বিশেষ রচনা
বিজয় দিবস ও আজকের
বাংলাদেশ
-মিঃ সুপ্রিয়
এবার আমরা বিশতম বিজয় বার্ষিকী
পালন করছি। একুশে পা দেবে বাড়ন্ত যৌবনা এই বঙ্গ ললনা। পেছনে ফেলে এলো সে ধূসর অতীত।
সমুখে নিরাশায় কুঁকড়ে যাওয়া অনুজ্জ্¦ল ভবিষ্যত। বর্তমানে চলছে এই প্রিয় মাতৃভূমির বুক
জুড়ে তীব্র ক্ষুধা, দুর্যোগ, রাজনীতির বেসাতি আর অবিরাম সন্ত্রাসের রক্তাক্ত নৈরাজ্য।
অবাধ ন্যাকামী নৃত্যের আস্ফালনে স্বাধীনতা বিরোধী কালো শকুনেরা অবজ্ঞা করছে বৃদ্ধাঙ্গুলী
দেখিয়ে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দ্রুত বিকাশে বিষিয়ে যাচ্ছে সামাজিক পরিবেশ। রাষ্ট্রীয়
মঞ্চে অভিনয় করছে তারাই যারা একাত্তোরে বিজয় চায়নি। যারা হাত রাঙিয়েছে আমার মুক্তিযোদ্ধা
পিতা কিংবা ভাইয়ের রক্তে। অসুরে চাহিদা মিটিয়ে নিয়েছে আমার স্নেহময়ী
মা-বোনের ইজ্জত হরণ করে। সাধের সংসদীয় গণতন্ত্রের মহেন্দ্রকালে তারাই ভীড় জমিয়েছে খোলস
পরে। তর তর করে উঠে গ্যাছে গণতন্ত্রকামী শত মানুষের লাশের সিঁড়ি ভেঙে ক্ষমতার লোভনীয়
মোহনায়। পল্লী বাংলা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ে উদঙ্গ বাজিয়ে নাচানাচি
শুরু করেছে তারা। বস্ত্র হরণ পর্ব শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন স্রেফ লুটেপুটে
নেয়ার আনন্দ আয়োজন। লক্ষ মুক্তিকামী জনতার রক্ত ভেজা পথ বেয়ে যে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে
এই সুজলা, সুফলা নারীর পৃথিবী কাঁপানো জন্ম, তার হৃৎপিণ্ডেই
চলছে নখর অস্ত্রোপচার। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারীর মত আজন্ম পাপে ভারী হয়ে আসছে
মাটি। রূপসী বাংলার চোখে বিস্ময়, হৃদয় তার অসহনীয় বেদনায় বিক্ষত। ক্লান্তিকর এ পদযাত্রা।
একাত্তোরের মুক্তি পাগল
যুদ্ধাহত যুবক এখন আধপ্রৌঢ়। বার্ধ্যক্যজনিত রোগে আমার যুদ্ধাহত পিতা আজ নিশ্চল। কিন্তু
যে নরশিশুর জন্ম সেদিনের রণক্ষেত্রে সে তো আজ তগবগে যুবা। হতে পারে তার অপ্রতিরোধ্য
শক্তি। সুন্দর স্বপ্ন দেখে সুখী হতে পারত সে। তারও নেই ভবিষ্যৎ, নেই বর্তমানও। তাই আজকের প্রজন্মের প্রশ্ন পূর্বসুরী
মুক্তিযোদ্ধার কাছে, তোমরা কিসের যুদ্ধ করেছিলে একাত্তোরে ? মুক্তির ? নাকি শুধু বিজয়ের
? আমরা তো জানি লক্ষ শহীদের রক্তিম আত্মাহুতির গৌরব গাঁথা। হাজার মায়ের কোল খালি হবার
নির্মম সাহিত্য। শত শত রমণীর ইজ্জত খুইয়ে যাবার বিভৎস ইতিহাস।
এ সবিই তো মুক্তির জন্য। পাকিস্তানী বেনিয়াদের শাসনের কালো হাত গুড়িয়ে দেবার মুক্তি,
বিজাতীয় শোষণের ঘৃণ্য কাঠামোকে বিকল করে দেবার মুক্তি। সর্বোপরি বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ।
আদতে আমরা কী পেয়েছি ? দিনের আলোর মতই পরিস্কার একাত্তোরের যুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন
করেছিলাম, মুক্তি নয়। শাসকের গোষ্ঠী বদলিয়েছে। শ্রেণী রয়ে গেছে এক ও অভিন্ন। শোষণের
হাত বদলেছে। শোষণের চরিত্র রয়েছে পূর্বেকার মত। এখানেই খুঁজে নিতে পারি বিজয় আর মুক্তির
পার্থক্য। হাতড়ালেই পথ খুঁজে পাবো গন্তব্যের।
সুতরাং এক শাসকের শেকড়
উপড়িলেও আরও এক জঘন্য স্বজাতীয় শাসক জেঁকে বসেছে এ দেশ জুড়ে। সাড়ে দশ কোটির এ জনারণ্যে
সাড়ে দশ সহস্র ধনী পরিবারের আংশিক মুক্তি হয়েছে হয়তো। বাকী বিশাল
জনমানুষ নিষ্পেষণের ঝাঁতাকলে মানবেতর শিকার। এ নিষ্পেষণের মাত্রা ও আকৃতি আরও তীব্র।
ভয়ংকর। এ শাসক শ্রেণীর নিষ্পেষকদের একবিন্দু রক্তেরও লেখা নেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সোনালী
ইতিহাসের পাতায়। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাত, শোষণ, দুর্নীতি নোংড়া গালিচা পেরিয়ে তারা আজ
বিলাসী জীবন নিয়ে তামাশা করছে। অথচ যারা অকাতরে রক্ত ঢেলেছে বাংলা মায়ের পবিত্র জমিনে
তাদের উত্তরসূরীরা আজ নিঃস্ব। যে যোদ্ধা আমরণ পঙ্গুত্বের দুঃসহ স্থবিরতাকে আলিঙ্গন
করেছে, যে মা/বোন তার সব খুইয়ে কলংক ধারণ করেছে তিল তিল যন্ত্রণায় তারা কী পেয়েছে
? এদেশের গরীব ক্রমাগত গরীব, ধনীরা আরও ধনী হয়। শোষিতের দ্রুত পতন, শোষকের অনায়াস উত্তরণ
ক্রমশ বিস্তৃতি বাড়ায় পরস্পরের। উভয়ের এ বিপরীতমূখী অগ্রযাত্রাকে থামাবে কে ! দুর্ভিক্ষের
নিয়ত পদধ্বনি শুনা যায় সর্বত্র জনপদে। বিবিধ মাত্রায় দুর্যোগের ঘনঘটা সর্বদা হামলে
ধরতে চায় কংকালসার দেশবাসীকে। দুর্ভিক্ষের অভিশাপ ও মৃত্যুর হীম শীতল স্পর্শ বাংলাদেশের
মানুষের পায়ে পায়ে ঘোরে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অনিবার্য উপজাত কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের
ভয়াল আক্রমনে কিছু দিন আগেও উত্তরাঞ্চল হাহাকারের প্রেতপুরীতে পরিণত হয়েছে। বিবদমান
আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে ক্ষুধার সঙ্গে বাঙালির চিরকালীন সহাবস্থান। দারিদ্র্য-পীড়িত
বৃহত্তর জনমানুষকে অনাহারের দুঃস্বপ্ন তাড়িত করেছে বার বার। বৈষম্যের বিষাক্ত গর্ভজাত
এই দুর্ভিক্ষই বিস্মৃতি পরায়ণ জাতির নির্মম ইতিহাসের উপজীব্য।
এভাবেই বুর্জোয়া রাজনৈতিক
দলগুলো পেয়ে যায় পুজি। অবলীলায়। বেশরম দুভিক্ষের গণমৃত্যুকে নিয়ে তারা চেচামেচি করে
বেধরক। বস্তা বস্তা করুণা নিয়ে সাহায্যের নাম করে দুর্গত এলাকায় নেতা নেত্রীরা তাদের
লোক দেখানো সফর করেন। অভাবী মানুষের অভাব মোচন, ক্ষুধাকাতর মানুষের ক্ষুধা নিবারণ কিংবা
অর্ধনগ্না কিশোরীর লজ্জা ঢাকা, কোনটাই তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের আপাতঃ উদ্দেশ্য রাজনৈতিক
সেন্টিমেন্ট। চুড়ান্ত লক্ষ্য ক্ষমতা নামক পাগল ঘোড়ায় আরোহন আর শাসন শোষণের আকাক্সক্ষা
পূরণ। গণতন্ত্রের মুখোশ পরে তারা সহজেই জনগণকে বিভ্রান্ত করে। ক্ষমতার সোনালী মসনদে
যেতে কিংবা তা পোক্ত করতে তারা অনেক সময় নারকীয় হত্যালীলার উৎসব পালন করে। কমরেড সিরাজ শিকদার, তার অনেক কর্মী,
জাসদের অসংখ্য ত্যাগী যোদ্ধাকে নির্লিপ্ত হত্যার মত নিষ্ঠুর অপকর্মের মাধ্যমেও তারা
ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের জগাখিচুরী উপহার দিতে চেয়েছে। তাজউদ্দীন সহ চার জাতীয়
নেতার রক্তে তারা গদি ধৌত করে, তারা কর্নেল তাহেরদের ফাঁসি দিয়ে সামাজিক ন্যায়-বিচার
প্রতিষ্ঠা করে এবং বসুনিয়া, নুর হোসেন, ডাঃ মিলন সহ শত নাম না জানা গণতন্ত্রী, স্বৈরাচারী
শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তিকামী মানুষের রক্তে পিচ্ছিল পথ নির্লজ্জ পাড়ি দিয়ে নতুন বাংলাদেশ
গড়ে। একটি শব্দ বেরিয়ে যায়। কি বিচিত্র সেলুকাস। তবুও কেন অহেতুক দৌড়াতে থাকে শোষিত
জনতা তাদের পিছু পিছু ? রক্তের অক্ষরে গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরী করে সংগ্রামী জনগণ
যখনই মুখোশধারী স্বৈরাচারীদের ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে যায় তখনই তো এক করে খসে যায় ওদের
খোলস। ন্যাংটো হয় তাদের বিকৃত চেহারা। তবুও মানুষ বুক ভরা আশা নিয়ে চেয়ে থাকে অপেক্ষায়
গর্দভের আদলে। বুঝতে পারি না কেন এ রাষ্ট্রযন্ত্র কিছুই দিতে পারে না শোষিত মানুষের
কাছে। সংকটে সংকটে এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা জর্জড়িত। তবুও কেন খামাকা রক্ত দেবো নরসুন্দরীদের
বেশরম আহ্বানে।
তৃতীয় দুনিয়ার কোটি জননীর
জরায়ু চিরে যে মানবশিশুই জন্ম নিক না কেন তাদের অস্তিত্বই মৃত্যু, ক্ষুধা, শোষণ, ধর্ষণ,
উচ্ছেদ, অত্যাচার আর অনিশ্চিতের অতল গহ্বরে অসহায়। সাম্রাজ্যবাদীর
একচ্ছত্র একাধিপত্যে আজ পৃথিবীব্যাপী নৈরাজ্যের বিকৃত থাবার আক্রমণ জন জীবনকে দুর্বিসহ
করে তুলছে। আমাদের মত চামচিকে ক্ষীণ রাষ্ট্র যন্ত্রকে কব্জা করে সে সর্বস্ব শুষে নেয়
তার অপ্রতিরোধ্য পুজির ধারালো সুচে। এই রক্তশোষা প্রভুরা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বীজ
বুনে দেয় আমাদের সমাজ দেহের পরতে পরতে। সদম্ভ খবরদারীতে। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না
অনন্তকাল। বিজয়ের যুদ্ধ নয় চুড়ান্ত মুক্তি যুদ্ধের দামামার পদধ্বনী শুনাতে হবে নব প্রজন্মের
চেতনার কানে কানে। লক্ষ কোটি অভুক্ত শোষিত শ্রেণীর দুর্দমনীয় দ্রোহের ঘুমন্ত আগ্নেয়াগিরিতে
জ্বালাতে হবে বিপ্লবের শিখা। এভাবেই প্রকৃত বিজয়। চুড়ান্ত মুক্তি।
----------------------------------------
আগাম সংবাদ
১) আগামী ফেব্রুয়ারী নাগাদ
পর্যন্ত চট্টগ্রাম কমিশন একটি সর্বশেষ ঘটনার রিপোর্ট প্রকাশ করবে। এরই ভিত্তিতে বাংলাদেশের
বৈদেশিক মিশন সমূহে এক সমন্বয় প্রক্রিয়া চলবে যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার
লংঘনের জন্য সরকারকে বিশেষভাবে অবগত করানো হবে। এছাড়াও আগামী এপ্রিলে প্যারিসে সাহায্যতদাতা
দেশসমূহ প্যারিস কনর্সোটিয়াম বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন অবসানের লক্ষ্যে সরকারকে
চুড়ান্তভাবে শর্তারোপ করবে।
২) পার্বত্য চট্টগ্রাম
সমস্যাকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন পর আবার চেষ্টা চলছে। এ জন্য যে
যোগাযোগ কমিটি গঠন হবার কথা তা চুড়ান্ত হয়েছে। এই যোগাযোগ কমিটির মাধ্যমেই আলোচনার
সময়, তারিখ, বিষয়বস্তু, স্থান সহ বিভিন্ন পদ্ধতিগত বিষয়সমূহ স্থির করা হবে। আশা করা
যাচ্ছে আগামী জানুয়ারী শেষ অথবা ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিকে বৈঠক শুরু হতে পারে।
৩) এ মাসের শেষান্তে লণ্ডন
থেকে বাংলাদেশের আদিবাসীদের উপর একটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। The
Adibashis in Bangladesh নামের এ বইটি
প্রকাশ করছে Minority Rights Group. ঐ বইয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের উপর
সরকারী নির্যাতনের একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন থাকছে।
৪) আগামী ৪র্থ পার্বত্য
চট্টগ্রাম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের দুটি সংশ্লিষ্ট
সংস্থাকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারী সহযোগীতা অব্যাহত থাকলে এ
সম্মেলন ঢাকাতে অনুষ্ঠিত হবে। অন্যথায় এ সম্মেলন ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত হবে।
------------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন