পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৮

রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা ২৪ -২৫

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা



পাতা: ২৪ - ২৫


গণ-আদালতের কাঠগড়ায়
গোলাম আযম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ

- মিঃ পল্লব

গত ২৬শে মার্চ ১৯৯২-এ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ৭১-এর নরঘাতক গোলাম আযমের বিচার। তবে এ বিচার গতানুগতিক বিচার নয়। এ বিচার জনগণের দ্বারা পরিচালিত বিচার। ব্যাপক জনগণের সমর্থনে গঠিত আদালত বলে এই আদালতের নাম গণ-আদালত। এই গণ আদালতের বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাবেক রেসকোর্স ময়দান, বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে, যেখান থেকে ১৯৭১ সালে শেখমুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। ঐ দিন লাখ লাখ জনতা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমাগম হতে লাগলেন উক্ত আদালত প্রঙ্গনে। নরঘাতক গোলাম আযমের বিচারের দাবীতে আগত লাখ লাখ জনতার গগণ বিদারী শ্লোগান ও করতালিতে সে দিনের রাজধানী ঢাকা নগরীর আকাশ বাতাস প্রকল্পিত হয়েছিল। সে দিন সংগ্রামী জনগণের চোখে মুখে ছিল ১৯৭১-এ অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করার দৃঢ় প্রত্যয়। তাই সে দিনের এক ঘন্টাব্যাপী বিচার অনুষ্ঠানে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে; যে শত্রুদেরকে বাংলার জনগণ ১৯৭১-এ পরাজিত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, সে সব জাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে এই স্বাধীন দেশে আবার জনগণের কেন নতুন করে সংগ্রাম করতে হচ্ছে? স্বাধীনতার দীর্ঘ বাইশ বছরেও কেন এসব অপশক্তিকে দেশ থেকে নির্মূল করা সম্ভব হলো না। তাহলে কি ৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম অসম্পূর্ণ ছিল ? এসব প্রশ্ন আজ বাংলার শ্রমজীবী জনগণের। এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ঐ অপশক্তির শেকড় কোথায় প্রোথিত ছিল, তার উত্তর খুঁজতে হবে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম ও তারও আগে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন তখনকার পাক-শাসক শ্রেণী ও তার পেটুয়া বাহিনী রাজাকার, আলসামসদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল। ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিরোধীতা করেছিল গোলাম আযম ও তার দল জামাত-ই-ইসলাম। শুধু তাই নয়। ধর্মের আলখেল্লা পরে মুক্তিকামী বাংলার জনগণের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়েছিল। হাজার হাজার মুক্তিকামী প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত হরণ করে তাদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করতে কুন্ঠাবোধ করেনি। এমন কি বর্তমান দেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও এসব অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাননি। এতকিছুর পরও শেখ সাহেব এসব নর পিশাচদেরকে নির্বিবাদে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ সরকার, পূর্ব বাংলার অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মেহনতি জনগণের প্রকৃত মুক্তির জন্য যিনি অবিরত সংগ্রাম করেছিলেন সেই বিপ্লবী নেতা কমরেড সিরাজ শিকদারকে ১৯৭৫ সালে গ্রেফতার করে আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যুনতম সুযোগ না দিয়ে হত্যা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের সে দিনের সেই তথাকথিত মহানুভবতার কারণে এই জামাত অপশক্তি বাংলার মাটিতে পা রাখতে সক্ষম হয়। ১৯৭৫-এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাত বদল হলে সেই কুখ্যাত জামাত ও তার প্রধান গোলাম আযম বাংলার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। এ যাব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন দলগুলো তাদের পৃষ্টপোষকতায় বিচারের পরিবর্তে এসব গণশত্রুদেরকে লালন করে আসছিলেন। এ নরঘাতক জামাত ও তার প্রধান গোলাম আযমের সাথে শেয়ার করে বি,এন,পি-র বর্তমান সরকার গঠন করতে সামান্যতম ভাবেও বিবেকে বাঁধেনি। এবং তারই সুযোগ নিয়ে বিদেশী নাগরিক গোলাম আযম আজ বাংলাদেশের জামাত-ই-ইসলামীর আমীর।

স্বাধীনতার সুদীর্ঘ বাইশ বছরের পরও ক্ষমতাসীন কোন সরকার যখন এসব জাতীয় অপরাধীদের বিচার করতে ব্যর্থ, তখনই বাংলার জনগণ এসব ঘাতক দালালদের বিচার করতে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। জনগণ দীর্ঘ বাইশ বছর সাধারণ প্রচলিত আইনের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ঐসব আইন এসব জাতীয় অপরাধীদের বিচার করতে অক্ষম, বরং ঝধভবমঁধফ হিসেবে কাজ করেছিল। এমন কি যারা এসব নর ঘাতকদের বিচার করতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে নির্লজ্জভাবে কোর্টে মামলা করে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেন। এখন প্রশ্ন, যে সরকার এসব জাতীয় অপরাধীদের স্বার্থে এবং তাদের নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে ব্যাপক জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাহলে এই সরকারকে আমরা কী বলবো ? সরকার যদি নিজেকে জনগণের সরকার হিসেবে দাবী করেন, তাহলে তার উচি অতিসত্তর জনগণের রায়কে বাস্তবায়িত করা। নতুবা জনগণ তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করলে জনগণকে দায়ী করা যাবে না।    


এসব মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি কোন কালে, কোন দেশে বা অঞ্চলে জনগণের স্বপক্ষে কোন কাজ করেনি এবং করতেও পারে না। তারা বরাবরই ধর্মকে তাদের একমাত্র প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সহজ সরল জনগণের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করতে ব্যস্ত থাকেন। এভাবে জামাত ও তার প্রধান গোলাম আযম ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসী সহজ সরল মুসলিম জনগোষ্ঠিকে ধর্মের পরলৌকিক লোভ দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে তারা ইহজগতের সকল অনাচার দুরাচারে মত্ত হয়ে মহাসুখে বেহেশ্তের সুখ উপভোগ করেন। অপর দিকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে এবং এই ঘোলা পানিতে মাছ ধরাই হচ্ছে তাদের স্বভাব। যেভাবে আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামী সম্প্রসারণবাদের কালো হাত প্রসারিত হচ্ছে এতে তাদের কুসি চেহারা ইতিমধ্যে প্রকাশ করে ফেলেছে। বিশ্ব ইসলামী মৌলবাদের প্রধান পৃষ্টপোষক সৌদি আরবের পেট্রো ডলারে নির্মিত হয়েছে একটি হাসপাতাল। লংগুদুতে প্রতিষ্ঠিত এই আল রাবেতা হাসপাতালটি চিকিসার নামে চালাচ্ছে পাহাড়িদের ইসলামী করণের প্রক্রিয়া। অপরদিকে ইসলামী মৌলবাদের সমান্তরাল করে কিছু সংখ্যক পাহাড়ি শুরু করেছে ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা। এক শ্রেণীর পাহাড়ি বুদ্ধ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে চড়ে শুরু করেছে ধর্মীয় প্রচারণা। সাধারণ শ্রমজীবী পাহাড়ি জনগণকে নির্বাণের লোভ দেখিয়ে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। এসব বক ধার্মিকেরা নিজে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত থেকে সাধারণ জনগণের নিকট নির্বাণের অমোঘবাণী ও বুদ্ধ ধর্মের অপব্যাখ্যায় মত্ত। অপর দিকে আরও কিছু সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত পাহাড়ি বুদ্ধ ধর্মের ব্যানার গলায় ঝুলিয়ে সা¤্রাজ্যবাদের অর্থে পুষ্ট হয়ে ধর্মীয় ব্যবসায় কোমড়ে কাপড় বেঁধে মাঠে নেমেছেন। কিছু লোক দেখানো জনকল্যাণমূলক কাজ করে এবং সেগুলো ঐ সব দাতা দেশে দেখিয়ে বড় বড় অংকের অর্থ নিয়ে এসে বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছেন। দেশীয় ও বিদেশী ধর্ম ব্যবসায়ীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছেন। দেশীয় বুদ্ধ ধর্ম ব্যবসায়ীরা সেনাবাহিনী থেকে সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে সেনা বাহিনীর কুকর্মের প্রতি সাফাই গাইতে বড় ওস্তাদ। তাই তারা সেনাবাহিনীর নির্যাতনমূলক অপকর্মের খুবই সহায়ক শক্তি। সে কারণে হাজার হাজার, লাখ লাখ টাকা খরচ করে সরকারী অর্থে ও সরকারী হেলিকপ্টারে চড়ে পার্বত্য অঞ্চলে ধর্ম প্রচারে এখন তারা খুবই ব্যস্ত। ইদানিং পার্বত্য এলাকায় মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনীরাও বুদ্ধ ধর্মের প্রতি খুবই অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। তাই, কিছু কিছু সেনা অফিসার এসব বুদ্ধ ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী ধর্মীয় গুরুদের নিয়ে ধর্মীয় সভা সমাবেশ করাচ্ছেন। এসব সরকার এবং তার সহায়ক শক্তি সেনাবাহিনী তাদের প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ সরল প্রাণ জনগণের চোখ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারী পৃষ্টপোষকতায় এসব ধর্মীয় মৌলবাদ বিকাশ লাভ করে। যেভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘ বাইশ বছরে বিকাশ লাভ করেছিল। তাই পার্বত্য এলাকায়ও এসব ভ- ধর্ম ব্যবসায়ীদের অপশক্তি সমাজের সর্বস্তরে প্রোথিত হবার পূর্বে উপড়ে ফেলতে হবে। নচে পার্বত্য এলাকায় প্রকৃত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাধা হয়ে দেখা দেবে। এবং গণতান্ত্রিক অধিকার কোন সময় অর্জিত হলেও বর্তমান বৃহত্তর বাংলাদেশের ন্যায় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই সময় থাকতে পার্বত্য এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দালাল ও ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলবাদী কালো অপশক্তিকে চিহ্নিত করে গোলাম আযমের মতন গণআদালতে বিচার করতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মকে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। প্রগতিশীল আদর্শকে বুকে ধারণ করে এসব দালাল ও ধর্ম ব্যবসায়ী অপশক্তিকে সামাজিকভাবে বয়কট করে জনগণের কাঠগোড়ায় দাঁড় করানোর ভিত্তি এখন থেকে তৈরি করে নিতে হবে। নচে পাহাড়ি জনগণের প্রকৃত মুক্তি অসম্ভব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন