দরকার নেই।
ঝ) তিনি “বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের” তথাকথিত মহাসচিবের সাথে সুর মিলিয়ে “পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের” রিপোর্টকে “পক্ষপাতদুষ্ট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উস্কানিমূলক” বলে প্রত্যাখান করেছেন।
যদি রিপোর্টটি সে ধরনের হয়ে থাকে তাহলে তা যাচাইয়ের জন্য দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করা দরকার। কিন্তু ঢাকায় নাগরিক কমিটি কর্তৃক তা পুনঃমুদ্রণের সময় কেন ছিনিয়ে নেয়া হবে ? জনাব শহীদুল্লাহকে নিগৃহীত হতে হবে ? তার মানেটা কি ?
ঞ) বদরুদ্দীন উমরের মতো দেশের একজন স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ, লেখক-বুদ্ধিজীবী রাডারে সাক্ষাকার দেয়ায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করে হাতেম তাই তাকেও একচোট দেখে নিয়েছেন। বদরুদ্দীন উমর নাকি “একজন রাজনীতিক অথচ সংবিধান সম্পর্কে অজ্ঞ ?” আমাদের প্রশ্ন- হাতেম তাই নিজে সংবিধান সম্পর্কে কতটুকু অভিজ্ঞ ? তিনি সংবিধানের ঐ ৩৬ নং অনুচ্ছেদটি পড়েই নিজেকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ মনে করছেন ? এতো কম মিথ্যা আহাস্মক নয়। হাতেম তাই খেই হারিয়ে ফেলে এক পর্যায়ে বদরুদ্দীন উমরকে “বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরীর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে উপদেশ দিতে চেয়েছেন।” সেই আব্দর রহমান চৌধুরী কে ? কি তার আসল পরিচয় ? সেই চৌধুরী এমন কে হয়েছেন যে- সাক্ষাকার দেবার জন্য উমর সাহেবকে তার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে ? তাছাড়া হাতেম তাই এর স্পর্ধা এতটুকু গড়িয়েছে যে-তিনি উমর সাহেবের বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে পর্যন্ত খর্ব করতে উদ্যত হয়েছেন এই উক্তি করে, “তাকে এহেন বিতর্কিত বক্তব্য রাখা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই।” এর জবাবে উমর সাহেবের বক্তব্য হাতেম তাই পরে পাবেন।

শেষ কথা শিরোনামে হাতেম সাহেব অভিযোগ এনেছেন “হিল লিটারেচার ফোরামের নীতি নাকি আগুন জ্বালানোর, নিভানোর নয়।” তার জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই- অন্ধকার দূরীকরণের জন্য যদি আলো জ্বালানোর দরকার হয়, তাহলে তার জন্য তো আগুন জ্বালতে হবে। আলো ছড়াতে হবে। তিনি রাডার সম্পর্কে বিষোদগার সৃষ্টি করতে বলেছেন “রাডারের জনকরা তো পার্বত্যবাসী নন, তারা রাজধানীর বিলাস বহুল জীবনের অধিকারী। তাই তো তারা গণতন্ত্রও বেশী বুঝে, অধিকারও বেশী চেনে।” নিজের বক্তব্যের সমর্থনে কোনরূপ যুক্তি খাড়া করতে না পেরে উম্মুক্ত [উন্মত্ত] হয়ে তিনি অসংলগ্ন কথা বলেছেন। তার সমালোচনা “নেকড়ে ও মেষ শাবক”-এর গল্পটিই মনে করিয়ে দেয়। গণতন্ত্র বুঝলে এবং অধিকার চিনলে- হাতেম তাই এর এত রাগ হবার কারণ কি ? আসলে কিছু নিমক হারামীর দল তো সব সময়ই চাচ্ছেন- পার্বত্যবাসীরা গণতন্ত্র ও অধিকার সম্পর্কে না বুঝে অন্ধকারে ডুবে থাকুক।

সবশেষ, হাতেম তাই গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে কোনরূপ তোয়াক্কা না করে যেভাবে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন ..... “সমূহ বিপদ। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান” আমরা তার এই গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার অশুভ তপরতা ও আপত্তিকর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে রাডারের সাথে সংশ্লিষ্টদের ওপর কিছু হলে আমরা হাতেম তাইকে দায়ী করবো।
পরিশেষে, রাডারকে সমালোচনা করতে চাইলে সুস্থ মস্তিষ্কে গঠনমূলক সমালোচনা করার জন্য আমরা আবারও হাতম তাইকে আহ্বান জানাচ্ছি।


 পৃষ্ঠা: ২৭

গত সেপ্টেম্বর ১৩ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত জার্মানীর হামবুর্গ মিউজিয়াম অব এটনোলজিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত যে ৩য় আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল সে সম্মেলনের একটি প্রেস রিলিজ আমরা পেয়েছি। সেই প্রেস রিলিজের ভাষান্তর ছাপানো হলোঃ

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
উন্নয়ন সাহায্যসমূহ বাংলাদেশে সামরিকীকরণ এবং মানবাধিকার লংঘনে সহায়তা করে।
সম্মেলনে বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার এবং উন্নয়ন সাহায্য। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এক বিরাট অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের বৃহত্তর বাঙালী জনগোষ্ঠী থেকে সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং ভাষাগতভাবে ভিন্ন আদিবাসীদের আবাসভূমি। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের শিকার।
সম্মেলনে কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী পাহাড়িসহ বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসী জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করেন। উক্ত সম্মেলনে কিছু বাঙালী অংশগ্রহণকারীও ছিলেন। সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এছাড়াও মানবাধিকার কর্মী এবং সমাজ বিজ্ঞানীরা বক্তব্য পেশ করেন।

উক্ত সম্মেলনে নিম্নলিখিত সত্য ঘটনাগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়।
·        বাংলাদেশ সরকার অনেকাংশে বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভরশীল (সরকারী ব্যায়ের ৯০ শতাংশেরও বেশী)।
·        বৈদেশিক সাহায্যসমূহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করে (ভতুর্কী দেয়)।
·        যদিও ১৯৯১ সনের ফেব্রুয়ারীতে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো সেনা নিয়ন্ত্রণের অধীন।
·        এই নতুন সরকারও আদিবাসীদের গণহত্যা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রামে (তথাকথিত গুচ্ছগ্রাম) জোরপূর্বক পুনর্বাসন এবং ভূমি বেদখল সম্পর্কিত অভিযোগ নিরসনে ব্যর্থ হয়েছেন।
·        গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও মানবাধিকার লংঘন অব্যাহতভাবে চলছে।
·        সম্মেলনে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ঘটে যাওয়া সামরিক অভিযান, গ্রাম ধ্বংস, হত্যা, ধর্ষণ, বেপরোয়া ধরপাকড়, নির্যাতন, চলাচলে বিধিনিষেধ এবং আদিবাসীদের নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ সম্পর্কিত রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করা হয়। ১৯৯১ -এর ২০শে মার্চ থেকে ২১ শে আগষ্ট পর্যন্ত ২১ টি ঘটনার রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
·        সেনাবাহিনী কর্তৃক গুচ্ছগ্রামগুলিতে খাদ্য সরবরাহে নানা বিধিনিষেধের কারণে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ অবস্থা চলছে। অনেক অনাহারে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
·        সম্মেলনে অংগ্রহণকারীরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে বলেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অব্যাহত মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে তা যেন অতিসত্বর বন্ধ করা হয়। তারা এও বলেছেন যে এ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান হওয়া উচিত এবং সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেয়া উচিত।

সম্মেলনে আদিবাসীদের দাবী দাওয়ার প্রতি সমর্থন দেয়া হয় এবং নিঃশর্তে নি¤œলিখিত দাবীগুলো পূরণের জন্য সুপারিশ করা হয়।
·        সাংবিধানিক নিশ্চয়তার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের স্বায়ত্তশাসন দেয়া।
·        পার্বত্য চট্টগ্রামে সহসা বেসামরিকীকরণ, বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করা।
·        পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী পুনর্বাসন বন্ধ করা।
·        যে সমস্ত বাঙালী অনুপ্রবেশকারীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে আসতে আগ্রহী তাদের পুনর্বাসনের জন্য সম্ভাব্য উন্নয়ন সাহায্য যোগানো।
·        বাঙালী অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা দখলকৃত ভূমি ও সম্পত্তিসমূহ প্রকৃত আদিবাসী পাহাড়ি মালিকদের ফেরত দান।
·        জাতিসংঘের বিশেষ তত্ত্বাবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার তদারকি করা। পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনে যে সকল উন্নয়ন এবং কর্মসূচী ভূমিকা রাখে সে সব উন্নয়ন সাহায্য এবং কর্মসূচী বন্ধ করার জন্য সম্মেলনে পশ্চিমা দাতা দেশ সমূহকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সম্মেলনে ভারত সরকারকেও নিম্নলিখিত সুপারিশ জানানো হয়-
·        বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসকারী ৫৫ হাজারের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উদ্বাস্ত পাহাড়ি জনগণকে শরণার্থীর মর্যাদা দান।
·        এই শরনার্থীদের জীবনের এবং সম্পত্তির নিশ্চয়তা দানের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা। সম্মেলনে আদিবাসী পাহাড়ি এবং বাঙালীদের সমন্বয়ে জাতীয় কমিটি গঠনের সাম্প্রদায়িক প্রস্তাবকে স্বাগত জানানো হয়। এই জাতীয় কমিটি মানবাধিকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য কাজ করবে। এই জাতীয় কমিটিকে গত বছরের প্রথম দিকে গঠিত ইউরোপে জুম্ম পিপলস নেট ওর্য়াকস -এর মাধ্যমে সহায়তা দান করা হবে। 

বিস্তারিত তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুনঃ
Jumma peoples Network in Europe
C/o International Work Group on Indigenous Affairs                                           Fiolstraede 10
1171 DK Copenhagen K.                                                                                        Denmark.                                                                                               
Phone – 45 33 124724
Fax – 45 33 147749

বা

Organising Committee Chittagong Hill Tracts                                                               Campaign                                                                                                                           P.O. Box – 11699                                                                                                             1001 CR Amsterdam                                                                                                         The Netherlands.                                                                                                   
Phone – 31 20 6629953

পৃষ্ঠা: ২৮

প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নিকট ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলফ্রেড টেলক্যাম্পার -এর চিঠি।

পার্লামেন্ট ইউরোপিয়ান                                                               প্রধান মন্ত্রী               
৯৭-১১৩ রু বেলির্য়াড                                                                মিসেস্ বেগম খালেদ জিয়া
এম, এ, ই ৭২৬                                                                       প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়, 
১০৭০ ব্রাসেলস                                                                        ঢাকা,  
 বেলজিয়াম।                                                                            বাংলাদেশ।

২০ শে সেপ্টেম্বর ১৯৯১

ডিয়ার মিসেস প্রধানমন্ত্রী,
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে ১৯৯০ -এর ডিসেম্বরে আমি বাংলাদেশ সফর করি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাঙ্গালী বসতিস্থাপনকারীদের দ্বারা মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগসমূহ তদন্ত করার জন্য এই মানবাধিকার কমিটির উদ্দেশ্য ছিল। আমাদের কমিশন “জীবন আমাদের নয়” শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ এবং সফরের তথ্য উল্লেখ করেছি। বর্তমানে আমি জানতে পারলাম, বাংলাদেশে এই রিপোর্ট সরবরাহকারী মানবাধিকার কর্মীদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ নাগরিক কমিটির মিঃ এস, এম, শহীদুল্লাহ ও রাশেদুর রহমান তারাকে পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার মিঃ তাবিবুর রহমান কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদ এবং হুমকি দেয়া হয় এবং আমাদের “জীবন আমাদের নয়” রিপোর্টের ৯৬০ কপি বাজেয়াপ্ত করা হয়। আমার জানা মতে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের রিপোর্ট বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয় এবং সেহেতু এই রিপোর্টের পুনঃপ্রকাশ বা বিতরণ বেআইনী নয়। সবিনয়ে আপনাকে এই তথ্য অবগত করছি যে আমাদের কমিশনের সফর ছিল সম্পূর্ণ বৈধ এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এই সফর সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু যদি এই রিপোর্ট বিতরণ নিষিদ্ধ হয়ে থাকে তবে তাতে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও তথ্য বিনিময়ের মত মৌলিক মানবাধিকার লংঘিত হবে।

সুতরাং উপরোল্লেখিত মিঃ শহীদুল্লাহ এবং মিঃ তারাকে ভীতি প্রদর্শন ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমি জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এই রিপোর্টের জন্য পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা বা বাংলাদেশের অন্য সরকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশী নাগরিকদের হয়রানী বন্ধের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।
যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের রিপোর্ট নিষিদ্ধ হয়ে থাকে তবে অনুগ্রহ পূর্বক আমাকে অবগত করান। আমি কমিশনের সকল সদস্যদের পক্ষ থেকে এই রিপোর্ট বিতরণের ক্ষেত্রে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করার জন্য আপনাকে এবং আপনার সরকারকে আহ্বান করছি। এই রিপোর্ট ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে এবং ইউরোপিয়ান কমিশনে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষন করতে পেরেছে। আমি নিশ্চিত যে জাতীয় সরকারসমূহ এবং ইউরোপিয়ান কমিশন বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং এই পরিস্থিতির আলোকে তারা পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

ধন্যবাদান্তে
উইলফ্রেড টেলক্যাম্পার


পৃষ্ঠা: ২৯ - ৩১

আন্তর্জাতিক
পেরুর গণযুদ্ধই বিশ্ব বিপ্লবের নতুন অগ্রযাত্রা
-         মিঃ পল্লব

“পেরু” হচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার একটি দেশ। কৃষি প্রধান এই দেশটির উত্তর-দক্ষিণ প্রলম্বিত ভাবে সমগ্র মধ্যভাগ জুড়ে রয়েছে সুউচ্চ আন্দেজ পর্বতমালা, যার সবটাই সবুজ অরণ্য দ্বারা আচ্ছাদিত। দেশের অবশিষ্টাংশ নদী বিধৌত সমতল ভূমি। রাজধানী হচ্ছে লিমা। এই পার্বত্যাধিক্য দেশটির মোট আয়তন ১৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। মোট ২৫টি Department বা রাজ্যে বিভক্ত। প্রতিটি Department আবার কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে। পেরুর বর্তমান লোকসংখ্যা ২ কোটি ৩০ লক্ষ। কু-ই-চুয়া আর স্প্যানিশ হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের ভাষা।

তেল, তামা, রূপা, লৌহা, সীসা, দস্তা, বিসমাথ, সোনা, পারদ, ট্যাংষ্টেন ও ইউরেনিয়াম ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশের মানুষ আজ বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত। উপরোক্ত প্রাকৃতিক সম্পদই যেন পেরুর জনগণের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তখনকার স্পেনীয় সরকারের। তাই ১৫শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পেরুর জনগণের উপর নেমে আসে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবা। গ্রাস করে নেয় সমগ্র পেরু। সুদীর্ঘ ৩শত বছর ধরে পেরুর মেহনতি জনগণের উপর চলে স্পেনীয় বর্বর উপনিবেশিক শোষণ নির্যাতন। কিন্তু পেরুর জনগণ সেই দানবীয় অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে ১৮২১ সালের ২১শে জুলাই স্পেন তার সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত গুটিয়ে নিলেও প্রকৃত মুক্তি আসে ১৮২৯ সালের দিকে আয়াকুচো রাজ্যে সংঘটিত এক ইতিহাসখ্যাত যুদ্ধের মাধ্যমে। স্পেনের উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেলেও তার চেয়ে আরও হিংস্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পেরুর জনগণের উপর নতুন করে চেপে বসে। আজও পেরুর মেহনতি জনগণ মুক্তি লাভ করতে পারেনি সেই তথাকথিত ইয়াংকী সভ্যতার কালো হাত থেকে। বর্তমান বিশ্বের তথাকথিত গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা ও বিশ্ব শান্তির প্রবক্তা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নির্লজ্জভাবে দমন পীড়ন চালাচ্ছে পেরুর জনগণের উপর। ষাটের দশকের শেষের দিকে ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের কালো হাতও পেরুর জনগণের উপর প্রসারিত হয়। যার ফলে ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবার সৈন্যে[র] উপস্থিত ঘটে। কৃষি অর্থনীতি নির্ভর পেরু এখন বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের করাল থাবায় ক্ষত-বিক্ষত। কৃষি অর্থনীতি থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান দেশীয় সামান্ত, মুসুদ্ধি বুর্জোয়া ও বহুজাতিক কোম্পানীদের হাতে।

এই YANKEE (মার্কিন) সাম্রাজ্যবাদসহ সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, এবং দেশী সামন্ত ও মুসুদ্দি বুর্জোয়াদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে প্রকৃত জনগণের সরকার কায়েম করার জন্য পেরুর জনগণ সুদীর্ঘকাল ধরে কমরেড মাও নির্দেশিত “গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও” নীতির ভিত্তিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, ও মাওসেতুং চিন্তাধারার আদর্শকে উর্ধ্বে তুলে ধরে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে যাচ্ছে পেরুর মেহনতি জনগণ। বর্তমান বিশ্বে যেখানে কমিউনিজমের এক বিরাট সংকটময় মুহুর্ত; ঠিক সময়ে পেরুর জনগণ প্রমাণ করে দিচ্ছে সঠিকভাবে মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাওসেতুং-এর চিন্তাধারার আদর্শে সজ্জিত কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করার কোন শক্তি এই পৃথিবীতে নেই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মত পরাক্রমশালী শক্তির সম্মুখে পেরুর গণযুদ্ধ আজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কোনঠাসা হয়ে পড়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক লালিত কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট আল বার্তো ফুজিমোরো ও তার সরকার। তাই অনন্যোপায় হয়ে তার লালিত পুত্রকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রেরণ করেছে গেরিলা যুদ্ধ বিরোধী বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত এবং ভিয়েতনাম ও পানামায় কুখ্যাতি অর্জনকারী “গ্রীন বেরেট” সেনা দলকে। এই গণযুদ্ধের নেতৃত্বে রয়েছে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি (PCP)। আজ যার নেতৃত্বে পেরুর গণযুদ্ধ উত্তর উত্তর বৃদ্ধি ঘটছে তিনি হচ্ছেন কমরেড আবিম্যাল গুজমান। যার পরিচয় কমরেড গণজালো নামে। পিসিপি সংগ্রামের বর্তমান যে স্তরে উপনীত হয়েছে, তার পিছনে রয়েছে সুদীর্ঘ এক উত্তান পতনের ইতিহাস। এই সামান্য পরিসরে যদিও পিসিপি-এর বিস্তারিত ইতিহাস বর্ণনা করা সম্ভব নয়, তথাপি মোটামুটি ধারণাটা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করবো।
পিসিপি এর আনুষ্ঠানিক জন্ম ১৯২৮সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তরুণ মার্ক্সবাদী জোসে কার্লোস ম্যারিয়েতে গুই । এই ক্ষণজন্মা বিপ্লবী মানুষটির রোগে মৃত্যু ঘটে পাটি প্রতিষ্ঠার দুবছর পরে। অর্থা ১৯৩০ সালে। তার জীবদ্দশায় লেনিন-ষ্টালিন প্রতিষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিকে সদস্য পদ লাভ করে পিসিপি। কিন্তু কমরেড ম্যারিয়েতে গুই যে স্বপ্ন নিয়ে পাটি গঠন করেছিলেন, তার মৃত্যুর পর, সেভাবে আর পার্টি পরিচালিত হয়নি। সংশোধনবাদে অধঃপতিত হয়ে নির্বাচন পন্থী সংসদীয় রাজনীতি ও অভ্যুত্থানের লাইনের নামে পিসিপি বৈপ্লবিক সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলে। পার্টি চলতে থাকে সুবিধাবাদী ধারায়। ১৯৫৩ সালে কমরেড স্টালিনের মহাপ্রয়ান ঘটলে ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিও সংশোধনবাদে অধঃপতিত হয়। যার ফলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কমরেড মাও সেতুঙের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মহা বিতর্ক Great Debate গড়ে তুলে। এই মহা বিতর্কের সময় পিসিপি দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারপর হতে চলতে থাকে দু’ ধারার মতাদর্শগত সংগ্রাম। মাও সেতুঙ চিন্তাধারার আদর্শে উজ্জীবিত একান্ত বিপ্লবীরা কমরেড গনজালোর নেতৃত্বে মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ ও মাওসেতুঙ চিন্তাধারার পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে এবং শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। ১৯৬৪ সালে ক্রুশ্চেভপন্থী সংশোধনবাদীরা পার্টি থেকে বহিস্কৃত হয়। তারপর হতে পার্টিকে পুনর্গঠনের জন্য আত্মনিয়োগ করেন বিপ্লবীরা। পিসিপি ম্যারিয়েতে গুই এর লাইনকে পর্যালোচনা করে তাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে। এবং পেরুর আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ও ভৌগৌলিক অবস্থার সাথে সংগতি রেখে মাও এর প্রদর্শিত গণযুদ্ধের লাইনকে আকড়ে ধরে।

কমরেড গনজালো ছিলেন শিক্ষক। আয়াকুশো রাজ্যের হুয়ামাঙ্গা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক কমরেড গনজালোর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে “ব্যানডেরা রোজা” বা লাল পতাকা নামে একটি কমিউনিস্ট গ্রুপ ভেঙ্গে পিসিপি এর নতুন ভ্রুণ জন্ম নেয়। যার পরিচয় “মেণ্ডেরো লুসি নোসো” সাইনিং পাথ বা অলোকোজ্জ্বল পথ। ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে পার্টি কেন্দ্রীয় কাজ হিসেবে নির্ধারণ করে শ্লোগান তুলে “সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হও”। এই শ্লোগানকে সম্মুখে রেখে ম্যারিয়েতে গুই এর সূত্রবদ্ধ “সাধারণ রাজনৈতিক লাইন ও সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন” গৃহীত হয়। এবং ৭৮ সালের কমরেড গনজালো অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে আত্মগোপন করেন এবং পার্টিকে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৯ সালে পার্টির নবম প্লেনামে সশস্ত্র সংগ্রামকে কেন্দ্রীয় কাজ হিসেবে গ্রহণ করে ঘোষণা করা হয় - “সশস্ত্র সংগ্রাম সূচনা কর”। ১৯৮০ সালে ১৭ মে “সশস্ত্র সংগ্রাম আরম্ভ করুন” এই শ্লোগানের ভিত্তিতে গণযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। তারপর দিন অর্থা ১৮ মে তারিখে আয়াকুশো রাজ্যের চুমকি ভোট কেন্দ্রে প্রথম সশস্ত্র হামলা হয়। একই বছরে চীনের দুতাবাসের সামনে একটি মৃত কুকুর ঝুলিয়ে রাখে এবং মৃত কুকুরের গলায় ঝুলানো ছিল “দেং শিয়া পিং” এর নাম। এভাবে পেরুর গেরিলারা সশস্ত্র সংগ্রামের শুরুতে নয়া সংশোধনবাদের উপর আঘাত হানলেন। তারপরই বিভিন্ন দুতাবাসে ও সরকারের উপর আক্রমন চালানোর মধ্য দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপকতা দেখে ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট বেলা উন্দে বিপ্লবীদেরকে দমানোর জন্য প্রথম সারির সেনাবাহিনী মাঠে নামালেন। শুরু হয় জনগণের উপর দমন পীড়ন। এই দমন পীড়নের সময়েই পিসিপি গঠন করে জনগণের নিজস্ব বিপ্লবী বাহিনী " "Peoples Guerrilla Army (PGA)"। জনগণের বিপ্লবী গণযুদ্ধকে ধ্বংস করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ “মাদক বিরোধী অভিযান” এর ধুয়া তুলে ফুজিমোরো সরকারকে ঋণ, অনুদান, সামরিক সাহায্য বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয়। এত কিছু আয়োজন করা সত্ত্বেও পরিস্থিতি আয়ত্ত্বে আনতে না পেরে রাজধানী লিমা সহ ৯ টি ডিপার্টমেন্ট-এ জরুরী আইন জারী করতে হয়েছে। “একজন সেণ্ডোরা বিপ্লবী গেরিলাকে খুঁজে বের করার জন্য প্রয়োজনে ১০ জন নিরিহ জনগণকে হত্যা করার” নীতি পেরুর প্রতিক্রিয়াশীল সরকার হাতে নিয়েছে। ১৯৮১ হতে ৯১ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে পিসিপি নেতা কর্মী সহ প্রায় ৩০ হাজারের অধিক জনগণ শহীদ হয়েছেন। বন্দী শিবির গুলোতে চলছে নিয়মিত হত্যাকা-। সেভিয়েত সমর্থিত পেরুর প্রতিক্রিয়াশীল সরকার প্রধান এলাগার্সিয়া পিসিপি বন্দী নেতা ও কর্মীদের হত্যা করার জন্য সমগ্র দেশের বন্দী শিবিরগুলো থেকে বাছাই করে রাজধানী লিমার তিনটি জেলে একত্রিত করার ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে। এই ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা বন্দীরা বুঝতে পেরে ১৯৮৬ সালে অন্যান্য বন্দীদের সহায়তায় লুরিগাস্নো, এবং নারী বন্দী শিবির মল্লাও এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। নিজের হাতে যা আছে তা দিয়ে তারা লেলিয়ে দেয়া সৈন্য বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং সরকারী বাহিনী হতে কেড়ে নেয়া হাতিয়ার নিয়ে ৬ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করে। পরে সরকার বিমান, গানবোট ও কামান থেকে অবিরাম গোলা বর্ষণের মধ্য দিয়ে তিনটি বন্দী শিবির ধ্বংস করে। এতে প্রায় তিন শতাধিক বিপ্লবী বন্দীকে হত্যা করা হয়। ১৯ জুন দিনটি পেরুর বিপ্লবী জনগণ " Day of Heroism" বা বীরত্বের দিন হিসেবে পালন করে। পিসিপি কর্তৃক আহুত ১৯৯০ মার্চের বন্ধ বানচাল করার লক্ষ্যে সরকার রাজধানী লিমা’র এক বস্তী এলাকার জন সমাবেশের উপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে ১১ জনকে হত্যা করে। এসব দানবীয় শাসনের বিরুদ্ধে পেরুর জনগণ শুধু নিজের উপর আস্থা রেখে কোন বিদেশী সাহায্য ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ সহ বিশ্বের সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পেরুর জনগণ যে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন, তার একমাত্র তত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাওসেতুঙ চিন্তাধারার বাস্তব প্রযোগ।       

১৯৯০ সালের এপ্রিলে PGA -র কয়েক শত গেরিলা জনগণের সক্রিয় সহযোগিতায় হুয়ালাঙ্গা রিভারভ্যালির সান্টলুসিয়া’র শক্তিশালী ও সুরক্ষিত মার্কিন যুদ্ধ ঘাটি আক্রমণ করে। এতে সাতটি মার্কিন হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়। ১৯৮৯ সালে জুলাই মাসে ইয়ানুকো ডিপার্টমেন্ট এর সবচেয়ে সুরক্ষিত মাদ্রিয়ার সেনা ঘাটি দখল করে নেয়। চার ঘন্টা স্থায়ী যুদ্ধে প্রায় দেড় শতাধিক সৈন্য হতাহত হয় এবং প্রচুর পরিমাণ গোলা বারুদ দখল করে নেয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা আক্রমণের কারণে ফুজিমোরো সরকার এখন ব্যাতিব্যস্ত। PCP এর মতে পেরুর বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা আধা-সামান্ততান্ত্রিক, আধা-উপনিবেশিক। পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির আসল লক্ষ্য হচ্ছে মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদকে সামনে রেখে পেরুর বাস্তব অবস্থানুসারে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধান করার লক্ষে নিম্নলিখিত কর্মসূচী গ্রহণ করা। সশস্ত্র গণযুদ্ধের পদ্ধতি হবে গ্রাম দিয়ে শহর দখল করা এবং তারই ভিত্তিতে -
(১) সাম্রাজ্যবাদের শাসন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। প্রধানতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ সহ সকল সাম্রাজ্যবাদের মুলোপাটন করা। (২) আমলাতান্ত্রিক পুজিবাদ ধ্বংস সহ দেশের এবং দেশের বাহিরে একচেতিয়া পুঁজি বাজেয়াপ্ত করা। (৩) সামন্ততান্ত্রিক ভূমি মালিকানা ধ্বংস করা “লাঙ্গল যার জমি তার” ভিত্তিতে কৃষকদেরকে জমি বন্টন করা এবং শর্ত সাপেক্ষে মাঝারী বুর্জোয়াদেরকে সমর্থন দেয়া। বিপ্লবী সশস্ত্র গণযুদ্ধের মাধ্যমে পুরানো রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধ্বংস করে নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা। উপরোক্ত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পেরুর গণযুদ্ধ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আন্দেজ পর্বতমালা ও দীর্ঘ নদী অববাহিকা থেকে পশ্চিমের প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত গেরিলাদের মুক্ত ঘাটি এলাকা গড়ে উঠেছে। PCP এর পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার গণ কমিটি। প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের প্রশাসনের পরিবর্তে নিজস্ব বিপ্লবী সরকারের  প্রশাসন চালু রয়েছে। ভূমি সংস্কার ও উপাদন ব্যবস্থার পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছে নতুন অর্থ ব্যবস্থা। ধর্মীয় মৌলবাদ ও সামন্ত প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের পরিবর্তে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন শিল্প-সংস্কৃতি। প্রতিদিন প্রসারিত হচ্ছে নতুন নতুন ঘাটি এলাকা। যে কোন মূহুর্তে সাম্রাজ্যবাদের কালো শাসন ভেঙ্গে গোটা দেশ ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হতে পারে জনগণের সরকার। পেরুর বিপ্লবী যুদ্ধকে বিশ্ব বিপ্লবে পরিণত করার লক্ষে " Revolutionary International Movement (RIM)) ১৯৯১ সালকে " 1991 Year of the International Solidarity with the Peoples War in Peru" বা পেরুর গণযুদ্ধের সাথে আন্তর্জাতিক সংহতি বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এতে শ্লোগান তোলা হয়েছে " Yankee go home" (মার্কিনীরা হাত গুটাও)। দেশে দেশে সত্যিকার বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো পেরুর গণযুদ্ধের সাথে সংহতি গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশেও গড়ে উঠেছে “পেরুর গণযুদ্ধ সংহতি পরিষদ” নামে একটি কমিটি। ফ্রান্স, স্পেন, মেক্সিকো, নেপাল, ভারত, আমেরিকা ও ইতালী সহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কমিটি গড়ে উঠেছে।

----------------------------------------------------------------------------------------------------

ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের পক্ষে, অন্যায়, অত্যাচার তথা প্রচলিত অপশাসনের নারকীয় অবস্থা থেকে নিস্কৃতির সাহসী সংগ্রামে যারা আপোষহীন, সুবিধাবাদী লেজুড়দের যারা ঘৃণা করে তারাই আমাদের সহযোদ্ধা। সুতরাং শুধু তারাই এসো শংকাহীন দৃপ্ত চেতনায় অনির্বাণ মশাল নিয়ে আমাদের প্রতিবাদী ব্যানারে।

প্রতিনিধি/সংবাদ দাতা/রিপোর্টার/বিক্রয় এজেন্ট-এর আবেদন পত্র

প্রিয় সম্পাদক                                                                                                          
 রাডার (RADAR)

আমি আপনাদের “রাডার” প্রকাশনার সাথে প্রতিনিধি/সংবাদ দাতা/রিপোর্টার/বিক্রয় এজেন্ট হিসেবে সম্পৃক্ত হতে চাই। এ প্রেক্ষিতে আমি আমার প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ পূরণ করে পাঠালাম।

নামঃ                                                   পিতার নামঃ
পেশাঃ                                                   যোগ্যতাঃ
যোগাযোগের ঠিকানাঃ                                                                                                                                                       
আবেদনকারীরর স্বাক্ষর
বিঃদ্রঃ    আগ্রহীরা অবশ্যই শুধুমাত্র এই ফরম পূরণ করে কেটে পাঠাবেন। অন্য কোন ফরমে আবেদন গ্রহণ করা হবে না।



পৃষ্ঠ মলাট
মূল্য ৫.০০ টাকা মাত্র

শুধুমাত্র খাদ্য গ্রহণ, নিদ্রা এবং যৌন জীবনে যার সন্তুষ্টি, যার জীবনের পরিধি এর বাইরে যায় না - যার জীবন - স্বার্থকতা মানে হচ্ছে আরও বেশী ভোগ, তার জীবনকে মার্কস বলেছিলেন গরুর জীবন। পশুর জীবনের সাথে তার পার্থক্য কি ? পশুর সঙ্গে মানুষের তফা, মানুষ সৃষ্টিশীল, মানুষ নিজের জীবনকে  পরিবর্তন করতে পারে। মানুষ প্রকৃতির নিয়ম জেনে তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে মানব সমাজকে উন্নততর অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। মানুষ শুধু নিজেকে নয়, পরিপার্শ্বকে পরিবর্তন করে, করতে চেষ্টা করে। যে সমাজ আর পরিপার্শ্বের মধ্যে আমরা বসবাস করি সেখানে যে নির্বিকার থাকতে পারে তার সঙ্গে পশুর জীবনের পার্থক্য নেই। নিজেদের মধ্যকার ঘুমন্ত সৃষ্টিশীলতা, উদ্যম এবং মানবিক গুণাবলীকে শৃংখলমুক্ত করার এই সময়। মহাক্ষমতাধর মানুষ যদি জেগে না উঠে তবে পরাক্রমশালী অমানুষের বীভস থাবার নীচে তাকে পীষ্ট হতেই হবে। আজকের তরুণ নিশ্চয়ই সেই মানুষ, যে এ অবস্থাকে কোন মতেই মেনে নেবে না।                        
                                                                        - আনু মুহাম্মদ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন