পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৮

রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা- ১৮ - ২১

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা



পাতা: ১৮ - ২১



প্রচ্ছদ বক্তব্য 
        
আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার তাপর্য ও
ছাত্র সমাজের দায়-দায়িত্ব
  -----------------  মিঃ গণমুক্তি

সুদীর্ঘকাল থেকে শিক্ষানবীশদের শোনানো হয়েছে বহু বিশ্রুত শাস্ত্র বাক্য, “ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ”। সংস্কৃতের অমর বাণী। গুরুজনদের প্রিয় মন্ত্র। যার অর্থ অধ্যয়নই ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা। শিক্ষার্থীদেরকে আজো গুরুজনদের কাছ থেকে এই উপদেশ শুনতে হয়।

এমন এক সময় ছিল যেকালে শাস্ত্র অধ্যয়নকে শিক্ষার্থীরা তপস্যা হিসেবে ধরে নিতে পারতো। তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতটা উন্নতি হয়নি। সেকালে পুঁথিপুস্তক ছিল হাতে গোনা। সেসবই ছিল সে যুগের মনীষীদের চিন্তার ফসল। সেই গুটি কয়েক পুঁথিতে শিষ্যরা নিজেদের মগ্ন রাখতে পারতো। অন্যকিছুতে তাদের মাথা ঘামাবার দরকার পড়তো না। সেকালে সে ধরনের পরিস্থিতিও ছিল না। মানুষের আর্থিক অবস্থা ছিল স্বচ্ছল। জীবন-ধারন ছিল সহজ সরল। কাজেই গুরুগৃহে থেকে শিক্ষার্থীরা নির্ঞ্চাটে বিদ্যা চর্চ্চা করতে পারতো।     
    
তবে, সে যুগেও কেবল শাস্ত্র চর্চ্চাই হতো না। ক্ষত্রিয়দেরকে শাস্ত্রের সাথে অস্ত্রের চর্চ্চা করতে হতো। কারণ সে যুগে যুদ্ধ বিগ্রহে পারদর্শী না হলে কারোর পক্ষে রাজ্য শাসন সম্ভব ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষত্রিয় বা রাজন্যবর্গকে বিদ্যাচর্চ্চার পাশাপাশি শাসনকার্যের কলাকৌশলও রপ্ত করতে হতো। সেকালে রাজা-রাজরাই ছিল সবকিছুর নিয়ন্তা। প্রজাদের উপর রাজত্ব করা ছিল তাদের একচ্ছত্র অধিকার। শাসনকার্য ছিল সাধারণ প্রজাবর্গের কাছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাজেই তাদের সন্তানদের ক্ষত্রিয়দের মতো অস্ত্র শিক্ষা কিংবা শাসনকার্য সম্পর্কে জানার-শেখার প্রয়োজন পড়তো না। রাজ্য জাহান্নামে গেলেও তাদের কিছু করার থাকতো না। অল্প বিস্তর যে বিদ্যা চর্চ্চার সুযোগ হতো, তাকে তপস্যা জ্ঞান করতো।

কালের আবর্তে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। সেকালের সাথে আজকের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। সমাজ ব্যবস্থা এখন বহু জটিল। জীবন-জীবিকা অনেক কঠিন। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে মানুষকে বেঁচে থাকার আয়োজন করতে হচ্ছে। বিশেষতঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জীবন মানেই সংগ্রাম, বেঁচে থাকা মানে লড়াই করা। দুনিয়ায় এখন মুহুর্তে মুহুর্তে অনেক কিছু ঘটছে। নিত্য-নতুনের উদ্ভব হচ্ছে, আবিস্কার হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগ এখন আর আগের মত সংকুচিত নয়। এর পরিধি এখন অনেক বেশী বিস্তৃত ও ব্যাপক।

এযুগে তাই শিক্ষা কিংবা বিদ্যাচর্চ্চাকে মান্ধতা আমলের নিরীখে বিচার করার অবকাশ নেই। কিন্তু এখনও অনেকে সেকেলে ভাবধারায় আচ্ছন্ন। সংস্কৃতের সেই পুরানো শাস্ত্র বাক্যকে আঁকড়ে থেকে ভুল অপব্যাখ্যা করছে। ফলে অনেকে ছাত্রদেরকে সংকীর্ণ গ-িতে আবদ্ধ রাখতে চান। বিদ্যাচর্চ্চা বলতে বুঝেন শুধুমাত্র সিলেবাস নির্ধারিত পুঁথিপুস্তক মশগুল থাকা। বাইরের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে ছাত্রদের যে পরিচয় হবার দরকার আছে, তা তারা বুঝতে চান না।

বর্তমান দিনে শিক্ষার অর্থ শুধু পুঁথিপুস্তক গলাধঃকরণ করা নয়। দুনিয়ার ঘটনাবলী থেকে চোখ বুঝে থাকা নয়। আবদ্ধ রুমে চোখ-কান বন্ধ করে বিদ্যাচর্চ্চার অর্থই শিক্ষা নয়।

আজকের দিনে আধুনিক চিন্তা-চেতনা থেকে দূরে থেকে, সংকীর্ণ গ-িতে আবদ্ধ থেকে প্রকৃত অর্থে ছাত্রদের শিক্ষিত হওয়া কিংবা বিদ্যার্চ্চা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক গলাধঃকরণ করে ছাত্রদের অনুসন্ধানী মনের প্রশ্ন মিটতে পারে না, সৃষ্টিশীল প্রতিভারও বিকাশ হতে পারে না।
চিন্তা-চেতনায় সাবালক হিসেবে গড়ে উঠার জন্য ছাত্রদেরকে অবশ্যই উন্নত আদর্শের সংস্পর্শে আসতে হবে। উন্নত চিন্তা-ভাবনার সাথে পরিচয় হয়ে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িয়ে পড়ার দরকার আছে।

আগেকার দিনে নানান সীমাবদ্ধতার কারণে শিক্ষার পরিধিকে সীমিত গণ্ডিতে দেখা হতো। উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী মানুষের সেকেলে ধারণাকে বদ্ধমূল করে দেবার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। তার কারণও ছিল।

রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা- ১৯

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা



পাতা: ১৯


আমরা শোকাহত

স্বাধীকারহারা ভাগ্যবঞ্চিত জুম্ম জনগণের
মুক্তি সংগ্রামে যে ছিল নিবেদিত প্রাণ,
 মৃত্যুহীন তারুণ্যের মহাশক্তিতে
 যে ভাঙতে চেয়েছিল জরাগ্রস্ত এ সমাজ,
সুবিধাবাদী পদলেহী দালালদের যে ঘৃণা করেছিল আজন্ম,
 অন্যায়-অত্যাচার আর নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে
যে ছিল বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ----                                 
 মিছিলের চেনামুখ,
যার দৃপ্ত পদভারে কেঁপেছিল রাজপথ ----
সে একটি অগ্নি স্ফুলিঙ্গের নাম
সজীব খীসা। সে আজ আর আমাদের মাঝে নেই।

গত ১২ই জানুয়ারী ৯২ইং, শুক্রবার, রাত পৌনে বারটায় দিঘীনালার বাবুছড়া গ্রামে শচীন্দ্র লাল খীসাকে পুত্র শোকে মুহ্যমান করে সজীব খীসা ১৯ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে হারিয়ে যায়। সে খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের একজন মেধাবী ছাত্র।   তার অকাল মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।


রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা- ২০

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা



পাতা: ২০


প্রতিবাদের অগ্নিশিখা হ’য়ে জ্বলে উঠুক এ তারুণ্য
মিঃ সুপ্রিয়

কারাগারের সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠে আঠকে গেছে ছয়টি শ্লোগান। আঘাতে আঘাতে দুঃশাসন গুড়িয়ে দেবার মত অমিততেজী তারুণ্যের সেই শ্লোগান। সতেরই ফেব্রুয়ারী রাজধানীর পীচ ঢালা পথে টি,এস,সি, অপরাজেয় বাংলা থেকে পান্থপথ অবধি সেই শ্লোগান কাঁপিয়েছে ঢাকার মুক্ত আকাশ। পার্বত্য এলাকায় ভূতের মত জেকে বসা জলপাই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে মিছিলে এসেছিল তারা। লক্ষ নিপীড়িতের অব্যক্ত বেদনার ভাষা বলতে চেয়েছে তারা এদেশের কোটি মেহনতি মানুষের কাছে। সকল প্রকার নাগরিক অধিকার নিয়ে গণতন্ত্রকে ঐ শৈলচত্বরব্যাপী বিস্তৃত করতে চায় তারা। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই সংসদীয় গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তুলতে অবিচ্ছেদ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অঘোষিত সামরিক শাসনের অবসান চেয়েছে তারা। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার সংগ্রামে তাদের এ আন্দোলন একটি অন্যতম শক্তি নিঃসন্দেহে।

অথচ হায় নির্লজ্জ উর্দী সাম্রাজ্য। ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ৭৫ জন ছাত্র-ছাত্রীকে মানিকছড়ি ক্যাম্পে আটকে রেখে তামাসা তামাসা খেলা খেললো তারা। অতঃপর দেশে প্রচলিত আইনের কোনরূপ তোয়াক্কা না করেই চল্লিশ ঘন্টার পর থানা হাজতে সোপর্দ করে তারা হয়ে গেলো ধোয়া তুলসী পাতা। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ও,সি, খালেদ ভাই অস্বস্থিতে পড়ে যান। কিন্তু না, থানা কর্তৃপক্ষকে নেংটি ইঁদুরের মত অনায়াসে বাধ্য করালো ছয়জন ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার জঘন্য মিথ্যা মামলা সাজাতে। সাবাস নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ। সাবাস ! কি বিচিত্র এ দেশ, মানুষ। জগ দেখলো না কি সহজ বেহায়াপনা। আর্ন্তাজাতিক ভাবমূর্তি সম্পন্ন এ দেশের সার্বভোমত্ব রক্ষায় নিবেদিত-প্রাণ কর্মীরা অবশ্যই জনগণের অংশ। এ বাহিনী এখন আর শিশু নয়। তারা এখন দক্ষ, সমর্থ ও সুশৃংখল বাহিনী - এতে আমাদের দ্বিমত নেই। দ্বিমত সেখানেই, যখন তারা দেশ রক্ষার নামে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে প্রশাসনকে বগলদাবা করেন। সন্ত্রাস দমনের নামে নিরীহ মানুষকে অত্যাচার করেন। বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে জিম্মি করে রাখেন অবাধে।

তবে আমরা নিশ্চিত জানি ঐ সাজানো অভিযোগে কারারুদ্ধ তরুণরা আগ্নেয় লাভায় জ্বলে উঠবে নিয়ত। ঐ লৌহ কপাট দিয়ে তারুণ্যকে আটকে রাখা হাস্যকর। গণতান্ত্রিক অধিকারকে শৃংখলাবদ্ধ করা নিন্দনীয়। এর চেয়ে লজ্জাকর রাষ্ট্রদ্রোহীতার মিথ্যা মামলা ঠুকিয়ে দেবার অরাজকতা। এটি আইনশৃংখলা রক্ষার নামে ভাওতাবাজী। সংবিধান পরিপন্থি অপশাসন মাত্র। আমরা এ নোংরামীর প্রাণঢালা ঘৃণা করি। প্রতিবাদ জানাই আমৃত্যু। দ্রুত অবসান দেখতে চাই এ ক্ষুদ্র প্রিয় রাজ্যের যত্তোসব নৈরাজ্যের।


রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা- ২১

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা



পাতা: ২১


জাগো জনতা, গড়ো প্রতিরোধ
- মিঃ চাইলা অং

অনেক হারিয়েছি আমরা। ভিটেমাটি, জায়গা-জমি, আত্মীয়-স্বজন, মান-ইজ্জত একে একে সব কেড়ে নেয়া হয়েছে আমাদের। এখন জাতীয় অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার কেড়ে নিতে উদ্যত হয়েছে কিছু অশুভ দানব। সেই ষাট দশক থেকেই হারানোর বিষাদময় ইতিহাসের শুরু। কাপ্তাই বাঁধের উল্লাসী রাক্ষুসী নীল জল সেদিন ছলা ছলা করে পাহাড়িদের ঘরবাড়ি জায়গা-জমি গ্রাস করে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। স্তব্ধ করেছিল সেদিন আনন্দ-কোলাহলপূর্ণ নয়নাভিরাম সবুজ পাহাড়ি জনপদ। ছন্নছাড়া, দেশছাড়া হয়েছিল সেদিন আমাদের অনেকেই। তারপর সেই হারানোর ধারাবাহিকতায় আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি অস্তিত্ব বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।    

এই দীর্ঘ সময় আমরা অনেক অসহনীয় অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার হিমালয় বয়েছি। অনেক দঃসহ ভয়াল কালোরাত পেরিয়েছি এতকাল। অত্যাচারীর চাবুকের আঘাতে পিঠের ছাল উঠে গেলেও নীরবে সহ্য করেছি আমরা। নিজের চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি কেড়ে নিলেও কোনো প্রতিবাদ করিনি। দ্বগ্ধ বুকে হজম করেছি শোভা, অঞ্জলি, বটুদের ইজ্জত হারানোর করুণ আর্তনাদ।

আমরা মুহুর্তের মধ্যে আমাদের বিস্তীর্ণ জনাকীর্ণ জনপদগুলো শ্মশান হয়ে যেতে দেখেছি। চোখের সামনে নিজের মা-বোনকে ধর্ষণ করার কুসিত রূপ দেখেছি। অসুরদের রক্তনেশা মেটাতে পশুর মত হাজার হাজার পাহাড়ি নরনারীকে জবাই করতে দেখেছি। আর দেখেছি দানবীয় হিং¯্রতায় উম্মত্ত হয়ে ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুদের গলা টিপে হত্যা করে উল্লসিত হতে। স্মরণাতীত কাল হতে সবুজ পাহাড়িয়া প্রকৃতি মাতার কোলে বেড়ে ওঠা এ জনপদের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের নিশ্চিহ্ন করতে সর্বশক্তি দিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে একটি অশুভ শক্তি।
আমরা এখনো দেখি তথাকথিত কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সির নগ্ন নখরাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে জনজীবন। এখনো প্রতিনিয়ত দেখি অশুভ শক্তির লাগামহীন দৌরাত্ম্য আর দান্তিক পদচারণা। দেখি ভ- জনদরদী পদলেহীদের চক্ষুলজ্জাহীন উলঙ্গ বেহায়াপনা।  আমরা এখানে প্রতিমুহুর্তে মৃত্যুর সাথে খেলা করে বেঁচে আছি। আমরা প্রতি পাঁচ জনে পেয়েছি একজন স্বশস্ত্র রক্ষাকর্তা - আমাদের জীবন মরণের মালিক। এখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে আমাদের মুক্ত বিচরণ। মানবাধিকার এখানে বুটের তলায় পিষ্ঠ। আর চিতাউর্দীর পকেটেই যাবতীয় আইন-কানুন, বিধি-বিধান। 

আমরা অনেক সহ্য করেছি। এবার নতুন করে জেগে উঠতে হবে। নতুন করে গড়তে হবে সবকিছু। হারানোর আর কোন ভয় নেই। স্বপ্ন আছে স্বাধীন মুক্ত জীবন ফিরে পাবার। যে ঘর জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তা আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। ফিরে পেতে হবে সেই কোলাহলপূর্ণ স্বর্গীয় জীবন। যতসব অন্যায়-অত্যাচার-শোষণ-উপীড়ন ভাসিয়ে নিয়ে ফেলে দিতে হবে বঙ্গোপসাগরে।

আজ তাই হতে হবে সংগঠিত, গড়তে হবে দৃঢ় ও লৌহকঠিন ঐক্য। ঐক্য মানেই শক্তি। সমগ্র পাহাড়ি জনগণের দৃঢ়তার ঐক্য মানেই এক দুর্জয় মহাশক্তি। এই মহাশক্তি রোধে কারোর সাধ্য নেই। জনতার এই মহাশক্তি দিয়েই সমস্ত অশুভ শক্তিকে চিরতরে ধূলিস্যা করতে হবে। আর কালক্ষেপণ নয়। দিকে দিকে এই ঐক্যশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে প্রতিরোধ সংগ্রামে। লক্ষ মানুষের প্রতিবাদের দুর্বার তেজী ¯্রােত বয়ে দিতে হবে সারা চট্টলায়। জাগো জনতা, গড়ো প্রতিরোধ।


রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা- ২২ - ২৩

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা


পাতা: ২২ - ২৩


দি কেস অব পলিটিক্যাল মাইগ্রেসন ইন দ্যা হিল ট্র্যক্টস
- দিমিতির

জাতিগত সমস্যা/দ্বন্দ্ব (Ethnic Conflict)) বর্তমানে বিশ্ব ব্যবস্থার একটি অন্যতম রূপ। জাতি গঠন বা রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া কখনো সহজ, সরল পথে এগোয়নি। প্রথম বিশ্ব থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্ব পর্যন্ত এই সমস্যা পরিব্যপ্ত। সাম্প্রতিককালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুগোশ্লাভিয়ার ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করেছে কম্যুনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও জাতিগত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অন্যদিকে উদারনৈতিক রাজনীতির ধ্বজাধারী বৃটেনেও এ সমস্যা বিদ্যামান। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ সমস্যা আরো প্রকট। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ সমস্যা কেন ? এর প্রকৃতিই বা কি?   

সামাজিক বিজ্ঞানের তত্ত্ববিদরা জাতিগত সমস্যাকে সরাসরি কতৃত্ববাদী এলিট কুশাসনের (elite misrule) সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। (১) সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সরকার সমূহের সমস্যা সম্পর্কে ভুল উপলদ্ধি এবং তহেতু ভ্রান্ত নীতিমালা ও পদক্ষেপ থেকে। (২) অবশ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মূল নিহিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে সহজেই ধরা পড়ে বাংলাদেশ একটি একক জাতি, সংস্কৃতি-ভাষা ভিত্তিক (mono-ethnic, culture-linguistic) রাষ্ট্র। মুজিব ১৯৭৩ সালে রাঙ্গামাটিতে-এক নির্বাচনী জনসভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের “পাহাড়িদের” নিজস্ব জাতিগত বৈশিষ্ট্য ভুলে গিয়ে ‘বাঙালি’ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ঐ জনসভায় তিনি এ হুমকিও প্রদান করেছিলেন, যদি পাহাড়িরা তার পরামর্শ গ্রহণ না করে, তাহলে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ বাঙালি ঢুকিয়ে দিয়ে তা করবেন। ১৯৭৪ সালের ২৩শে জানুয়ারী পার্লামেন্ট বাংলাদেশকে একটি "uni-cultural and uni-lingual nation-state" wn‡m‡e †NvlYv K‡i GKwU wej cvm K‡i| GLv‡b mn‡RB evsjv‡`k ivóª-e¨e¯’v Ges ivR‰bwZK wm‡÷‡gi "non-accommodative"হিসেবে ঘোষণা করে একটি বিল পাস করে। এখানে সহজেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সিস্টেমের "non-accommodative"  চরিত্র চোখে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রত্যেকটি সরকারই "accommodative"  নীতির পরিবর্তে "assimilationist" পলিসি অনুসরণ করেছে। এর যথাযোগ্য প্রতিফলন হচ্ছে - পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সমতল ভূমি থেকে বাঙালি পুনর্বাসন।   

রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা- ২৩

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা

পাতা: ২৩

পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
২০ শে মার্চ ’৯২ইং
সাহায্যদাতা দেশসমূহের বৈঠক অত্যাসন্ন
বাংলাদেশ নতুনভাবে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগের সম্মুখীন
বিগত বিশ বছর ধরে স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে সংগ্রামরত উপজাতীয় জনগণের আবাসভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের নতুন অভিযোগসমূহ গত রাত্রে বাংলাদেশ সরকারকে গভীরভাবে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনের এক বছর পর পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। “এখনো সেনাবাহিনী কর্তৃক বেপরোয়া ধরপাকড় অব্যাহত আছে এবং যাবতীয় নির্যাতন ও ধর্ষণ এখনো স্বাভাবিক ব্যাপার” - বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে তথ্যানুসন্ধানের আন্তর্জাতিক কমিশনের কো-চেয়ারম্যান এবং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলফ্রেড টেলক্যাম্পার। কমিশনের ১৯৯১ইং রিপোর্ট (লাইফ ইজ নট আওয়ারস্ ল্যাণ্ড এ- হিউম্যান রাইটস্ ইন দি চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস) -এর নব-সংস্করণে সংযোজিত নতুন তথ্যসমূহ ঠিক এক বছর আগে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বিশেষভাবে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। কমিশন মনে করে, ক্ষমতায় এক বছর থাকার পরও তার গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক কর্তৃত্ত্বকে সামান্যই প্রভাবিত করেছে- বরং বলা যায়, সেনাবাহিনীই পার্বত্য অঞ্চলের প্রকৃত শাসক। অভিযোগসমূহ বাংলাদেশকে সাহায্য লাভে অসুবিধায় ফেলতে পারে। কারণ ইদানিং দাতা দেশসমূহ গ্রহীতা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সাথে তাদের সাহায্যের পরিমাণ সম্পর্কিত করতে আগ্রহী। বিশ্ব ব্যাংকের সভাপতিত্বে সাহায্যদাতা দেশসমূহের বৈঠক আগামী ২১ ও ২২শে এপ্রিল প্যারিসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে - যেখানে দাতা দেশগুলো বাংলাদেশের প্রত্যাশিত ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাহায্য পূরণ করবে কিনা তা সিদ্ধান্ত নেবে।

১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট হোসাইন মোঃ এরশাদের পতনের পর গত বছর মার্চ-এ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বার্মা থেকে বাংলাদেশ আসা ৬০/৭০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের ভরণ পোষণের ভার বহনের জন্যও সাহায্যের আবেদন করছে। উইলফ্রেড টেলক্যাম্পার মন্তব্য করে বলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্ভাস্তু উপজাতীয় শরণার্থীদের সমান - যারা ১৯৮৬ সাল থেকে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতের উত্তর-পূর্ব ত্রিপুরা রাজ্যের শরণার্থী শিবিরে এখনো অবস্থান করছে।

কমিশনের টঢ়ফধঃব রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে কিভাবে লিভার ব্রাদার্স (বাংলাদেশ) -এর ম্যানেজার বাবু মনতোষ দেওয়ানকে গত জুলাই মাসে আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকেই তাকে মারাত্মকভাবে মারধর, ইলেকট্রিক শক এবং আঙ্গুলে স্টাপলার মেরে দেয়া হয়। কমিশনের মতে মনতোষ দেওয়ানকে নির্যাতন করার কারণ হচ্ছে, সেনাবাহিনীর অভিযোগ ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক কমিশন বাংলাদেশ সফরে গেলে তিনি তাদের সাথে কথা বলেছিলেন। কমিশনের সদস্যরা বলছেন যে, বাংলাদেশে থাকাকালীন তারা যাদের সাথে কথা বলেছেন তাদের প্রত্যেকের নাম তারা নোট করেছেন এবং তাদের মধ্যে মিঃ মনতোষ দেওয়ান -এর নাম নেই। যখন স্ত্রী তাকে দেখতে যান তখন একজন আর্মি অফিসার তার স্বামী সম্পর্কে কাউকে কিছু না বলার জন্য সতর্ক করে দেন। ডিসেম্বরের শেষে হাই কোর্ট মনতোষ দেওয়ান-এর আটকাদেশ অবৈধ বলে ঘোষণা করে। কমিশনের জানা মতে তাকে এখনো ছেড়ে দেয়া হয়নি।

গত বিশ বছর যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্মি এবং সরকারী বাহিনীর দ্বারা অসংখ্য মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনী পাল্টা অভিযোগ করেছে যে, পাহাড়িদের রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংস্থা শান্তিবাহিনীও মানবাধিকার লংঘন করছে। জে,এস,এস-এর দাবী হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং চার লাখ বাঙালিকে প্রত্যাহার করা যাদেরকে পূর্ববতী দুই সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় পুনর্বাসিত করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারী ৯১-এর নির্বাচনে বিগত সরকারসমূহের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত সংকীর্ণ নীতির অবসানের একটা সুযোগ ছিল বলে কমিশন মনে করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেই সুযোগ গ্রহণ করার পরিবর্তে পূর্ববর্তী ঘৃণিত এরশাদ সরকারের সকল নীতি অব্যাহত রেখেছে।   

রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা ২৪ -২৫

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা



পাতা: ২৪ - ২৫


গণ-আদালতের কাঠগড়ায়
গোলাম আযম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ

- মিঃ পল্লব

গত ২৬শে মার্চ ১৯৯২-এ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ৭১-এর নরঘাতক গোলাম আযমের বিচার। তবে এ বিচার গতানুগতিক বিচার নয়। এ বিচার জনগণের দ্বারা পরিচালিত বিচার। ব্যাপক জনগণের সমর্থনে গঠিত আদালত বলে এই আদালতের নাম গণ-আদালত। এই গণ আদালতের বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাবেক রেসকোর্স ময়দান, বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে, যেখান থেকে ১৯৭১ সালে শেখমুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। ঐ দিন লাখ লাখ জনতা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমাগম হতে লাগলেন উক্ত আদালত প্রঙ্গনে। নরঘাতক গোলাম আযমের বিচারের দাবীতে আগত লাখ লাখ জনতার গগণ বিদারী শ্লোগান ও করতালিতে সে দিনের রাজধানী ঢাকা নগরীর আকাশ বাতাস প্রকল্পিত হয়েছিল। সে দিন সংগ্রামী জনগণের চোখে মুখে ছিল ১৯৭১-এ অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করার দৃঢ় প্রত্যয়। তাই সে দিনের এক ঘন্টাব্যাপী বিচার অনুষ্ঠানে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে; যে শত্রুদেরকে বাংলার জনগণ ১৯৭১-এ পরাজিত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, সে সব জাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে এই স্বাধীন দেশে আবার জনগণের কেন নতুন করে সংগ্রাম করতে হচ্ছে? স্বাধীনতার দীর্ঘ বাইশ বছরেও কেন এসব অপশক্তিকে দেশ থেকে নির্মূল করা সম্ভব হলো না। তাহলে কি ৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম অসম্পূর্ণ ছিল ? এসব প্রশ্ন আজ বাংলার শ্রমজীবী জনগণের। এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ঐ অপশক্তির শেকড় কোথায় প্রোথিত ছিল, তার উত্তর খুঁজতে হবে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম ও তারও আগে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন তখনকার পাক-শাসক শ্রেণী ও তার পেটুয়া বাহিনী রাজাকার, আলসামসদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল। ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিরোধীতা করেছিল গোলাম আযম ও তার দল জামাত-ই-ইসলাম। শুধু তাই নয়। ধর্মের আলখেল্লা পরে মুক্তিকামী বাংলার জনগণের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়েছিল। হাজার হাজার মুক্তিকামী প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত হরণ করে তাদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করতে কুন্ঠাবোধ করেনি। এমন কি বর্তমান দেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও এসব অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাননি। এতকিছুর পরও শেখ সাহেব এসব নর পিশাচদেরকে নির্বিবাদে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ সরকার, পূর্ব বাংলার অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মেহনতি জনগণের প্রকৃত মুক্তির জন্য যিনি অবিরত সংগ্রাম করেছিলেন সেই বিপ্লবী নেতা কমরেড সিরাজ শিকদারকে ১৯৭৫ সালে গ্রেফতার করে আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যুনতম সুযোগ না দিয়ে হত্যা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের সে দিনের সেই তথাকথিত মহানুভবতার কারণে এই জামাত অপশক্তি বাংলার মাটিতে পা রাখতে সক্ষম হয়। ১৯৭৫-এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাত বদল হলে সেই কুখ্যাত জামাত ও তার প্রধান গোলাম আযম বাংলার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। এ যাব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন দলগুলো তাদের পৃষ্টপোষকতায় বিচারের পরিবর্তে এসব গণশত্রুদেরকে লালন করে আসছিলেন। এ নরঘাতক জামাত ও তার প্রধান গোলাম আযমের সাথে শেয়ার করে বি,এন,পি-র বর্তমান সরকার গঠন করতে সামান্যতম ভাবেও বিবেকে বাঁধেনি। এবং তারই সুযোগ নিয়ে বিদেশী নাগরিক গোলাম আযম আজ বাংলাদেশের জামাত-ই-ইসলামীর আমীর।

রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা- ২৫

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা

পাতা: ২৫

বিশেষ ঘোষণা
শীঘ্রই দালাল ও গণদুশমন তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে

“হিল লিটারেচার ফোরাম” এর সহযোগিতায় “গণদুশমন ও দালাল তালিকা প্রণয়ন কমিটি” গঠিত হয়েছে। সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত দালাল-দুশমনদের তালিকা সংগ্রহের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। সুষ্ঠু ও নিখুঁত তালিকা প্রণয়ন করতে আপনিও এগিয়ে আসুন। আপনার এলাকায় চেনা-জানা বদমায়েশ, দালাল ও গণদুশমনদের নাম, পিতার নাম, বয়স, ঠিকানা ও কুকর্মের বিস্তারিত তালিকা (প্রয়োজনে ছবিসহ) নি¤œ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিন ঃ
আহ্বায়ক
গণদুশমন ও দালাল তালিকা প্রণয়ন কমিটি                                                                                                
প্রযত্নে, হিল লিটারেচার ফোরাম।
দালাল কারা :-
১। যারা বিভিন্নভাবে জনস্বার্থ বিরোধী কাজে লিপ্ত ছিল বা আছে।                                                                         
২। যে সব পাহাড়ি ব্যক্তি জগণের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে কাজ করেছে বা করছে।                
৩। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান/সদস্য/সমর্থক।                                                                                          
৪। গ,প্র,ক বাহিনী; টাইগার বাহিনী; লায়ন বাহিনী ইত্যাদি আঙ্গুল বাহিনীর সদস্য/সদস্যা।                                              
৫। যারা নিরীহ জনগণকে শান্তিবাহিনী আখ্যায়িত করে ধরিয়ে দেয়।                                                                       
৬। যারা রাত-বিরাতে, সময়ে-অসময়ে সন্দেহজনক এলাকায় যাতায়াত করে এবং নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট   রিপোর্ট দিয়ে জনগণের জীবন দুর্বিসহ করে তোলে।                                                                                        
৭। ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যারা সমাজ ও জাতির ইজ্জত বিকিয়ে দিচ্ছে। সমাজকে কলুসিত করছে।


রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা: ২৬ - ২৯

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা


 পাতা: ২৬ - ২৯

সা ক্ষা ত কা র
[পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা। সঙ্গত কারণেই আমরা মনে করি এ সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের সচেতন ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকাকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে কে কী ভাবছেন তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিকর্মীসহ সচেতন মহলের সাক্ষাতকার ছাপাচ্ছি। এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় চলমান সংখ্যায় একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক জনাব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং স্বনামধন্য কবি শামসুর রাহমানের সাক্ষাতকার ছাপানো হলো।]

পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের
উদাসীনতা শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জার বিষয়ও বটে।
- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

[জনাব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং উক্ত কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। এছাড়া তিনি লেখক শিবির-এর কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি এবং “তৃণমূল” ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস “চিলে কৌঠার সেপাই” খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ছোট গল্পের মধ্যে দুধে ভাতে উপাত, দোজখের ওম ও খোঁয়ারী উল্লেখযোগ্য।]

১। বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কতখানি অবগত?
সরকারী প্রচার মাধ্যম যতোই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করুক আর বেসরকারী কাগজপত্র যতোই এড়িয়ে চলুক, দেশবাসী আজ জানে যে গত কয়েক বছর ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরতিহীনভাবে রক্তপাত ঘটে চলেছে।    
সেখানকার অধিবাসীদের নিজ নিজ জাতিসত্তা নিয়ে টিকে থাকার অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে, নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে তাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে গণ্য করা হয় ঔদ্ধত্য বলে এবং তাদের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী বিবেচিত হয় অপরাধ হিসাবে। তাদের ঐ অধিকার, ইচ্ছা ও দাবীকে সমূলে উপাটনের জন্যে শাসকদের নির্যাতন শুরু হয় পাকিস্তানী আমলে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তাই রূপ নিয়েছে হিং¯্র আক্রমনে। প্রথমে নিজভূমে তাদের পরবাসী করে রাখার জন্যে এবং পরে ভিটেমাটি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই আক্রমণকে প্রতিরোধ করার খবরও পাই বৈকি। ১৯৮১ সালে আমি রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের কয়েকটি জায়গায় গিয়েছিলাম। বান্দরবানে সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মুরং ছাত্রকে। তখন নিজের চোখে দেখে এবং পাহাড়ি ও বাঙালী অধিবাসীদের মুখে কখনো একই রকম কখনো পরস্পরবিরোধী কথা শুনে ওখানকার অবস্থা অনেকটাই আঁচ করতে পারি। এরপর প্রায় কয়েক যুগ কেটে গেলো। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়েছি। আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার প্রতিবেদন পড়েছি। “রাডার” পড়ার সুযোগও পাই। এ ছাড়া সরকারের পরিবেশিত তথ্য থেকেও কিছু কিছু ব্যাপার বুঝতে চেষ্টা করি। তবু খুব লজ্জা ও গ্লানির সঙ্গে বলি, আমাদের এই ছোট দেশটির ঐ এলাকার অত্যন্ত তাপর্যপূর্ণ ও জরুরী অনেক কিছুই আমার জানা নেই। ভালো করে যেটুকু জানি তার ওপর ভিত্তি করেই আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো।

২। এ দেশের সংবাদ মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলীর সঠিক চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। এর জন্য আপনি কাকে দায়ী করেন?
সরকারী প্রচার মাধ্যমগুলি সম্বন্ধে বলার মানে হয় না। সেখানে মন্ত্রী, নিমমন্ত্রী, আমলা এবং নিম আমলার মামাতো ভাইয়ের বাড়িওয়ালার শালার বিড়ালের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করা যাবে, কিন্তু গোলাম আযমের ফাঁসি দাবী করে অনুষ্ঠিত গণ-আদালতের বিশাল সমাবেশের খবরটা বেমালুম চেপে যেতে হবে। তারা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত হত্যাযজ্ঞের খবর দেবে কি করে ? কিন্তু দেশে বেসরকারী ও বিরোধী দলের খবরের কাগজ, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক সাময়িকী এবং মাসিক পত্রিকার তো অভাব নেই। সেসব জায়গায় পার্বত্য এলাকার সংঘর্ষ, হত্যা ও নারী নির্যাতনের ব্যাপারে টু শব্দটি করা হয় না কেন ?  শিক্ষিত বাঙালীর মধ্যে এক ধরনের উগ্র ও উদ্ভট জাতীয়তাবাদী উন্নাসিকতা আছে যার ফলে একটু ভিন্ন সংস্কৃতির নিকটতম প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখ থেকে তারা নিজেদের সরিয়ে রাখেন। নিজের দেশের সংখ্যালঘু বিভিন্ন জাতিসত্তার সদস্যদের সম্বন্ধে এঁদের সীমাহীন অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য। বাঙালী শিক্ষিত সমাজের যে অংশটি বিদ্যাচর্চা করেন, সাহিত্য সৃষ্টি করেন কিংবা শিল্পের নানা মাধ্যমে নিয়োজিত রয়েছেন দেশেরই কোনো কোনো অংশের মানুষ সম্বন্ধে তাঁদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা এবং উন্নাসিকতাই পাহাড়ি মানুষের সমস্যা সম্বন্ধে দেশবাসীর অজ্ঞ ও উদাসীন থাকার প্রধান কারণ।