পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩ মে, ২০১৭

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ১৪ - ১৫

এম, এন, লারমাকে যেমন দেখেছি
-আব্দুল্লাহ সরকার

সত্তোর দশকের কথা। আজ দীর্ঘ প্রায় দেঢ় যুগ পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার অনেক কথাই বেশ মনে পড়ছে। তকালীন জাতীয় সংসদে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এবং আমি নিজের এলাকা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই। সমসাময়িক রাজনৈতিক জীবনে আমরা পরস্পর খুবই কাছাকাছি ছিলাম। এতে করে তার চিন্তা, চেতনা, রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে কাছ থেকে জানার সুযোগ আমার হয়েছে। তখন সারা দেশের নানাবিধ সমস্যাসহ পার্বত্যাঞ্চলের সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগণের ন্যায্য অধিকার নিয়েও আমরা বিস্তারিত আলাপ করেছি। তিনি বরাবরই নিপীড়িত নির্যাতিত মেহনতি শ্রেণীর দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে জাতীয় সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করতেন। বাংলাদেশের মত একটি অনুন্নত পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কোন রাজনৈতিক ধারণায় সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় তা তিনি গভীরভাবে ভাবতেন। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার সমস্যাকে জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসার গুরুত্ব সম্পর্কে আমি প্রায়ই লারমাকে বলতাম। যেহেতু পাহাড়িয়া এলাকার জনগণ বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোন বিচ্ছিন্ন অংশ নয়, কাজেই তাদের সমস্যা অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণেরই সমস্যা। ৭২ সালে তিনি পাহাড়ি জনগণের চার দফা দাবী শেখ মুজিবর রহমানের নিকট পেশ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, তকালীন সরকার তার দাবী সমূহের মীমাংসা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও বাঙালী জাতীয়তা থেকে ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বকীয় বৈশিষ্টের অধিকারী পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের অস্তিত্বের প্রশ্নে এম, এন, লারমা সুস্পষ্টভাবে যুক্তি দেখিয়েছেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের পর যে সরকারসমূহ ক্ষমতাসীন হয়েছেন তারাও পার্বত্য এলাকার ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতি অনুসরণ করেছে। যেহেতু তাদের শ্রেণীগত চরিত্র অভিন্ন, সুতরাং তাদের শাসন শোষণের প্রকৃতিও এক। এটাই বাস্তব। তাই স্বাধীনতাত্তোর প্রতিটি সরকারই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে একইভাবে চিহ্নিত করে তারই ভিত্তিতে দমন পীড়নের কৌশল অবলম্বন করেছে। ফলে সংখ্যালঘু জনগণের মনে মূল ভূ-খন্ডের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ক্রমেই অবিশ্বাস আর সন্দেহ বেড়েছে বই কমেনি।

আমার ধারণা লারমা কখনোই পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘুদের সমস্যাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে চাননি। তার রাজনৈতিক বক্তব্যে বা আচরণে আমি বিচ্ছিন্নতাবোধের পরিচয় পাইনি। ৭৫ -এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দেশের অবস্থা তখন অস্থিতিশীল ছিল। মূলতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের সমস্যার সাথে একই সূত্রে গাঁথা। সমগ্র বাংলাদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের দাবী দাওয়ার সাথে পার্বত্য জনগণের অধিকারের প্রশ্নও সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং এ সমস্যা একটি জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যু। তাই অবিচ্ছেদ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের অধিকারের সংগ্রামকে অবশ্যই গোটা দেশের মেহনতি জনতার সংগ্রামের অংশে পরিণত করতে হবে। আর এই উপলব্ধি এম, এন, লারমা করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়েছিল। তিনি অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে গিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন নিজের সমস্যার কথা। আশির দশকে তিনি মর্মান্তিভাবে নিহত হন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অনেকটা বদলে যায়। তকালীন এম, পি, জাসদের উপন্দ্রে লাল চাকমার সাথেও আমার কথা হয়। আশি সালে কাউখালীর কলমপতিতে পাহাড়িদের উপর যে হত্যাকা- চালানো হয় সে ঘটনার সত্যানুসন্ধানী দলের (শাহজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন, উপন্দ্রে লাল চাকমা) সাথে আমারও যাবার কথা ছিল কিন্তু নানা অসুবিধার করণে আমার যাওয়া হয়নি।

এম, এন, লারমা খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। তার মধ্যে কোন প্রকার বিলাসিতা আমি দেখিনি। বেশ পড়াশুনা করতে দেখেছি তাকে। মোদ্দা কথা Plain living, high thinking যাকে বলে। পাহাড়ি জনগণের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি সংস্কৃতি এবং স্বতন্ত্র জাতিগত জীবন যাত্রা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভোমত্বের আওতায় এই অবহেলিত জনগণের স্বকীয় অস্তিত্ব, কৃষ্টি, সংস্কৃতি কিভাবে রক্ষা করা যায় তাই ভাবতেন লারমা। পশ্চাদপদ মানুষের একজন সাচ্চা কল্যাণকামী প্রতিনিধি হিসেবে তাদের ন্যায্য দাবী দাওয়ার ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আপোষহীন। শুধু পাহাড়িয়া এলাকার জনগণ নয় দেশের সমগ্র খেটে খাওয়া মানুষের দুরবস্থার কথা তিনি ভাবতেন। সংসদ অধিবেশনে তার বিভিন্ন বক্তব্যে নির্যাতিত, মেহনতি শ্রেণীর মানুষের অধিকারের কথাই ফুটে উঠত। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শোষিত মানুষের দঃখ দুর্দশার প্রশ্নে সহমর্মী এবং উদার প্রকৃতির ছিলেন। স্বাধীনতার পর বিপর্যস্ত অর্থনীতি এ দেশে পুরুষের পাশাপাশি শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নারী সমাজের প্রতি অবহেলার কথা, শোষণ নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে সংসদে তিনি আবেগে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলেন। বাজেট অধিবেশনের সময়ও তার ভাষণে তিনি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের পক্ষেই কথা বলেছেন। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে তিনি বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ করতেন। আমাদের মত পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। এ অব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সেই মানুষদেরই সংগঠিত করে একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সংগ্রাম করতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি সজাগ ছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ভাষাভাষি অনেকগুলো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ন্যায়সংগত দাবী আদায়ের সংগ্রামে এম, এন, লারমা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তার সময়ে সেখানকার অধিকাংশ জনগণের বঞ্চনার কথা তিনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। এ কারণে তিনি পার্বত্য জনগণের অত্যন্ত পরিচিত এবং প্রিয় অবিসংবাদিত নেতাতে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তাই তাকেই তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতধারায় দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন।

পার্বত্য এলাকায় এখনো অব্যাহতভাবে অশান্তি চলছে। ধরপাকড়, সাজা, অমানুষিক নির্যাতন, হত্যা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আমরা সকল প্রকার জাতিগত নিপীড়নের বিরোধীতা করি। অবসান কামনা করি মানবাধিকার লংঘনের। সকল প্রকার নির্যাতনের পথ পরিহার করে শীগ্রই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করে সেখানে সংখ্যালঘু জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রদান করা উচিত। কোন প্রকার অবহেলা আরও প্রাণহানীর জন্য দায়ী  হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অপাহাড়ি জনগণকে হত্যা করেও সমস্যার কোন মৌলিক সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। এতে সরকার জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পারবে। একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করে পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে দীর্ঘ দিনের সমস্যা নিষ্পত্তি করার উদ্দ্যোগ নিতে হবে। এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক উপায়ে এ সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের দায়িত্ব সরকারকে বহন করতে হবে।

(জনাব আব্দুল্লাহ সরকার বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য। জাতীয় সংসদেও একজন সদস্য ছিলেন তিনি। শোষিত, বঞ্চিত সর্বহারা শ্রেণীর পক্ষে তিনি নিরন্তরভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, অনেক দুরত্বে অবস্থান করলেও তার মত সংগ্রামী মানুষেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ পাহাড়ি জনগণেরও নিকটজন। আমরা তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন কামনা করি। “রাডার” প্রকাশনা কমিটি)।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
--------------------------------------------------------------------------


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন