পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ২ মে, ২০১৭

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ১৬ - ১৭

চালচিত্র

“মার্ডার হলেও রাডার কিনবো”
রাডারের রাহুমুক্তি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সংখ্যাটি খুবই সমাদৃত হয়। অনেককে রাডার পড়ার জন্য নিগৃহীত হতে হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়িতে প্রতুল বিকাশ খীসাকে রাডার কেনার দায়ে জনৈক আর্মি কর্তৃক উরুতে লাঠি খেতে হয়েছে। পরে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “লাঠি নয়, মার্ডার হলেও রাডার কিনবো।”

কাশীরাম চাকমা-র জীবনের মূল্য ৫,০০০ টাকা
গত ১০ই মে ’৯১ রাতে কাউখালী উপজেলার মিদিঙ্গ্যাছড়ি গ্রামের কাশীরাম চাকমা নামক জৈনক কৃষককে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। দৈহিক নির্যাতনের ফলে তিনি শেষ পর্যন্ত মারা যান। ১৩ তারিখ তার লাশ ফেরত দেয়া হয় এবং তার সকারের জন্য ৫,০০০ টাকা প্রদান করে বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য এলাকাবাসীকে বিশেষভাবে হুমকি দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ১৯৮০ সালে এই কাউখালীতেই সংঘটিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে কলংকময় ঘটনা “কলমপতি হত্যাকাণ্ড”।

সহানুভূতি চাওয়ার শাস্তি ৪০০ ঘনফুট কড়ই গাছ
খাগড়াছড়ি জেলার ভাইবোনছড়া আর্মি ক্যাম্প কমা-ারের কড়া নির্দেশ- “গুচ্ছগ্রামবাসীদের সপ্তাহে অন্ততঃ দুদিন বিনা পারিশ্রমিকে ক্যাম্পে কাজ করে দিতে হবে। অবহেলা করলে চরম দণ্ড।” লাঠি ছাড়া কথা বলতে তিনি অভ্যস্ত নন। “অসহায় গ্রামবাসী সপ্তাহে একদিন ক্যাম্পে কাজ করবে এবং কমাণ্ডার সাহেব তার লাঠি ব্যবহার করবেন না”- এই মর্মে জনৈক জেলা পরিষদ সদস্যের মাধ্যমে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। কিন্তু বিধি বাম। সদয় দৃষ্টি বর্ষিত হলো না। বরং কমা-ার সাহেব আরো বেশী ক্ষেপে গেলেন। তার বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল! এত বড় ধৃষ্টতা! অতএব, গ্রাসবাসীদের ডেকে কড়া নির্দেশ এই ধৃষ্টতা দেখানোর বাড়তি সেলামী হিসেবে ৪০০ ঘনফুট কড়ই গাছ সংগ্রহ করে দিতে হবে। অনন্যোপায় হয়ে সন্ত্রস্ত গুচ্ছগ্রামবাসী হুকুম মানতে বাধ্য হয়।

“বিশ্বজি আর সুবোধকে আটক করতে পারে না”
গত ৯ই জুলাই ঢাকার টি,এস,সি - তে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসনের চিত্র তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য ৫ দফা দাবী সম্বলিত একটি লিফলেট প্রচার করে। এজন্যে খাগড়াছড়ি ক্যান্টম্যান্টে ডাক পড়ে পদলেহী লেজুরদের, যারা “জেলা পরিষদ” নামক প্রতিষ্ঠানে পুতুল নাচ দেখান। স্যারেরা গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে সামনে বসা। বার বার উক্ত লিফলেটটি পড়ে শুনানোর পর স্যার বললেন- “তোমাদের আমরা কী জন্য বানিয়েছি ? তোমাদের ছেলেরা ঢাকায় গিয়ে এগুলো কি করছে ? তোমরা এদের নিষেধ করতে পার না?” ইত্যাদি ইত্যাদি। জেলা পরিষদ নেতারা বাকশক্তিহনি। তারা স্যারদের সামনে কিছুই বলতে পারলেন না। শেষে বেরিয়ে এসে পুরুষোত্তম, পূর্ণজ্যোতি, অরুণোদয় পরস্পরকে বলাবলি করতে লাগলেন- “খালি আমাদের উপর খবরদারী। বিশ্বজি আর সুবোধ -কে আটক করতে পারে না?” উল্লেখ্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বাবু সুবোধ বিকাশ চাকমা এবং সভাপতিত্ব করেছিলেন বাবু বিশ্বজি চাকমা। তাই তাদের উপর লেজুড়দের এত আক্রোশ।

“বুয়েট; বি,আই,টি; কৃষি কলেজে পাহাড়ি ছাত্রদের ভর্তি অনিশ্চিত”
বুয়েট; বি,আই,টি; মেডিকেল ও কৃষি কলেজে যে কোটা সিষ্টেম চালু আছে তার সিলেকশন দিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জি,ও,সি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এবার যথা সময়ে পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীরা দরখাস্ত দাখিল ও পরীক্ষা দেয়ার পরও জি,ও,সি, ভর্তি অনুমোদন দিচ্ছেন না। অথচ ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির শেষ সীমা অতিক্রান্ত হয়ে ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। এভাবে পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্য চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জিম্মি হয়ে আছে।

“রাডার বিক্রির দায়ে মুচলেকা আদায়”
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত দেওয়ান রাজুকে রাডার বিক্রয় করার জন্য পুলিশ ১লা অক্টোবর ৯১ ইং আটক করে। পরে তাকে “পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে সংশ্লিষ্টতা পরিত্যাগ করবে” -এই মুচলেকা আদায় করে মুক্তি দেয়া হয়। বর্তমানে রাঙ্গামাটির লাইব্রেরীগুলোতে “রাডার” বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

“ষ্টাইপেণ্ড প্রদানে ক্যাপ্টেন হারুন ও দীপালোর অবৈধ প্রভাব”
গত ২৪/৯/৯১ ইং তারিখে মহালছড়ি উপজেলা পরিষদের ষ্টাইপেণ্ড প্রদানের জন্য বাছাই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেব যোগ্যতার ভিত্তিতে বৈধ ছাত্র- ছাত্রীদের ষ্টাইপে- প্রদানের পক্ষপাতি। কিন্তু বাঁধ সাধলেন ক্যাপ্টেন হারুন ও তার অনুগত লেুজুড় উপজেলা চেয়ারম্যান দীপালো। তাদের অভিমত হলো সেনাবাহিনীর অনুগত লোকদের ছেলেমেয়েদেরকে ষ্টাইপে- দিতে হবে। অবশেষে তাদের মতই প্রাধান্য পেল। ষ্টাইপে- দেয়া হলো (১) বিপুল খীসা পীং সুধাংশু খীসা, (২) জ্ঞানেশ্বর চাকমা ও (৩) মঞ্জু বিকাশ চাকমা - পীং ধৃতরঞ্জন চাকমা-কে, যদিও তাদের ছাত্রত্ব নেই। উল্লেখ্য, কথিত দীপালো চাকমা গত উপজেলা নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উলঙ্গ হস্তক্ষেপে প্রতিদ্বন্দ্বী আদি শংকর খীসাকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই এখন সেনাবাহিনীর পদলেহনই তার ক্ষমতার ভিত্তি, জনসমর্থন নয়।

“শান্তিবাহিনী আত্মসমর্পনের কেচ্ছা”
খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের মাথায় ভূত চেপে বসলো, যেভাবেই হোক শান্তিবাহিনী যে আত্মসমর্পন করছে তা দেখাতে হবে। অতএব, ৬/১১/৯১ ইং তারিখ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার আয়োজন। খাগড়াছড়ি কলেজিয়েট হাইস্কুলের ছাত্রাবাস “শান্তিনিকেতন কটেজ” থেকে ৮/৯ জন স্বাস্থ্যবান পাহাড়ি ছাত্রকে ব্রিগেড অফিসে ডেকে এনে শান্তিবাহিনীর পোশাক পরিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর তাদের হাতে অস্ত্র দিয়ে ছবি তোলা হয় এবং ভি,ডি,ও -তে ধারণ করা হয়। ছবি তোলার সময় ছাত্রদের মধ্যে নন্দিত নামের একজন আত্মসমর্পনকারীকে বসানো হয়, যাতে এই বানোয়াট ঘটনা সম্পর্কে জনগণের মনে বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করা যায়। এই ঘটনার দু’দিন পর প্রায় সব পত্রিকায় “১১ জন শান্তিবাহিনীর আত্মসমর্পণ” শিরোনামে উক্ত ঘটনাটি পরিবেশন করা হয়।

“মুখ লুকানো ছবি এবং .... ”
সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় হঠা কয়েকজন উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা খাগড়াছড়ি নতুন কুঁড়ি কেজি স্কুলে পদধূলি দিতে যান। সেখানে শিক্ষয়িত্রীদের সাথে চা-নাস্তা ও গল্প-গুজবের পর পাহাড়ি শিক্ষয়িত্রীদের ছবি তোলার অনুরোধ করা হয়। শিক্ষয়িত্রীরা এতে রাজী না হলে অনুরোধ আদেশে পরিণত হয়। অগত্যা শিক্ষয়িত্রীরা ক্যামেরার সামনে দাড়ালেন। তাদের হাতে দেয়া হলো “শান্তিবাহিনী নিপাত যাক”, “আমরা বাংলাদেশকে ভালবাসি” ইত্যাদি শ্লোগান সম্বলিত ব্যানার। অপমানে, দুঃখে, ক্ষোভে শিক্ষয়িত্রীরা ব্যানারের আড়ালে মুখ লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। এই মুখ লুকানো ছবি সেনা অফিসারদের কতটুকু কাজে লেগেছে তা জানা যায় নি, তবে এই ঘটনার পর পাহাড়ি শিক্ষয়িত্রীরা পদত্যাগ করেন বলে জানা গেছে।

“ভূবনের উপাতে বাঁশ বিক্রেতারা অতিষ্ঠ”
ব্রিগেডিয়ার ইব্রাহিমের আমলে গঠিত তথাকথিত টাইগার বাহিনীর প্রধান কুখ্যাত ভূবন চাকমার দাপতে এখন নানিয়ারচরের বাঁশ বিক্রেতাগণ অতিষ্ঠ। বিক্রেতাদের কাছ থেকে সে ট্যাক্স আদায় করছে এবং না দিলে “শান্তিবাহিনী” বা “শান্তিবাহিনীর সহযোগী” বলে আর্মির হাতে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। ফলে বেচারা বাঁশ বিক্রেতাদের বাধ্য হয়ে দাবীকৃত ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। অধিকন্তু পাহাড়ি বাঁশ বিক্রেতাদেরকে এক কিস্তিতে দাম পরিশোধ না করার জন্য ব্যবসায়ীদেরকে আদেশ দিচ্ছে, যাতে বিক্রেতারা বারে বারে বাজারে এসে দাম নিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং সেও বার বার ট্যাক্স আদায় করতে পারে। ব্যবসায়ীদের প্রতি তার বক্তব্য- “তোমরা যদি সব টাকা একসাথে দিয়ে দাও, তাহলে ওরা অর্ধেক টাকা শান্তিবাহিনীকে দিয়ে দেবে।”

“পাহাড়িদের জমি অনুপ্রবেশকারীদের দখল”
বর্তমানে পানছড়ি, দিঘীনালা ও কমলছড়ি এলাকার পাহাড়িদের ব্যাপক জমি-জমা সমতলবাসী অনুপ্রবেশকারীদের দখলে চলে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে এর মদদ দিচ্ছে বলে জানা গেছে। পানছড়ি ও দিঘীনালা এলাকার অধিবাসীরা বর্তমানে অনেকে ভারতে শরণার্থী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আর যারা দেশে রয়েছেন তারা “গুচ্ছগ্রাম” নামক বন্দী শিবিরে দিন যাপন করছেন। গুচ্ছগ্রামবাসীদেরকে তাদের নিজ নিজ জায়গা-জমিতে সেনাবাহিনী চাষাবাদ কিংবা ঘর-বাড়ি করতে দিচ্ছে না। অথচ এসব পাহাড়িদের জায়গা-জমিতে এখন প্রতিনিয়ত অনুপ্রবেশকারীদের বসত বাড়ি গড়ে উঠেছে এবং এভাবে পাহাড়িরা তাদের জায়গা-জমি হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে।

“প্রতি পরিবার মাত্র দুই কেজি চাল কিনতে পারবে”

২৭/১০/৯১ ইং মহালছড়ি জোনের জোনাল কমা-ার নির্দেশ দিয়েছেন যে, পাহাড়িরা পরিবার প্রতি মাত্র ২ কেজি চাল কিনতে পারবে। অধিকন্তু, তার নির্দেশে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ২৫/১০/৯১ ইং তারিখে পাহাড়িদের কাছ থেকে বাজার থেকে ফেরার সময় সমস্ত চাল কেড়ে নেয়। এভাবে প্রায় ১০/১২ মন চাল কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে যা আর ফের পাওয়া যায় নি।

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ১৮ - ১৯

সংসদীয় গণতন্ত্র ও জনগণের প্রত্যাশা
-         মিঃ পারদর্শী

অবশেষে জনগণের চাপে ক্ষমতাসীন সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা হলো সরকার পদ্ধতির প্রশ্নে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন চুড়ান্ত রূপ লাভ করলো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস এবং সর্বোপরি সংবিধানের বিধানানুযায়ী গণভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। যদিও স্বৈরাচারী এরশাদের আস্তানা রংপুরের জনগণ পাইকারী হারে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির বিরুদ্ধে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির গালে চপেটাঘাত লাগায়। দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচারী শাসন-শোষণে পিষ্ট জনগণ বুঝি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এবার বুঝি বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে চললো। দারিদ্য-পীড়িত বাংলার জনতা পাবে গণতন্ত্রের সোনালী আভা। তাদের ভাত-কাপড়-বাসস্থানের সমস্যা বুঝি দূর হবে। কিন্তু এ স্বপ্ন দেখতে না দেখতে জনতার মোহভঙ্গ হলো যখন বি,এন,পি, সরকার প্রেসিডেন্টের আসনে বসালো রাজাকার আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে। এবপর একের পর এক শুরু হলো রাজাকারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে ক্ষমতায় বসিয়ে পুনর্বাসন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জনাব পন্নীকে করা হলো দেশের প্রাণকেন্দ্র আইন সভার ডেপুটি স্পীকার। সর্বোপরি দেশের উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষাবস্থা সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। কমনওয়েলথ সম্মেলন থেকে ফিরে এসেই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বললেন, দেশে কোন দুর্ভিক্ষাবস্থা নেই। অথচ জনগণ জানে দেশের উত্তরাঞ্চল এবং পার্বত্যঞ্চলে দারুণ খাদ্যভাব বিরাজ করছে এবং অনাহারে অর্ধাহারে মানুষ দিন গুণছে। মৃত্যুর সংবাদও কম আসেনি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে যদি এ ধরনের মন্তব্য শুনতে হয় তাহলে সংসদীয় সরকারের ভবিষ্য যে কী হবে তা সচেতন জনগণ ভাল করেই জানেন। তদুপরি দেশের প্রধান তিনটি বৃহ রাজনৈতিক জোটের রূপরেখা (যে রূপরেখার ভিত্তিতে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিলো) এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফা দাবী বাস্তবায়নের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। তিন জোটের রূপরেখা এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফার অন্যতম প্রধান দাবী ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের সহযোগীদের কোন দলে আশ্রয় না দেয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেশের প্রধান দুটি দল (ক্ষমতাসীন বি,এন,পি এবং বিরোধী আওয়ামী লীগ) তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একের পর এক এরশাদের সহযোগীদের নিজের দলে আশ্রয় দিয়ে পুনর্বাসন করতে থাকলো। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে ? সবচেয়ে জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে ৯০ -এর ছাত্র-গণ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অপরাধী নীরু, অভিদেরকে শুধুমাত্র দলের স্বার্থে নিজের দলে আশ্রয় দেয়া। স্বৈরাচারী এরশাদের সহযোগীরা ক্ষমতাসীন সরকারী দল এবং প্রধান বিরোধী দল উভয়ের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। এরা একে অপরকে দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দোষ ঢেকে রাখার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। সর্বোপরি এরশাদ পতন আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফা দাবীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অগ্রাহ্য করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করলো এই সংসদীয় সরকার জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। রংপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সারা দেশে যখন মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে মারা যাচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে সংসদে আলোচনা হচ্ছে সাংসদরা লাল পাসপোর্ট কিভাবে পাবেন, প্রধান মন্ত্রীর সুযোগ সুবিধা কী হবে, কোন মন্ত্রীরা কত টাকা বেতন পাবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের অবরোধ-হামলা সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে সরকারী দল এবং প্রধান বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন সমূহের মধ্যে গুলি পাল্টা গুলির কারণে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ ছাত্র, টোকাই। দোষ চাপানোর চেষ্টা চলছে একে অন্যের উপর। জনগণের টাকায় পোষা পুলিশ পালন করছে নীরব ভূমিকা। এজন্য পুলিশ প্রশাসনকে প্রশ্ন করা হলে তারা স্পষ্টভাবে জবাব দিচ্ছে “আমাদের উপর নির্দেশ না থাকলে আমরা কী করবো।” সরকারী কর্মচারীদের বেতন স্কেল নিয়ে আন্দোলন হলে সরকার তা দমন করে নির্মমভাবে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর পুলিশ এবং মাস্তানদের লাঠি চার্জ করা হয়। স্বৈরাচারী ভঙ্গীতে শ্রমিকদের উপর আক্রমণের ফলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রি। ফলে বেকার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক এবং গার্মেন্টস শিল্পের মত একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হচ্ছে ধ্বংসের মুখোমুখী। ভাঙচুরের প্রতিবাদে বুয়েটের শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ মিছিলেও পুলিশ বাধা দান করে। মুদ্রাষ্ফীতির পরিমাণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে জনজীবন বিপর্যস্ত করেছে। মোদ্দাকথা, সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করার পরও জনগণের এই দশা ! এসবের মূল কারণ হচ্ছে, সরকার পদ্ধতিতে পরিবর্তন হলেও শাসন কাঠামো পূর্বের মতই রয়ে গেছে। কাজেই রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তনের ফলে দেশের শাসন ব্যবস্থায় বড় ধরনের আশা করাটা বোকামী। জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধান করতে হলে দরকার এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙ্গে নতুন করে সাজানো। অর্থা বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধানের পথ নিহিত রয়েছে।

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ২০ - ২২

সাক্ষাতকার
[পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা। সঙ্গত কারণেই আমরা মনে করি এ সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের সচেতন ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিকর্মীসহ সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকাকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে কে কী ভাবছেন তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সচেতন মহলের সাক্ষাতকার ছাপাবো। এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে গত সংখ্যায় (রাহুমুক্তি সংখ্যা) আমরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী জনাব বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাতকার ছেপেছিলাম। এ সংখ্যায় তিনজন বিশিষ্ট ছাত্র নেতার সাক্ষাতকার ছাপানো হলো]

প্রশ্নসমূহ নীচে দেয়া হলোঃ-
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগণের যে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চলছে তাকে আপনার সংগঠন কিভাবে মূল্যায়ন  করে ? এ সমস্যার ব্যাপারে আপনাদের সংগঠনের কি কর্মসূচী আছে?
(খ) পার্বত্য এলাকায় যে ব্যাপক সামরিকীকরণ এবং সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে যে বিপুল অ-পাহাড়ি পুনর্বাসন করা হচ্ছে সে সম্পর্কে আপনাদের কী বক্তব্য?
(গ) পাহাড়ি ছাত্ররা বরাবরই তাদের দাবী দাওয়া নিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক মূল স্রোতধারায় মিলিত হবার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। তাদের আন্দোলনের প্রবাহকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে আপনারা কী ভূমিকা নিতে পারেন ?
(ঘ) বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীনে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের আন্দোলনের ফলাফল কি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর সাথে আপনি কি একমত ?
(ঙ) পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি অন্যতম জাতীয় সমস্যা। অথচ এ সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় রাজনৈতিক দলসমূহ দুর্ভাগ্যজনকভাবে উদাসীন। এর সমাধানের দাবী শুধু সেখানকার অধিবাসীদের আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। তাই এ ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার জন্য আপনাদের ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করুন।

পাহাড়ি জনগণের সাথে দেশের ব্যাপক অ-পাহাড়ি জনগণের কোন বিরোধ নেই।
ফয়জুল হাকিম, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন

ক) পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগণের যে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চলছে তাকে আমাদের সংঠন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে। এ সমস্যার ব্যাপারে আমাদের সংগঠনের কর্মসূচী মূলতঃ আমাদের রাজনৈতিক জোট, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের নেতৃত্বে জাতিগত সংখ্যালঘু ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করেছে।

খ) পার্বত্য এলাকায় যে ব্যাপক সামরিকীকরণ এবং সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গোপন সার্কূলারের মাধ্যমে যে বিপুল অ-পাহাড়ি পুনর্বাসন করা হচ্ছে সে সম্পর্কে আমরা অবহিত। এ কাজ এ দেশের শাসক সংখ্যালঘু লুটেরা ধনিক-বণিক শ্রেণীর সরকারসমূহ করে আসছে উগ্র জাতীয়তাবাদের আবরণে এবং পাহাড়ি জনগণের উপর শোষণ-শাসন বলব রাখতে অ-পাহাড়িদের ধারা অব্যাহত রেখে পাহাড়ি জনগণের সাথে অ-পাহাড়ি জনগণের “বিরোধ” সৃষ্টির মাধ্যমে। এই “বিরোধ” কে সামনে রেখে এরা সামরিকীকরণের প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য করবার অপচেষ্টায় লিপ্ত। আমরা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, মনে করি পার্বত্য এলাকাসহ দেশের যে-কোন স্থানে সামরিকীকরণের বিরোধীতা করা ছাড়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এক কদমও অগ্রসর হতে পারে না।

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ২৩ - ২৬

 দৈনিক গিরিদর্পনে প্রকাশিত হাতেম তাই-এর কিছু কথার জবাবেঃ
-  মি. গণমুক্তি

দৈনিক গিরিদর্পনের ২২/১০/৯১ ইং তারিখের “হিল লিটারেচার ফোরামের ‘রাডার’, আজকের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আমাদের কিছু কথা” শীর্ষক লেখাটি আমাদের দৃষ্টি গোচর হয়েছে। আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছিলাম মত-পথ নির্বিশেষে আমাদের সমালোচনা করার অধিকার সবার। পাশাপাশি আমরাও আমাদরে লেখার অধিকার চেয়েছি। মতামত প্রকাশ ও আলোচনা-সমালোচনার ব্যাপারে এই হচ্ছে আমাদের পরিস্কার বক্তব্য। তাই যে কোন গঠনমূলক, সৃজনশীল, দিক নির্দেশনামূলক সারগর্ভপূর্ণ আলোচনা-সমালোচনা আমাদের কাছে বেশ আদরণীয়। আমরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে সে ধরনের লেখা দেখতে চাই।

দৈনিক গিরিদর্পনে প্রকাশিত হাতেম তাই সাহেবের লেখা আমরা যে মনযোগ ও আগ্রহের সাথে দেখতে চেয়েছি, দুঃখজনক হলেও সত্য, তার লেখায় আমরা মনযোগ দেবার মতো কোন কিছুই পাইনি। আগ্রহের পরিবর্তে তার লেখা পড়তে অনীহা এসেছে এবং ঘৃণা জেগেছে।

তিনি পরিণত মন ও কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে লিখতে পারেননি। আবেগের বশবর্তী হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। অনেক অসংলগ্ন, অশোভন ও কুরুচিপূর্ণ উক্তি করে ফেলেছেন। সচরাচর আমরা কোন উদ্ভট ও অন্তসারশূন্য লেখাকে আমল দিই না এবং পরোয়াও করিনা। হাতেম তাই সাহেবের কাণ্ডজ্ঞানহীন সমালোচনাকেও আমরা মোটেই আমল দিতাম না। অহেতুক কাগজ-কালি খরচের বিলাসিতা করতে যেতাম না। কিন্তু তিনি সমালোচনা করার নামে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে যেভাবে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন তা কোন অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না।                                                                  
দেশের এত পত্র-পত্রিকা থাকতে কিসের তাড়নায় তিনি দৈনিক গিরিদর্পনের মতো একটা বিশেষ (?) পত্রিকায় রাডারের সমালোচনা করতে গেলেন ? এটা কি ঐ পত্রিকার কাট্তি বাড়াবার একটা বাণিজ্যিক কৌশল ? রাডারের Good will থেকে কিছু ফায়দা লুটার ন্যাকামীপনা ? নাকি আবার অন্য কিছু ? হাতেম তাই সাহেব যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ঐ সমালোচনা লিখে থাকুন- আমরা তার প্রতিটি লাইন ও বাক্যের জবাব দিতে পারি। উদ্ভট সমালোচনার পেছনে কাগজ ও কালি অপচয়ের কথা ভেবে আমরা শুধু নীচের কিছু বিষয়ের উপর আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছিঃ

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ২৭

গত সেপ্টেম্বর ১৩ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত জার্মানীর হামবুর্গ মিউজিয়াম অব এটনোলজিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত যে ৩য় আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল সে সম্মেলনের একটি প্রেস রিলিজ আমরা পেয়েছি। সেই প্রেস রিলিজের ভাষান্তর ছাপানো হলোঃ

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
উন্নয়ন সাহায্যসমূহ বাংলাদেশে সামরিকীকরণ এবং মানবাধিকার লংঘনে সহায়তা করে।
সম্মেলনে বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার এবং উন্নয়ন সাহায্য। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এক বিরাট অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের বৃহত্তর বাঙালী জনগোষ্ঠী থেকে সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং ভাষাগতভাবে ভিন্ন আদিবাসীদের আবাসভূমি। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের শিকার।
সম্মেলনে কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী পাহাড়িসহ বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসী জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করেন। উক্ত সম্মেলনে কিছু বাঙালী অংশগ্রহণকারীও ছিলেন। সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এছাড়াও মানবাধিকার কর্মী এবং সমাজ বিজ্ঞানীরা বক্তব্য পেশ করেন।

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ২৮


প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নিকট ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলফ্রেড টেলক্যাম্পার -এর চিঠি।

পার্লামেন্ট ইউরোপিয়ান                                                               প্রধান মন্ত্রী               
৯৭-১১৩ রু বেলির্য়াড                                                                মিসেস্ বেগম খালেদ জিয়া
এম, এ, ই ৭২৬                                                                       প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়, 
১০৭০ ব্রাসেলস                                                                        ঢাকা,  
 বেলজিয়াম।                                                                            বাংলাদেশ।

২০ শে সেপ্টেম্বর ১৯৯১

ডিয়ার মিসেস প্রধানমন্ত্রী,
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে ১৯৯০ -এর ডিসেম্বরে আমি বাংলাদেশ সফর করি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাঙ্গালী বসতিস্থাপনকারীদের দ্বারা মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগসমূহ তদন্ত করার জন্য এই মানবাধিকার কমিটির উদ্দেশ্য ছিল। আমাদের কমিশন “জীবন আমাদের নয়” শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ এবং সফরের তথ্য উল্লেখ করেছি। বর্তমানে আমি জানতে পারলাম, বাংলাদেশে এই রিপোর্ট সরবরাহকারী মানবাধিকার কর্মীদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ নাগরিক কমিটির মিঃ এস, এম, শহীদুল্লাহ ও রাশেদুর রহমান তারাকে পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার মিঃ তাবিবুর রহমান কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদ এবং হুমকি দেয়া হয় এবং আমাদের “জীবন আমাদের নয়” রিপোর্টের ৯৬০ কপি বাজেয়াপ্ত করা হয়। আমার জানা মতে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের রিপোর্ট বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয় এবং সেহেতু এই রিপোর্টের পুনঃপ্রকাশ বা বিতরণ বেআইনী নয়। সবিনয়ে আপনাকে এই তথ্য অবগত করছি যে আমাদের কমিশনের সফর ছিল সম্পূর্ণ বৈধ এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এই সফর সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু যদি এই রিপোর্ট বিতরণ নিষিদ্ধ হয়ে থাকে তবে তাতে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও তথ্য বিনিময়ের মত মৌলিক মানবাধিকার লংঘিত হবে।

সুতরাং উপরোল্লেখিত মিঃ শহীদুল্লাহ এবং মিঃ তারাকে ভীতি প্রদর্শন ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমি জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এই রিপোর্টের জন্য পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা বা বাংলাদেশের অন্য সরকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশী নাগরিকদের হয়রানী বন্ধের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।
যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের রিপোর্ট নিষিদ্ধ হয়ে থাকে তবে অনুগ্রহ পূর্বক আমাকে অবগত করান। আমি কমিশনের সকল সদস্যদের পক্ষ থেকে এই রিপোর্ট বিতরণের ক্ষেত্রে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করার জন্য আপনাকে এবং আপনার সরকারকে আহ্বান করছি। এই রিপোর্ট ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে এবং ইউরোপিয়ান কমিশনে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষন করতে পেরেছে। আমি নিশ্চিত যে জাতীয় সরকারসমূহ এবং ইউরোপিয়ান কমিশন বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং এই পরিস্থিতির আলোকে তারা পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

ধন্যবাদান্তে
উইলফ্রেড টেলক্যাম্পার

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা): পৃষ্ঠা: ২৯ - ৩১

আন্তর্জাতিক
পেরুর গণযুদ্ধই বিশ্ব বিপ্লবের নতুন অগ্রযাত্রা
-         মিঃ পল্লব

“পেরু” হচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার একটি দেশ। কৃষি প্রধান এই দেশটির উত্তর-দক্ষিণ প্রলম্বিত ভাবে সমগ্র মধ্যভাগ জুড়ে রয়েছে সুউচ্চ আন্দেজ পর্বতমালা, যার সবটাই সবুজ অরণ্য দ্বারা আচ্ছাদিত। দেশের অবশিষ্টাংশ নদী বিধৌত সমতল ভূমি। রাজধানী হচ্ছে লিমা। এই পার্বত্যাধিক্য দেশটির মোট আয়তন ১৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। মোট ২৫টি Department বা রাজ্যে বিভক্ত। প্রতিটি Department আবার কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে। পেরুর বর্তমান লোকসংখ্যা ২ কোটি ৩০ লক্ষ। কু-ই-চুয়া আর স্প্যানিশ হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের ভাষা।

তেল, তামা, রূপা, লৌহা, সীসা, দস্তা, বিসমাথ, সোনা, পারদ, ট্যাংষ্টেন ও ইউরেনিয়াম ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশের মানুষ আজ বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত। উপরোক্ত প্রাকৃতিক সম্পদই যেন পেরুর জনগণের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তখনকার স্পেনীয় সরকারের। তাই ১৫শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পেরুর জনগণের উপর নেমে আসে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবা। গ্রাস করে নেয় সমগ্র পেরু। সুদীর্ঘ ৩শত বছর ধরে পেরুর মেহনতি জনগণের উপর চলে স্পেনীয় বর্বর উপনিবেশিক শোষণ নির্যাতন। কিন্তু পেরুর জনগণ সেই দানবীয় অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে ১৮২১ সালের ২১শে জুলাই স্পেন তার সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত গুটিয়ে নিলেও প্রকৃত মুক্তি আসে ১৮২৯ সালের দিকে আয়াকুচো রাজ্যে সংঘটিত এক ইতিহাসখ্যাত যুদ্ধের মাধ্যমে। স্পেনের উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেলেও তার চেয়ে আরও হিংস্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পেরুর জনগণের উপর নতুন করে চেপে বসে। আজও পেরুর মেহনতি জনগণ মুক্তি লাভ করতে পারেনি সেই তথাকথিত ইয়াংকী সভ্যতার কালো হাত থেকে। বর্তমান বিশ্বের তথাকথিত গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা ও বিশ্ব শান্তির প্রবক্তা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নির্লজ্জভাবে দমন পীড়ন চালাচ্ছে পেরুর জনগণের উপর। ষাটের দশকের শেষের দিকে ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের কালো হাতও পেরুর জনগণের উপর প্রসারিত হয়। যার ফলে ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবার সৈন্যে[র] উপস্থিত ঘটে। কৃষি অর্থনীতি নির্ভর পেরু এখন বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের করাল থাবায় ক্ষত-বিক্ষত। কৃষি অর্থনীতি থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান দেশীয় সামান্ত, মুসুদ্ধি বুর্জোয়া ও বহুজাতিক কোম্পানীদের হাতে।

এই YANKEE (মার্কিন) সাম্রাজ্যবাদসহ সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, এবং দেশী সামন্ত ও মুসুদ্দি বুর্জোয়াদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে প্রকৃত জনগণের সরকার কায়েম করার জন্য পেরুর জনগণ সুদীর্ঘকাল ধরে কমরেড মাও নির্দেশিত “গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও” নীতির ভিত্তিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, ও মাওসেতুং চিন্তাধারার আদর্শকে উর্ধ্বে তুলে ধরে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে যাচ্ছে পেরুর মেহনতি জনগণ। বর্তমান বিশ্বে যেখানে কমিউনিজমের এক বিরাট সংকটময় মুহুর্ত; ঠিক সময়ে পেরুর জনগণ প্রমাণ করে দিচ্ছে সঠিকভাবে মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাওসেতুং-এর চিন্তাধারার আদর্শে সজ্জিত কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করার কোন শক্তি এই পৃথিবীতে নেই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মত পরাক্রমশালী শক্তির সম্মুখে পেরুর গণযুদ্ধ আজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কোনঠাসা হয়ে পড়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক লালিত কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট আল বার্তো ফুজিমোরো ও তার সরকার। তাই অনন্যোপায় হয়ে তার লালিত পুত্রকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রেরণ করেছে গেরিলা যুদ্ধ বিরোধী বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত এবং ভিয়েতনাম ও পানামায় কুখ্যাতি অর্জনকারী “গ্রীন বেরেট” সেনা দলকে। এই গণযুদ্ধের নেতৃত্বে রয়েছে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি (PCP)। আজ যার নেতৃত্বে পেরুর গণযুদ্ধ উত্তর উত্তর বৃদ্ধি ঘটছে তিনি হচ্ছেন কমরেড আবিম্যাল গুজমান। যার পরিচয় কমরেড গণজালো নামে। পিসিপি সংগ্রামের বর্তমান যে স্তরে উপনীত হয়েছে, তার পিছনে রয়েছে সুদীর্ঘ এক উত্তান পতনের ইতিহাস। এই সামান্য পরিসরে যদিও পিসিপি-এর বিস্তারিত ইতিহাস বর্ণনা করা সম্ভব নয়, তথাপি মোটামুটি ধারণাটা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করবো।

রাডার (বিজয় দিবস সংখ্যা) : পৃষ্ঠ মলাট

মূল্য ৫.০০ টাকা মাত্র


শুধুমাত্র খাদ্য গ্রহণ, নিদ্রা এবং যৌন জীবনে যার সন্তুষ্টি, যার জীবনের পরিধি এর বাইরে যায় না - যার জীবন - স্বার্থকতা মানে হচ্ছে আরও বেশী ভোগ, তার জীবনকে মার্কস বলেছিলেন গরুর জীবন। পশুর জীবনের সাথে তার পার্থক্য কি ? পশুর সঙ্গে মানুষের তফা, মানুষ সৃষ্টিশীল, মানুষ নিজের জীবনকে  পরিবর্তন করতে পারে। মানুষ প্রকৃতির নিয়ম জেনে তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে মানব সমাজকে উন্নততর অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। মানুষ শুধু নিজেকে নয়, পরিপার্শ্বকে পরিবর্তন করে, করতে চেষ্টা করে। যে সমাজ আর পরিপার্শ্বের মধ্যে আমরা বসবাস করি সেখানে যে নির্বিকার থাকতে পারে তার সঙ্গে পশুর জীবনের পার্থক্য নেই। নিজেদের মধ্যকার ঘুমন্ত সৃষ্টিশীলতা, উদ্যম এবং মানবিক গুণাবলীকে শৃংখলমুক্ত করার এই সময়। মহাক্ষমতাধর মানুষ যদি জেগে না উঠে তবে পরাক্রমশালী অমানুষের বীভস থাবার নীচে তাকে পীষ্ট হতেই হবে। আজকের তরুণ নিশ্চয়ই সেই মানুষ, যে এ অবস্থাকে কোন মতেই মেনে নেবে না।                        
                                                                        - আনু মুহাম্মদ।