প্রচ্ছদ নিবন্ধ
তথাকথিত কাউন্টার
ইন্সার্জেন্সি : পার্বত্য জনগণের দুর্ভোগ
- মিঃ মানবমিত্র ।
১.প্রাক-কথনঃ রক্তাক্ত সংঘাতময় এক জনপদের নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম।
একদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য সশস্ত্র
গণসংগ্রাম এবং অন্যদিকে সেই সংগ্রামকে দমন করার জন্য সামরিক প্রচেষ্টা-
পার্বত্য
চট্টগ্রামকে পরিণত করেছে এক অগ্নিগর্ভ রণক্ষেত্রে। এখানে উগ্র বারুদ অত্যাচারে জনজীবন
হয়েছে দুর্বিসহ। তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির যাঁতাকলে পিষ্ঠ পাহাড়ি বাঙালী নির্বিশেষ।
দীর্ঘ অত্যাচার, নির্যাতন আর যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত পার্বত্য জনতার আজ বেদনার্ত উচ্চারণ
- “জীবন আমাদের নয়”। সত্যিই সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ এক “অপারেশন থিয়েটার”। কাউন্টার
ইন্সার্জেন্সি নামক বেয়নেট দিয়ে জনজীবনের ওপর চালানো হচ্ছে আনকোরা ডাক্তারের অপারেশন
সার্জারী। পার্বত্য জীবন আজ কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির হাতে জিম্মি।
২.কেন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি?:
কাউন্টার
ইন্সার্জেন্সির আক্ষরিক অর্থই হলো সামরিকভাবে বিদ্রোহ দমন। পার্বত্য চট্টগ্রামে একজন
সামরিক অফিসারের ভাষায়, “Our aim is to gradually
finish the insurgency" কিন্তু কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির আপাতঃ উদ্দেশ্য বিদ্রোহ
দমন হলেও এর চুড়ান্ত লক্ষ্য পাহাড়ি জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেয়া। কারণ পার্বত্য
চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা তথা অস্তিত্ব সংরক্ষণের সমস্যা। অন্য কোন
কারণে নয়, একমাত্র জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এই বিদ্রোহের সূত্রপাত। কাজেই পাহাড়ি
জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের গ্যারান্টি না দিয়ে সামরিক উপায়ে অর্থাৎ কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির
মাধ্যমে উদ্ভুত বিদ্রোহ দমন করার অর্থই হলো জাতীয় অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেয়া।
৩.কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির জন্য
নিয়োজিত বাহিনীঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে বিশাল সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। Chittagong
Hill Tracts Campaign and Information Network এর একটি প্রচারপত্র অনুযায়ী দেশের
নিয়মিত বাহিনীর এক তৃতীয়াংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত। অপরদিকে CHT কমিশনের রিপোর্ট
মতে যদি প্রতি দশজন পাহাড়ির জন্য একজন সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকে তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে
নিয়োজিত সেনাসংখ্যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০,০০০। কিন্তু কেন এই বিশাল সামরিক বাহিনী বা এই
সামরিক বাহিনীর কাজ কি ? CHT কমিশনের রিপোর্ট
অনুযায়ী " The justification for the massive
military buildup in the CHT is that it needed to counter and contain insurgency
activities of the Shanti Bahini (SB). Counter-insurgency is their main task." বর্তমানে
সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম এরিয়া কমাণ্ডারের নেতৃত্বে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি
চালাচ্ছে নিয়মিত সেনাবাহিনী, BDR, পুলিশ, আনসার, VDP, এবং একটি Naval Base.
৪.কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির ট্রেনিং
: কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির ট্রেনিং দেয়ার জন্য ঢাকায় Defence
Staff College নামে একটি সামরিক কলেজ রয়েছে। সেখানে বৃটেনের সামরিক বাহিনীর অভিজ্ঞ
অফিসারগণ প্রশিক্ষণ দেন। তাছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারগণ বিদেশ থেকেও কাউন্টার
ইন্সার্জেন্সির ট্রেনিং নিয়ে থাকেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের US
Army Intelligence Centre ও Military Staff College
Fort Lavenworth, যুক্তরাজ্যের
Aldershot and Camberley, পাকিস্তানের National Defence
College
এবং মালয়েশিয়ার Staff College ইত্যাদি।
৫.পার্বত্য চট্টগ্রাম - কাউন্টার
ইন্সার্জেন্সির মডেলঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিদেশীদের কাছে বর্তমানে নিজেই একটি কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির
মডেল হিসেবে বিবেচিত। বস্তুতঃ কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির বাস্তব শিক্ষাক্ষেত্র হচ্ছে
পার্বত্য চট্টগ্রাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন, USA, কেনিয়া, ভারত,
পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসমূহের সামরিক অফিসারগণ Counter
Insurgency -র পার্বত্য চট্টগ্রাম মডেলকে বাস্তবে
অধ্যয়ন করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে থাকেন।
৬.কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির কলাকৌশলঃ
কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির কলাকৌশলকে চার ভাগে করা যেতে পারে। যেমন- সামরিক, রাজনৈতিক,
অর্থনৈতিক ও সামাজিক কৌশল। এই কৌশলসমূহ আবার পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ও একে অপরের ওপর
প্রভাবিত। সব ধরনের কৌশলই সামরিক বাহিনী কর্তৃক প্রয়োগ করা হয়। এই সব কৌশলসমূহ আলোচনার
মধ্য দিয়েই প্রতিভাত হবে পার্বত্য জনগণের ভোগান্তির চিত্র। নিম্নে এই কলাকৌশলসমূহ আলোচনা
করা হলোঃ-
ক) সামরিক কৌশলঃ কাউন্টার
ইন্সার্জেন্সির Vital technique হচ্ছে সামরিক।
এর একমাত্র উদ্দেশ্য জনগণের মধ্যে অব্যাহত সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করা।
এই কৌশল প্রয়োগের প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে (১) সামরিক অভিযান (২) গণহত্যা ও (৩) “আঙ্গুল”
বাহিনী ব্যবহার।
(i) সামরিক অভিযানঃ শান্তিবাহিনী অনুসন্ধান করার নামে পাহাড়ি জনগণের গ্রাম
ঘেরাও করা, তাদের ঘর বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়া, ধন সম্পত্তি লুট করা, গ্রেফতার, নারী ধর্ষণ,
হত্যা ও অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালানো ইত্যাদি সামরিক অভিযানের অংশ।
(ii) গণহত্যাঃ সন্ত্রাস সৃষ্টির আর এক পদ্ধতি হচ্ছে পাহাড়ি জনগণের ওপর গণহত্যা
চালানো। এ ক্ষেত্রে বসতিস্থাপনকারী বাঙালিদেরকেও ব্যবহার করা হয়। ১৯৮০ সালের কাউখালী
গণহত্যা থেকে আরম্ভ করে ১৯৮৯ এর লংগদু গণহত্যা পর্যন্ত কমপক্ষে ৭/৮ টি গণহত্যায় শত
শত পাহাড়ি প্রাণ হারায়। সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। ফলে
হাজার হাজার পাহাড়ি প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
(iii) “আঙ্গুল” বাহিনী ব্যবহারঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তথাকথিত গণপ্রতিরোধ
কমিটি (ঘুঘ্রুক), টইগার বাহিনী, লায়ন বাহিনী ইত্যাদি মাস্তান বাহিনীকে “আঙ্গুল বাহিনী”
আখ্যা দিয়েছে। এরা পাহাড়ি জনগণের মধ্য থেকে সংগৃহীত এবং সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত,
নিয়ন্ত্রিত ও ভাতাপ্রাপ্ত। এদের সন্ত্রাসী উৎপাতে পার্বত্য
জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। তাদের কাজ হলো মূলতঃ শান্তিবাহিনীর অবস্থান ও বিভিন্ন ব্যক্তি
সম্পর্কে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট দেওয়া।
মূলতঃ সামরিক সন্ত্রাসের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম মানুষের বাসের অযোগ্য
হয়ে উঠেছে। প্রতি মুহুর্তে রয়েছে জীবনের ওপর গ্রেফতার, দৈহিক নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুর
শীতল পরশ নেমে আসার ভয়। নিঃশ্বাস ফেলতেও এখানে কষ্ট হয়।
খ) রাজনৈতিক কৌশলঃ রাজনৈতিকভাবে
জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্য সামরিক সন্ত্রাসের পাশাপাশি রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ- কাউন্টার
ইন্সার্জেন্সির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। রাজনৈতিক কৌশল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম।
যেমন বর্তমানে অকেজো হলেও তৎকালীন জিয়া সরকার জেএসএসকে রাজনৈতিকভাবে
মোকাবিলা করার জন্য ট্রাইবেল কনভেনশন গঠন করেছিলেন। বর্তমান রাজনৈতিক কৌশলসমূহ নিম্নরূপঃ-
(i) বাঙালি বসতিস্থাপন ও তাদের গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহারঃ রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে
এ পদ্ধতিকেই সবচেয়ে জঘন্য বলা যেতে পারে। প্রধানতঃ জিয়ার আমল থেকে হাজার হাজার নিরীহ
গরীব বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুনর্বাসিত করা হয়।
CHT Commission লিখেছে, "
The settlement of Bengalis is also an aspect of Counter-insurgency through
population control, as explained to the Commision by an army officer," বর্তমানে
পাহাড়ি ও বাঙালির অনুপাত পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬০ঃ৪০। এই বাঙালিদের দিয়ে Population
control
করে insurgency দমন করা হলেও তারা নিজেরাই কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির
নির্মম শিকার। তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। CHT কমিশনের রিপোর্ট
থেকে জানা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙালিরা তাদের নিজস্ব সমতল ভূমিতে
ফিরে আসতে চায়। কিন্তু সরকার তাদেরকে জোরপূর্বক আটকে রাখছে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদেরও কোন স্বাধীনতা নেই। সামরিক ক্যাম্পের চারপাশে গুচ্ছগ্রাম
নামক বন্দী শিবিরে আটক রেখে তাদেরকে মানবদুর্গ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে - যাতে শান্তিবাহিনীরা
সেনাক্যাম্প আক্রমন করতে না পারে বা আক্রমণ করলেও সেনাবাহিনীর কোন ক্ষতি না হয়ে বরং
civilian দের ক্ষতি হয়।
(ii) Devide and Rule পলিসি ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারঃ সরকার পাহাড়ি জনগণের ঐতিহ্যগত সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়ার জঘন্য অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই লক্ষ্যে সে “ভাগ কর ও শাসন কর” ফর্মূলাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রয়োগ করার জন্য
ইতিমধ্যে তথাকথিত চাকমা উন্নয়ন সংসদ, মারমা উন্নয়ন সংসদ, ত্রিপুরা উন্নয়ন সংসদ ইত্যাদি
প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনের জন্ম দিয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনী ইদানিং ধর্মকেও ব্যবহার করছে
তাদের রাজনৈতিক হীন স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তারা এক্ষেত্রে বনভান্তে -কেও ব্যবহার করছে।
(iii) জেলা পরিষদঃ J. S. S. এর ওপর রাজনৈতিকভাবে
সুপিরিয়রিটি অর্জন করার মানসে এরশাদ সরকার জেলা পরিষদ গঠন করে এবং তা রাজনৈতিক সমাধান
হিসাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। CHT কমিশনের মতে,
" it (commission) assesses the implementation
of the District Councils also in terms of Counter-insurgency strategy."
(iv) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাঃ বিদ্রোহীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির
একটি পুরোনো কৌশল। এযাবত বেশ কয়েকবার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
এর উদ্দেশ্য বিদ্রোহীদেরকে কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিস্ক্রিয় করা ও তাদের সামরিক শক্তিকে
খর্ব করা।
গ) অর্থনৈতিক কৌশলঃ কাউন্টার
ইন্সার্জেন্সির ষ্ট্র্যাটেজি হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো
প্রয়োগ করা হচ্ছেঃ
(a) পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং যৌথ খামার, আদর্শগ্রাম, গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তরঃ
অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা দান ও শান্তিবাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচানোর নামে সেনাবাহিনী
পাহাড়িদেরকে তাদের স্ব স্ব বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে যৌথখামার, আদর্শগ্রাম, গুচ্ছগ্রাম
ও শান্তিগ্রাম নামক বন্দী শিবিরে স্থানান্তর করা হলেও এর উদ্দেশ্য হলো শান্তিবাহিনীকে
জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। CHT কমিশনের রিপোর্ট "
Life is not Ours " এ উল্লেখিত একজন সামরিক অফিসারের বক্তব্য হচ্ছে- "
the main aim (of the Counrer-insurgency) is to cut the line of supplies to the
Shanti Bahini." এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হওয়াতো
দূরের কথা; বরং অনেকেই এই বন্দীশালা থেকে পালিয়ে এসে সর্বস্বান্ত হয়ে ভিক্ষাবৃত্তির
মত ঘৃণ্য পেশা অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। Concentration
Camp আখ্যা
দেয়া এই গুচ্ছগ্রাম, যৌথখামারে কোন স্বাধীনতা নেই। জনগণকে সেখানে বন্দীর মত জীবন যাপন
করতে হয়। অনেক গুচ্ছগ্রামে তাদেরকে সন্ধ্যার সময় দা, কুড়াল ইত্যাদি কাজ করার হাতিয়ার
সেনা ক্যাম্পে জমা দিতে হয় এবং সকালে কাজে যাওয়ার জন্য আবার সংগ্রহ করতে হয়।
(b) কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে দুই ভাবে কৃত্রিম
দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হচ্ছেঃ-
(i) নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় বিক্রয়ে অবরোধঃ সেনাবাহিনী কর্তৃক সংজ্ঞায়িত
তথাকথিত “লাল অঞ্চলের” প্রত্যেক পাহাড়িকে একটি পরিচয়পত্র ও একটি মার্কেট পাস বাধ্যতামূলকভাবে
বহন করতে হয়। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী চাল, কেরোসিন, তেল, লবণ, ঔষধপত্র প্রভৃতি নিত্য
প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ করে। গত ২৭/১০/৯১ ইং মহালছড়ি জোনের জোনাল কমাণ্ডারের নির্দেশ,
“পাহাড়িরা পরিবার প্রতি মাত্র ২ কেজি চাল কিনতে পারবে।” উৎপাদিত দ্রব্যের
বিক্রয়ের ওপরও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। CHT কমিশনের রিপোর্ট -এ বলা হয়েছে,
One hill youth in Dighinala Upazilla told the
Commisson that his family wanted to sell rice so he could pay the fees for his
studies. When the permission came they were allowed to sell only one maund
(about 40kg) which were not enough to pay for his studies." এই নিত্য
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রয় বিক্রয়ের অবরোধ সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হলো শান্তিবাহিনীরা
যাতে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাজার থেকে সংগ্রহ করতে না পারে। এ ব্যাপারে CHT কমিশনেরও একই
মত, " The reason behind these measures is the
army's fear that people will give food and other necessaries to the SB (Shanti
Bahini)."
(ii) গাছের পারমিটের ওপর নিয়ন্ত্রণঃ শান্তিবাহিনীরা টাকা সংগ্রহ করে - এই অজুহাতে
পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন গাছ ও বাঁশ কাটা ও ক্রয় বিক্রয় বন্ধ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী।
ফলে যাদের জীবিকা গাছ বাঁশের ওপর নির্ভরশীল তাদের অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। পার্বত্য
চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় গত ৫/৬ মাস যাবৎ দুর্ভিক্ষ চলছে।
এতে প্রায় ২০/২৫ জন লোক মারা গেছে।
ঘ) সামাজিক কৌশলঃ সামাজিক কৌশলকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ
(i) চলাচল ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানাদির নিয়ন্ত্রণঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যেককে
পরিচয় পত্র বাধ্যতামূলকভাবে বহন করতে হয়। প্রতি মাইল অন্তত সামরিক চেকপোষ্টে ব্যাগ-বডি
চেক করা হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতেও সামরিক বাহিনীর পূর্বানুমতি বাধ্যতামূলক।
এমন কি কোন গ্রামের কারো বাড়িতে মেহমান আসলেও তা পার্শ্ববর্তী সামরিক ক্যাম্পে জানিয়ে
অনুমতি নিতে হয়।
(ii) ফ্রেইণ্ডশীপ প্রোগ্রাম বা মৈত্রী প্রকল্পঃ সামরিক বাহিনীর ওপর পাহাড়ি জনগণের
আস্থা অর্জন অর্থাৎ পাহাড়ি জনগণের হৃদয় মন জয় করার জন্য সেনাবাহিনী
কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির কৌশল হিসাবে “ফ্রেইণ্ডশীপ প্রোগ্রাম” বা মৈত্রী প্রকল্প হাতে
নিয়েছে। এই প্রকল্পের অধীন কাজগুলো হচ্ছে ক্ষুদ্রায়তন আয় সংস্থান প্রকল্প সৃষ্টি, মন্দির,
স্কুল সংস্কার ও নির্মাণ, খাদ্যদ্রব্য বিতরণ, চাকুরী প্রদান ইত্যাদি। “মৈত্রী প্রকল্প”
খাতে সরকার এখন বিরাট পরিমাণ অর্থ খরচ করছে। ১৯৮৮/৮৯ সালে খাগড়াছড়িতে ব্রিগেডিয়ার ইব্রাহীম
পাহাড়িদের কাছে অকাতরে নোট বিলিয়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা
বলার কারণে। এই জন্যই CHT কমিশনের কাছে একজন সামরিক অফিসারের উক্তি,
" We deserve a Nobel Prize for what we
are doing." দুঃখ হয়, তবুও কেন Nobel কমিটির পার্বত্য
চট্টগ্রামের উপর এতটুকু নজর পড়ে না।
৭.তবুও কেন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি?:
সরকার স্বীকার করেছেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিকভাবেই
তা সমাধান করবেন। কিন্তু মুখে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বললেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো
চলছে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নগ্ন থাবা। এই কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি হলো মূখ্যতঃ একটি
সামরিক প্রক্রিয়া। তাই সঙ্গত কারণেই আজ দেশবাসীর প্রশ্ন - রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান
করা হলে তবুও কেন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির প্রয়োজনীয়তা ?
৮.উপসংহারঃ তিন বছর আগে
একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন
যে, যেভাবে তারা কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি চালাচ্ছিলেন, তাতে দু’বছরের মধ্যেই পার্বত্য
চট্টগ্রামে বিদ্রোহ নির্মূল হবে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, তিন বছর পরও বিদ্রোহ দমন
হয়নি। বরং নিরীহ পাহাড়ি বাঙালি জনসাধারণই এই কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নির্মম শিকার
হচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই কাউন্টর ইন্সার্জেন্সির প্রতি পার্বত্য জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষ
বেড়েই চলেছে। এটা এখন পরিস্কার যে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির মাধ্যমে কিছুতেই বিদ্রোহ
দমন করা যাবে না। সরকারের অনুধাবন করা উচিত; যে কারণে বিদ্রোহের জন্ম, একমাত্র সেই
কারণগুলি দুরীভূত করার মাধ্যমেই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব। [সহায়তাঃ Life
is not Ours', Land and Human Rights in Chittagonh Hill Tracts]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন