পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৮

রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা: ২৬ - ২৯

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা


 পাতা: ২৬ - ২৯

সা ক্ষা ত কা র
[পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা। সঙ্গত কারণেই আমরা মনে করি এ সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের সচেতন ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকাকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে কে কী ভাবছেন তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিকর্মীসহ সচেতন মহলের সাক্ষাতকার ছাপাচ্ছি। এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় চলমান সংখ্যায় একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক জনাব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং স্বনামধন্য কবি শামসুর রাহমানের সাক্ষাতকার ছাপানো হলো।]

পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের
উদাসীনতা শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জার বিষয়ও বটে।
- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

[জনাব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং উক্ত কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। এছাড়া তিনি লেখক শিবির-এর কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি এবং “তৃণমূল” ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস “চিলে কৌঠার সেপাই” খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ছোট গল্পের মধ্যে দুধে ভাতে উপাত, দোজখের ওম ও খোঁয়ারী উল্লেখযোগ্য।]

১। বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কতখানি অবগত?
সরকারী প্রচার মাধ্যম যতোই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করুক আর বেসরকারী কাগজপত্র যতোই এড়িয়ে চলুক, দেশবাসী আজ জানে যে গত কয়েক বছর ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরতিহীনভাবে রক্তপাত ঘটে চলেছে।    
সেখানকার অধিবাসীদের নিজ নিজ জাতিসত্তা নিয়ে টিকে থাকার অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে, নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে তাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে গণ্য করা হয় ঔদ্ধত্য বলে এবং তাদের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী বিবেচিত হয় অপরাধ হিসাবে। তাদের ঐ অধিকার, ইচ্ছা ও দাবীকে সমূলে উপাটনের জন্যে শাসকদের নির্যাতন শুরু হয় পাকিস্তানী আমলে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তাই রূপ নিয়েছে হিং¯্র আক্রমনে। প্রথমে নিজভূমে তাদের পরবাসী করে রাখার জন্যে এবং পরে ভিটেমাটি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই আক্রমণকে প্রতিরোধ করার খবরও পাই বৈকি। ১৯৮১ সালে আমি রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের কয়েকটি জায়গায় গিয়েছিলাম। বান্দরবানে সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মুরং ছাত্রকে। তখন নিজের চোখে দেখে এবং পাহাড়ি ও বাঙালী অধিবাসীদের মুখে কখনো একই রকম কখনো পরস্পরবিরোধী কথা শুনে ওখানকার অবস্থা অনেকটাই আঁচ করতে পারি। এরপর প্রায় কয়েক যুগ কেটে গেলো। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়েছি। আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার প্রতিবেদন পড়েছি। “রাডার” পড়ার সুযোগও পাই। এ ছাড়া সরকারের পরিবেশিত তথ্য থেকেও কিছু কিছু ব্যাপার বুঝতে চেষ্টা করি। তবু খুব লজ্জা ও গ্লানির সঙ্গে বলি, আমাদের এই ছোট দেশটির ঐ এলাকার অত্যন্ত তাপর্যপূর্ণ ও জরুরী অনেক কিছুই আমার জানা নেই। ভালো করে যেটুকু জানি তার ওপর ভিত্তি করেই আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো।

২। এ দেশের সংবাদ মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলীর সঠিক চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। এর জন্য আপনি কাকে দায়ী করেন?
সরকারী প্রচার মাধ্যমগুলি সম্বন্ধে বলার মানে হয় না। সেখানে মন্ত্রী, নিমমন্ত্রী, আমলা এবং নিম আমলার মামাতো ভাইয়ের বাড়িওয়ালার শালার বিড়ালের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করা যাবে, কিন্তু গোলাম আযমের ফাঁসি দাবী করে অনুষ্ঠিত গণ-আদালতের বিশাল সমাবেশের খবরটা বেমালুম চেপে যেতে হবে। তারা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত হত্যাযজ্ঞের খবর দেবে কি করে ? কিন্তু দেশে বেসরকারী ও বিরোধী দলের খবরের কাগজ, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক সাময়িকী এবং মাসিক পত্রিকার তো অভাব নেই। সেসব জায়গায় পার্বত্য এলাকার সংঘর্ষ, হত্যা ও নারী নির্যাতনের ব্যাপারে টু শব্দটি করা হয় না কেন ?  শিক্ষিত বাঙালীর মধ্যে এক ধরনের উগ্র ও উদ্ভট জাতীয়তাবাদী উন্নাসিকতা আছে যার ফলে একটু ভিন্ন সংস্কৃতির নিকটতম প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখ থেকে তারা নিজেদের সরিয়ে রাখেন। নিজের দেশের সংখ্যালঘু বিভিন্ন জাতিসত্তার সদস্যদের সম্বন্ধে এঁদের সীমাহীন অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য। বাঙালী শিক্ষিত সমাজের যে অংশটি বিদ্যাচর্চা করেন, সাহিত্য সৃষ্টি করেন কিংবা শিল্পের নানা মাধ্যমে নিয়োজিত রয়েছেন দেশেরই কোনো কোনো অংশের মানুষ সম্বন্ধে তাঁদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা এবং উন্নাসিকতাই পাহাড়ি মানুষের সমস্যা সম্বন্ধে দেশবাসীর অজ্ঞ ও উদাসীন থাকার প্রধান কারণ।

৩। পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের একটা অঞ্চল, অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অঞ্চলের জনশক্তি ও সম্পদকে দেশের বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে লাগাবার পরিবর্তে বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় করা হচ্ছে ঐ এলাকার সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে দাবিয়ে রাখতে। বনজ সম্পদসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ তছ্নছ্ হচ্ছে। এর শেষ কোথায় ?     
আমিও জানতে চাই, এর শেষ কোথায় ? শুধু সরকারকে দোষ দেবো কেন ? দেশের রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন পেশাজীবী, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র - কেউই কি বুঝতে পান যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান অবস্থা জারি থাকলে দেশের অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত কোথায় মুখ থুবড়ে পড়বে ? এই দরিদ্র দেশের মানুষের দারিদ্র নামবে কোন পর্যায়ে ? মধ্যবিত্তের লেখাপড়া, বিদ্যাচর্চা যাবে কোন রসাতলে ? পার্বত্য চট্টগ্রামের আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে তার আঁচ থেকে বাঁচবে কে ?

৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পেশকৃত ৫ দফা সম্পর্কে মূল্যায়ন করুন।
পাঁচ দফায় পাহাড়ি ছাত্রদের গণতান্ত্রিক মনোভাব ও বিবেচনাবোধের পরিচয় পাই। তবে জাতীয় সংসদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটি কি করতে পারে ? তাদের কাজ করতে হবে গঠনতন্ত্র অনুসারে। গঠনতন্ত্রে দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাসমূহের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার কোনো ব্যবস্থা আছে কি ? আর জাতীয় সংসদে পাহাড়ি প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে পাহাড়ি রাজাকার বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোন কাজ হবে ? ৩ নম্বর দফা সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় আজই ব্যবস্থা নিতে পারে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা কে কোন বিষয় পড়বে, কার যোগ্যতা কতটুকু তার বিচার করার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকা উচিত সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজ করবে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, তা সশস্ত্র বা নিরস্ত্র, হিংস্র বা নিরীহ যাই হোক না কেন, এই ব্যাপারে তাদের কোনো রকম নাক গলানো বরদাশত করা উচিত নয়।

৫। দেশের লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী প্রমুখের পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের দায়দায়িত্ব কতখানি বলে মনে করেন?
বাঙালীর ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামে দেশবাসীকে উদ্ভুদ্ধ করতে আমাদের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন এই দেশের ছোট জাতিসত্ত্বাগুলির অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীকে নস্যা করার জন্যে যখন নিষ্ঠুর নিপীড়ন চলে তখন ঐ লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের উদাসীনতা শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জার বিষয়ও বটে। ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা বাবরি মসজিদে ইতর আক্রমণ চালালে আমারা সঙ্গতভাবেই তার প্রতিবাদ করি। বাংলাদেশে মুসলমান মৌলবাদীদের পাশবিক আস্ফালনে সভ্যতা ও সংস্কৃতি সংকটাপন্ন হলে আমরা রুখে দাঁড়াই। এ সবই বাঙালী লেখকদের দায়িত্ববোধ ও সাহসের পরিচয় দেয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে গত কয়েক বছর ধরে যে অবিরাম নির্যাতন চলছে তা নিয়ে এরা নীরব কেন ? গত বছর অক্টোবরে খাগড়াছড়ির দুটো গ্রামের একটিতে দুর্গাপূজার জন্যে তৈরি মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হলো, আরেকটি বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধদেবের মুর্তি ভাঙ্গা হলো, একই জেলায় একই মাসে একটি গ্রামে অপারেশন চালাতে গিয়ে একটি বাড়িতে পুরুষদের বেঁধে রেখে মা ও মেয়েকে এক সঙ্গে বলাকার করা হলো। লেখকদের মধ্যে এসব ক্ষোভের সঞ্চার করে না কেন ? কয়েক বছর আগে জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস ঢাকায় এলে আমাদের লেখকদের সামনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা নিয়ে গভীর আক্ষেপ করে যান। আমরা কিন্তু তাঁর আক্ষেপে সাড়া দিইনী। লেখকদের এই প্রতিক্রিয়া কিংবা প্রতিক্রিয়ার অভাব মোটেই শিল্পীসুলভ নয়।    
এই দেশের এবং স্বতন্ত্র হলেও কাছাকাছি সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় রাখা লেখকদের অপরিহার্য কর্তব্য। যেখানে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের সংস্কৃতি বিপন্ন হলে যে কোনো শিল্পী তাতে উদ্বেগ বোধ না করে পারেন না, সেখানে আমাদেরই কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখী হলে সমগ্র জাতির স্বার্থেই তাদের এর প্রতিকারে উচ্চকন্ঠ হওয়া উচিত। শিল্পীর সামাজিক দায়িত্বের কথা যদি নাও বলি, কেবল তার শিল্পচর্চার জন্যেও নিজের দেশের অধিবাসীদের ওপর নির্যাতন নিয়ে মাথা ঘামানো দরকার। দেশের ভেতরেই ভয়াবহ, রক্তাক্ত ও বিভীষিকাময় এবং একই সঙ্গে সাহসী ও সংকল্পাবদ্ধ ঘটনা ঘটে চলেছে, এ নিয়ে লেখক ও শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীরা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সচেতন ও প্রতিবাদী করে তোলার কাজে অবশ্যই এগিয়ে আসতে পারেন।

৬। কীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধান হতে পারে ? আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন।  
সমাধান বালানো আমার সাধ্যও এখতিয়ারের বাইরে। একজন লেখক হিসাবে আমি কেবল সম্ভাবনা সম্বন্ধে আমার অনুভতির কথা বলতে পারি।
প্রথমত ও প্রধানতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সমস্যাকে প্রত্যেক বাঙালিকে নিজের সমস্যা বলে অনুভব করতে হবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ ও ঘরে ঘরে অগ্নি সংযোগের ঘটনা আজো আমাদের মধ্যে ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে, রাজাকার আলবদরদের আমরা এখনো ফাঁসি দাবী করি। আমাদের দেশের যে কোন জাতিসত্তার ওপর নির্যাতন আমাদের মধ্যে একই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করা উচিত, তা হলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এর প্রতিকারে প্রতিরোধের লক্ষ্যে এগিয়ে আসবেন।            
পাহাড়িদের জমিতে জোর করে যাঁদের বসানো হচ্ছে তাঁরা হলেন নিরীহ ও গরিব বাঙালি কৃষক। এঁদের প্রতি কোনো ভালোবাসা থেকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়নি। পাহাড়িদের উচ্ছেদ করার জন্যে এঁদের ব্যবহার করা হচ্ছে। পাহাড়িদের যদি নিশ্চিহ্ন করা যায় তো তার পর পরই এঁদেরও ঐসব জমি থেকে নির্মূল করা হবে, ঐ জমি দখলের জন্যে তখন হামলে পড়বে দেশের ধনী, বুর্জোয়া সুবিধাভোগীর দল। এই ধরনের ব্যাপার এই উপমহাদেশে আগেও ঘটেছে। বাঙালি নি¤œবিত্ত শ্রমজীবীর সঙ্গে বাঙালি বুর্জোয়া, সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। নির্যাতিত ও শোষিত পাহাড়ি এবং নির্যাতিত ও শোষিত ও প্রতারিত বাঙালি শ্রমজীবী অনেক ঘনিষ্ট আত্মীয়। এই সত্যটি সবার মধ্যে উপলদ্ধি করবার দায়িত্ব বাঙালি ও পাহাড়ি লেখক, শিল্পী ও রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর।
এখন বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ অত্যন্ত কম। এটা খুব দুঃখজনক। উভয় সংস্কৃতির জন্যেই এটা ক্ষতিকর। পরস্পরের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে পরস্পরকে ওয়াকিবহাল হতে হবে। পরস্পরকে না চিনলে কেউ কারো সমস্যা বুঝতে পারবেন না, শুধু তথ্য জেনে কোন সম্প্রদায় কিংবা জাতিসত্তার সমস্যা সম্বন্ধে কেউ উদ্বিগ্ন হতে পারে না। এই ব্যাপারে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের শিক্ষিত ও সচেতন অংশের একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্বন্ধে বাঙালিদের অবগত করার দায়িত্ব তাঁরাই নেবেন। হিল লিটারেচার ফোরামের মুখপত্র “রাডার” এই ব্যাপারে উদাসীন। পাহাড়িদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারটি সফলভাবে প্রকাশ করলেও তাঁদের সাহিত্যকর্ম বা সংস্কৃতির কোনো পরিচয় দেওয়ার উদ্যোগ সেখানে নেই। বিভিন্ন জাতিসত্তার রূপকথা, গাথা, গল্প, কবিতা, নাটক, গান প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হলেই বাঙালি তাঁদের আত্মীয় বলে পাহাড়িদের চিনতে পারবে। রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে সঙ্গেই এই কাজগুলো করতে হবে।
পাহাড়িরা ২১শে ফেব্রুয়ারিকে তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার দিবস হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন। বাঙালিরা কিন্তু এই দিনটিকে শুধু বাংলা ভাষা আদায়ের আন্দোলনের দিবস হিসেবে বিবেচনা করেন না, তা হলে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গেই এর কার্যকারিতা ফুরিয়ে যেতো। বাঙালির প্রত্যেকটি প্রগতিশীল আন্দোলন প্রত্যেক বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে নতুন গতি ও উত্তাপ লাভ করেছে। পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহ যদি ঐ দিনেই তাঁদের নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী দিবস হিসাবে চিহ্নিত করেন তাহলে বাঙালিরা একদিকে তাঁদের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করবেন এবং অন্যদিকে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে তাঁরা অন্য ভাষাভাষীদের ভাষার দাবীকে সম্মান করতে শিখবেন। পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের প্রত্যেকের ইতিহাস সম্বন্ধে দেশের সবাইকে ওয়াকিবহাল করতে হবে। এঁদের বিদ্রোহের ঐতিহ্যও দীর্ঘদিনের। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বেচ্ছাচারিতা ও শোষণের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির বিদ্রোহের বিবরণ অনেক জায়গায় পাওয়া যায়। তাঁদের এই বীরত্বব্যঞ্জক ও সাহসী প্রতিরোধের ঐতিহ্যে চাকমাদের সঙ্গে বাঙালিও গৌরব বোধ করতে পারেন যদি এই ইতিহাস যথাযথভাবে প্রচার করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক কার্যকলাপের তুলনায় শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নতুন মুল্যায়ন কিছুমাত্র কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
------------------------------------------

সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাবলীকে রাজনৈতিকভাবে

 সমাধান করা

-কবি শামসুর রাহমান

[কথা ছিল কবি কবিতা লিখবেন রাডারে। সে যত ছোটই হোক। কিন্তু শারীরিকভাবে তিনি অসুস্থ। তার সত্ত্বর আরোগ্য কামনা করে অপেক্ষা করলাম আমরা বেশ ক’দিন। অবশেষে তিনি কবিতা না লিখে কিছু প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগ্রহ জানালেন ফোনে। তক্ষনা কিছু প্রশ্ন নিয়ে কবির মুখোমুখি হওয়া। এক নাগারে বলে যান আমাদের প্রশ্নের জবাব। বললেন অব ুড়ঁ যধঢ়ঢ়ু ? সকৃতজ্ঞ স্বীকারোক্তি। অবশ্যই। বার্ধক্যের চাহনিতে চেয়ে থাকেন ফ্যাল ফ্যাল। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জমতে থাকে কবির প্রতি। আমরা কবির সুষ্ঠু ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। (সম্পাদনা পরিষদ) ]

(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে কীভাবে দেখেন ? সেখানে সচরাচর পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের পেছনেও যে পাহাড়িদের উপর সামরিক ও রাজনৈতিক অত্যাচার চলছে তা জানেন কি ?
আমি Life is not ours রিপোর্টটি পড়েছি। এই রিপোর্ট একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন প্রস্তুত করেছেন। এই রিপোর্টের তথ্য ভুল বলে আমি মনে করি না। এতে অনেক সত্য কথা আছে এবং আমি দু’এক জন পাহাড়ি ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের দুঃখ দুর্দশার কথা জানতে পেরেছি। আমি মনে করি এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। কোন রকম জোর জবরদস্তি করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না।

(খ) স্বতন্ত্র কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ভেতর বিকশিত পার্বত্য এলাকার অনগ্রসর ও নির্যাতিত পাহাড়ি মানুষগুলোর জন্য কবি হিসেবে আপনার কী করণীয় বলে মনে করেন ? বাংলাদেশর একজন নাগরিক হিসেবেই বা কী দায়িত্ব ?
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্তর্গত এলাকা। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। এদেশের প্রত্যেক অঞ্চলের জন্যে আমার ভালোবাসা রয়েছে। এ দেশের মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ আমার একান্ত কাম্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধিবাসীদের একটি আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। এই সংস্কৃতির বিকাশ আমার কাম্য। পাহাড়িরা যাতে নিরাপদভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং অবাধ সংস্কৃতি চর্চ্চা করতে পারে সেজন্যে অনুকুল পরিবেশ তৈরী করা আমাদের সবারই দায়িত্ব। আমি চাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যাবলীর যত তাড়াতাড়ি একটি সুষ্ঠু সমাধান হোক।

(গ) অনেক দিন আগে আপনি রাঙ্গামাটি গিয়েছেন। কর্ণফুলীর কৃত্রিম হ্রদের নীল জল আর পাহাড়িয়া প্রকৃতি আপনার কবি হৃদয়ে কী রকম প্রভাব ফেলেছে?
আমি রাঙ্গামাটিতে গিয়ে নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেখানকার প্রকৃতির একটি আলাদা সৌন্দর্য্য সহজেই চোখে পড়ে। পাহাড়ি এলাকার রূপ এখনও আমার চোখ ও মন জুড়ে আছে। এই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে যে সন্ত্রাস তা আমাকে পীড়িত করে। আমি চাই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা সন্ত্রাস মুক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে মধ্যে বসবাস করুক। যেন কোন সমস্যাই তাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতে না পারে সে দিকে প্রসাশনের লক্ষ্য রাখা উচিত । এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদেরও একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা দরকার।

(ঘ) আপনার ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’ কবিতাটি খুবই ভালো লেগেছে। আমরা যদি নিজেদের স্বকীয় অস্তিত্ব, কৃষ্টি, সংস্কৃতি তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের কথা বলি তখন আপনি তা কীভাবে দেখবেন ? এতো নিশ্চয়ই দেশদ্রোহীতা হতে পারে না।
আমার কবিতা “দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে” একটি বিশেষ পটভূমিতে লেখা হয়েছিল। যখন স্বাধীনতা বিরোধী লোকজনদের বাংলাদেশের প্রতি কৃত্রিম, বানোয়াট দরদ লক্ষ্য করি তখন মনে বেদনা এবং ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। তাই দুঃখ করে লিখেছিলাম ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’। আমি মনে করি পাহাড়িদের ন্যায্য দাবীগুলি মেনে নেওয়া উচিত। তাহলে পাহাড়িদের মধ্যে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কোন অবকাশ থাকবে না। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত নেতৃবর্গ এবং সরকারের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

(ঙ) পার্বত্য এলাকায় অবিরাম মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। প্রাণহানী হচ্ছে অহেতুক। অথচ আমরা শান্তিপ্রিয় জনগণ এরকমটি কেও চাই না। এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
আমরা কেউ চাই না পার্বত্য এলাকার বাসিন্দাদের মানবাধিকার ভুলুণ্ঠিত হোক। একই দেশের একটি বিশেষ অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা শাসন ব্যবস্থা চলবে এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। এটি অন্যায়।
আমি আগেও বলেছি। আবারও বলছি বাংলাদেশ সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাবলীকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা। রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সুরাহা হলেই, আশা করি সেখানে শান্তি ফিরে আসবে। একটি ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হলে তা ক্যানসারে পরিণত হয়। অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই ক্ষত সারিয়ে ফেলা দরকার। কেননা, এই ক্যানসার বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

-------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন