রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা
পাতা: ১৮ - ২১
প্রচ্ছদ বক্তব্য
আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার তাৎপর্য ও
ছাত্র সমাজের দায়-দায়িত্ব
----------------- মিঃ গণমুক্তি
সুদীর্ঘকাল থেকে শিক্ষানবীশদের শোনানো হয়েছে বহু বিশ্রুত শাস্ত্র বাক্য,
“ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ”। সংস্কৃতের অমর বাণী। গুরুজনদের প্রিয় মন্ত্র। যার অর্থ অধ্যয়নই
ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা। শিক্ষার্থীদেরকে আজো গুরুজনদের কাছ থেকে এই উপদেশ শুনতে হয়।
এমন এক সময় ছিল যেকালে শাস্ত্র অধ্যয়নকে শিক্ষার্থীরা তপস্যা হিসেবে
ধরে নিতে পারতো। তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতটা উন্নতি হয়নি। সেকালে পুঁথিপুস্তক ছিল হাতে
গোনা। সেসবই ছিল সে যুগের মনীষীদের চিন্তার ফসল। সেই গুটি কয়েক পুঁথিতে শিষ্যরা নিজেদের
মগ্ন রাখতে পারতো। অন্যকিছুতে তাদের মাথা ঘামাবার দরকার পড়তো না। সেকালে সে ধরনের পরিস্থিতিও
ছিল না। মানুষের আর্থিক অবস্থা ছিল স্বচ্ছল। জীবন-ধারন ছিল সহজ সরল। কাজেই গুরুগৃহে
থেকে শিক্ষার্থীরা নির্ঞ্চাটে বিদ্যা চর্চ্চা করতে পারতো।
তবে, সে যুগেও কেবল শাস্ত্র চর্চ্চাই হতো না। ক্ষত্রিয়দেরকে শাস্ত্রের
সাথে অস্ত্রের চর্চ্চা করতে হতো। কারণ সে যুগে যুদ্ধ বিগ্রহে পারদর্শী না হলে কারোর
পক্ষে রাজ্য শাসন সম্ভব ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষত্রিয় বা রাজন্যবর্গকে বিদ্যাচর্চ্চার
পাশাপাশি শাসনকার্যের কলাকৌশলও রপ্ত করতে হতো। সেকালে রাজা-রাজরাই ছিল সবকিছুর নিয়ন্তা।
প্রজাদের উপর রাজত্ব করা ছিল তাদের একচ্ছত্র অধিকার। শাসনকার্য ছিল সাধারণ প্রজাবর্গের
কাছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাজেই তাদের সন্তানদের ক্ষত্রিয়দের মতো অস্ত্র শিক্ষা কিংবা
শাসনকার্য সম্পর্কে জানার-শেখার প্রয়োজন পড়তো না। রাজ্য জাহান্নামে গেলেও তাদের কিছু
করার থাকতো না। অল্প বিস্তর যে বিদ্যা চর্চ্চার সুযোগ হতো, তাকে তপস্যা জ্ঞান করতো।
কালের আবর্তে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। সেকালের সাথে আজকের ব্যবধান আকাশ-পাতাল।
সমাজ ব্যবস্থা এখন বহু জটিল। জীবন-জীবিকা অনেক কঠিন। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে মানুষকে
বেঁচে থাকার আয়োজন করতে হচ্ছে। বিশেষতঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জীবন মানেই সংগ্রাম,
বেঁচে থাকা মানে লড়াই করা। দুনিয়ায় এখন মুহুর্তে মুহুর্তে অনেক কিছু ঘটছে। নিত্য-নতুনের
উদ্ভব হচ্ছে, আবিস্কার হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগৎ এখন আর আগের
মত সংকুচিত নয়। এর পরিধি এখন অনেক বেশী বিস্তৃত ও ব্যাপক।
এযুগে তাই শিক্ষা কিংবা বিদ্যাচর্চ্চাকে মান্ধতা আমলের নিরীখে বিচার
করার অবকাশ নেই। কিন্তু এখনও অনেকে সেকেলে ভাবধারায় আচ্ছন্ন। সংস্কৃতের সেই পুরানো
শাস্ত্র বাক্যকে আঁকড়ে থেকে ভুল অপব্যাখ্যা করছে। ফলে অনেকে ছাত্রদেরকে সংকীর্ণ গ-িতে
আবদ্ধ রাখতে চান। বিদ্যাচর্চ্চা বলতে বুঝেন শুধুমাত্র সিলেবাস নির্ধারিত পুঁথিপুস্তক
মশগুল থাকা। বাইরের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে ছাত্রদের যে পরিচয় হবার দরকার আছে,
তা তারা বুঝতে চান না।
বর্তমান দিনে শিক্ষার অর্থ শুধু পুঁথিপুস্তক গলাধঃকরণ করা নয়। দুনিয়ার
ঘটনাবলী থেকে চোখ বুঝে থাকা নয়। আবদ্ধ রুমে চোখ-কান বন্ধ করে বিদ্যাচর্চ্চার অর্থই
শিক্ষা নয়।
আজকের দিনে আধুনিক চিন্তা-চেতনা থেকে দূরে থেকে, সংকীর্ণ গ-িতে আবদ্ধ
থেকে প্রকৃত অর্থে ছাত্রদের শিক্ষিত হওয়া কিংবা বিদ্যার্চ্চা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক
গলাধঃকরণ করে ছাত্রদের অনুসন্ধানী মনের প্রশ্ন মিটতে পারে না, সৃষ্টিশীল প্রতিভারও
বিকাশ হতে পারে না।
চিন্তা-চেতনায় সাবালক হিসেবে গড়ে উঠার জন্য ছাত্রদেরকে অবশ্যই উন্নত
আদর্শের সংস্পর্শে আসতে হবে। উন্নত চিন্তা-ভাবনার সাথে পরিচয় হয়ে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে
নিজেদের জড়িয়ে পড়ার দরকার আছে।
আগেকার দিনে নানান সীমাবদ্ধতার কারণে শিক্ষার পরিধিকে সীমিত গণ্ডিতে দেখা
হতো। উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী মানুষের সেকেলে ধারণাকে বদ্ধমূল করে দেবার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
তার কারণও ছিল।