পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩ মে, ২০১৭

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ৫-৮

মানবাধিকার
পার্বত্য চট্টগ্রাম মানবাধিকার লংঘনের স্বর্গপুরী

[সুষ্টু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে কথিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। জেল-জুলুম, শারীরিক নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি-সংযোগ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হামলা-ইত্যাদি ঘটনার খবর আমাদের হাতে অহরহ আসছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের খবরগুলো এই কলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। - সম্পাদনা পরিষদ]

মাটিরাঙ্গা
মাটিরাঙ্গায় দুর্গাপূজা উসব পণ্ড দুর্গাদেবী প্রতিমাসহ গনেশ-কার্তিকের মূর্তি ভাঙচুর ঠাকুরবাবা প্রহৃত
মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। ১৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার ৯১ ইং। “গোমতী সর্বজনীন কালি মন্দির কমিটি” কর্তৃক বিপুল উসাহ উদ্দীপনা ও ভক্তি সহকারে যে “সারদীয় দুর্গা পূজা” আয়োজন করা হয় তা ভন্ডুল হয়েছে।
দুর্গোসবের ৮/১০ দিন পূর্বে প্রতিমাগুলো রঙ করানোর উদ্দেশ্যে রৌদ্রে শুকোতে দিলে স্থানীয় অনুপ্রবেশকারীরা রাতের অন্ধকারে সেগুলো ভাঙচুর করে দেয়। এতে দুর্গাদেবীর প্রতিমাসহ গনেশ-কার্তিক প্রভৃতি মূর্তিগুলোর হাত-পা ভেঙ্গে যায়। উক্ত ঘটনার সুবিচার পাবার আশায় পূজা উদযাপনকারীরা স্থানীয় ক্যাম্পের অধিনায়কের শরণাপন্ন হলে তাদেরকে ৫০০/৬০০ টাকা দিয়ে ফের দেয়া হয়। সুবিচার না পেয়ে তারা বিফল মনোরথে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ক্ষোভে-দুঃখে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তারা আবারও মূর্তি নির্মাণ করে কোন মতে উসবের আয়োজন সম্পন্ন করেন।
কিন্তু অত্যাচার উপীড়নে তাদের সমস্ত আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যায়। পূজা মহোসব চলাকালে মোঃ দুলাল মিয়া নামের এক বেআইনী অনুপ্রবেশকারী পাণ্ডা সন্দেহজনকভাবে মন্দির এলাকায় সারাদিন ঘোরাফেরা করে। সন্ধ্যায় মদ্যাসক্ত অবস্থায় সে প্রাক্তন ওয়ার্ড মেম্বার বিপ্র কুমারের বাড়ীতে যায় এবং বাসরিক পূজার আহার আয়োজনকালে মহোসবের উপাসক ঠাকুরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে অবমাননাকর কথাবার্তা বলে মিথ্যা সংবাদ দেয়। মহোসবের উপাসক ঠাকুর শান্তিবাহিনীদের সাথে বসে খাওয়া-দাওয়া করছে বলেও ষড়যন্ত্রমূলক রিপোর্ট দেয়। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন সহসা বিপ্র কুমারের বাড়ীতে চড়াও হয়ে ঠাকুরবাবাকে নির্বিচারে মারধোর করতে থাকে। এলাকার জনৈক ব্যক্তি তাতে আপত্তি জানালে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন তাকেও নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করে।
উক্ত ঘটনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়াও এলাকাবাসীদের মনে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে যেভাবে ধর্মীয় উপীড়নের মাত্রা বেড়ে চলেছে তাতে পাহাড়িদের মন বিষিয়ে উঠছে। নিজেদের আচার-প্রথা ও রীতি অনুসারে কোন সামাজিক অনুষ্ঠান করতে গেলে যেভাবে প্রতিবন্ধকতা আসছে তাতে মাটিরাঙ্গা উপজেলার পাহাড়ি জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ। জানা গেছে, অনুপ্রবেশকারী দুলাল মিয়া নাকি স্থানীয় ক্যাম্পে মিথ্যা বানোয়াট রিপোর্ট দিয়ে এলাকাবাসীদের হয়রানী করছে। এ ব্যাপারে এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছে।  [সংবাদটি মাটিরাঙ্গা থেকে প্রেরিত]

বুড়িঘাট
গণভোটের তিন দিন পূর্বে ৬ বছরের নিরপরাধ শিশুর জীবন অকালে ঝরে গেল
কাঠালতলী। রাঙ্গামাটির নানিয়াচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের এক নিভৃত শান্ত পল্লী। গণভোটের আয়োজনে সারা দেশবাসী সে সময় ব্যস্ত। সংসদীয় ব্যবস্থার সমর্থনে রায় দিতে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল দিনটির। তার ৩ দিন পূর্বে ১৪ই অক্টোবর এই কাঠালতলীর নিভৃত পল্লীতে অত্যন্ত নির্মমভাবে ৬ বছরের নিরপরাধ শিশু খুন হয়েছে।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গণভোটের নিরাপত্তা বিধানের অজুহাতে বুড়িঘাট ক্যাম্প কমা-ারের নেতৃত্বে ৮ম ইঃ বেঙ্গলের একদল সেনা কাঠালতলীতে মোতায়েন করা হয়। ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টায় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে হতভাগিনী শিশু সেবিকা চাকমা তার মা’র সাথে বাড়ীর বাইরে আসলে ডিউটিরত সেনাদের নির্বিচার গুলি বর্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একটি নিষ্পাপ শিশুর জীবন এভাবে জিঘাংসার নেশামত্ত সেনাদের হাতে অকালে ঝড়ে গেল।
সেবিকা চাকমা নিহত হলে ঐ গোলাগুলির শব্দে ভীত সস্ত্রস্ত গ্রামবাসী আশ্রয় খোঁজার জন্য এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকলে, তাদেরও ডিউটিরত নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন ধরে ফেলে এবং নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করে ছেড়ে দেয়। নিহত শিশুর লাশও তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
ঘটনার পরের দিন নিহত শিশুর শোকাহত পিতা জয় কুমার চাকমা, নিকট আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসী মৃত সকারের উদ্দেশ্যে লাশ আনতে গেলে তাদেরকে কড়াভাবে শাসানো হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন তাদের সামনে লাশ দাহ করার জন্য চাপ দেয়। অন্য কোথাও নিয়ে গেলে সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং আর্মি ক্যাম্পের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ঢুকিয়ে রাখার হুমকি দেয়া হয়। এমনকি গ্রামশুদ্ধ মেরে ফেলারও ভয় দেখায়। ইতিপূর্বে নিরাপত্তা বাহিনীরা ঐ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে বলেও দম্ভোক্তি করে এবং বাড়াবাড়ি না করার জন্য গ্রামবাসীকে সাবধান করে দেয়।
পরে ইলেকশন ডিউটিরত প্রিসাইডিং অফিসার ও বুড়িঘাট ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে “সেবিকা চাকমা নিরাপত্তা বাহিনী ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়ের সময় নিহত হয়েছে”-এই মর্মে জোরপূর্বক লিখিত আদায় করে। এ ধরনের মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক ও বর্বরোচিত ঘটনায় কাঠালতলী গ্রামবাসী নিজেদের জীবন নিয়েও শংকিত হয়ে পড়েছে। আইন শৃঙ্খলাহীন এদেশে কিভাবে যে মানুষ থাকবে তাতে গ্রামবাসী উদ্বিগ্ন। [সংবাদটি নানিয়াচর থেকে প্রেরিত]

উল্টাছড়ি
একই সাথে মা ও মেয়ে ধর্ষিতা, নারী নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে
গোলক্যাপাড়া, মহালছড়ি উপজেলা। ২৪ অক্টোবর ৯১ইং। মহালছড়ি জোনের ২৪ ইঃ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ২৭ ইঃ বেঙ্গল রেজিমেন্ট যৌথভাবে এক অপারেশন চালাতে গেলে সমস্ত বর্বরতাকে ছাড়িয়ে একই সাথে মা ও মেয়ে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পাশবিক হামলার শিকার মিসেস্ রংপতি চাকমা (৩২) স্বামী বৈকুন্ত চাকমা ও তার কিশোরী মেয়ে মিস্ চঞ্চলা চাকমা (১৫) বর্তমানে মানসিক ও শারিরীকভাবে বিপর্যস্ত বলে জানা গেছে।
উক্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনার সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মান-ইজ্জত নিয়ে মানুষ যখন সমাজে চলতে-ফিরতে পারছে না স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে ক্ষোভ ও বিদ্রোহের আগুন ধুমায়িত হচ্ছে। রিপোর্টটি উল্টাছড়ি প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে “রাডার” -এ চিঠি লিখে পাঠানো।
ইতিপূর্বে ২৭/৭/৯১ইং মহালছড়ি বাজারে আসার পথে মিস্ স্বপ্না চাকমা (১৬), পিতাঃ সুভাষ চন্দ্র চাকমা, গ্রামঃ লেমুছড়ি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা-মহালছড়ি জোনের অধীন একজন ভি,ডি,পি জোয়ান কর্তৃক ধর্ষিতা হয়েছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, পাশবিক লালসার শিকার স্বপ্না চাকমা জেলা পরিষদ সদস্য রইথি মারমা ও বিভূতি রঞ্জনের কাছে বিচারপ্রার্থী হলে ঐ স্বার্থবাজ দালালরা কোন কিছুই করে দিতে পারেনি। পরে, সুবিচারের আশায় ুড়হব ঙভভরপব -এ শরণাপন্ন হলে তা কাকস্য পরিবেদনায় পর্যবসিত হয়। অদ্যাবধি ঐ ভি,ডি,পি -র বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। [মহালছড়ি থেকে রিপোর্টটি পাঠানো]

উল্টাছড়ি
বুদ্ধ মুর্তি ভাঙচুর বিহারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ
উল্টোছড়ি, মহালছড়ি উপজেলা। ২৪ শে অক্টোবর ৯১ ইং। নিরাপত্তা বাহিনীর ছত্রছায়ায় বেআইনী অনুপ্রবেশকারীরা এখানকার “জনবল সুদর্শন বৌদ্ধ বিহার”-এ উন্মত্তভাবে ঢুকে বুদ্ধ মুর্তি ভাঙচুর করে এবং মূল্যবান সামগ্রী তচনছ করে দেয়। বিহারের বড় বুদ্ধ মূর্তির গলা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সিমেন্টের প্লাষ্টার করা ও মূর্তির ভেতরের দিকটা কাপড় দিয়ে তৈরী বলে কোনমতে তা বসিয়ে রাখা হয়েছে। বুদ্ধ মূর্তির নাকের প্লাষ্টারও উঠে গিয়েছে। পিতলের মূর্তি (গুয়াই) ভারী জিনিসের আঘাতের ফলে নীচের দিকটা ভেঙ্গে যায় এবং মূর্তিতে ভাঙ্গার চির ধরেছে। বিহারে টাঙ্গানো সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তের) আয়না বাঁধানো ছবিও মাটিতে আছড়ে ফেলে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বিহারের দু’টি আলমিরার তালা ভেঙ্গে বহু মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নেয়া হয়েছে।

মাইসছড়ি
নির্বিচারে ধরপাকড় ও প্রহার
মাইসছড়ি, মহালছড়ি উপজেলা। ২৬ শে অক্টোবর ’৯১ইং। বাজারে যারার পথে ধারাস চাকমাকে (পিতাঃ বিরেন্দ্র চাকমা) পথিমধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন আটক করে এবং নিষ্ঠুরভাবে মারধোর করে। বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজারে নিয়ে যাওয়া ৫/৬ টি কলাছড়া ও মুরগী জোর করে কোন দাম ছাড়াই নিয়ে নেয়।
 লাংধা চাকমা (পিতাঃ আলিয়া চাকমা) নামে অপর একজন রাখাল পর্যন্ত ঐদিন রেহাই পায়নি। ঐ নিরাপরাধ রাখালকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে মারধোর করা হয়েছে।
অপর এক খবরে প্রকাশ ঐ দিন অপারেশন থেকে ফেরার পথে দাতকুপ্যা এলাকা থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন অনেক নিরপরাধ মানুষজনকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্বিচারে মারধোর করে ছেড়ে দেয়। এই নির্বিচার মারপিটের শিকার হয়েছেন-
১) তীর্থ মেম্বার (মাইসছড়ি) 
২) চির জ্যোতি চাকমা পিতাঃ সুরেন্দ্রদাল চাকমা।                                                                                ৩) লিটন চাকমা পিতাঃ প্রমোদ রঞ্জন চাকমা।
৪) সাপো চাকমা পিতাঃ কমোদ রঞ্জন চাকমা।
জানা গেছে শুধু পাইকারী মারধোর করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। বাড়ীতে ঢুকে গোলক্যাপাড়া এলাকার নিরীহ জনসাধারণের বাড়ীতে ঢুকে জিনিসপত্র পর্যন্ত তছনছ করে দিয়েছে। [সংবাদটি মহালছড়ি থেকে পাঠানো]

মহালছড়ি
হিন্দু ও বড়ুয়া পরিবার উচ্ছেদ অভিযান
পাহাড়তলী, মহালছড়ি উপজেলা। ১০ আগষ্ট ৯১ ইং। এই গ্রামে বসবাসরত হিন্দু ও বড়–য়া পরিবারদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে উপজেলা সদরের হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী এক নোংরা বিল্ডিং-এ গাদাগাদিভাবে জড়ো করা হয়েছে। বর্তমানে তারা নিজেদের জমিতে চাষ-বাস করতে ভীষণ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ইতিমধ্যে ঝঝঈ পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে কোন পাহাড়ি পরীক্ষার্থী হিন্দু-বড়–য়া ঘরে থাকতে পারবে না বলে জোন থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এলাকায় হিন্দু-বড়–য়া অধিবাসীদের ধারণাপাহাড়িদের সাথে তাদের আন্তরিকতা যাতে গড়ে না উঠে এবং পরীক্ষার্থী রাখার মাধ্যমে তাদের যে কিছু আয় হয় তা থেকে বঞ্চিত করার জন্যই ঐ নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল।

ঘাগড়া
বেআইনী অনুপ্রবেশ অব্যাহত
ঘাগড়া, রাঙ্গামাটি। ২৪ অক্টোবর ৯১ ইং। ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩০ জনের অধিক একটি বেআইনী অনুপ্রবেশকারী দল আশ্রয় নেয়। স্কুলে অবস্থানকালে অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীদের কাছে সাহায্যের জন্য গেলে গোমর ফাঁস হয়ে পড়ে। উত্তরবঙ্গ থেকে ঐ অনুপ্রবেশকারীরা মারিশ্যায় সেটেল হবার জন্য যাচ্ছিল। এভাবে প্রতিনিয়ত লোকচক্ষুর আড়ালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেআইনী অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকায় এই বেআইনী অনুপ্রবেশ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রুমা, লামা, আলিকদম, থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়িতে প্রতিদিন অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ছে বলে জানা গেছে। খাগড়াছড়ি জেলার অবস্থাও করুণ। রামগড় হয়ে প্রতিদিন খাগড়াছড়িতে বেআইনী অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ছে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা- রামগড় উপজেলা ফেনীর সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় এই বেআইনী অনুপ্রবেশ ঘটানো সরকারের সুবিধে হয়েছে। বর্তমানে মানিকছড়ি, মাটিরাঙ্গা, তবলছড়ি, তাইন্দং, কাচালং -- প্রভৃতি এলাকায় বেআইনী অনুপ্রবেশকারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে- ইতিপূর্বে ফেনী হত্যাকাণ্ডের পর উক্ত এলাকাসমূহের পাহাড়িরা বাস্তুভিটা হারিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। ইত্যবসরে অনুপ্রবেশকারীরা তাদের জায়গা জমি দখল করে নিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ- রামগড় থেকে প্রতিদিন বিশেষ বিশেষ বাস-ট্রাক ভর্তি সমতলবাসী খাগড়াছড়িতে ঢুকে পড়ছে। খাগড়াছড়ি কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে সন্ধ্যার দিকে এক চক্কর দিলেই কাঁথা-কম্বল নিয়ে অসংখ্য অনুপ্রবেশকারী চোখে পড়ে। কলেজিয়েট স্কুলের মাঠ, ভাঙ্গা জায়গাগুলোই হচ্ছে তাদের বিশ্রামাগার।
সন্ধ্যা হতে না হতেই খাগড়াছড়ি প্রশাসনের প্রভাবশালী মহল ও বাজারের জনৈক তথাকথিত জনপ্রতিনিধি নাকি অভ্যর্থনা জানাতে কলেজিয়েট স্কুলে আসে। রাতের অন্ধকারে ঐ অনুপ্রবেশকারীদের দীঘিনালা, মেরুং ও পানছড়ি প্রভৃতি এলাকায় চালান দেয়া হয় বলে স্থানীয় জনসাধারণের ধারণা। এধরনের বেপরোয়া অনুপ্রবেশের কারণে স্থানীয় পাহাড়ি জনসাধারণ ও পুরাতন অধিবাসী বাঙালিরাও শংকিত বলে জানা গেছে। কারণ, বেআইনী অনুপ্রবেশকারীরা যে ধরনের সরকারী সুযোগ-সুবিধা ও আনুকূল্য পাচ্ছে সে অনুপাতে পুরাতন বসতিরা পাচ্ছে না। এবং পাহাড়িদের সাথে তাদের সম্ভাবের কারণে প্রশাসনের উর্ধ্বতন মহলে তাদের সন্দেহের চোখে দেখে বলেও জানা গেছে।

খাগড়াছড়ি
পুজগাঙ এলাকায় দু’জন পাহাড়ি যুবক নিখোঁজ
পানছড়িতে ৬ জন বাঙালি নিহত হলে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কালানাল ঘটনাস্থল হতে ব্রজমোহন কার্বারীর ছেলেকে অনুপ্রবেশকারীরা ধরে ইচ্ছেমতো মারধোর করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সে অনুপ্রবেশকারীদের ভয়ে গাছে উঠে লুকিয়ে থাকতে চেয়েছিল। পরে লাফ দিয়ে পালাতে গিয়ে নাকি ধরা পড়ে যায়।
অপর এক যুবককে মির্জাবিল এলাকা থেকে সেনাবাহিনীরা ধরে নিয়ে যায়। পানছড়ি স্কুলে নিয়ে তাকে নাকি ভীষণ মারধোর করা হয়। এলাকার লোকজন দু’জন যুবককে আধমরা অবস্থায় স্কুলে পড়ে থাকতে দেখেছে। পরবর্তীতে তাদের আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায় নি।

রাজস্থলী
প্রহরার জ্বালাতনে রাজস্থলী উপজেলাবাসীর নাভিশ্বাস
রাজস্থলী উপজেলার নিরীহ খেটে-খাওয়া মানুষকে প্রবল শীতের রাতে পাহারা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনীর পর আবার রাত জেগে পাহারাদাসে বাধ্য করায় এলাকাবাসীদের দুর্ভোগের সীমা নেই।
বিগত কয়েক মাস ধরে রাজস্থলী জোন কর্তৃক এই প্রহরা দানের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পাহাড়িদের রাতের বেলায় গাছের লাঠি ছাড়া কিছুই রাখতে দেয়া হয় না। কিন্তু তাতেও পাহারাদারদের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনী সন্দেহমুক্ত নয়। এক রাতে সেনাবাহিনীরা পাহারাদারদের অস্ত্র আছে কিনা তল্লাসী করতে গিয়ে অশোভন উপায়ে লুঙ্গী পর্যন্ত খুলে দেখে। সহজ-সরল গ্রামবাসী এতে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়েছে।

বুড়িঘাটের সাম্প্রতিক ঘটনা
১৫ নভেম্বর ৯১ইং। শুক্রবার। রাঙ্গামাটিতে কঠিন চীবর দান উসব। অমানুষিকভাবে প্রহৃত ঃ 
(১) শান্তানু চাকমা (৩৫), গ্রামঃ বড় কলগ, ডাকঃ বুড়িঘাট, উপজেলাঃ নানিয়াচর। ৮ম বেঙ্গল কর্র্তৃক ধৃত ও নির্মমভাবে প্রহৃত।
(২) রমণী রঞ্জন চাকমা (৩২), গ্রামঃ হাতিমারা, ৪ নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন, নানিয়াচর উপজেলা। প্রহৃত এবং আটকাধীন।                          

ধর্ষণের প্রচেষ্টা ও শ্লীলতাহানিঃ ১৫ নভেম্বর ৯১ ইং।    
(১) রূপায়নের মা (৩১), রবিভূষণ চাকমা। গ্রামঃ বড় কলগ। সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়, পরে কোন মতে টানাহেঁচড়া করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। (২) বসেন্তরী চাকমা (১৪), গ্রামঃ হাতিমারা। শ্লীলতাহানি করা হয়েছে।

দিঘীনালার ঘটনাবলী
নিষ্ঠুরভাবে মারধোর :
(১) ২৫/১১/৯১ ইং। জ্ঞান জ্যোতি চাকমা। রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের ছাত্র। বাড়ী- বড়াদাম। সে উদোলবাগানে চিকিসা করতে গেলে তাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ না করেই বিনাদোষে মারধোর করা হয়েছে। সে ভীষণ জখম হয়েছে বলে জানা গেছে। সেনাদের প্রতিহিংসার আক্রোশে একজন নিরীহ ছাত্র পর্যন্ত রেহাই পেল না।   
(২) ২৪/১১/৯১ ইং। ধানক্ষেতে কাজ করার সময় বাবুছড়া হাইস্কুলের একজন ছাত্রসহ মোট ৭ জনকে বাবুছড়া ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অমানুষিকভাবে শারিরীক নির্যাতন করা হয়। ইতিপূর্বে ধারাস চন্দ্র চাকমাকেও সাংঘাতিকভাবে মারধোর করা হয়েছে।
(৩) বর্তমানে দিঘীনালায় আবল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার জন্য আইডি কার্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটা নাগরিক অধিকার লংঘন।

গুইমারায় নিরীহ গ্রামবাসী গুলিবিদ্ধ
পাইন্দং পাড়া, গুইমারা। রামগড় উপজেলা। ১ অক্টোবর ৯১ ইং। ৩৪ ইঃ বেঙ্গলের সেনারা গুইমারা এলাকায় ব্যাপক অপারেশন চালিয়ে ফেরার পথে নিরীহ গ্রামবাসী রাম কমল চাকমাকে (পিতা নোয়ারাম চাকমা) সেনাবাহিনীরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করেছে।

নিরপরাধ মানুষ গুলিবিদ্ধ
১২ আগষ্ট ৯১ ইং। শান্তিবাহিনীর গোয়েন্দা সন্দেহে মিঃ গোলাধন চাকমা (৫০) কে (পিতাঃ বৃজ কুমার চাকমা) গুইমারা ক্যাম্পে (৩৪ ইঃ বেঙ্গল) জনৈক ক্যাপ্টেন গুলি করে খুন করেছে।

মহালছড়ি
রাডার কেনায় প্রহৃত
মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। ১৫ অক্টোবর ৯১ইং অনিয়মিত সাময়িকী রাডার কিনে পড়ার দায়ে এখানে অনেকে নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। এমনকি শারীরিকভাবে পর্যন্ত নির্যাতিত হয়েছেন। এখানকার জোনের ২৪ ইঃ বেঙ্গল এর মেজর কর্তৃক ৩ জন স্থানীয় পাহাড়ি অমানুষিকভাবে প্রহৃত হয়েছেন। নিগৃহীতারা হচ্ছেন-
১) মং চাই মারমা (সিনিয়র নার্স, মহালছড়ি হাসপাতাল)।
২) প্রতুল বিকাশ খীসা (হোমিও ডাক্তার) পিতাঃ সুধাংশু বিকাশ খীসা, হেডম্যান - কেরেঙ্গানাল।
৩) প্রেমলাল চাকমা (সিনিয়র নার্স, মহালছড়ি হাসপাতাল)। যে পত্রিকার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে, তা কিনে পড়তেও যে ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন তা পূর্বের স্বৈরাচারী শাসনকেই মনে করিয়ে দেয়। নাগরিক অধিকারের ছিটেফোটাও যে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়নি উক্ত ঘটনা তারই প্রমাণ। শুধু পত্রিকা ম্যাগাজিন কিনতে বিধি নিষেধই নয়, মহালছড়ি বাজারে প্রবেশ করতেও বিধি নিষেধ রয়েছে। জোন কর্তৃক ইস্যুকৃত কার্ড ছাড়া কেউই বাজারে প্রবেশ করতে পারে না। জোন এর অনুমতি ছাড়া নিজের ধান-চাল পর্যন্ত কোথাও আনা-নেয়া করা যায় না।

[গ্রন্থনা মিঃ অপ্রিয়]                                                                                                                       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন