পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ২ মে, ২০১৭

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ১৬ - ১৭

চালচিত্র

“মার্ডার হলেও রাডার কিনবো”
রাডারের রাহুমুক্তি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সংখ্যাটি খুবই সমাদৃত হয়। অনেককে রাডার পড়ার জন্য নিগৃহীত হতে হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়িতে প্রতুল বিকাশ খীসাকে রাডার কেনার দায়ে জনৈক আর্মি কর্তৃক উরুতে লাঠি খেতে হয়েছে। পরে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “লাঠি নয়, মার্ডার হলেও রাডার কিনবো।”

কাশীরাম চাকমা-র জীবনের মূল্য ৫,০০০ টাকা
গত ১০ই মে ’৯১ রাতে কাউখালী উপজেলার মিদিঙ্গ্যাছড়ি গ্রামের কাশীরাম চাকমা নামক জৈনক কৃষককে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। দৈহিক নির্যাতনের ফলে তিনি শেষ পর্যন্ত মারা যান। ১৩ তারিখ তার লাশ ফেরত দেয়া হয় এবং তার সকারের জন্য ৫,০০০ টাকা প্রদান করে বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য এলাকাবাসীকে বিশেষভাবে হুমকি দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ১৯৮০ সালে এই কাউখালীতেই সংঘটিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে কলংকময় ঘটনা “কলমপতি হত্যাকাণ্ড”।

সহানুভূতি চাওয়ার শাস্তি ৪০০ ঘনফুট কড়ই গাছ
খাগড়াছড়ি জেলার ভাইবোনছড়া আর্মি ক্যাম্প কমা-ারের কড়া নির্দেশ- “গুচ্ছগ্রামবাসীদের সপ্তাহে অন্ততঃ দুদিন বিনা পারিশ্রমিকে ক্যাম্পে কাজ করে দিতে হবে। অবহেলা করলে চরম দণ্ড।” লাঠি ছাড়া কথা বলতে তিনি অভ্যস্ত নন। “অসহায় গ্রামবাসী সপ্তাহে একদিন ক্যাম্পে কাজ করবে এবং কমাণ্ডার সাহেব তার লাঠি ব্যবহার করবেন না”- এই মর্মে জনৈক জেলা পরিষদ সদস্যের মাধ্যমে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। কিন্তু বিধি বাম। সদয় দৃষ্টি বর্ষিত হলো না। বরং কমা-ার সাহেব আরো বেশী ক্ষেপে গেলেন। তার বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল! এত বড় ধৃষ্টতা! অতএব, গ্রাসবাসীদের ডেকে কড়া নির্দেশ এই ধৃষ্টতা দেখানোর বাড়তি সেলামী হিসেবে ৪০০ ঘনফুট কড়ই গাছ সংগ্রহ করে দিতে হবে। অনন্যোপায় হয়ে সন্ত্রস্ত গুচ্ছগ্রামবাসী হুকুম মানতে বাধ্য হয়।

“বিশ্বজি আর সুবোধকে আটক করতে পারে না”
গত ৯ই জুলাই ঢাকার টি,এস,সি - তে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসনের চিত্র তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য ৫ দফা দাবী সম্বলিত একটি লিফলেট প্রচার করে। এজন্যে খাগড়াছড়ি ক্যান্টম্যান্টে ডাক পড়ে পদলেহী লেজুরদের, যারা “জেলা পরিষদ” নামক প্রতিষ্ঠানে পুতুল নাচ দেখান। স্যারেরা গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে সামনে বসা। বার বার উক্ত লিফলেটটি পড়ে শুনানোর পর স্যার বললেন- “তোমাদের আমরা কী জন্য বানিয়েছি ? তোমাদের ছেলেরা ঢাকায় গিয়ে এগুলো কি করছে ? তোমরা এদের নিষেধ করতে পার না?” ইত্যাদি ইত্যাদি। জেলা পরিষদ নেতারা বাকশক্তিহনি। তারা স্যারদের সামনে কিছুই বলতে পারলেন না। শেষে বেরিয়ে এসে পুরুষোত্তম, পূর্ণজ্যোতি, অরুণোদয় পরস্পরকে বলাবলি করতে লাগলেন- “খালি আমাদের উপর খবরদারী। বিশ্বজি আর সুবোধ -কে আটক করতে পারে না?” উল্লেখ্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বাবু সুবোধ বিকাশ চাকমা এবং সভাপতিত্ব করেছিলেন বাবু বিশ্বজি চাকমা। তাই তাদের উপর লেজুড়দের এত আক্রোশ।

“বুয়েট; বি,আই,টি; কৃষি কলেজে পাহাড়ি ছাত্রদের ভর্তি অনিশ্চিত”
বুয়েট; বি,আই,টি; মেডিকেল ও কৃষি কলেজে যে কোটা সিষ্টেম চালু আছে তার সিলেকশন দিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জি,ও,সি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এবার যথা সময়ে পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীরা দরখাস্ত দাখিল ও পরীক্ষা দেয়ার পরও জি,ও,সি, ভর্তি অনুমোদন দিচ্ছেন না। অথচ ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির শেষ সীমা অতিক্রান্ত হয়ে ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। এভাবে পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্য চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জিম্মি হয়ে আছে।

“রাডার বিক্রির দায়ে মুচলেকা আদায়”
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত দেওয়ান রাজুকে রাডার বিক্রয় করার জন্য পুলিশ ১লা অক্টোবর ৯১ ইং আটক করে। পরে তাকে “পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে সংশ্লিষ্টতা পরিত্যাগ করবে” -এই মুচলেকা আদায় করে মুক্তি দেয়া হয়। বর্তমানে রাঙ্গামাটির লাইব্রেরীগুলোতে “রাডার” বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

“ষ্টাইপেণ্ড প্রদানে ক্যাপ্টেন হারুন ও দীপালোর অবৈধ প্রভাব”
গত ২৪/৯/৯১ ইং তারিখে মহালছড়ি উপজেলা পরিষদের ষ্টাইপেণ্ড প্রদানের জন্য বাছাই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেব যোগ্যতার ভিত্তিতে বৈধ ছাত্র- ছাত্রীদের ষ্টাইপে- প্রদানের পক্ষপাতি। কিন্তু বাঁধ সাধলেন ক্যাপ্টেন হারুন ও তার অনুগত লেুজুড় উপজেলা চেয়ারম্যান দীপালো। তাদের অভিমত হলো সেনাবাহিনীর অনুগত লোকদের ছেলেমেয়েদেরকে ষ্টাইপে- দিতে হবে। অবশেষে তাদের মতই প্রাধান্য পেল। ষ্টাইপে- দেয়া হলো (১) বিপুল খীসা পীং সুধাংশু খীসা, (২) জ্ঞানেশ্বর চাকমা ও (৩) মঞ্জু বিকাশ চাকমা - পীং ধৃতরঞ্জন চাকমা-কে, যদিও তাদের ছাত্রত্ব নেই। উল্লেখ্য, কথিত দীপালো চাকমা গত উপজেলা নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উলঙ্গ হস্তক্ষেপে প্রতিদ্বন্দ্বী আদি শংকর খীসাকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই এখন সেনাবাহিনীর পদলেহনই তার ক্ষমতার ভিত্তি, জনসমর্থন নয়।

“শান্তিবাহিনী আত্মসমর্পনের কেচ্ছা”
খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের মাথায় ভূত চেপে বসলো, যেভাবেই হোক শান্তিবাহিনী যে আত্মসমর্পন করছে তা দেখাতে হবে। অতএব, ৬/১১/৯১ ইং তারিখ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার আয়োজন। খাগড়াছড়ি কলেজিয়েট হাইস্কুলের ছাত্রাবাস “শান্তিনিকেতন কটেজ” থেকে ৮/৯ জন স্বাস্থ্যবান পাহাড়ি ছাত্রকে ব্রিগেড অফিসে ডেকে এনে শান্তিবাহিনীর পোশাক পরিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর তাদের হাতে অস্ত্র দিয়ে ছবি তোলা হয় এবং ভি,ডি,ও -তে ধারণ করা হয়। ছবি তোলার সময় ছাত্রদের মধ্যে নন্দিত নামের একজন আত্মসমর্পনকারীকে বসানো হয়, যাতে এই বানোয়াট ঘটনা সম্পর্কে জনগণের মনে বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করা যায়। এই ঘটনার দু’দিন পর প্রায় সব পত্রিকায় “১১ জন শান্তিবাহিনীর আত্মসমর্পণ” শিরোনামে উক্ত ঘটনাটি পরিবেশন করা হয়।

“মুখ লুকানো ছবি এবং .... ”
সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় হঠা কয়েকজন উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা খাগড়াছড়ি নতুন কুঁড়ি কেজি স্কুলে পদধূলি দিতে যান। সেখানে শিক্ষয়িত্রীদের সাথে চা-নাস্তা ও গল্প-গুজবের পর পাহাড়ি শিক্ষয়িত্রীদের ছবি তোলার অনুরোধ করা হয়। শিক্ষয়িত্রীরা এতে রাজী না হলে অনুরোধ আদেশে পরিণত হয়। অগত্যা শিক্ষয়িত্রীরা ক্যামেরার সামনে দাড়ালেন। তাদের হাতে দেয়া হলো “শান্তিবাহিনী নিপাত যাক”, “আমরা বাংলাদেশকে ভালবাসি” ইত্যাদি শ্লোগান সম্বলিত ব্যানার। অপমানে, দুঃখে, ক্ষোভে শিক্ষয়িত্রীরা ব্যানারের আড়ালে মুখ লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। এই মুখ লুকানো ছবি সেনা অফিসারদের কতটুকু কাজে লেগেছে তা জানা যায় নি, তবে এই ঘটনার পর পাহাড়ি শিক্ষয়িত্রীরা পদত্যাগ করেন বলে জানা গেছে।

“ভূবনের উপাতে বাঁশ বিক্রেতারা অতিষ্ঠ”
ব্রিগেডিয়ার ইব্রাহিমের আমলে গঠিত তথাকথিত টাইগার বাহিনীর প্রধান কুখ্যাত ভূবন চাকমার দাপতে এখন নানিয়ারচরের বাঁশ বিক্রেতাগণ অতিষ্ঠ। বিক্রেতাদের কাছ থেকে সে ট্যাক্স আদায় করছে এবং না দিলে “শান্তিবাহিনী” বা “শান্তিবাহিনীর সহযোগী” বলে আর্মির হাতে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। ফলে বেচারা বাঁশ বিক্রেতাদের বাধ্য হয়ে দাবীকৃত ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। অধিকন্তু পাহাড়ি বাঁশ বিক্রেতাদেরকে এক কিস্তিতে দাম পরিশোধ না করার জন্য ব্যবসায়ীদেরকে আদেশ দিচ্ছে, যাতে বিক্রেতারা বারে বারে বাজারে এসে দাম নিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং সেও বার বার ট্যাক্স আদায় করতে পারে। ব্যবসায়ীদের প্রতি তার বক্তব্য- “তোমরা যদি সব টাকা একসাথে দিয়ে দাও, তাহলে ওরা অর্ধেক টাকা শান্তিবাহিনীকে দিয়ে দেবে।”

“পাহাড়িদের জমি অনুপ্রবেশকারীদের দখল”
বর্তমানে পানছড়ি, দিঘীনালা ও কমলছড়ি এলাকার পাহাড়িদের ব্যাপক জমি-জমা সমতলবাসী অনুপ্রবেশকারীদের দখলে চলে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে এর মদদ দিচ্ছে বলে জানা গেছে। পানছড়ি ও দিঘীনালা এলাকার অধিবাসীরা বর্তমানে অনেকে ভারতে শরণার্থী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আর যারা দেশে রয়েছেন তারা “গুচ্ছগ্রাম” নামক বন্দী শিবিরে দিন যাপন করছেন। গুচ্ছগ্রামবাসীদেরকে তাদের নিজ নিজ জায়গা-জমিতে সেনাবাহিনী চাষাবাদ কিংবা ঘর-বাড়ি করতে দিচ্ছে না। অথচ এসব পাহাড়িদের জায়গা-জমিতে এখন প্রতিনিয়ত অনুপ্রবেশকারীদের বসত বাড়ি গড়ে উঠেছে এবং এভাবে পাহাড়িরা তাদের জায়গা-জমি হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে।

“প্রতি পরিবার মাত্র দুই কেজি চাল কিনতে পারবে”

২৭/১০/৯১ ইং মহালছড়ি জোনের জোনাল কমা-ার নির্দেশ দিয়েছেন যে, পাহাড়িরা পরিবার প্রতি মাত্র ২ কেজি চাল কিনতে পারবে। অধিকন্তু, তার নির্দেশে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ২৫/১০/৯১ ইং তারিখে পাহাড়িদের কাছ থেকে বাজার থেকে ফেরার সময় সমস্ত চাল কেড়ে নেয়। এভাবে প্রায় ১০/১২ মন চাল কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে যা আর ফের পাওয়া যায় নি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন