* পিডিএফ কপি পেতে ক্লিক করুন এখানে
ব্লগ সম্পাদকের নোট:
রাডার বৈসাবি ’৯২ সংখ্যা আপলোড করা হলো। বিজয় দিবস সংখ্যার পর এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালের ১৩ এপ্রিল। এই সংখ্যায় প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ও প্রগতিশীল লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও বাংলাদেশের প্রধান ও স্বনামধন্য কবি শামসুর রাহমনের সাক্ষাতকার ছাপা হওয়ায় তা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। (বর্তমানে তারা দু’জনেই প্রয়াত)। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের প্রতি এই দুই মহান বাঙালির সমর্থন জুম্ম জনগণকে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত ও উজ্জ্বীবিত করেছিল।
বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাগুলো কিছু বানানের পরিবর্তন ও সংশোধন ছাড়া হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে। তবে দু’একটি লেখায় মুদ্রণজনিত ভুল সংশোধন করা হয়েছে। তারপরও যদি কোন ভুল আপনাদের নজরে আসে তাহলে আমাদের জানালে খুশী হবো। আশাকরি এ সংখ্যাটি আপনাদের ভালো লাগবে।]
রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত
প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা
জাগো জনতা গড়ো প্রতিরোধ
সন্ত্রাসকারীরা চিহ্নিত,
নামমাত্র শাস্তি ভোগ
সাক্ষাতকার : আখরুজ্জামান
ইলিয়াস ও শামসুর রহমান
গণ-আদালতের কাঠগড়ায়
গোলাম আজম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ
CHT কমিশনের প্রেস রিলিজ
দি কেস অব পলিটিকেল
মাইগ্রেসন ইন দ্যা হিল ট্রাক্টস
পাতা: ২
----------
----------
চিঠিপত্র
আমরাও আছি রাডারের সুখে-দুঃখে-বেদনাতে
প্রিয় সম্পাদক,
যুদ্ধ শুরু হবে এবার। এ যুদ্ধ অন্যায়, অত্যাচার আর সকল প্রতিক্রিয়াশীলতার
বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধ ন্যায়ের যুদ্ধ Ñ মুক্তির লড়াই। আমরা আর ভয় করি না। কারণ
“রাডার” এ যুদ্ধের নেতৃত্বে। আমরা ঘরে ঘরে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলবো এবার। যত্তসব
বাধার প্রাচীর ছিন্ন করে এগিয়ে যাবো মুক্তির সোনালী জগতে।
“রাডার” তুমি এ যুদ্ধের ডাক দাও। আমরা এ যুদ্ধে সাহসী সৈনিক হতে চাই।
তোমার কোন ভয় নেই, আমরা আছি তোমার সুখে-দুঃখে-বেদনাতে।
- ছোটন/মারিশ্যা
[এ যুদ্ধে বিজয় আমাদের অনিবার্য]
প্রবাসী জুম্মদের জন্য একটি বিভাগ খোলা হোক
প্রিয় সম্পাদক/
আপনাদের অনিয়মিত প্রকাশনা “রাডার” পড়ে খুব ভালো লাগলো। হিল লিটারেচার
ফোরাম এবং রাডার প্রকাশনা কমিটিকে অনেক ধন্যবাদ। আমার বিশ্বাস, আধুনিক প্রযুক্তিতে
নির্মিত রাডার-এ যেমন শত্রু বাহিনীর গতিবিধি ও অবস্থান ¯পষ্টভাবে ধরা পড়ে, তেমনিভাবে পার্বত্য
চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ওপর অন্যায়, অত্যাচার ও সেই সাথে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সংগ্রামের
প্রকৃত চিত্র আপনাদের রাডারে ভেসে উঠবে।
আমি রাডারে ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল এবং আসামে বসবাসরত জুম্ম জনগণের
অবস্থা সম্পর্কে লিখতে চাই। অনুমতি দিলে বাধিত হব। শেষে অনুরোধ, প্রবাসী জুম্মদের জন্য
রাডারে একটি বিভাগ খোলা হোক।
- বি, দেওয়ান/ত্রিপুরা/ভারত
[বিঃ দ্রঃ চিঠিটি ইংরেজিতে লেখা। আমরা এখানে তা অনুবাদ করে ছাপালাম]
[প্রবাসী জুম্মদের কাছ থেকে আরো সাড়া পেলে অবশ্যই প্রবাসীর কলাম খোলা
হবে। রাডারে লেখার দুয়ার সবসময় খোলা]
“রাডার” দেশবাসীর কাছে সত্যকে তুলে ধরুক
প্রিয় সম্পাদক,
রাডার প্রকাশিত হওয়ায় আমি খুব আনন্দিত। কারণ, যে সময় উর্দি সম্রাটদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ জনগণ বাক্হারা, কন্ঠরুদ্ধ- তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সঠিক অবস্থা
তুলে ধরতে এবং শোষণ-বঞ্চনা ও নির্যাতনের কথা বলতে রাডারের সাহসী উদ্যোগ সত্যিই সমীহযোগ্য।
সত্য সবার কাছে প্রিয় নয়। এজন্য ইতিমধ্যেই অনেকের গা জ্বালা শুরু হয়েছে। এরা সত্যকে
ভয় পায়। এ জন্য এরা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত চিত্র দেশের আপামর জনগণের কাছে প্রকাশ
করতে দেয়নি এবং এখনো দিচ্ছে না। আশাকরি, “রাডার” দেশবাসীর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের
প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরতে পারবে।
- তাপস ত্রিপুরা (তপু)/রাঙ্গুনিয়া কলেজ।
“রাডার” হোক মুক্তির ঔষুধ
সম্পাদকবাবু/ জনতার রাডারের মাধ্যমে জনতার কাছে গেয়ে
যাইঃ
“আয় আয় ছুটে আয় সজাগ জনতা
আয় আয় নিয়ে আয় নতুন বারতা।
রামের দেশেতে সেই রাবণ বধিতে
যায় যদি যাক জীবনটাই যাক।”
দুঃখ, ঘৃণা ও ক্ষোভে বুক ভেঙে গেছে অনেক আগে। কিন্তু হৃদয় ভাঙতে দিইনি।
আজ প্রাণভরে বহুদিনের কাংখিত রাডারের আস্বাদ পেয়ে এই দগ্ধ হৃদয় ভরে উঠেছে নতুন স্বপ্নে।
আমি এখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে (যক্ষা) আক্রান্ত। গায়ে প্রচ- জ্বর। “রাডার”
পড়ে অনেক সুস্থ বোধ করছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, “রাডার” আমাদের “সমাজের দুরারোগ্য ব্যাধিতে”
নিরাময়কারী ঔষুধের কাজ করবে। “রাডার” হোক “রোগাক্রান্ত সমাজের” এক মহৌষধ।
- রূপায়ন চাকমা/নানিয়াচর
[দঃখ, ঘৃণা এবং ক্ষোভকে রূপান্তরিত করতে হবে প্রতিবাদের ভাষায়]
রাডারকে পরামর্শ
বাবু সম্পাদক/ সংগ্রামী অভিনন্দন। রাডার নিপীড়িত-নির্যাতিত পাহাড়ি জনগণের
কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাই সুবিধাবাদী দালালদের কাছে তা আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাডারের সৌন্দর্য্য রক্ষার সুবিধার্থে সংবাদদাতা/রিপোর্টার-এর বিজ্ঞাপনটা আলাদা কাগজে
দেয়ার জন্য “রাডার প্রকাশনা কমিটি” -কে অনুরোধ করছি। শেষে রাডারের মঙ্গল কামনায়।
“সুবিধাবাদী দুলাগোষ্ঠী নিপাত যাক
নির্যাতিত পাহাড়ি জনগণ মুক্তি পাক”
- বিভাস চাকমা/কুমিল্লা
[আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ]
রসদের কার্টুন চাই
প্রিয় সম্পাদক/
আপনাকে ও “রাডার প্রকাশনা কমিটি”-কে সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
১৬ই ডিসেম্বর ’৯১ বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত কার্টুন ছবিটা অত্যন্ত অর্থবহ ও উপভোগ্য
হয়েছে। আমাদের সকলকে এভাবে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। বজ্রকন্ঠে
নূর হোসেনের মতো আওয়াজ তুলতে হবে “সেনাশাসন নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক।” আগামীতে
আমরা আরো এ ধরনের কার্টুন চাই।
- জুয়েল (র)/কাট্টলী/মারিশ্যা
[আশাকরি নিয়মিত কার্টুন পেয়ে যাবেন]
রাডার ইংরেজিতেও প্রকাশিত হোক
শ্রদ্ধেয় সম্পাদক/ পার্বত্য চট্টলার রক্তিম চেতনা সমৃদ্ধ নব প্রজন্মের সূর্য
সন্তানদের পক্ষ থেকে আপনাদের জানাচ্ছি বিপ্লবী অভিনন্দন। আমরা আপনাদের রাডারের ডাকে
সাড়া দিয়েছি।
যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারহারা পাহাড়ি জনগণের দুঃখ বেদনা
ও ক্ষোভের কথাগুলো প্রকাশের ভাষা পায়নি। বার বার আমাদের কণ্ঠকে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
আপনারা অশুভশক্তির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সত্য উচ্চারণে যে বীরত্ব ও সাহসের নজির
সৃষ্টি করেছেন তাতে জুম্ম জনগণ আশান্বিত হয়েছে। এইভাবে সারা বিশ্ববাসী তথা সভ্যতার
কাছে আমাদের ওপর মধ্যযুগীয় বর্বর অত্যাচার উৎপীড়নের কথা
তুলে ধরার জন্য রাডার ইংরেজীতেও প্রকাশ করা হোক।
- ডুনান্ট চাকমা (শিপ্লব)/নানিয়াচর
[হ্যাঁ, রাডার ইংরেজিতেও ছাপার পরিকল্পনা রয়েছে। সময় এবং
আর্থিক সুবিধার ব্যাপার মাত্র]
[আরো যারা লিখেছেন- (১) তিনাঙী, সৈকত, লোটাস/খাগড়াছড়ি, (২) জবাব কুসুম, বসন্ত/ঘাগড়া,
(৩) সুভাষদত্ত/মারিশ্যা, (৪) সুশীল বিকাশ,/লোগাং, (৫) শাক্য উজ্জ্বল (শুভ্র)/ স্যার
আশুতোষ কলেজ, চট্টগ্রাম (৬) টি, মারমা/ রাইখালী, চন্দ্রঘোনা এবং আরো অনেকে।]
পাতা: ৩
-----------
-----------
সম্পাদক : মি : সুপ্রিয়
নির্বাহী সম্পাদক : মি : মানবমিত্র
প্রধান প্রতিবেদক : মি : সৌরভ সিজেল
সার্কুলেশন ম্যানেজার : মি : পল্লব
অংকন শিল্পী : মি : রসদ
শিল্প নির্দেশনা : মি : চাকমা ধীরব
খীসা
যোগাযোগ (বার্তা ও চিঠি) :-
৩২০, পূর্ব বাড়ী, জগন্নাথ হল, ঢাঃ বিঃ।
প্রাপ্তিস্থান :-
পাঠক সমাবেশ, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট, মুজিব
হলের বিপরীতে, ঢাকা।
দীপ্র প্রকাশনী, ৬৮/২ পুরানা পল্টন, বাসস-এর
নীচে।
কারেন্ট বুক সেন্টার, চট্টগ্রাম।
৩৫৬, নবাব অব্দুল লতিফ হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
৪১৯/বি, শামসুল হক হল, বাংলাদেশ কৃষি বিঃ ময়নসিংহ।
সম্পাদকীয়
· সুপ্রিয় পাঠক, “বৈ-সা-বি”
উপলক্ষে আপনাদের জানাই রক্তিম শুভেচ্ছা। সাড়ে তিন মাস পর আবার জনতার অন্তরের কথা বলতে
রাডার বের হলো। এ দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস আমরা ছট্ফট্ করেছিলাম দুর্ভাগা জনতার কথা বলতে।
জানি, আপনারাও অধীর আগ্রহে সীমাহীন ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন আমাদের। কিন্তু,
বিভিন্ন অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতার কারণে এ সংযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য আমরা আন্তরিকভাবে
দুঃখিত।
· প্রিয় পাঠক, বাংলা
ক্যালে-ারের পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে কালের আবর্তে হারিয়ে দিলো আরো একটি বছর।
সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকারহারা দুর্ভাগা জনগণও অত্যাচার-উৎপীড়নের আবর্তে আবর্তিত
হয়ে হারিয়েছে অনেক তাজা প্রাণ, অনিকা, অঞ্জনা, অঞ্জলী ও বটুদের মতো নাম জানা-অজানা
অনেক মা-বোন হারিয়েছে ইজ্জত, প্রদীপন, পুলক, অনিমেষ -এর মত অনেক প্রাণোচ্ছল
তগবগে তরুণ পরেছে “হাতকড়া” নামক সহজলভ্য অলংকার। এই দুঃসহ নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়াতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অজস্র পাহাড়ি ছাত্র-জনতা। প্রতিবাদের লক্ষ ভাষায় কেঁপে
উঠেছিল চিম্বুক, ফুরমৌন, ভগবানটিলা। ঢাকা, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির রাজপথ
প্রকম্পিত হয়েছিল প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার পদভারে। কিন্তু তবুও আমরা সেই কুৎসিত অত্যাচার-উৎপীড়নের আবর্ত থেকে
বেরিয়ে আসতে পারিনি এখনো। পারিনি হতে স্বাধীন, শৃংখলমুক্ত মানুষ।
এখনো আমাদের সবুজ পাহাড়ের কোলে শান্তির কপোত ওড়েনি। এখনো আমরা আতংকিত ঘুমে দীর্ঘ দুঃস্বপ্নাচ্ছন্ন।
আমাদের অনেকেই এখনো মাটির অন্ধকার প্রকোষ্টে নরক যন্ত্রণায় কাতর। স্যাঁতস্যাঁতে কারা
প্রাচীরে এখনো আমাদের ভাইয়েরা তন্দ্রাহীন রাত পোহায়। দুঃখ-বেদনা ও দুঃসহ গ্লানি নিয়ে
ত্রিপুরা রাজ্যের জীর্ণ শরণার্থী কুটিরে এখনো আমাদের হাজার হাজার জুম্ম নর-নারী প্রিয়
জন্মভূমিতে ফেরার প্রহর গোনে।
· তাই বিঝু আনন্দের নয়।
এই বিঝু নব চেতনা জাগরণের দিন। প্রতিবাদের লক্ষ মুষ্টিবদ্ধ হাত উর্ধ্বে তুলে ধরে শপথ
নেয়ার দিন। সেই বিঝুই হবে প্রকৃত বিঝু, সেই সাংগ্রাই হবে সবচেয়ে আনন্দঘন, সেই বৈসুক
হবে সবচেয়ে বেশী কোলাহলপূর্ণ- যেদিন আমাদের বুকে
আর নিপীড়ন নির্যাতনের আশংকা থাকবে না; যেদিন সবাই আমরা আবার আমাদের প্রিয় পার্বত্য
ভূমিতে মিলিত হতে পারবো। আমরা সেই কাংখিত বিঝু-সাংগ্রাই-বৈসুর জন্য এই বিঝু উৎসর্গ করতে চাই। সেই
বৈ-সা-বির জন্য আজকের বিঝুতে আমরা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ সংগ্রামে অবিচল, একনিষ্ট ও দৃঢ়
থাকার অঙ্গীকার চাই।
· প্রিয় পাঠক, লজ্জা
শরমের মাথা খেয়ে বলছি আমরা নিদারুণ আর্থিক অনটনে ভূগছি। রাডার দেরীতে বেরুনোর এই মূল
কারণ। তাই বছরের ক্রান্তিকালের উৎসবে দশ টাকার উৎপাত সহ্য করুন। দোহাই
আমরা চাঁদাবাজ নই। বিনিময়ে দিই ঝরঝরে লেখায় সমৃদ্ধ তাজা রাডার।
· শেষে বাংলা নববর্ষের
প্রাণঢালা উঞ্চ ভালোবাসা।
-----------------------------------------------------------------------------------------
“হিল লিটারেচার ফোরাম”
-এর পক্ষে “রাডার” প্রকাশনা কমিটি ও সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত
পাতা: ৪
---------
---------
ঘটনা প্রবাহ
পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে মুক্ত আলোচনা
গত ২১ শে মার্চ ’৯২ আন্তর্জাতিক বর্ণবাদ বিরোধী দিবস উপলক্ষে রাজধানী
ঢাকায় গণউন্নয়ন গ্রন্থ কেন্দ্রের সেমিনার কক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সম্পর্কে
এক মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সাপ্তাহিক “দেশদশ” এই মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে। মানবাধিকার
কর্মী ফাদার আর, ডব্লিউ, টিম এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভার শুরুতে বিশিষ্ট
সাংবাদিক চিম্ময় মুৎসুদ্দী পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা বিষয়ক তার একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। তারপর
আলোচনায় অংশ নেন যথাক্রমে রাশেদ খান মেনন এম, পি, (ওয়ার্কার্স পার্টি): জনাব কর্ণেল
(অবঃ) আকবর হোসেন এম,পি,(বিএনপি); তোফায়েল আহমদ এম,পি,(আওয়ামী লীগ); দীপংকর তালুকদার
এম,পি, (আওয়ামী লীগ); চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, পাহাড়ি গণ পরিষদ সভাপতি
বাবু সুবোধ বিকাশ চাকমা, সাবেক ছাত্র নেতা মোস্তফা ফারুক, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি
প্রসিত বিকাশ খীসা এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক সালিম সামাদ।
আলোচকগণের মধ্যে কর্ণেল (অবঃ) আকবর হোসেন ব্যতীত সকলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম
সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা বলে স্বীকৃতি দেন এবং রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করার জন্য
সরকারকে আহ্বান জানান। বক্তাগণ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে সামরিকভাবে সমাধানের
চেষ্টা করায় সমস্যা আরো জটিল হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। কর্ণেল (অবঃ) আকবর হোসেন পার্বত্য
চট্টগ্রাম সমস্যাকে মূলতঃ অর্থনৈতিক এবং আইন শৃংখলা জনিত সমস্যা বলে উল্লেখ করেন। সভাপতির
ভাষণে ফাদার টিম পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘুদের জমি জবর দখলের প্রক্রিয়া রোধ করতে
উপযুক্ত ব্যবস্থা হাতে নেয়ার আহ্বান জানান। সভা শেষে “দেশদশ” পত্রিকার সম্পাদক জনাব
ফারুক ফয়সাল একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। তিনি বলেন, “আমাদের দাবী দেশে যেহেতু সার্বভৌম
সংসদ রয়েছে, অতএব এই সমস্যা সংসদে উপস্থাপন করা হোক এবং সংসদীয় পদ্ধতিতেই এই সমস্যা
সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া হোক।
------------------------
বেশ কয়েকটি আটকাদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে চ্যালেঞ্জ
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান পরিস্থিতির শিকার হয়ে দীর্ঘ দিন যাবৎ বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক প্রায় ৪২ জন পাহাড়ি বন্দীর আটকাদেশের বিরুদ্ধে
চ্যালেঞ্জ করে মহামান্য হাইকোর্টে রীট আবেদন পেশ করা হয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়
হতে এই রীট আবেদন শুরু হয়। আন্তার্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ব্যারিষ্টার আমীরুল
ইসলাম ও এডভোকেট নাসিমসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী পিটিশনারদের পক্ষ হয়ে রীট আবেদনগুলো পরিচালনা
করছেন।
এযাবৎ মোট ২৬টি রীট
পিটিশনের রায় বের হয়েছে এবং সব কয়েকটি আটকাদেশ অবৈধ বলে মহামান্য হাইকোর্ট রায় প্রদান
করেছেন। এই রায় সমূহে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “যে মৎড়ঁহফ -এর ভিত্তিতে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এই আদেশ প্রদান করেছেন তা অবৈধ
এবং এই অবৈধ আটকাদেশ বর্ধিত করাও অবৈধ। ঢাকায় অধ্যয়নরত পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে
পিটিশনার হয়ে এই রীট আবেদনগুলো দাখিল করেছেন। --------------------------
CHT কমিশনের Update Report প্রকাশিত
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন সম্প্রতি তাদের মূল রিপোর্ট
" Life is not Ours "-এর Update Edition প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে যে, স্বৈরাচারী
এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম
পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। কমিশন অভিযোগ করেছে যে, এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে আগের
মতই হত্যা, ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, অনুপ্রবেশ, শারীরিক নির্যাতন, ধর্মীয় পরিহানি ইত্যাদি
মানবতা বিরোধী কাজ চলছে। কমিশনের এই Update রিপোর্ট -এ মানবাধিকার লংঘনের বিভিন্ন ঘটনা
সচিত্র উল্লেখ পূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের সুপারিশ সমূহ পুনর্ব্যক্ত
করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের শেষার্ধে ভারতের ত্রিপুরার শরণার্থী শিবির
এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের পর CHT কমিশন ১৯৯১ সালের মে মাসে তাদের রিপোর্ট
"Life Is Not Ours, Land and Human Rights in Chittsgong Hill Tracts,
Bangladesh" প্রকাশ করে।
----------------------------
স্পীকার সমীপে ছাত্র পরিষদের স্মারকলিপি পেশ
দীর্ঘদিন যাবত বিরাজিত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের
জন্য গত ১৭ই ফেব্রুয়ারী পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ মাননীয় স্পীকারের সমীপে ৫ দফা দাবী সম্বলিত
একটি স্মারকলিপি পেশ করে। স্মারকলিপি প্রদানের সময় রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত
এম,পি, যথাক্রমে দীপংকর তালুকদার ও কল্পরঞ্জন চাকমাও উপস্থিত ছিলেন। পরিষদের সভাপতি
মিঃ প্রসিত বিকাশ খীসা স্মারকলিপি পাঠ করার পর মাননীয় স্পীকারের নিকট প্রদান করেন।
মাননীয় স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দের
সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি এই সমস্যার সমাধানের
জন্য একটি ঝঃধহফরহম কমিটি গঠনেরও আশ্বাস দেন।
স্মারকলিপি প্রদানের পূর্বে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এক সমাবেশের আয়োজন করে। এতে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান
জেলাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ৬ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ
করে। মিঃ প্রসিত বিকাশ খীসার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন গণতান্ত্রিক
ছাত্র ঐক্যের নেতা নাজমুল হক প্রধান, বেলাল চৌধুরী, উদয় পাল, নাসিরুদ্দৌজা প্রমুখ এবং
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মিঃ করুণাময় চাকমা ও সাংগঠনিক
সম্পাদক মিঃ কে,এস,মং। সমাবেশ শেষে পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীরা স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি
প্রদানের উদ্দেশ্যে সংসদ ভবন অভিমুখে মিছিল সহকারে যাত্রা করে। মিছিলটি বাংলা মোটরে
পুলিশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হলে ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে
সংসদ ভবনে যান। একই দিন বিকালে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি সাংবাদিক
সম্মেলনেরও আয়োজন করে।
---------------------
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতীক অনশন
পালিত
পার্বত্য চট্টগ্রামে বেপরোয়া ধরপাকড়, ধর্ষণ, বোমাবাজি ইত্যাদির প্রতিবাদে
এবং ৬ জন ছাত্রনেতার মুক্তির দাবীতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা, রাঙ্গামাটি
ও খাগড়াছড়িতে একযোগে গত ২৩শে ফেব্রুয়ারী এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রদীপন, মনোৎপল, পুলকসহ ছয় জন ছাত্রকে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারী মানিকছড়ি সেনাক্যাম্পে আটক
করা হয়। তারা ১৭ তারিখ ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সমাবেশ ও স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি
প্রদান অনুষ্ঠান শেষে খাগড়াছড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন।
তা ছাড়া উক্ত ছয়জন ছাত্রের মুক্তির দাবীতে গত ১২ই মার্চ ঢাকা, খাগড়াছড়ি
ও রাঙ্গামাটিতে একযোগে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ প্রতীক অনশন ধর্মঘট পালন করে।
----------------------------
পাতা: ৫ - ১৪
--------------
--------------
মানবাধিকার
অশান্ত
পার্বত্য চট্টগ্রাম
মানবাধিকার
লংঘনের শেষ কোথায়? ...............................................................
[এক ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের পতন
ঘটেছে। ক্ষমতায় আসীন হয়েছে বহুল কথিত একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। তারপর এক বৎসরাধিক কাল অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু তবুও পার্বত্য চট্টগ্রামের
অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। জেল-জুলুম, হত্যা, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন,
অগ্নিসংযোগ ও ধর্মীয় পরিহানি ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ আগের মতোই বর্তমান কথিত
গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও অহরহ ঘটে চলেছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের
খবরগুলো এই কলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি- সম্পাদনা পরিষদ]
দীঘিনালা
(১)
ভি, ডি, পি, কর্তৃক প্রহৃত
১২ই ডিসেম্বর ১৯৯১ ইং, বৃহস্পতিবার। তখন সন্ধ্যে প্রায় সাতটা। “শান্তি
নিবাস” নামক গুচ্ছগ্রামবাসী মিঃ মণি চাকমা তার বন্ধু মিঃ সুকুমার চাকমার বাড়ী থেকে
ফিরছিলেন। পথে টহলরত দীপায়ন চাকমা নামক জনৈক ভি,ডি,পি গু-া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তাকে
আটক করে ও অযথা হয়রানিমূলক নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে। ভিডিপি গু-ারা মনি চাকমাকে শান্তিবাহিনীর
সহযোগী সন্দেহে বেদম প্রহার করে ও মিঃ ক্রিনটেন্দ্র -এর দোকানের খুটিতে উলঙ্গ অবস্থায়
সারা রাত বেঁধে রাখে। পরের দিন তাকে এই শর্তে ছেড়ে দেয়া হয় যে, (১) সে যথাযথ কর্তৃপক্ষের
অনুমতি ছাড়া গুচ্ছগ্রামের বাইরে যাবে না, (২) সে শান্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখবে
না, (৩) সে তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করবে এবং (৪) সে পরবর্তী দশদিন ধরে ভিডিপি ক্যাম্পে
হাজিরা দেবে। উল্লেখ্য মিঃ মনি চাকমার পিতা ভেজাল্যা চাকমাকে এক বছর আগে বাংলাদেশ
সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক করা হয় এবং তিনি এখনো খাগড়াছড়ি জেলে অন্তরীণ আছেন।
জানা গেছে সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট এই তথাকথিত ভিডিপি আঙ্গুলবাহিনী আখ্যাত
গ্রাম্য মস্তানদের উৎপাতে গুচ্ছগ্রামবাসীদের জীবন বর্তমানে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। একে খাদ্য সংকট,
অসুখ-বিসুখ ও নিয়ন্ত্রিত জীবন; তার উপর এই ভিডিপি ও আঙ্গুলবাহিনী নামক গু-াদের দৌরাত্ম্য- গুচ্ছগ্রামবাসীদের
যেন মরার উপর খারার ঘা।
(২)
বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ : দুইজন প্রহৃত
গত ১৩/১২/৯১ইং বাবুছড়া সাব-জোন কমা-ার মেজর নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল
সেনাবাহিনী দিঘীনালা উপজেলার হংসজয় কার্বারি পাড়ায় হানা দেয়। তারা তিন ব্যক্তির ওপর
অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায় এবং অন্য দুই জনের বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে
দেয়। যাদের বাড়ীগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয় তারা হলেন (১) ভারতচন্দ্র চাকমা, পিতা হিরণ মোহন
চাকমা এবং (২) ভারতমনি চাকমা পিতা উদয়মনি চাকমা। তাছাড়া, সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে
জটিলা চাকমা পিং বাঙাল্যা চাকমা, জগদীশ মনি চাকমা ও বাচ্যু মনি চাকমা নামে তিনজন নিরীহ
ব্যক্তিকে অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত বেদম প্রহার করে।
জানা গেছে, বাবুছড়ায় অবস্থিত শান্তিনিবাস গুচ্ছগ্রাম নিবাসী মিঃ সুজেন্দ্র
চাকমার পুত্র মিঃ বাচ্যুমনি চাকমাকে সেনা সদস্যরা পথ প্রদর্শক হিসাবে সেখান থেকে জোরপূর্বক
নিয়ে গিয়েছিল।
(৩)
সেনাবাহিনী কর্তৃক কিশোরী ধর্ষিতা
২২/১২/৯১ইং রবিবার, বৌদ্ধপাড়া গ্রাম দিঘীনালা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সড়ক
টহলদান সেনাবাহিনীর প্রাত্যহিক কাজ। ঐ দিন টহলদানরত আলীগড় টিলা ক্যাম্প কমা-ার (৮ম
বেঙ্গল রেজি) তার চার জন সৈন্যসহ দুপুর একটার সময় টহল পোষ্টের অনতিদূরে বৌদ্ধপাড়া গ্রামে
যায় এবং মিঃ রতন কুমার ত্রিপুরার ১৯ বছরের সুন্দরী কিশোরী কন্যা অঞ্জলী ত্রিপুরাকে
বলপূর্বক উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। উক্ত ঘটনার পর এলাকায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক
চাপা ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বর্বরোচিত ঘটনার যথার্থ বিচার পাওয়ার কোন উপায়
না দেখে এলাকাবাসীরা ক্ষোভে-দুঃখে শুধু অশ্রুপাত করতে থাকে।
(৪)
সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়ি গ্রামে হানা, বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ
২২/১২/৯১ইং, রোজ রবিবার, দুপুর ২টা। ঐ দিন পানছড়ি জোন-এর একদল আর্মি বাবুছড়া
ইউনিয়নের শুকনাছড়ি গ্রামে অতর্কিত হানা দেয় এবং গ্রামবাসীদের উপর বেপরোয়া গুলি বর্ষণ
করে। ঐ সময় গ্রামবাসীরা প্রাণের ভয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে এবং অনেকে পার্শ্ববর্তী
জঙ্গলে আশ্রয় নিতে সমর্থ হয়। উক্ত ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। কারণ ঐ এলাকাকে
সেনাবাহিনী কর্তৃক বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। তবে পালিয়ে আসা একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান,
সেনাবাহিনীরা সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৯ জনের বাড়ি-ঘর ভস্মিভূত
হওয়ার খবর প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তারা হলেনÑ (১) অক্ষয় চন্দ্র চাকমা পিতা
চুচ্যাং চাকমা, (২) জুক্যা চাকমা পিতা মধুচন্দ্র চাকমা, (৩) দিল্লীজয় চাকমা পিতা Ñ জানা যায় নি, (৪) মিত্রময় চাকমা পিতা Ñ উত্তুচ্যা চাকমা, (৫) বীরকর
চাকমা পিতা মিত্রজয় চাকমা, (৬) প্রভাতচন্দ্র চাকমা পিতা জমাদিরন চাকমা (৭) জচিন্যা
চাকমা পিতা রাঙ্যা চাকমা, (৮) বীরসেন চাকমা পিতা রাঙ্যা চাকমা এবং (৯) যুধিষ্টির চাকমা
পিতা অজানা চাকমা।
(৫)
সাইকেল চালানোর জন্য দশম শ্রেণীর ছাত্র প্রহৃত
২৩ শে ডিসেম্বর ১৯৯১ ইং। “শান্তিনিবাস” গুচ্ছগ্রাম ও বাজারের পরিচালক
লেন্স নায়েব বেলায়েত দশম শ্রেণীর ছাত্র ইরিস কান্তি চাকমাকে বিনা কারণে বেদম প্রহার
করে। জানা গেছে, “শান্তিনিবাস” গুচ্ছগ্রামবাসী বিমল কান্তি বাপের ছেলে মিঃ ইরিস কান্তিকে
গুচ্ছগ্রাম এলাকার বাইরে সাইকেলে চড়ায় জনাব বেলায়েত কোন জিজ্ঞাসাবাদ না করে অজ্ঞান
না হওয়া পর্যন্ত তাকে নাকে মুখে বেপরোয়াভাবে কিলঘুষি লাঠি মারতে থাকে।
(৬)
এক বছরের শিশু সোহেল-এর কি অপরাধ ?
পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভিন্ন ভাষাভাষী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার-নির্যাতন
পৃথিবীর সমস্ত বর্বরতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মায়ের কোলের ছোট ছোট শিশুরাও এই বর্বরতার হাত
থেকে রেহাই পাচ্ছে না। গত ৬/১/৯২ ইং শান্তিপুর গ্রামের জাঙ্গাল্যা চাকমার এক বছরের
শিশুপুত্র সোহেল চাকমাকে সেনাবাহিনীর জনৈক সদস্য তার মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে লাঠি
মারে এবং আছার দেয়। এর ফলে শিশুটি প্রায় আট ঘন্টার মতো অচেতন অবস্থায় থাকে।
(৭)
সেনাবাহিনী কর্তৃক ভোট বাক্স দখল
৪ঠা ফেব্রুয়ারি ’৯২ দিঘীনালা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সকাল
৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অত্র এলাকার জনগণ সুষ্ঠুভাবে স্ব স্ব ভোট প্রদান করেন।
কিন্তু ভোট গণনার সময় বড়াদম সাব-জোনের সেনা অধিনায়কের নির্দেশক্রমে ভোট বাক্সসহ ভোট
গ্রহণকারী কর্মচারীদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশ^স্ত সূত্রে জানা যায়, প্রিজাইডিং
অফিসার বীরেন্দ্র কুমার চাকমা (প,প,অফিসার) এবং সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার জীবন চন্দ্র
দে (সহকারী শিক্ষক, বড়াদম উচ্চ বিদ্যালয়)-কে ভোট বাক্সসহ জোরপূর্বক ক্যাম্পের এক গোপন
কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ভোট বাক্স খুলতে বাধ্য করা হয়। এরপর আর কি করা হয় তা জানা
যায় নি। তবে সেনাবাহিনী কালিজয় চাকমা পাশ করেছে বলে ঘোষণা দেয়। উল্লেখ্য, এই কালিজয়
চাকমাকে সেনাবাহিনীর গুপ্ত সহযোগী বলে মনে করা হয়।
(৮)
সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রচারাভিযানে বাধা দান
১লা ফেব্রুয়ারি ’৯২ ইং রোজ শনিবার ডি,পি, পাড়ার ক্যাম্প অধিনায়ক লেঃ তারেক
৪ নং দীঘিনালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী চিত্তকিশোর চাকমাকে নির্বাচনী প্রচারণা
চালাতে দেয়নি। তার সমর্থকদের প্রচার মিছিল ঐদিন উদল বাগানে পৌঁছলে সেনাবাহিনী কর্তৃক
বাধা দেয়া হয় এবং চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী চিত্তকিশোর চাকমা সহ তার সমর্থকদের প্রাণনাশের
হুমকী দেয়া হয়। অপর এক ঘটনায় উক্ত সেনা অফিসার ২নং বোয়ালখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী
ফণি রঞ্জন ত্রিপুরাকে ডি,পি, পাড়ায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেয়নি।
বরকল
(১)
জোরপূর্বক গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তরকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত
বরকল উপজেলার জোন কমা-ার (১৬ নং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) মরা উজ্যাংছড়ি,
লতিবাঁশ ছড়া, সুয়ারী পাড়া, বৈরাগী পাড়া, বাঘছড়ি, আইমা ছড়া - এসব এলাকার নিরীহ
পাহাড়ি জনগণকে তাদের স্থায়ী আবাসভূমি থেকে জোর করে গুচ্ছগ্রামে বসবাস করতে বাধ্য করছে।
কিন্তু তাদের জমিজমা গুচ্ছগ্রাম থেকে অনেক দুরে পড়ে যাবে এবং চাষ হবে না বিধায় তারা
এর প্রতিকারের জন্য জিওসি-এর কাছে ধর্ণা দিলেও তাতে কোন ফল হয়নি। এদিকে স্থানীয় জোন
কমা-ার জানুয়ারি ১০/১৫ তারিখের মধ্যে নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে গুচ্ছগ্রামে চলে আসার জন্য
উক্ত এলাকাবাসীদেরকে পুনর্বার কড়া নির্দেশ জারী করেছে। উক্ত তারিখের মধ্যে স্ব ইচ্ছায়
গুচ্ছগ্রামে না আসলে সে তাদেরকে জোর করে নিয়ে আসবে বলে হুমকি দিয়েছে বলে জানা গেছে।
(২)
জনগণের ভোগান্তির বিনিময়ে বাজার জমজমাট করার খায়েশ বরকল বাজারকে
জমজমাট করার সেনাবাহিনীর (১৬ নং ইষ্ট বেঙ্গল) খায়েশ মেটাতে বর্তমানে বরকল উপজেলাধীন
হালাম্বা, বাঘাছলা, ভুরবানিয়া, কুসুমছড়ি, বিল্লাছড়া, ইত্যাদি এলাকার অধিবাসীদের সীমাহীন
ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। সেনাবাহিনীর নির্দেশে উক্ত এলাকার নিরীহ জনসাধারণকে
নিকটবর্তী সুবলং বাজারে না গিয়ে ৩/৪ ঘন্টার পানিপথ অতিক্রম করে বরকল বাজারে তাদের উৎপাদিত সামগ্রী (কলা, আদা, হলুদ ইত্যাদি) পানির দামে
বিক্রি করতে হচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে নতুন সিও আসার পর থেকে এ নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে বলে জানা গেছে।
(৩)
একই সাথে দুই বোন ধর্ষিতা
১৬ই মার্চ ১৯৯২ ইং বরকল সদর জোনের ১৬ ইষ্ট বেঙ্গলের অধীন মাইচছড়ি নামক
আর্মি ক্যাম্পের ৪ (চার) জন জোয়ান সহোদর দুই বোনকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষিতা
সহোদর দুই বোনের নাম হলো যথাক্রমে Ñ মিস অনিকা চাকমা এস,এস,সি
পরীক্ষার্থীনি এবং তার ছোট বোন অঞ্জনা চাকমা নবম শ্রেণীর ছাত্রী, পিতা ধর্ম ধন চাকমা,
গ্রামঃ সুবলং হাজাছড়া। জানা যায় উক্ত দুই বোন জমিতে ধান রোপন শেষে বাড়িতে ফেরার পথে
বরকল সদর জোনের ১৬ ইষ্ট বেঙ্গলের অধীন মাইচছড়ি ক্যাম্পের ৪ (চার) জন জোয়ান অস্ত্রের
ভয় দেখিয়ে দুই বোনকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে তাদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করে। এখনও পর্যন্ত
অপরাধী এ সেনাদের বিরুদ্ধে কোন রকম আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
(৪)
সেনাবাহিনী কর্তৃক নববধু ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ স্বামী ছুরিকাহত
গত ১২ই মার্চ ৯২ইং রোজ বৃহস্পতিবার বরকল সদর জোনের অধীন বেতছড়ি ক্যাম্পের
কয়েকজন জোয়ান (১৬ বেঙ্গল) খামার বাড়িতে অবস্থানরত বিনয় কান্তি চাকমার নবপরিণীতা স্ত্রীকে
বলপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটির প্রবল বাধা দানের ফলে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ
হলে সেনা জোয়ানরা বিনয় কান্তি চাকমাকে ছুরিকাঘাত করে। এতে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়।
বিনয় কান্তি মাইচছড়ি গ্রামের বিজু চন্দ্র চাকমার পুত্র।
(৫)
গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত, একজন নিহত
বর্তমানে বরকল জোনের (১৬ বেঙ্গল) অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল ইকবাল করিম ভুঁইয়া
হালাম্বা, বেগেনাছড়ি, দেওয়ান চর, ওজ্যাংছড়ি ইত্যাদি এলাকার জনসাধারণকে জোরপূর্বক গুচ্ছগ্রামে
স্থানান্তরিত করার জন্য জোর প্রয়াস চালাচ্ছে। এজন্য এখন এসব গ্রামে সেনা অভিযান চালানো
হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ৪/৩/৯২ইং রোজ বুধবার ওজ্যাংছড়ি গ্রামে হানা দেয়।
মিঃ জয়চন্দ্র চাকমা পীং পাগোয্যা চাকমা গুচ্ছগ্রামে যেতে অস্বীকার করলে তাকে পিটিয়ে
নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই দিন সেনারা আরো একজনকে একই কারণে হত্যা করে। যার নাম
এখনো পাওয়া যায়নি। এলাকাবাসীদেরকে গুচ্ছগ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ
করা হচ্ছে। কৃষকদেরকে কৃষিঋণ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সরকারী আদেশ নির্দেশ এবং কার্যক্রমের
ওপর আর্মিরা হস্তক্ষেপ করছে। বিলছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য সরকার কর্তৃক মঞ্জুরীকৃত
চল্লিশ হাজার টাকা উক্ত জোন কমা-ার বন্ধ করে দেন। তা ছাড়া সুবলং এলাকার সরকারী প্রাইমারী
বিদ্যালয়সমূহ পুনঃনির্মাণ বা মেরামত বাবদ যে কয়েক লক্ষ টাকা সরকার বরাদ্দ করেছেন, তাও
সেনারা গুচ্ছগ্রাম খাতে ব্যয় করছে। বর্তমানে অত্র এলাকার জনসাধারণ খুবই ত্রস্ত জীবন
যাপন করছে। গুচ্ছগ্রাম নামক বন্দী শিবিরে যেতে অস্বীকার করলেই মারধর করা হচ্ছে। আবার
গুচ্ছগ্রামে গেলেও কোন চাষবাস হবে না। কারণ জমিগুলো অনেক দুরে পড়ে থাকবে এবং তা বাঙালিরা
দখল করে নেবে।
বাঘাইছড়ি
(১)
বাঘাইছড়িতে শিক্ষক হয়রানি
“আমরা সেনাবাহিনী কর্তৃক এই রকম অযথা হয়রানি হওয়া থেকে মুক্তি পেতে চাই” Ñ এই কথাগুলো বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঘাইছড়ি উপজেলার একজন প্রাইমারী
স্কুলের শিক্ষক। উল্লেখ্য, রাঙ্গামাটি জেলাধীন উক্ত উপজেলার প্রায় ৩০০জন প্রাইমারী
স্কুলের শিক্ষককে প্রত্যেক মাসে বেতন তোলার আগে স্থানীয় জোন কমা-ার লেঃ কর্ণেল হারুনুর
রশীদ (৪৬ নং ইষ্ট বেঙ্গল রেজি) -এর কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হচ্ছে। উক্ত ক্লিয়ারেন্স
বা ছাড়পত্র ব্যতীত সোনালী ব্যাংক কাউকে বেতন দেয় না। এর ফলে শিক্ষক/শিক্ষিকারা যেমন
হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তেমনি এলাকার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরও পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে। কারণ
এ ছাড়পত্র নিতে প্রত্যেক মাসে ১ দিন করে উক্ত উপজেলার স্কুলগুলি বন্ধ রাখতে হয়। বলাবাহুল্য
৮ম ব্যাটেলিয়ন থাকাকালীন ১৯৭৯ সাল থেকে এ হয়রানিমূলক ব্যবস্থা চালু হয়, যা অন্য অঞ্চলে
নেই। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকগণ অনেক আগে শিক্ষা
মন্ত্রণালয় পর্যন্ত লেখালেখি ও তদবির করেছিলেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি। তারপর গত বৎসরের ডিসেম্বর মাসে ২৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট Ñএর সিও জনাব
ফাতেমী আহম্মদ রুমী তার বদলীর সময় বিদায় অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, প্রাইমারী শিক্ষকদের এ
ব্যবস্থা মাফ করে দেয়া হবে। কিন্তু ২৮ বেঙ্গল বদলীর পরও ৪৬ বেঙ্গল এসে উক্ত কালো ব্যবস্থা
পুনর্বহাল রাখেন। একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক বলেন, “অন্যায় কাজ করেন তারা, অপরাধ
হয় আমাদের। তারপরেও মাফ চেয়েছি এবং রুমী সাহেবের কাছ থেকে মাফ পেয়েছি। কিন্তু মাফ পেলাম
না ৪৬ বেঙ্গল এর কাছ থেকে।” বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩০০ জন শিক্ষক জানেন না তাদের ওপর এই
হয়রানি ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার শেষ কোথায় ?
(২)
কাচালং কলেজের তিন জন ছাত্র গ্রেফতার
গত ২রা মার্চ ’৯২ ইং বাঘাইছড়ি বি,ডি,আর সেনা জোয়ানরা বাবুপাড়া গ্রামের
রিপল চাকমা পীং সুনেন্দু চাকমা এবং তালুকদার পাড়া গ্রামের মিঃ লোকবল চাকমা পীং মেম্বার
দীপংকর তালুকদার -নামে কাচালং কলেজের দুই জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। সেনারা রিপল চাকমাকে
মারিশ্যা বাজার লঞ্চঘাট থেকে এবং লোকবল চাকমাকে নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। বাঘাইছড়ি
থেকে আমাদের সংবাদদাতা কর্তৃক এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের ওপর অমানুষিক শারিরীক নির্যাতন
চালানো হচ্ছিল বলে জানা গেছে। এছাড়া গত ৩রা মার্চ ’৯২ আদিত্য চাকমা নামক কাচালং
কলেজের আরো একজন ছাত্রকে উক্ত সেনা সদস্যরা ধরে নিয়ে যায় এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতন
চালিয়ে তার কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয়। উল্লেখ্য, উক্ত তিন ছাত্রসহ
পার্বত্য চট্টগ্রামের আরো অন্যান্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারকৃত মোট ৯ জন
ছাত্রের মুক্তির দাবীতে গত ১২/৩/৯২ ইং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ঢাকা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে
একযোগে প্রতীক অনশন ধর্মঘট পালন করে। তাদেরকে এখনো ছেড়ে দেয়া হয়নি।
নানিয়াচর
(১)
মার্মা পাড়ায় ভি,ডি,পি কর্তৃক বাড়ি-ঘর ভাঙচুর, লুটপাট একজন গুম
৭ই নভেম্বর ’৯১, নানিয়াচর উপজেলার বুড়িঘাট এলাকায় পলিপাড়া মারমা সম্প্রদায়
অধ্যুষিত এক শান্ত-¯িœগ্ধ গ্রাম। অবশেষে ভি,ডি,পি দের হামলায় সেই পলিপাড়াও এক বিরানভূমিতে পরিণত
হলো। জানা যায়, ঐ দিন (৭/১১/৯১) বুড়িঘাটে অবস্থানরত অনুপ্রবেশকারী ভি,ডি,পি সদস্যরা
পলিপাড়ায় এক অতর্কিত হানা দিয়ে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালায়। তারা আহ্লা মার্মা
নামক জনৈক ব্যক্তির এক জোড়া হালের গরুও নিয়ে যায়। মিঃ আহ্লা মার্মা (৭০) পীং ক্যাজাই
মার্মা তার হারানো গরু জোড়াটি অনুপ্রবেশকারীদের পাড়ায় খোঁজ করতে গেলে তিনি নিখোঁজ
হয়ে যান। পলিপাড়ার মার্মা অধিবাসীরা মনে করে আহ্লা মার্মা অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা
গুম হয়েছেন।
উল্লেখ্য, একই দিন অনুপ্রবেশকারী ভি,ডি,পি সদস্যরা উত্তর মঙ্গলা, দক্ষিণ
মঙ্গলা, হাতিমারা, তংতুল্যা, কেরেটছড়ি, রামহরি পাড়া ও কৃঞ্চমা ছড়া গ্রামের জুম্ম অধিবাসীদের
পাইকারীভাবে মারধর করে এবং প্রচুর টাকার সম্পত্তি তছনছ ও লুট করে নিয়ে যায়। সর্বশেষ
খবরে জানা গেছে, উক্ত ঘটনায় উদ্বাস্তু হওয়া পলিপাড়ার মার্মাজুম্ম ও অধিবাসীরা এখন তাদের
নিজ নিজ বাড়ি-ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। তবে এলাকায় এখনো আতংক বিরাজ করছে। এ রিপোর্ট লেখা
পর্যন্ত মিঃ আহ্লা মার্মাÑএর (জ্যান্ত/মৃত) কোন হদিস পাওয়া যায় নি।
(২)
বিজয় দিবসে ধর্ষণের চেষ্টা ও মারধর
১৬ই ডিসেম্বর যখন সারা দেশ ২০ তম বিজয় বার্ষিকীতে আনন্দে মাতোয়ারা, তখন
পার্বত্য চট্টগ্রামের নানিয়াচর উপজেলার দক্ষিণ হাতিমারা নামক অখ্যাত এক গ্রামে বাংলাদেশ
সেনাবাহিনী পৈশাচিক হামলার মাধ্যমে বিজয় দিবস পালনে ব্যস্ত-যা ১৯৭১ সালের হানাদার পাকবাহিনীদের
কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমাদের রাডার সংবাদদাতা জানান, ঐ দিন (১৬/১২/৯১) বুড়িঘাট আর্মি ক্যাম্প -এর মেজর মুনির -এর (৮ ইঞ্জিনিয়ারিং
ব্যাটালিয়ন নানিয়াচর জোন) নেতৃত্বে ১১ জনের একটি সেনাদল দুটি জেট বোটে করে টহল দেওয়ার
সময় দক্ষিণ হাতিমারায় এসে নারী ধর্ষণের চেষ্টা চালায় এবং মারধর করে। উক্ত ঘটনার শিকার
ব্যক্তিদের নাম ঠিকানা ও অত্যাচারের বিবরণ নিম্নরূপ ঃ-
১। মিসেস ধনপতি চাকমা (২৩) স্বামী - সুশীল জীবন চাকমা,
গ্রাম দক্ষিণ হাতিমারা, ৭০ নং হাজাছড়ি মৌজা, নানিয়াচর উপজেলা-কে জনৈক মেঘনাথ -এর বাড়িতে ঢুকিয়ে
বলাৎকারের চেষ্টা করলে মেয়েটির
চিৎকারের ফলে ছেড়ে দিতে বাধ্য
হয়। পরে সেনারা বন্দুকের বাট দিয়ে যৌনাঙ্গে আঘাত করে। মিসেস ধনপতিকে নৌকাযোগে পানি
আনতে গিয়ে ফেরার পথে জোর করে ঐ মেঘনাথ এর বাসায় জনৈক আর্মি নিয়ে যায়।
২। মিস্ অমলিকা চাকমা (১৫) পীং - রবি চাকমা, গ্রামঃ কেরেটছড়ি, ৭০ নং হাজাছড়ি মৌজা, নানিয়াচর - কে ধষণের চেষ্টা
করলে জনৈক সাধন মাষ্টারের বৃদ্ধা মা তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে ধরে
অমলিকাকে উদ্ধার করেন। ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হলে সেনা জোয়ানরা (নাম-আজিজ, জোনেল, নজরুল,
সিরাজ) মেয়েটির বুকে বোমা লুকানো আছে - এই অজুহাতে মেয়েটির ব্লাউজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ন্যাক্কারজনকভাবে
শ্লীলতাহানি করে। পরে টাকার লোভ দেখানো সত্ত্বেও যৌনসঙ্গমে রাজি না হওয়ায় সেনা জোয়ারা
অমলিকাকে মারধর করে।
তাছাড়াও (১) মিস্ আলোরাণী চাকমা (১৫) পীং- চারু মোহন চাকমা
(২) মিস্ সুচরিতা চাকমা (১২) পীং- আনন্দ শেখর চাকমা (৩) মিসেস প্রণীতা চাকমা (২২) স্বামী- পংকজ চাকমা
(৪) মিস্ বসুন্ধরা চাকমা (১৩) পীং- বিরাজমুনি চাকমা (৫) মিসেস রূপালি চাকমা (৪৫) স্বামী- পুলিন্যা চাকমা
ও (৬) মিসেস সাধনাদেবী চাকমা (২৮) স্বামী- শান্তনু চাকমা -কেও ঐ সেনাবাহিনীর সদস্যরা
ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হলে মারধর করে। তারা কাউকে যৌনাঙ্গে বন্দুকের বাট দিয়ে
আঘাত করে, কাউকে ব্লাউজ ছিড়ে দিয়ে উলঙ্গ করে।
জানা গেছে, সেনা জোয়ানরা একই গ্রামের মিঃ রমণী রঞ্জন চাকমা (৩৪) পীং- মৃত প্রভাত চন্দ্র
চাকমা, মিঃ বাত্যা চাকমা (৩৫) পীং- জুগরাম চাকমা এবং মিঃ দেবেন্দ্র চাকমা (৫০) পীং- পরশচন্দ্র চাকমা
নামক তিনজন নিরীহ ব্যক্তিকেও অমানুষিকভাবে প্রহার করে। সেনারা রমণী রঞ্জন চাকমাকে নাকে-মুখে
পানি ঢেলে নির্যাতন করে এবং শান্তিবাহিনী ও চাঁদা আদায়কারী বলে মিথ্যাভাবে অভিযুক্ত
করে বুড়িঘাট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে তার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানা যায় নি।
(৩)
গুলিতে নিরীহ জুম্ম মাছ ব্যবসায়ী আহত
২৪শে নভেম্বর ১৯৯১ ইং, রাত আনুমানিক ১১ঃ০০ টার সময় নানিয়াচর জোন (৮ নং
ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন) হেড কোয়াটার থেকে একদল আর্মি তৈচাকমা মুখ গামারী বাগান নামক
জায়গায় মিঃ নন্দ বিলাস চাকমা (২৭) পীং-শারদা চাকমা ও মিঃ ভুত্তুঙ্যা চাকমা (৩৫) পীং- করি রঞ্জন চাকমা
নামে দুইজন মাছ ব্যবসায়ীকে গুলি করে আহত অবস্থায় ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আহত ব্যক্তিরা
সাবেক্ষং ইউনিয়ন, ৬২ নং সাবেক্ষং মৌজার অন্তর্গত জগনাতলী গ্রামের অধিবাসী বলে জানা
গেছে।
উক্ত ঘটনার সূত্রে জানা যায়, রাধা নাথ বহদ্দার নামে একজন হিন্দু জেলে
মাছ ধরার জন্য ঐ স্থানে (তৈচাকমা মুখ গামারী বাগান) একটা জায়গা পরিস্কার করলে উহাতে
বল বহদ্দার নামে অপর একজন হিন্দু জেলে মাছ ধরতে এলে দুইজনের মধ্যে তুমুল বাকবিত-া হয়।
এই ঘটনার জের হিসেবে বল বহদ্দার নানিয়াচর আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে শান্তিবাহিনীরা কালেকশানে
আসবে বলে খবর দেয় এবং সঙ্গে একদল আর্মি নিয়ে আসে। ঘটনার ঠিক কয়েক মিনিট আগে ২ জন জুম্ম
মাছ ব্যবসায়ী মাছ কেনার জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছলে আর্মিরা তাদেরকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে
গুলি চালায়। এতে ব্যবসায়িদ্বয় সাংঘাতিকভাবে আহত অবস্থায় কোন রকমে তীরে ওঠে। আর্মিরা
সারা রাত ঐ স্থানটি ঘেরাও করে রেখে পরদিন ভোরে আহত অবস্থায় তাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
(৪)
সেনাবাহিনী কর্তৃক ২জন যুবতী অপহৃত
৫ই ডিসেম্বর ’৯১ ইং ডাক বাংলো আর্মি ক্যাম্প (৮ম ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন,
নানিয়াচর বড় জোন) -এর সেনা সদস্যরা টহলরত সামরিক যানে করে মিস্ সোনালী চাকমা ওরফে সোনাপুদি
(১৯) পীং-বসন্ত কুমার চাকমা এবং মিস বাদনী চাকমা ওরফে চম্পা (১৭) পীং- সিদোল মুনি চাকমাকে
অপহরণ করে নিয়ে যায়। জানা গেছে, নিজেদের খামার বাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডাক বাংলো
বগাছড়ি আর্মি ক্যাম্প সংলগ্ন রাস্তার মোড়ে পৌছলে সেনা সদস্যরা উক্ত যুবতীদ্বয়কে সামরিক
যানটিতে জোরপূর্বক তুলে ডাক বাংলো ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের
কোন হদিস পাওয়া যায়নি। উক্ত যুবতীদ্বয় নানিয়াচর উপজেলার বুড়িঘাট অঞ্চলের অন্তর্গত নানাক্রুম
গ্রামের অধিবাসী। গোপন সূত্রে জানা গেছে, যুবতী নারীদেরকে ছলেবলে কৌশলে অপহরণ করে নিয়ে
বিয়ে করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত সেনাবাহিনীদের উপর গোপন নির্দেশ রয়েছে।
(৫)
সুবেদার তফাজ্জলের যৌন উন্মাদনায় যুবতী নারীরা সস্ত্রস্ত, একজন কিশোরী
ধর্ষিতা
সমস্ত প্রকার বস্তুগত সম্পদ-বঞ্চিত পার্বত্য চট্টগ্রামের অসহায় অবলা নারী
সমাজকে সতীত্ব নামক যে সম্পদ দিয়ে রাখা হয়েছে, বর্তমানে কতিপয় দুশ্চরিত্র লম্পট সেনাসদস্য
তাও বর্বরভাবে হরণ করতে উদ্যত।
গত ১২ই ডিসেম্বর ১৯৯১ ইং মিস ঝর্ণাদেবী চাকমা-কে (১৪) জুরাছড়ি আর্মি ক্যাম্প
কমা-ার (৮ম ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন, নানিয়াচর জোন) সুবেদার তফাজ্জল বর্বরভাবে ধর্ষণ
করে। সে খাগড়াছড়ি জেলার ইটছড়ি গ্রামের অধিবাসী মিঃ কান্দারা চাকমার কন্যা। উল্লেখ্য,
উক্ত পাশবিক ঘটনার কিছুদিন আগে ঝর্ণাদেবী তার দাদু মিঃ রত্নধর চাকমার (গ্রাম-মাইচছড়ি,
ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন, নানিয়াচর উপজেলা) বাড়িতে বেড়াতে আসে। কয়েকদিন সেখানে থাকার পর সে তার
দাদুকে নিয়ে নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য মহালছড়ি-মানিকছড়ি রাস্তায় জুরাছড়ি আর্মি ক্যাম্পের
নিকটে পাবলিক বাস অপেক্ষা করছিল। ঠিক সেই মুহুর্তে সুবেদার তফাজ্জল ঝর্ণাদেবীকে জোর
পূর্বক ক্যাম্পের গোল ঘর-এ নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করে। ঐ সময় ৬৫ বছর বয়স্ক দাদু ঝর্ণাদেবীর
‘আজু আজু’ চিৎকার শুনে গোল ঘরের দিকে যেতে
চাইলে অন্য একজন আর্মি তাকে বাধা দেয়। কিছুক্ষণ পরে অসুরিক চাহিদা মেটার পর তফাজ্জল
ঝর্ণাদেবীকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনার পর সে শারিরীক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার
গালে ও বুকে এখনো তফাজ্জলের হিংস্র লোলুপ কামড়ের দাগ রয়েছে। এলাকায় এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার
খবর ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উক্ত পৈশাচিক ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের
কোন উপায় না দেখে তাদের মনে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ আরও দ্বিগুণ বাড়তে থাকে।
তফাজ্জলের কুকীর্তি এখানে শেষ নয়। ঝর্ণাদেবীকে ধর্ষণের পর তার অসুর-সত্ত্বা
আরো দ্বিগুণ প্রবল হয়ে ওঠে। উক্ত ঘটনার পর সে আরো দুজন কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা
করে। গত ১৩-১২-৯১ইং তফাজ্জল ১৭ বছরের আরেক যুবতী মিস্ আনন্দ মালা চাকমা পীং বেরগুয়া
চাকমা, গ্রামঃ কাঠালতলী, ৭২নং বুড়িঘাট মৌজা, নানিয়াচর উপজেলা-কে ক্যাম্পের একই গোলঘরে
বলপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু প্রবল বাধা দান ও চিৎকারে শেষ পর্যন্ত তফাজ্জলের ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ
হয়। ঐ দিন আনন্দ মালা তার ভগ্নিপতি অজিত কুমার চাকমার সাথে কুতুকছড়ি বাজার থেকে বাড়ি
ফিরছিল।
জানা গেছে, আনন্দ মালাকে এ দিন ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ছেড়ে দেয়
এবং পরের দিন একা একা আসার জন্য নির্দেশ দেয়। তফাজ্জল আনন্দ মংালাকে তার কাছে পাঠাতে
ব্যর্থ হলে অজিতকে মারধর ও জেলে পুরে রাখবে বলেও হুমকি দেয়।
এরপর গত ১৬-১২-৯১ইং সেনাবাহিনীর কলংক সুবেদার তফাজ্জল মিস্ কালাবি চাকমা
নাম্রী ১৬ বছরের আরো এক যুবতীকে একই স্থানে বলাৎকার করার চেষ্টা করে। কালাবী চাকমা নানিয়াচর উপজেলার
৪নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন ও ৭১নং ছোটমহাপুরম মৌজার অন্তর্গত মাইচছড়ি গ্রামের অধিবাসী পরানকিষ্ট
চাকমার কন্যা। জানা যায়, উক্ত ঘটনার একদিন আগে তফাজ্জল কালাবী চাকমাকে ক্যাম্পে নিয়ে
আসার জন্য মাইচছড়ি নিবাসী মিঃ শান্তিময় চাকমাকে নির্দেশ দেয়। কারণ কালাবীর বিরুদ্ধে
নাকি তাদের কাছে অভিযোগ আছে। তার পরের দিন (১৬-১২-৯১) শান্তিময় বাবু কালাবিকে নিয়ে
ক্যাম্পে যায়। তফাজ্জল তাকে কিছু দুরে রেখে কালাবীকে গোলঘরে বসিয়ে অহেতুক নানা প্রশ্ন
জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে এক পর্যায়ে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু প্রবল
চিৎকার ও ধস্তাধস্তির পর কালাবী
গোলঘরের বাহিরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
সেনাবাহিনীর কলংক এই সুবেদার তফাজ্জলকে বর্তমানে জেলে রাখা হয়েছে বলে
জানা গেছে। তাকে রাঙ্গামাটি ব্রিগেড কমাণ্ডা গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন। এখন নানিয়াচর
এলাকার বাসিন্দারা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে।
(৬)
শান্তিবাহিনীর সহযোগী সন্দেহে মারধর দুগ্ধ-শিশুও বাদ যায়নি
গত ৩রা ডিসেম্বর ’৯১ইং নানিয়াচর জোন-এর আমীর (৮ম ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন)
শান্তিবাহিনীর সহযোগী সন্দেহে বেতছড়ি দ্বজর পাড়া ও জগনাতলী গ্রামের একজন দুগ্ধ-শিশুসহ
৬ ব্যক্তিকে অমানবিকভাবে মারধর করে। এই হতভাগ্যরা হচ্ছেন, নানিয়াচর উপজেলার ৭৫ নং বেতছড়ি
মৌজার অন্তর্গত বেতছড়ি দ্বজর পাড়া গ্রামের মিঃ ইন্দ্রমুনি চাকমা (৫৫) পীং পাক্যা চাকমা,
মিসেস মনতা চাকমা (২৬) স্বামী- সোনাময় চাকমা ও তার ২ বৎসরের শিশুপুত্র নবেন্দু চাকমা এবং একই উপজেলার সাবেক্ষং
ইউনিয়নের অন্তর্গত জগনাতুলী গ্রামের মিঃ মেদেরা চাকমা (১৩) পীং- পদ্ম চাকমা,
অমর বিকাশ চাকমা (১৫) পীং- নীলমোহন চাকমা এবং মিঃ শুভজিৎ চাকমা (১২) পীং- কালাবুয়া চাকমা।
(৭)
গুলিতে একজন নিহত, লাশ ফেরত দেয়া হয়নি
গত ১২/২/৯২ইং রোজ বুধবার বেতছড়ি ক্যাম্প কমা-ার মেজর মাহবুবুল আনাম (৮ম
বেঙ্গল) এর নেতৃত্বে তার সেনারা একদল লোকের ওপর বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করলে এতে চেরেত্তো
চাকমা (২৬) পীং- নেপাল চন্দ্র চাকমা নামে এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। ধর্মীয়ভাবে
দাহ কার্য সম্পন্ন করার জন্য নিহত ব্যক্তির লাশ ফেরত দেয়া হয়নি এবং সেনাকর্তারা পিতাকে লাশ দেখতে দেয়নি।
ঘটনার খবরে প্রকাশ, উক্ত দিন সকালে লক্ষী বিলাস চাকমা পীং সুর্য্যমনি
চাকমা, অনাদি রঞ্জন চাকমা পীং বুকুন্দু বিকাশ চাকমা, বড়চোগা চাকমা পিং মঙ্গল চন্দ্র
চাকমা, চেরেত্তো চাকমা পীং নেপাল চন্দ্র চাকমা সানাই বাজারে মাছ বিক্রি করার পর নৌকা
যোগে বাড়ি ফিরছিল। তারা বেতছড়ি ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌছলে সেনা সদস্যরা তাদের ওপর এলোপাথারি
গুলি বর্ষণ করে। এতে বাকী তিনজন পানিতে ঝাঁপ দিয়ে রক্ষা পেলেও চেরেত্তো চাকমা ঘটনাস্থলে
নিহত হন। এরপর গুলি থেকে রক্ষা পেলেও উক্ত তিন জনকে পানি থেকে তুলে বেপরোয়া মারধর করা
হয় এবং এলাকার আরো দুই ব্যক্তিসহ তাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ঘটনার চারদিন পর নানিয়াচর জোনের সি,ও,সাহেব নিহত ব্যক্তির পিতাকে
পাঁচ শত টাকা ক্ষতিপূরণ দেন এবং এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করার জন্য হুমকি দেন।
(৮)
ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হলে .......
গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ৯২ইং শশী রাণী চাকমা, স্বামী রবি কুমার চাকমা, গ্রামঃ
কৃঞ্চমা ছড়া, নানিয়াচর উপজেলা-কে ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হলে তাকে কুপিয়ে হত্যা করার চেষ্টা
করা হয়।
জানা যায়, ঐ দিন সকাল বেলা একজন বাঙালী অনুপ্রবেশকারীসহ পার্শ্ববর্তী
ক্যাম্পের মেজর আহসান এবং সুবেদার তোফাজ্জল রবি কুমার চাকমার বাড়ি যায়। ঐ সময় সে বাসায়
অনুপস্থিত ছিল। রবি কুমার চাকমার অনুপস্থিতির খবর জেনে তারা ফিরে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ
পরই উক্ত বাঙালী অনুপ্রবেশকারী লোকটি পুনরায় রবি কুমারের বাড়িতে ফিরে আসে এবং শশী রাণী
চাকমাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। শশী রাণী চাকমার প্রবল চিৎকার এবং বাধা দানের দরুণ ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হলে উক্ত
লোকটি তাকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করে। এতে শশী রাণী মারাত্মকভাবে জখম হয়।
পরে তাকে রাঙ্গামাটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
(৯)
পাহাড়ি গ্রামে হানা তিনজনকে মারধর
গত ২ শে জানুয়ারী ’৯২ রাতে নানিয়াচর জোনের সেনা সদস্যরা (৮ম বেঙ্গল) মেজর
ফিরোজের নেতৃত্বে উত্তর মরা চেঙ্গী গ্রামে হানা দেয় এবং তিন ব্যক্তিকে অমানুষিকভাবে
প্রহার করে। এরা হলেন, অনাদী রঞ্জন চাকমা (৩৫) পীং আনন্দ মোহন চাকমা, সুশীল রঞ্জন চাকমা
(৩৩) পীং গোলক বাঁশী চাকমা এবং প্রদীপ চন্দ্র চাকমা (৩৮) পীং শুক্রচার্য্য চাকমা।
(১০)
তফাজ্জল কর্তৃক কিশোরী ধর্ষিতা ৯ই জানুয়ারী ৯২ইং। জুরাছড়ি আর্মি ক্যাম্পের কুখ্যাত
সুবেদার তফাজ্জল পুকুরছড়ি গ্রামের জয়মোহন চাকমার স্ত্রী মিসেস জুরাহেলা চাকমা এবং কন্যা
মিস্ বনদেবী চাকমাকে জোরর্পূবক বাড়ি থেকে ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং বনদেবী চাকমাকে ধর্ষণ
করার পর ছেড়ে দেয়। উল্লেখ্য, এই কুখ্যাত দানব তফাজ্জল ইতিপূর্বে আরো অনেক মেয়েকে জোরপূর্বক
ধর্ষণ করেছে।
(১১)
শান্তিবাহিনী সন্দেহে একজন প্রহৃত
৩রা জানুয়ারী ’৯২ইং মেজর ফিরোজের নেতৃত্বে (৮ম বেঙ্গল) নানিয়াচর জোন থেকে
একদল সেনা গভীর রাত্রে যাদব ছড়া গ্রামের মিঃ মঙ্গল চাকমা (৬৯) পীং পেত্তো চাকমার বাড়ি
ঘেরাও করে এবং শান্তিবাহিনী সন্দেহে তাকে সাংঘাতিকভাবে প্রহার করে।
(১২)
শ্লীলতাহানির চেষ্টা ব্যর্থ
বিনতা রাণী চাকমা (২৫) স্বামী সাধনা কুমার চাকমা গ্রামঃ চৈছড়ি, ৪নং ঘিলাছড়ি
ইউনিয়ন, উপজেলাঃ নানিয়াচর। গত ৫/৩/৯২ইং তারিখে কলকপাড়া ক্যাম্পের রাস্তায় কর্তব্যরত
দুইজন সৈনিক কুতুকছড়ি বাজার থেকে ফেরার পথে বিনতা রাণী চাকমাকে ঝাপতে ধরে রাস্তার পাশে
নিয়ে যায়। এসময় হাঠৎ একটা জীপগাড়ি
আসায় শ্লীলতাহানির চেষ্টা থেকে তিনি রক্ষা পান। কিন্তু টাকা পয়সা যা ছিল সব কেড়ে নেয়া
হয়। এই অভিযোগ ঘিলাছড়ি ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর আহসানুল হককে জানালে তিনি বিনতা রাণী
চাকমাকে ১০০ টাকা দিয়ে বিদায় করেন।
মহালছড়ি
(১)
গুলিতে নিরীহ জুম্ম নিহত, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীকে কি খুন করার
লাইসেন্স দেয়া হয়েছে?
২০শে ডিসেম্বর ১৯৯১ইং ২৬ বেঙ্গল মানিকছড়ি জোন-এর অধীন বাজার পাড়া ক্যাম্প
অধিনায়ক ক্যাপ্তেন হামিজ শান্তিবাহিনীর কট্টর সহযোগী আখ্যায়িত করে নিশি কুমার চাকমাকে
(৪৫) পীং মঙ্গল চাকমা, গ্রামঃ চংড়াছড়ি মুখ, ২১৬নং গোয়াছড়ি মৌজা, সিন্দুকছড়ি ইউনিয়ন,
মহালছড়ি উপজেলা-কে নিজ বাড়ির উঠানে রাত ১০.০০ টায় নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে লাশটি
দাহ করার জন্য তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদেরকে অনুমতি দেয়া হয়নি। ক্যাপ্তেন হামিজ নিহত
ব্যক্তির পকেটের ৭৯০ টাকা সহ লাশটি ক্যাম্পে নিয়ে যান।
উক্ত হত্যাকা- পূর্বপরিকল্পিত ও প্রতিশোধমূলক বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য,
উক্ত ঘটনার পুর্বে স্থানীয় বাজার পাড়া ক্যাম্পের আর্মিদের প্রচ- উপদ্রব সহ্য করতে না
পেরে নিহত নিশি কুমার চাকমাসহ মি. কিনাধন কার্বারী ও মি. মুই থোয়াই মেম্বার এই তিন
ব্যক্তি গত ৪/১১/৯১ইং মানিকছড়ি জোন-এর ঈঙ লেঃ কর্ণেল হানিফ ইকবালের কাছে আশ্রয় নেয়।
ক্যাপ্তেন হামিজ এই আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে না পেরে নিশি কুমার চাকমাকে
খুন করে। এই নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা সম্পর্কে মানিকছড়ি ঈঙ অবগত হলে ক্যাপ্তেন হামিজ-এর
উপর চাপ আসতে থাকে। ঈঙ সাহেব তাকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। ফলশ্রুটিতে ক্যাপ্তেন
হামিজ ২৩/১২/৯১ইং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাধ্য হয়ে “বাজার ফা- দেয়া হবে” এই
অজুহাতে গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ স্থানীয় গ্রামবাসীদের ক্যাম্পে আসতে নির্দেশ দেয়। ঐ দিন
প্রায় ৪৮ জন জুম্ম উপস্থিত হয়। উপস্থিত জুম্মদেরকে নানা ধরনের হুমকি ও কড়া ভাষায় শাসানোর
পর নিহত নিশি কুমার চাকমার বিরুদ্ধে ৩টি অভিযোগ (১. শান্তিবাহিনীর কট্টর সহযোগী, ২.
শান্তিবাহিনীর কট্টর সহযোগী বিধায় পকেটে রসিদসহ নগদ ৭৯০ টাকা পাওয়া গেছে এবং ৩. তার
কাছে বন্দুক ছিল) আনয়ন করে এবং তার সমর্থনে জোরপূর্বক ৭ জনের স্বাক্ষর নেয়া হয়। এরা
হচ্ছেন চংড়াছড়ি মুখ গ্রামের অধিবাসী সুজিত কুমার চাকমা, রাজমুনি চাকমা, ব্রতমুনি চাকমা,
ইন্দ্রমুনি চাকমা, ধন কুমার চাকমা, কদরাম চাকমা এবং নিক্যা চাকমা।
নিশি কুমার চাকমার হত্যাকা-ের পর গত ২৭-১২-৯২ইং ক্যাপ্তেন হামিজ চংড়াছড়ি
গ্রামের নন্দী কুমার চাকমার পুত্র প্রসন্ন কুমার চাকমা (৩২) নামক আরো একজন নিরীহ জুম্মকে
রাত ৯.০০ টায় নিজ বাড়ির উঠানে কোন প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা
হরে। অথচ ঘটনার পরদিন উক্ত ঘটনাকে বিকৃত করে “বিদ্রোহী শান্তি বাহিনীর সাথে নিরাপত্তা
বাহিনীর সংঘর্ষে একজন শান্তিবাহিনী নিহত হয়” - বলে বিসিবি থেকে প্রচার করা হয়।
উক্ত দুই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর চংড়াছড়ি ও পার্শ্ববতী গ্রামের অধিবাসীরা
সস্ত্রস্ত ও নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করছে। জনমনে এখন স্বাভাবিক প্রশ্ন সরকার কি পার্বত্য
চট্টগ্রামের সেনাবাহিনীকে নির্বিচারে মানুষ খুন করার লাইসেন্স প্রদান করেছেন ?
(২)
পরিচয় পত্র না থাকায় মারধর
সঙ্গে পরিচয় পত্র না থাকায় গত ২৮সে জানুয়ারি ৯২ইং মহালছড়ি জোনের লেঃ কঃ
আব্দুল কাদের (২৩ বেঙ্গল) এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে জখম করেছে। উক্ত ঘটনার শিকার ব্যক্তির
নাম হচ্ছে - বানু কুমার চাকমা (৩৫) পীং তরণী সেন চাকমা, গ্রামঃ যন্ত্রনাথ পাড়া (পাকুয্যাছড়ি)
২৫০ নং লেমুছড়ি মৌজা। ঐ দিন মহালছড়ি বাজারে যাওয়ার সময় তাকে বাজারের প্রবেশ পথে চেক
পয়েন্ট থামানো হয় এবং পরিচয় পত্র না পেলে মারধর করা হয়। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাজারে
প্রবেশ করার সময় সকল পাহাড়িকে তন্নতন্ন করে তল্লাশী করা হয়।
মানিকছড়ি
শান্তিবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে বেদম প্রহার গত ১৮-১২-৯১ইং
মানিকছড়ি জোন-এর অধীন ২৬ বেঙ্গল-এর বাজার পাড়া আর্মি ক্যাম্প কমা-ার ক্যাপ্তেন হামিজ
চংড়াছড়ি গ্রামের ভাগ্যমুনি চাকমার পুত্র ধন্যমুনি চাকমা (৩৫) কে শান্তিবাহিনীর সাথে
সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে মারাত্মকভাবে প্রহার করে। ক্যাপ্তেন হামিজ তাকে কিল-ঘুষি-লাঠি
ও ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করে।
(২)
সেনাকর্তার প্রমোশনের বলি দুই জন নিরীহ পাহাড়ি
মানিকছড়ি জোনের
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য জনৈক মেজর শহীদ প্রমোশন পাওয়ার আশায় একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন
করে। পরিকল্পনা মোতাবেক সে আমিন মিঞা (একজন মেম্বার, মানিকছড়ি) এবং গোলাপ মিঞা নামক
দুই ব্যক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে দুইটি বন্দুক ক্রয় করে। অতঃপর সে ৪/৩/৯২ইং পরিকল্পনা
বাস্তবায়ন করে। ঐ দিন উক্ত মেজর তার দলবল নিয়ে বেত্মাতলী গ্রামে হানা দেয় এবং ধানক্ষেতে
কর্মরত দুইজন নিরীহ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। এরা হলেন প্রাক্তন ইউ,পি, চেয়ারম্যান
মিঃ আধু মারমা পীং মৃত মুইল্যা মারমা এবং আথোয়াই মারমা (৩০) পীং চেইল্যা মারমা। অতঃপর
মেজর শহীদ পূর্বে ক্রয় করা বন্দুক দুটি ধানক্ষেতের পাশের ঝোপ থেকে বের করে ক্যাম্পে
নিয়ে আসে এবং সে দুইজন শান্তিবাহিনীকে হত্যা করে দুইটি বন্দুক উদ্ধার করেছে বলে বীর
দর্পে ঘোষণা করে।
উক্ত ঘটনার পর সেনাসদস্যরা আরো তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এবং তাদের
ওপর শারীরিক অত্যাচার চালায়। এরা হলেন বেত্মাতলী গ্রামের (১) শাই খুয়াই চৌধুরী পীং
উগ্য জাই চৌধুরী (২) অং থোয়াই মারমা পীং মোন মারমা এবং (৩) রামপ্রু মারমা পীং চোইল্যাপ্রু
মারমা। আরো জানা যায়, উক্ত মেজর যাতে তার পরিকল্পনা ফাঁস না হয় সেজন্য আমিন মিঞাকে
কৌশলে থানায় ঢুকিয়ে রেখেছে।
(৩)
সেনাবাহিনীর গুলিতে একজন নিহত
গত ২৭/১২/৯১ইং রাতে ক্যাপ্তেন হামিদের নেতৃত্বে মানিকছড়ি জোনের অধীন বাজার
পাড়া আর্মি ক্যাম্প থেকে ২৬ বেঙ্গলের একদল সদস্য লক্ষীছড়ি ইউনিয়নের চংড়াছড়ি গ্রামে
হানা দেয়। তারা ঐ সময় প্রসন্ন কুমার চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে
আসতে হুকুম দেয়। প্রসন্ন কুমার বাড়ির বাইরে আসলে সেনা সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা
হরে। নিহত ব্যক্তির লাশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরিবারের সদস্যদের অনুরোধ সত্ত্বেও
লাশটি দাহ করতে দেয়া হয়নি।
কাউখালি
(১)
স্বপরিবারে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত পার্বত্য চট্টগ্রামে
অভাব-অনটনের সুযোগে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে জুম্মদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করণ প্রক্রিয়া
এখনো অব্যাহত রয়েছে। গত ১৭ই ডিসেম্বর ৯১ইং ৬৯ বৎসর বয়স্ক মিঃ মনোরাম চাকমা ও তার পরিবারকে কাউখালি উপজেলার ম্যাজিষ্ট্রেট
সিদ্দিকুর রহমান-এর কোর্টে লেঃ কঃ দেলোয়ার হোসেন মিঞা (৫ম ঈষ্ট বেঙ্গল, ঘাগড়া জোন)-এর
উপস্থিতিতে ধর্মান্তরিত করা হয়। মিঃ মনোরাম চাকমার নিবাস গ্রামঃ উগলছড়ি, ৯৭নং মুবাছড়ি
মৌজা, ৩নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন কাউখালি উপজেলা, রাঙ্গামাটি। উল্লেখ্য, অভাব অনটনের কারণে
সেনাবাহিনীর বিভিন্ন প্রলোভনের শিকার হয়ে মিঃ মনোরাম চাকমা দীর্ঘদিন ধরে গোপনে স্থানীয়
সরলপ্রাণ নিরীহ এলাকাবাসীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে সরবরাহ
করে আসছিল। পরে খবর পেয়ে এলাকাবাসীরা তাকে সমাজচ্যুত করে এবং সে সেনাবাহিনীর নিকট আশ্রয়
প্রার্থনা করে। এই সুযোগে সেনাবাহিনীরা তাকে ও তার পরিবারের অন্য সাত সদস্যকে ইসলাম
ধর্মে দীক্ষিত করে। জানা যায়, মনোরাম চাকমা (৬৯) পীং বেগেনা পেদা চাকমা ও তার স্ত্রী
মঙ্গল মুনি চাকমার (৬০) ধর্মান্তরিত নাম যথাক্রমে মোঃ আব্দুল রহিম ও সাহেরা বেগম দেওয়া
হয়। তার দুই পুত্র নিশি কুমার চাকমা (৩৫) ও শেষ কুমার চাকমা (৩২) এর নাম ধর্মান্তরিত
করে যথাক্রমে আব্দুল মালেক ও আব্দুল খালেক এবং শেষ কুমার চাকমার স্ত্রী সূর্যদেবী চাকমার
(২৭) ধর্মান্তরিত নাম নুরজাহান রাখা হয়। তাছাড়া শেষ কুমার চাকমার ৭ বছরের ছেলে নব কুমার
চাকমা, ৩ বছরের ছেলে সক্রিয় চাকমা ও ৭ মাস বয়সী মেয়ে বাসনাদেবী চাকমার নাম যথাক্রমে
সোরাব হোসেন, আব্দুল সোবহান ও রীনা আক্তার রাখা হয়।
(২)
হত্যা যেন ওদের হাতের মোয়া এবং একটি লাশের বৃত্তান্ত
নাম অবিরন চাকমা। পিতার নাম কিনাচন্দ্র কার্বারী। গ্রামঃ শুকনাছড়ি, উপজেলাঃ
কাউখালি, জেলাঃ রাঙ্গামাটি। ফটিকছড়ি ইউনিয়নের অন্যতম চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এবং একজন
সম্ভাব্য চেয়ারম্যান। বর্তমানে পশুপক্ষীর মত একটি লাশ মাত্র। এই হলো অবিরন চাকমার সংক্ষিপ্ত
পরিচয়। তাকে গত ১৪ই জানুয়ারী ৯২ নির্বাচনী প্রচারণায় কিছু সংখ্যক সমর্থক নিয়ে বর্মাছড়ি
নতুন বাজারে গেলে নবপ্রতিষ্ঠিত বড়ইতলী আর্মি ক্যাম্প কমা-ার জনাব নুরুল কবীর ধরে নিয়ে
যান জোরপূর্বক। সেখানে তাকে অমানুষিকভাবে প্রহার করে অথবা গুলি করে লাশ বানানো হয়।
তা তখনো কেউ জানতে পারেনি। পরদিন ১৫ই ফেব্রুয়ারী অবিরন চাকমার হতভাগ্য জন্মদাতা কিনাচন্দ্র
কার্বারীকে ক্যাম্পে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ক্যাম্পে গিয়ে তিনি পুত্রের বিশ্রী লাশ দেখে
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শত অনুরোধ-আবদার সত্ত্বেও নিজের পুত্রের লাশকে বাড়িতে নিয়ে যেতে
দেয়নি ঐ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য জনাব নুরুল কবীর। ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিকে লংঘন
করে ক্যাম্পের নিকটবর্তী জঙ্গলে পিতার উপস্থিতিতে লাশকে কবর দেয়া হয়। আনন্দ প্রকাশের
জন্য সৈন্যরা কবর দেয়ার আগে কয়েক রাউ- শুন্যে গুলি ছোড়ে। এইভাবে একটি লাশের সংক্ষিপ্ত
কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু পুত্রহারা কিনাচন্দ্র সহ আরো অনেকে লাশ হওয়ার প্রতীক্ষায়
প্রহর গোনে। কারণ একমাত্র লাশ হতে কোন অনুমতি নিতে হয় না।
(৩)
মধ্যযুগীয় বর্বরতা: নাকে মুখে গরম পানি ঢেলে দিয়ে অত্যাচার
১০ই ফেব্রুয়ারী ৯২ইং ঘাগড়া জোনের অধীন কাউখালি ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর
তারেক আহমেদ (১৮ বেঙ্গল) তালুকদার পাড়া নিবাসী মেরেয়্যা চাকমা নামক জনৈক নিরীহ কৃষককে
শান্তিবাহিনী সন্দেহে গ্রেফতার করে। তাকে সেনা সদস্যরা সাংঘাতিকভাবে মারধর করে এবং
নাকে-চোখে-মুখে ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দেয়। ফলে তার নাক ও মুখ থেকে রক্ত বের হতে থাকে।
পরে তাকে ঘাগড়া জোন হেড কোয়াটারে চালান দেয়া হয় এবং সেখান থেকে কয়েকদিন পর ছেড়ে দেয়া
হয়।
(৪)
চৌদ্দ বছরের কিশোরী ধর্ষিতা, বহু ব্যক্তি প্রহৃত
২২শে ফেব্রুয়ারী ৯২। হাটবার। কাউখালি উপজেলাধীন লেভাপাড়া আর্মি ক্যাম্পের
অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জাহিদের (১৮ বেঙ্গল) নেতৃত্বে একদল আর্মি সকালে উল্টাপাড়া নামক গ্রাম
ঘেরাও করে এবং গ্রামের উপর বৃষ্টির মত এলোপাথারি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। এতে ভয় পেয়ে
লোকজন এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। যারা পালিয়ে যেতে
পারেনি তাদেরকে দৈহিকভাবে নির্যাতন করা হয়। ক্যাপ্টেন জাহিদ নীরবালা নামক চৌদ্দ বছরের
একা কিশোরীকে বলপূর্বক ধর্ষণ করে। সে ললিত মোহনের কন্যা বলে জানা গেছে। যারা শারীরিকভাবে
নির্যাতিত হয়েছেন তারা হলেন- (১) ফন চোগী চাকমা (৭৫) স্বামী বীর কুমার চাকমা, (২)
জ্যোতিলা চাকমা (৪০) স্বামী ললিত মোহন চাকমা এবং (৩) সাধন দেব চাকমা (১৫) পীং সুখেশ্বর
চাকমা।
(৫)
তিন জন শান্তিবাহিনী গ্রেফতার গত ২৯শে জানুয়ারী
৯২ইং ঘাগড়া জোনের অধীন কাঁশখালী আর্মি ক্যাম্পের অধিনায়ক লেঃ সাব্বিরের (১৮ইঃ বেঙ্গল)
নেতৃত্বে এক দল সৈন্য ভোর রাত্রিতে শুকনাছড়ি গ্রামে গিয়ে তিনটি বাড়ি ঘেরাও করে রাখে
এবং বাড়ির পাশে গোপনে তিনটি দেশীয় গাদা বন্দুক লুকিয়ে রাখে। পরে ভোর হলে বন্দুকসহ তিন
ব্যক্তিকে কাঁশখালী আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। একইদিন গিরিদর্পন, বনভূমি ও রেডিওতে
প্রচার করা হয় যে, সেনাবাহিনী অস্ত্রসহ শুকনাছড়ি থেকে তিনজন শান্তিবাহিনী গ্রেফতার
করেছে। এই তিন জন হলেন, মথুর চাকমা (৭০) পীং মৃত বালি চাকমা, প্রদীপ কুমার চাকমা (৪০)
পীং মথুর চাকমা এবং জ্বালিয়া চাকমা পীং মৃত বইলাম চাকমা। তাদেরকে পরে ঘাগড়া ক্যাম্পে
পাঠানো হয় এবং সেখানে ১৭/১৮ দিন যাবত মাটির নীচের অন্ধকার গর্তে রাখা হয়। তাদেরকে নানাভাবে
নির্যাতন করার পর ছেড়ে দেয়া হয়।
লংগদু
(১)
সেনাবাহিনী কর্তৃৃক নতুন কায়দায় ডাকাতি
গত ২রা জানুয়ারী ১৯৯১ইং করল্যাছড়ি ক্যাম্প কমা-ার ক্যাপ্টেন নাসির মি.
বাজি মোহন চাকমা ও দুলাল্যা চাকমা নামে দুইজন ব্যবসায়ীকে আটক করে। সে তাদেরকে সাংঘাতিকভাবে
মারধোর করে এবং শান্তিবাহিনী কর্তৃক নিযুক্ত ট্যাক্স কালেক্টর বলে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক
স্বীকারোক্তি আদায় করে। আটক করার সময় তাদের দুজনের কাছে মোট ৪১০৫ টাকা ছিল, যা ক্যাপ্টেন
নাসির বাজেয়াপ্ত করে নিজের পকেটস্থ করেছেন বলে জানা গেছে। উক্ত ঘটনার পর এলাকাবাসীদের
প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, “এ এক নতুন কায়দায় ডাকাতি।”
লংগদু উপজেলাধীন বামের আটরকছড়া গ্রাম নিবাসী মিঃ বাজি মোহন চাকমা ও দুলাল্যা
চাকমাকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এখনো ছেড়ে দেয়া হয়নি।
(২)
দুই ব্যক্তি প্রহৃত
গত ২রা জানুয়ারী ৯২ইং করল্যাছড়ি সাব জোনের অধিনায়ক মেজর লুৎফর দুই ব্যক্তিকে বন্দুকের বাট ও লাঠি দিয়ে জ্ঞান না
হারানো পর্যন্ত মারধর করে। এরা হলেন, আটরক ছড়া গ্রামের মিঃ নাগর বাঁশী চাকমা (৪০) পীং
গুনরূপ চাকমা এবং আনন্দ ময় চাকমা (৩২) পীং কালী কুমার চাকমা। ঐ দিন উক্ত দু’ব্যাক্তিকে
বাজারে যাওয়ার পথে করল্যাছড়ি সাব জোনের চেকপোষ্টে আটক করা হয়। তাদেরকে সেনা সদস্যরা
শান্তিবাহিনীকে সাহায্য করে কিনা জিজ্ঞেস করলে তারা না বলে উত্তর দেয়। এর পর তাদের
উপর চলতে থাকে কিল, লাথি ইত্যাদি।
(৩)
নিরীহ ব্যক্তি প্রহৃত
গত ৭ই জানুয়ারী ৯২ইং পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর করিম রাঙ্গাপানি
ছড়া গ্রামের মিঃ জুরনী সেন চাকমাকে (৪২) পিটিয়ে জখম করে। জানা যায় জুরানী সেনের সাথে
সুসম্পর্ক থাকার জন্য একজন বাঙালি ব্যবসায়ী প্রায়শঃ তার বাসায় আসা-যাওয়া করত। উক্ত
দিনও উক্ত বাঙালি ব্যবসায়ী ভদ্রলোক জুরানী সেনের বাসায় বেড়াতে যায়। গল্প গুজব শেষে
ভদ্রলোকটি চলে যাওয়ার পর পরই সেনা সদস্যরা হঠাৎ জুরানী সেনের
বাসায় আসে। তারা সঙ্গে সঙ্গেই জুরানী সেনকে আটক করে এবং উক্ত ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি কেন
তার বাসায় এসেছে তা জিজ্ঞেস করে। জুরানী সেন সত্য কথা বললেও তারা বাঙালি ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি
জুরানী সেন চাকমার মাধ্যমে শান্তিবাহিনীকে চাঁদা দেয় বলে সন্দেহ করে। এই সন্দেহই অতঃপর
রূপান্তরিত হয় শারীরিক নির্যাতনে।
রাঙ্গামাটি সদর
(১)
একজন ধর্ষিতা, দুই ব্যক্তি প্রহৃত
গত ১০ই ফেব্রুয়ারী ৯২ইং খারিক্ষ্যং আর্মি ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন মকিম সরকার
(৮ ইঞ্জিঃ) রাঙ্গামাটি সদর উপজেলাধীন বন্দুকভাঙ্গা খারিক্ষ্যং এলাকার দুই ব্যক্তিকে
নির্দয়ভাবে প্রহার করে এবং মিঃ বিরিত্তং চাকমার চৌদ্দ বছরের কিশোরী কন্যা মিস তাত্তরাং
চাকমাকে ধর্ষণ করে। প্রহৃত ব্যক্তিদ্বয়ের নাম মিঃ ঘুশান মনি চাকমা (৩২) পীং মিঃ আনন্দ
কুমার চাকমা এবং মিঃ মিহির লাল চাকমা, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, ৩নং ওয়ার্ড।
(২)
ক্যাপ্টেন মকিমের বেপরোয়া মারধর
গত ১লা জানুয়ারী ৯২ইং ৫৯ বন্দুকভাঙ্গা মৌজার অধীন কুমার পাড়া গ্রামের
মিঃ কল্পতরু চাকমা (২৮) পীং শুক্রমনি চাকমা খারিক্ষ্যং আর্মি ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন
মকিম কর্তৃক সাংঘাতিকভাবে প্রহৃত হয়েছেন। ঐ দিন তিনি কর্ণফুলি হৃদে মাছ ধরতে গেলে মকিম
তাকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যায় এবং শান্তিবাহিনীকে চাঁদা প্রদানকারী আখ্যায়িত করে বেপরোয়া
মারধর করে। তার নাকে মুখে গরম পানি ঢেলে দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন মকিম তার মাছ ধরার জালসহ
সবকিছু আটক করেছে। এছাড়া গত ২/১/৯২ইং উক্ত ক্যাপ্টেন আরো তিন ব্যক্তিকে ক্যাম্পে ডেকে
নিয়ে প্রহার করে। এরা হলেন, মিঃ রঞ্জন কুমার (৩০) পীং বিন্দুনাথ চাকমা গ্রামঃ মুবাছড়ি,
মিঃ উদয়ন চাকমা (১৭) পীং নতুন চন্দ্র চাকমা, গ্রামঃ লেখ্যংছড়ি এবং মিঃ শান্তিময় চাকমা
(১৮) পীং সুর্য্য চন্দ্র চাকমা, গ্রামঃ লেখ্যংছড়ি। শেষোক্ত দুই ব্যক্তি যথাক্রমে রাণী
দয়াময়ী স্কুলের দশম শ্রেণী এবং রাঙ্গুনিয়া কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র।
(৩)
চার ব্যক্তি আটক
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা (১৭ বেঙ্গল) গত ৯ই মার্চ ৯২ ঘাগড়া ক্যান্টনমেন্টে
দুই ব্যক্তিকে আটক করেছে। এরা হলেন, সুকেন চাকমা ও অনিল চাকমা (শিমুল)। এছাড়া গত ৮ই
মার্চ প্রবীন খীসাকে এবং ২৮শে ফেব্রুয়ারী মিঃ শান্তিজয় চাকমাকে আটকাবস্থায় রাঙ্গামাটিতে
রাখা হয়েছে। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি।
[সংবাদ পাঠিয়েছেন- দিঘীনালা থেকে স্বচল, দিলীপ, লংগদু থেকে সজীব খীসা,
নানিয়াচর থেকে প্রসেনজিৎ, মহালছড়ি থেকে নেশান, অঘ্যজাই, কাউখালি থেকে প্রীতিকুমার (দ্বীপ্য),
খাগড়াছড়ি থেকে রনবীর এবং বাঘাইছড়ি থেকে সুভাষ।]
গ্রন্থনা : মানবমিত্র।
--------------------------------
বিজ্ঞপ্তি
[মানুষের অধিকার মানেই মানবাধিকার। নিজস্ব চিন্তা, চেতনা, ভাষা, সংস্কৃতি
ও অস্তিত্ত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার। নিজের মতামত ব্যক্ত করার, প্রতিবাদ করার,
সংগঠন করার ও চলাফেরা করার অবাধ অধিকার। এই অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত। অথচ
আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামে কি আপনার এমন অধিকার ভোগ করছেন ? খর্ব করা হচ্ছে কি আপনার
অধিকার ? মানবাধিকার লংঘনের প্রত্যক্ষ শিকার অথবা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থাকলে লিখুন
আমাদের ঠিকানায়। কে, কি, কখন, কোথায়, কিভাবে, কেন ইত্যাদির ভিত্তিতে বিস্তারিত লিখুন।
নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন এবং এই অধিকারের জন্য সংগ্রাম
করুন। - রাডার সম্পাদনা পরিষদ]
পাতা: ১৫
--------
--------
আর, এস, ও এবং রোহিঙ্গা
শরণার্থী কর্তৃক
যৌথভাবে পাহাড়ি গ্রামে
হামলা
গত ১২ইং ফেব্রুয়ারী ’৯২ তারিখ রাত ১০টার দিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাধীন সোনাইছড়ি ইউনিয়নের রেজু মৌজার চুলাপাড়ায় (প্রোত্তংথি রোয়া)
কমপক্ষে ৪০ জনের বার্মার আরাকানের একদল সশস্ত্র মুসলিম মৌলবাদী R.S.O. (Rohingya Solidarity
Organization) ARIF(Arakan Rohingya Islamic Front) এবং কিছু সংখ্যক স্থানীয় মৌলবাদী দুষ্কৃতিকারীদের
সহায়তায় ১১টি সংখ্যালঘু চাক পরিবারের উপর হামলা চালিয়ে সর্বসহায় সম্পত্তি লুট করে নিয়ে
যায়। হামলা চালানো কালে দুষ্কৃতিকারীরা নিরীহ গ্রামবাসীদেরকে শারীরিক অমানুষিক নির্যাতন
করে এবং মহিলাদেরকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। উক্ত গ্রামের আক্রান্ত পরিবারের পুরুষদেরকে
ঘরের বাইরে নিয়ে অমানুষিক শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয় এবং মহিলাদেরকে পর্যায়ক্রমে
ধর্ষণ করা হয়। দুস্কৃতিকারীদের দ্বারা আক্রান্তদের নাম নি¤েœ দেয়া হলো-
১) ওয়ে থোঁয়ে ও (বয়স-৩০ বৎসর) - তাকে
শারীরিকভাবে অমানুষিক মারধোর করা হয়। তার স্ত্রী ডমে নিন (২৭) কে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ
করা হয়।
২) হং শোয়ে হ্লা- তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয় এবং তার স্ত্রী ছো মা হ্রীকে
পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করা হয়।
৩) মং ছা অং (৪০) -তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। তার বৃদ্ধা মা থাউকে
(৮০) মারধোর করা হয় এবং স্ত্রীকেও নির্যাতন করা হয়।
৪) ছা ফ্রু অং (৯০) -এই অশিতিপর বৃদ্ধাকে নির্যাতন করা হয়। তার মেয়ে নাং চিং
গুকে মারধোর করা হয় এবং তার অবিবাহিতা নাতনী চিং রাখাইনকে (২৫) দুস্কৃতিকারীরা পর্যায়ক্রমে
ধর্ষণ করে।
৫) তেজেন্দ্র বড়–য়া (ক্রামং) - তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয় এবং তার স্ত্রী হ্রা মো তুকে
পলাক্রমে ধর্ষণ করে।
৬) অং থোঁয়ে চিং (২৭) - তাকে শারীরিকভাবে অমানুষিক নির্যাতন করা হয় এবং তার সর্বস্ব
লুট করে নিয়ে যায়।
৭) আলুং (৪০) - তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। তার স্ত্রী তা ধা ওয়ানকে
(৩৫) ধর্ষণের জন্য ঝাপিয়ে ধরলে তার শিশু পুত্রটি চিৎকার করে তখন দুস্কৃতিকারীরা শিশুটিকে দা দিয়ে আঘাত করলে শিশুটি আহত হয়
এবং তা ধা ওয়ানের মাথা কেটে যায়।
৮) মা রেইন নু (১১) - তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
৯) হ্লো অং (২৮) - দুস্কৃতিকারীরা তার সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়।
১০) হ্রা মো ছু (৪৫) - দুস্কৃতিকারীরা তাকে ধর্ষণ করে এবং তার স্বামীকে অমানুষিক
নির্যাতন করে।
১১) উ মে ছিং (২৭) - স্বামী উ ওয়ে ডো - দুস্কৃতিকারীরা তাদেরকে অমানুষিক নির্যাতন করে এবং সর্বস্ব
লুট করে নিয়ে যায়।
১২) মা ঞেন্ট (৩০) - দুস্কৃতিকারীরা তার স্বামীকে অমনুষিক নির্যাতন করে এবং তাকে
পর্যায় ক্রমে ধর্ষণ করা হয়।
১৩) উমং (৪০) - দুস্কৃতিকারীদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু
তার নববিবাহিতা কন্যা মা না গুয়েকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করা করা হয়।
দুস্কৃতিকারীরা তাদের পাশবিকতা চরিতার্থ করে চলে যাবার সময় নির্যাতিতদেরকে
বার্মা চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে যায়। বাংলাদেশ ছেড়ে না গেলে পরবর্তীতে তাদের হত্যা
করা হবে বলে হুমকি দিয়ে যায়।
এই ঘটনার সময় গ্রামের নিকটতম পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দিলে অসময়ে যেতে পারবে
না বলে ফিরিয়ে দেয়। তবে দুস্কৃতিকারীরা চলে যাবার ৪ ঘন্টা পর একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে
উপস্থিত হয়। অপর দিকে নাইক্ষ্যংছড়ি বি.ডি.আর ক্যাম্পে গিয়ে আক্রান্ত গ্রামবাসীরা নিরাপত্তার
প্রার্থনা জানালে বি.ডি.আর Ñএর মেজর সাহেব তাদেরকে অন্যত্র চলে যেতে পরামর্শ দেন। অন্যথায়
নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। উক্ত গ্রামের পাহাড়িরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায়
রয়েছেন।
বর্তমানে বান্দরবান ও কক্সবাজার এলাকায়
বার্মা থেকে আগত রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী ও স্থানীয় মৌলবাদীরা সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক
হীন চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। অত্র এলাকায় এখন সংখ্যালঘুদের জান মালের নিরাপত্তার অভাব
বিরাজমান। এ মুহুর্তে সরকারের উচিত সেখানকার স্থানীয় সংখ্যালঘুদের জান-মালের নিরাপত্তা
বিধান করা। - হারবাং প্রতিনিধি কর্তৃক প্রেরিত।
-------------------------------------
পাতা: ১৫
---------
---------
সন্ত্রাসকারীরা চিহ্নিত,
নামমাত্র শাস্তি ভোগ
ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিকের ঘটনা। লংগদু বাজারের কাঁচা তরকারী বিক্রি
করতে আসে এক সহজ সরল নিরীহ পাহাড়ি। হঠাৎ সে ঠাহ্র পায়, তার থুপড়ীতে একজন সৈনিক কি যেন রেখে দিচ্ছে। পরে সে চিনতে
পেরে “বোমা বোমা” বলে চিৎকার করতে
থাকে। হাতেনাতে ধরা পড়ার পর অফিসার সৈনিকটিকে শাস্তিস্বরূপ কানে ধরে উঠাবসা করান। অথচ
ধরা না পড়লে কী যে হতো তা বলার দরকার নেই। পরদিন এ দেশের দৈনিক, সাপ্তাহিকীতে বড় বড়
হেডিং-এ খবর আসতো ‘সন্ত্রাসবাদী শান্তিবাহিনীর বোমা বিস্ফোরণে ........জন নিহত’ ইত্যাদি
ইত্যাদি। উল্লেখ্য এই একই কায়দায় ২রা ফেব্রুয়ারী লংগদুতে লঞ্চ বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো
হয়েছিল। অথচ দোষ পড়েছিল শান্তিবাহিনীর ওপর। আসলে সেনাবাহিনীরাই বর্তমানে এভাবে শান্তিবাহিনীদের
নাম দিয়ে নিজেরাই সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এটা এখন পরিস্কার যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসল
সন্ত্রাসবাদী কারা। কারা এই সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে চায়। কারা যখন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা
সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয় তখন এসব বোমাবাজি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হত্যা ঘটায়।
- বরকল থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি
পাতা: ১৬ - ১৭
------------
------------
চা ল চি ত্র
সমীরণের স্বপ্ন
তথাকথিত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কুখ্যাত দালাল সমীরণ
দেওয়ান এখন বিদেশে রাষ্ট্রদূত হবার স্বপ্নে বিভোর। ব্রিগেডিয়ার ইব্রাহীম নাকি তাকে
কথা দিয়েছিলেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানশীপ চলে গেলে তাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত বানিয়ে
পাঠিয়ে দেয়া হবে। সমীরণ নাকি এখন মহা ভাবনায় আছেন, পাছে তাকে ফিলিফাইনে রাষ্ট্রদূত
বানিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারণ এখানে নাকি কমিউনিষ্ট বিদ্রোহিদের শক্তি খুব বেশী।
-------------------------------------
গৌতমের একটি ধাপ
তথাকথিত রাংগামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান শৃগালের
ন্যায় ধূর্ত। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হবার পর তিনি বরাবরই বলতে থাকেন যে জেলা পরিষদ
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের একটি “ধাপ” মাত্র, চূড়ান্ত সমাধান নয়। এটা বলে
তিনি দু’কূল রক্ষা করার চেষ্টা করেন। প্রথমতঃ জেলা পরিষদের যারা বিরোধী তাদেরকে বুঝাতে
চান যে তিনিও এটাতে তৃপ্ত নন। অন্যদিকে সরকারকে বুঝাতে চান যে, তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা
আরো একটু বাড়িয়ে দিলে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। অথচ তিনি “স্বায়ত্তশাসন” প্রয়োজন মনে
করেন না। গৌতমের এই ধূর্তামী প্রসঙ্গে রসিকজনেরা বলেন, গৌতমের এসব নাকি গর্বাচেভীয়
কায়দায় রাজনীতি।
------------------------------------
জেরীর মহানুভবতা
বান্দরবান পার্বত্য জেলা চেয়ারম্যান চাচিংপ্রু জেরী এই তথাকথিত জেলা পরিষদের
ইতিহাসে একটা চমক সৃষ্টি করতে চান। সরকার প্রচার করে থাকেন যে, পাহাড়িদের বেলায় চাকুরীর
ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা একধাপ শিথিলযোগ্য (যদিও বাস্তব বড়ই কঠিন)। জেরী মনে করেন
এটা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অ-পাহাড়িদের প্রতি একটা বৈষম্য। তাই তিনি বিশেষ মন্ত্রণালয়ে
একটি চিঠি লিখেন এই দাবী করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অ-পাহাড়িদের ক্ষেত্রেও চাকুরীর
ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা একধাপ শিথিল করতে হবে। বিশেষ মন্ত্রণালয় তার এই দাবী কতটুকু
আমল দিয়েছেন জানা যায়নি। কিন্তু এখন জেরী সাহেব সুযোগ মত অ-পাহাড়িদের বলেন, “দেখ আমি
তোমাদের কত মহানুভবতা দেখিয়েছি। সুতরাং আগামী নির্বাচনে আবার........”
-----------------------------------------
সমীরণের গাড়ির বাহার
সমীরণের পাজেরো গাড়িটি একদা খাগড়াছড়ি বাজার ট্রাফিক জামে আটকা পড়ে। এমন
সময় আরো কয়েকটি সম-মানের পাজেরো গাড়ি তার গাড়িটির আশে-পাশে এসে থামে। তখন সমীরণ ড্রাইভারের
কাছে জিজ্ঞাসা করেন “এখানে থামানো পাজেরোর মধ্যে কোনটা বেশী ভালো?” ড্রাইভার প্রভুর
সন্তুষ্টির জন্য বলে, “স্যার আপনারটা”। সমীরণ পিকপিক করে হেসে বলেন, “ঠিক বলেছ। ঐগুলো
বাজে, দাম বেশী হলে ১২/১৪ লাখ হবে Ñ আমারটা তো ২৫ লাখ।”
-----------------------------------------
দালালদের পদত্যাগ কর্মসূচী
পাহাড়ি গণ পরিষদ ও ছাত্র পরিষদসহ সর্বস্তরের জনগণ যখন গণধিকৃত তিন পার্বত্য
জেলা পরিষদ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনেতিক সমাধানের দাবী জানাচ্ছে,
তখনই তিন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সমস্যাকে দীর্ঘায়িত করার হীন কৌশল অবলম্বন করে। এরই
অংশ হিসেবে ৭/১১/৯১ইং তিন চেয়ারম্যান এক যুক্ত ঘোষণায় তথাকথিত ১১ দফা দাবী ঘোষণা করে।
সেখানে জেলা পরিষদের ২২টি বিষয় হস্তান্তরের দাবী ছাড়াও আরো কিছু শ্রুতিমধুর দাবী ছিল।
সবচেয়ে বড় কথা, এই দাবী পূরণের জন্য সরকারকে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় সীমাও বেঁধে
দেয়া হয়েছিল, অন্যথায় পদত্যাগ। সময়সীমা অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তিন জেলা পরিষদ
চেয়ারম্যান এখনো ..........।
-----------------------------------------
নন্দিতের গুলিবিদ্ধ হবার নাটক
গত ২২শে ফেব্রুয়ারি ’৯২ নন্দিত নামের এক আত্মসমর্পনকৃত ব্যক্তিকে হত্যা
করার চেষ্টা করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে তিনি গুলিবিদ্ধ হলেও বেঁচে যান। গুলিবিদ্ধ হবার পর
নন্দিত যখন হাসপাতালের জরুরী চিকিৎসায় রয়েছেন, তখন জনৈক জেলা পরিষদ সদস্য মন্তব্য করেন, “পিস্তলটা এখন পূর্ণজ্যোতির
বাসা তল্লাশী করলে পাওয়া যাবে।” এই পূর্ণজ্যোতিও একজন জেলা পরিষদ মেম্বার, যার নিরাপত্তা
বাহিনীর সাথে দহরম-মহরম সম্পর্ক রয়েছে এবং অনেক সময় আর্মির পোশাক পড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর
সাথে অপারেশনে গিয়ে নিরীহ লোক ধরে নিয়ে আসে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
----------------------------------------
কুখ্যাত হেডম্যান দীপংকরের কারসাজী
দীঘিনালার কুখ্যাত হেডম্যান দীপংকরের দৌরাত্ম্যে দীঘিনালার নিরীহ জনসাধারণ
অতিষ্ঠ। তিনি এখন একটা চমৎকার ব্যবসা আরম্ভ করেছেন। ব্যবসাটা হলো নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের
হাতে যে কোন নিরীহ লোককে “শান্তিবাহিনী” বলে ধরিয়ে দেয়া এবং গ্রেফতারকৃতদের ছাড়িয়ে
আনার আশ্বাস দিয়ে মোটা অংকের ঘুষ (যা ৫০ হাজার টাকার নীচে নয়) আদায় করা। যারা এই মোটা
অংকের ঘুষ দিতে না পারবেন তারা রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর শ্রীঘরে
থাকবেন। এই অংক তার সাথে গ্রেফতারকারীর আনুপাতিক হারে ভাগ হয়। তার এই পুঁজি ছাড়া ব্যবসায়
তিনি যে দাপট দেখাচ্ছেন তাতে ওখানে তাকে উপাধি দেয়া হয়েছে 2-I.C
অর্থাৎ ব্রিগেডিয়ার
সাহেবের নীচের র্যাংক। এভাবে মোটা অংকের ঘুষ নেয়ার সময় স্বয়ং D.G.F.I.এর জনৈক
ক্যাপ্টেনের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়লেও ক্যান্টম্যান্ট থেকে টেলিফোন আসার কারণে এই কুখ্যাত
দীপংকরকে গ্রেফতার করতে পারেন নি। সেদিন থেকে দীপংকর তার 2-I.C -র দাপট
আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
----------------------------------------
ছেলের জীবনের দাম এক হাজার টাকা
গত ৫/১/৯২ইং পানছড়ি জোন-এর C. O. সাহেব পানছড়ি থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। খুব দ্রুত
বেগে চলছিল তার গাড়িটি। গুইমারার লুনধুক্যা গ্রামে এসে হঠাৎ তার চলমান গাড়িটি গংরী মারমা নামে তের বছরের এক বালককে চাপা দিয়ে চলে
যায়। এতে বালকটি সংগে সংগে মারা যায়। পরদিন গুইমারা জোন-এর অধিনায়ক বেদনাহত পিতা কংজ
মারমাকে ছেলের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক হাজার টাকা প্রদান করেন।
-----------------------------------------
তোমাকে গুলি করলেও . . .
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক পাহাড়ি ছাত্র তার বড় ভাইকে ছাড়িয়ে আনার
জন্য গত ১৯ শে ফেব্রুয়ারি বগাছড়ি আর্মি ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। সেখানে আলাপের এক পর্যায়ে
ক্যাম্প কমাণ্ডার মেজর গাজী ফিরোজ তাকে হুমকি দিয়ে বলেন, “তোমার মত ছেলেকে বাড়িতে গিয়ে
গুলি করে হত্যা করলেও এই মেজর ফিরোজ -এর কিচ্ছু হবে না।” গাজী ফিরোজ আরো বলেন, “সরকার আমাদের
যেটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, তার এক বিন্দুও আমরা ব্যবহার করছি না। যেকোন লোককে গুলি করে
মারার ক্ষমতা আমাদের আছে।”
------------------------------------------
এগুলো ধরতেও লজ্জা করে
পার্বত্য চট্টগ্রামে রাডার একটি পাঠক সমাদৃত পত্রিকা। গত বিজয় দিবস সংখ্যার
একটি কপি নানিয়াচর জোন-এর কমাণ্ডিং অফিসার ওয়াকিব মিঞার হাতে পড়লে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যান দুর্বাশামনিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এগুলোতো (রাডার উচিয়ে ধরে) ধরতেও লজ্জা
করে। চেয়ারম্যান সাহেব, ছেলেরা এসব কি লেখে ?”
-----------------------------------------
তুমি জুম্মল্যাণ্ড থেকে এসেছ
নানিয়াচর জোন -এর কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল ওয়াকিব মিঞা জনৈক পাহাড়িকে
প্রশ্ন করেন, “তুমি কোন দেশ থেকে এসেছো ?” উক্ত ব্যক্তি উত্তরে বলেন, “কেন স্যার, বাংলাদেশ
থেকে।” এর পর C.O. সাহেব হোঃ হোঃ করে হেসে বললেন, “না, না, তুমিতো জুম্মল্যা- থেকে এসেছো।”
লোকটি কোনকিছু না বুঝে বললো, ‘হ্যাঁ স্যার, আমি জুম কাটি।’ C.O. সাহেব তাকে আবার
বললেন, “না, না, জুম কাটা নয়। ঐ যে শান্তিবাহিনীরা জুম্মল্যাণ্ড চায়, তুমি সেই জুম্মল্যাণ্ড
থেকেই এসেছো।”
------------------------------------------
গরুও গেলো, শাস্তিও পেলো
তিনি শীলছড়ি সাম্রাজ্যের অধিপতি মেজর আরফিন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিনা
পয়সায় গরু ক্রয় করে গোমাংস ভক্ষণ করতে অভ্যস্ত। যেন “সিংহ আমি বনের রাজা”। অবশেষে জানুয়ারী
২৭ তারিখে এলো শাক্য সিংহ তালুকদারের কপাল ভাংগার পালা। একটা গরু দিতে হবে স¤্রাটকে। অগত্যা
অনুরোধ “বেছে নিন স্যার”। কিন্তু দুর্ভাগ্যে, একমাত্র হালের জোড়ার একটিই মনপুতঃ হলো
স্যারের। বিনয়ের সাথে হাত জোড় করে শাক্য সিংহ বললেন, “স্যার, এটি আমার হালের জোড়া
. . . . স্যার। অন্য একটি বেছে নিন, স্যার।” অতঃপর এই কথা বলার পুরস্কার বেধড়ক শারীরিক
অত্যাচার, শুধু অত্যাচার এবং পানিতে ডুবিয়ে অত্যাচার। তারপর বীরবেশে বীরপুত্র মেজর
আরফিনের পছন্দসই সেই গরুটি নিয়ে প্রস্থান।
--------------------------------------
দাদা ডাকাতে . . . . . . . . . .
সেদিন ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ৯২ইং। ইউ,পি নির্বাচনের দিন। জুড়াছড়ি উপজেলার বেগেনাছড়ি
আর্মি ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন হায়দার তার দল বল নিয়ে টহলদানে রত। এমন সময় একটি নৌকা তাদের
টহলযানের মুখোমুখি হলে ক্যাপ্টেন হায়দার কয়েকজন ছাত্রের সাথে কথা বলেন। বরকল -এর একজন ছাত্র
তাকে “দাদা” বলে সম্বোধন করে। দাদা ডাকাতে ক্যাপ্টেন সাহেব নিজেকে অপমানিত বোধ করলেন
এবং ছেলেটিকে আচ্ছাভাবে চার্জ করতে লাগলেন। পরে ক্যাপ্টেন সাহেব ছেলেটিকে সতর্ক করে
দিয়ে বলেন সে ভবিষ্যতে যেন আর কোন আর্মিকে “দাদা” বলে সম্বোধন না করে। হায়দার সাহেব
আরো বলেন, “বরকলে তোমাদের মত ছেলেদের ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে,
কাজেই সাবধান।”
-------------------------------------
লেঃ কর্ণেল ইকবালের কৃষি ঋণ বন্টন
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বরকল শাখায় গত ১/৩/৯২ইং থেকে প্রকৃত কৃষকদের জন্য
বোরো মৌসুমের ঋণ বিতরণ শুরু হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ব্যাংকের ঋণ বিতরণের নিয়ম কানুন
লংঘন করে প্রকৃত বোরো মৌসুমের পাহাড়ি চাষীদের বঞ্চিত করে শুধুমাত্র পছন্দই এবং মুসলিম
বাঙালি অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে লেঃ কর্ণেল ইকবাল কর্তৃক কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়।
------------------------------------
বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান করতে
পারবে না কারণ . . . . .
গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বান্দরবান জেলায় নব নির্মিত স্থানীয় সরকার
পরিষদের অফিস উদ্বোধন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান বি,এন,পি
সরকারের মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল (অবঃ) অলি আহম্মদ। তার ভাষণে প্রধান অতিথি বলেন,
“অশান্ত পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা বর্তমান সরকার সমাধান করতে পারবে না। কারণ পার্বত্যবাসীরা
বর্তমান বি,এন,পি সরকারকে বিগত সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয় নাই। তারা ভোট দিয়েছে আওয়ামী
লীগকে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা অব্যাহত থাকবেই। “প্রধান অতিথির কাছ থেকে এ কথা
শুনে জনগণের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার
পরিষদের চেয়ারম্যান সাচিংপ্রু জেরী, ম্যামাচিং এম,পি, প্রমুখ।
------------------------------------
পাতা: ১৮ - ২১
----------
----------
প্রচ্ছদ বক্তব্য
আজকের
পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার তাৎপর্য ও
ছাত্র
সমাজের দায়-দায়িত্ব
----------------- মিঃ গণমুক্তি
সুদীর্ঘকাল থেকে শিক্ষানবীশদের শোনানো হয়েছে বহু বিশ্রুত শাস্ত্র বাক্য,
“ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ”। সংস্কৃতের অমর বাণী। গুরুজনদের প্রিয় মন্ত্র। যার অর্থ অধ্যয়নই
ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা। শিক্ষার্থীদেরকে আজো গুরুজনদের কাছ থেকে এই উপদেশ শুনতে হয়।
এমন এক সময় ছিল যেকালে শাস্ত্র অধ্যয়নকে শিক্ষার্থীরা তপস্যা হিসেবে ধরে
নিতে পারতো। তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতটা উন্নতি হয়নি। সেকালে পুঁথিপুস্তক ছিল হাতে গোনা।
সেসবই ছিল সে যুগের মনীষীদের চিন্তার ফসল। সেই গুটি কয়েক পুঁথিতে শিষ্যরা নিজেদের মগ্ন
রাখতে পারতো। অন্যকিছুতে তাদের মাথা ঘামাবার দরকার পড়তো না। সেকালে সে ধরনের পরিস্থিতিও
ছিল না। মানুষের আর্থিক অবস্থা ছিল স্বচ্ছল। জীবন-ধারন ছিল সহজ সরল। কাজেই গুরুগৃহে
থেকে শিক্ষার্থীরা নির্ঞ্চাটে বিদ্যা চর্চ্চা করতে পারতো।
তবে, সে যুগেও কেবল শাস্ত্র চর্চ্চাই হতো না। ক্ষত্রিয়দেরকে শাস্ত্রের
সাথে অস্ত্রের চর্চ্চা করতে হতো। কারণ সে যুগে যুদ্ধ বিগ্রহে পারদর্শী না হলে কারোর
পক্ষে রাজ্য শাসন সম্ভব ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষত্রিয় বা রাজন্যবর্গকে বিদ্যাচর্চ্চার
পাশাপাশি শাসনকার্যের কলাকৌশলও রপ্ত করতে হতো। সেকালে রাজা-রাজরাই ছিল সবকিছুর নিয়ন্তা।
প্রজাদের উপর রাজত্ব করা ছিল তাদের একচ্ছত্র অধিকার। শাসনকার্য ছিল সাধারণ প্রজাবর্গের
কাছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাজেই তাদের সন্তানদের ক্ষত্রিয়দের মতো অস্ত্র শিক্ষা কিংবা
শাসনকার্য সম্পর্কে জানার-শেখার প্রয়োজন পড়তো না। রাজ্য জাহান্নামে গেলেও তাদের কিছু
করার থাকতো না। অল্প বিস্তর যে বিদ্যা চর্চ্চার সুযোগ হতো, তাকে তপস্যা জ্ঞান করতো।
কালের আবর্তে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। সেকালের সাথে আজকের ব্যবধান আকাশ-পাতাল।
সমাজ ব্যবস্থা এখন বহু জটিল। জীবন-জীবিকা অনেক কঠিন। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে মানুষকে
বেঁচে থাকার আয়োজন করতে হচ্ছে। বিশেষতঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জীবন মানেই সংগ্রাম,
বেঁচে থাকা মানে লড়াই করা। দুনিয়ায় এখন মুহুর্তে মুহুর্তে অনেক কিছু ঘটছে। নিত্য-নতুনের
উদ্ভব হচ্ছে, আবিস্কার হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগৎ এখন আর আগের
মত সংকুচিত নয়। এর পরিধি এখন অনেক বেশী বিস্তৃত ও ব্যাপক।
এযুগে তাই শিক্ষা কিংবা বিদ্যাচর্চ্চাকে মান্ধতা আমলের নিরীখে বিচার করার
অবকাশ নেই। কিন্তু এখনও অনেকে সেকেলে ভাবধারায় আচ্ছন্ন। সংস্কৃতের সেই পুরানো শাস্ত্র
বাক্যকে আঁকড়ে থেকে ভুল অপব্যাখ্যা করছে। ফলে অনেকে ছাত্রদেরকে সংকীর্ণ গ-িতে আবদ্ধ
রাখতে চান। বিদ্যাচর্চ্চা বলতে বুঝেন শুধুমাত্র সিলেবাস নির্ধারিত পুঁথিপুস্তক মশগুল
থাকা। বাইরের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে ছাত্রদের যে পরিচয় হবার দরকার আছে, তা তারা
বুঝতে চান না।
বর্তমান দিনে শিক্ষার অর্থ শুধু পুঁথিপুস্তক গলাধঃকরণ করা নয়। দুনিয়ার
ঘটনাবলী থেকে চোখ বুঝে থাকা নয়। আবদ্ধ রুমে চোখ-কান বন্ধ করে বিদ্যাচর্চ্চার অর্থই
শিক্ষা নয়।
আজকের দিনে আধুনিক চিন্তা-চেতনা থেকে দূরে থেকে, সংকীর্ণ গ-িতে আবদ্ধ
থেকে প্রকৃত অর্থে ছাত্রদের শিক্ষিত হওয়া কিংবা বিদ্যার্চ্চা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক
গলাধঃকরণ করে ছাত্রদের অনুসন্ধানী মনের প্রশ্ন মিটতে পারে না, সৃষ্টিশীল প্রতিভারও
বিকাশ হতে পারে না।
চিন্তা-চেতনায় সাবালক হিসেবে গড়ে উঠার জন্য ছাত্রদেরকে অবশ্যই উন্নত আদর্শের
সংস্পর্শে আসতে হবে। উন্নত চিন্তা-ভাবনার সাথে পরিচয় হয়ে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিজেদের
জড়িয়ে পড়ার দরকার আছে।
আগেকার দিনে নানান সীমাবদ্ধতার কারণে শিক্ষার পরিধিকে সীমিত গণ্ডিতে দেখা
হতো। উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী মানুষের সেকেলে ধারণাকে বদ্ধমূল করে দেবার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
তার কারণও ছিল।
এদেশে উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল
যতটা না জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে, তার চাইতে বেশী নিজেদের প্রয়োজনে। সাত সমুদ্র তের
নদী পেরিয়ে এসে এদেশকে শাসন করতে তারা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেনি। তাই তাদের শাসনকার্যে
সহায়তা দেবার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কিছু মাঝারী শিক্ষিত লোক। যাদের দিয়ে সাহেবদের
কেরাণী কাজ করানো যাবে। যাদেরকে অল্প মাইনে দিয়ে অনেক বেশী কাজ করানো যাবে, অধিক লোক
নিয়োগ করা যাবে। আসলে ব্রিটিশরা যত কথাই বলুক, তারা এদেশে কেরাণী তৈরীর শিক্ষা ব্যবস্থাই
প্রবর্তন করে গিয়েছে। উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা এমন ছিল যাতে শিক্ষার্থীরা পুঁথিপুস্তকের
বাইরে অন্য কিছু ভাবতে না পারে, সীমিত গ-ীর বাইরে অন্যকিছু করতে না পারে। কারণ ছাত্ররা
যদি উন্নত মতাদর্শের সংস্পর্শে এসে সচেতন হয়, শাসকগোষ্ঠীর সুক্ষ¥ ষড়যন্ত্র বুঝে
ফেলে, তাহলে তারা আর মানুষকে ইচ্ছে মতন শোষণ করতে পারবে না। ছাত্র, তরুণ অন্যায়-অবিচারের
বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। তাই উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার ধরন এমন ছিল যাতে শিক্ষার্থীদের
মনে এমন ধারণা দেয়া হতো যে - পড়ালেখা করার উদ্দেশ্য সাহেবদের অধীনে একটা কেরাণী
চাকরী পাওয়া। তাই ছাত্রদের অন্যতম কর্তব্য প্রশাসকদের একান্ত অনুগত-বাধ্যগত হওয়া। ছাত্ররা
এর ব্যতিক্রম কিছু চিন্তা-ভাবনা লালন পালন করলে কিংবা দেশের ভালোমন্দ সম্পর্কে মাথা
ঘামলে সে সব ছাত্রের সরকারী চাকরী জুটতো না। সরকারী চাকরীর লোভ দেখিয়ে ছাত্রদেরকে দমিয়ে
রাখতো। দেশের ভালোমন্দ সম্পর্কে এবং চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে যাতে ছাত্রদের কোন আগ্রহ
সৃষ্টি না হয়, এমন কি সমাজ-জাতি রসাতলে গেলেও যাতে ছাত্ররা খবর না রাখে, নির্বিকার
ও উদাসীন থেক, নিজেরা যাতে সংগঠিত হতে না পারে, শাসক গোষ্ঠীর দুঃশাসন নিয়ে যাতে মাথা
না ঘামায় সে ব্যবস্থাই করা হতো।
এভাবে ছাত্রদেরকে দেশের ও সমাজের সমস্যা জানতে না দিয়ে যদি দূরে সরিয়ে
রাখা যায়, তাহলে শাসকগোষ্ঠীর লাভ। তারা ছলে-বলে-কৌশলে সেটাই করতে চাইতো।
হাল আমলেও সেই উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। গোটা দেশে
তো বটেই বিশেষতঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক ভূ-খন্ডের অবস্থা আরো করুণ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ যে এদেশের নাগরিক, পাহাড়ি শিক্ষার্থীরাও যে
এদেশের ছাত্র, প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীরা মনে হয় তা স্বীকার করতে চান না। তা না হলে,
একটা স্বাধীন দেশে কেন বৈষম্য সৃষ্টি করা হবে ? কেন উপনিবেশিক কায়দায় শাসন-শোষণ চালানো
হবে ? পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজকে উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার বেড়াজালে আবদ্ধ
রাখার হেতু কি ?
ছাত্রসমাজকে যদি সমাজের ভবিষ্যত, জাতির মেরুদ- মনে করা হয়ে থাকে তাহলে
পাহাড়ি ছাত্র সমাজকে কেন ছলে-বলে-কৌশলে দাবিয়ে রাখা হবে ? কেন তারা অন্যান্য অঞ্চলের
ছাত্রদের মতো মুক্তবুদ্ধি চর্চ্চা করতে পারছে না ? চিন্তা-চেতনা ও সৃজনশীল প্রতিভা
বিকাশের কোন সুযোগ কেন তারা পাচ্ছে না ?
অথচ বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে বলে বিস্তর প্রচার
করা হচ্ছে। ছাত্রদেরকে অন্য কিছুতে মাথা না ঘামিয়ে শান্ত-শিষ্ট সুবোধ ছেলে হবার উপদেশ
দেয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র বিদ্যা চর্চ্চায় মনোনিবেশ করতে বলা হচ্ছে। আশে-পাশের মানুষ মরল
কি বাঁচল, তাতে কান না দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ চিন্তায় মশগুল থাকতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামে যে পরিস্থিতি তাতে কেউই স্বাভাবিক কার্যক্রম
চালাতে পারছেনা। নিশ্চিন্তে-নির্বিঘ্নে বিদ্যাচর্চ্চার প্রশ্ন তো আসতেই পারে না। স্কুল, কলেজ,
বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা যেখানেই পাহাড়ি ছাত্ররা পড়ালেখা করছে কোথাও তারা স্বস্তিতে থাকতে
পারছে না। প্রতিনিয়ত আতংকে ভুগছে। তাদের এক বুক আশংকা, কখন জানি কি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম
যেন এক জ¦লন্ত আগ্নেয়গিরি।
যে স্কুল কলেজের ছাত্ররা পার্বত্য চট্টগ্রামে পড়ালেখা করছে, তারা তো প্রত্যক্ষ
ভুক্তভোগী। নিশ্চিন্তে বিদ্যা চর্চ্চার কোন সুযোগই তাদের নেই। বিপুল আগ্রহ ও মনোযোগ
নিয়ে কোন শিক্ষার্থী যখন পড়তে বসে, তখন সে মরা কান্না শুনতে পায়। ভয়াল আর্তচিৎকারে গা শিউরে উঠে, এলাকা কেঁপে উঠে। তখন তার তো পড়ায়
মন বসার প্রশ্ন উঠে না। অথবা পড়তে বসে যদি অনুপ্রবেশকারীরা তাদের বাড়িতে আগুন লাগাতে
ছুটে আসে, বাড়ির লোকজনকে খুন করতে দা, খন্তা, কুড়াল,বর্শা প্রভৃতি ধারালো অস্ত্র নিয়ে
ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন সেই পরিবেশে প্রাণ না বাঁচিয়ে অন্য কিছুতে মনোযোগ দেবার কথা উঠতে
পারে না।
দাঙ্গা-হাঙ্গামার
ভয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। লোকালয় থেকে দূরে গহীন
অরণ্যে আশ্রয় নিতে হয়। ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সহায়-সম্পত্তি লুটপাট করে নেয়া হয়।
নিজ বাসভূমে আর ফিরে আসতে পারে না। সেভাবে পানছড়ি,দীঘিনালা,ফেনী,ভূষণছড়া,বরকল ও জুড়াছড়ির
লোকজন ফিরে আসতে পারেনি। সে সব ঘটনার শিকার ছেলেদের কাছে শিক্ষা জীবনই দুর্লভ বস্তু।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন শান্তিবাহিনী তল্লাশীর নামে গ্রামে গ্রামে অপারেশন
চালানো হয়, বাড়ি বাড়ি তল্লাশী করে নিরীহ লোকজনদের নির্বিচারে মারধোর করা হয়, নিজেদের
চোখের সামনে মা-বোনদের পাশবিক অত্যাচার করা হয়, পড়–য়া ছাত্রদের ধরে নিয়ে ক্যাম্পে কুলীর
কাজ করানো হয়, কখনো কখনো ক্যাম্পের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ঢুকিয়ে রাখা হয় মাসের পর মাস,
বাড়িতে ঢুকে পড়–য়া ছাত্রদের বইপত্র, পরীক্ষার নোটপত্র সরকার বিরোধী, আপত্তিকর ইত্যাদি
নানান অজুহাতে পুড়িয়ে দেয়া হয় - সেই পরিস্থিতিতে তাদের মনে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে
? উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কারোর পক্ষে নির্বিকার-উদাসীন থাকা সম্ভব নয়, ছাত্রদের তো নয়ই।
ছাত্র তরুণরা হচ্ছে দেশের জনশক্তির সবচেয়ে সচেতন ও অগ্রসর অংশ। সমাজের
বড় শক্তি। যখনই দেশ দুঃশাসনে কবলিত হয় তখনই ছাত্ররা তার প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিশ্বের
দেশে দেশে ছাত্ররা তাদের ইতিহাস নির্ধারিত পথে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজেরও
রয়েছে গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা। ৫২ সাল থেকে ৬৯ -এর গণঅভ্যুত্থান এবং সাম্প্রতিক কালের স্বৈরশাসন
পতনে ছাত্ররা সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। স্বৈরশাসন যখন দেশকে গ্রাস করে ধ্বংসের
দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, সেদিন ছাত্ররা ক্যাম্পাসে নির্বিকারভাবে বইপুস্তক হাতে বসে থাকতে
পারেনি। ধ্বংস ও অনাচারের প্রতিবাদে ছাত্ররা শত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজপথে বেরিয়ে
এসেছিল। প্রতিবাদ বিক্ষোভে রাজপথ মাতিয়ে তুলেছিল, স্বৈরশাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
অবশেষে স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়েছিল। সেদিন সেটাই ছিল ছাত্রদের ইতিহাস নির্ধারিত কর্তব্য।
আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামেও যে অন্যায় অবিচার চলছে, তাতে ছাত্ররা যদি
সমাজ-জাতি সম্পর্কে ধারণা না রাখে, জাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে না ভাবে, মানুষের দুঃখ দুর্দশার
খবর না রাখে, তাহলে সমাজ তাদের উপর কি ভরসা রাখবে ? সমাজের ভবিষ্যত কর্ণধার হিসেবে
তাদেরকে বিদ্যাচর্চ্চার পাশাপাশি অবশ্যই জনগণকে দুঃখ-দুর্দশা থেকে উদ্ধারের পথ খুজে
বের করতে হবে। তার জন্য যদি পড়ালেখার পাশাাপাশি আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয় - তাহলে তাদেরকে
তাই করতে হবে। যদি রাজনীতির চর্চ্চা করতে হয় - তাহলে সেটাই করতে হবে। পুরানো সেকেলে ভাবধারায় আচ্ছন্ন
হয়ে এখন আর ছাত্রদের ঝিমিয়ে থাকার সময় নেই।
প্রায়ই বলা হয়ে থাকে “ছাত্ররা সমাজের ভবিষ্যত”, “দেশের কর্ণধার”। কিন্তু
দেশ ধ্বংস হলে, জাতির সর্বনাশ হলে Ñ ছাত্ররা কার ভবিষ্যত হবে
? কার কর্ণধার হবে ?
তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
সত্যিকার অর্থে সমাজের কর্ণধার হতে হলে এখন থেকে প্রস্তুত হতে হবে। কারণ, মানুষ নতুনদের
ঘিরে প্রত্যাশা করে। আগামী দিনের স্বপ্ন দেখে।
চীনের জনক মাও সেতুঙ ১৯৫৭ সনে শিক্ষানবীশ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে চমৎকারভাবে বলেছিলেন - “পৃথিবীটা তোমাদের
এবং আমাদেরও, কিন্তু অবশেষে তোমাদেরই। তোমরা যুবক, সজীব ও প্রাণশক্তিতে উচ্ছল, জীবনের
স্ফুটনোস্মুখ অবস্থায়, সকালবেলার আটটা-নয়টার সূর্যের মতো। তোমাদের উপরেই আশা রাখি”।
....................................
পাতা: ১৯
--------
--------
আমরা শোকাহত
স্বাধীকারহারা ভাগ্যবঞ্চিত জুম্ম জনগণের
মুক্তি সংগ্রামে যে ছিল নিবেদিত প্রাণ,
মৃত্যুহীন তারুণ্যের মহাশক্তিতে
যে ভাঙতে চেয়েছিল জরাগ্রস্ত এ সমাজ,
সুবিধাবাদী পদলেহী দালালদের যে ঘৃণা
করেছিল আজন্ম,
অন্যায়-অত্যাচার আর নিপীড়ন নির্যাতনের
বিরুদ্ধে
যে ছিল বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ----
মিছিলের চেনামুখ,
যার দৃপ্ত পদভারে কেঁপেছিল রাজপথ
----
সে একটি অগ্নি স্ফুলিঙ্গের নাম
সজীব খীসা। সে আজ আর আমাদের মাঝে নেই।
গত ১২ই জানুয়ারী ৯২ইং, শুক্রবার, রাত পৌনে বারটায় দিঘীনালার বাবুছড়া গ্রামে
শচীন্দ্র লাল খীসাকে পুত্র শোকে মুহ্যমান করে সজীব খীসা ১৯ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে হারিয়ে
যায়। সে খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের একজন মেধাবী ছাত্র। তার অকাল মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।
পাতা: ২০
--------
--------
প্রতিবাদের অগ্নিশিখা
হ’য়ে জ্বলে উঠুক এ তারুণ্য
মিঃ সুপ্রিয়
কারাগারের সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠে আঠকে গেছে ছয়টি শ্লোগান। আঘাতে আঘাতে দুঃশাসন
গুড়িয়ে দেবার মত অমিততেজী তারুণ্যের সেই শ্লোগান। সতেরই ফেব্রুয়ারী রাজধানীর পীচ ঢালা
পথে টি,এস,সি, অপরাজেয় বাংলা থেকে পান্থপথ অবধি সেই শ্লোগান কাঁপিয়েছে ঢাকার মুক্ত
আকাশ। পার্বত্য এলাকায় ভূতের মত জেকে বসা জলপাই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে
মিছিলে এসেছিল তারা। লক্ষ নিপীড়িতের অব্যক্ত বেদনার ভাষা বলতে চেয়েছে তারা এদেশের কোটি
মেহনতি মানুষের কাছে। সকল প্রকার নাগরিক অধিকার নিয়ে গণতন্ত্রকে ঐ শৈলচত্বরব্যাপী বিস্তৃত
করতে চায় তারা। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই সংসদীয় গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তুলতে অবিচ্ছেদ্য
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অঘোষিত সামরিক শাসনের অবসান চেয়েছে তারা। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক
রূপ দেয়ার সংগ্রামে তাদের এ আন্দোলন একটি অন্যতম শক্তি নিঃসন্দেহে।
অথচ হায় নির্লজ্জ উর্দী সাম্রাজ্য। ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ৭৫ জন ছাত্র-ছাত্রীকে
মানিকছড়ি ক্যাম্পে আটকে রেখে তামাসা তামাসা খেলা খেললো তারা। অতঃপর দেশে প্রচলিত আইনের
কোনরূপ তোয়াক্কা না করেই চল্লিশ ঘন্টার পর থানা হাজতে সোপর্দ করে তারা হয়ে গেলো ধোয়া
তুলসী পাতা। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ও,সি, খালেদ ভাই অস্বস্থিতে পড়ে যান। কিন্তু
না, থানা কর্তৃপক্ষকে নেংটি ইঁদুরের মত অনায়াসে বাধ্য করালো ছয়জন ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে
রাষ্ট্রদ্রোহীতার জঘন্য মিথ্যা মামলা সাজাতে। সাবাস নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ। সাবাস ! কি
বিচিত্র এ দেশ, মানুষ। জগৎ দেখলো না কি সহজ বেহায়াপনা। আর্ন্তাজাতিক ভাবমূর্তি সম্পন্ন এ দেশের সার্বভোমত্ব
রক্ষায় নিবেদিত-প্রাণ কর্মীরা অবশ্যই জনগণের অংশ। এ বাহিনী এখন আর শিশু নয়। তারা এখন
দক্ষ, সমর্থ ও সুশৃংখল বাহিনী - এতে আমাদের দ্বিমত নেই। দ্বিমত সেখানেই, যখন তারা দেশ রক্ষার
নামে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে প্রশাসনকে বগলদাবা করেন। সন্ত্রাস
দমনের নামে নিরীহ মানুষকে অত্যাচার করেন। বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে জিম্মি করে রাখেন অবাধে।
তবে আমরা নিশ্চিত জানি ঐ সাজানো অভিযোগে কারারুদ্ধ তরুণরা আগ্নেয় লাভায়
জ্বলে উঠবে নিয়ত। ঐ লৌহ কপাট দিয়ে তারুণ্যকে আটকে রাখা হাস্যকর। গণতান্ত্রিক অধিকারকে
শৃংখলাবদ্ধ করা নিন্দনীয়। এর চেয়ে লজ্জাকর রাষ্ট্রদ্রোহীতার মিথ্যা মামলা ঠুকিয়ে দেবার
অরাজকতা। এটি আইনশৃংখলা রক্ষার নামে ভাওতাবাজী। সংবিধান পরিপন্থি অপশাসন মাত্র। আমরা
এ নোংরামীর প্রাণঢালা ঘৃণা করি। প্রতিবাদ জানাই আমৃত্যু। দ্রুত অবসান দেখতে চাই এ ক্ষুদ্র
প্রিয় রাজ্যের যত্তোসব নৈরাজ্যের।
পাতা: ২১
---------
---------
জাগো জনতা, গড়ো প্রতিরোধ
- মিঃ চাইলা অং
অনেক হারিয়েছি আমরা। ভিটেমাটি, জায়গা-জমি, আত্মীয়-স্বজন, মান-ইজ্জত একে
একে সব কেড়ে নেয়া হয়েছে আমাদের। এখন জাতীয় অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার
কেড়ে নিতে উদ্যত হয়েছে কিছু অশুভ দানব। সেই ষাট দশক থেকেই হারানোর বিষাদময় ইতিহাসের
শুরু। কাপ্তাই বাঁধের উল্লাসী রাক্ষুসী নীল জল সেদিন ছলাৎ ছলাৎ করে পাহাড়িদের ঘরবাড়ি জায়গা-জমি গ্রাস করে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল।
স্তব্ধ করেছিল সেদিন আনন্দ-কোলাহলপূর্ণ নয়নাভিরাম সবুজ পাহাড়ি জনপদ। ছন্নছাড়া, দেশছাড়া
হয়েছিল সেদিন আমাদের অনেকেই। তারপর সেই হারানোর ধারাবাহিকতায় আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি
অস্তিত্ব বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
এই দীর্ঘ সময় আমরা অনেক অসহনীয় অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার হিমালয়
বয়েছি। অনেক দঃসহ ভয়াল কালোরাত পেরিয়েছি এতকাল। অত্যাচারীর চাবুকের আঘাতে পিঠের ছাল
উঠে গেলেও নীরবে সহ্য করেছি আমরা। নিজের চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি কেড়ে নিলেও কোনো প্রতিবাদ
করিনি। দ্বগ্ধ বুকে হজম করেছি শোভা, অঞ্জলি, বটুদের ইজ্জত হারানোর করুণ আর্তনাদ।
আমরা মুহুর্তের মধ্যে আমাদের বিস্তীর্ণ জনাকীর্ণ জনপদগুলো শ্মশান হয়ে
যেতে দেখেছি। চোখের সামনে নিজের মা-বোনকে ধর্ষণ করার কুৎসিত রূপ দেখেছি। অসুরদের রক্তনেশা মেটাতে
পশুর মত হাজার হাজার পাহাড়ি নরনারীকে জবাই করতে দেখেছি। আর দেখেছি দানবীয় হিং¯্রতায় উম্মত্ত হয়ে ফুলের মতো নিষ্পাপ
শিশুদের গলা টিপে হত্যা করে উল্লসিত হতে। স্মরণাতীত কাল হতে সবুজ পাহাড়িয়া প্রকৃতি
মাতার কোলে বেড়ে ওঠা এ জনপদের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের নিশ্চিহ্ন করতে সর্বশক্তি দিয়ে উঠে
পড়ে লেগেছে একটি অশুভ শক্তি।
আমরা এখনো দেখি তথাকথিত কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সির নগ্ন নখরাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত
হতে জনজীবন। এখনো প্রতিনিয়ত দেখি অশুভ শক্তির লাগামহীন দৌরাত্ম্য আর দান্তিক পদচারণা।
দেখি ভ- জনদরদী পদলেহীদের চক্ষুলজ্জাহীন উলঙ্গ বেহায়াপনা। আমরা এখানে প্রতিমুহুর্তে মৃত্যুর সাথে
খেলা করে বেঁচে আছি। আমরা প্রতি পাঁচ জনে পেয়েছি একজন স্বশস্ত্র রক্ষাকর্তা - আমাদের জীবন মরণের মালিক। এখানে নিষিদ্ধ
ঘোষিত হয়েছে আমাদের মুক্ত বিচরণ। মানবাধিকার এখানে বুটের তলায় পিষ্ঠ। আর চিতাউর্দীর
পকেটেই যাবতীয় আইন-কানুন, বিধি-বিধান।
আমরা অনেক সহ্য করেছি। এবার নতুন করে জেগে উঠতে হবে। নতুন করে গড়তে হবে
সবকিছু। হারানোর আর কোন ভয় নেই। স্বপ্ন আছে স্বাধীন মুক্ত জীবন ফিরে পাবার। যে ঘর জ্বলে
পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তা আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। ফিরে পেতে হবে সেই কোলাহলপূর্ণ
স্বর্গীয় জীবন। যতসব অন্যায়-অত্যাচার-শোষণ-উৎপীড়ন ভাসিয়ে
নিয়ে ফেলে দিতে হবে বঙ্গোপসাগরে।
আজ তাই হতে হবে সংগঠিত, গড়তে হবে দৃঢ় ও লৌহকঠিন ঐক্য। ঐক্য মানেই শক্তি।
সমগ্র পাহাড়ি জনগণের দৃঢ়তার ঐক্য মানেই এক দুর্জয় মহাশক্তি। এই মহাশক্তি রোধে কারোর
সাধ্য নেই। জনতার এই মহাশক্তি দিয়েই সমস্ত অশুভ শক্তিকে চিরতরে ধূলিস্যাৎ করতে হবে। আর কালক্ষেপণ নয়। দিকে দিকে
এই ঐক্যশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে প্রতিরোধ সংগ্রামে। লক্ষ মানুষের
প্রতিবাদের দুর্বার তেজী ¯্রােত বয়ে দিতে হবে সারা চট্টলায়। জাগো জনতা, গড়ো প্রতিরোধ।
পাতা: ২২ - ২৩
-------------
-------------
দি
কেস অব পলিটিক্যাল মাইগ্রেসন ইন দ্যা হিল ট্র্যক্টস
- দিমিতির
জাতিগত সমস্যা/দ্বন্দ্ব (Ethnic Conflict)) বর্তমানে বিশ্ব ব্যবস্থার
একটি অন্যতম রূপ। জাতি গঠন বা রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া কখনো সহজ, সরল পথে এগোয়নি। প্রথম
বিশ্ব থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্ব পর্যন্ত এই সমস্যা পরিব্যপ্ত। সাম্প্রতিককালে সোভিয়েত
ইউনিয়ন এবং যুগোশ্লাভিয়ার ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করেছে কম্যুনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র
ব্যবস্থায়ও জাতিগত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অন্যদিকে উদারনৈতিক রাজনীতির ধ্বজাধারী
বৃটেনেও এ সমস্যা বিদ্যামান। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ সমস্যা আরো প্রকট। এ ক্ষেত্রে
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ সমস্যা কেন ? এর প্রকৃতিই বা কি?
সামাজিক বিজ্ঞানের তত্ত্ববিদরা জাতিগত সমস্যাকে সরাসরি কতৃত্ববাদী এলিট
কুশাসনের (elite misrule) সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। (১) সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে,
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সরকার সমূহের সমস্যা সম্পর্কে ভুল উপলদ্ধি
এবং তৎহেতু ভ্রান্ত নীতিমালা ও পদক্ষেপ
থেকে। (২) অবশ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মূল
নিহিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে সহজেই ধরা পড়ে বাংলাদেশ
একটি একক জাতি, সংস্কৃতি-ভাষা ভিত্তিক (mono-ethnic, culture-linguistic) রাষ্ট্র।
মুজিব ১৯৭৩ সালে রাঙ্গামাটিতে-এক নির্বাচনী জনসভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের “পাহাড়িদের”
নিজস্ব জাতিগত বৈশিষ্ট্য ভুলে গিয়ে ‘বাঙালি’ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ঐ জনসভায় তিনি
এ হুমকিও প্রদান করেছিলেন, যদি পাহাড়িরা তার পরামর্শ গ্রহণ না করে, তাহলে তিনি পার্বত্য
চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ বাঙালি ঢুকিয়ে দিয়ে তা করবেন। ১৯৭৪ সালের ২৩শে জানুয়ারী পার্লামেন্ট
বাংলাদেশকে একটি "uni-cultural and uni-lingual nation-state" wn‡m‡e †NvlYv K‡i GKwU wej cvm K‡i| GLv‡b mn‡RB evsjv‡`k ivóª-e¨e¯’v Ges ivR‰bwZK wm‡÷‡gi "non-accommodative"হিসেবে ঘোষণা করে একটি বিল পাস করে। এখানে
সহজেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সিস্টেমের "non-accommodative" চরিত্র চোখে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রত্যেকটি সরকারই
"accommodative" নীতির পরিবর্তে "assimilationist" পলিসি অনুসরণ
করেছে। এর যথাযোগ্য প্রতিফলন হচ্ছে - পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সমতল ভূমি
থেকে বাঙালি পুনর্বাসন।
পূর্বের এক লেখায় পার্বত্য চট্টগ্রামে মাইগ্রেশনকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল।
(১) স্বাভাবিক (natural); এবং (২) রাজনৈতিক (political)। প্রথম ধারণায় লোকজন পার্বত্য
চট্টগ্রামে মাইগ্রেট করেছে ভাগ্যের সন্ধানে অর্থাৎ হয় চাকুরীর জন্য
না হয় ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। কিন্তু দ্বিতীয় ধারণায়, সরকার সুপরিকল্পিতভাবে বিশেষ রাজনৈতিক
উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য দেশের সমতল অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে লোক পুনর্বাসন করেছে।
১৯৪৭ সালের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা
করলে বুঝা যাবে কত দ্রুত হারে জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৪৭ সালে জেলার লোকসংখ্যার
৯৮ শতাংশেরও অধিক ছিল পাহাড়ি, আর অপাহাড়ি ছিল ২ শতাংশেরও কম। ১৯৫১ সালে জেলায় বাঙালির
হার দাঁড়ায় ৯%, ৬১ সালে ১২% এবং সরকারী হিসেব মতে ১৯৮১ সালে ৪০%। বাংলাদেশের এক সাপ্তাহিক
পত্রিকার মতে ১৯৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপাহাড়ি জনসংখ্যার হার ৫০% এর অধিক হয়।
১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে জেলায় পাহাড়ি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৭১.৭% আর বাঙালি
জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১২৫.১%। পরিসংখ্যান থেকে একটা পরিস্কার চিত্র ফুটে উঠে যে, বাংলাদেশ
স্বাধীন হওয়ার পর জেলায় অপাহাড়ি জনসংখ্যার পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা
জেলার ডিমোগ্রাফিক চেহারা পাল্টে দিয়েছে।
১৯০০ সালে হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাইরের লোকদের
গমনাগমন এবং বসতি স্থাপনের ব্যাপারে কিছু সুস্পষ্ট বিধি বিধান ছিল। ১৯৪৭ সালের পর এইসব
বিধি বিধান উপেক্ষা করে পাকিস্তান সরকার সমতলবাসী বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি
স্থাপনে উৎসাহ প্রদান করে। বাংলাদেশ
আমলে এ প্রক্রিয়া উৎসাহ প্রদানের পরিবর্তে পৃষ্ঠপোষকতায় রূপ লাভ করে। এক সরকারী গোপন মেমোরে-ামে
দেখা যায়, সমতলবাসী যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করবে তাদের প্রতি পরিবারকে
৫ একর হিলি জমি, ৪ একর মিশ্র জমি, ২.৫ একর ধান্য জমি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
(৪) স্বভাবতই যে প্রশ্নটা উঠে তা হচ্ছে, যে মিশ্র এবং ধান্য জমির প্রতিশ্রুটি দেয়া
হচ্ছে তা কোত্থেকে আসবে ? পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পর্বতময় এলাকা, এখানে চাষযোগ্য জমির
পরিমাণ এমনিতেই কম। তার উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে জেলার ৪০% চাষযোগ্য জমি পানিতে
ডুবে যায়। সরকার সে সময়ই বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়িদের চাষযোগ্য জমির অভাবে
পুনর্বাসন করতে পারেনি। কাজেই পরবর্তীকালে দেখা গেলো পাহাড়িদের ভূমির বেদখল, অধিগ্রহণ
ইত্যাদি। এই সমস্ত অবিচার, বৈষম্য, অশুভ নীতির ফলেই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার
সৃষ্টি।
বর্তমানে আমরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিমোগ্রাফিক মানচিত্রের দিকে
তাকাই, তাহলে সরকারী নীতিমালার প্রতিফলন সহজেই চোখে পড়বে। তবলছড়ি এবং রামগড় এলাকায়
বর্তমানে পাহাড়ি নেই বললেই চলে, যেখানে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় বাঙালি ছিলই না।
জেলার দক্ষিণাংশে নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, রুমা উপজেলাগুলোতেও এই পরিস্থিতি চোখে পড়বে।
লংগদু এলাকার পরিস্থিতিও ভয়াবহ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের এসব নীতির উদ্দেশ্যে কী
?
সরকারী এ নীতিমালার মূলে রয়েছে পশ্চিমা anti-insurgency তত্ত্বগুলো।
তত্ত্বগতভাবে একথা বলা হয়, যখন কোন অঞ্চলে insurgency দেখা দেয় তখন insurgent group এবং সরকারের
মধ্যে জনসমর্থন নিয়ে টানাটানি হয়। জনসমর্থন ছাড়া insurgent গ্রুপগুলো তাদের
কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। অন্যদিকে insurgency দমন করতে হলে সরকারের স্থানীয় অধিবাসীদের সমর্থন দরকার
হয়। এই অবস্থায় সরকার যদি স্থানীয় জনসমর্থন না পায় তাহলে অন্য এলাকা থেকে নিজ বংশোদ্ভুত
বা সমর্থন পেতে পারে এমন লোকজন এনে ঐ বিশেষ এলাকায় বসতি স্থাপন করায়। এতে সরকার স্থানীয়
লোকদের নিজ সমর্থনপুষ্ট লোকজন দ্বারা out-number করে ঐ সমস্যা সমাধানে প্রয়াস পায়। এটা অনেকটা Demographic
invasion -এরই নামান্তর। বৃটিশ সরকার Communist insurgency দমন করতে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া
সীমান্তে এ নীতি প্রয়োগ করেছিল। ফিলিপাইনে মরোদের বিরুদ্ধে, শ্রীলংকায় তামিলদের বিরুদ্ধেও
এ নীতি প্রয়োগ করা হয়। চীনারা এ নীতি প্রয়োগ করেছে তিব্বতে। আর বাংলাদেশ সরকারও পার্বত্য
চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে এ নীতিরই আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাসমূহের
অস্তিত্ব বিপন্ন প্রায়। অবশ্য অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চলছে নানাভাবে। কিন্তু শঙ্কার
কারণ হল সরকারের অনুসৃত নীতি। না হয় হাজার বছর ধরে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চালানো
যেত।
(1) Dov Ronen, "Ethnicity, Politics and Development : An
Introduction" in Dennis L. Thompson and Dov Ronen (etc), Ethnicity,
Politics and Development (Boulder; Colorado: Lynne Rienner Publishers, (1986)
(2) Syed Anwar Husain, Religion and Ethnicity in Bangladesh Politics,
BIISS Journal, Vol. 12, No. 4, 1991.
(3) Chittagong Hill Tracts District Statistics, 1983 (Dhaka :
Bangladesh Bureau of Statistics, 1983) p-27.
The Chittagong Hill Tracts: Militarization, Oppression and the
Hill Tribe (London : Anti-Slavery Society Publication, 1984) P.P. 71-73.
পাতা: ২৩
---------
---------
পার্বত্য চট্টগ্রাম
কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
২০ শে মার্চ ’৯২ইং
সাহায্যদাতা দেশসমূহের
বৈঠক অত্যাসন্ন
বাংলাদেশ নতুনভাবে
মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগের সম্মুখীন
বিগত বিশ বছর ধরে স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে সংগ্রামরত
উপজাতীয় জনগণের আবাসভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের নতুন অভিযোগসমূহ
গত রাত্রে বাংলাদেশ সরকারকে গভীরভাবে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। গণতান্ত্রিক সরকারের
শাসনের এক বছর পর পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। “এখনো সেনাবাহিনী
কর্তৃক বেপরোয়া ধরপাকড় অব্যাহত আছে এবং যাবতীয় নির্যাতন ও ধর্ষণ এখনো স্বাভাবিক ব্যাপার” - বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে তথ্যানুসন্ধানের
আন্তর্জাতিক কমিশনের কো-চেয়ারম্যান এবং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলফ্রেড
টেলক্যাম্পার। কমিশনের ১৯৯১ইং রিপোর্ট (লাইফ ইজ নট আওয়ারস্ ল্যাণ্ড এ- হিউম্যান রাইটস্
ইন দি চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস) -এর নব-সংস্করণে সংযোজিত নতুন তথ্যসমূহ ঠিক এক বছর আগে
ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বিশেষভাবে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। কমিশন মনে
করে, ক্ষমতায় এক বছর থাকার পরও তার গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পার্বত্য
চট্টগ্রামে সামরিক কর্তৃত্ত্বকে সামান্যই প্রভাবিত করেছে- বরং বলা যায়, সেনাবাহিনীই পার্বত্য অঞ্চলের প্রকৃত শাসক। অভিযোগসমূহ বাংলাদেশকে
সাহায্য লাভে অসুবিধায় ফেলতে পারে। কারণ ইদানিং দাতা দেশসমূহ গ্রহীতা দেশের মানবাধিকার
পরিস্থিতির সাথে তাদের সাহায্যের পরিমাণ সম্পর্কিত করতে আগ্রহী। বিশ্ব ব্যাংকের সভাপতিত্বে
সাহায্যদাতা দেশসমূহের বৈঠক আগামী ২১ ও ২২শে এপ্রিল প্যারিসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে - যেখানে দাতা দেশগুলো বাংলাদেশের প্রত্যাশিত
২.৪ বিলিয়ন ডলার সাহায্য পূরণ করবে কিনা তা সিদ্ধান্ত নেবে।
১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট হোসাইন মোঃ
এরশাদের পতনের পর গত বছর মার্চ-এ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বার্মা
থেকে বাংলাদেশ আসা ৬০/৭০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের ভরণ পোষণের ভার বহনের জন্যও
সাহায্যের আবেদন করছে। উইলফ্রেড টেলক্যাম্পার মন্তব্য করে বলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের
সংখ্যা প্রায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্ভাস্তু উপজাতীয় শরণার্থীদের সমান - যারা ১৯৮৬ সাল থেকে বাংলাদেশ ত্যাগ করে
ভারতের উত্তর-পূর্ব ত্রিপুরা রাজ্যের শরণার্থী শিবিরে এখনো অবস্থান করছে।
কমিশনের টঢ়ফধঃব রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে কিভাবে
লিভার ব্রাদার্স (বাংলাদেশ) -এর ম্যানেজার বাবু মনতোষ দেওয়ানকে গত জুলাই মাসে আর্মিরা
ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকেই তাকে মারাত্মকভাবে মারধর, ইলেকট্রিক শক এবং আঙ্গুলে স্টাপলার
মেরে দেয়া হয়। কমিশনের মতে মনতোষ দেওয়ানকে নির্যাতন করার কারণ হচ্ছে, সেনাবাহিনীর অভিযোগ
১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক কমিশন বাংলাদেশ সফরে গেলে তিনি তাদের সাথে কথা বলেছিলেন। কমিশনের
সদস্যরা বলছেন যে, বাংলাদেশে থাকাকালীন তারা যাদের সাথে কথা বলেছেন তাদের প্রত্যেকের
নাম তারা নোট করেছেন এবং তাদের মধ্যে মিঃ মনতোষ দেওয়ান -এর নাম নেই। যখন স্ত্রী তাকে
দেখতে যান তখন একজন আর্মি অফিসার তার স্বামী সম্পর্কে কাউকে কিছু না বলার জন্য সতর্ক
করে দেন। ডিসেম্বরের শেষে হাই কোর্ট মনতোষ দেওয়ান-এর আটকাদেশ অবৈধ বলে ঘোষণা করে। কমিশনের
জানা মতে তাকে এখনো ছেড়ে দেয়া হয়নি।
গত বিশ বছর যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্মি
এবং সরকারী বাহিনীর দ্বারা অসংখ্য মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনী পাল্টা
অভিযোগ করেছে যে, পাহাড়িদের রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংস্থা শান্তিবাহিনীও
মানবাধিকার লংঘন করছে। জে,এস,এস-এর দাবী হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্বায়ত্তশাসন
প্রদান এবং চার লাখ বাঙালিকে প্রত্যাহার করা যাদেরকে পূর্ববতী দুই সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে
পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় পুনর্বাসিত করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারী ৯১-এর নির্বাচনে বিগত সরকারসমূহের
পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত সংকীর্ণ নীতির অবসানের একটা সুযোগ ছিল বলে কমিশন মনে
করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেই সুযোগ গ্রহণ করার পরিবর্তে পূর্ববর্তী
ঘৃণিত এরশাদ সরকারের সকল নীতি অব্যাহত রেখেছে।
পাতা: ২৪ - ২৫
--------------
--------------
গণ-আদালতের কাঠগড়ায়
গোলাম আযম ও
পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ
- মিঃ পল্লব
গত ২৬শে মার্চ ১৯৯২-এ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত
হয় ৭১-এর নরঘাতক গোলাম আযমের বিচার। তবে এ বিচার গতানুগতিক বিচার নয়। এ বিচার জনগণের
দ্বারা পরিচালিত বিচার। ব্যাপক জনগণের সমর্থনে গঠিত আদালত বলে এই আদালতের নাম গণ-আদালত।
এই গণ আদালতের বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাবেক রেসকোর্স ময়দান, বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী
উদ্যানে, যেখান থেকে ১৯৭১ সালে শেখমুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। ঐ দিন লাখ
লাখ জনতা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমাগম হতে লাগলেন উক্ত আদালত প্রঙ্গনে। নরঘাতক গোলাম
আযমের বিচারের দাবীতে আগত লাখ লাখ জনতার গগণ বিদারী শ্লোগান ও করতালিতে সে দিনের রাজধানী
ঢাকা নগরীর আকাশ বাতাস প্রকল্পিত হয়েছিল। সে দিন সংগ্রামী জনগণের চোখে মুখে ছিল ১৯৭১-এ
অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করার দৃঢ় প্রত্যয়। তাই সে দিনের এক ঘন্টাব্যাপী বিচার
অনুষ্ঠানে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে; যে শত্রুদেরকে বাংলার জনগণ ১৯৭১-এ
পরাজিত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, সে সব জাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে এই স্বাধীন দেশে
আবার জনগণের কেন নতুন করে সংগ্রাম করতে হচ্ছে? স্বাধীনতার দীর্ঘ বাইশ বছরেও কেন এসব
অপশক্তিকে দেশ থেকে নির্মূল করা সম্ভব হলো না। তাহলে কি ৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম
অসম্পূর্ণ ছিল ? এসব প্রশ্ন আজ বাংলার শ্রমজীবী জনগণের। এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে
হলে ঐ অপশক্তির শেকড় কোথায় প্রোথিত ছিল, তার উত্তর খুঁজতে হবে। দীর্ঘ নয় মাসের
রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম ও তারও আগে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন তখনকার পাক-শাসক শ্রেণী
ও তার পেটুয়া বাহিনী রাজাকার, আলসামসদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল। ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে
বিরোধীতা করেছিল গোলাম আযম ও তার দল জামাত-ই-ইসলাম। শুধু তাই নয়। ধর্মের আলখেল্লা পরে
মুক্তিকামী বাংলার জনগণের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়েছিল। হাজার হাজার
মুক্তিকামী প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। হাজার হাজার মা-বোনের
ইজ্জত হরণ করে তাদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করতে কুন্ঠাবোধ করেনি। এমন কি বর্তমান দেশের
প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও এসব অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাননি। এতকিছুর পরও
শেখ সাহেব এসব নর পিশাচদেরকে নির্বিবাদে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ
সরকার, পূর্ব বাংলার অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মেহনতি জনগণের প্রকৃত মুক্তির জন্য
যিনি অবিরত সংগ্রাম করেছিলেন সেই বিপ্লবী নেতা কমরেড সিরাজ শিকদারকে ১৯৭৫ সালে গ্রেফতার
করে আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যুনতম সুযোগ না দিয়ে হত্যা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের সে দিনের
সেই তথাকথিত মহানুভবতার কারণে এই জামাত অপশক্তি বাংলার মাটিতে পা রাখতে সক্ষম হয়। ১৯৭৫-এ
দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাত বদল হলে সেই কুখ্যাত জামাত ও তার প্রধান গোলাম আযম বাংলার
রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। এ যাবৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়
আসীন দলগুলো তাদের পৃষ্টপোষকতায় বিচারের পরিবর্তে এসব গণশত্রুদেরকে লালন করে আসছিলেন।
এ নরঘাতক জামাত ও তার প্রধান গোলাম আযমের সাথে শেয়ার করে বি,এন,পি-র বর্তমান সরকার
গঠন করতে সামান্যতম ভাবেও বিবেকে বাঁধেনি। এবং তারই সুযোগ নিয়ে বিদেশী নাগরিক গোলাম
আযম আজ বাংলাদেশের জামাত-ই-ইসলামীর আমীর।
স্বাধীনতার সুদীর্ঘ বাইশ বছরের পরও ক্ষমতাসীন কোন সরকার
যখন এসব জাতীয় অপরাধীদের বিচার করতে ব্যর্থ, তখনই বাংলার জনগণ এসব ঘাতক দালালদের বিচার
করতে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। জনগণ দীর্ঘ বাইশ বছর সাধারণ প্রচলিত আইনের
অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ঐসব আইন এসব জাতীয় অপরাধীদের বিচার করতে অক্ষম, বরং ঝধভবমঁধৎফ হিসেবে কাজ করেছিল। এমন কি যারা এসব নর ঘাতকদের বিচার
করতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে নির্লজ্জভাবে
কোর্টে মামলা করে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেন। এখন প্রশ্ন, যে সরকার এসব জাতীয় অপরাধীদের
স্বার্থে এবং তাদের নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে ব্যাপক জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাহলে
এই সরকারকে আমরা কী বলবো ? সরকার যদি নিজেকে জনগণের সরকার হিসেবে দাবী করেন, তাহলে
তার উচিৎ অতিসত্তর জনগণের রায়কে বাস্তবায়িত করা। নতুবা জনগণ
তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করলে জনগণকে দায়ী করা যাবে না।
এসব মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি কোন কালে, কোন
দেশে বা অঞ্চলে জনগণের স্বপক্ষে কোন কাজ করেনি এবং করতেও পারে না। তারা বরাবরই ধর্মকে
তাদের একমাত্র প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সহজ সরল জনগণের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের
ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করতে ব্যস্ত থাকেন। এভাবে জামাত ও তার প্রধান গোলাম আযম ইসলাম
ধর্ম বিশ্বাসী সহজ সরল মুসলিম জনগোষ্ঠিকে ধর্মের পরলৌকিক লোভ দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে তারা
ইহজগতের সকল অনাচার দুরাচারে মত্ত হয়ে মহাসুখে বেহেশ্তের সুখ উপভোগ করেন। অপর দিকে
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে
পরিস্থিতি ঘোলাটে করে এবং এই ঘোলা পানিতে মাছ ধরাই হচ্ছে তাদের স্বভাব। যেভাবে আজকের
পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামী সম্প্রসারণবাদের কালো হাত প্রসারিত হচ্ছে এতে তাদের কুৎসিৎ চেহারা ইতিমধ্যে
প্রকাশ করে ফেলেছে। বিশ্ব ইসলামী মৌলবাদের প্রধান পৃষ্টপোষক সৌদি আরবের পেট্রো ডলারে
নির্মিত হয়েছে একটি হাসপাতাল। লংগুদুতে প্রতিষ্ঠিত এই আল রাবেতা হাসপাতালটি চিকিৎসার নামে চালাচ্ছে পাহাড়িদের ইসলামী করণের প্রক্রিয়া।
অপরদিকে ইসলামী মৌলবাদের সমান্তরাল করে কিছু সংখ্যক পাহাড়ি শুরু করেছে ধর্মকে নিয়ে
ব্যবসা। এক শ্রেণীর পাহাড়ি বুদ্ধ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে চড়ে
শুরু করেছে ধর্মীয় প্রচারণা। সাধারণ শ্রমজীবী পাহাড়ি জনগণকে নির্বাণের লোভ দেখিয়ে প্রগতিশীল
চিন্তা চেতনা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। এসব বক ধার্মিকেরা নিজে বিভিন্ন
অপকর্মে লিপ্ত থেকে সাধারণ জনগণের নিকট নির্বাণের অমোঘবাণী ও বুদ্ধ ধর্মের অপব্যাখ্যায়
মত্ত। অপর দিকে আরও কিছু সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত পাহাড়ি বুদ্ধ ধর্মের ব্যানার গলায় ঝুলিয়ে
সা¤্রাজ্যবাদের
অর্থে পুষ্ট হয়ে ধর্মীয় ব্যবসায় কোমড়ে কাপড় বেঁধে মাঠে নেমেছেন। কিছু লোক দেখানো জনকল্যাণমূলক
কাজ করে এবং সেগুলো ঐ সব দাতা দেশে দেখিয়ে বড় বড় অংকের অর্থ নিয়ে এসে বিভিন্ন অসামাজিক
কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছেন। দেশীয় ও বিদেশী ধর্ম ব্যবসায়ীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান
অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছেন। দেশীয় বুদ্ধ ধর্ম ব্যবসায়ীরা সেনাবাহিনী
থেকে সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে সেনা বাহিনীর কুকর্মের প্রতি সাফাই গাইতে বড় ওস্তাদ। তাই
তারা সেনাবাহিনীর নির্যাতনমূলক অপকর্মের খুবই সহায়ক শক্তি। সে কারণে হাজার হাজার, লাখ
লাখ টাকা খরচ করে সরকারী অর্থে ও সরকারী হেলিকপ্টারে চড়ে পার্বত্য অঞ্চলে ধর্ম প্রচারে
এখন তারা খুবই ব্যস্ত। ইদানিং পার্বত্য এলাকায় মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনীরাও বুদ্ধ ধর্মের
প্রতি খুবই অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। তাই, কিছু কিছু সেনা অফিসার এসব বুদ্ধ ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী
ধর্মীয় গুরুদের নিয়ে ধর্মীয় সভা সমাবেশ করাচ্ছেন। এসব সরকার এবং তার সহায়ক শক্তি সেনাবাহিনী
তাদের প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ সরল প্রাণ জনগণের চোখ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা
ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারী পৃষ্টপোষকতায় এসব ধর্মীয় মৌলবাদ বিকাশ লাভ করে। যেভাবে স্বাধীন
বাংলাদেশে দীর্ঘ বাইশ বছরে বিকাশ লাভ করেছিল। তাই পার্বত্য এলাকায়ও এসব ভ- ধর্ম ব্যবসায়ীদের
অপশক্তি সমাজের সর্বস্তরে প্রোথিত হবার পূর্বে উপড়ে ফেলতে হবে। নচেৎ পার্বত্য এলাকায় প্রকৃত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাধা হয়ে দেখা দেবে। এবং
গণতান্ত্রিক অধিকার কোন সময় অর্জিত হলেও বর্তমান বৃহত্তর বাংলাদেশের ন্যায় অসম্পূর্ণ
থেকে যাবে। তাই সময় থাকতে পার্বত্য এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দালাল ও ধর্ম ব্যবসায়ী
মৌলবাদী কালো অপশক্তিকে চিহ্নিত করে গোলাম আযমের মতন গণআদালতে বিচার করতে হবে। বিশেষ
করে বর্তমান প্রজন্মকে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। প্রগতিশীল আদর্শকে
বুকে ধারণ করে এসব দালাল ও ধর্ম ব্যবসায়ী অপশক্তিকে সামাজিকভাবে বয়কট করে জনগণের কাঠগোড়ায়
দাঁড় করানোর ভিত্তি এখন থেকে তৈরি করে নিতে হবে। নচেৎ পাহাড়ি জনগণের প্রকৃত মুক্তি অসম্ভব।
পাতা: ২৫
----------
----------
বিশেষ ঘোষণা
শীঘ্রই দালাল ও গণদুশমন
তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে
“হিল লিটারেচার ফোরাম” এর সহযোগিতায় “গণদুশমন
ও দালাল তালিকা প্রণয়ন কমিটি” গঠিত হয়েছে। সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন অপকর্মে
লিপ্ত দালাল-দুশমনদের তালিকা সংগ্রহের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। সুষ্ঠু ও নিখুঁত
তালিকা প্রণয়ন করতে আপনিও এগিয়ে আসুন। আপনার এলাকায় চেনা-জানা বদমায়েশ, দালাল ও গণদুশমনদের
নাম, পিতার নাম, বয়স, ঠিকানা ও কুকর্মের বিস্তারিত তালিকা (প্রয়োজনে ছবিসহ) নি¤œ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিন ঃ
আহ্বায়ক
গণদুশমন ও দালাল তালিকা প্রণয়ন কমিটি
প্রযত্নে, হিল লিটারেচার ফোরাম।
দালাল কারা :-
১। যারা বিভিন্নভাবে জনস্বার্থ বিরোধী কাজে
লিপ্ত ছিল বা আছে।
২। যে সব পাহাড়ি ব্যক্তি জগণের স্বাধিকার আদায়ের
সংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে কাজ করেছে বা করছে।
৩। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান/সদস্য/সমর্থক।
৪। গ,প্র,ক বাহিনী; টাইগার বাহিনী; লায়ন বাহিনী
ইত্যাদি আঙ্গুল বাহিনীর সদস্য/সদস্যা।
৫। যারা নিরীহ জনগণকে শান্তিবাহিনী আখ্যায়িত
করে ধরিয়ে দেয়।
৬। যারা রাত-বিরাতে, সময়ে-অসময়ে সন্দেহজনক এলাকায়
যাতায়াত করে এবং নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট রিপোর্ট দিয়ে জনগণের জীবন দুর্বিসহ করে তোলে।
৭। ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যারা সমাজ
ও জাতির ইজ্জত বিকিয়ে দিচ্ছে। সমাজকে কলুসিত করছে।
পাতা: ২৬ - ২৯
-------------
-------------
সা ক্ষা ত কা র
[পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিঃসন্দেহে একটি জাতীয়
রাজনৈতিক সমস্যা। সঙ্গত কারণেই আমরা মনে করি এ সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের সচেতন ছাত্র,
বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর এক বিরাট
ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকাকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে
কে কী ভাবছেন তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী,
শিক্ষক, সাংস্কৃতিকর্মীসহ সচেতন মহলের সাক্ষাতকার ছাপাচ্ছি। এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায়
চলমান সংখ্যায় একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক জনাব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং স্বনামধন্য কবি
শামসুর রাহমানের সাক্ষাতকার ছাপানো হলো।]
পার্বত্য
চট্টগ্রাম সম্পর্কে লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের
উদাসীনতা
শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জার বিষয়ও বটে।
- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
[জনাব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক,
ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং উক্ত কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। এছাড়া তিনি লেখক
শিবির-এর কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি এবং “তৃণমূল” ত্রৈমাসিক পত্রিকার
সম্পাদক। তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস “চিলে কৌঠার সেপাই” খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ছোট
গল্পের মধ্যে দুধে ভাতে উৎপাত, দোজখের ওম ও খোঁয়ারী উল্লেখযোগ্য।]
১। বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি
সম্পর্কে আপনি কতখানি অবগত?
সরকারী প্রচার মাধ্যম যতোই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করুক
আর বেসরকারী কাগজপত্র যতোই এড়িয়ে চলুক, দেশবাসী আজ জানে যে গত কয়েক বছর ধরেই পার্বত্য
চট্টগ্রামে বিরতিহীনভাবে রক্তপাত ঘটে চলেছে।
সেখানকার অধিবাসীদের নিজ নিজ জাতিসত্তা নিয়ে টিকে থাকার
অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে, নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে তাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে গণ্য
করা হয় ঔদ্ধত্য বলে এবং তাদের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী বিবেচিত হয় অপরাধ হিসাবে। তাদের
ঐ অধিকার, ইচ্ছা ও দাবীকে সমূলে উৎপাটনের জন্যে শাসকদের নির্যাতন
শুরু হয় পাকিস্তানী আমলে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তাই রূপ নিয়েছে হিং¯্র আক্রমনে। প্রথমে নিজভূমে তাদের পরবাসী করে রাখার জন্যে এবং পরে ভিটেমাটি
থেকে তাদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই আক্রমণকে প্রতিরোধ করার খবরও পাই বৈকি।
১৯৮১ সালে আমি রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের কয়েকটি জায়গায় গিয়েছিলাম। বান্দরবানে সঙ্গী
হিসাবে পেয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মুরং ছাত্রকে। তখন নিজের চোখে দেখে
এবং পাহাড়ি ও বাঙালী অধিবাসীদের মুখে কখনো একই রকম কখনো পরস্পরবিরোধী কথা শুনে ওখানকার
অবস্থা অনেকটাই আঁচ করতে পারি। এরপর প্রায় কয়েক যুগ কেটে গেলো। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন
সূত্রে খবর পেয়েছি। আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার প্রতিবেদন পড়েছি। “রাডার” পড়ার সুযোগও
পাই। এ ছাড়া সরকারের পরিবেশিত তথ্য থেকেও কিছু কিছু ব্যাপার বুঝতে চেষ্টা করি। তবু
খুব লজ্জা ও গ্লানির সঙ্গে বলি, আমাদের এই ছোট দেশটির ঐ এলাকার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ
ও জরুরী অনেক কিছুই আমার জানা নেই। ভালো করে যেটুকু জানি তার ওপর ভিত্তি করেই আপনাদের
প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো।
২। এ দেশের সংবাদ মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলীর
সঠিক চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। এর জন্য আপনি কাকে দায়ী করেন?
সরকারী প্রচার মাধ্যমগুলি সম্বন্ধে বলার মানে হয় না।
সেখানে মন্ত্রী, নিমমন্ত্রী, আমলা এবং নিম আমলার মামাতো ভাইয়ের বাড়িওয়ালার শালার বিড়ালের
মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করা যাবে, কিন্তু গোলাম আযমের ফাঁসি দাবী করে অনুষ্ঠিত গণ-আদালতের
বিশাল সমাবেশের খবরটা বেমালুম চেপে যেতে হবে। তারা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত হত্যাযজ্ঞের
খবর দেবে কি করে ? কিন্তু দেশে বেসরকারী ও বিরোধী দলের খবরের কাগজ, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক
সাময়িকী এবং মাসিক পত্রিকার তো অভাব নেই। সেসব জায়গায় পার্বত্য এলাকার সংঘর্ষ, হত্যা
ও নারী নির্যাতনের ব্যাপারে টু শব্দটি করা হয় না কেন ? শিক্ষিত বাঙালীর মধ্যে এক ধরনের উগ্র ও উদ্ভট জাতীয়তাবাদী উন্নাসিকতা
আছে যার ফলে একটু ভিন্ন সংস্কৃতির নিকটতম প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখ থেকে তারা নিজেদের সরিয়ে
রাখেন। নিজের দেশের সংখ্যালঘু বিভিন্ন জাতিসত্তার সদস্যদের সম্বন্ধে এঁদের সীমাহীন
অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য। বাঙালী শিক্ষিত সমাজের যে অংশটি বিদ্যাচর্চা করেন, সাহিত্য সৃষ্টি
করেন কিংবা শিল্পের নানা মাধ্যমে নিয়োজিত রয়েছেন দেশেরই কোনো কোনো অংশের মানুষ সম্বন্ধে
তাঁদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা এবং উন্নাসিকতাই পাহাড়ি মানুষের সমস্যা সম্বন্ধে দেশবাসীর
অজ্ঞ ও উদাসীন থাকার প্রধান কারণ।
৩। পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের একটা অঞ্চল, অবিচ্ছেদ্য
অংশ। এই অঞ্চলের জনশক্তি ও সম্পদকে দেশের বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে লাগাবার পরিবর্তে
বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় করা হচ্ছে ঐ এলাকার সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে দাবিয়ে রাখতে। বনজ সম্পদসহ
কোটি কোটি টাকার সম্পদ তছ্নছ্ হচ্ছে। এর শেষ কোথায় ?
আমিও জানতে চাই, এর শেষ কোথায় ? শুধু সরকারকে দোষ দেবো
কেন ? দেশের রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন পেশাজীবী, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী,
ছাত্র - কেউই কি বুঝতে পান যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান অবস্থা জারি থাকলে
দেশের অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত কোথায় মুখ থুবড়ে পড়বে ? এই দরিদ্র দেশের মানুষের দারিদ্র
নামবে কোন পর্যায়ে ? মধ্যবিত্তের লেখাপড়া, বিদ্যাচর্চা যাবে কোন রসাতলে ? পার্বত্য
চট্টগ্রামের আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে তার আঁচ থেকে বাঁচবে কে ?
৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে পাহাড়ি ছাত্র
পরিষদের পেশকৃত ৫ দফা সম্পর্কে মূল্যায়ন করুন।
পাঁচ দফায় পাহাড়ি ছাত্রদের গণতান্ত্রিক মনোভাব ও বিবেচনাবোধের
পরিচয় পাই। তবে জাতীয় সংসদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটি কি করতে পারে ? তাদের কাজ করতে
হবে গঠনতন্ত্র অনুসারে। গঠনতন্ত্রে দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাসমূহের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব
রক্ষার কোনো ব্যবস্থা আছে কি ? আর জাতীয় সংসদে পাহাড়ি প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে পাহাড়ি রাজাকার
বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোন কাজ হবে ? ৩ নম্বর দফা সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় আজই
ব্যবস্থা নিতে পারে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা কে কোন বিষয় পড়বে,
কার যোগ্যতা কতটুকু তার বিচার করার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকা উচিত সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর
হাতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজ করবে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান,
তা সশস্ত্র বা নিরস্ত্র, হিংস্র বা নিরীহ যাই
হোক না কেন, এই ব্যাপারে তাদের কোনো রকম নাক গলানো বরদাশত করা উচিত নয়।
৫। দেশের লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী প্রমুখের পার্বত্য
চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের দায়দায়িত্ব কতখানি বলে মনে করেন?
বাঙালীর ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ও স্বাধীন
রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামে দেশবাসীকে উদ্ভুদ্ধ করতে আমাদের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের
ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন এই দেশের ছোট জাতিসত্ত্বাগুলির অধিকার প্রতিষ্ঠার
দাবীকে নস্যাৎ করার জন্যে যখন নিষ্ঠুর নিপীড়ন চলে তখন ঐ লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের
উদাসীনতা শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জার বিষয়ও বটে। ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা বাবরি মসজিদে
ইতর আক্রমণ চালালে আমারা সঙ্গতভাবেই তার প্রতিবাদ করি। বাংলাদেশে মুসলমান মৌলবাদীদের
পাশবিক আস্ফালনে সভ্যতা ও সংস্কৃতি সংকটাপন্ন হলে আমরা রুখে দাঁড়াই। এ সবই বাঙালী লেখকদের
দায়িত্ববোধ ও সাহসের পরিচয় দেয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে গত কয়েক বছর ধরে যে অবিরাম
নির্যাতন চলছে তা নিয়ে এরা নীরব কেন ? গত বছর অক্টোবরে খাগড়াছড়ির দুটো গ্রামের একটিতে
দুর্গাপূজার জন্যে তৈরি মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হলো, আরেকটি বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধদেবের মুর্তি
ভাঙ্গা হলো, একই জেলায় একই মাসে একটি গ্রামে অপারেশন চালাতে গিয়ে একটি বাড়িতে পুরুষদের
বেঁধে রেখে মা ও মেয়েকে এক সঙ্গে বলাৎকার করা হলো। লেখকদের মধ্যে
এসব ক্ষোভের সঞ্চার করে না কেন ? কয়েক বছর আগে জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস ঢাকায় এলে
আমাদের লেখকদের সামনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা নিয়ে গভীর আক্ষেপ করে যান। আমরা কিন্তু
তাঁর আক্ষেপে সাড়া দিইনী। লেখকদের এই প্রতিক্রিয়া কিংবা প্রতিক্রিয়ার অভাব মোটেই শিল্পীসুলভ
নয়।
এই দেশের এবং স্বতন্ত্র হলেও কাছাকাছি সংস্কৃতির সঙ্গে
নিবিড় পরিচয় রাখা লেখকদের অপরিহার্য কর্তব্য। যেখানে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের সংস্কৃতি
বিপন্ন হলে যে কোনো শিল্পী তাতে উদ্বেগ বোধ না করে পারেন না, সেখানে আমাদেরই কয়েকটি
জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখী হলে সমগ্র জাতির স্বার্থেই তাদের এর প্রতিকারে
উচ্চকন্ঠ হওয়া উচিত। শিল্পীর সামাজিক দায়িত্বের কথা যদি নাও বলি, কেবল তার শিল্পচর্চার
জন্যেও নিজের দেশের অধিবাসীদের ওপর নির্যাতন নিয়ে মাথা ঘামানো দরকার। দেশের ভেতরেই
ভয়াবহ, রক্তাক্ত ও বিভীষিকাময় এবং একই সঙ্গে সাহসী ও সংকল্পাবদ্ধ ঘটনা ঘটে চলেছে, এ
নিয়ে লেখক ও শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীরা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সচেতন
ও প্রতিবাদী করে তোলার কাজে অবশ্যই এগিয়ে আসতে পারেন।
৬। কীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধান হতে
পারে ? আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন।
সমাধান বাৎলানো আমার সাধ্যও এখতিয়ারের
বাইরে। একজন লেখক হিসাবে আমি কেবল সম্ভাবনা সম্বন্ধে আমার অনুভতির কথা বলতে পারি।
প্রথমত ও প্রধানতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সমস্যাকে
প্রত্যেক বাঙালিকে নিজের সমস্যা বলে অনুভব করতে হবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর
হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ ও ঘরে ঘরে অগ্নি সংযোগের ঘটনা আজো আমাদের মধ্যে ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে
রেখেছে, রাজাকার আলবদরদের আমরা এখনো ফাঁসি দাবী করি। আমাদের দেশের যে কোন জাতিসত্তার
ওপর নির্যাতন আমাদের মধ্যে একই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করা উচিত, তা হলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ
মানুষ এর প্রতিকারে প্রতিরোধের লক্ষ্যে এগিয়ে আসবেন।
পাহাড়িদের জমিতে জোর করে যাঁদের বসানো হচ্ছে তাঁরা
হলেন নিরীহ ও গরিব বাঙালি কৃষক। এঁদের প্রতি কোনো ভালোবাসা থেকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
পাহাড়িদের উচ্ছেদ করার জন্যে এঁদের ব্যবহার করা হচ্ছে। পাহাড়িদের যদি নিশ্চিহ্ন করা
যায় তো তার পর পরই এঁদেরও ঐসব জমি থেকে নির্মূল করা হবে, ঐ জমি দখলের জন্যে তখন হামলে
পড়বে দেশের ধনী, বুর্জোয়া সুবিধাভোগীর দল। এই ধরনের ব্যাপার এই উপমহাদেশে আগেও ঘটেছে।
বাঙালি নি¤œবিত্ত শ্রমজীবীর সঙ্গে বাঙালি
বুর্জোয়া, সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। নির্যাতিত
ও শোষিত পাহাড়ি এবং নির্যাতিত ও শোষিত ও প্রতারিত বাঙালি শ্রমজীবী অনেক ঘনিষ্ট আত্মীয়।
এই সত্যটি সবার মধ্যে উপলদ্ধি করবার দায়িত্ব বাঙালি ও পাহাড়ি লেখক, শিল্পী ও রাজনৈতিক
কর্মীদের ওপর।
এখন বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ অত্যন্ত
কম। এটা খুব দুঃখজনক। উভয় সংস্কৃতির জন্যেই এটা ক্ষতিকর। পরস্পরের সাহিত্য, সংস্কৃতি
ও ঐতিহ্য সম্পর্কে পরস্পরকে ওয়াকিবহাল হতে হবে। পরস্পরকে না চিনলে কেউ কারো সমস্যা
বুঝতে পারবেন না, শুধু তথ্য জেনে কোন সম্প্রদায় কিংবা জাতিসত্তার সমস্যা সম্বন্ধে কেউ
উদ্বিগ্ন হতে পারে না। এই ব্যাপারে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের শিক্ষিত ও সচেতন অংশের একটি
বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্বন্ধে বাঙালিদের অবগত করার
দায়িত্ব তাঁরাই নেবেন। হিল লিটারেচার ফোরামের মুখপত্র “রাডার” এই ব্যাপারে উদাসীন।
পাহাড়িদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারটি সফলভাবে প্রকাশ করলেও তাঁদের সাহিত্যকর্ম বা সংস্কৃতির
কোনো পরিচয় দেওয়ার উদ্যোগ সেখানে নেই। বিভিন্ন জাতিসত্তার রূপকথা, গাথা, গল্প, কবিতা,
নাটক, গান প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হলেই বাঙালি তাঁদের আত্মীয় বলে পাহাড়িদের চিনতে পারবে।
রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে সঙ্গেই এই কাজগুলো করতে হবে।
পাহাড়িরা ২১শে ফেব্রুয়ারিকে তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি
প্রতিষ্ঠার দিবস হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন। বাঙালিরা কিন্তু এই দিনটিকে শুধু বাংলা ভাষা
আদায়ের আন্দোলনের দিবস হিসেবে বিবেচনা করেন না, তা হলে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের অন্যতম
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গেই এর কার্যকারিতা ফুরিয়ে যেতো। বাঙালির
প্রত্যেকটি প্রগতিশীল আন্দোলন প্রত্যেক বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে নতুন গতি ও উত্তাপ লাভ
করেছে। পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহ যদি ঐ দিনেই তাঁদের নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি অধিকার প্রতিষ্ঠার
দাবী দিবস হিসাবে চিহ্নিত করেন তাহলে বাঙালিরা একদিকে তাঁদের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করবেন
এবং অন্যদিকে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে তাঁরা অন্য ভাষাভাষীদের ভাষার দাবীকে সম্মান
করতে শিখবেন। পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের প্রত্যেকের ইতিহাস সম্বন্ধে দেশের সবাইকে ওয়াকিবহাল
করতে হবে। এঁদের বিদ্রোহের ঐতিহ্যও দীর্ঘদিনের। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির
স্বেচ্ছাচারিতা ও শোষণের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির বিদ্রোহের বিবরণ অনেক জায়গায় পাওয়া যায়।
তাঁদের এই বীরত্বব্যঞ্জক ও সাহসী প্রতিরোধের ঐতিহ্যে চাকমাদের সঙ্গে বাঙালিও গৌরব বোধ
করতে পারেন যদি এই ইতিহাস যথাযথভাবে প্রচার করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে
রাজনৈতিক কার্যকলাপের তুলনায় শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নতুন
মুল্যায়ন কিছুমাত্র কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
------------------------------------------
সরকারের
উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাবলীকে রাজনৈতিকভাবে
সমাধান করা
-কবি শামসুর
রাহমান
[কথা ছিল কবি কবিতা লিখবেন রাডারে। সে যত ছোটই হোক।
কিন্তু শারীরিকভাবে তিনি অসুস্থ। তার সত্ত্বর আরোগ্য কামনা করে অপেক্ষা করলাম আমরা
বেশ ক’দিন। অবশেষে তিনি কবিতা না লিখে কিছু প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগ্রহ জানালেন ফোনে।
তৎক্ষনাৎ কিছু প্রশ্ন নিয়ে কবির মুখোমুখি হওয়া। এক নাগারে বলে যান আমাদের প্রশ্নের
জবাব। বললেন অৎব ুড়ঁ যধঢ়ঢ়ু ? সকৃতজ্ঞ স্বীকারোক্তি। অবশ্যই। বার্ধক্যের চাহনিতে চেয়ে
থাকেন ফ্যাল ফ্যাল। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জমতে থাকে কবির প্রতি। আমরা কবির সুষ্ঠু ও
দীর্ঘায়ু কামনা করি। (সম্পাদনা পরিষদ) ]
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে কীভাবে
দেখেন ? সেখানে সচরাচর পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের পেছনেও যে পাহাড়িদের উপর সামরিক ও রাজনৈতিক
অত্যাচার চলছে তা জানেন কি ?
আমি Life is not
ours রিপোর্টটি পড়েছি। এই রিপোর্ট
একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন প্রস্তুত করেছেন। এই রিপোর্টের তথ্য ভুল বলে আমি
মনে করি না। এতে অনেক সত্য কথা আছে এবং আমি দু’এক জন পাহাড়ি ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করে
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের দুঃখ দুর্দশার কথা জানতে পেরেছি। আমি মনে করি এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধান
করতে হবে। কোন রকম জোর জবরদস্তি করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
(খ) স্বতন্ত্র কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ভেতর বিকশিত পার্বত্য
এলাকার অনগ্রসর ও নির্যাতিত পাহাড়ি মানুষগুলোর জন্য কবি হিসেবে আপনার কী করণীয় বলে
মনে করেন ? বাংলাদেশর একজন নাগরিক হিসেবেই বা কী দায়িত্ব ?
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্তর্গত এলাকা। আমি
আমার দেশকে ভালোবাসি। এদেশের প্রত্যেক অঞ্চলের জন্যে আমার ভালোবাসা রয়েছে। এ দেশের
মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ আমার একান্ত কাম্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের
পাহাড়ি অধিবাসীদের একটি আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। এই সংস্কৃতির বিকাশ আমার কাম্য। পাহাড়িরা যাতে নিরাপদভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং অবাধ সংস্কৃতি চর্চ্চা
করতে পারে সেজন্যে অনুকুল পরিবেশ তৈরী করা আমাদের সবারই দায়িত্ব। আমি চাই পার্বত্য
চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যাবলীর যত তাড়াতাড়ি একটি সুষ্ঠু সমাধান হোক।
(গ) অনেক দিন আগে আপনি রাঙ্গামাটি গিয়েছেন। কর্ণফুলীর
কৃত্রিম হ্রদের নীল জল আর পাহাড়িয়া প্রকৃতি আপনার কবি হৃদয়ে কী রকম প্রভাব ফেলেছে?
আমি রাঙ্গামাটিতে গিয়ে নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য দেখে
মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেখানকার প্রকৃতির একটি আলাদা সৌন্দর্য্য সহজেই চোখে পড়ে। পাহাড়ি এলাকার
রূপ এখনও আমার চোখ ও মন জুড়ে আছে। এই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে যে সন্ত্রাস তা আমাকে
পীড়িত করে। আমি চাই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা সন্ত্রাস মুক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে
মধ্যে বসবাস করুক। যেন কোন সমস্যাই তাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতে না পারে সে দিকে
প্রসাশনের লক্ষ্য রাখা উচিত । এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদেরও একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা
দরকার।
(ঘ) আপনার ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’ কবিতাটি খুবই
ভালো লেগেছে। আমরা যদি নিজেদের স্বকীয় অস্তিত্ব, কৃষ্টি, সংস্কৃতি তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার
অর্জনের কথা বলি তখন আপনি তা কীভাবে দেখবেন ? এতো নিশ্চয়ই দেশদ্রোহীতা হতে পারে না।
আমার কবিতা “দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে” একটি বিশেষ পটভূমিতে
লেখা হয়েছিল। যখন স্বাধীনতা বিরোধী লোকজনদের বাংলাদেশের প্রতি কৃত্রিম, বানোয়াট দরদ
লক্ষ্য করি তখন মনে বেদনা এবং ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। তাই দুঃখ করে লিখেছিলাম ‘দেশদ্রোহী
হতে ইচ্ছে করে’। আমি মনে করি পাহাড়িদের ন্যায্য
দাবীগুলি মেনে নেওয়া উচিত। তাহলে পাহাড়িদের মধ্যে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কোন অবকাশ থাকবে
না। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত নেতৃবর্গ এবং সরকারের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে
সমস্যার সমাধান করতে হবে।
(ঙ) পার্বত্য এলাকায় অবিরাম মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে।
প্রাণহানী হচ্ছে অহেতুক। অথচ আমরা শান্তিপ্রিয় জনগণ এরকমটি কেও চাই না। এ ব্যাপারে
কিছু বলুন।
আমরা কেউ চাই না পার্বত্য এলাকার বাসিন্দাদের মানবাধিকার
ভুলুণ্ঠিত হোক। একই দেশের একটি বিশেষ অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা শাসন ব্যবস্থা
চলবে এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। এটি অন্যায়।
আমি আগেও বলেছি। আবারও বলছি বাংলাদেশ সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাবলীকে রাজনৈতিকভাবে
সমাধান করা। রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সুরাহা হলেই, আশা করি সেখানে শান্তি ফিরে আসবে। একটি ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হলে তা ক্যানসারে পরিণত হয়। অবিলম্বে পার্বত্য
চট্টগ্রামে এই ক্ষত সারিয়ে ফেলা দরকার। কেননা, এই ক্যানসার বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত
ক্ষতিকর।
-------------------------------
পাতা: ২৯ - ৩০
-------------
-------------
বিশেষ
প্রতিবেদন
পাহাড়ি বন্দীদের রীট
আবেদন বিষয়ক
বিশেষ সংবাদ
প্রতিবেদন
আইন সালিশী কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মানবাধিকার
সংস্থার আর্থিক সহায়তায় এ যাবৎ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক ৪২ জন পাহাড়ির জন্য মহামান্য হাই কোর্টে
রীট আবেদন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ব্যারিষ্টার আমীরুল ইসলামের
নেতৃত্বে পরিচালিত Law Associates, Globe Chamber (2nd floor), 104 Motijheel
Commercial Area, Dhaka-2, Bangladesh. Phone – 234098, 256294 এবং মোহাম্মদ নিজামুল হক নাসিম, এ্যাডভোকেট
এর নেতৃত্বে পরিচালিত আর একটি আইনজীবী গোষ্ঠী এই পিটিশনে দরখাস্তকারীদের পক্ষে মামলা
পরিচালনা করছেন। ঢাকায় অধ্যয়নরত পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীরা দরখাস্তকারী হয়ে এই সমস্ত রীট
পিটিশন দাখিল করেছেন। এ পর্যন্ত ২৬ জন বন্দীর আটকাদেশ মহামান্য হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা
করেছেন এবং সব কয়জন বন্দীর মুক্তির আদেশ মার্চ মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা
প্রশাসক ও কারা কর্তৃপক্ষের বরাবরে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃপক্ষ প্রেরণ করেছেন। তাদের
নাম ও ঠিকানা এবং রীট পিটিশন নং নিম্নে দেয়া হল :
ক্রমিক নং নাম পিতার নাম ঠিকানা রীট পিটিশন নং
১। দিল্লী মোহন চাকমা রাজেশ্বর চাকমা হাজাছড়ী পশ্চিম পাড়া, নানিয়াচর ৩২৭৮/৯১
২। মনতোষ দেওয়ান মোহিনী মোহন দেওয়ান রাজা নগর, রাঙ্গুনিয়া ৩২৭৬/৯১
৩। মার্থন চাকমা --- ---- ৩২৭৪/৯১
৪। অনিল বিকাশ চাকমা মদন্যা চাকমা গলাছড়ি, লংগদু ৩২৭৫/৯১
৫। শান্তিজয় চাকমা সরৎ কুমার চাকমা দেবাছড়া, কাউখালি ৩৩৭৮/৯১
৬। চ¤পুমণি চাকমা মোনিন্দ্র চাকমা কুলবাং, বরকল ৩৩৭৭/৯১
৭। কামিনী কুমার চাকমা মৃত কালি কুমার চাকমা ভাইবোনছড়া, বাঘাইছড়ি ৩৩৭৯/৯১
৮। রমেশ চন্দ্র চাকমা মৃত বগড়া চাকমা ভঙ্গছড়া, মারিশ্যা ৩৩৮৭/৯১
৯। সংঘসুর চাকমা --- --- ৩৩৮০/৯১
১০। ইন্দ্র বিকাশ চাকমা দিনো মোহন চাকমা ইরুকিছড়া, রেইং খং ৩২৭৭/৯১
১১। পলাশ চাকমা --- --- ৩১৫৪/৯১
১২। সাজাইমং মারমা কংজপ্রু মারমা কলোনা ইখ্যামুখ, কাপ্তাই ৩১৬০/৯১
১৩। রণজিৎ তঞ্চঙ্গ্যা কৈলাশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা বাশবুন্যা, রাঙ্গুনিয়া ৩১৬১/৯১
১৪। অমর সিন্দু চাকমা ---- ---- ৩১৭৬/৯১
১৫। প্রবীন বিকাশ খীসা মৃত, রাজেন্দ্র লাল খীসা --- ৩১৭৭/৯১
১৬। সুবোধ কুমার চাকমা যুদ্ধধন চাকমা সার্বোয়াতুলি ৩১৭৮/৯১
১৭। বিমল চাকমা মজি- চাকমা সেওয়াপাড়া, লক্ষীছড়ি ২০২/৯২
১৮। সুনীল চাকমা --- --- ২০৩/৯২
১৯। সুখেন চাকমা --- --- ২০৪/৯২
২০। অনিল কুমার চাকমা --- --- ২০৫/৯২
২১। অচিন্ত্য কুমার চাকমা বানো রঞ্জন চাকমা বড়াদাম, দিঘীনালা ৩১৮/৯২
২২। মংগল মোহন চাকমা মৃত, কদম জয় চাকমা থানাপাড়া, দিঘীনালা ৩১৯/৯২
২৩। সাধন চন্দ্র চাকমা মৃত, মুনি চাকমা তারাবনিয়া, দিঘীনালা ৩২০/৯২
২৪। জ্ঞান প্রদীপ চাকমা দিনো মোহন চাকমা থানাপাড়া, দিঘীনালা ৩২১/৯২
২৫। অজয় বিকাশ চাকমা বারিবিন্দু চাকমা থানাপাড়া, দিঘীনালা ৩২২/৯২
২৬। হৃদয় রঞ্জন চাকমা মৃত চন্দ্র কিশোর চাকমা পুকুর ঘাট, দিঘীনালা ৩২৩/৯২
এদের মধ্যে ১৭/৩/৯২ইং সাধন চন্দ্র চাকমার
রীট পিটিশন শুনানী চলাকালে সরকারী পদের বিজ্ঞ সহকারী এটর্নী জেনারেল আটক ব্যাক্তিকে
মুক্তি দেয়া হয়েছে দাবী করলে মাননীয় বিচারপতি এই রীট পিটিশন ডিস্চার্জ করে দেন। সে
কারণে সাধন চন্দ্র চাকমার মুক্তির আদেশ প্রেরণ করা হবে না। কাজেই সাধন চন্দ্র চাকমার
মুক্তির ব্যাপারে জটিলতা দেখা দিলে তার নিকট আত্মীয়কে অতিসত্ত্বর ঢাকায় যোগাযোগ করে
তার মুক্তির আদেশ নিয়ে যেতে তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া যাদের মুক্তির আদেশ মহামান্য
হাইকোর্ট থেকে প্রেরণ করা হয়েছে অথচ (অন্য কোন মামলা না থাকলে) মুক্তির ব্যাপারে জটিলতা
দেখা দিয়েছে, তাদের নিকট-আত্মীয়দেরকে তাৎক্ষণিকভাবে
ঢাকায় এসে যোগাযোগ করার জন্য আইনজীবীরা তাগিদ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আত্মীয়কে
আইনজীবীর সাথে যোগাযোগে অপারগ হলে তাৎক্ষণিকভাবে
৩২০ পূর্ব জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা - অথবা ৪৭০ জগন্নাথ হল অক্টোবর স্মৃতি
ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা এই ঠিকানায় যোগাযোগ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া যাদের রীট পিটিশন মহামান্য হাইকোর্টে
শুনানীর জন্য অপেক্ষায় আছে তাদের নাম ঠিকানা নিম্নে দেয়া হল :
ক্রমিক নং নাম পিতার নাম ঠিকানা রীট পিটিশন নং
১। সুভাষ জ্যোতি চাকমা অক্ষয় মুণি চাকমা বাবুছড়া, দিঘীনালা ৩৫৫/৯২
২। নুতন নাগর চাকমা মৃত, কালাচান চাকমা বানছড়া, দিঘীনালা ৩৫৬/৯২
৩। অজিতেশ্বর চাকমা প্রাণ কুমার চাকমা রাঙ্গাপানিছড়া, দিঘীনালা ৩৫৭/৯২
৪। কৃপাচন্দ্র চাকমা নাওমা চাকমা বানছড়া, দিঘীনালা ৩৫৮/৯২
৫। পরিমল চাকমা লালন চন্দ্র চাকমা ৩১নং যৌথখামার, দিঘীনালা ৩৫৯/৯২
৬। বিনতা রঞ্জন চাকমা মৃত পূর্ণমাসি চাকমা ১নং যৌথখামার, দিঘীনালা ৩৬০/৯২
৭। অর্ধেন্দু বিকাশ চাকমা বরুণ মোহন চাকমা থানাপাড়া, দিঘীনালা ৩৬১/৯২
৮। দেবসিন্দু চাকমা তালুক চন্দ্র চাকমা পুচগাং, পানছড়ি
৯। কেহলা চাই মারমা কৈ ইচাই মারমা রক্তছড়ি, কাউখালি
১০। হৃদয় কুমার চাকমা জয়ন্ত কুমার চাকমা বেতছড়ি, খাগড়াছড়ি
১১। অযোধ্যা চাকমা চন্দ্র মোহন চাকমা হারুবিল, পানছড়ি
১২। শশী রঞ্জন চাকমা সত্যাধন চাকমা বরকল
১৩। ধীমান চাকমা আদিত্য কুমার চাকমা পশ্চিম জগনাতলী
১৪। চক্কুয়া চাকমা গোপাল চন্দ্র চাকমা মনারটেক
১৫। ধনমুনি চাকমা মৃত দিলীপ কুমার চাকমা বড়াদাম, রাঙ্গামাটি
উপরোক্ত আটক ব্যাক্তিদের মধ্যে অজিতেশ্বর
চাকমা ও কৃপাচন্দ্র চাকমাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞ সরকারী এটর্নী জেনারেল মহামান্য
হাইকোর্টকে জানিয়েছেন। এরা ইতিমধ্যে মুক্তি না পেলে তার আত্মীয়কে অতিসত্বর ঢাকায় যোগাযোগ
করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। এই তাগিদ অন্যান্যদের ক্ষেত্রেও দেয়া হয়েছে। তাছাড়া যারা
মুক্তি পেয়েছেন তাদেরকেও ঢাকায় অবগত করানোর অনুরোধ করা হয়েছে। - প্রতিবেদক মিঃ অলীক।
পাতা- ৩১
--------
--------
---------------------------------------------------
বিঝু-সাংগ্রাই-বৈসু উপলক্ষে
পাহাড়ি
ছাত্র পরিষদের
শুভেচ্ছা বার্তা
মহান ঐতিহ্যবাহী বিঝুতে (সাংগ্রাই-বৈসু) আমরা পার্বত্য
চট্টগ্রামের স্বাধিকারহারা নিপীড়িত-নির্যাতিত কন্ঠরুদ্ধ পাহাড়ি জনগণকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
এবারের বিঝু আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ৫০ হাজারের অধিক বাস্তুভিটাহারা হতভাগা মানুষের
কথা, যারা বিঝু’র মতো একটি বড় উৎসব থেকে বঞ্চিত, যারা আত্মীয়-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ দেশে দুঃসহ
দিনাতিপাত করছে। তাদের অনুপস্থিতিতে বিঝু উৎসবের আনন্দ অসম্পূর্ণ থেকে
যাবে।
আমরা দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে স্মরণ করছি - আমাদের অকুতোভয় অনেক সহযোদ্ধাদের,
যারা বিনাদোষে অন্যায়ভাবে আটক হয়ে কারাগারে মুক্তির প্রহর গুনছে। তাদের অনুপস্থিতিতেও
আমাদের বিঝু উৎসবের আনন্দ ম্লান হয়ে যাবে। আসলে এ বিঝুতে আনন্দ করার নয়। শপথ উচ্চারণ
করার দিন। সে-ই দিনই বিঝুর সার্থক আনন্দ হবে - যেদিন স্বাধিকারহারা মানুষ
তাদের অধিকার ফিরে পাবে।
তবুও এ বিঝু মানুষের জন্য কিছুটা হলেও আশা বয়ে আনুক - এই শুভ কামনায়।
কেন্দ্রীয় কমিটি
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ।
---------------------------------------------------------------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন