পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২৩ মে, ২০১৮

রাডার লোগাং গণহত্যা সংখ্যা


* পিডিএফ কপি পেতে ক্লিক করুন এখানে


রাডার লোগাং গণহত্যা সংখ্যা

সম্পাদকীয় নোট
রাডারের লোগাং গণহত্যা সংখ্যা (চতুর্থ) আপলোড করা হলো। ১ জুন ১৯৯২ প্রকাশিত এই সংখ্যাই রাডার নামে হিল লিটারেচার ফোরামের সর্বশেষ প্রকাশনা, কারণ তকালীন সরকার এই সংখ্যার পরবর্তী সকল সংখ্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তবে হিল লিটারেচার ফোরাম স্যাটেলাইট নামে পরবর্তী প্রকাশনা বের করে, যা পরে এখানে আপলোড করা হবে।
রাডার ‘লোগাং গণহত্যা সংখ্যা ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল সংঘটিত রোমহর্ষক লোগাং গণহত্যার পর প্রকাশিত হয়েছিল।
এই সংখ্যা পাঠে তকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে। সে সময় সরকার বিশেষত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে পড়ে ওঠা গণ আন্দোলন দমনের জন্য জেল-জুলুম জারী রাখে এবং উগ্রসাম্প্রয়িক সেটলার সংগঠনগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এর পরিণতিতে রাঙ্গামাটি শহরে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে  হামলা ও পাহাড়ি বসতিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। তখনকার এই বাস্তবতা রাডার অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল।
রাডারের পূর্বের সংখ্যাগুলোর মতো এই সংখ্যায়ও ভুল বানান সংশোধন করা হয়েছে। তারপরও কোথাও কোন ভুল চোখে পড়লে তা ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ থাকলো।
----------------
রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১লা জুন ’৯২
লোগাং গণহত্যা সংখ্যা

সাক্ষাতকার : দিলীপ বড়ুয়া
খালেদার নিকট চিঠি : EC ঢাকা; CHT ক্যাম্পেইন, নেদারল্যাণ্ড
--------------------------------------------------------------------------------
অকথিত সাগরের কথা ও লোগাং
                                              - মিঃ সুপ্রিয়

পড়ন্ত মৃদু লাল চিকচিকে সূর্য্যটা হারিয়ে যাচ্ছিল বিশ্বলোকের কুয়াশার গভীরে। আমাদের ডলফিন কোচ ফেরীতে উঠল। সাগরের বিষাদময় চাহনি দেখে অনেক কিছুই মনে পড়ল। তার কপোল জুড়ে অশ্রু শুকিয়ে গেছে। কদিন ধরে সে থেকে থেকে কাঁদছিল। ফেরীর রেলিং-এ দাঁড়িয়ে কিছুটা এদিক ওদিক তাকাই। জিজ্ঞেস করি কি নাম। চন্দ্র সাগর।   
প্রিয় পাঠক, চন্দ্র সাগর একটি হতভাগ্য কিশোরের নাম। একটি অনিশ্চিত জীবনের অস্তিত্ব। একই সাথে একটি ভয়াল গণহত্যার  জ্বলন্ত সত্ত্বা। জীবন্ত সাক্ষী। ১০ই এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে যে নারকীয় হত্যালীলা চালানো হয় তাতে এই কিশোর তার চোখের সামনেই প্রত্যক্ষ করে অনেক বীভস অপহত্যা। তাকেও ধারালো দা দিয়ে কোঁপাচ্ছিল মোহম্মদ শামসু নামের অনুপ্রবেশকারী জানোয়ারটি। ভাগ্যক্রমে সে দৌড়ে পালাতে থাকে। পালাতে গিয়ে জাকির আনসার তাকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। অলৌকিকভাবে মৃত্যু তাকে স্পর্শ করেনি। পরে এই জাকির আনসারের গুলিতে অরবিন্দু মাষ্টারকে ঢলে পরতে দেখল সে। খানিক দূরে সে দেখল দুই বছরের ফেন্সীকে ইদ্রিস মিয়া তিন টুকরো করল। ভুদি চাকমাকে কেটে ফেলল। শামসু-র ভাই মোহাম্মদ খনা রূপসেনকে আঘাত করল। শাহজাহান অরুন কান্তিকে, আলী আহম্মদ সুমিত্রাকে আঘাত করতেও দেখল সাগর। মধ্যযুগীয় নারকীয় তা-ব প্রত্যক্ষ করল এই কিশোর।
চট্টগ্রামের এক আশ্রমে থাকত সে। চৈত্রসংক্রান্তি (বৈ-সা-বি) উসব উপভোগ করতে সে তার বাবা মায়ের কাছে ঐ লোগাং গুচ্ছগ্রামে যায়। ঘটনার দিন তার বড় ভাই পাশের ছড়ায় (খাল) মাছ ধরতে যায়। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। সাগরের প্রিয় দাদু ও তার আদরের দুই শিশু ভাইপো এবং ভাইঝি -কে আগুনে মারা হয় বলে তার ধারণা। তার মা বাবা ও বৌদির খোঁজ সে এখনো জানে না। তারা আদৌ কি জীবিত না মৃত ? এ প্রশ্নের উত্তর কার কাছে পাবে সাগর। হৃদয়বিদারক সে দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে যেয়ে সাগর এখন আর কাঁদে না। হয়ত বা কাঁদতে পারে না। যেমনিভাবে লোগাং-এর ঐ নিরীহ মানুষগুলো ভুলে গেছে কিভাবে কাঁদতে হয়। ঘটনার আকস্মিকতা আর নির্মমতায় এলাকাবাসী বাকরুদ্ধ। মুহুর্তে একটা প্রাণবন্ত জনবসতি শ্মশানে পরিণত হবে কেউ ভাবতে পারেনি। ঘটনার পরদিন ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে সাগর তিনটি দাবী করেছিল। এক) আমাদেরও আক্রমণ প্রতিহত করতে দিন এবং আপনারা নিরপেক্ষ থাকুন; দুই) আমাদের স্বজনদের লাশ ফিরিয়ে দিন; তিন) সীমান্ত খুলে দিন আমরা আবার ভারতে আশ্রয় নেবো। সেদিন সেনা কমাণ্ডার কিছুই জবাব দিতে পারেনি।  
লোগাং গণহত্যা পার্বত্য জনগণের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম। সাড়ে সাত শত পরিবার অধ্যুষিত লোগাং গুচ্ছগ্রামের গণহত্যায় কত মানুষ যে মারা গেছে তার সঠিক সংখ্যা বের করা খুবই কঠিন। প্রত্যেকটি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মারাত্মকভাবে। কোন কোন পরিবারের কেউ আর বেঁচে নেই। অধিকাংশই হারিয়েছে স্বজন। আগুনে ছাই হয়েছে পুরো গ্রাম।  
চন্দ্রসাগর আজ দুঃখ, শোক ও ক্ষোভে পাথর। এ পাথরের আঘাতেই মৃত্যু হবে শত্রুর। লোগাং গণহত্যা অনেকের মতো তাকেও করে তুলেছে এক দৃপ্ত সংগ্রামী। প্রিয় স্বজনের মৃত্যুর প্রতিশোধের আগুন ঢাউ ঢাউ জ্বলে তার উজ্জল দু’ চোখে। নিজের মাটিতেই নিজের অস্তিত্ব খুঁজে নেবে - এই তার প্রতিজ্ঞা। শহীদের তাজা লাল রক্ত চন্দ্রসাগরের মতো যে বীর সৈনিকের জন্ম দিয়েছে সে রক্ত কোনদিন বৃথা যেতে পারে না। গণহত্যাকে হত্যা করার জন্যই চন্দ্রসাগরদের জন্ম হয়। অস্তিত্বের শত্রুদের চিরতরে ধ্বংস করার জন্যই চন্দ্রসাগর আর আমরা বেঁচে থাকি।
----------------------------------
রক্তাক্ত লোগাং
---------------------
রাংগামাটিতে বর্ণবাদের গন্ধ
সন্ত্রাসের লাগাম কার হাতে?





চি ঠি প ত্র
--------------
দালাল তালিকা শীঘ্রই প্রকাশ করা হউক
সংগ্রামী সম্পাদক/
আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পার্বত্য জনগণের একমাত্র মুখপত্র “রাডার” যথাসাধ্য প্রকাশ করে যাচ্ছেন তার জন্য “রাডার” -এর সাহসী কর্মীবৃন্দকে আন্তরিক ধন্যবাদ।    
“বৈসাবি” সংখ্যায় আপনাদের ঘোষিত “দালাল তালিকা” প্রকাশের যে উদ্যোগ তা সত্যি প্রশংসনীয়। কারণ অনেক মুখোশধারী দালালদের দ্বারা পাহাড়ি জনগণ ও বৃহত্তর বাঙালি জনগণ নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছেন। তাই এই প্রতারণার হাত থেকে জনগণকে সতর্ক করার নিমিত্তে “দালাল তালিকা” সত্ত্বর প্রকাশ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। যাতে জনগণ এই প্রতারকদের হাত থেকে সত্ত্বর মুক্তি পেতে পারে। এই জন্য “দালাল তালিকা” প্রকাশ করার জন্য ঐকান্তিক অনুরোধ রইল।      
পরিশেষে রাডারের দীর্ঘায়ু কামনা করে .........
মংহ্লা চিং মারমা/মহালছড়ি 
[আমাদের হাতে প্রচুর দালালের নাম ঠিকানা এসে গেছে। এব্যাপারে পাঠকদের কাছ থেকে আরো ব্যাপক সাড়া পেলে প্রকাশ করা হবে]

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্ববিরোধীতা      
গত ১৩ মে ১৯৯২ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া খাগড়াছড়ি সফরে যান। তার এ সফর মুলতঃ লোগাং-এ সংঘতিত হত্যাকা-ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা। যা হউক লোগাং হত্যাকা-ের দীর্ঘ একমাস পর প্রধানমন্ত্রী লোগাং যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তার এই দায়িত্ববোধের (?) জন্য তাকে ধন্যবাদ।
হত্যাকা-ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তথাকথিত “স্থানীয় সরকার পরিষদ”-এর নতুন ভবনটিও উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী ভাষণে পার্বত্য এলাকার সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার কথা উচ্চারণ করলেও এই “গণতান্ত্রিক” সরকারের স্বৈরাচারি ভাব লুকাতে পারেন নি। পার্বত্য জনগণ কর্তৃক জেলা পরিষদ ও পার্বত্য এলাকায় মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনীদের যৌথ উদ্যোগে পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধান করে শান্তি ফিরে আনবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায় আদতে পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধানে তার আন্তরিকতা কতটুকু। যে সেনাবাহিনী আজ সুদীর্ঘ ১৬/১৭ বছর যাব পাহাড়ি জনতার উপর দমনপীড়ন চালিয়ে আসছে, যে সেনাবাহিনীর দ্বারা পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধান সম্ভব হচ্ছেনা, সে সেনাবাহিনী আবার পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধান করবে, এই কথা বেগম খালেদা জিয়া বিশ্বাস করলেও পাহাড়ি জনগণ ও দেশের বিবেকবান মানুষ বিশ্বাস করেন না। প্রধানমন্ত্রীর একদিকে রাজনৈতিক সমাধানের প্রতিশ্রুতি, অপর দিকে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা এই রকম স্ববিরোধী বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
হিরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা/খাগড়াছড়ি।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাডার পৌছানোর ব্যবস্থা করা হউক
প্রিয় সম্পাদকবাবু
মুমুর্ষু জীবন থেকে আপনাকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা সংগ্রামী শুভেচ্ছা। বহু বছরের জমাট বাধা দুঃখ বেদনা আপনার “রাডার” পড়ে কিছুটা প্রশমিত করতে পারলাম। আমি কোন দিন ভাবিনি জুম্ম জনগণের নিত্য সঙ্গী অমানবিক নির্যাতনের কাহিনী কোন প্রচার মাধ্যমে প্রচার হবে। এত দিনের এই বদ্ধমুল ধারণা “রাডার” ভাঙতে পেরেছে। তাই এক বেলার ভাত না খেয়েও “রাডার” কেনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। যদিও একবেলা ভাত আমাকে একদিন বাঁচার নিশ্চয়তা দেবে, কিন্তু “রাডার” দেবে আজীবন বেঁচে থাকার প্রেরণা। তাই “রাডার” এর এন্টি ব্যারিকেড ভেঙ্গে পার্বত্য এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোঁছানোর নিশ্চিত ব্যবস্থা করা হউক।
রাজ ত্রিপুরা/ রাঙ্গামাটি। 
[এই প্রচেষ্টা শুধু “রাডার” প্রকাশনার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি সচেতন পাঠকের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।]

লোগাং হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা প্রকাশের জন্য “রাডার” কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন
গত ১০ এপ্রিল ১৯৯২ তারিখে লোগাং-এ ঘটে গেল স্বাধীন বাংলাদেশের সবচে বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। এ হত্যাকা- বৃহত্তর দেশের জনগণ ও বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে ঢাকা থেকে যে সকল বুদ্ধিজীবি, আইনজীবি, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও ছাত্র নেতারা পাহাড়ি জনগণের দুঃখের সাথে সামিল হয়েছেন তাদেরকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। সরকার এই বর্বরতম হত্যাকা- ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রথমাবস্থায় বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিলেও উক্ত গণতান্ত্রিক ব্যক্তিদের সহায়তায় সেই অপকৌশল আপাতত বুমেরাং হয়ে আসল চিত্র দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর নিকট উন্মোচিত হয়ে যায়। ইদানিং “গণতান্ত্রিক সরকার” আরও বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে জনগণের ও বিশ্ব মানবতাবাদীদের চাপে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তা কতটুকু নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে দেশবাসীর মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। তাই সরকার যাতে তার এই নীল নক্সা বাস্তবায়ন করতে না পারে তার জন্য “রাডার” কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সে আবেদন রইল। প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরার সর্বাত্মক সহযোগীতায় পার্বত্যবাসী সব সময় “রাডার” -এর পাশে থাকবে। এই প্রত্যাশা রেখে “রাডার” প্রকাশনার সকল সদস্যদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে আজকের মত বিদায়।
নিকিলাস চাকমা/ খাগড়াছড়ি।
 [“রাডার” এব্যাপারে সবসময় প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে]

-----------------------------------------------------
বিজ্ঞপ্তি
রাডারের বর্তমান সংখ্যা প্রকাশের একেবারে শেষ মুহুর্তে আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠিয়েছেন। অনেকে চিঠিও লিখেছেন। দেরীতে পৌঁছানোর জন্য এসমস্ত তথ্যাবলী বর্তমান সংখ্যায় ছাপানো সম্ভব হলো না বলে দুঃখিত। পরবর্তী সংখ্যার জন্য আরো রিপোর্ট পাঠানোর জন্য সংবাদদাতা ও পাঠকদের প্রতি অনুরোধ রইল।
“রাডার” সম্পাদনা পরিষদ
------------------------------------------------------

আর নয় রাজনীতি নির্ভর নিরস গদ্য
সুপ্রিয় পাঠক আমরা আগামীতে একটি সাহিত্য সংখ্যা প্রকাশের আয়োজন করছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগণের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সতত লালন করে স্বকীয় সত্ত্বা বিকাশে একটি সৃজনশীল আন্দোলন শুরু করতে চাই আমরা। রাজনৈতিক অধিকার সচেতনতার পাশাপাশি নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও যুগপ সংরক্ষণ ও বিকাশের তাড়না তরান্বিত করতে হবে নিঃসন্দেহে। অতএব, ছোট গল্প, গল্প, উপন্যাস, লোক কাহিনী, রূপকথা, কবিতা লিখুন এবং আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন।
------------------------------------------------------------


সম্পাদক                   : মিঃ সুপ্রিয়                                                                                        
নির্বাহী সম্পাদক           : মিঃ মানবমিত্র                                                                            
প্রধান প্রতিবদেক          : মিঃ সৌরভ সিজেল                                                                 
সার্কুলেশন ম্যানেজার     : মিঃ পল্লব   


অংকন                       : মিঃ রসদ                                                                             
শিল্প নির্দেশনা             : মিঃ ধীবর

যোগাযোগ (বার্তা ও চিঠি) :- 
* ৩২০, পূর্ব বাড়ী, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রাপ্তি স্থান :-
* পাঠক সমাবেশ, ১৭/এ আজিজ মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।    
* দীপ্ত প্রকাশনী, ৬৮/২ পুরানা পল্টন, বাসস-এর নীচে। 
* কারেন্ট বুক সেন্টার, চট্টগ্রাম। 
* বুক স্টল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
* ৩৫৬, নবাব আব্দুল লতিফ হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। 
* ৪১৯/ বি, শামসুল হক হল, বাংলাদেশ কৃষি বিঃ ময়মনসিংহ।
-------------------------------------------------------------


রাডার
সম্পাদকীয়
<> নিরাপত্তা বাহিনীর নগ্ন আক্রমণে লোগাং-এ সংঘটিত নারকীয় গণহত্যায় সত্যিই একটি রক্তের নদী রচিত হলো সেদিন। লাশে পরিণত হল শত শত নিরীহ জীবন। বুলেট, বেয়নেট আর ধারালো দাওয়ের আঘাতে বিক্ষিপ্তভাবে মৃত দেহ পড়ে থাকল। নিকটস্থ সূর্য তরুন ক্লাবে জড়ো করা হল কয়েক শত লাশের স্তুপ। নিমেষেই ছাই হয়ে গেল হাজার পরিবারের গ্রাম। খবর ছড়িয়ে যায় দ্রুত। পার্বত্য কোলে জমাট বাঁধে শোকের মেঘ। দু’দিন পরে চৈত্র সংক্রান্তি উসবের আনন্দ বেদনায় রূপ লাভ করে। অতপর বুক কাঁপে শংকায়। কাঁদো পাহাড়ি জনতা কাঁদো।

<> পিলে চমকানো ক্ষোভ, দুঃখ প্রতিবাদ নাড়া দিয়ে যায় প্রতিটি জুম্ম নর নারীর হৃদয়ে। শোকে যেমন মুর্চ্ছে পড়ে, তেমনি বিক্ষোভে ফেটে পরে শত গুণে নিপীড়িত মানুষ। তারপর পেছনে ফেলে আসি আরো ক’টা দিন। কিছুটা শান্ত হয় পরিবেশ। কিন্তু না, চল্লিশ দিনের মাথায় রাঙ্গামাটিতে আবার হামলা চালানো হয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদ্যাপনের দিনে। আমাদের আশংকা বেড়ে যায়। অবিশ্বাস অনাস্থা বেড়ে যায় এ সরকারের প্রতি। প্রধান মন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী তন্ত্রী ঘটনাস্থল দেখতে যান। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। আমরা ভাবতে থাকি এসব ভেজা বেড়ালের ন্যাকামী। সময় মত ঠিকই নখর থাবা বেরুবে তুলতুলে হাতের ভেতর থেকে। তাই নিশ্চিন্ত হবার কোন অবকাশ নেই, প্রিয় জনতা।

<> কাউন্টার ইনসার্জেন্সীর সেনা কর্তৃপক্ষ ক্রমশঃ পার্বত্য চট্টগ্রামকে কাশ্মীর, প্যালেষ্টাইন বা অন্য কিছু বানানোর পাঁয়তারা করছে। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের অবশেষ আর কোথায় রাখল তারা। এখনো সরকার তালবাহানা করছে। সামরিক দমনে তার আজো অবিচল মনোভাব। দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে - হে প্রিয় জুম্ম জনগণ। দ্রোহের আগুনে জাগাতে হবে ভয়ার্ত জীবনে। প্রতিরোধের রুদ্র রোষে শাণিত করো ত্রস্ত চেতনাকে। এ যুগের প্রজন্ম সংগ্রামের ডাক দিয়ে যায়। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার সংগঠিত শক্তি বেগবান করবেই আমার তারুণ্যের মহাশক্তিকে। সামনে স্বাধিকারের জীবন আমাদেরই।
--------------------------------------------------------------------------------------
“হিল লিটারেচার ফোরাম” -এর পক্ষে “রাডার” প্রকাশনা কমিটি ও সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত


----------------
ঘ ট না প্র বা হ
----------------

লোগাং-এ নিহতদের উদ্দেশ্যে শোক সভা ও মিছিল
১০ই এপ্রিল বিডিআর, ভিডিপি, আনসারসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা সংঘটিত ভয়াবহতম গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটি কর্তৃক খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে যথাক্রমে ১২ ও ১৪ ই এপ্রিল শোক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈ-সা-বি উসব বর্জন করা হয়। এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ১৩ই এপ্রিল খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় ১৯ এপ্রিল এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ মৌন মিছিল বের করে এবং প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে মৌন পদযাত্রা
লোগাং-এ নিহতদের উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন ও শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে গত ২৮ শে এপ্রিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে লোগাং-এর উদ্দেশ্যে মৌন পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এই পদযাত্রা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান থেকে আগত হাজার হাজার ছাত্র জনতা অংশ গ্রহণ করে। ঢাকা থেকে বাসদ নেতা আব্দুল্লাহ সরকার এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের নেতা নূর আহমেদ বকুল, রুহিন হোসেন প্রিন্স, আব্দস সাত্তার খান সহ অনেক ছাত্র নেতা ও সাংবাদিক এ পদ যাত্রায় সামিল হন। গত ১০ই এপ্রিল গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল সেই লোগাং গুচ্ছগ্রামে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নিহতদের স্মরণে পুস্পস্তবক অর্পন করে এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। এর পর সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সভা হয়। এতে সবার পক্ষে বক্তব্য রাখেন জনাব আব্দুল্লাহ সরকার।

গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের দেশ ব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল         
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ও লোগাং হত্যা কা-ের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীতে গত ৭ই মে গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য সারা দেশ ব্যাপী মিছিল ও সমাবেশ করে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই বিক্ষোভ সমাবেশে ছাত্র নেতা নাসিরুদ্দোজা ও নাজমুল হক প্রধান বক্তব্য রাখেন। তাছাড়া ৬মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রথম বারের মত একই দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

ঢাকায় শোক মিছিল ও স্মারকলিপি প্রদান  
১০ই এপ্রিল লোগাং হত্যাকা-ের প্রতিবাদে গত ১৮ই এপ্রিল রাজধানী ঢাকাতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এক শোক মিছিল আয়োজন করে। উক্ত মিছিলে শতাধিক পাহাড়ি ছাত্র ছাত্রী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হতে মিছিল সহকারে বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রদক্ষিণ করে প্রেস ক্লাবে যায়। প্রেস ক্লাবের সম্মুখে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে আবারও মিছিল সহকারে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় তেঁজগাও-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মিছিলটি বাংলা মোটরে এসে পৌছলে পুলিশ বাধা প্রদান করে। সেখান থেকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পুলিশের জীপে করে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে লোগাং-এর হত্যাকা-ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।
.............................

কৃষ্ণমা ছড়া গ্রামে বিশাল জনসমাবেশ
গত ১৫ই মে ৯২ নানিয়ারচর উপজেলাধীন কৃঞ্চমা ছড়া গ্রামে সামরিক বাহিনীর অব্যাহত জেল-জুলুম ও অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদে এক বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে আশেপাশে সাতটি গ্রামের ছাত্র-কৃষকসহ সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেন। উক্ত সভায় সভাপতির ভাষণে অনুরূপ চাকমা বলেন, পার্বত্য এলাকায় অব্যাহত ধর্ষণ, নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিটি গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সংগ্রাম করে কোন জাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি বরং অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 
সমাবেশ শেষে একটি গণমিছিল বের হয়। মিছিলটি কৃঞ্চমাছড়া গ্রাম থেকে আরম্ভ হয়ে মাইচছড়ি, ধার্য্যছড়ি, হাতিমারা ও রামহরি পাড়া গ্রাম প্রদক্ষিণ করে শেষ হয়। উল্লেখ্য, পার্বত্য এলাকায় গ্রাম পর্যায়ে এ ধরণের গণসমাবেশ ও মিছিল এই এলাকায় এটাই প্রথম।
                                                       - নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত।
...........................




মানবাধিকার
পার্বত্য চট্টগ্রাম
সেনাসন্ত্রাসের কবলে মানবাধিকার
--------------------------------------
[এক ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। ক্ষমতায় আসীন হয়েছে বহুল কথিত একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। তারপর এক বসরাধিক কাল অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু তবুও পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। জেল-জুলুম, হত্যা, ধর্ষণ, শারিরীক নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্মীয় পরিহানি ইত্যাদি মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ আগের মতোই বর্তমান কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও অহরহ ঘটে চলেছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের খবরগুলো এই কলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি- সম্পাদনা পরিষদ]
-------------------------------------------------------------------------------------------------

দিঘীনালা
(১)
সেনাবাহিনীর মাল অন্যত্র বহন করতে অপরগতা প্রকাশ করায় .........
গত ১৫/৪/৯২ তারিখে বাবুছড়া আর্মি ক্যাম্পের (৮২ বেঙ্গল) কোয়াটার মাষ্টার মিঃ মতি আনুমানিক রাত দশটায় পাশ্ববর্তী বাবুছড়া গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মিঃ চিত্ত রঞ্জন চাকমা (৪০) পীং মৃত কালেন্দর চাকমা এবং মিঃ জহরলাল চাকমা (২৪) পীং দয়াল চন্দ্র চাকমাকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যায়। সে উক্ত দু’জনকে সেই রাতে কিছু জিনিষ-পত্র জারুলছড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলে। রাত বেশী হওয়ায় চিত্তরঞ্জন ও জহরলাল অপারগতা প্রকাশ করে তার পরের দিন সকালে পৌঁছে দেবে বলে জানায়। এই অপরাগতা প্রকাশ করাতে কোয়ার্টার মাষ্টার মতি উক্ত দু’জন পাহাড়িকে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছামত মারধর করে এবং বুটজুতা পরা অবস্থায় তাদের গায়ের উপর উঠে লাফাতে থাকে। শেষে চিত্তরঞ্জন চাকমার পায়ে ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করলে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়। এভাবে দীর্ঘক্ষণ মারধর করার পর দুইটা করে প্যারাসিটামল ও ১০০ টাকা করে প্রদান করে দ’জনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
+ + + + + + + + +

(২)
খুকুমনি চাকমাকে রহস্যজনক গ্রেফতার
গত ২৭/৪/৯২ তারিখ অর্থা বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যখন খাগড়াছড়ি সফরে গিয়েছিলেন, সে উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে এক বিরাট জনসভা হয়। সেই জনসভায় খাগড়াছড়ির বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও লোকজন এসে হাজির হয়। ঠিক অনুরূপভাবে উক্ত জনসভায় আসার জন্য খুকুমনি চাকমা (২৫) পীং গৌবিন্দ বিজয় চাকমা গ্রাম- নোয়াপাড়া মুখ, উপজেলা- দিঘীনালা কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে দিঘীনালা বাস ষ্টেশনে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় দিঘীনালা থানার পি,এস,ও, আব্দুল হাই সাদা পোষাকে ষ্টেশনে অপেক্ষারত লোকজনের নাম গ্রাম জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। যখন খুকুমনির নাম জানতে পারলেন তখন কোন কথা না বলে থানায় নিয়ে যায়। আমাদের সংবাদদাতার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাকে কোথায় কি অবস্থায় রাখা হয়েছে তা জানা যায়নি।
=  =  =  =  =  =  =  =  =

খাগড়ছড়ি সদর

ধর্ষণকারীর শাস্তি পঞ্চাশ টাকা জরিমানা
গত ২৩/৪/৯২ রোজ বৃহস্পতিবার মিঃ পুলেন ত্রিপুরার স্ত্রী মিসেস কেরেবালা ত্রিপুরা (২৫) পার্শ্ববর্তী ধান কলে ধান ভাঙতে যান। পথিমধ্যে রাস্তায় টহলরত আনসার (৪৭ ইষ্ট বেঙ্গলের অধীনে) নুরনবী (২নং ব্যাটালিয়ন) মিসেস কেরেবালাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। কেরেবালার চিকারে পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীরা এগিয়ে আসলে ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঘটনাটি প্রকাশ হয়ে পড়লে সেখানকার পোষ্ট কমা-ার আনসার নুরনবীকে গালে দুই চড় মারে এবং পঞ্চাশ টাকা জরিমানা করে। ঘটনাটি ঘটে গাছবানের ২ নং প্রকল্প নামক গুচ্ছ গ্রামে।
                                                     + + + + + + + + +

--------------------------------------------------------------------------------------------
গর্ভবতী স্ত্রী ধর্ষিত                                                                                                           
গত ২৪/৮/৯২ রোজ মঙ্গলবার পাজ্যা চাকমার গর্ভবতী স্ত্রী বাধনী চাকমা (২৪) খাগড়াছড়ি বাজার থেকে বেলা ২টার সময় ২ কেজি চাল নিয়ে ফিরছিলেন। স্থানীয় কমলছড়ি ক্যাম্পের ১২ জন সেনা তখন রাস্তায় টহলরত ছিল। বাধনী চাকমাকে রাস্তায় একা পেয়ে জোর করে ১২ জন সেনা দানব উপর্যুপরি ধর্ষণ করে ছেড়ে দেয়। এর ফলে কয়েকদিন পর বাধনী চাকমার গর্ভপাত হয়। এ খবর প্রকাশ না করার জন্য বাধনী চাকমার স্বামী পাজ্যা চাকমাকে উক্ত ধর্ষণকারীরা এক হাজার টাকা দিতে যায়। কিন্তু মিঃ পাজ্যা চাকমা ঘৃণাভরে টাকাগুলো প্রত্যাখান করেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বাধনী চাকমার ধর্ষণকারী সেনাজোয়ানরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে রয়েছে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------                         
(২)
গরু চড়াতে গিয়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক গুলিতে নিহত
দশ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশে সবচেয়ে বর্বরতম লোগাং হত্যাকা-ের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই নর দানব সেনা বাহিনীর হাতে রাখাল বালক সাধুলাল চাকমাকে (১৮) গুলিতে প্রাণ হারাতে হল। গত ২৭/৪/৯২ তারিখ মহিশুর চাকমার ১৮ বছরের যুবক ছেলে সাধুলাল চাকমা পার্শ্ববর্তী উল্টাছড়ি মূখ গ্রামের পাশে গরু চড়াচ্ছিল। এমন সময় উল্টাছড়ি ক্যাম্পের ক্যাম্প কমা-ার মেজর মিজান তার দলবল নিয়ে সে দিকে যাচ্ছিলেন। হঠা কোন কারণ ছাড়া ঐ রাখাল সাধুলালকে লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করলে সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। সেনাবাহিনী নিহত ব্যক্তির লাশ ফেরত দেয়নি এবং অভাগা বৃদ্ধ পিতা মহিশুর চাকমাকে নিজের কাঁধে করে তার ছেলের লাশ ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয়। তাছাড়া মেজর বাহাদুর শান্তিবাহিনীরা সাধুলাল চাকমাকে হত্যা করেছে বলে জোরপূর্বক তার পিতার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে।
                                                       =  =  =  =  =  =  =

নানিয়ারচর
(১)
স্কুল শিক্ষক গ্রেফতার
বেতছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিঃ হেমন্ত চাকমাকে শান্তিবাহিনী কর্তৃক নিয়োজিত গোয়েন্দা আখ্যায়িত করে গত ৬/৩/৯২ বেতছড়ি সাবজোন থেকে হাবিলদার গফুরের নেতৃত্বে একটি সেনাদল গ্রেফতার করে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। তার পরের দিন গ্রামের মুরুব্বীরা মাষ্টারকে কেন ধরে আনা হয়েছে জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন রশিদ শান্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বলে জানিয়ে দেয়। সুতরাং তাকে ছেড়ে দেয়া সম্ভব নয় বলে ক্যাপ্টেন জানান। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মিঃ হেমন্তকে কোথায় কি অবস্থায় রাখা হয়েছে জানা যায় নি।
+  +  +  +  +  +

(২)
সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরীহ পাহাড়িদের উপর নির্যাতন অব্যাহত
গত ২/২/৯২ তারিখে বেতছড়ি গুনিয়া পাড়া ক্যাম্প থেকে হাবিলদার গফুরের নেতৃত্বে একদল আর্মি পার্শ্ববর্তী গ্রাম ডানে তৈচাকমা পাড়ায় যায়। সকাল ১০টায় ঐ গ্রামের সব লোকজন এক জায়গায় জড়ো করা হয়। সে সময় গ্রামের পাশে নিজের জমিতে নন্দ কুমার চাকমা হাল দিচ্ছিলেন। তাকে কর্মরত অবস্থায় আর্মিরা জমি থেকে ধরে নিয়ে আসে। তারপরে আরও একটা বাড়ি ঘেরাও করে ৭৫ নং বেতছড়ি মৌজার তালুকদার পাড়া নিবাসী সাপ্প্যা চাকমাকে গ্রেফতার করে। মিঃ সাপ্প্যা চাকমা ঐ গ্রামে সেদিন বেড়াতে গিয়েছিলেন। তারপর তাদের দু’জনকে গুনিয়া পাড়া আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে এসে শারিরীকভাবে নির্যাতন করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর সাপ্প্যা চাকমাকে গুনিয়া পাড়া ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দিয়ে নন্দকুমারকে নানিয়ারচর জোন হেড কোয়াটারে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ পাঁচ দিন শারিরীক নির্যাতনের পর তাকেও জোন হেড কোয়াটার থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে দুজনই প্রায় পঙ্গু। কোন কাজ কর্ম করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

(৩)
২০ কেজি চাল সেরেট্টো চাকমার কাল হয়ে দেখা দিল
গত ১২/২/৯২ তারিখে নানিয়ারচর উপজেলাধীন বেতছড়ি ইউনিয়নের অর্ন্তগত দ্বজর পাড়ার পাঁচ জন ছাত্র যথাক্রমে (১) সমেন্তু চাকমা (মালছড়ি কলেজের ছাত্র) (২) সেরেট্টো চাকমা, (৩) লক্ষী বিলাস চাকমা, (৪) বড় চোখা চাকমা, (৫) অনাদি রঞ্জন চাকমা (ওসমানগণি স্কুলের ছাত্র), তাদের পার্শ্ববর্তী বাজার সানাই বাজার থেকে ২০ কেজি চাল কিনে নৌকাযোগে বাড়ি ফিরে। পাড়ায় পৌঁছে চাল যখন ভাগাভাগি করতে যাচ্ছিল ঠিক সে সময় বেতছড়ি গুনিয়া পাড়া আর্মি ক্যাম্প থেকে হাবিলদার গফুরের নেতৃত্বে একটি সেনাদল উক্ত পাড়ায় অভিযান চালায়। উক্ত পাঁচ ছাত্র যখন চাল ভাগাভাগি করতে যাচ্ছে ঠিক সে সময় ঐ সেনা দল থেকে একজন অতর্কিতভাবে তাদের (পাঁচ ছাত্রের) উপর গুলি ছুড়ে। এতে ঘটনাস্থলে সেরেট্টো চাকমা মারা যায়। কিছুক্ষণ পর নানিয়ারচর থেকে একটি স্পীড বোট ঐ জায়গায় পৌঁছলে মিঃ বড়চোখা চাকমা ও লক্ষী বিলাস চাকমাকে পেছনে হাতজোড়া করে বেঁধে ঐ স্পীড বোটের পিছনে বেঁধে স্পীড বোটটি জোড়ে চালিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ শাস্তি দেওয়ার পর আধামরাবস্থায় স্কুলে তুলে রাখে। আর বাকী দু’জন সমেন্ত চাকমা ও অনাদি রঞ্জন চাকমাকে এক নাগারে ২০ হতে ৩০ মিনিট পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে রাখে। সে দিনের দুপুর ১২ টার দিকে লাশটিসহ বাকী চারজনকে নানিয়ারচর জোন হেড কোয়াটারে নিয়ে যায়। এ খবর আশে পাশে ছড়িয়ে পড়লে অরুন আলো চাকমা (ইউপি মেম্বার), অনু চাকমা (ইউপি মেম্বার), দুর্বাশা মনি চাকমা (চেয়ারম্যান ইউপি) এ তিন জন মিলে জোন অধিনায়কের নিকট লাশটি ফের দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল ওয়াকিব মিঞা তাদের অনুরোধ শুনে ক্ষেপে যান এবং ইচ্ছামত গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেন। কিন্তু ঠিক একদিন পরে ঐ মৃত লাশটি বের করে শান্তিবাহিনীরা হত্যা করেছে বলে প্রচার চালানো হয়। বিভিন্নভাবে শারিরীক নির্যাতন চালিয়ে ঘটনার ৫ দিন পর সমেন্ত চাকমা ও অনাদি চাকমাকে ছেড়ে দিলেও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত লক্ষী বিলাস চাকমা ও বড় চোখার ভাগ্যে কি জুটেছে তা জানা যায়নি।
+  +  +  +  +  +

(৪)
পদ্ম কুমার চাকমার কি অপরাধ
গত ৮/৩/৯২ তারিখ বগাছড়ি পাাড়ার পদ্মকুমার চাকমা নদীতে বাঁশ বাঁধছিলেন। এমন সময় বেতছড়ি গুনিয়া পাড়া আর্মি ক্যাম্পের কমা-ার ক্যাপ্টেন বাশার আর,পি জয়নাল আহম্মদকে দিয়ে পদ্মকুমারকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যায় এবং কোন কারণ ছাড়া একটি অন্ধকার রুমে ডুকিয়ে শারিরীকভাবে নির্যাতন ও ইলেক্ট্রিক শক লাগিয়ে দেয়। এভাবে প্রায় তিন ঘন্টা যাব শারিরীক নির্যাতন করার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।                                       
বাংলাদেশের বীর সেনা বাহিনী পার্বত্য এলাকায় গিয়ে পাহাড়ি জনগণকে তাদের মনোরঞ্জনের বস্তু হিসেবে ব্যবহার করে। তাই সেনা বাহিনীদের করার মত কোন কাজ না থাকলে পদ্মকুমারের মত কোন এক পাহাড়িকে ডেকে বিভিন্নভাবে অমানুষিক নির্যাতন করে অবসর সময় কাটিয়ে দেয়। এই হচ্ছে পার্বত্য এলাকার বর্তমান বাস্তবতা।
+  +  +  +  +  +

(৫)
শান্তিবাহিনী সন্দেহে গ্রেফতার
১৮/২/৯২ তারিখে বেতছড়ি সাব জোনের কমা-ার ক্যাপ্টেন শামীমের নির্দেশে সুবেদার মতিনের নেতৃত্বে একটি দল সকাল ৯টায় বেতছড়ি গ্রামে প্রবেশ করে। ঠিক সে সময় উক্ত গ্রামের বাসিন্দা মিঃ শান্তিমাধব চাকমা নিজ জমিতে কাজ করছিলেন। এমন সময় উক্ত সেনা দলটি শান্তিমাধবকে গ্রেফতার করে। অপর দিকে একই গ্রামের বাসিন্দা মিঃ বসন্তকুমারকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। একদিন পরে ধৃত ব্যক্তিদের আত্মীয় স্বজন ও পাড়ার কার্বারীকে ডেকে জানিয়ে দেয় যে ধৃত শান্তিমাধব চাকমা ও বসন্তকুমার চাকমা নাকি শান্তিবাহিনীর সহযোগী। সুতরাং তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদেরকে কোথায় এবং কি অবস্থায় রাখা হয়েছে তা জানা যায়নি।                                           
পার্বত্য এলাকায় নিরীহ পাহাড়ি জনগণ প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনী কর্তৃক শান্তিবাহিনী আখ্যায়িত হয়ে হয়রানি হচ্ছেন। সেনাবাহিনী কর্তৃক নিযুক্ত কিছু সংখ্যক পাহাড়ি আঙ্গুল বাহিনী প্রকৃত শান্তিবাহিনীর কোন তথ্য দিতে না পারলে নিরীহ গ্রামবাসীকে মিথ্যাভাবে শান্তিবাহিনীর সহযোগী বলে ক্যাম্পে রিপোর্ট প্রদান করে। যাতে তাদের নিয়মিত ভাতা চালু থাকে।
                                                  +  +  +  +  +  +

(৬)
সেনাবাহিনীর অপারেশনের শিকার নিরীহ গ্রামবাসী
গত ১৮/৪/৯২ তারিখে নানিয়ারচর জোন হেড কোয়াটার থেকে ক্যাপ্টেন ছালেক একটা গ্রুপ নিয়ে কৃঞ্চমাছড়া গ্রামে অভিযান চালায়। বিভিন্ন ঘরবাড়ি তল্লাশী করে কিছু না পেয়ে শেষ পর্যন্ত (১) শশীনাথ কার্বারী (৫০) (প্রাক্তন মেম্বার) পিতা মৃত্যুঞ্জয়, (২) কনক কুমার চাকমা (৪৪) পিতা- ঐ, (৩) উগুরিক্কো চাকমা (৩২) পিতা- ঐ, (৪) প্রিয় রঞ্জন চাকমা পিতা নিকুঞ্জ বিহারী চাকমা (৪৫) কে কোন বাদ বিচার ছাড়া বেধরক মারপিট করে বীরদর্পে ক্যাম্পে ফিরে যায়। এই নির্যাতন ভোগকারী চার জনের অপরাধ কি ? অহেতুক লাঠিপেটা খাওয়ায় কার কাছে বিচার চাইবে ?
                                                             +  +  +  +  +  +

(৭)
সেনাবাহিনী কর্তৃক দুই ব্যক্তি আটক ও পরে মুক্তি
নানিয়ারচর জোন কমা-ার কর্তৃক গত ৬ই মে সাপমারা গ্রামের নীলমণি চাকমা পীং পয়নুন্দ চাকমা, নীহার বিন্দু চাকমা পীং নীলমণি চাকমা এবং চন্দ্রকুমার চাকমা পীং সুষ্ঠ বাপ নামে তিন ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তাদেরকে সেনাসদস্যরা বাড়ি থেকে ধরে আনে এবং সাংঘাতিকভাবে মারধর করার পর শেষের দুই জনকে পরদিন ছেড়ে দেয়া হয়। তবে নীলমণি চাকমাকে শারিরীক অত্যাচার চালানোর পর গত ১০/৫/৯২ ইং ছেড়ে দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, এর আগেও মিঃ নীলমণি চাকমাকে শান্তিবাহিনী সন্দেহে আটক করা হয় এবং বিনা কারণে ২/৩ বছর জেলে রাখা হয়।
                                                            +  +  +  +  +   +

(৮)
শান্তিবাহিনী সন্দেহে
মিঃ সুব্ব জ্যোতি চাকমা (৩০) পীং ললিত কুমার চাকমা গ্রাম- পশ্চিম হাতিমারা, বুড়িঘাট -কে গত ২৬/৪/৯২ইং বুড়িঘাট ক্যাম্প কমা-ার কর্তৃক আটক করা হয়। সাংঘাতিকভাবে শারিরীক নির্যাতনের পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। 
গত ৩০/৪/৯২ইং নানিয়ারচর জোনের সেনা সদস্যরা লাল মোহন চাকমা পীং যুম্যাধন চাকমা গ্রাম- বেতছড়ি দ্বজর পাড়া-কে তার নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মিঃ লালু মোহন নানিয়ারচর জোনে আটকাবস্থায় আছেন বলে জানা গেছে।                                        
গত ৭/৫/৯২ইং কানন জ্যোতি তালুকদার পীং মহেন্দ্র লাল তালুকদার গ্রাম- রাঙ্গীপাড়া -কে নানিয়ারচর জোন কমা-ার কর্তৃক তার নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে আটক করা হয়। তাকেও সাংঘাতিকভাবে মারধর করা হয় এবং এখনো নানিয়ারচর জোনে আটকাবস্থায় রাখা হয়েছে।                                   
এছাড়া গত ১৬/৪/৯২ইং বিপুল বিহারী চাকমা পীং তবলচান চাকমা গ্রাম- দক্ষিণ হাতিমারা -কে বুড়িঘাট ক্যাম্প কমা-ার কর্তৃক আটক করা হয়। তাকে সেনা সদস্যরা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাকে নানিয়ারচর জোনে আটক রাখা হয়েছে। নানিয়ারচর জোনে আটক এসব ব্যক্তির ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনো জানা যায়নি।
=  =  =  =  =  =


মাটিরাঙ্গা
(১
সেনাবাহিনীর ধর্ষণের হাত থেকে বিবাহিতা মেয়েদেরও রক্ষা নেই
প্রাক্তন মেম্বার হৃদয় কুমার ত্রিপুরার স্ত্রী মিসেস ধর্মলীলা ত্রিপুরা গত ৩/২/৯২ তারিখে ঘাটে পানি আনতে গেলে মাটিরাঙ্গা জোনের তৈমাতাই মুখ সেনা ক্যাম্পের নায়েব সুবেদার মোঃ অলিউল্লাহ কর্তৃক ধর্ষিত হন। সুবেদা যখন ধর্ষণের চেষ্টা চালায় সে সময় ধর্মলীলা ত্রিপুরার চিকারে গ্রামের কয়েকজন যুবক উদ্ধার করতে এগিয়ে যায়। কিন্তু নরপশু সুবেদার অলিউল্লাহ তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে তার পাশবিক লালসা চিরতার্থ করে ক্যাম্পে চলে যায়। মিসেস ধর্মলীলা ত্রিপুরা গুইমারা ইউনিয়নের তৈমাতাই গ্রামের বাসিন্দা।
                                                        +  +  +  +  +  +

(২)
ধর্ষণের পর সেনা ক্যাম্পে নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে
গুইমারা ইউনিয়নের কুমায়্য পাড়া বাসিন্দা দেবেন্দ্র চাকমার ১৮ বছরের যুবতী কণ্যা মিস্ পুষ্পরাণী গত ১৩/৩/৯২ তারিখ ৩৪ ইষ্ট বেঙ্গলের সুবেদার হামিজ উদ্দীন কর্তৃক নিজ বাড়িতে ধর্ষিত হয়। পুষ্পরাণী গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। শুধু তাই নয়, সুবেদার হামিজ ধর্ষণ করেও পুষ্পরাণীকে রেহাই দিচ্ছে না। তাকে এখন নিয়মিত ক্যাম্পে হাজিরা দিতে হচ্ছে।
                                                            +  +  +  +  +  +

(৩)
রাস্তায় টহলরত সেনাবাহিনী আনসার কর্তৃক এস,এস,সি পরীক্ষার্থীনী ধর্ষিত
গত জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকে ১৯৯২ সনের এস,এস,সি পরীক্ষার্থী মিস্ আলোরাণী ত্রিপুরা কোচিং ক্লাশ শেষ করে মাটিরাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ফিরছিল। আনুমানিক দুপুর ১২টা নাগাদ মিস্ আলোরাণী ত্রিপুরা রসুলপুর ফরেষ্ট সেগুন বাগান পৌছলে পার্শ্বের রাস্তায় পাহাড়া রত সেন্ট্রিপোষ্ট থেকে ২জন সেনা সদস্য নেমে এসে জোর করে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং সেখানে পাহারারত ৩ জন সদস্য ও ২জন আনসার আলোরাণীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে ছেড়ে দেয়।
উল্লেখ্য উক্ত জায়গায় এযাব আলোরাণীসহ ৭ জন পাহাড়ি মেয়ে সেনাবাহিনীর পাশবিক লালসার শিকার হয়।

+  +  +  +  +  +

(৪)
ইউ,পি, নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে কাতন ত্রিপুরার স্ত্রীকে অপহরণ
গত ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে ৪নং গোমতী ইউনিয়নের বান্দরছড়া মৌজায় পুনর্বাসিত অনুপ্রবেশকারী মোঃ মিঞা গত ইউ,পি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ায় কাতন কুমারের স্ত্রী মিসেস কাখরা কার্তিকে সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় অপহরণ করে। মিসেস কাখরা এক সন্তানের জননী। ঘটনার পরে মোঃ মিঞার স্ত্রী মিসেস বেগম আলী বলেছেন, “তার স্বামী নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর হতে নাকি এ ধরণের কাজের পরিকল্পনা করছিল। প্রথম প্রথম মিসেস আলী এর প্রতিবাদ করলে তাকে লাঠি পেটা খেতে হয়। পরে তিনি ভয়ে কিছু বলেননি। বেগম আলীর মতে সেখানে অবস্থানরত সেনা সদস্যরা প্রায় সময় এ ব্যাপারে আলী মিঞাকে উসাহ প্রদান করত। সে কারণে কাতন কুমার তখন সেনাবাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করা সত্ত্বেও কোন সহযোগীতা পাইনি। অথচ তখনও নাগালের ভেতরে ছিল। সম্প্রতিক জানা গেছে ঐ বদমাইশ আলী কাতনের স্ত্রীকে নিয়ে বর্তমানে চৌদ্দগ্রামের কোন এক জায়গায় অবস্থান করছে।
                                                          +  +  +  +  +  +

(৫)
গ্রামবাসী হয়রানি
গত ১৬/৪/৯২ বৃহস্পতিবার মাটিরাঙ্গা উপজেলার খাগড়াপুর নামক স্থানে পার্শ্ববর্তী অনুপ্রবেশকারী গ্রামের কিছু সংখ্যক অনুপ্রবেশকারী মেয়ে ঘাটে পানি আনতে যায়। ফেরার পথে একজন মেয়ের কাঁখের কলসী পড়ে ভেঙ্গে গেলে সে তাড়াতাড়ি তার স্বামীকে খবর দেয় যে, একজন ত্রিপুরা পাহাড়ি তাকে দা, কুড়াল দিয়ে তাড়িয়ে আসলে সে পালাতে গিয়েই তার কলসী পড়ে ভেঙ্গে যায়। এই মিথ্যা খবরটি ঐ মেয়ের স্বামী পার্শ্ববর্তী সেনা ক্যাম্পে খবর দিলে সেনাবাহিনীরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উক্ত গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং সমস্ত গ্রামের লোকজনকে এক জায়গায় জড়ো করে সারা দিন আটক করে রাখে। শুধু সেনাবাহিনীরা নয় সঙ্গে অনুপ্রবেশকারী একটি দলও দা, কুড়াল হাতে এসেছিল। ভাগ্যক্রমে সে দিন বড় ধরণের রক্তপাত থেকে খাগড়াপুর গ্রামবাসী রক্ষা পায়।
=  =  =  =  =  =

মহালছড়ি
পুলিন বিহারী চাকমার মুক্তির ব্যাপারে বিভিন্ন মানবতাবাদী সংগঠন ও ব্যক্তির সাহায্য প্রার্থনা
পুলিন বিহারী চাকমা পিতা ইত্তুক্যে চাকমা গ্রাম- জরল্যাছড়ি উপজেলা-মহালছড়ি সে একজন সহজ সরল খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষ। একদিন হঠা করে সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ তাদের গ্রামে অপারেশন চালায় এবং নিজ বাড়ি থেকে ইত্তুক্যে চাকমাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৯৯১ সনের প্রথম দিকে ধরে নিয়ে আসলেও আজ অবধি তাকে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছে। অন্যদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বন্দী থাকায় তার পরিবারের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তাই দেশের বিভিন্ন মানবাদী সংগঠন ও ব্যক্তির নিকট ইত্তুক্যে মুক্তির ব্যাপারে তার পরিবারের পক্ষ থেকে সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে।
                                                 =   =   =  =  =  =

জুরাছড়ি
বিবাহিতা বেনুকা চাকমা জনৈক সেনাবাহিনীর সদস্য কর্তৃক ধর্ষিত
৪নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের চৌইছড়ি গ্রামের বাসিন্দা মিঃ সাধন কুমার চাকমার স্ত্রী মিসেস বেনুকা চাকমা গত ৫/৩/৯২ তারিখে জুরাছড়ি ক্যাম্পের জনৈক আর্মি কর্তৃক ধর্ষিতা হন।
=  =  =  =  =  =

সেনাবিাহিনী কর্তৃক বৌদ্ধ ভিক্ষু গ্রেফতার
গত ৩রা এপ্রিল ’৯২ জুরাছড়ি আর্মি ক্যাম্পের ক্যাম্প কমাণ্ডার ধামেই পাড়া বৌদ্ধবিহারের বিহারাধ্যক্ষ সুমনানন্দ ভিক্ষুকে গ্রেফতার করে দৈহিকভাবে নির্যাতন করে। জানা যায়, গ্রেফতারের কিছুদিন আগে উক্ত সেনা অফিসারকে ভিক্ষু সুমনানন্দ জুতা পায়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। এতে উক্ত সেনা অফিসার রেগে যান এবং কিছুদিন পর গত ৩রা এপ্রিল সদলবলে ঐ বৌদ্ধমন্দিরে উপস্থিত হয়ে সুমনানন্দ ভিক্ষুকে বিনাকারণে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে নিয়ে যান। এখন সেনা কমা-ার কর্তৃক উক্ত ভিক্ষুকে চোরা কারবারী বলে অপবাদ দেয়া হচ্ছে গ্রেফতার করার কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সুমনানন্দ ভিক্ষুকে জুরাছড়ি আর্মি ক্যাম্পে আটকাবস্থায় রাখা হয়েছে। মারধর করা হয়েছে কিনা জানা যায়নি।

কাউখালী
(১)
সেনা বাহিনী কর্তৃক স্কুল ছাত্রীকে উপর্যুপরি ধর্ষণ
৮ম শ্রেণী ছাত্রী মিস্ চারুবালা চাকমা, পিতা- ললিত মোহন চাকমা ঘাগড়া ইউনিয়ন অর্ন্তগত উল্টাছড়ি গ্রামের অধিবাসী। গত ২২/২/৯২ তারিখ লেভাছড়া আর্মি ক্যাম্পের ১৮ ইষ্ট বেঙ্গলের একজন নিরাপত্তা রক্ষাকারী (?) সেনা বাহিনী মিস্ চারুবালা চাকমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। চারুবালাকে বাঁচাতেগিয়ে বৃদ্ধা নানীও সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রহৃত হন। বর্তমানে চারুবালা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এসব ঘটনাবলী পার্বত্য এলাকায় এখন প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। আমরা রাডারে যা প্রকাশ করি এবং “রাডার” যা সংগ্রহ করতে পারে তা প্রকৃত ঘটনার সিকি ভাগ মাত্র।
                                                             +  +  +  +  +  +

(২)
বুজল্যা চাকমা সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার
গত ১/৫/৯২ ইং পোয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বুজল্যা চাকমাকে শান্তিবাহিনী সন্দেহে সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার করা হয়েছে। বুজল্যা চাকমা পোয়াপাড়া গ্রামের অন্যদের চেয়ে একটু স্বচ্ছল। কোন প্রকারে   খেয়েপরে বেঁচে থাকার সামর্থ রয়েছে, কিন্তু নির্যাতক সেনা সদস্যদের তা চক্ষুশুল হয়ে দেখা দিল। তাই তাকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার লক্ষ্যে কাউখালি ক্যাম্পে বেআইনীভাবে আটক করা হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দেয়া হয়নি।
+  +  +  +  +  +

(৩)
শান্তিবাহিনীর চাঁদা আদায়কারী অভিযোগে গ্রেফতার
১/৫/৯২ তারিখে রাতে কাঁশখালী ক্যাম্পের ক্যাম্প কমাণ্ডার লেঃ সাব্বির (১৮ বেঙ্গল) উল্টারাঙ্গী পাড়া গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং সকাল হলে ভূবন বিকাশ চাকমা (৫৫) পীং নিশি মোহন চাকমাকে ধরে দৈহিকভাবে নির্যাতন করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে জান গেছে ভূবন বিকাশের দোষ নাকি তিনি শান্তিবাহিনীকে চাঁদা সংগ্রহ করার কাজে সাহায্য করেছেন। অথচ এই বৃদ্ধ নিজে কায়িক পরিশ্রম করে কোন রকম বেঁচে আছেন। এই রিপোর্ট লেখার সময় জানা গেছে ভূবন মোহনকে কাঁশখালী ক্যাম্পের মাটির/অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকাবস্থায় রাখা হয়েছে।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে ঐ দিন লেঃ সাব্বির আরও একই উপজেলার শুকনাছড়ি গ্রামেও হামলা চালায় এবং মিঃ ফরচান চাকমা (৭০) পীং মৃত ব্যাত্যা চাকমা ও জাপানী কুমার চাকমা (২৩) পীং দুর্গ মোহন চাকমা নামে দুই ব্যক্তিকে দৈহিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যায়। ৭০ বছরের একজন বৃদ্ধ পর্যন্ত অত্যাচারী লেঃ সাব্বিরের হাত থেকে রক্ষা পাননি।
+  +  +  +  +  +

(৪)
সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার পোয়াপাড়া গ্রামবাসী
গত ২০/৩/৯২ইং কাউখালি উপজেলাধীন পোয়াপাড়া গ্রামের নিরীহ গ্রামবাসীদেরকে পার্শ্ববর্তী কাচখালী ক্যাম্পে ক্যাম্প কমা-ার কর্তৃক ডেকে পাঠানো হয়। গ্রামবাসীরা “হুজুরের” হুকুমে ভয়ে ভয়ে ক্যাম্পে উপস্থিত হলে ক্যাম্প কমাণ্ডার তাদের কাছ থেকে জানতে চান তারা (গ্রামবাসীরা) তাদের অস্ত্রগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। হঠা এই প্রশ্নের কারণ তারা কিছুই বুঝতে পারল না। কারণ যাদেরকে সারাদিন কঠোর কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, তারা অস্ত্রের খবর জানবে কি করে বা তাদের কাছে অস্ত্র থাকবে কেন ? সুতরাং অনিবার্যভাবে গ্রামবাসীরা তাদের কোন অস্ত্র নেই বলে জানিয়ে দেয়। এই উত্তর পাওয়ার পর ক্যাম্প কমা-ার তাদেরকে উল্টাভাবে গাছের ডালে ঝুলিয়ে ইচ্ছেমত প্রহার করতে থাকে। তারপরও তৃপ্তি না হলে উক্ত কমা-ার তাদের নাকে মুখে ১৫ টাংকি পানি ঢেলে দেয়। যার ফলে তাদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানে কানে শুনতে পান না। যারা ঐ দিন শারিরীকভাবে নির্যাতনের ফলে সবচেয়ে বেশী জখম হন তারা হলেন, (১) মিলন কান্তি চাকমা (২৫), (২) উপালি চাকমা (৪৫), (৩) শ্যামল কান্তি চাকমা (২৭), (৪) দীপংকর চাকমা (২৪) এবং (৫) বিমলেন্দু চাকমা।
=  =  =  =  =  =

পানছড়ি
চক্রান্তমূলক গ্রেফতার
সেনাবাহিনী কর্তৃক যে বর্বর হত্যাকাণ্ড গত ১০ এপ্রিল সংঘটিত হয় তা সকলের জানা। যে সেনাবাহিনী এতগুলো নীরিহ লোককে হত্যা করলো তারা আবার মানবতাবাদী সেজে ভস্মীভূত লোগাং গ্রামে কিছু কুড়ে ঘর তৈরী করে দেয়। সেই কুড়ে ঘরগুলো আবার তারাই ২৯শে এপ্রিলের রাতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পুড়ে দেয়। কিন্তু ঐ ঘরগুলো পুড়ে দেয়ার অভিযোগে ৩০ এপ্রিল বকুল কান্তি চাকমা (১৬) নবম শ্রেণীর ছাত্র পীং খগেন্দ্র চাকমা গ্রাম- ম্যাছ্যাছড়া, পানছড়ি -কে পানছড়ি আর্মি ক্যাম্পে ডেকে দৈহিক নির্যাতন করে আটক করে রাখে।
তার কিছু দিন পর একই অভিযোগে গত ১৩ মে জেরবো রাম চাকমা (৪০) পীং কামালধন চাকমা, গ্রাম- বড়হলক পানছড়ি -কে লোগাং ক্যাম্পের বিডিআর-রা গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এদেরকে মুক্তি দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
                                                       =  =  =  =  =  =           

দুরছড়ি
সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণ
গত ২১ শে জানুয়ারী ১৯৯২, মঙ্গলবার, ২ নম্বর দিতিলা ক্যাম্প থেকে একজন সুবেদারের নেতৃত্বে পার্শ্ববর্তী রান্যাবন ছড়া গ্রামে এক অপারেশনে যায়। ঐ গ্রামে গিয়ে এই সেনা দলটি (১) মিলেশ চাকমা পিতা- মৃত পূর্ণলাল চাকমা (২) বড় মিলেশ চাকমা পিতা- অমর চান চাকমা নামের দুইজন কিশোরীকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে এবং গ্রামে আরও বিভিন্ন নির্যাতনমূলক ঘটনা সাঙ্গ করে ক্যাম্পে ফিরে আসে।
                                                       =  =  =  =  =  =                               

রাঙ্গামাটি
(১)
সেনা বাহিনীর গুলিতে নিরীহ গ্রামবাসীর মৃত্যু
গত ৩০/৩/৯২ রাঙ্গামাটি সদর সদর উপজেলাধীন বালুখালী ইউনিয়নের বসন্তগ্রামের অধিবাসী (১) মিঃ শান্তি চাকমা (২৮), (২) সাগরবাসা চাকমা (১৩) পিতা মিঃ সূর্যধন চাকমা রাণী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র, (৩) জ্ঞান রতন চাকমা (৩২) পিতা রজনী কুমার চাকমা, দিনমজুর ও (৪) বুদ্ধ চাকমা (২৬) পিতা সূর্যধন চাকমা সেনাবাহিনী কর্তৃক গুলিতে নিহত হন এবং উক্ত ঘটনায় যারা আহত হন, তারা হচ্ছেন, (১) কালা মাজন চাকমা, (২) চার সন্তানের জননী নামতা চাকমা, স্বামী উক্ত ঘটনায় নিহত জ্ঞান রতন চাকমা, (৩) কিশোরী অলকা চাকমা (১৩), (৪) অমূল্য রতন চাকমা (১৮) রাঙ্গুনিয়া কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র।  
                   
ঘটনাটি যেভাবে ঘটলো :-
ঐ দিন ভোর সকালে কাপ্তাই ব্রিগেডের অধীন মিদিঙ্যাছড়ি সাব জোনের সাব জোন কমা-ার মেজর নাসেরের আদেশ প্রাপ্ত হয়ে লেঃ হাবিবের নেতৃত্বে রাজমনি পাড়া ক্যাম্প ও বসন্ত ক্যাম্পের যৌথ উদ্যোগে বসন্ত নামক জায়গায় গিয়ে অবস্থান নেয়। সকাল ৬ঃ১৯টা দিকে বিনা উস্কানীতে অবস্থানরত আর্মিরা ব্যাপরোয়াভাবে গোলাগুলি শুরু করে। ঠিক সে মুহুর্তে সাগর বাসা চাকমা ও তার বড় ভাই বুদ্ধ চাকমা নদীতে নৌকা যোগে জাল তুলছিল। এমন সময় দেখল যে আর্মিরা তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তেছে। সাগর বাসা চাকমা তখন চীকার করে আর্মিদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো, “স্যার আমরা এই পাড়ার লোক, আমাদেরকে মারবেন না।” এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সাগর বাসা হাতে গুলিবিদ্ধ হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে পানিতে পড়ে যায়। আহত সাগর সাতার কাটতে কাটতে আবারও তাদের পরিচয় দিতে লাগল। এ সময় লেঃ হাবিব বললেন, “ঠিক আছে তুমি কুলে আস তোমাকে কিছু করা হবে না।” এই আশ্বাস পেয়ে সাগর নৌকাতে উঠে পড়ল এবং বীর লেঃ হাবিব সঙ্গে সঙ্গে সাগরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। ঐ গুলিতে সাগরের মাথার খুলি উড়ে যায় এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একই ভাবে সাগরের বড় ভাই বুদ্ধকেও হত্যা করা হয। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে শান্তি চাকমা ও জ্ঞান রতনকে নদীর ঘাটে গুলি করে হত্যা করা হয়। জ্ঞান রতন চাকমাকে নদীর ঘাটে যখন নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছিল সেই নারকীয় দৃশ্য জ্ঞান রতনের স্ত্রী ও চার সন্তানের জননী নামতা চাকমার সম্মুখে ঘটতে দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। নামতার কান্নাকাটি দেখে রাজমনি পাড়া ক্যাম্পের কোয়াটার মাষ্টার মোঃ শফি রেগে যায় এবং নামতাকে বেদম প্রহার করে। তাছাড়া দীপ্যা চাকমার বাড়ীতে বেড়াতে আসা দু’জন কিশোরীর মধ্যে একজন অলকা চাকমা ও কলেজ ছাত্র অমূল্য রতনকে ইচ্ছামত মারধর করে মুমুর্ষ অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। এদেরকে চিকিসার জন্য রাঙ্গামাটিতে নিয়ে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। গুলিবিদ্ধ কালামাজনকে মেজর নাসের রাজমনি ছড়া ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোথায় কি অবস্থায় আছে তা জানা যায়নি। অস্বাভাবিকভাবে কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটলে দেশের প্রচলিত আইনে পোষ্ট মর্টেম করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু মেজর নাসের তা করতে দেয়নি। জোর করে লাশগুলো নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলে।

                                                       +  +  +  +  +  +


(২)
পুলিশ হাবিলদার কর্তৃক স্কুল শিক্ষিকা প্রহৃত
গত ৪ঠা এপ্রিল ১৯৯২ইং একজন পুলিশ হাবিলদার কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলা শহরের পুলিশ লাইন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মিসেস মালবিকা প্রহৃতা হয়েছেন।
ঐদিন সকাল বেলা মিসেস মালবিকা যখন একটি শ্রেণী কক্ষে পাঠদানরত ছিলেন তখন করিডোরে একই স্কুলের দুইজন ছাত্রী আকলিমা ও মনিয়ার মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়। এতে তার পাঠদানে অসুবিধার সৃষ্টি হলে তিনি উক্ত ছাত্রীদ্বয়কে গোলমাল না করার জন্য বেশ কয়েকবার নিষেধ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও গোলমাল বন্ধ না হলে মিসেস মালবিকা ছাত্রীদ্বয়কে শাস্তিস্বরুপ কানে ধরে উঠাবসা করারন। এই দুইজন ছাত্রীর মধ্যে মনিয়া হচ্ছে হাবিলদার ইব্রাহীমের (ইমাম) মেয়ে। তার মেয়ের মাধ্যমে হাবিলদার ইব্রাহীম মেয়ের এই শাস্তির সংবাদ শুনামাত্র রেগে যান এবং তক্ষণা স্কুলে গিয়ে উম্মাদের মত চিকার করে মানবিকাকে খঁজতে থাকেন। এই সময় মিসেস মালবিকা অংকের ক্লাশে পাঠদানরত ছিলেন। হাবিলদার ইব্রাহীম ঝড়ের মতো মানবিকার ক্লাশে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন এবং পায়ের বুটজুতা দিয়ে মিসেস মালবিকার চুল ধরে বেপরোয়াভাবে জুতা পেটা করেন। এই দিকে এই ঘটনা রাঙ্গামাটি শহরে বিরাট ক্ষোভ ও চাঞ্চলের সৃষ্টি করেছে।
=  =  =  =  =  =

 লক্ষীছড়ি
লক্ষীছড়িতে এক ব্যক্তিকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা
ঘটনাটিকে সাজিয়ে বলা হয়েছিণ কালাবিজা চাকমা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো গত ১৮ই মার্চ লক্ষীছড়ি উপজেলার ধুল্যাতলী গ্রামের ২৭ বছর বয়সী উক্ত ব্যক্তিকে সাবজোন কমা-ার মেজর সিদ্দিকুর রহমানের নিয়ন্ত্রণাধীন ধুল্যাতলী আর্মি ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। হতভাগা ঐ ব্যক্তির স্ত্রী এখন দুই নাবালক সন্তান নিয়ে কোথায় যাবে জানে না।

------------------------------------------------------------------------------------
বেসামরিক প্রশাসন যেখানে জিম্মি
রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলা। মিজোরাম সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় জোন কমা-ারই সর্বেসর্বা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এখানে ইচ্ছেমত হয়রানী করা হয়। কিছু দিন আগে এক নিরীহ শিক্ষককে বিনা অপরাধে আটক করা হয়। উক্ত শিক্ষকদের বাবা ও ভাইকে প্রতি সপ্তাহে ক্যাম্পে হাজিরা দিতে হয়। দিনের পর দিন এভাবে হয়রানির পর অতীষ্ঠ হয়ে তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই হল উক্ত শিক্ষকদের অপরাধ। তার বাবা ও ভাইকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত তাকে নির্যাতন করার হুমকি দেয়া হয়েছিল।
এ উপজেলার প্রত্যেক প্রাইমারী শিক্ষককে প্রতি মাসে জোন অফিসে মাসিক রিপোর্ট দেয়া বাধ্যতামূলক। মাসিক রিপোর্ট ছাড়া তারা বেতন পান না। একবার শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে মিছিল করার জন্য শিক্ষকদের চাপ দেয়া হয়েছিল।
উপজেলা কর্মকর্তাদের ছুটি মঞ্জুর করেন জোন কমা-ার। এমনকি উপজেলার বিভিন্ন বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে এক একজন ক্যাপ্টেন অলিখিতভাবে নিয়োজিত। সেনা ক্যাম্পের মেডিকেল কোরের জনৈক ক্যাপ্টেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ দেখাশুনা করেন।
গত ঈদের পর উক্ত উপজেলার পোষ্ট মাষ্টারের মা ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট ছুটির প্রার্থনা করলে মঞ্জুর হয়ে যায়। কিন্তু বাধ সাধলেন জোন কমা-ার। জানা গেছে ঐ পোষ্ট মাষ্টারকে ছুটি ভোগ করতে দেয়নি জোন কর্তৃপক্ষ।                                                                                                                                                                          বরকল প্রতিনিধি মারফত
------------------------------------------------------------------------------------------


লোগাং হত্যাকাণ্ড
পাহাড়ে সভ্যতার সংজ্ঞা
রোকন রহমান/জাহিদ নেওয়াজ

“শৃঙ্খলা যেখানে অবিচার,
বিশৃঙ্খলাই সেখানে নতুন নিয়মের জননী”
-রঁমা রঁল্যা

সভ্যতা মানে ইটদালানের সরকারী কোঠা, সভ্যতা মানে সবুজ ল্যা-রোভার উর্দি পরা সশস্ত্র সংগঠন। সেখানে সভ্যতা মানে সন্ধ্যের পর ঘরে বন্দী, সভ্যতা মানে বাঙালি ও পাহাড়ির আগুন চোখে চোখাচোখি। সভ্যতার আরো সংজ্ঞা আছে সেখানে, সকাল ন’টার আগে এবং বিকেল তিনটের পরে শহর ছাড়তে না পারা। যখন তখন উর্দি পরা লোকজনের কাছে কৈফিয়ত দেয়া। সারা শহরের অলিতে গলিতে পেছনে টিকটিকি লেগে থাকা। সভ্যতা মানে টেলিফোনে বাইরে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া। এটা হচ্ছে খাগড়াছড়ি সভ্যতা। অশান্ত মানচিত্রের সভ্যতা হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা। কোথাও কোন শিল্প কারখানা, উপাদন সম্পর্কিত প্রকল্প নেই। প্রতিদিন পার্বত্য অঞ্চলে ব্যয় হচ্ছে প্রায় এক কোটি টাকা। সভ্যতার নগ্ন বুভুক্ষু পেট গিলে খাচ্ছে প্রতিদিন এই পরিমাণ অংক। এই সভ্যতায় কোথাও চোখে পড়বে না উন্নত জীবনাচার, উন্নয়নের তথাকথিত স্পর্শ। এই সভ্যতা মানুষসৃষ্ট। এখানে শোষক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সভ্যতার বিকৃত উপস্থাপন চলছে নিরন্তর। মানুষ এখানে প্রায় অমানুষ। জীবনযাপনের সংজ্ঞায় মানুষ অসভ্য এখানে প্রতিদিন। সভ্যতার আরো সংজ্ঞা আছে পার্বত্য অঞ্চলে। প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা (?) জনিত কারণে চেক পোষ্ট আছে যত্রতত্র। এক বাজার থেকে অন্য বাজারে প্রবেশের মুখে আপনাকে বাঁধা দেয়া হবে। লোগাং যাওয়ার পথে এক পাহাড়ি ছাত্র জানায় তারা কখনো এদিকে আসতে পারেনি, আমাদের জন্যে আসতে পারলো। অবশ্য ঢাকা থেকে আসার কারণে আমাদের সৌজন্যে তেমন বাধা দেয়নি। এখানেও অধিকার বৈষম্য। নাগরিক অধিকারের এক কানাকড়িও পাহাড়ি জনগণ পায় না।
প্রিয় পাঠক, আমরা খাগড়াছড়ি জেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে হত্যাকা- উত্তর অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম। খাগড়াছড়ি থেকে প্রায় ২০ মাইল ভেতরে, সীমান্তের দু’মাইলের কাছে লোগাং নদীর পাশে একটি টিলায় অবস্থিত এই গুচ্ছগ্রাম। যদিও চারপাশে পাহাড় কিন্তু সবুজ অরণ্যের লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই। বৈশাখের প্রচ- খরতাপ দগ্ধ দুপুরে আমরা সেখানে উপস্থিত হই কিছুটা পায়ে হেঁটে, কিছুটা গাড়িতে চড়ে। টিলাটিতে পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন। কাল্পনিকতায়ও আমরা সেখানে জনবসতি আবিস্কার করতে পারিনি। ঘটনার আঠারো দিন পরও মৃত মানুষের হাড়গোড় পাওয়া গেছে। অথচ মাটি পরিস্কার, বৃষ্টি কিংবা পরিচ্ছন্ন অভিযানের ফলে। টিলার চারিদিকে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর টাওয়ার। আমাদের সশস্ত্র রক্ষীদের ফাঁক গলিয়ে কিভাবে দিন দুপুরে এ ধরনের অমানবিক হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিতা-ব ঘটে তা সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। গুচ্ছগ্রামটির মাটি আগুনের মত গরম হয়ে আছে, যেন মাথার উপরে সূর্য। একটি পোড়া ভিটেয় দেখা গেল শিশুর ঘুমন্ত ছাপ। মনে হয় ঐ অবস্থায় শিশুটি দগ্ধ হয়।    
পাশের টিপরা বসতির কেউ ভয়ে মুখ খুলছে না। কোন অদৃশ্যের তর্জনী শাসন তাদের মুখ বন্ধ করে রেখেছে কে জানে। বাঙালি যারা মুখ খুলেছে তারা শান্তিবাহিনীর ওপর এ দায় চাপিয়েছে। পাহাড়িরা বাঙালিদের ওপর। আমরা সিদ্ধান্তে আসি, যারাই করুক চারপাশের বিডিআর, সৈন্যের উপস্থিতিতে কিভাবে এটা সম্ভব ? শান্তিবাহিনী এ হত্যাযজ্ঞ চালালে বিডিআর - আর্মি নিশ্চুপ ছিল কিংবা বাঙালিরা করলেও তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। কেন তাদের এই নিরবতা ? মৃতের সংখ্যা নিয়ে এত স্ববিরোধিতা কেন ? এতে নিজেদের দুর্বলতাই কি প্রকাশ পায় না ? লাশগুলোর কি হলো সভ্যতা ? ফেরত দেয়া যায়নি কোন অনিবার্য কারণবশতঃ? মৃতেরা কি তাদের ধর্মানুযায়ী সভ্যতাকে স্পর্শ করতে পেরেছে ?
আমাদের কৌতুহল, ঘুরে ঘুরে দেখা জিজ্ঞাসাই এ প্রতিবেদন। প্রকৃতির নিসর্গতায় মুগ্ধ হওয়ার অবকাশ ছিল না। শুধু শোকার্ত মানুষের অসহায় মুখগুলো। প্রশ্নবোধক জিজ্ঞাসা নিয়ে আমাদের এই বক্ষ্যমান অনুসন্ধান।

লোগাং গণহত্যার আগের ঘটনা
লোগাং এ সংঘটিত গণহত্যার নেপথ্য ঘটনা কি ? এ সম্পর্কে তিন রকম ভাষ্য পাওয়া গেছেঃ (১) অগ্রসর বোদ্ধনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র চন্দ্র সাগর চাকমা। ১০ এপ্রিলের ঘটনায় তার ভাই রাজেন্দ্রলাল চাকমা, ভাইপো কিরণ বিকাশ চাকমা (১২) ও ভাইঝি চক্ষু চাকমা (১৬) নিহত হয়েছে। চন্দ্রসাগর জানায়, গরু চরাতে গিয়েছিলো তিন বাঙালি রাখাল বালক। তাদের একজন ছিলো খ্যাপাটে। রাখাল বালকরা গরু চরানোর ফাঁকে মার্বেল খেলেছিলো। খ্যাপাটে বালকটি বেশি খেলেছিলো। খ্যাপাটে বালকটি বেশি মার্বেল নিয়ে যায়। এতে বাকি দু’জন ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে দা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে। পরে বাঙালিদের গ্রামে এসে প্রচার করে পাহাড়িদের হামলায় সে নিহত হয়েছে। উত্তেজিত বাঙালিরা পরে হামলা চালায় লোগাং গ্রামে কোন রকম সত্যতা যাচাই ছাড়াই। লোগাং এর বরুণ চন্দ্র চাকমারও অনুরূপ বক্তব্য।           

(২) গণহত্যার নেপথ্য ঘটনার দ্বিতীয় ভাষ্যটি এ রকমঃ একজন চাকমা তরুণী গরু চরাতে গেলে কয়েকজন বাঙালি রাখাল তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এতে উত্তেজিত চাকমা যুবকরা রাখালদের একজনকে হত্যা করলে বাঙালিরা লোগাং গ্রামে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চালায়।
(৩) পানছড়ি বাজারের দোকানদার মালেক এবং পাইলট পাড়ার ভিডিপি সদস্য ইসহাক বলেছেন Ñ বাঙালিরা গরু চরানোর সময় পাহাড় থেকে শান্তিবাহিনীর একটি দল নেমে আসে। বাঙালি রাখালদের তারা হরিণ ধরার কোন দল দেখেছে কিনা এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। সুদুত্তর না পেয়ে শান্তিবাহিনী কবির আহাম্মদকে (পিতা মনা মিয়া) হত্যা করে। পরবর্তীতে হামলা চলে লোগাং গ্রামে। মালেক এবং ইসহাক বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছে Ñ আগে পাহাড়িরা মেরেছে। পরে মেরেছে বাঙালিরা।

কবির এর মৃত্যু রহস্যজনক
পানছড়ি থেকে লোগাং পর্যন্ত ৭ কিমি এলাকার পাহাড়ি এবং বাঙালিদের সঙ্গে আলাপ করে এটা স্পষ্ট হয়েছেঃ ১০ এপ্রিল আনুমানিক সকাল ১০ টা সাড়ে ১০টায় একজন বাঙালি রাখাল কবির নিহত হয়। পরবর্তীতে নির্বিচারে হামলা চলে পাহাড়িদের গ্রামটিতে। তবে বিভিন্ন রকম ভাষ্যই প্রমাণ করে কবির আহম্মদের মৃত্যু রহস্যজনক। এই মৃত্যুর পেছনে কোন বিশেষ অপশক্তি’র হাত রয়েছে। আর এই মৃত্যুকে কেবল গণহত্যা চালানোর জন্যে ছুতো হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রত্যাগত শরণার্থী নিশ্চয়তা কোথায় :                                            
যে গ্রামটিতে ১০ এপ্রিল গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তার অধিবাসী ছিলো মূলতঃ ভারত থেকে প্রত্যাগত শরণার্থী পাহাড়িরা। একটি সূত্র মতে এই গ্রামে ৫৬৪টি পরিবার ছিলো। ঘরের সংখ্যা ছিলো মোট ৬০৫টি। অবশ্য ৩ বছর আগে ভারত প্রত্যাগত বরুন চন্দ্র চাকমার মতে গুচ্ছগ্রামটিতে পরিবারের সংখ্যা ছিলো ৫৮৯। শান্তি রঞ্জন (৩০) এ সংখ্যাকে ১৫০০ বলে উল্লেখ করেছেন। শান্তি আরো জানান ঘটনার আগের দিন ৯ এপ্রিল আরো ৩০টি পরিবারের ৭৫ জন শরণার্থী ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে এসেছিলো। তারা ছিলো নিকটবর্তী বিডিআর ক্যাম্পে। লোগাং-এর গণহত্যার পর এই ৭৫ জনও নিখোঁজ রয়েছে। শান্তি রঞ্জন দঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমরা ফিরে এসেছিলাম শরণার্থী শিবির থেকে। সেখানে খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা না থাকলেও জীবনের নিশ্চয়তা ছিলো। এখানে তাও নেই। আমরা কোথায় যাবো ?

যেভাবে হামলা হয়েছে
পানছড়ি মালেক এবং পাইলট পাড়ার ইসহাকের ভাষ্যমতে তারা যা শুনেছেনঃ বাঙালিদের গ্রামে তখন জুম্মা’র নামাজের প্রস্তুতি চলছিলো। তখনই খবর আসে একজন বাঙালি নিহত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে পাহাড়িদের গ্রামটিতে।
চন্দ্র সাগর চাকমা জানানঃ আমি তখন নদীতে মাছ ধরছিলাম। গ্রামে আগুন দেখে ফিরে আসি। আমাকেও আগুনে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছি। আমার ভাইঝি চক্ষু চাকমাকে প্রথমে উরুতে গুলি করা হয়। তারপর পেটে চালানো হয় দায়ের কোপ। রাজেন্দ্র চাকমা এবং ভাইপো কিরণ বিকাশ চাকমা (১২) কেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি বিডিআরকে বলেছি - আমাদের বাঁচান। তারা বলেছে - কিচ্ছু হবে না। চন্দ্র সাগর বলেন বাঙালি, ভিডিপি এবং আনসার হামলা করেছিলো। হামলার নেতৃত্ব দেয় ভিডিপির জাকির এবং বাঙালিদের মধ্যে বাশার, ইদ্রিস, মনা মিয়া এবং মঙ্গল।          
পাশের গুচ্ছ বড়গ্রামের নীরুলা বলেন, বাঙালিরা হামলার সময় বলছিলো - আজ পাহাড়িদের রক্ত খাবো। আক্রান্ত গ্রামের প্রভারঞ্জন চাকমা (পিতা ধীরেন্দ্র চাকমা) জানান- আনসার, ভিডিপি ও বাঙালিরা যৌথভাবে আক্রমণ করে। জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলাম বলে প্রাণে বেঁচে গিয়েছি।
শান্তি রঞ্জন (পিতা রাজ মোহন) বলেছেনঃ আমি তাস খেলেছিলাম। বাঙালিদের সঙ্গে আনসার, ভিডিপিরাও হামলা করে। এমনকি বিডিআরও ব্রাশ ফায়ার করেছে। ব্রাশ ফায়ারের সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এলএমজি’র বর্ণনা দিয়ে বলেন-ওটা থেকেও টানা গুলি হয়েছে।

নিহতের সংখ্যা
১০ এপ্রিলের গণহত্যায় কতোজন পাহাড়ি নিহত হয়েছে ? এ ব্যাপারে স্থানীয় সাংসদ বাবু কল্পরঞ্জন চাকমার ভাষ্যঃ নিহতের সংখ্যা কয়েক শত। খাগড়াছড়ির জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিহতের সংখ্যা অনেক বলে উল্লেখ করেছেন। ভাই হারানো চন্দ্র সাগর চাকমা বলেছেনঃ আমি ক্লাব ঘরে রাখা ১৫০ টি লাশ গুনেছি। প্রভারঞ্জন চাকমা নিহতের সংখ্যা ৩০০/৪০০ এবং শান্তিরঞ্জন এ সংখ্যাকে ১০০/১৫০ বলে উল্লেখ করেছেন। একটি সরকারি সূত্রে নিহতের সংখ্যা ১৩৮ বলা হয়েছে।

লোগাং গণহত্যা সম্পর্কে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
গত ২৭ এপ্রিল সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে লোগাং পরিদর্শনে গিয়েছিলেন সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এ সম্পর্কে প্রিয় প্রজন্মকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, এটা অবিশ্বাস্য। ভাবতে পারি না মানুষ মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারে। ধ্বংস করে দিতে পারে তাদের বাস্তুভিটা। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান সম্পর্কে তিনি বলেন, বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, কালবিলম্ব না করে সংলাপের মাধ্যমেই জাতীয় এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। বিষয়টি পার্লামেন্টে যটো দ্রুত সম্ভব আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিদিন এক কোটি টাকা খরচ হয়। এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে কতো টাকা খরচ হয়েছে তার শ্বেতপত্র প্রকাশিত হওয়া উচিত।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, অখণ্ড বাংলাদেশের স্বার্থেই একের বিরুদ্ধে অন্যকে খেপিয়ে দিলে চলবে না। শক্তি প্রয়োগে সমস্যার সমাধান হবে না। সকল পক্ষকেই তা রিয়েলাইজ করতে হবে। তিনি বলেন, সাংবিধানিকভাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসমূহের ভাষা, কৃষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যসহ মৌলিক মানবাধিকার সমূহ সুপ্রতিষ্ঠত করার মাধ্যমেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। আশা করি জাতীয় সংসদের মাধ্যমে খালেদা জিয়া এ ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগী হবেন।

শেষ কথা
পাঠক, আজকের মার্কিন সভ্যরা এক সময় নির্মমভাবে আমেরিকার আদি অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আজকেও কৃঞ্চাঙ্গ জনগণের উপর শোষণের বিকৃত ষ্টীম রোলার চালাচ্ছে। সব কিছুই শোষক দুর্বৃত্তের শ্রেণী স্বার্থে। পুঁজিবাদের নির্মম টিকে থাকার আয়োজনে এই যন্ত্রণাদগ্ধ নির্মমতা চলবে। আমাদের সামষ্টিক প্রতিরোধেই কেবল এই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি সম্ভব। আমরা পার্বত্য অঞ্চলে সমাধান দাবি করি। বিচ্ছিন্নতা নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে পাহাড়িদের নিজস্ব সংস্কৃতি জীবনাচার মেনে নিয়েই এ সমস্যার সমাধান করা যায়। তাদের নিশ্চিহ্ন করার ভেতর কোন সুবুদ্ধির পরিচয় নেই। অতপর আমরা অপেক্ষায় থাকি সোনালী দিনের। আমরা ভাবতে থাকি এসব হত্যাকা- আর ঘটবে না, এই ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে না এবং নিউজপ্রিন্টের বুকে কালো কলমের আঁচড় কাটতে হবে না নিরন্তর। আমাদের এ স্বপ্নে কি কাল্পনিকতার অবাস্তব ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে ? অবশ্যই, আমাদের স্বপ্নের ঘোড়া একদিন এই সভ্যতাকে লাথি মেরে ছুটে চলবে শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থার আলিঙ্গনে।

 [সৌজন্যেঃ সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম / ১০ মে ’৯২] 
---------------------

লোগাং গণহত্যার প্রাথমিক খতিয়ান
গত ১০ই এপ্রিল ’৯২ ইং নিরাপত্তাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পুনর্বাসিত অনুপ্রবেশকারীরা পাহাড়ি অধ্যুষিত লোগাং গুচ্ছগ্রামে এক লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ গণহত্যায় সহ¯্রাধিক নিহত হয়, আহত হয় তারও অধিক এবং শত শত লোক এখনো নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই উক্ত ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর পরই ঐ এলাকা সেনাবেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। লাশগুলো সরিয়ে না ফেলা পর্যন্ত কাউকে ঐ এলাকায় যেতে দেয়া হয়নি। তদুপরি যারা কোনভাবে প্রাণে বেঁচে যান তারাও হয় গভীর জঙ্গলে অথবা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাই নিহত সমস্ত ব্যক্তিদের নামের তালিকা সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে নিহতদের যে তালিকা প্রকাশ করা হলো তা আমরা অসম্পূর্ণ ও আংশিক মনে করি এবং নিহতের সংখ্যা এর থেকে আরো অনেক অনেক বেশী। নিম্নে প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং হামলাকারীদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হলঃ

যারা নিহত হয়েছেন------                                       
১। মিঃ মঙ্গল চাকমা (২২) পীং টংগ চাকমা                                
২। মিঃ হরিদাশ চাকমা (১২) পীং চক্রধন চাকমা                                   
৩। মিঃ কিরণ বিকাশ চাকমা (১২) পীং রামেন্দ্র চাকমা                                       
৪। মিস্ রমা দেবী চাকমা (২২) পীং রামেন্দ্র চাকমা                                
৫। মিঃ কালী কুমার চাকমা (৬৭) পীং পুজোক্যা চাকমা                                       
৬। মিঃ টনা চাকমা (৬) পীং অমিয় কান্তি চাকমা                                   
৭। মিস্ চিকন মিলা চাকমা (৩) পীং বিমলেন্দু চাকমা                                       
৮। মিঃ কান্দারা চাকমা (৮) পীং আন্দারা চাকমা                                    
৯। মিস্ যুব মায়া চাকমা (১২) পীং শেষ মনি চাকমা                                 
১০। মিসেস্ কালাবী চাকমা (৫০) স্বামী রাজচন্দ্র চাকমা                                      
১১। মিঃ ভুদি চাকমা (৩২) পীং অজ্ঞাত                                      
১২। মিঃ সঞ্চীত চাকমা (৮) পীং মায়াধন চাকমা                                     
১৩। মিঃ মিতু চাকমা (১১) পীং ঐ                                
১৪। মিঃ কনোক্যা চাকমা (১২) পীং বীরেন্দ্র চাকমা                                   
১৫। মিসেস্ মল্লিকা দেবী চাকমা (২৭) স্বামী বৈশিষ্ট্য মুনি চাকমা                                      
১৬। মিঃ সুধীর চন্দ্র চাকমা (২২) পীং বৃন্দ ধন চাকমা                                         
১৭। মিসেস্ ধন্দরি চাকমা (৩৪) স্বামী বীরেন্দ্র চাকমা                                        
১৮। মিঃ রূপান্তর চাকমা (৮) পীং বীরেন্দ্র চাকমা                                    
১৯। মিঃ রূপনন্দ চাকমা (৪) পীং রসিক চন্দ্র চাকমা                                 
২০। মিঃ বিভুতি চাকমা (৩০) পীং খুলা রাম চাকমা
২১। মিসেস্ সুধা পতি চাকমা (৪৫) স্বামী ধারোজ চন্দ্র চাকমা                                        
২২। মিস্ সন্তলী চাকমা (১৯) পীং তুষার মনি চাকমা                                        
২৩। মিঃ আঙারা চাকমা (৬০) পীং বোদ্দেয়্যা চাকমা                              
২৪। মিঃ শুভ মঙ্গল চাকমা (১৩) পীং রঞ্জন বিকাশ চাকমা                                    
২৫। মিঃ হেরে চন্দ্র ত্রিপুরা (৩৫) পীং সুমচন্দ্র ত্রিপুরা                               
২৬। মিঃ অদংগ মনি চাকমা (১৩) পীং কালোন্দ্র চাকমা                                       
২৭। মিঃ বাজিগড় চাকমা (৬০) পীং কালোন্দ্র চাকমা                                         
২৮। মিঃ কালাবুয়া চাকমা (৩০) পীং টুত্তুবী চাকমা                                
২৯। মিঃ নিত্ত্য চাকমা (২৫) ঐ                                     
৩০। মিসেস্ ধনেন্দ্র মা (৬০) অজ্ঞাত                                        
৩১। মিঃ রাজীশ চাকমা (১০) পীং তরেয়্যা চাকমা                                      
৩২। মিস্ ইন্দু মতি চাকমা (৬) পীং প্রভাত চন্দ্র চাকমা                                            
৩৩। মিঃ অমিয় কান্তি চাকমা (৩৫) পীং যামিনী চন্দ্র চাকমা                                 
৩৪। মিস্ স্নেহ দেবী চাকমা (৫) পীং বিমলেন্দু চাকমা                                        
৩৫। মিসেস্ কালাবী চাকমা (৫০) স্বামী রাজ চন্দ্র চাকমা                                     
৩৬। মিঃ বাত্যা চাকমা (১৮) পীং বিদ্যা ধন চাকমা                                
৩৭। মিঃ বুধির চাকমা (১৪) পীং খুলারাম চাকমা                                   
৩৮। মিঃ শান্তিময় চাকমা (৯) ঐ                                
৩৯। মিস্ প্রিয়বালা চাকমা (১২) পীং তারা বিকাশ চাকমা                                     
৪০। মিস্ সুর্য্য শিখা চাকমা (৩) পীং রাজমোহন চাকমা                                     
৪১। মিস্ বিজন বালা চাকমা (১৬) পীং রূপনন্দ চাকমা                                     
৪২। মিঃ কিরন বিকাশ চাকমা (১৩) পীং রাজেন্দ্র চাকমা                                      
৪৩। মিঃ চোক্যা চাকমা (১৪) পীং ঐ                                       
৪৪। মিস্ মল্লিকা চাকমা (১১) পীং হিরন লাল চাকমা                                         
৪৫। মিঃ বাত্যা চাকমা (-) পীং বিদ্যা ধন চাকমা                                    
৪৬। মিঃ যতিন ত্রিপুরা (৬০) পীং অজ্ঞাত                                
৪৭। মিসেস্ গুলং মা চাকমা (২৪) স্বামী অজ্ঞাত                                   
৪৮। মিঃ চিঝিক্য চাকমা (৮) পীং বিমলেন্দু চাকমা                                  
৪৯। মিস্ ইতুগী চাকমা (২০) বসুথা মনি চাকমা                                     
৫০। মিসেস্ মিলাবো চাকমা (২৫) স্বামী ধেভা চাকমা                                         
৫১। মিসেস্ বুদ্ধবী চাকমা (২৬) স্বামী অজ্ঞাত                                        
৫২। মিঃ কোরোয় পেদা চাকমা (৪০) পীং রাজেন্দ্র চাকমা                                  
৫৩। মিঃ হেমরঞ্জন চাকমা (৩৯) পীং রাজমোহন চাকমা                                     
৫৪। মিঃ রূবধন চাকমা (২০) বল্লী চাকমা                                  
৫৫। মিঃ বাত্তী চাকমা (২১) বিল্ল ধন চাকমা                                        
৫৬। মিঃ নীলমনি চাকমা (৬৫) পীং অজ্ঞাত                                
৫৭। মিস্ ফেন্সী চাকমা (২) পীং বিমলেন্দু চাকমা                                  
৫৮। মিস্ কালা চোগী চাকমা (১৬) বিশ্ব চেলা চাকমা                                        
৫৯। মিঃ দেমখুলা চাকমা (২৫) বিশ্ব চেলা চাকমা                                    
৬০। মিস্ সাধন দেবী চাকমা (১২)পীং দুর্গা মোহন চাকমা                                    
৬১। মিঃ বাচ্যু চাকমা (৭) পীং অরবেন্দু চাকমা                                      
৬২। মিসেস্ বুদ্ধজয় মা (৪৫) স্বামী বুদ্ধময় বাপ                
৬৩। মিস্ আশা দেবী চাকমা (১১) পীং মঙ্গল চাকমা                                   
৬৪। মিঃ অরুন শান্তি চাকমা (১৯) পীং মহাজন চাকমা                                    
৬৫। গোপ্পুয়া চাকমা (৩)পীং চত্তা বাচ্যা চাকমা                                   
৬৬। মিস্ নীহার বালা চাকমা (১১) পীং ঐ                                 
৬৭। মিসেস্ আরিশা মা (৪৫) স্বামী আরিশা বাপ                                      
৬৮। মিস্ সাধনা চাকমা (১৬) ভক্ত চাকমা                                 
৬৯। মিস্ সুজাতা চাকমা (৭) পীং চুলা চাকমা                                      
৭০। মিঃ নিরঙ্গ চাকমা (১৫) পীং বিমল চাকমা                                      
৭১। মিঃ কদাল্যা চাকমা (৩৫) পীং অজ্ঞাত                              
৭২। মিঃ নবীন কুমার চাকমা (১৬) পীং অজ্ঞাত                                     
৭৩। কেশ দাবানা চাকমা (৩৫) কেশ দাবানা বাপ                                  
৭৪। মিঃ টুকুরুক্যা চাকমা (২২) চিল্লুয়্য চাকমা                                     
৭৫। মিস্ মনাবী চাকমা (১২) পীং ওগোলোক্যা চাকমা                                      
৭৬। মিঃ কালা চোগা চাকমা (১৬) কালা বাকোন্য                                    
৭৭। মিস্ দয়া রাণী চাকমা (১৬) পীং ধন্যা চাকমা                                
৭৮। মিস্ মিকা চাকমা (১৪) ঐ                                  
৭৯। মিস্ স্বপ্না চাকমা (১৪) পীং ভূবন মোহন চাকমা                              
৮০। মিস্ চিরিঙ্গি চাকমা (৮) পীং বুদ্ধ মনি চাকমা                                
৮১। মিঃ চিজি গুলো চাকমা (৬) ঐ                                       
৮২। মিঃ সুনীল জীবন চাকমা (১২) পীং কানুঙ্গু চাকমা                                      
৮৩। মিঃ ভেজাল্যা চাকমা (৬) পীং অজ্ঞাত                                
৮৪। মিঃ ধলচান চাকমা (১৪) পীং ধনচান বাপ                                      
৮৫। মিঃ বান্দয্যা চাকমা (১৩) পীং ললিত মোহন চাকমা                                  
৮৬। মিঃ সবমনি চাকমা (৭) পীং টেংকা চাকমা                                  
৮৭। মিঃ বেঙ্গ মনি চাকমা (৫) পীং ঐ                                     
৮৮। মিস্ বাসন্তী চাকমা (১৪) পীং যামিনী কুমার চাকমা                                   
৮৯। মিঃ ঢক্কুয়্য চাকমা (৮) পীং ভূদ চাকমা                        
৯০। মিঃ নুঙকালা চাকমা (৯) পীং পাগালা চাকমা                          
৯১। মিঃ চিক্কধন চাকমা (৫) পীং বৃষ কেতু চাকমা                          
৯২। মিস্ বাদি মিলা চাকমা (১৬) পীং গদা চাকমা                         
৯৩। মিঃ বরুন চাকমা (১৩) পীং ঐ                               
৯৪। মিঃ দুলুক্যা চাকমা (৪) পীং ধমর চাকমা                                    
৯৫। মিঃ রাঙ্গামনি চাকমা (১৭) পীং অজ্ঞাত                                 
৯৬। মিঃ রাংকু চাকমা (১২) পীং অজ্ঞাত                           
 ৯৭। মিঃ উত্তরন চাকমা (১১) পীং অজ্ঞাত                         
৯৮। মিস্ হত্তলী চাকমা (৮) পীং নমস্মৃতি চাকমা                                 
৯৯। মিঃ ধন্য কুমার চাকমা (৫০)                           
১০০। মিঃ আগন্যা কুমার চাকমা (২৭) পীং কিনা রাম চাকমা                                
১০১। মিঃ চাগা হলা চাকমা (১৩) চন্দিয়্যা চাকমা                                  
১০২। মিস্ মেইয়্যাবি চাকমা (৭) পীং লালন বিহারী চাকমা                                 
১০৩। মিঃ চোক্যা চাকমা (৫৫) মৃত চোক্যা বাপ                                   
১০৪। মিঃ আদুয্যা চাকমা (১৫)
১০৫। মিঃ অগলোক্যা চাকমা (৪০) পীং অজ্ঞাত                                   
১০৬। মিঃ মেরেয়্যা চাকমা (২৩) পীং ভাত পাগালা চাকমা                                  
১০৭। মিঃ কেদোক ফা চাকমা (৮) পীং কেদোক ফা বাপ                                    
১০৮। মিঃ টালো চাকমা (৭) পীং কেরপপা চাকমা                                 
১০৯। মিঃ লিঙ্গিয়্যা চাকমা (১০) বলেন্দ্র চাকমা                                     
১১০। মিঃ ধনেক্কো চাকমা (১১) পীং সমরসিয়া চাকমা                                     
১১১। মিঃ টিবুয্যা চাকমা (৫) পীং জোলো চাকমা                                 
১১২। মিস্ ভালুগী চাকমা (৭) পীং ঐ                                   
১১৩। মিঃ সঙ্গ চাকমা (১২) পীং সম রুসয়া চাকমা                              
১১৪। মিঃ বান্দরী বাপ (৪৫)                                     
১১৫। মিঃ চদরঙ্গ্যা চাকমা (১৭) পীং বান্দরী বাপ                                
১১৬। মিঃ বাজিগর চাকমা (৫৭)                               
১১৭। কালোক্যা চাকমা (১৪)                                  
১১৮। মিঃ প্রভাত চন্দ্র চাকমা (৪১) লঙচরা চাকমা                                  
১১৯। মিঃ অরুন কান্তি চাকমা (২৬) সরশীর চাকমা                               
১২০। মিঃ বিভূতি চাকমা (৩০) পীং খুলারাম চাকমা                             
১২১। মিঃ কান্দারা চাকমা (৩৩) পীং উরিখ্যা চাকমা                               
১২২। মিঃ ধারোন্যা চাকমা (৫৩) পীং অজ্ঞাত                                       
১২৩। মিস্ কালা সোনা চাকমা (২২) পীং কালা সোনা বাপ                                
১২৪। মিঃ কালী মোহন চাকমা (৩০) পীং কনযুক্যা চাকমা                                 
১২৫। মিঃ খগেন্দ্র ত্রিপুরা (৪২) জগেন্দ্র ত্রিপুরা                                  
 ১২৬। জুনিদেক্যা চাকমা (৮) পীং ভুদিচন্দ্র চাকমা                               
১২৭। ধবলিকা ত্রিপুরা (১২) পীং নবীন কুমার ত্রিপুরা                            
১২৮। কমুদিনী ত্রিপুরা (৩২) স্বামী রান্টী ত্রিপুরা                                    
১২৯। কারেন্দ্র ত্রিপুরা (৫) পীং রান্টী ত্রিপুরা                                       
১৩০। জনমতি ত্রিপুরা (১০) পীং সার্গো কার্বারী                                  
১৩১। পোকথাক ত্রিপুরা                                
১৩২। কমুদিনী ত্রিপুরা (২৫) স্বামী মালেন্দ্র ত্রিপুরা                                
১৩৩। রূপালোদী ত্রিপুরা (২৪) স্বামী খরেন্দ্র ত্রিপুরা                            
১৩৪। সুতি ত্রিপুরা (১২) পীং খীরেন্দ্র কুমার ত্রিপুরা                              
১৩৫। বালতি ত্রিপুরা (৫) পীং রূপেন্দ্র ত্রিপুরা                                     
১৩৬। সুচিত্রা ত্রিপুরা (৩) পীং রূপেন্দ্র ত্রিপুরা                                       
১৩৭। ইন্দ্র ত্রিপুরা (১০) পীং হলেন্দ্র ত্রিপুরা

১০ এপ্রিল সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে আহত ব্যক্তির তালিকা:                          
১। পুর্নাঙ্গ কুমার চাকমা পীং সেচ চন্দ্র চাকমা                                        
২। লালন বিহারী চাকমা (৪০) স্কুল শিক্ষক পীং ভোমবাটাং                                 
 ৩। ধীর কুমার চাকমা পীং জানা নেই                                    
৪। মিলা পুদি চাকমা পীং ঐ                                      
৫। প্রভা চাকমা পীং ঐ                                  
৬। দেব সোনা চাকমা পীং ঐ                                      
৭। পুলক্ক রানী চাকমা (৩৫) স্বামী রূপসেন চাকমা
৮। জনাকী চাকমা (২৮) স্বামী বদী চাকমা                                  
৯। পেরিমোহন চাকমা পীং জয়মনি চাকমা                                 
১০। বিনয় কান্তি চাকমা পীং জানা নেই                                  
১১। প্রিয়বালা চাকমা পীং যুদিষ্টি মোহন চাকমা                                    
১২। অমর কান্তি চাকমা পীং অমিয় কান্তি চাকমা                                   
১৩। তংঙ্গ্যা চাকম পীং জানা নেই                               
১৪। নোয়াবী চাকমা স্বামী বিমলেন্দু চাকমা                             
১৫। সাধন চাকমা পীং জানা নেই                                   
১৬। কুমারী চাকমা স্বামী দেঙা চাকমা                                      
১৭। শান্তি রঞ্জন চাকমা পীং বাক্যা চাকমা                                   
১৮। জয়মনি চাকমা পীং হেম রঞ্জন চাকমা                               
১৯। প্রশান্ত কুমার চাকমা পীং জানা নেই                                    
২০। পুষ্পরানী চাকমা পীং সুনীতিময় চাকমা                                          
২১। যারবোয়া রাম চাকমা (৩৫)পীং জমল ধন চাকমা                                      
২২। সুখমনি চাকমা (১৭) (এস এস সি পরীক্ষার্থী) পীং লক্ষীবিলাস চাকমা                                    
২৩। সূর্যমনি (১৯) পীং রাজমোহন চাকমা                                 
২৪। যত্মা চাকমা (১৪)পীং রূপসেন চাকমা                                 
২৫। মিঃ রূপসেন চাকমা (৩৭) পীং সেচচন্দ্র চাকমা                                
২৬। থিরেন্দ্র ত্রিপুরা (২৯)                               
২৭। কমলা রানী চাকমা (৪৫)                                     
২৮। হিরেন্দ্র ত্রিপুরা (৪৫)                                 
২৯। জ্যোৎস্না দেবী চাকমা (১২)                               
৩০। কোরি চোগী চাকমা (৪০)                                  
৩১। অরুন কান্তি ত্রিপুরা                              
৩২। মনিন্দ্র ত্রিপুরা                                    
 ৩৩। নিরেন্দ্র ত্রিপুরা                                    
৩৪। আলোনা দেবী চাকমা                                       
৩৫। ইন্দ্রমুখী চাকমা                                     
৩৬। অনঙ্গলতা চাকমা                                  
৩৭। কাজল চাকমা (২৩)                              
৩৮। আলপনা চাকমা (১০)                                      
৩৯। হালক্যা চাকমা (১৬)                                         
৪০। সুমিত্র চাকমা                                       
৪১। অরুন চাকমা                                      
৪২। কমলা বাপ চাকমা                                  
৪৩। বিমলেন্দু চাকমা                                   
৪৪। বুদ্ধ জয় মা চাকমা                                 
৪৫। শান্তি রতন চাকমা (১৫)                                    
৪৬। বাসন্তি দেবী চাকমা                               
৪৭। সাধনা দেবী চাকমা                                  
৪৮। অমিয় কান্তি চাকমা

১০ এপ্রিল লোগাং হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি হত্যা করেছিল তাদের তালিকার একাংশ
১। মঙ্গল মিয়া                                 
২। মনু মিয়া ও তার দুই ছেলে দুলাল্যা ও মোঃ আরিফ                                     
৩। কাজী হানিফ (ইউপি মেম্বার)                               
৪। বাসার (মেম্বার ভাই) আলপনা ও বাচ্চুকে হত্যা করে                                    
৫। কিরণ ভুঁইয়া ইউপি চেয়ারম্যান পীং আব্দুল আজিজ ভুঁইয়্যা (দলনেতা)                                    
৬। মেজর গনি - পুজগাং শুকনাছড়ি সাবজোন কমাণ্ডার                                        
৭। রাধীকা শাহ্ পীং নুরুল ইসলাম মোল্লা                                 
৮। মোঃ ইলিয়াস                           
৯। মোঃ শামসু                               
১০। মোঃ খনা (শামসুর ভাই) রূপায়নকে কেটেছে                               
১১। হারাধন সাহা                                       
১২। পুতুল সাহা (হারাধনের ছেলে)                                       
১৩। জাকির আনসার (চন্দ্র সাগর চাকমা ও অরবিন্দুকে গুলি করে) পীং আবুল হোসেন                               
১৪। কেরামত আলী (ভিডিপি কমা-ার)                                     
১৫। ইউসুপ (আনসার)                               
১৬। সফিউল                                 
১৭। আব্দুল মোতালেব (বিডিআর) দুজনকে গুলি করে মেরেছে ও অনেককে আহত করেছে                             ১৮। দুলাল মিয়া আনসার ৬ জনকে মেরেছে ও অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে                                      
১৯। কাসেম আনসার                                   
২০। জনাব আলী অনুপ্রবেশকারী                              
২১। ইদ্রিস মোল্লা পীং নুরুল ইসলা মোল্লা (অনু)                                  
২২। শাহীন ভিডিপি                                
২৩। মোঃ সুমন (ভিডিপি)                              
২৪। মোঃ দুলু                                     
২৫। মোঃ বেলাল আনসার                                        
২৬। ভাণ্ডারী (ভূপাতিকে মেরেছে)                               
২৭। আলী আহম্মেদ                                   
২৮। শাহ্ জালাল                                       
২৯। জ্যোল্যা                                 
৩০। জামশেদ ভুঁইয়া পীং আব্দুল আজিজ ভুঁইয়া (অনুপ্রবেশকারী)                                    
৩১। হাবিলদার জলিল (আনসার সদস্য)                                   
৩২। আবু জাহেদ পীং মৃত আব্দুল গফুর (অনুপ্রবেশকারী)                                   
৩৩। আবুল হাশেম কাজী পীং আলী আহমদ (অনুপ্রবেশকারী)                                        
৩৪। সিদ্দিকুর রহমান (আনসার পি.সি)                                   
৩৫। এসহাফ মিয়া পীং মৃত আবু আহমদ (অনুপ্রবেশকারী)                               
৩৬। নুরুন্নবী পীং সামসুল হক (অনুপ্রবেশকারী)                                    
৩৭। নূর মোহাম্মদ পীং বারু মিয়া (অনুপ্রবেশকারী)                               
৩৮। আজাদ মিয়া পীং মংগল মিঞা (অনুপ্রবেশকারী)                                            
৩৯। আমীর আলী পীং মোঃ হাসান আলী (অনুপ্রবেশকারী)                                  
৪০। সুক্কর আলী ভুঁইয়্যা পীং সৈয়দ আলী ভুঁইয়্যা (অনুপ্রবেশকারী)                               
৪১। মধুমিয়া পীং আব্দুল রহিম (অনুপ্রবেশকারী)
৪২। খায়ের আলী পীং মোঃ নায়ের আলী (অনুপ্রবেশকারী)                               
৪৩। কোরবান আলী পীং সৈয়দ আলী (অনুপ্রবেশকারী)                                 
৪৪। মিন্টুমিয়া পীং মজলিশ মিয়া (অনুপ্রবেশকারী)                              
৪৫। হাসান আলী পীং খয়ন মিয়া (অনুপ্রবেশকারী)                                
৪৬। আবুল জলিল পীং আনু মিয়া (অনুপ্রবেশকারী)                             
৪৭। কামাল হোসেন পীং আবু জাহের (অনুপ্রবেশকারী)                                   
৪৮। হাবিবুল্লাহ পীং আব্দুল রহিম(মেম্বার) অনুপ্রবেশকারী)                                  
৪৯। লোকমান (আনসার)                          
৫০। সুলতান কাজী (আনসার)                                   
৫১। লোকমান (অনুপ্রবেশকারী)                                  
৫২। জাকের মিয়া (অনুপ্রবেশকারী)                                       
৫৩। জলফু (অনুপ্রবেশকারী)                                    
৫৪। শাহ জাহান (অনুপ্রবেশকারী)                              
৫৫। আলী আহম্মেদ (অনুপ্রবেশকারী)                                    
৫৬। মোঃ হাইরে (অনুপ্রবেশকারী)                                       
৫৭। সুবেদার হাবিবুর রহমান                                   
৫৮। নায়েক সুবেদা সোহর হোসেন                                     
৫৯। এ, সি, পি নূর                             
৬০। পি, সি অলি রহমান

-----------------------------------------------------------------------------

 [ বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটির আমন্ত্রণে চৈত্র সংক্রান্তি (বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু) উপলক্ষে ঢাকা থেকে ডেপুটি এটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ সহ ২৩ জন রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, লেখক, আইনজীবি, সাংবাদিক, ছাত্র নেতা, মানবাধিকারকর্মী পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেন। ঘটনাক্রমে তখন খাগড়াছড়ি জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে এক মর্মান্তিক ও বিভীষিকাময় গণহত্যা সংঘটিত হয়। সম্মানিত অথিতিবৃন্দ ঐ গণহত্যা সংঘটিত এলাকায় যেতে চাইলে পানছড়ি জোনের মেজর রেজা তাদেরকে বাধা দেন। পরে শোক, ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসে তাঁরা একটি বিবৃতি দিয়ে আলোচনার ঝড় তোলেন। নিম্নোক্ত তাদের প্রদত্ত বিবৃতিটি হুবহু ছাপানো হলোঃ]
------------------------------------------
পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রত্যাগত ২৩ জন রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, লেখক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা, মানবাধিকার কর্মীর যুক্ত বিবৃতি
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বা অর্থা পার্বত্য জনগণের ঐতিহ্যবাহী উসব বৈ-সা-বি অনুষ্ঠানের কথা ছিল ৩০,৩১ চৈত্র ও ১লা বৈশাক (১২,১৩,১৪ এপ্রিল)। বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটি এতে যোগদানের জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানায় এবং সেমত আমরা গত ১১ এপ্রিল খাগড়াছড়ি যাই। ঐদিন দেশের সকল জাতীয় দৈনিকে একটি খবর প্রকাশিত হয় এই মর্মে যে, “শান্তিবাহিনীর হামলায় খাগড়াছড়ির লোগাং গ্রামে ১ জন বাঙালি ও ১০ জন উপজাতীয় নিহত হয়েছেন।” খাগড়াছড়ি গিয়ে আমরা স্বভাবতঃই ঐ অঞ্চলে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করি ঘটনার সত্যাসত্য জানবার দায়িত্ববোধ থেকে। কিন্তু পরের দিন ১২ই এপ্রিল লোগাং যাবার পথে পানছড়িতে আমরা বাধাগ্রস্থ হই এবং আমাদের নিরাপত্তার কথা বলে নিরাপত্তাবাহিনী আামাদের ঘটনাস্থলে যেতে বাধাদান করে। ফিরবার পথে এবং খাগড়াছড়িতে বহু সংখ্যক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনার শিকার ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের সাক্ষা হয়। কর্তৃপক্ষীয় বিভিন্ন ব্যক্তির সাথেও এ নিয়ে আমাদের কথা হয়। এ সব কিছু থেকে আমরা এই স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, লোগাং গ্রামে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। একজন বাঙালি কিশোর নিহত হওয়ার সূত্র ধরে সেখানে চাকমা ও ত্রিপুরা গুচ্ছগ্রামে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ভিডিপি ও আনসার বাহিনী কিছু বাঙালি দুষ্কৃতিকারীর সহযোগিতায় হামলা চালায়। চারশরও বেশি ঘর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় এবং শিশু-নারী-বৃদ্ধসহ ২ শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। এ বর্বর গণহত্যার বর্ণনা শুনে আমরা স্তম্ভিত হই, এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এ বর্বর গণহত্যার কারণে পুরো অঞ্চলে পাহাড়ি জনগণের বার্ষিক উসবের সকল কর্মসূচী পরিত্যক্ত হয়। আনন্দমুখর জনপদ শোক ও অশ্রুর জনপদে পরিণত হয়। ঘরছাড়া, মা হারানো, বাবা হারানো, সন্তান হারানো নিরীহ দুর্বল দরিদ্র জনগণের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ক্ষুব্ধ। একইসঙ্গে আমরা ক্ষুব্ধ প্রকৃত ঘটনা চেপে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের ন্যাক্কারজনক চেষ্টায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য জনগণের উসবের অংশীদার হতে গিয়ে আমরা তাঁদের শোকের ও ক্ষোভের অংশীদার হয়েছি। অঞ্চলের জনগণ ও কর্তৃপক্ষের বিভিন্নস্তরে কথা বলে এবং বাস্তব অবস্থা দেখে বুঝেছি সমগ্র এলাকায় কার্যতঃ একটি সামরিক শাসন চলছে। সমগ্র বেসামরিক প্রশাসন আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসনের অধীনস্ত এলাকায় সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের কোন স্বাধীন কার্যক্রম নেই। চলাফেরার স্বাধীনতা সাংঘাতিকভাবে সীমাবদ্ধ।

পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে বাঙালি জনগণের একটি কৃত্রিম দ্বন্ধ সৃষ্টি করে এবং তা অব্যাহত রেখে লাভবান হচ্ছে একটি কায়েমি স্বার্থবাদী মহল। জাতীয় ঐক্য, অখ-তা ও বাঙালি জনগণের স্বার্থের কথা বললেও এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐক্য, অখ-তা ও বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যারা লড়াই করেছেন সেই বাঙালি জনগণ কোনভাবেই অন্য জাতির উপর নিপীড়ন অনুমোদন করতে পারেন না। এই অবস্থার দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের, বাঙালি শাসক শ্রেণীর।
পার্বত্য অঞ্চলে অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে চলাফেরার মত প্রকাশ, তথ্য প্রকাশ ইত্যাদির উপর নানা প্রকার বিধি নিষেধ আরোপ করে বিপুল লুন্ঠন পরিচালিত হচ্ছে বলে আমাদের ধারণা। ঐ অঞ্চলে যে বিপুল রাজস্ব ব্যয় হচ্ছে তার বাস্তব পরিণতি সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবার যথেষ্ট কারণ আছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার মানুষদেরকে বাঙালিদের চাইতে ভিন্নভাবে সন্দেহ অসম্মানের চোখে কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে দেখার কারণে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিপুল সম্পদ ও সম্ভাবনার এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের এই পরিস্থিতি সমগ্র জাতীয় উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। আমরা তাই পরিস্থিতি পরিবর্তনের আশু পদক্ষেপ হিসাবে কয়েকটি সুপারিশ করছি। আশাকরি নির্বাচিত সরকার এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে পার্বত্য অঞ্চলে স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগী হবেন।

(১) অবিলম্বে লোগাং হত্যাকা-ের স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে এতদিন যত হত্যাকা-, ধর্ষণ, নিপীড়ন হয়েছে সেই ঘটনাবলীর বিচার বিভাগীয় তদন্তকার্য পরিচালনা করে সকল তথ্য প্রকাশ করতে হবে ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে।
(২) পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ২০ বছরে সৃষ্ট পরিস্থিতি, রাজস্ব ব্যয় ও তার ফলাফল সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
(৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাধানের জন্য বলপ্রয়োগের নীতি বর্জন করে বিষয়টিকে সংসদের অধীনস্থ করতে হবে এবং ঐ সংসদে খোলাখুলি আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৪) সংসদ সদস্য ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্টি-দল ও সামাজিক শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে এবং ঐ অঞ্চলে সন্ত্রাসমুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করবার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
(৫) প্রশাসনকে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে বেসামরিক নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন কার্যকর করতে হবে।
(৬) অঞ্চলের সমগ্র জনগণকে হাতেগোণা কিছু লোকের শান্তিবাহিনীর সঙ্গে এক করে দেখার বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ যাতে নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এ দেশের সব মৌলিক অধিকার ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকতে পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিবৃতে স্বাক্ষর দান করেন :-
১। পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য, সাধারণ সম্পাদক, ন্যাপ, ২। দিলীপ বড়–য়া, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল; ৩। নিজামুল হক নাসিম, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; ৪। শাহজাহান মিয়া, সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন; ৫। আনু মুহাম্মদ, শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ৬। সৈয়দ হাশেমী, শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ৭। মোস্তফা ফারুক, কেন্দ্রীয় নেতা, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল; ৮। আদিলুর রহমান খান শুভ্র, আইনজীবি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; ৯। সারা হোসেন, ব্যারিষ্টার; ১০। নাসিরউদ্দুজা, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন; ১১। আহাদ আহমেদ, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন; ১২। বিপ্লব রহমান, প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন; ১৩। প্রিসিলা রাজ, সংবাদদাতা, প্রিয় প্রজন্ম; ১৪। আব্দুল জলিল ভুঞা, ডেইলী ষ্টার; ১৫। আখতার আহমেদ খান, বাংলার বাণী; ১৬। সলিমউল্লাহ সেলিম, আলোকচিত্র সাংবাদিক; ১৭। সৈয়দ সারোয়ার আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ অবজারভার, ১৮। সুবীর দাস, ভোরের কাগজ; ১৯। আহমেদ যোবায়ের, দৈনিক জনতা; ২০। রোজালীন কস্তা, হটলাইন, বাংলাদেশ; ২১। শিশির মোড়ল, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ, ২২। মাসুদ আলম, জাতীয় যুব জোট।
-----------------
       

ভাবনার কথা/আহমদ শরীফ
জান্তব হিংস্রতাঃ সভ্য মানুষের লজ্জা
১৯৯২ সনের ১০ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামের তিনজন পাহাড়ি যুবতী মাঠে গরু চড়াতে গেলে পার্শ্ববর্তী বাঙালি গুচ্ছগ্রাম থেকে কিছু উচ্ছৃংখল যুবক জোরপূর্বক তাদের ধর্ষণের চেষ্টা করে। পাহাড়ি যুবতীরা দা দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। এতে একজন বাঙালি আহত হয় এবং পরে রক্তকরণের ফলে মারা যায়। [বেনামা ইস্তেহার] ধর্ষণ শাস্ত্রনামা সভ্যজগতে এবং সংস্কৃতিমান মানুষের নৈতিক চেতনায় গর্হিত অমানবিক কর্ম আচরণ। জোরে জুলুমে ও জবরদস্তীতে তাদের লাঞ্ছিত করার হামলা তারা হাতের অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ করেছে। এ জন্য সভ্য-সংস্কৃতিমান এবং শাস্ত্রমানা নীতি-নিয়মনিষ্ঠ ব্যক্তি মাত্রই নারীদের তারিফে মুখর হওয়ার কথা। কিন্তু স্থানীয় পর্ষদ সদস্য ও পর্ষদ চেয়ারম্যানের ভাই এবং শান্তি-শৃংখলা রক্ষক দুর্বল অসহায় আক্রান্ত মানুষের ভ্রাতা আনসার প্রভৃতির মধ্যে মনুষ্যত্ব ছিলো না, ছিলো না শাস্ত্র চেতনা, ছিলো না মানবিক বিবেক-বিবেচনা, ছিলো না নীতি-নিয়মে, রুচি-আইনে আনুগত্য। তারা তখন মানুষ হিসেবে নয়, কেবল মুসলিম হিসেবে, জান্তব হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো গাঁয়ে মুসলিম হত্যারূপ অবমাননার প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্যে। ফলে প্রাণ হারালো প্রায় দেড় হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, রুগ্ন নির্বিশেষে ভস্মীভুত হলো ঘরবাড়ি, অর্থ-সম্পদ, ধান-চাল, পশু-পাখি এ যেন আর এক মাইলাই !     
১৯৯২ সনের এপ্রিল মাসে সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের গ্রামরক্ষী দল, আনসার ও সরকারের অনুগত পর্ষদ সদস্যরা এ শক্তি, এ সাহস কোথায় পেলো, কেন পেলো তা এখন আর গুহায়িত নেই। সরকার এ হিংস্র পশ্চাচারকে যে সমর্থন করল, শান্তিবাহিনীর অপকর্ম বলে যে রটাল, তাতেই বোঝা গেলো সরকার পাশবশক্তির সমর্থক এবং শাসক মুসলিম গোষ্ঠীর মান-মর্যাদা রক্ষায় প্রয়াসী। সরকারী নীতি ‘দুর্বলেরে রক্ষা আর দুর্জনেরে হানা নয়, দুষ্ট-দুর্জন-দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতি-স্বধর্মীকে আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে পোষণ। সরকারের অনুগত সৈন্যবাহিনীও এ সরকারী নীতির বাস্তবায়নে নিষ্ঠ এবং কার্যতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী প্রতিরোধের নামে সামরিক শাসনই চলে। বেনামা ইস্তেহারে এগারো জন হত্যাকারীর নামও দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের গ্রেফতারের কোনো খবর জানা যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তার ও সংস্কৃতির প্রতীক, প্রতিম ও প্রতিভূস্বরূপ বার্ষিক বর্ষশেষ ও নববর্ষ উসব “বৈসাবি” উপলক্ষে এ বছর ঢাকার তেইশ জন রাজনীতিক, শিক্ষক, লেখক, আইনজীবি,সাংবাদিক, ছাত্রনেতা ও মানবাধিকার কর্মী আমন্ত্রিত হয়ে ওই বীভস ঘটনার একদিন পরে তিনদিনের সফরে খাগড়াছড়ি ১১ এপ্রিল পৌছেন, কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের লোগাং গাঁয়ে যেতে দেয়নি সঙ্গত সরকারী নির্দেশে ও স্বার্থেই। এরাও ফিরে এসে ১৮ এপ্রিল একটি সস্বাক্ষর বিবৃতি প্রচার করেছেন।
তাদের বিবৃতির একটি অংশ এই খাগড়াছড়িতে বহুসংখ্যক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষা হয়। কর্তৃপক্ষীয় বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গেও এ নিয়ে আমাদের কথা হয়। এ সব কিছু থেকে আমরা এই স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, লোগাং গ্রামে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। গ্রাম প্রতিরক্ষা দল, আনসার বাহিনী কিছু বাঙালি দুষ্কৃতিকারীর সহযোগিতায় (লোগাং গ্রামে)। চারশ’র বেশি ঘর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়, এবং শিশু-নারী বৃদ্ধসহ দু’শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়”।
বিবৃতিদানকারীদের প্রায় সবাই ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহলে সুপরিচিত ব্যক্তি। বিবৃতি শেষে এরা এ সম্পর্কে ছয়টি দাবীও পেশ করেছেন, অবশ্য নীতিনিষ্ঠ সরকারের বধির কর্ণে এগুলো কখনো প্রবেশ পথ পাবে না। সরকারের চোখ-কান-মন-মত ও হাত কেবল সরকারের স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়। এ-ই সরকারী নীতি ও নিয়ম। তাই আমরা বিবেকের তাড়নায়, নিন্দায়, ধিক্কারে আমাদের অন্তরের মানবিক ঘৃণা পরিব্যক্ত করেই বয়ান শেষ করলাম। তবে জিজ্ঞাসু ও কৌতুহলী বিবেকবান ব্যক্তির জিজ্ঞাসা ও কৌতুহল নিবারণের জন্যে ১৯৯২ সনের মার্চ মাসে Chittagong Hill Tracts Commission প্রকাশিত `Life is not Ours' : Land and Human Rights in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh' নামে প্রকাশিত শোষণ,পীড়ন, বঞ্চনা, লাঞ্ছনার তথ্য সম্বলিত An up to date of May 1991 Report পড়ে দেখতে পারেন।
[সৌজন্য : সাপ্তাহিক খবরের কাগজ ৭ মে ১৯৯২ইং সংখ্যা]
------------------------

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস নোট মন্ত্রীর বক্তব্য এবং আমাদের কথা
- মিঃ পল্লব

গত ১০ এপ্রিল ১৯৯২ এই স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরতম গণহত্যা হয়ে গেল। পার্বত্য জনগণের তথাকথিত নিরাপত্তার জন্য যে বিশাল সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে তাদেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পুনর্বাসিত অনুপ্রবেশকারীরা পাহাড়ি জনগণের উপর চৈত্রের ভর দুপুরে ঝাঁপিয়ে পড়ল আগ্নেয়াস্ত্রসহ দা, বর্শা, খন্তা প্রভৃতি ধারালো অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে। মাত্র ঘন্টা খানেকের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে গেল এক হাজারেরও অধিক তরতাজা মানুষ। কি নির্মম এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এতবড় একটা ঘটনা ঘটল অথচ দেশের কোন মানুষ জানতে পারল না। তার প্রকৃত ঘটনাটি কি ? রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এ শাসক শ্রেণী তার ক্ষমতার জোরে সে দিনের খবর উল্টোভাবে প্রচার করলেন। ঢাকাস্থ বিবিসি সংবাদদাতা আতাউস সামাদ খবর পাঠালেন, “শান্তিবাহিনীর বেপরোয়া আক্রমণে ১১জন পাহাড়ি নিহত।” হায়রে সাংবাদ মাধ্যম। হায়রে সাংবাদিক। একজন সাংবাদিকের দায়িত্বজ্ঞানের কথা ভুলে গিয়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক সরবরাহকৃত খবরের উপর নির্ভর করে কোন বিচার বিবেচনা ছাড়া সংবাদটি প্রেরণ করলেন। এর অর্থ কি নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা ? নাকি হলুদ সাংবাদিকতা ? বিচারের দায়িত্ব শান্তিকামী জনগণের।
এদেশে এখন গণতান্ত্রিক (?) সরকার বর্তমান। গণতন্ত্রের জয়গান দেশে বিদেশে গাইতে থাকেন সরকার প্রধান মিসেস্ খালেদা জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গ আমলা ও মন্ত্রী মহোদয়গণ। আর গণতন্ত্রকে নচ্যা করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে বলে একইসাথে অনবরতভাবে অভিযোগ করে চলেন তিনি। কিন্তু কি সেই গণতন্ত্র ? গণতন্ত্রের অর্থ কি জনগণের অর্থে পালিত সেনাবাহিনী, বিডিআর, আনসার, ভিডিপিকর্তৃক নিরীহ জনগণকে হত্যা করা ? গণতন্ত্রের অর্থ কি ৭১ এর নর ঘাতক রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের রক্ষা করার জন্য সরকারীভাবে দায়িত্ব নেয়া ? গণতন্ত্রের অর্থ কি নিজের দ্বারা সংঘটিত ঘটনাবলি অন্যের ঘাড়ে চেপে দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো ? গণতন্ত্রের অর্থ কি সংখ্যালঘু পাহাড়ি গনগণের উপর ইচ্ছামত দমন-পীড়ন কর ? গণতন্ত্রের অর্থ যদি তাই হয় এবং এই গণতন্ত্র যদি সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের বিপক্ষে যায় তাহলে সেই গণতন্ত্র নিশ্চয়ই কারোর কাম্য হতে পারে না।

সে দিনের দশ এপ্রিলের ঘটনায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে সমস্ত পাহাড়ি জনগণ। তাদের ঐতিহ্যম-িত বৈ-সা-বি’র আনন্দ উসব রূপান্তরিত হয় শোক দিবসে। হাজার হাজার পাহাড়ি কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক (?) সরকার অনড়-অটল। পার্বত্য এলাকার সংগ্রামী পাহাড়ি ছাত্র সমাজ ও সর্বস্তরের জনগণ এই পাশবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশের সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন সমূহ এ ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায়। দেশী বিদেশী বিভিন্ন মানবতাবাদী সংগঠনও এই জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে এগিয়ে আসেন। বর্তমানে গণতান্ত্রিক (?) সরকার যখন বুঝতে পারলেন ঘটনাটি আর ধামাচাপা দেয়া যাবে না তখন লোক দেখানো সফরে পাঠালেন তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরীকে। তাও ঘটনার পনের দিন পরে মন্ত্রী মহোদয় গেলেন লোগাং-এ। দেখলেন ভস্মীভূত তথাকথিত “শান্তিগ্রাম” নামক বন্দী শালাটি। তারপরও আঁচ করতে পারলেন না ঘটনাটি কতটুকু মর্মান্তিক। তিনি সেখানে একটা সংক্ষিপ্ত জনসভাও করলেন। এবং ঐ জনসভায় বললেন তিনি এবং তার সরকার নাকি সন্ত্রাস দমন করতে বদ্ধ পরিকর। প্রশ্ন জাগে এ সরকার কোন সন্ত্রাস বন্ধ করবে ? দেশে সন্ত্রাসকারী কারা ? আমার মনে হয় বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসকারী হচ্ছে সরকার নিজেই। প্রতিনিয়ত সরকারের আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে সরকারী সেনাবাহিনী, সরকারী ছাত্র দল এবং সেনা মদদপুষ্ট গুটি কয়েক ছাত্র সংগঠন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার সন্ত্রাস বন্ধ করবে নাকি জনগণকে সন্ত্রাস বন্ধের জন্য নামতে হবে ? মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, এই দুটো থেকে কোনটি আপনারা বেছে নিতে চান ? নিজেরাই নিজের সন্ত্রাস যদি বন্ধ করেন ভাল কথা। কিন্তু জনগণকে যদি সন্ত্রাস বন্ধের জন্য নামতে হয় তার পরিণাম আপনাদের জন্য শুভ হবে না। সুতরাং সাবধান।
মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ঢাকায় ফিরে এসে স্বভাব সুলভ বশতঃ একটা প্রেস নোটও দিলেন। এতে লিখা ছিল লোগাং-এর ঘটনায় নাকি মাত্র তের জন লোক মারা গেছে। মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এই হিসেব কোথায় পেলেন? নিশ্চয় তাদের কাছ থেকে পেয়েছেন যারা দশ তারিখের ঘটনায় জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তবে এবার প্রেস নোটে উল্লেখ ছিল শান্তিবাহিনীর স্থলে স্থানীয় উশৃংখল একদল বাঙালি। মাননীয় গণতান্ত্রিক (?) সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, আপনারা এত লাজুক কেন ? সত্য স্বীকার করতে এত লজ্জা ও ভয় কিসের ? একবার বলেন শান্তিবাহিনীর হামলায় ১১ জন নিহত, আবার বলেন স্থানীয় উশৃঙখল বাঙালিদের হামলায় ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আপনাদের এসব বক্তব্য থেকে আপনাদের অগণতান্ত্রিক চরিত্র প্রকাশ পায় না ? আপনাদের এহেন আচরণ থেকে বুঝতে বাকী থাকে না এই গনতন্ত্র জনগণের জানমাল নিরাপত্তা বিধানের গণতন্ত্র নয়। এই গণতন্ত্র নিরীহ জনগণকে মারার গণতন্ত্র।
খাগড়াছড়ির সেনা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা হয়েছে লোগাং ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নাকি এ যাব চৌত্রিশ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আদতে কি গ্রেফতার করা হয়েছে ? হয়ে থাকলে কোন জেলে এসব আসামীদেরকে রাখা হয়েছে এবং কোন কোর্টে তাদেরকে সোপর্দ করা হয়েছে জনগণ তা জানতে চায়। কারণ পূর্বেও এ রকম অনেক মুখরোচক খবর শোনানো হয়েছে। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় ১৯৯০ সনে সেনাবাহিনী কর্তৃক ১৪ জন কিশোরীকে উপর্যুপরি ধর্ষণের ঘটনার ব্যাপারেও নাকি তখন বলা হয়েছিল এসব সেনাবাহিনী সদস্যদেরকে গ্রেফতার করে সাজা দেয়া হয়েছে। কিন্তু জনগণ জানে না ঐ সব সেনা সদস্যরা কোন জেলে ছিল এবং আছে। পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত এভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে। তাই আমাদের দাবী এসব ঘাতক কুখ্যত খুনীদের গোপনে কেন ? প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হউক। জনসমক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হউক। যদি তা না হয়, তাহলে বুঝবো পর্দার অন্তরালে পূর্বের মত লোক দেখানো গ্রেফতার ছাড়া এবারেও তার চেয়ে বেশী কিছু হওয়ার আশাা নেই।

মাননীয় গণতান্ত্রিক (?) সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, আপনার প্রয়াত স্বামীর নীতি পার্বত্য এলাকায় অনুসরণ করবেন না। আপনার স্বামীর ভুল নীতির কারণে পার্বত্য এলাকার সমস্যা আজ এত গভীরে চলে গেছে। আর, বর্তমানে আপনি ক্ষমতায় এসে নির্যাতনের মাত্রা এরশাদ আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে নির্যাতন অব্যাহত থাকলে তার ফল শুভ হবে না। তাই সময় থাকতে সমাধান করতে চেষ্টা করুন।

------------------------------------------
আমরা দুঃখিত
রাডারের গত বৈ-সা-বি সংখ্যায় “গণ আদালতের কাঠগড়ায় গোলাম আযম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ” শিরোনামে প্রকাশিত মিঃ পল্লবের লেখার প্রতি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যুক্তভাবে একটি চিঠি লিখেছেন সহযোদ্ধা বৃষকেতু চাকমা, কর্মসেন চাকমা, পি জে চাকমা, সুনীল বিকাশ দেওয়ান, সুগতদর্শী চাকমা ও সমর বিজয় চাকমা। উক্ত চিঠিটি খুবই শেষ মুহুর্তে আমাদের হাতে আসায় এ সংখ্যায় তা ছাপানো সম্ভব হলো না বলে আমরা দুঃখিত। পরবর্তীতে ছাপানোর ইচ্ছে রইল। উল্লেখ্য, “রাডার”-এ প্রকাশিত লেখকদের সব মতামত ও বক্তব্য সম্পাদনা পরিষদের সাথে এক নাও হতে পারে। - “রাডার” সম্পাদনা পরিষদ
----------------------------------------------------------


কিছুই দেখি না কিছুই শুনি না
কিছুই বুঝি না

আনু মুহাম্মদ

বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির বাইরে যেসব সংখ্যালঘু জাতিসত্তা আছে তাদের সম্পর্কে বাঙালি শিক্ষিত ভদ্রসন্তানদের নাক উঁচু ভাবটা কোন গোপন ব্যাপার নয়। এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি হল - এসব জাতি হচ্ছে বর্বর, এই খায় - সেই খাই, চেহারা কি রকম, কোথায় থাকে গোছের; আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি হল - বৈচিত্রের জন্য এদের কিছু জিনিস রক্ষা করা দরকার, কিছু মুখস্ত “নাচ-নাচ” “পোষাক” দিয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ কর, ওরা, “উপজাতীয়” - কি-সব ভাষায় কথা বলে বেশ মজার ভাবভঙ্গি করে তবে এগুলো ধ্বংস হতে দেয়া ঠিক নয় - এ জাতীয় পিঠ চাপড়ানো ভাব।
এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বাঙালি মধ্যবিত্ত বেশ গর্ব অনুভব করে, নিজেকে উঁচু সভ্য জাতির একজন ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, কখনো ধমক দিয়ে কখনো মার দিয়ে কখনও “আদর” করে নিজেদের অবস্থানকে আরও পাকাপোক্ত করতে চায়। শত শত বছর বাঙালি এই দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হয়েছে - বিশেষতঃ ইংরেজ ও ইউরোপীয়নদের এই নাক উচু ভাব তো লুকানো ব্যাপার ছিল না - গদগদ বাঙালি মধ্যবিত্তের কাঁধে ব্রিটিশ প্রভুর জোয়ালের দাগ এখনও তার খুব প্রিয় স্মৃতি। ইংরেজরা যেভাবে শুধু বাঙালি কেন ভারতীয়দের দেখতো, সেই একই দেখার যোগ্যতা বাঙালি অধিপতিরা অর্জন করতে পেরে মহাগর্বিত। এই যোগ্যতা আর কিছু নয় শাসক শ্রেণীর আসনে যাওয়া। বাঙালি শাসকশ্রেণী আরেকটি জাতির উপর চড়াও হয়ে, তাকে ঘৃণা করে, অসম্মান করে, হত্যা করে, ধর্ষণ করে, ঘর ছাড়া করে, অনুগ্রহ করে খুব গর্ব অনুভব করে।

তাদের উপর চড়াও হয়েছে বাঙালি শাসকশ্রেণী, যাদেরকে সভ্য কোন পুর্ণাঙ্গ জাতি বলেই সে স্বীকার করে না, তাদের কোন জাতীয় উসব থাকতে পারে, এটা সে কি করে স্বীকার করবে? কিন্তু স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি দিয়ে বাস্তবতার কিছু আসে যায় না। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতি নিজেদের কোন জাতীয় উসব এখনও ঠিক করতে পারেনি, ভাষা আর ধর্মীয় পরিচয়ের দ্বন্দ্বে তাদের পরিচয় সংকট এখনও কাটেনি। কিন্তু সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহ তাদের জাতীয় উসব সম্পর্কে দ্বিধান্বিত নয়, দ্বিধান্বিত নয় নিজেদের পরিচয় নিয়েও।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা বসবাস করেন তাদের মধ্যে প্রধান তিনটি হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা। এদের ভাষা, সংস্কৃতি, উসব সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না - না জানায় আমাদের কোন লজ্জাও নেই, মাঝে মধ্যে একটু আধটু জেনে ওদের কৃতার্থ করবার ভঙ্গি করি। ওদের আবার উসব কি হবে? - এ জন্য জাতীয় বেতার-টিভি ওদের জাতীয় উসব সম্পর্কে একটি অনুষ্ঠান তো দুরের কথা একটি ছোট খবরও দেয় না।
বস্তুতঃ উসব করবার মত অবস্থায় ওরা এখন নেই। সারাক্ষণ মৃত্যু, উচ্ছেদ, নিপীড়ন ও ভয়ে ভীত মানুষদের পক্ষে কোন উসবের কথা চিন্তা করা মুশকিল। তবু যদি দেখা যায় এই অবস্থা বছরের পর বছর চলছে তাহলে ঐ জনগোষ্ঠীর আর কিছু করবার থাকে না। তখন মৃত্যুর সঙ্গে উসবকে এক করে নিতে হয়, সচল জীবন দিয়ে অচল জনপদের প্রতি ব্যঙ্গ ছুঁড়ে দিতে হয়।
এ বছরও তাই উসবের প্রস্তুতি চলেছে। উসবের নাম বৈসাবি; ত্রিপুরাদের বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমাদের বিজু -এক সঙ্গে বৈসাবি। শহুরে বাঙালিরা অভ্যস্ত না হলেও গ্রামাঞ্চলে চৈত্র শেষে এবং বৈশাখের শুরুতে যে উসবের আমেজ তৈরী হতো এবং এখনও কিছু কিছু হয় তা চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা জাতি - জাতীয় উসব হিসেবেই পালন করে। তাদের এই উসব তিনদিনব্যাপী-চৈত্রের শেষ দু’দিন এবং ১লা বৈশাখ। চাকমাদের বিজু উসবের প্রথম দিন ফুল বিজু, দ্বিতীয় দিন মুল বিজু, তৃতীয় দিন সামাজিক মিলন। এ সময়ে মেয়েরা ৩০ চৈত্রের ভোরে পাহাড়ি নদীতে ফুল দিয়ে উসব শুরু করে। নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় শিশুরা। স্থানে স্থানে পাহাড়ের ঢালে গান, নাচের অনুষ্ঠান হয়। বাড়িতে বাড়িতে খায় সকলে, নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে উসব শেষ হয়।
এ বছরও সে রকমই পরিকল্পনা হচ্ছিল। তিনদিন সব রক্তচক্ষু ভুলে থাকার প্রস্তুতি। কিন্তু হল না। হৃদয়ের রক্তকরণ নিয়ে যদিও বা উসবের আয়োজন করা যায় কিন্তু তাজা রক্তের উপর উসব করা যায় না।
সব শুরুর ঠিক এক দিন আগে লোগাং-এ দরিদ্র, বন্দী, নিরস্ত্র শত শত মানুষ নিহত হলেন। শিশু, নারী, বৃদ্ধ। তখন মধ্যাহ্ন। প্রচ- দুপুর। ঘরে ক্লান্ত দুর্বল অসহায় মানুষেরা প্রহর গুণছে। হিংস্র আক্রমণ হল তখনই। খোলা ঘরে কিংবা ঘরে ছিটকিনি দিয়ে আগুন ধরানো হল। আগুন ধরালো যারা, যারা দা, বটি, লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তারা সবল; তাদের বরঞ্চ আগুন নেভানোর দায়িত্ব- দুর্বলকে রক্ষা করবার দায়িত্বের কথা বলেই তারা আছে। শত শত ক্ষুদ্র কুটির নিমেষে পুড়ে গেল, পুড়লো মানুষ। নারী-শিশু মাথা হাত পা পোড়া আধপোড়া দেখেছেন অনেকেই।

প্রিয়জন নিহত হলে কি কান্নার অধিকার থাকবে না ? চিকার করে অভিযোগ জানানোর অধিকার থাকবে না? প্রিয়জন হারানোর বেদনা অন্যকে জানানোর অধিকার থাকবে না ? বর্বরদের বিরুদ্ধে পুরো দেশকে জানানোর অধিকার থাকবে না?                                
না। থাকবে না। কিছুই বলা যাবে না, কাঁদা যাবে না। শিশুদের নিয়ে বাবা হাঁটে, মা মরে গেছে - কোথায় যাবে কি করবে কে জানে? সন্তানেরা হেঁটে বেড়ায় অনিশ্চিত - বাবা-মা দুজনই মরেছে। ......... বর্বর ঘাতক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়- তৃপ্তির ছাপ চোখে মুখে। দেশের অখ-তা রক্ষা করলাম। নিহতদের স্বজনেরা পালিয়ে বেড়ায়, একটু বসে কান্নার সাহস নেই। কেউ যেতে পারবে না তাদের কাছে।
তারাই যেতে পারবে পোড়া আধপোড়া জনপদে যারা ফিরে এসে বলবে - “কিছুই হয়নি, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক চলছে। ওরা খুব সুখে আছে।”
এই কন্ঠ আমরা চিনি। এসব বর্বর ঘটনা ও যুক্তির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অনেক দিনের। বাঙালি জনগণ শুধু এ তথ্যটুকু জানেন না, তাদের দোহাই দিয়ে তাদের স্বজাতি শাসকেরা একই রকম হায়েনার বর্বর থাবা চাপাচ্ছে অন্য জাতির উপর।
এ সবকিছুই ঘটছে, কিন্তু আমরা কিছুই দেখি না, কিছুই শুনি না, কিছুই বুঝি না।
শাসক শ্রেণীর বদৌলতে পত্রিকার পাতায় ও টিভি-বেতারে তৈরী খবর পরিবেশিত হয়, চিন্তা নেই- সব ঠিকঠাক। সন্তুষ্ট হবার মত খবর দেখেশুনে বাঙালি শিক্ষিতেরা তৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘুমাতে যায়। বর্ণবাদের শিকার বাঙালি নিজেই বর্ণবাদীতে পরিণত হয়।                      
পাহাড়ের কোলে কোলে রক্তপাত চলতে থাকে। ১৮-৪-৯২
আনু মুহাম্মদ : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক।

[সৌজন্যে : ভোরের কাগজ ২৪/৪/১৯৯২ ইং] 


------------------------------------------
লোগাং - এ র টু কি টা কি 
----------------------------------------
লাশ নিয়ে রাজনীতি করা চলবে না
লোগাং গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর দিন অর্থা ১২ই এপ্রিল ‘৯২ খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমা-ার ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। গুচ্ছগ্রামবাসীরা স্ব স্ব ধর্মমতে দাহ করার জন্য নিহত ব্যক্তিদের লাশ ফেরত দেয়ার দাবী জানান। এর জবাবে ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজ সংঘটিত গণহত্যা এবং লাশ নিয়ে বাড়াবাড়ি ও রাজনীতি করা চলবে না বলে সকলকে হুঁশিয়ার করে দেন।                              
উল্লেখ্য, এই ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশে ও সহযোগিতায় খাগড়াছড়ি কৃষক শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ ও একটি তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা ছয়টি লাশ নিয়ে ঢাকায় ১২/১১/৯১ ইং রাজনীতি করেছিল।
---------------------

কুখ্যাত মিন্টু বিকাশ কর্তৃক চাল আত্মসা
১০ই এপ্রিল লোগাং গণহত্যার শিকার পরিবারবর্গের জন্য ৫৩০ মন চাউল বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে ৪২৫ মন বন্টন করা হলেও বাকী ১০৫ মন চাউল খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ সদস্য কুখ্যাত মিন্টু বিকাশ চাকমা কর্তৃক আত্মসা করা হয়। উল্লেখ্য এই কুলাঙ্গার দালাল অতীতেও বহুবার জনগণের সম্পদ এইভাবে আত্মসা করেছে এবং নিরীহ পাহাড়ি জনগণের বিরুদ্ধে সেনাক্যাম্পে মিথ্যা ও সাজানো রিপোর্ট দিয়েছে।
----------------------

সত্য কথা বলা যাবে না
গত ১৪ই এপ্রিল ‘৯২ পানছড়ি উপজেলার ২৮ জন গন্যমান্য ব্যক্তিগণকে জনৈক সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক পানছড়ি আর্মি ক্যাম্পে ডেকে পাঠানো হয় এবং লোগাং গণহত্যা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য তাদেরকে কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, একই দিন পানছড়ি বাজার প্রাঙ্গনে একটি সাধারণ সভারও আয়োজন করা হয় এবং প্রকৃত ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক সাজানো ঘটনাকে প্রচার করার জন্য জনসাধারণকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়।
-----------------------

কুকুরের লাশ ??
গণহত্যার দিন লোগাং গুচ্ছগ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (নিরাপত্তাজনিত কারণে) একজন ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সদস্য নিহত রূপানন্দ চাকমা পীং রসিক চন্দ্র চাকমা ও বাত্যা চাকমা পীং বৃন্দধন চাকমা নামে দুই ব্যক্তির লাশ মাটিতে পুঁতে রাখতে দেখেন। ঘটনার এক সপ্তাহ পর অর্থা ১৭/৪/৯২ইং উক্ত স্থান হতে উপরোক্ত ব্যক্তিদের পঁচাগলা লাশ একটি লুঙ্গিসহ উদ্ধার করা হয়। এই সময় পুজগাং সাবজোনের মেজর গণি ও সুবেদার মেজর শাহজাহান, পানছড়ি বিডিআর ক্যাম্পের কমা-িং অফিসার মেজর আজাদ ও সুবেদার আব্দুল কাইয়ুম, পানছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এর ডাঃ জহিরুল ইসলাম এবং লোগাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবু সতিশ চন্দ্র চাকমা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপরোল্লেখিত ব্যক্তিদের লাশ সনাক্ত করা সম্ভব হলেও তা অস্বীকার করে কুকুরের লাশ বলে প্রচার করা হয়েছে। এখন সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, তাহলে কুকুর ও লুঙ্গী পরে লাশ হয় ?
----------------------

জনসভায় লাঠি চার্জ নয়, লাঠি চার্জ করেই জনসভা
সমাবেশ বা জনসভায় পুলিশ কর্র্তৃক লাঠি চার্জের ঘটনা এ দেশে অহরহ। কিন্তু লাঠি চার্জ করে জনগণকে সভা-সমাবেশে উপস্থিত করানোর খবর অনেকের কাছে রীতিমত অবিশ্বাস্য হতে পারে। আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সবই সম্ভব। 
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিল চৌধুরী গণহত্যা সংঘটিত লোগাং গুচ্ছগ্রাম পরিদর্শনে গেলে পানছড়ি জোন-এর সিও-এর নির্দেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক জনসাধারণকে জনসভায় আনা হয় এবং কেউ উক্ত সভায় যেতে অস্বীকার করলে লাঠি চার্জ কর হয়।
----------------------

জোর যার মুল্লুক তার
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জনসভায় জনসাধারণকে লাঠি চার্জ করে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হলেও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ২৮/৪/৯২ইং লোগাং-এর পোড়াভিটায় শহীদদের উদ্দেশ্যে কৃত ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেয়ার জন্য লোগাং অঞ্চলের জনগণকে যেতে দেয়া হয়নি। অধীর আগ্রহ থাকা সত্তেও সেনাবাহিনীর চাপে ধর্মপ্রাণ পাহাড়ি জনগণ ঐ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে গণহত্যায় শহীদ নিজের আত্মীয় স্বজনদের আত্মার সদগতির প্রার্থনা করতে পারেনি।
--------------------

“যাও না তাদের কাছে”
গত ৪/৫/৯২ইং পানছড়ি জোনের উপ-অধিনায়ক মেজর রেজা (৩৩ বেঙ্গল) লোগাং পোড়াভিটা পরিদর্শনে যান। এ সময় গুচ্ছগ্রামবাসীরা তার কাছে রেশনের দাবী করে। মেজর রেজা এ দাবীর জবাব দেন অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে। তিনি আরো বলেন, “গত ২৮শে এপ্রিল ছাত্রনেতা, সাংবাদিক এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতারা এসে তো অনেক কিছু বলেছিলো। তাদের কাছে যাও না কেন ? তারা (ছাত্ররা) তোমাদের কি দিলো, কি .  .  .  .  (লেখার অযোগ্য) করলো .  .  .  .  ” ইত্যাদি ইত্যাদি।
--------------------

খালেদা বিবি এলো গেলো ৫ কেজি চাল দিয়ে গেলো
দীর্ঘদিন লোগাং গুচ্ছগ্রামে রেশনিং বন্ধ ছিল। অতঃপর হঠা খালেদা জিয়া লোগাং-এর উক্ত পোড়াভিটা পরিদর্শনে যাবার একদিন আগে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারের জন্য ৫ কেজি করে চাউল বিতরণ শুরু হয়ে যায়। তারপর তিনি চলে যাবার পর আবার বন্ধ। তবে গুচ্ছগ্রামবাসীরা এখন উপোস করলেও একটি গান রচনা করেছে। এই গানটি হলো - “খালেদা বিবি এলো গেলো, ৫ কেজি চাল দিয়ে গেলো।”
---------------------

লোগাং গণহত্যাকে ধামাচাপা দিতে ডাঃ জহিরুল ইসলামকে দিয়ে মিথ্যা এফিডেভিট
১০ই এপ্রিল ’৯২ লোগাং গুচ্ছগ্রামে সংঘটিত গণহত্যাকে নির্লজ্জভাবে ধামাচাপা দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী কর্তৃক ডাঃ জহিরুল ইসলামকে একটি মিথ্যা এফিডেভিট পত্রে স্বাক্ষর দানে বাধ্য করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ডাঃ জহিরুল ইসলাম ঘটনার পর চিকিসার দায়িত্বে লোগাং গুচ্ছগ্রামে গিয়েছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলে নিজেই ১৪৮ টি লাশ গোনার পর অজ্ঞান হয়ে যান বলে প্রচার করেন, যা দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই সত্য কথা বলায় গত ২৮/৪/৯২ইং ডাঃ জহিরকে পানছড়ি জোন হেড কোয়ার্টারে ডেকে পাঠানো হয় এবং তাকে অত্র জোনের জনৈক সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক “গাধা কোথাকার”, “অপদার্থ” ইত্যাদি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও শাসানো হয়। পরে, লোগা-এর প্রকৃত ঘটনাকে মিথ্যাভাবে সাজানোর হীন উদ্দেশ্যে স্মারক নং- ৪৩, ইউ,এম/পান, তারিখ ২৮/৪/৯২ইং -এর মূলে অত্র জোনের জোন কমা-ারের কঠোর নির্দেশে জনাব হাবিবুল ইসলাম, ১ম শ্রেণীর হাকিম, পানছড়ি -এর মাধ্যমে ডাঃ জহিরুল ইসলামকে একটি মিথ্যা ও বানোয়াট এফিডেভিট পত্রে স্বাক্ষরদানে বাধ্য করা হয়। এই এফিডেভিট পত্রে সনাক্তকারী ও সাক্ষী হিসাবে যথাক্রমে শ্রী অনিল কান্তি দে- নিম্নমান সহকারী পানছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং মফিজুর রহমান স্বাস্থ্য পরিদর্শক - পানছড়ি কোর্ট কার্যালয়ে উপস্থিত থেকে ও সেনাবাহিনীর নির্দেশে সই করতে বাধ্য হন। উক্ত এফিডেভিট পত্রে ডাঃ জহিরুল ইসলাম লোগাং গুচ্ছগ্রামে চিকিসার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকাকালীন কেবলমাত্র ১৩টি লাশ ও ১৩ জন আহত ব্যক্তি দেখতে পান এবং তিনি কোন সাংবাদিকের সাথে কথা বলেন নি বলে মিথ্যাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এরপর ডাঃ জহিরুল ইসলামকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

কোন রকমে সমীরনের প্রাণ রক্ষা
১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যার পর সেনাবাহিনী জাতীয় কুলাঙ্গার, দালাল সমীরন দেওয়ানকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার জন্য লোগাং গুচ্ছগ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে সে প্রাণে বেঁচে যাওয়া গুচ্ছগ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে চাইলে স্বজনহারা বিক্ষুব্ধ গুচ্ছগ্রামবাসীরা স্বজনদের লাশ ফের চেয়ে তীব্র ভাষায় গালি দেয়। তারপরও ভোঁদাই সমীরন আবোল তাবোল বলতে থাকলে ক্ষোভে দুঃখে এলাকাবাসীরা তার উপর চড়াও হয়। সমীরন উপায়ান্তর না দেখে আর্মিদের ভিড়ে ঢুকে পড়ে এবং সেনাসদস্যরা কোন রকমে এই জনরোষ থেকে তাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। এরপর সমীরন আর এক দ- ঐ জায়গায় না থেকে সরাসরি আর্মি জীপে করে খাগড়াছড়ি চলে আসে।
-------------------

জেলা পরিষদ সদস্য মিন্টুর বগল বাজনা
গত ১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যার খবর শুনে মানুষ যখন শোক বিহ্বল, তখন গণধিকৃত জেলাপরিষদ সদস্য কুলাঙ্গার মিন্টু বিকাশ চাকমা এ খবর শুনামাত্র নিজের বগল বাঁজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে এবং খুশীতে নাচানাচি করে।   
উল্লেখ্য, এই নরপশু মিন্টু বিকাশ চাকমার দৌরাত্ম্যে বর্তমানে পানছড়ি এলাকার নিরীহ জনগণ অতীষ্ট হয়ে উঠেছে। নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে সেনাক্যাম্পে মিথ্যা রিপোর্ট দেয়া এবং লোক ধরিয়ে দেয়া তার পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
-------------------

সমীরন এখন Half-mad
ব্যাপক জনরোষ, সেনাকর্তাদের অনাদর, জনসমর্থনহীন এবং সর্বোপরি নিজের কোনঠাসা অবস্থা দেখে সমীরন এখন Half-mad. বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সে নাকি এখন উম্মাদের মত গ্লাসের পর গ্লাস মদ গিলছে আর ঠঈজ এ বোম্বে ফিল্ম দেখছে। স্ত্রী পুত্রের সাথেও কথা বলে কম। তাছাড়া ১৩ইমে খালেদা জিয়ার খাগড়াছড়ি জনসভায় সমীরন ভাষণ দিতে মঞ্চে দাঁড়াতেই উপস্থিত জনতা জুতা/সে-েল দেখিয়ে বিক্ষোভ দেখায়। প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতে দাঁড়ালে প্রথমে স্বাগতম ধ্বনী তোলে উপস্থিত জনতা। কিন্তু যে মুহুর্তে তিনি জেলা পরিষদ শক্তিশালী করার কথা ঘোষণা দেন ঠিক সে মূহুর্তে শত শত জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সমাবেশ ত্যাগ করে। সেদিন রাত্রে সমীরনকে অঝোরে কাঁদতে দেখা যায়।

একটি আকুল মিনতি
রাডার বিলি-বিক্রির দায়িত্বে যারা অক্লান্ত নিবেদিত তারা যেন আরও তপর হন। শুধু তপর নয় আন্তরিকও। তপর ও আন্তরিক হবেন রাডারের মূল্য পাঠানোর ক্ষেত্রেও। যত দ্রুত মূল্য পাঠাবেন ততই আমাদের কাজ এগোবে এবং পাঠকরা তরতাজা খবরে সমৃদ্ধ রাডার পাবেন।
বড়ই বন্ধুর ও সংঘাতমুখর আমাদের এ যাত্রাপথ। অনেক প্রতিকূল ও বিরুদ্ধ স্রোত পাড়ি দিয়ে এগোতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই আপনাদের সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই আমাদের চরম লক্ষ্যে। 
-------------------



পার্বত্য চট্টগ্রামে গণহত্যাঃ একটি সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র
মিঃ দিমিতির

"In fact, the Hill Peoples are caught up
in a similar situation to that of the
Bangalees in Pre-1971 Pakistan,"
-Dr. Imtiaz Ahmed.
                  - May 22, 1992, HOLIDAY.

ভাবতেও অবাক লাগে দু’দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানীদের শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-নিপীড়ন, আর হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস ভুলে গেল। যে বাঙালি পাকিস্তানীদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়েছে, তারাই আজ পাকিস্তানীদের মত একই খেলায় মেতেছে নিজ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাগুলোর বিরুদ্ধে। অবশ্য দেশের আপামর জনসাধারণ জানেই না পার্বত্য চট্টগ্রামে আসলে কি হচ্ছে। সরকার, শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত তথ্য, সত্য তুলে ধরতে শংকিত, দ্বিধান্বিত, কোন এক অজানা ভয়ে সস্ত্রস্থ। এই লেখার উদ্দেশ্য হল বিগত দু’দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত বড় বড় হত্যাকা-গুলোর একটি সংকিপ্ত তথ্যচিত্র তুলে ধরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যাযজ্ঞের শুরু সেই বাংলাদেশ শুরুর আগেই, একবারে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে। ১৯৭১ সালের ৫ই ডিসেম্বর রক্ষীবাহিনীরা পানছড়িতে ১৬ জন পাহাড়িকে হত্যা করে। তারপর বরকল এবং বান্দরবানেও একই রকম ঘটনা ঘটে। সেই যে শুরু, আর থামেনি। এরপর অবশ্য হত্যাযজ্ঞ প্রকট আকারে শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে।

(১)কাউখালী-কলমপতি হত্যাকাণ্ড, ২৫শে মার্চ, ১৯৮০।
বেতবুনিয়া থানাধীন কলমপতি ইউনিয়নের কাউখালী বাজারে ১৯৮০ সালের ২৫ শে মার্চ সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ বর্বরোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম। এতে সামরিক বাহিনী ও বাঙালি বসতিস্থাপনকারীদের হাতে কয়েক’শ পাহাড়ি নিহত হয়।
কলমপতি হত্যাকাণ্ড একটি পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন। ২৫ শে মার্চ স্থানীয় সেনা ইউনিটের প্রধান এক ধর্মীয় সভা আহ্বান করে কমলমপতি ইউনিয়নের পাহাড়ি নেতাদের জড়ো করান এবং সাধারণ পাহাড়িদেরও সকাল বেলায় পোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরের সংস্কার কাজের জন্য ডাকেন। তারপর সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে বাজার চোধুরী কুমুদ বিকাশ তালুকদার, স্থানীয় স্কুল কমিটির সেক্রেটারি শরদিহর চাকমাও রয়েছেন। এদের হত্যা করেও সেনাবাহিনী ক্ষান্ত হয়নি। তারপর নতুন বসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের নিয়ে পাহাড়ি অধ্যুষিত কাউখালী, মুখপাড়া, পোয়াপড়া, কাউখালী বাজার, তোংপাড়া এবং হ্যাডম্যান পাড়া আক্রমণ করে। সেনাবাহিনী গ্রামের চারিপাশে ঘিরে থাকে যাতে কেউ বেরুতে না পারে। আর বসতিস্থাপনকারীরা দা, কুড়াল ইত্যাদি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে পাহাড়িদের কুপিয়ে মারে ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। মুখপাড়া বৌদ্ধমন্দির, পোয়াপাড়া বৌদ্ধমন্দির, কাউখালী বৌদ্ধমন্দির এবং হ্যাডম্যানপাড়া বৌদ্ধমন্দিরও এদের হাত থেকে ঐদিন রক্ষা পায়নি।
ঘটনার প্রায় একমাস পর ২১ শে এপ্রিল (১৯৮০) তিন সদস্যর একটি বিরোধী সংসদীয় তথ্যানুসন্ধানী দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। শাহজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন এবং উপেন্দ্র লাল চাকমার সমন্বয়ে গঠিত এই টিম ঘটনার প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে সিদ্ধান্তে পৌছায় যে, "It is obvious to us that the incident of Kalampati is an isolated event. It has been perpetrated systematically and with a definite plan."

ঘটনার মৃতের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে নির্ধারণ করা না গেলেও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ও নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে একথা বলা যায়, বেশ কয়েক’শ পাহাড়ি ঘটনায় নিহত হয়েছে। এক প্রত্যক্ষদর্শী এক গণকবরে ৫০ জনকে কবর দিতে দেখেছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ১লা এপ্রিল ১৯৮০ সালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবী করেছেন, "The exact human toll is unknown but certainly exceeds 200."

(২) বরকল হত্যাকাণ্ড, ৩১ শে মে - ১লা জুন ১৯৮৪।
১৯৮৪ সালে ৩১ শে মে এবং ১লা জুন নিরাপত্তা বাহিনী এবং নতুন বসতিস্থাপনকারীরা হেটবাড়িয়া, সুগুরিপাড়া, গোরস্থান, তেরেঙ্গাঘাট, ভূষনছড়া এবং ভূষনবাগ পাহাড়ি গ্রামগুলোর উপর আক্রমণ চালিয়ে শত শত শিশু, মহিলাসহ পাহাড়িদের হত্যা করে। এ্যমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল -এর মতে ২৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩০৫ ব্রিগেডের আর্মিরা এবং বাংলাদেশ রাইফেলসের ১৭ ব্যাটেলিয়ন সদস্যরা এতে জড়িত ছিল। এ্যমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ১০ বছরের কম বয়সী ২১ জন বালক ও  ১১জন মহিলাসহ ৬৭ জনের নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করতে পেরেছে। ঘটনায় অনেক মহিলা গণধর্ষণের শিকার হয় এবং তারপর তাদের ব্যয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়।

(৩) পানছড়ি হত্যাকাণ্ড, ১লা মে, ১৯৮৬।
এ্যমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মতে, “১লা মে এবং তার পরের দিনগুলোতে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সদস্যবৃন্দ নতুন বসতি স্থাপনকারীদের নিয়ে পানছড়ি-খাগড়াছড়ি এলাকার উপজাতীয় গ্রামগুলোতে প্রবেশ করে এবং স্বতোঃপ্রবৃত্তভাবে ডজন-ডজন উপজাতীয়দের হত্যা করে। এই গ্রামগুলো হল গোলকপতিমাছড়া, কালানাল, ছোট করমা পাড়া, শান্তিপুর, মীর্যাবিল, হেদারা ছড়া,  (খেদারা ছড়া মুখ পাড়া নামেও পরিচিত) পুজগাং, লোগাং, হাতিমুক্তিপাড়া, সাড়েশ্বরপাড়া, নাবিদা পাড়া, এবং দেওয়ান বাজার। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ মতে ছয়টি গ্রামের ১৬ জন মৃত ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেছে। যদিও অনেক প্রত্যক্ষদর্শী মৃত ব্যক্তিদের দেখেছেন, কিন্তু নাম জানেন না বলে জানিয়েছেন অথবা সঠিক কি অবস্থায় তারা মারা গিয়েছিলেন তাও জানেন না বলে জানিয়েছেন। পরিশিষ্ট ১-এ আরো অতিরিক্ত ২৩ জন মৃত ব্যক্তির নাম দেয়া হয়েছে যারা ঘটনায় নিহত হয়েছে।”   
অনেকগুলোর সূত্র কয়েকদিন ধরে চলা এ হত্যাকা-ে মৃতের সংখ্যা কয়েক’শ বলে দাবী করেছে। শত শত ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর হাজার হাজার লোক সীমান্তের ওপারে আশ্রয় নিয়েছে। মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ড। মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক এ বর্বরতা! এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, ১লা মের পরের দিন সে দেখেছে এক শিশু মৃত মায়ের বুক থেকে দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছে। কি অলৌকিতায় সেই বাচ্চাটি বেঁচে গিয়েছিল।

(৪) মাটিরাঙ্গা হত্যাকাণ্ড, মে, ১৯৮৬।
১৯৮৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক মাটিরাঙ্গা এলাকায় কমপক্ষে ৭০ জন লোক নিহত হয়। নিরাপত্তা বাহিনী এবং বসতিস্থাপনকারীদের অত্যাচারে তখন মাটিরাঙ্গা এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল এবং অনেক পাহাড়ি ভয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল এবং অনেকে ভারত সীমান্তে নিরাপত্তার সন্ধানে পাড়ি জমাবার চেষ্টা করছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরীহ পাহাড়িদের উপর এমতাবস্তায় বিনা উস্কানীতে গুলিবর্ষণ করে। এ্যমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল মানবাধিকার সংস্থা ঠিকানাসহ ১৫ জনের নাম সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী গ্রামবাসীর মতে,“আমরা আর্মিদের অতর্কিত আক্রমণে দৌঁড়াতে শুরু করি। তারা আমাদের জন্য বড় বড় বন্দুক নিয়ে অপেক্ষা করছিল এবং তারপর গুলিবৃষ্টি হতে লাগল। আমি অনেক লোককে গুলির আঘাতে মরতে দেখেছি, তারপর আমি দৌঁড়ে পালাই এবং সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই।”

(৫) কুমিল্লাটিলা-তাইন্দং হত্যাকাণ্ড, ১৮-১৯ মে, ১৯৮৬।
মাটিরাঙ্গা হত্যাকা-ের পর অস্থিতিশীল ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির জন্য মে মাসের মাঝামাঝির দিকে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রায় ২০ লোক নিরাপত্তার খোঁজে ভারত সীমান্তে শিলাছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ৩১ ব্যটেলিয়নের বিডিআর খবর পেয়ে কুমিল্লাটিলা-তাইন্দং -এর এইসব নিরীহ পাহাড়িদের উপর হঠা আক্রমণ করে বসে। অনেকেই এতে নিহত হয়। যারা বেঁচে যায়, তারা তারপর নতুন বসতিস্থাপনকারীদের দ্বারা আক্রমণ হয়। এ করে গ্রুপের প্রায় সকলেই নিহত হয় এবং কিছু সংখ্যক সীমান্তের ওপারে আশ্রয় গ্রহণ করে।

(৬) হীরাচর, সার্বোতলী, খাগড়াছড়ি, পাবলাখালী গণহত্যা, ৮,৯,১০ আগষ্ট, ১৯৮৮।
বাংলাদেশ আর্মি এবং নতুন বসতিস্থাপনকারী বাঙালিরা ৮,৯ এবং ১০ই আগষ্ট, ১৯৮৮ সালে পাহাড়ি অধ্যুষিত বাঘাইছড়ি উপজেলার হীরাচর, সার্বোতলী, খাগড়াছড়ি, পাবালাখালী ইত্যাদি গ্রামে হামলা চালিয়ে পাহাড়িদের পাইকারী হারে হত্যা করে। প্রায় শ’খানেক লোক এতে নিহত হয়। গণধর্ষণের শিকার হয় অনেক পাহাড়ি মেয়ে। মৃত ৪৬ ব্যক্তির নাম ও পরিচয় জানা যায় এবং ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এরকম ৪ জনের নামও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়।

(৭) লংগদু হত্যাকাণ্ড, ৪ঠা মে, ১৯৮৯।
১৯৮৯ সালের মে মাসে আর্মি ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সহায়তায় নতুন বাঙালি বসতিস্থাপনকারীরা লংগদু উপজেলার পাহাড়ি অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করে এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ও বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করে। বহু লোক এতে নিহত হয়। এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাই থোয়াই রোয়াজা, প্রাক্তন সংসদ সদস্য মিসেস সুদীপ্তা দেওয়ান, প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান এবং রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ জন বিশিষ্ট পাহাড়ি নেতা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন। মেমোরে-ামের একাংশ উদ্ধৃত করলে হত্যাযজ্ঞের ভয়াভহতা পরিষ্কার হবে - “উপজেলা সদরে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য, লংগদু ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, ট্রাইবেল কনভেনশনের প্রাক্তন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান ৩নং লংগদু মৌজার হেডম্যান বাবু অনিল বিহারী চাকমা তার বাসভবনে হামলার শিকার হন। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার স্ত্রী ও প্রতিবেশিদের অনেকে (যারা হেডম্যান বাসভবনে আশ্রয় নিয়েছেল) এই নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যাকারীরা দা, বল্লম ইত্যাদিসহ আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা গুলি করে এইসব নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি। মৃতদেহগুলি বাড়িতে ফেলে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। বাবু অনিল বিহারী চাকমা তার স্ত্রীর মৃতদেহ বাড়ি থেকে বের বাড়ির পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে সারারাত পাহাড়া দিয়ে রাখেন। ভোরের দিকে থানায় খবর দিতে এসে উদ্ধার করতে গেলে পরবর্তীতে মৃতদেহের কোন হদিস পাননি। পরিস্থিতির এমন ভয়াবহতায় মৃতদেহগুলি ধর্মীয় বিধিতে পর্যন্ত সকার করা সম্ভব হয়নি। লংগদু উপজেলায় আজ উপজাতি বসতিগুলি পুড়ে ছাড়খার। কত পরিবার যে পরিজন হারা হয়েছে তা এখনও অজ্ঞাত। কারণ এই সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় দুঃখজনক সংবাদ ধীরে ধীরে আমরা অবগত হচ্ছি।” দুঃখজনক হলেও সত্যি - এ হত্যাযজ্ঞের সংবাদ বাংলাদেশের কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।

(৮) লোগাং গণহত্যা, ১০ই এপ্রিল, ১৯৯২।
পার্বত্য চট্টগ্রামে গণহত্যার ধারাবাহিকতার সর্বশেষ এবং সবচেয়ে জঘন্যতম সংযোজন গত ১০ই এপ্রিল ১৯৯২-এ সংঘটিত লোগাং গণহত্যা। স্থানীয় সাংসদ মিঃ কল্পরঞ্জন চাকমার মতে এক হাজারের উপর এই জঘন্যতম গণহত্যায় নিহত হয়েছে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এবং পাহাড়ি গণ-পরিষদও মৃতের সংখ্যা হাজারের উপর দাবী করেছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাও মৃতের সংখ্যা সরকারের স্বীকৃত হিসেব থেকে অনেক বেশী বলে দাবী করেছেন (বিবিসি, ৭ই মে, ১৯৯২ উল্লেখ্য সরকারী হিসেব মতে মৃতের সংখ্যা ১৩।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী মিঃ বৈশিষ্ট্য মুনি চাকমার মতে, সে নিজে ১৪৭ টি মৃতদেহ গুনেছে। (ডেইলী স্টার, এপ্রিল ২১, ১৯৯২ ছবিসহ প্রকাশিত)। ঘটনায় তার স্ত্রী নিহত হয়। আর এক প্রত্যক্ষদর্শী চন্দ্র সাগর চাকমার মতে, সে শ’দেড়েক মৃতদেহ দেখেছে (একতা ৮-১৪ই মে, ১৯৯২ ছবিসহ প্রকাশিত)। ঘটনায় তার ভাইয়ের ছেলে ও মেয়ে নিহত হয়। সে নিজ চোখে এসব প্রত্যক্ষ করেছে কি করে এদেরকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়ে মারা হয়। চন্দ সাগর চাকমার মতে, তাকে লাশ স্তুপাকার করার কাজে লাগানো হয়। পরে তাকে পালিয়ে যেতে বলা সে খাগড়াছড়ি চলে আসে। ঘটনার আর এক প্রত্যক্ষদর্শী ডাঃ জামালউদ্দীন। ঘটনার পর তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় আহতদের দেখাশোনার জন্য। এত লাশ দেখে ডাক্তার জ্ঞান হারান। এখন ডাক্তার সাহেব চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ওখান থেকে চলে এসছেন।

১০ই এপ্রিল, ১৯৯২। পাহাড়িরা চৈত্রসংক্রান্তি উসব পালনের জন্য প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। লোগাং -এর পাহাড়ি অধ্যুষিত গুচ্ছগ্রামগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। অনেক আত্মীয়স্বজন চৈত্রসংক্রান্তি উসবের জন্য এসেছিল। তার আগের দিন ভারতের উদ্বাস্তু শিবির থেকে ৩০টি পরিবারের প্রায় ১০০ জন পাহাড়ি গুচ্ছগ্রামগুলোর পাশে নিরাপত্তা বাহিনীর শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। ১০ই এপ্রিল দুপুর বেলায় হঠা শুরু হল ধ্বংসযজ্ঞ। ২০০ গজ দূরে অবস্থিত বিডিআর ক্যাম্পের বিডিআর, পুলিশ এবং গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনী ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন বসতিস্থাপকারী বাঙালিরা পাহাড়িদের গুচ্ছগ্রামের উপর একযোগে হামলা চালায়। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী (?) দল বন্দুক দিয়ে আর বসতিস্থাপনকারীরা দা, কুড়াল, কিরিচ ইত্যাদি দিয়ে দুই ঘন্টার মত হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাহাড়িদের বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। আর যারা বাইরে ছিল এবং দৌঁড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল তাদের গুলি করা হয়। শিশু, মহিলা এবং বৃদ্ধরাই বেশী এতে পুড়ে মরে। গ্রামে একটি বাড়িও আর অবশিষ্ট নেই।


কতলোক নিহত হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকার দেয়নি। গুচ্ছগ্রামে বাড়ি ছিল ৬০০টি, পরিবার ছিল ৫৬৪। আর লোকসংখ্যা ছিল ২২৩৬। ঘটনার পর গ্রামে এখন পাহাড়ি আছে ৩০০-এর মত। সীমান্তের ওপারে ভারতে পালিয়ে গেছে ৭৩ জন। আর কিছু জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। বাকীরা কোথায় গেল ? ঘটনার আগের দিন যে ১০০ জন উদ্ভাস্ত শিবির থেকে ফিরেছিল তাদেরও কোন হদিশ নেই। সেদিন ছিল শুক্রবার। শুক্রবারে পার্বত্য চট্টগ্রামে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু সেদিন রাত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা ট্রাকের বহর চলাচলের শব্দ শুনেছে। চীকারও শোনা গিয়েছিল, “দয়া করে গাড়ি আস্তে চালান।” আহত ও নিহতদের স্তূপাকার করে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তারপর কোন এক অজ্ঞাত স্থানে আহত নিহত সবাইকে গণকবর দেয়া হয়। প্রত্যেক কিছুর একটা সীমা থাকে। নিষ্ঠুরতারও একটা সীমা রয়েছে। কিন্তু এ নিষ্ঠুরতার, বর্বরতার সীমা নেই। ট্রাকের বহর খাগড়াছড়ি শহর ছেড়ে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম রাস্তার দিকে চলে যায়।
সরকার প্রথমে ঘটনার দায় শান্তিবাহিনীর উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। অবশ্য এটা অনভিপ্রেত ছিল না। ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা তাই বলে। হত্যাকা-ের পরদিন ১১ই এপ্রিল ১৯৯২ সব জাতীয় দৈনিকগুলোতে খবর বেরুল শান্তিবাহিনীর হামলায় ১০ জন উপজাতীয় ও ১ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। কিন্তু সেসময় খাগড়াছড়িতে উপস্থিত ছিল ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, আইনজীবি এবং সর্বোপরি সাংবাদিক সমন্বিত একটি গ্রুপ, যারা পাহাড়িদের চৈত্রসংক্রান্তি উসবে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য সেই গ্রুপে বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি এটর্নী জেনারেল জনাব আরিফ আহমেদ এবং ডিইউজের প্রেসিডেন্ট শাহজাহান মিয়াও ছিলেন। সরকারের শেষ রক্ষা হল না। গ্রুপের সদস্যরা ১২ই এপ্রিল লোগাং যেতে চাইলেন, যেতে দেয়া হল না। থলের বিড়াল শেষে বেড়িয়ে পড়ল। ঢাকা এসে তারা এক যুক্ত বিবৃতিতে প্রকৃত তথ্য ফাঁস করে দিলেন। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিল। তারপর লোগাং ছুটে গেলেন সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। খাগড়াছড়িতে জনসভায় বক্তারা বললেন, এ আর এক মাইলাই।
আজ দাবী উঠেছে প্রকৃত তথ্য জানার। প্রশ্ন উঠেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। গুচ্ছগ্রামের ২০০ গজের মধ্যে বিডিআর ক্যাম্প। হত্যাযজ্ঞের সময় তাদের কি ভূমিকা ছিল ? যাই থাকুক, তবে একটা জিনিস পরিস্কার Ñ তারা রক্ষকের ভূমিকায় ভক্ষক।
নিরাপত্তার নাম করে পাহাড়িদের আদি গ্রাম থেকে জোরপূর্বক গুচ্ছগ্রামে বন্দী করা হয়েছিল। কিন্তু একি নিরাপত্তার নমুনা ? এতো পরিকল্পিত গণহত্যা। সরকারের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আজ প্রশ্ন উঠেছে। সরকার কি পাহাড়িদের এভাবে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ? আজ সময় এসেছে এসব রহস্য উদঘাটনের। কেন গুচ্ছগ্রামে পাহাড়িদের বন্দী করা হচ্ছে ? কেন কৌশলগতভাবে এইসব গুচ্ছগ্রাম তৈরী করা ? পাহাড়িদের মাঝখানে রেখে চারিপাশে বাঙালি অধ্যুষিত গুচ্ছগ্রাম ও নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প ? কেন গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী শুধু বাঙালিদের মধ্যে থেকে করা হয় ? সরকারের উচিত এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া, লোগাং হত্যাকা-ের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তসহ পূর্বেকার সমস্ত ঘটনার তদন্ত সম্বলিত শ্বেতপত্র প্রকাশ করা।



---------------------------------
পার্বত্য চট্টগ্রাম : মৃত্যুচিহ্নিত লোগাং
----------------------------------
                                                  শিশিরকণা দাস

সরকারি তথ্য বিবরণী অনুযায়ী ১০ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার উপজাতীয় গুচ্ছগ্রাম লোগাংয়ে সংঘটিত অবাঞ্ছিত ও দুঃখজনক ঘটনায় ১৩ জন প্রাণ হারিয়েছে এবং ১৩ জন আহত হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সূত্র মৃতের সংখ্যা দেড়শ বলে দাবি করেছে।
২৫ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে এক সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন লোগাং ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যাচার, অপপ্রচার এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি আরো বলেছেন, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন এবং অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিনাশের যে কোন অপচেষ্টা প্রতিহত করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবাররা সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সাহায্য পাবে এবং হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করা হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে।
২৭ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা লোগাং ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। খাগড়াছড়িতে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় সেনাবাহিনী। পানছড়ি এলাকার সেনা কমা-ার লেফটেনেন্ট কর্ণেল আব্দুল মতিন শেখ তাঁকে জানান - ১০ এপ্রিল আটজন রাখাল গরু চরাতে গেলে ‘সন্ত্রাসকারীরা একজনকে হত্যা ও তিনজনকে আহত করে। তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্থানীয় বাঙালি, ভিডিপি ও আনসারদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।
লোগাং গুচ্ছগ্রামটি খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলা থেকে প্রায় ১০ কিমি উত্তর-পশ্চিমে ভারতীয় সীমান্তের কাছে অবস্থিত। উপজাতীয়দের নিরাপত্তার কারণে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২০/২৫ টি উপজাতীয় গ্রামের বাসিন্দাদের এ গুচ্ছগ্রামে জড়ো করা হয়েছে। এখানে প্রায় ৫৫০টি উপজাতীয় পরিবারের ৩ হাজারের মত নারী পুরুষ শিশু বসবাস করে বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। লোগাংয়ের কাছেই রয়েছে বাঙালিদের একটি গুচ্ছগ্রাম এবং বিডিআর ক্যাম্প। বাঙালি ও উপজাতীয়দের মধ্যে সম্ভাব্য বিরোধ মীমাংসার দায়িত্বে থাকে ভিডিপি বা গ্রাম প্রতিরক্ষা দল। এ দলের সদস্যরা সকলেই বাঙালি।
ঘটনাচক্রে ১১ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে উপস্থিত ছিলো ঢাকা থেকে যাওয়া ২৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। দলটি উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক অনুষ্ঠান বৈসাবি উসবে যোগ দেবার  জন্যে উসব উদযাপন কমিটির আমন্ত্রণে খাগড়াছড়ি গিয়েছিল। বৈসাবি উদযাপন করার কথা ছিল ১২,১৩ ও ১৪ এপ্রিল। লোগাং ঘটনার প্রতিবাদে উপজাতীয়রা তাদের ঐতিহ্যবাহি উসবটি বর্জন করেন। ঢাকার প্রতিনিধি দলটিতে ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফসহ ছিলেন বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ শিক্ষক, লেখক, আইনজীবি, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা এবং মানবাধিকার কর্মীরা। খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে এ প্রতিনিধি দলটির বেশ কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এ ঘটনা সম্পর্কে তাঁদের অনুভুতি ও সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করেছেন।
তাঁরা খাগড়াছড়িতে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ঘটনার যে বিবরণ সংগ্রহ করেছেন তা এরকমঃ ১০ এপ্রিল সকালে লোগাংয়ের অদূরবর্তী বাঙালি গুচ্ছগ্রাম থেকে তিনজন বাঙালি রাখাল বিপদমুক্ত এলাকার বাইরে গরু চরাতে গেলে কে বা কারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের আঘাত করে। ফলে একজন কিশোর নিহত হয়। সরকারি সূত্র বলছে, আক্রমণকারীরা শান্তিবাহিনীর সদস্য ছিলো। বাঙালি বালকটির লাশ তার গ্রামে নিয়ে যাওয়া হলে সমস্ত এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জুম্মার নামাজের পর বাঙালি ও স্থানীয় গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভিডিপি সদস্যরা চারদিক থেকে উপজাতীয় গুচ্ছগ্রামটি ঘিরে ফেলে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, দা-কুড়ালসহ নানা ধরনের ধারালো অস্ত্র নিয়ে বাঙালিরা উপজাতীয়দের আক্রমণ করে এবং তাদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সংঘর্ষের সময় গুলি ছোঁড়া হয় বলেও অভিযোগ আছে। এ সংঘর্ষ এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে চলে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন। মৃত উপজাতীয় সংখ্যা দেড় শর মত, ভস্মীভুত ঘরবাড়ির সংখ্যা কয়েকশ।
ঢাকার প্রতিনিধি দলটির সাথে জনৈক উপেন চাকমার দেখা হয়, যার পরিবারের ন’জন সদস্যের মধ্যে পাঁচজনই মারা গেছে বলে তিনি জানান। উপেন চাকমার মত আরো কয়েকজন বলেন যে অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে অথবা পানছড়ি, নয় খাগড়াছড়ি শহরে পালিয়ে গেছে।
প্রতিনিধি দলের অনেক সদস্যই লোগাং যেতে চাইলে পথে সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন বলে জানিয়েছেন। পানছড়ি থেকে ফেরার পথে তাঁদের সাথে ঘটনার বহু প্রত্যক্ষদর্শীর দেখা ও আলাপ হয়।
প্রতিনিধি দলটির সাথে খাগড়াছড়ি অঞ্চলের সামরিক কর্মকর্তাদের একাধিক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয় বলে জানা গেছে। জনৈক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে দলটির একজন সদস্য লিখেছেন যে ১২ তারিখ পর্যন্ত ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এদের মধ্যে বেশ কিছু বাঙালি ও ভিডিপি সদস্য আছে। প্রতিনিধি দলটিকে লোগাং পরিদর্শনে যেতে না দেয়ার কারণ হিসেবে তাদের বলা হয় -
ইনসারজেন্ট এলাকায় বিশেষ কোথাও যেতে চাইলে বিশেষ অনুমতির দরকার, যা তাদের ছিল না। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা এও বলেন যে অতিথি হিসেবে দু’এক দিন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জটিল সমস্যা বোঝা সম্ভব নয়। সমস্যাটির রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেন তাঁরা।
ঢাকায় ফিরে এসে প্রতিনিধি দলটির সদস্যরা একটি যুক্ত বিবৃতিতে কয়েকটি সুপারিশ করেনঃ
(১) অবিলম্বে লোগাং হত্যাকা-ের স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে এতদিন যত হত্যাকা-, ধর্ষণ, নিপীড়ন হয়েছে, সেই ঘটনাবলীর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কার্য পরিচালনা করে সকল তথ্য প্রকাশ করতে হবে ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে।
(২) পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ২০ বছরে সৃষ্ট পরিস্থিতি, রাজস্ব ব্যয় ও তার ফলাফল সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।   
(৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাধানের জন্য বল প্রয়োগের নীতি বর্জন করে বিষয়টিকে সংসদের অধীনস্ত করতে হবে এবং ঐ সংসদে খোলাখুলি আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে।  
(৪) সংসদ সদস্য ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে উচ্চকক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠী-দল ও সামাজিক শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে এবং ঐ অঞ্চলে সন্ত্রাসমুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে
(৫) প্রশাসনকে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে বেসামরিক নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন কার্যকর করতে হবে।                     
(৬) অঞ্চলের সামগ্রিক জনগণকে হাতে গোনা কিছু শান্তিবাহিনীর সঙ্গে এক করে দেখার বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ যাতে নিজ জিন ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এদেশের সব মৌলিক অধিকার পেয়ে পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।      
মৃত্যুচিহ্নিত লোগাং নতুন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গুচ্ছগ্রাম, সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলেছে কিনা বিভিন্ন মহল থেকে এ প্রশ্নও উঠেছে। সম্প্রতি তিনটি পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদের যৌথ শীর্ষ বৈঠকে ১২ দফা দাবি পেশ করা হয়েছে। এ সব দাবির একটি হচ্ছে বর্তমান অবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতীয় ও অ-উপজাতীয়দের গুচ্ছগ্রাম ভেঙে দিয়ে তাদের নিজ নিজ এলাকায় ফেরত যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তারা স্থায়ীভাবে নিজ নিজ এলাকায় পুনর্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্যে রেশন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। খাগড়াছড়ি পরিদর্শনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী বলেন, সরকার পার্বত্য জেলার স্থায়ী সমাধান করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ জন্যে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। শেখ হাসিনাও বলেছেন, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে এ অঞ্চলের সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, সরকার যদি এ সমাধান এবং দোষীদের বিচার ও শাস্তির নিশ্চয়তা দিতে না পারে তবে আওয়ামী লীগ পার্বত্য এলাকার জনগণের পাশে দাঁড়াবে।
[সৌজন্য : সাপ্তাহিক বিচিন্তা / ১লা মে ‘৯২]

 --------------------------------------------------------------------------------------------
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকীয়
মৃত্যু-চিহ্নিত লোগাং। ইতিহাসের কালো পাতায় আরো একটি নাম সংযোজিত হলো। লোগাংয়ে পাহাড়িদের নৃশংস হত্যার দায় আজ কে নেবে ? শুধু কি সেই ছিন্নমূল পুনর্বাসিত বাঙালি মানুষগুলো। যারা একদিন ভিটেমাটি হারিয়ে সমতট ছেড়ে কায়ক্লেশে পাড়ি জমিয়েছিল অজানা পার্বত্য পথে। হ্যাঁ ওরাও বাস্তুহারা প্রপীড়িত ছিন্নমূল নর-নারী। সেদিন ওদের নাকের ডগায় মুলো ঝুলিয়ে যারা তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল তারা আর কতদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকবেন ? সমর সাজে সেজে একদল বাস্তুহারাদের দিয়ে অন্য একদলকে উদ্বাস্ত করার মরণ-খেলায় দাবার ঘুটির মত ব্যবহৃত হচ্ছে পার্বত্য এলাকা তথা বাংলাদেশ। স্বজনহারা, নির্যাতিত এই পাহাড়ি মানুষগুলো কি আর ফিরে পাবে এ ভূ-খ-ে বাস করার সমূহ বিশ্বাস ? কিংবা পুনর্বাসিত ছিন্নমূল বাঙালিদের জন্য কি আদৌ এটা হবে নিশ্চিত কোন আবাসভূমি ? ভাবার বিষয়ই বটে ? আর বিংশ শতাব্দির শেষ দশকটিতে কোন উপজাতিকে সমূলে বিনাশের কথা যদি কেউ ভেবে থাকেন তবে তা হবে সুনিশ্চিত আত্মঘাতি পদক্ষেপ।
[সৌজন্য : সাপ্তাহিক বিচিন্তা / ১লা মে ‘৯২]
------------------------------------------------------------------------------------------------
 লোগাং হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে গিয়ে নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ করেছেন। সরকারি ব্যাখ্যা স্ববিরোধী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আমাদের প্রতিবেদক ঘুরে এসে বলেছেন লোগাং -এর যে গুচ্ছগ্রামটিতে হত্যাকা- সংঘটিত হয় তার চারপাশে পঞ্চাশ গজের ভেতরেই বিডিআর এবং সেনাবাহিনীর অবস্থান। একটি টিলার উপর অবস্থিত এ গুচ্ছগ্রামটিতে প্রায় ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন। ধ্বংসযজ্ঞের পর সুপরিকল্পিতভাবে সেখানে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন অভিযান চলে। তারপরও মৃতদগ্ধ মানুষের হাড়গোড়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। চারদিকের সামরিক প্রহরার মধ্যেও প্রকাশ্য দিবালোকে কিভাবে এ ধরনের হত্যাকা- ধ্বংসযজ্ঞ চলে তা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে সচেতন বিবেকের মস্তিস্কে প্রবলভাবে ধাক্কা দেয়। পার্বত্য অঞ্চলে মানুষের নিরাপত্তাজনিত কারণে সেখানে সামরিক উপস্থিতি অনিবার্য হলে (সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী) এসব হত্যাযজ্ঞে তাদের ভূমিকা কি ? কোটি টাকার পোষ্য বাহিনী গোটা পার্বত্য এলাকায় সামরিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একই সাথে জনজীবন বিপর্যস্ত এবং পরিবেশ ধ্বংসে লিপ্ত। শান্তিবাহিনীর ভয়ে নিবিড় পাহাড়ের গাছপালায় আগুন দিয়ে পরিস্কার করে যাচ্ছেন তারা বনের পর বন। যারা রাত আটটার পরে তাদের প্রিয় শহর ঘুরে দেখতে পারে না, যারা জেলা শহরের আদি বাসিন্দা হয়েও নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তাদের জীবন যে প্রকৃত অর্থে তাদেরই নয়, সেটা আজ প্রমাণিত সত্য। আমরা পার্বত্য এলাকার জনগণের ন্যায্য দাবীর পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই
[সৌজন্য : সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম / ৩ মে ‘৯২ইং] 
----------------------------------------------------------------------------------------------    

খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
ধ্বংসের চক্রান্ত রুখো

অজস্র কালো টাকা ছড়িয়ে কিছু এজেন্টের মাধ্যমে দশ ভিন্ন ভাষাভাষী পাহাড়ি জনতার ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ক ধ্বংসের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। তারা ষড়যন্ত্রকারী বিশেষ সংস্থার নীলনক্সা অনুযায়ী এখন বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে আমাদের আন্তসাম্প্রদায়িক শক্তিশালী সৌহার্দ্য বিভক্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। যে মুহুর্তে পাহাড়ি গণ-পরিষদ ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে ঐক্য ও সংহতি দৃঢ়তর হয়ে আন্দোলন তীব্র হয়ে আসছে, ঠিক সে মুহুর্তে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সহ পাহাড়ি জনগণের পারস্পরিক সম্পপ্রীতি বিনষ্ট করার পায়তারা চলছে। আমরা যেকোন মূল্যে এই চক্রান্তকারীদের অপচেষ্টা রুখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। একই সাথে খাগড়াছড়ির সর্বস্তরের জনগণকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। 
-------------------------------------------------------------------------------------------------


বি ক্ষু দ্ধ সংলাপ  /  মি: মানবমিত্র
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও খালেদা জিয়ার খোলামন
১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর এযাবত বিরোধী দলীয় নেত্রী ও সরকারী মন্ত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা, সাংবাদিক ও সেনা কর্মকর্তা ঐ এলাকা সফর করেছেন। অবশেষে গত ১৩ই মে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং পদধুুলি দিলেন লোগাং -এর পোড়াভিটায়। অনেকটা মুখ রক্ষার জন্যই বাধ্য হয়ে তার এই পদধুলি - সেখানকার জনগণকে ভালোবেসে নয়। তার প্রমাণ মিলেছে তার বক্তব্যে। লোগাং -এর পোড়াভিটা, যেখানে ১০ই এপ্রিল লোমহর্ষক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, পরিদর্শনের পর প্রধানমন্ত্রী তোতাপাখির মত সেনাবাহিনীর শেখানো সেই একই পুরানো বুলি কপচালেন, “১৩ জন নিহত এবং ১৩ জন আহত”। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের এসব প্রাত্যহিক বক্তব্য আমাদেরকে আহত, পীড়িত কিংবা ব্যথিত করে না। এসব মনগড়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য ও মন্তব্য আমাদের মধ্যে ক্রোধ, ক্ষোভ ও বিদ্রোহই জাগ্রত করে। প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে চাই, নিহতদের সংখ্যা যদি ১৩ জনই হয়ে থাকে (প্রকৃত নিহতের সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশী, অনেক মহলের দাবী নিহতের সংখ্যা ১২শত), তাহলেও ঐ ১৩ জনের লাশ গেলো কোথায় ? ঐ লাশ তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি কেন? কারা এইসব লাশ কি উদ্দেশ্যে গায়েব করেছে?” জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সাধ্য নেই। জনগণের কাছে তিনি দায়বদ্ধ নন। জনগণের কাছে তার জবাব দিতে হয় না। একমাত্র একটি জায়গায়ই তাকে জবাবদিহি করতে হয়। আর তা হলো এইড ক্লাব মিটিং-এ। যেমন এবারে প্যারিস কনসটিয়াম মিটিং-এ জবাবদিহি করতে হলো।            
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে বলেছেন তার “গণতান্ত্রিক” সরকার যে কোন সময় খোলা মনে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। তিনি এসব কথা কতটুকু খোলামনে বলেছেন তাও সন্দেহের অবকাশ রাখে। কারণ সবচেয়ে বেশী খোলামন নিয়ে জাতীয় সংসদেই এ ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। অথচ পাহাড়ি জনগণের বার বার দাবী সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সম্পর্কে জাতীয় সংসদে এ যাবত একবারও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং এই ইস্যুটি সংসদে বার বার পাশ কাটানো হয়েছে। মাননীয় স্পীকার সাহেব পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা নিয়ে আলোচনার মূলতবী প্রস্তাব নাখোশ করে দেন অজ্ঞাত কারণে। সংসদ চলাকালীন লোগাং গণহত্যা সংঘটিত হলেও মাননীয় স্পীকার নানা অজুহাত দেখিয়ে লোগাং গণহত্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে দেননি। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর মন কতটুকু খোলা তা অবশ্যই সন্দেহের অবকাশ রাখে। জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে আরো পরিস্কার বোঝা যাবে।
তিনি আরো বলেছেন, “আমার মনে হয়, কেবলমাত্র দেশের সংবিধান ও সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব।” প্রধানমন্ত্রীর এই কথার অর্থ কি ? তার এই কথার অর্থ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার এখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধান হয়নি। অর্থা স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামলে সৃষ্ট জেলা পরিষদ প্রকৃতই কোন রাজনৈতিক সমাধান নয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমাধানের পথে তা একটি প্রতিবন্ধক। অথচ এই জেলা পরিষদকেই তার “গণতান্ত্রিক” সরকার টিকিয়ে রাখছে। শুধু তাই নয় স্বৈরাচারী এরশাদ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে যে নীতি কার্যকর করে যেতে পারেননি, তা এই “গণতান্ত্রিক” সরকার কার্যকর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এইজন্য গর্বের সাথে খালেদা জিয়া বলছেন যে, এরশাদ সরকার জেলা পরিষদে মাত্র তিনটি বিষয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন, কিন্তু তার সরকার গত সাত মাসে আরো সাতটি বিষয় জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করেছে। শুধু তাই নয়, তিনি পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে আরো শক্তিশালী ও সুসংহত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন এবং যথাসময়ে পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দেন। তাই একদিকে মুখে রাজনৈতিক সমাধানের বুলি এবং অন্যদিকে সমস্যা সমাধানে প্রতিবন্ধক জেলা পরিষদকে টিকিয়ে রাখা - এই পরস্পর বিরোধী আচরণ খালেদা জিয়ার খোলামনের পরিচায়ক নয়। এ কারণে স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সাথে বর্তমান “গণতান্ত্রিক” সরকারের পার্থক্য কোথায় ? এটা সাদা চোখে লক্ষ্যনীয় যে, বর্তমান খালেদা জিয়ার সরকার স্বৈরাচারী এরশাদের নীতির ধারাবাহিকতাই রক্ষা করে চলেছেন।
প্রকৃত অর্থে, শুধু পাহাড়ি জনগণের স্বার্থে নয়, সমগ্র দেশের সমস্ত জনগণের স্বার্থেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার যথার্থ রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। মনে হয় এই সত্যের উপলব্দি বর্তমানে সবাই অনুভব করতে পেরেছেন। সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী এবং তাদের Mouth Organ “বাঙালি গণ পরিষদ” ছাড়া দেশের সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, শিক্ষক, সকলেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দাবী করছেন। যেন তেন সমাধান নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান দরকার যে সমাধানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের জাতীয় অস্তিত্ব ও সার্বিক অধিকার সংরক্ষিত ও নিশ্চিত হবে। জেলা পরিষদের মত ভাওতাপূর্ণ সমাধান নয়। এ রকম সমাধান কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আর সমাধান তো অবশ্যই দেশের সংবিধান ও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান সেই সংবিধান ও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই সম্ভব যে সংবিধান ও সাংবিধানিক কাঠামো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসমূহের অস্তিত্ব ও তাদের সার্বিক অধিকারসমূহ স্বীকার ও রক্ষা করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যে আলোচনা হবে তা অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে হতে হবে। কারণ রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান একমাত্র রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরাই আলোচনার মাধ্যমে করতে পারেন। অতীতে দেখা গেছে জনসংহতি সমিতির সাথে আলোচনায় সরকারের তরফে সেনাবাহিনীর সদস্যরাই সবকিছু করেছেন। এরশাদ আমলে তারাই জনসংহতি সমিতির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক আলোচনা, বৈঠক, সমাধানের রূপরেখা প্রদান ও তা বাস্তবায়নসহ সকল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল। এজন্য তাদের সৃষ্ট জেলা পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান না হয়ে বরং তা নিজেই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও খবরদারীত্ব দেশে নয় বছর স্বৈরশাসনের সুযোগে নিরংকুশ ও একচেটিয়া হয়ে যায়। বেসরকারী প্রশাসন ও রাজনীতিসহ সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিকভাবে সমাধানের পদক্ষেপ হিসাবে সেনাবাহিনীকে অবশ্যই রাজনীতি প্রক্রিয়া/রাজনীতির অধীন করতে হবে। কারণ তাদের কাজ রাজনৈতিক সমাধান দেয়া নয়।           
আমরা আশা করি অতীতের এসব ভুল থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা গ্রহণ করবেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজিত সমস্যা সমাধানের জন্য অচিরেই খোলামনে আলোচনার উদ্যোগ নেবেন।
..................

------------------------------
প্রগতিশী বই, পত্র-পত্রিকা ও
 গণ-সঙ্গীতের ক্যাসেটের জন্য
দীপ্ত প্রকাশনী

৬৮/২, পুরানা পল্টন, (বাসস-এর নীচ তলায়), ঢাকা-১০০০।
------------------------------




সা ম্প্র তি ক
রাঙ্গামাটিতে বর্ণবাদের গন্ধ 
সন্ত্রাসের লাগাম কার হাতে?
                     মিঃ সৌরভ সিজেল
           মিঃ সুপ্রিয়

কথারন্ত :
লোগাং গণহত্যার রক্তের দাগ শুকোতে না শুকোতেই সেনা মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা আবার জান্তব হিংস্রতায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে। এরা সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রাঙ্গামাটিতে আমদানী করেছে শ্বেতাঙ্গদের পরিত্যক্ত সেই কুসি, ঘৃণার্থ বর্ণবাদ নীতি - যা এই বিংশ সভ্যতার ললাটে এঁকে দিয়েছিল এক কলংক তিলক। অথচ আজ এই বর্ণবাদ নীতির পঁচা গন্ধ সারা পার্বত্য এলাকায় ছড়িয়ে দিয়ে শেষ রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে সেই চিহ্নিত অশুভশক্তি। এই নীল নক্সারই পরীক্ষামূলক আংশিক বাস্তবায়ন রাঙ্গামাটি - ২০শে এপ্রিল।

ঘটনা শুরু :
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজ প্রাঙ্গনে তার ৩য় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের কথা বহু আগেই ঘোষণা করেছিল। এজন্য তারা ১৮ ও ১৯ তারিখ মাইকিং করে। ১৯ তারিখ বিকেলে হঠা করে তথাকথিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একই সময়ে রাঙ্গামাটি কলেজ প্রাঙ্গনে একটি সমাবেশ করবে বলে ঘোষণা দেয়। ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ অপ্রীতিকর ঘটনার আশংকায় ২৬ তারিখ পর্যন্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে এবং কলেজ চত্বরে সকল প্রকার সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়।

স্থান পরিবর্তন :
এর পর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তথাকথিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকে।

ক্ষমতাহীন এ,ডি,সি :
কথা ছিল পৌরসভা টাউন হলে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ২০ তারিখ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ২১ তারিখ কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু বর্তমানে পৌরসভার দায়িত্ব নিয়োজিত এ,ডি,সি, টাউন হলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে উক্ত অনুষ্ঠান করার অনুমোদন দিলেও এক অদৃশ্য শক্তির কড়া নির্দেশে পরবর্তীতে তা বাতিল করতে বাধ্য হন। তিনি অসহায়ভাবে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কর্মীদের বলেন, “দুঃখিত, কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম না। ......... বলেছে না দিতে। দেখেন, আমারওতো চাকরী বাঁচাতে হবে।” পরে অবশ্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ বটতলাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

অবশেষে ২০ শে মে ‘৯২ :
তবুও ফিরে আসে ২০ শে মে ‘৯২। উদযাপন করতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেষ্টুন ইত্যাদি নিয়ে শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গন বটতলায় সমবেত হয়।

মর্নিং এ্যাকশান  :
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের এই শান্তিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সমাবেশ বানচাল করে দেয়ার ব্লু প্রিন্ট বাস্তবায়ন করতে সকাল থেকেই উঠে পড়ে লেগে যায় তথাকথিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সকালে সবাই তাজ্জব বনে যায়, টেক্সী ড্রাইভার ভাইয়েরা পাহাড়িদেরকে তাদের গাড়িতে নিতে অপরাগতা প্রকাশ করছে। কারণ কি ? তাদের মুখেই জানা গেল বিএনপি -এর ছাত্র দলের কর্মীদের নির্দেশ পাহাড়িদেরকে টেক্সীতে নেয়া যাবে না।
তাছাড়া “সংগ্রাম পরিষদের” কর্মীরা ভোর সকালে অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বটতলাগামী পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের একটি বাস পৌরসভা অফিসের নিকট আটক করে। পরে বাদানুবাদের পর ছাত্রদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।    
অনুষ্ঠানে উদ্বোধক মিঃ যামিনী রঞ্জন চাকমাকেও তারা পৌরসভা ও কাকলী সিনেমা হলের সামনে পর পর দু’বার আটকায়। টেক্সীতে না তোলায় তাঁকেও হেঁটে আসতে হয়।

অতঃপর এ্যাকশান আর এ্যাকশান :
সকাল ন’টায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। জাতীয় সঙ্গীত ও দলীয় সঙ্গীত সহ উদ্বোধনের পর সংগঠনের সভাপতি মিঃ প্রসিত বিকাশ খীসার ভাষণ শেষ হতে না হতেই তথাকথিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা পাহাড়ি ছাত্রদের সমাবেশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। দশ বিশ গজের মধ্যেই ছিল দাঙ্গা পুলিশ। কিন্তু “সংগ্রাম পরিষদের” কর্মীদের হামলা চলাকালে দাঙ্গা পুলিশ কোন বাধা দেয়নি। বরং নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি কলেজ শাখার জি,এস, বোধিসত্ত্ব চাকমা “সংগ্রাম পরিষদ” কর্মীদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করার আহ্বান জানান। কিন্তু সে কথায় তারা কোন আমল দেয়নি। তারা পাহাড়ি ছাত্রদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তাদের আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে এবং ধাওয়া করে তেড়ে নিলে “সংগ্রাম পরিষদ” কর্মীরা রাণী দয়াময়ী স্কুলের সামনে অবস্থান নেয়। এ সময়ই পুলিশ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ ও বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করে এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে অনেক পাহাড়ি ছাত্র কর্মী আহত হয়।
ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর জনৈক কর্ণেল আবার সংগ্রাম পরিষদ কর্মীদের পুনর্গঠিত করে রাণী দয়াময়ী স্কুলের সামনে অবস্থান নেয় এবং পাহাড়ি ছাত্রদেরকে আক্রমণ করার জন্য তাদের প্ররোচিত করতে থাকে। এদিকে রাণী দয়াময়ী স্কুলের সামনে অবস্থান নেয়ার পর সংগ্রাম পরিষদ কর্মীরা উস্কানীমুলক শ্লোগান দিতে থাকে। জনৈক কর্মী জাহাঙ্গীর আলম মুন্না পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এখন থেকে রাঙ্গামাটিতে মিটিং’ মিছিল, সমাবেশ এমনকি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে পারবে না বলে মাইকে ঘোষণা দেয়। নাম না জানা প্রশাসনের এক ব্যক্তি মুন্নাকে ও অন্যান্য কর্মীদেরকে এরকম উস্কানীমূলক শ্লোগান ও বক্তব্য না দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু তারা কথায় আমল দেয়নি এবং মুন্না ষ্টেডিয়ামের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থানরত ২০০ বাঙালি শ্রমিকদের লক্ষ্য করে আহ্বান জানিয়ে বলে, “বাঙালি ভাইয়েরা, আপনারা যারা ষ্টেডিয়ামের পশ্চিম পার্শ্বে আছেন, আমাদের সাথে যোগ দিন - কোন ভয় নেই...।” কিন্তু পাহাড়ি ছাত্রদের অবস্থান তখন তাদের দুই অংশের মাঝখানে হওয়াতে শ্রমিকরা মুন্নাদের সাথে যোগ দিতে পারেনি। উল্লেখ্য, উপজেলা অফিসে কর্মরত এই বাঙালি শ্রমিকদেরকে “সংগ্রাম পরিষদ” কর্মীরা ডেকে নিয়ে এসে ষ্টেডিয়ামের পশ্চিম পার্শ্বে মজুত রেখেছিল।

কম্প্রোমাইজ :
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিরাট সংগঠিত শক্তি দেখে পরে মুন্নাসহ আরো কয়েকজন বাঙালি ছাত্র একটা আপোষ করার জন্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কাছে আসে। তারা জানায যে, তারা কলেজ চত্বরে গিয়ে তাদের পূর্বনির্ধারিত সভা করতে চায়। তারা নিজেরাই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ওপর হামলা করবে না বলেও অঙ্গীকার করে। এরপর সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রহরায় সংগ্রাম পরিষদ কলেজ অভিমুখে রওনা হয়। হামলা না করার অঙ্গীকার করলেও পাহাড়ি ছাত্রদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কোন কর্মী “আক্রমণ করেনি। তারা ধৈর্য্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করে। পরে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ মিছিল সহকারে বনরূপা পেট্রল পাম্পে এসে তাদের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে।

আবার আক্রমণ :
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পিছে পিছেই তথাকথিত সর্বদলীয় ছাত্র পরিষদের মিছিল এগোতে থাকে। এ সময় তারা পাহাড়িদের প্রগতি মোটরস ওয়ারক্স, পিংচিং এজেন্সী, জয়া ফার্মেসী ও রিবাং ইলেক্ট্রনিক্স দোকানে ভাংচুর এবং মালামাল লুটপাট করে।                                
অবশেষে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীরা মিছিল শেষে যখন নিজ নিজ বাড়িতে যাচ্ছিল তখনই সংগ্রাম পরিষদের মাস্তানরা আবার আক্রমণ করে। তারা কিরিচ, দা, কুড়াল, খন্তা, বল্লম ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাহাড়ি ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তারা পাহাড়িদের গ্রামে ঢুকে পড়ে। প্রথমে A.S.U. অফিস থেকে তিন রাউ- ফায়ার করে প্রহরারত সেনাদেরকে আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরই প্রহরারত সেনা সদস্যরা ট্রাবেল আদামের ওপর গুলি বর্ষন করতে থাকে। এ সময় মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে এদিক ওদিক দৌঁড়াতে থাকে এবং পানিতে ঝাপ দিতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিরা ট্রাবেল আদামে ঢুকে পড়ে এবং মালামাল লুট করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

বনরূপাতেও বাঙালিরা ঢোকার চেষ্টা করে কিন্তু পাহাড়িরা প্রতিরোধ করলে তারা বাধাগ্রস্ত হয়। পরে বিএনপি-এর স্থানীয় নেতা ফারুক নিজের গ্যারেজের মালামাল সরিয়ে ফেলে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তার এই গ্যারেজটা পাহাড়িদের বাড়ির সংলগ্ন হওয়ায় তার গ্যারেজের আগুন দ্রুত পাহাড়িদের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে।
কাটা পাহাড়ে (পোড়া ভিটা) আর্মিদের সহায়তায় তারা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ধীরাজ চাকমাদের বাসায়ও আগুন ধরিয়ে দেয়। এই আগুন আরও অন্যান্য অনেক বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে।
তাদের এই হামলায় ট্রাবেল আদাম, বনরূপা ও কাটাপাহাড়ে দেড়শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে যায়, কয়েক লক্ষ টাকার মালামাল লুট হয় এবং আহত হয় অনেকে।
তাছাড় শহরের বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মালামাল কেনাবেচার জন্য আগত পাহাড়িদের ওপরও হামলা চলে এবং তাদের কাছ থেকে দেড় লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে নেয়া হয়। তবলছড়ি, রিজার্ভ বাজার এলাকায় তাদেরকে মারধর করা হয়।

বাবলু আহত :
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক দেবাশীষ চাকমা বাবলু মোটর সাইকেলযোগে তবলছড়ি থেকে ফিরছিলেন। তথাকথিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা তাকে বনরূপা বিনিময় ষ্টোর-এর সামনে আটকায় এবং চড়াও হয়। তারা কিরিচ দিয়ে মাথার ওপর তিন কোপ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাবলু সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এরপর বিএনপির স্থানীয় নেতা ফারুক, যে নিজের গ্যারেজ আগুন ধরিয়েছিল, মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর তারা আনন্দ চাকমা সহ সোনালী ব্যাংকের একজন মহিলা কর্মচারী আলোরাণী চাকমাকে সাংঘাতিভাবে মারধর করে।

এ কি তন্ময়?
মেধাবী ছাত্র, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সক্রিয় কর্মী তন্ময় চাকমাকে আর চেনাই যায় না যেন। কাটা পাহাড় এলাকায় বর্বরেরা পৈশাচিক নৃত্য করে তার নাক মুখ সর্বাঙ্গ শরীরে এসিড নিক্ষেপ করে। পুড়ে যায় সে। কিন্তু কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যায়।


দমকল বাহিনী কোথায়?
প্রায় ১২ টা থেকে আরম্ভ হয়ে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। এ সময় দমকল বাহিনী আগুন নেভানোর জন্যে স্পট-এর অভিমুখে আসার পথে বাঙালিরা আটকিয়ে রাখে। তাছাড়া পাহাড়িরা নিজেরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে আর্মিরা গুলি করে বাধা প্রদান করে। ফলে আগুন একচেটিয়া জ্বলতে থাকে।

১৪৪ ধারা ও কারফিউ :
সন্ধ্যে ৭টা থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। রাঙ্গামাটি জোনসদর কারফিউ বলব করে এবং ২৩ তারিখ পর্যন্ত বলব থাকে।

তদন্ত কমিটি ও গৌতম দেওয়ানের পদত্যাগ :
গৌতম দেওয়ান ঘটনার সাথে সাথে বিরাট গণরোষ এড়াতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে ৩জন বাঙালি সদস্যসহ আরো ১৬ জন জেলাপরিষদ সদস্য পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু আর্মিরা ব্রিগেড অফিসে ডেকে নিয়ে তাদেরকে হুমকিদিলে তারা চুপ থেকে যায়।                                     
ঘটনার পরদিন রাঙ্গামাটির ADM কে (Additional District Magistrate) প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তা প্রত্যাখান করে।

সন্ত্রাসীদের অবাধ বিচরণ :
ঘটনার সাথে জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হলেও মূল দাঙ্গাবাজ সন্ত্রাসীরা রাঙ্গামাটিতে এখনো অবাধে বিচরণ করছে। বিএনপির সদস্য নাজিম উদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম মুন্না, স্থানীয় সংবাদদাতা অঞ্জন, পার্বত্য বাঙালি গণ পরিষদ সদস্য আশরাফ ও শাহ আলম এখন বুক ফুঁলিয়ে রাঙ্গামাটিতে ঘোরাফেরা করছে।

ষড়যন্ত্রের মূল অন্বেষণে :
১৮ই মে রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপি-এর এক নেতার বাসায় আলাপ হচ্ছিল। বলা হয়েছিল দলীয় মিটিং। জি-২ আইয়ুবকে বেশ তপর মনে হল। তিনিই মূলতঃ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকগুলো সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছিলেন এবং সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যত কর্মসূচীর কথা বলছিলেন। ঐ দিনের মিটিংকে ষড়যন্ত্র বলা যেতে পারে নির্দ্ধিধায়। এই মেজর ছাত্র জীবনে ইসলামী ছাত্র শিবির করতেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায় বান্দরবানের অধিবাসী এই মেজরকে এলাকায় ষড়যন্ত্র চালানোর জন্যে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই আইয়ুবের নির্দেশে রাঙ্গামাটি সহ পার্বত্য এলাকায় অনেক নিরীহ লোককে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। মনতোষ দেওয়ান, মংথোয়াই, মনতোষ চাকমা, বিজয়কেতন চাকমা, অনিল চাকমার নাম এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। ২০ শে মে রাঙ্গামাটি ঘটনার জের ধরে চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান পদত্যাগ করলে মেজর আইয়ুব বিদ্রুপের হাসি দিয়ে মন্তব্য করছিলেন, “চেয়ারম্যান গৌতম ভালো লাগছেনা গৌতমের, কন্ট্রাক্টর গৌতম ভালো লাগবে এবার।” শুধু দালাল গৌতমই নয় মেজরের দৌরাত্ম্য রাঙ্গামাটিতে অনেক প্রশাসনিক পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নাভিশ্বাস উঠছিল। এক এক সময় এক এক চক্রান্ত নিয়ে ব্যস্ত সমস্ত থাকতে দেখা যায় এই তরুণ সামরিক অফিসারটিকে। তার হাত দিয়ে দেদার কালো টাকা ছড়ানো হয়েছে। নামে বেনামে বিভিন্ন সময়ে সংগঠন খাড়া করানো, পত্রিকায় বক্তব্য, বিবৃতি দেয়া, বিভিন্ন প্রচার পত্র ছাপানো এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত করার জন্যে পাহাড়িদের মধ্যে কতিপয় এজেন্ট লাগিয়ে দেয়া, উপজাতীয় কোটা বাতিলের দাবি তোলা ইত্যাদির জন্যে কিছু সুবিধাভোগী মাস্তান (মনীরুজ্জামান মনীর) লেলিয়ে দেয়া তার পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময়ে খাগড়াছড়িতে ব্রিগেডিয়ার ইব্রাহীম এবং বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে মেজর আইয়ুবের নাম শুনেনি এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে। সাম্প্রতিক রাঙ্গামাটির ঘটনায় এই মেজর আইয়ুবের চক্রান্ত ফাঁস হয়ে পড়লে ডি,জি,এফ,আই-এর মেজর সাদেক আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি মেজর সাদেক বলছি মেজর আইয়ুবের বিরুদ্ধে আমি এক হাত দেখে ছাড়বোই।”

গোমর ফাঁস করলেন এস,পি। পাহাড়িরা বেসামরিক প্রশাসন ভালবাসে :
দাঙ্গাত্তোর রাঙ্গামাটিতে যান ছাত্র ইউনিয়নের দুই কেন্দ্রীয় নেতা। তারা বিভিন্ন মহলের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। তারা এককালীন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের এক সময়ের ভি,পি, বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে এস,পি’র সাথে খোলামেলা আলাপ করেন। এক পর্যায়ে তিনি একটি বিশেষ কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। পুলিশ প্রশাসনের উপর বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণের কথা বলেও তিনি বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি অষন্তোষ প্রকাশ করেন। ১৮ ই মে যে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল তাই তিনি মোটামুটি খুলে বললেন। ঘটনার সাথে জড়িত চারজন বাঙালি সন্ত্রাসীকে পুলিশে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা যে স্বীকারোক্তি দেয় তা এস,পি, মহোদয় নেতৃবৃন্দকে দেখান। স্বীকারোক্তীতে আসামীরা বলেন ব্রিগেডের নির্দেশে তারা আক্রমণ করতে এসেছিল। তাদের লোকালয়ও রাঙ্গামাটি শহরে নয়। তাদের লঞ্চে আনা হয়েছে লংগুদু থেকে। তাদের কাছ থেকে পুলিশ ধারালো অস্ত্র ও লোহার রড উদ্ধার করেছে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া যখন চলছিল তখনই বিভিন্ন স্থানে কর্মরত মুসলীম অনুপ্রবেশকারীদের বলা হয়েছিল, “হাতে যার যা আছে তা নিয়ে চাকমা মারতে চলে আস। চাকমারা মুসলীমদের কেটে ফেলেছে।” এভাবেই সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে অনেককে উত্তেজিত করে দাঙ্গা বাঁধাতে চেষ্টা করা হয়েছে। নিকটবর্তী সেনা ছাউনী থেকে বাবুর্চী সহ কিছু শ্রমিককেও দাঙ্গায় যোগ দিতে তাগিদ দেয়া হয়েছে।

সামরিক কর্তৃপক্ষের যা ছিল মনে :
সাম্পদায়িকতার সহজলভ্য সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানকে বানচাল করার এক মহা পরিকল্পনা ছিল সামরিক কর্তৃপক্ষের। সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বাঁধিয়ে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় এবং পুত পবিত্র রাখতে চেয়েছিল তারা। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে তারাই যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পদ লুটে পুতে খেতে চায় এবং নিজেদের একক সাম্রাজ্য টিকিয়ে রেখে নির্বিঘ্নে জাতীয় বাজেটে ফুটো করতে চায়। বার বার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ফায়দা লুটাই এই বিশেষ গোষ্টির বহু দিনের শখ। এভাবেই রাঙ্গামাটিতে পরিকল্পনাটি হাতে নেয়া হয়েছিল। দুই ঘন্টা ধরে তীব্র সংঘর্ষ লাগিয়ে একটা বিশৃংখল অবস্থার জন্ম দিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কয়েক শত নেতা কর্মীকে জেলে ঢুকিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে নিষিদ্ধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তারা। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক মহোদয়কে বার বার চাপ দেয়া হয়েছিল যাতে পাহাড়ি ছাত্রদের পাইকারীভাবে আটক করা হয়। পাহাড়ি ছাত্রদের একমাত্র প্রিয় সংগঠনকে ব্যা- করে সারা দেশে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে তাদের শান্তিবাহিনীতে পাঠানোর চেষ্টা করছে ঐ বিশেষ চক্রটি। তাই তারা মনে মনে এসব ফন্দি ফিকির আঁটে। ১৯ শে মে জেলা প্রশাসকের নিকট তারা স্বাক্ষর বিহীন একটি স্মারকলিপি প্রদান করে। এতে প্রধান দাবী ছিল - কয়েকজন পাহাড়ি ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার এবং ছাত্র পরিষদের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা। প্রিয় পাঠক, এতেই কী পরিস্কার হয় না কিছু ছাত্র নামধারী এজেন্ট লাগিয়ে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করার ঐ বিশেষ মহলের কুচক্রান্ত।

কুচালের রকমফের। আমাদের করণীয়:
(১) বনরূপা, ট্রাবেল আদাম ইত্যাদি পাহাড়ি বসতিতে যখন আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিল ঐ সন্ত্রাসীরা, তখন উর্দিপরা রক্ষীরা প্রায় ৭০/৮০ রাউ- গুলি ছোড়ে। যাতে করে জনসাধারণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং উদ্ধার কার্য চালাতে না পারে। ফায়ার ব্রিগেডকে অপারেশন চালাতে দেয়নি তারা। যে মুহুর্তে মোটামুটি ভালোমত পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই তারা নিজেরাও উদ্ধারকারী সেজে বসে।
 (২) সকালের দিকে প্রথম যখন দাঙ্গা হাঙ্গামা চলছিল তখন প্রশাসন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। তখন কোন আইন (১৪৪ ধারা) লাগানোর খেয়াল হয়নি তাদের। মারামারি, জ্বালাও পোড়াও অভিযান সমাপ্ত হলে পরে তারা ১৪৪ ধারা দিয়ে নিরাপত্তা রক্ষায় এগিয়ে আসে। যদিও দাঙ্গা চলাকালীন অসংখ্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছিল রাস্তার মোড়ে মোড়ে।
(৩) জেলা প্রশাসন পরিস্থিতি চরমে উঠলে ১৪৪ ধারা জারী করে। সাথে সাথে আবার সেনা কর্তৃপক্ষ শহরে সান্ধ্য আইন (কারফিউ) ঘোষণা দেয়। নিজেদের দায় এড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে তারা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দের মোলাকাত করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
(৪) খাগড়াছড়ি পর্ব :- রাঙ্গামাটিতে যে সময় আক্রমণ চলছিল ঠিক সে সময় খাগড়াছড়িতে আরো এক নাটকের মঞ্চায়ন হয়। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের ডেকে পাঠানো হয় ব্রিগেড অফিসে। একই সময়ে চাকমা, মারমা নেতাদের নিয়ে সভা বসে জোন অফিসে। জানা যায় ত্রিপুরা নেতারা যেতে চাননি। অন্যদিকে জোন কর্তৃপক্ষ উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের সামনে সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলাপকালীন সৌখিন চাকমা নামক এক স্থানীয় নেতাকে বার বার বকছিলেন। খাগড়াছড়িতে নেতৃবৃন্দকে ব্যস্ত রাখাই এর উদ্দেশ্য। যাতে তারা রাঙ্গামাটির ঘটনার প্রতিক্রিয়া করতে না পারে তার ব্যবস্থা হিসেবে।

অতএব, এ বিষয়ে জনগণের করণীয় একটাই। সেটা হল ঐ কুচক্রীদের চক্রান্তে জড়িয়ে না পড়া। সতর্ক থাকা সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক উস্কানী থেকে। যে কোন মূল্যে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য রক্ষা করা এখন জরুরী এবং এটাই আমাদের আশু করণীয়।

........................


--------------------------------------------------------------
খালেদা সরকারের বাধ্যতামুলক প্রাথমিক শিক্ষা
পার্বত্য এলাকাকে বাদ দিয়ে

বর্তমান “গণতান্ত্রিক” সরকারের প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার জন্য গালভরা কথা বিভিন্ন জনসমাবেশে বলে থাকেন। খালেদা সরকারের এই পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তা অবশ্যই বিবেচনাধীন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এই পরিকল্পনার ধারে কাছেও নেই বরং পূর্বে যেভাবে শিক্ষার কার্যক্রম চলছিল তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের প্রতিবেদক রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালী উপজেলার উপর একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ চালিয়ে যে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছেন তা হচ্ছে নিম্নরূপ।
কাউখালি উপজেলার উপজেলা সদরের কাছাকাছি কয়েকটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া গ্রাম অঞ্চলে যে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে সেগুলো সবকটিই বন্ধ। নয়ত মাত্র একজন শিক্ষককে বিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেদক এসবের কারণ হিসেবে সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন। কারণ যে সকল প্রাথমিক শিক্ষক গ্রাম অঞ্চলে শিক্ষকতা করতেন তাদের বেতন নিতে হয় এলাকার সেনা ক্যাম্প থেকে। শুধু এভাবে বেতন নিলে হবে না, প্রতি সপ্তাহে শান্তিবাহিনীর খবরা খবর সেনা ক্যাম্পে সরবরাহ করতে হবে। যে সব শিক্ষক নিয়মিত শান্তিবাহিনীর খবর সরবরাহ করতে পারবেন না, তাদের বেতন সেনা কমা-াররা বন্ধ করে দেন। ইত্যাদি কারণে গ্রাম অঞ্চলে যে সকল শিক্ষককে পোষ্টিং দেয়া হয়েছে তারা প্রায়ই নিজেদের কর্মস্থলে যাননি। সেই কারণে কাউখালি উপজেলাতে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ। অথচ এদিকে “গণতান্ত্রিক” সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রী পার্বত্য এলাকায় শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে বলে অনেক গালভরা কথা বললেও পার্বত্য এলাকায় বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে চলছে তার খবর রাখেন কি?
বর্তমানে কাউখালিতে গ্রাম এলাকায় যে সব প্রাথমিক স্কুল রয়েছে সে সব স্কুলের মধ্যে রাংগীপাড়া (উত্তর মুবাছড়ি) সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বটতলী, দুর্য্যাপাড়া, নভাঙ্গা, শুকনাছড়ি ইত্যাদি এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ঘুরে আমাদের প্রতিবেদক রাঙ্গীপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নভাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে শিক্ষক থাকলেও বাকী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কোন শিক্ষকের উপস্থিতি দেখতে পাননি। তাই বর্তমানে অনেক স্কুল ঘর গরু রাখার ঘরে পরিণত হয়েছে।
এই চিত্রটা শুধু মাত্র কাউখালী এলাকায় নয়। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে একই চিত্র বিরাজ করছে। এ হচ্ছে এযাব ক্ষমতাসীন সরকারগুলো কর্তৃক পার্বত্য এলাকার শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়নের চেহারা। উন্নয়নের নামে এসব প্রতারণা আমরা তীব্রভাবে নিন্দা করি। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে যথোপযুক্ত তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবী জানাচ্ছি।
- রাডার প্রতিবেদক
-------------------------------------------------------------------------------------------------


[ঢাকাস্থ ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের প্রধানরা লোগাং-এ সংঘটিত গণহত্যা এবং তার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যাপারে আলোচনা করেন। আলোচনার পরদিন ইউরোপীয় কমিউনিটির বর্তমান চেয়ারম্যান ব্রিটিশ হাই কমিশনার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে যে চিঠি দেন তা অনুবাদ করে ছাপানো হলো :]

৪ঠা মে ১৯৯২                                                                            ব্রিটিশ হাই কমিশন                      
মহামহিম                                                                                                 ঢাকা                     
মিঃ এ,এস,এম মুস্তাফিজুর রহমান এম,পি, মন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়                                  
সেগুন বাগিচা                                 
 ঢাকা।

প্রিয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পার্বত্য চট্টগ্রামে গণহত্যার অভিযোগ সম্পর্কে আপনাকে লেখার জন্য গতকাল ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের মিশনের প্রধানরা তাদের আলোচনায় আমাকে অনুরোধ করেছেন।
প্যারিসে কনসার্টিয়াম বৈঠকে দাতাদের অনেক প্রতিনিধি এ বিষয়ে উত্থাপন করার ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে অর্থমন্ত্রী আপনাকে এবং অন্যান্য ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের অবগত করেছেন। সেখানে কনফারেন্স হলের বাহিরে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল যা ইউরোপীয়ান প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। প্রতিনিধিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ সম্পর্কে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বিশেষ আগ্রহের কথা অবহিত করেন এবং এ ব্যাপারে সরকারকে জবাবদিহি করতে প্রস্তুত থাকতে হবে, বিশেষতঃ বাংলাদেশকে দেয়া সাহায্য কর্মসূচী সংক্রান্ত প্রশ্নে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের চাপের ফলে অর্থমন্ত্রী কনসার্টিয়াম বৈঠকে নিশ্চয়তা দেন যে তিনি ঢাকা ফিরে তদন্তের জন্য বলবেন। প্রতিনিধিরা একটি পূর্ণ বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং এর ফলাফল সর্বসাধারণের প্রকাশ্যে করা উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

আমি ফেরার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং (যখন আমি এফসিও-তে দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান মিঃ উইলিয়ামের সাথে দেখা করি) মাননীয় তথ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে অবগত করাই।
আমি কৃতজ্ঞ হব যদি আপনি তদন্ত হয়েছে কিনা এবং কবে নাগাদ আমরা ফলাফল প্রত্যাশা করতে পারি এ সম্পর্কে আমাকে অবগত করান। রাষ্ট্রদূতরা তাদের সংশ্লিষ্ট সরকারকে অবগত করাতে ইচ্ছুক।

উঞ্চ শুভেচ্ছা সহ                                 
আপনার একান্ত                                
 কলিন ইমরে                                   
 সি,এইচ, ইমরে


প্যারিস কনসোটিয়াম বৈঠকের সময় কনফারেন্স হলের বাহিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের লোগাং-এ গণহত্যাসহ সামরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হয়। উপরের ছবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভকারীদের দেখা যাচ্ছে।
-------------


[প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা অর্গানাইজিং কমিটি চিটাগং হিলট্রাক্টস ক্যাম্পেইন-এর চিঠি অনুবাদ করে ছাপানো হল]

অর্গানাইজিং কমিটি                                         
চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস ক্যাম্পেইন                                  
পি,ও, বক্স ১১৬৯৯ ১০০১ জিআর আর্মষ্টারদাম ন্যাদারল্যাণ্ড                                
পোষ্টগিরো ২৭১৩৬০১
প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া                                    
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়                                    
পুরাতন সংসদ ভবন                                    
 ঢাকা                                
বাংলাদেশ

সূত্র :  ১০ই এপ্রিল ১৯৯২ পার্বত্য চট্টগ্রামের পানছড়ি উপজেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা।

৮ই মে ১৯৯২

প্রিয় বেগম খালেদা জিয়া,
আমাদের কাছে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য স্বাধীন সূত্রে পাঠানো ১০ ই এপ্রিল ১৯৯২, পানছড়ি উপজেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙালিদের সহযোগে বিডিআর, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক শত শত নিরীহ পাহাড়ি হত্যার খবরে আমরা গভীরভাগে মর্মাহত।
এই গণহত্যা সম্পর্কে খাগড়াছড়ি জেলার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সূত্রগুলো স্বীকার করেছে যারা উক্ত সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাম এবং সাত শয়েরও বেশী ভস্মীভূত বাড়ি এবং কয়েক শত মৃতদেহ দেখতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তারা এও স্বীকার করেছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে গত দুই যুগের মধ্যে লোগাং গণহত্যাই সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড।
খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজ এই সত্যতা স্বীকার করেছেন যে, তিনি শান্তিবাহিনী কর্তৃক ১১ জন মানুষ নিহতের খবর প্রচার মাধ্যমে অবগত করেছিলেন। তিনি আরও স্বীকার করেছেন যে, পাল্টা হামলা হিসেবে বিডিআর, এবং গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী এই গণহত্যা সংঘটিত করেছে।
এই গণহত্যার প্রত্যক্ষ কারণ ছিল তিনজন বাঙালি কিশোর কর্তৃক তিনজন পাহাড়ি কিশোরী ধর্ষণের চেষ্টা প্রতিহত করার তাক্ষণিক আত্মরক্ষা।
কেবল এই নৃশংসতাই নয়, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লংঘনের অসংখ্য ঘটনা আমরা অবগত হয়ে আসছি। এর মধ্যে অতি সম্প্রতিগুলো হল :-
* ২রা ফেব্রুয়ারী ১৯৯২ লংগদু উপজেলার মাইল্যাতে সেনাবাহিনী কর্তৃক লঞ্চে পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার পর বাঙালি শরণার্থীদের দ্বারা ৩০ জনেরও বেশী পাহাড়িকে হত্যা করা হয়।
* ১২ই মার্চ ১৯৯২ রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী থানা থেকে পংহলা প্রু মারমার ছেলে মিঃ মং থোয়াই চিং মারমা নিখোঁজ হয়ে যান। তিনি কোথায় এখনো জানা যায়নি।
* ২৭ শে এপ্রিল লোগাং গণহত্যার ১৭ দিন পর খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলায় উল্টাছড়িমুখ দাতকুপ্যা গ্রামের ১৭ বছর বয়সী সাধুলাল চাকমা গরু চড়ানোর সময় প্রহরারত সেনাবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়।

এই প্রাপ্ত ঘটনাগুলো হয় মিথ্যাভাবে শান্তিবাহিনীর ঘাড়ে দোষারোপ করা হয়েছে অথবা মোটেই প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি।
এ সবই আমাদের প্রাপ্ত তথ্য সমূহের সত্যতা প্রমাণ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো অঘোষিতভাবে সংবাদে বিধিনিষেধ আরোপিত আছে। এই প্রাপ্ত ঘটনায় কোনটার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়নি।
আমরা বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানাই -
(১) লোগাং গণহত্যা তদন্ত, তার তথ্য প্রকাশ ও দোষীদের শাস্তি প্রদান করতে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
(২) অতীতের সকল হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচার, বেপরোয়া গ্রেফতার, গ্রাম ধ্বংস, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, অবৈধ ভূমি দখল ইত্যাদি তথ্য প্রকাশ এবং দোষীদের শাস্তি প্রদানের জন্য একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
(৩) পাহাড়িদের গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তর বন্ধ করতে হবে এবং সকল গুচ্ছগ্রাম ভেঙে দিতে হবে। সকল পাহাড়ি মানুষদের তাদের নিজ নিজ পৈতৃক জায়গায় পুনর্বাসন করতে হবে।
(৪) বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী কর্তৃক পাহাড়িদের উপর সকল মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এরূপ গণহত্যা বা অন্য কোন মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সংঘটিত না হয় তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
(৫) পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক ভাবে সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থা তদন্তের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করতে হবে।
(৬) পাহাড়ি জনগণের উপর আরোপিত সকল বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘুদের বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
(৭) পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ঘটনার তথ্য স্বাধীনভাবে প্রচার করার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমরা আপনার সত্ত্বর উত্তরের অপেক্ষায় আছি।

আপনার একান্ত                                 
জেনেকি এরেন্স                                  
অর্গানাইজিং কমিটি, চিটাগং হিল ট্রাক্টস ক্যাম্পেইন -এর পক্ষে।

অনুলিপি :
মিঃ আব্দুল মতিন চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।                                    
 মিঃ মোস্তাফিজুর রহমান, পররাষ্ট্র মন্ত্রী।                                 
শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, বিরোধী দলীয় নেত্রী।                                       
বিচারপতি শাহাবুদ্দীন।                                  
এটর্নী জেনারেল আমীনুল হক।                                   
লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরুদ্দীন খান, সেনাবাহিনী প্রধান।                                  
মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান, জিওসি, চট্টগ্রাম সেনানিবাস।                                   

ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজ, আঞ্চলিক কমাণ্ডার খাগড়াছড়ি। 
-----------------


সা ক্ষা ত কা র
[পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা। সঙ্গত কারণেই আমরা মনে করি এ সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের সচেতন ছাত্র, বুদ্ধিজীবি, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকাকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে কে কি ভাবছেন তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সচেতন মহলের সাক্ষাতকার ছাপাচ্ছি। এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় চলমান সংখ্যায় বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের সাধারন ও পি,ডি,এফ-এর আহবায়ক দিলীপ বড়–য়ার সাক্ষাতকার ছাপানো হলো ]

কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল কোটি কোটি সরকারী টাকা এবং বনজ সম্পদ লুটপাট করার
লক্ষ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে স্থায়ীভাবে জিইয়ে রাখতে সচেষ্ট
                                   - দিলীপ বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল।

১। সম্প্রতি আপনারা পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে এসেছেন। বছরের পর বছর ধরে বিচ্ছিন্ন করে রাখা পার্বত্য চট্টগ্রামে এ সফর খুবই তাপর্যপূর্ণ। সফরের অভিজ্ঞতার আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করুন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের দেশেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাকৃতিক কারণে যেমন এর একটি নিজস্ব স্বতন্ত্রতা আছে তেমনি চেঙ্গী, মাইনি সহ বিভিন্ন ভ্যালির অববাহিকায় শতশত বসর ধরে যাদের বাস তাদের মধ্যে ভাষা সাংস্কৃতিতেও স্বাতন্ত্রতা আছে। আমরা জাতি হিসাবে বাঙ্গালি, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী শ্রেণী হিসাবে শোষিত। আর পাহাড়ি অঞ্চলে যাদের বাস তারা হচ্ছে ১০এর অধিক সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার বিভক্ত জনগোষ্ঠী। বাঙ্গালি জাতি হিসাবে আমাদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সব সময় শুনেছি অরণ্য, বনানী ও পাহাড়ের কোলে লালিত এই জনগোষ্ঠী এক কালে সহজ সরল সাদাসিদে জীবন যাপন করতো। নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিতে আপন মহিমায় মহিমান্বিত ছিল। শান্তির ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত এই জনগোষ্ঠীর তেমন কোন রাজনৈতিক উচ্ছাভিলাষও ছিল না।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর নির্মম জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণ থেকে মুক্তির স্বাদ পাবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীও আমাদের সাথী ছিলেন। আমরা যারা অনেক মূল্যের বিনিময়ে জাতিগত নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেলাম তাদের স্বাভাবিকভাবে উচিত ছিল আমাদের সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বা অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বায়ত্ত্বশাসনের স্বীকৃতি দেওয়া। পাকিস্তান ভারত সহ সকলে তাদের দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাগুলোর বিকাশ এবং শাসন করার ক্ষেত্রে সীমিতভাবে অভিন্ন কতগুলো নিয়ম অনুসরণ করে চলেছে। এমন কি পশ্চিম বঙ্গে শুভাষ ঘিসিং -এর নেতৃত্বে নেপালি বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
যে জাতি জাতিগত নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাবার জন্য অনেক মূল্য দিয়েছে সেই জাতির শাসক গোষ্ঠীরা আমাদের গর্বের বিষয় চিরহরি বনানীর কোলে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাগুলোর অধিকারগুলো মেনে না নিয়ে জাত্যাভিমানের বশবর্তী হয়ে যে পথ অনুসরণ করছে তাহা কোন মতেই সংখ্যালঘু জাতি সত্ত্বাদের জন্য ত বটেই বাঙ্গালি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্যও মঙ্গলজনক নয়।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে স্বার্থান্বেষী মহল পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বা সম্পর্কে ভ্রান্তনীতি অনুসরণের ফলেই একটি অবৈরীমূলক দ্বন্দ্ব বৈরিমূলক দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে মিথ্যা ও ভুল তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সাথে সমতল ভূমির জনগণের মধ্যে কৃত্রিমভাবে পর্বত প্রমাণ পার্থক্যের প্রাচীর সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বীয় গোষ্ঠীর স্বার্থে ঐ কুচক্রী মহল সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার উপর এক দিকে যেমন চরম নিপীড়নের নীতি অনুসরণ করছে তেমনি সমতল ভূমির নিরীহ ছিন্নমূল মানুষগুলোকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থে ব্যবহার করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের সঠিক পথ না নিয়ে সমস্যার পরিধিকে ব্যাপকতর করার লক্ষ্যেই ঐ স্বার্থান্বেষী মহল সকল ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে সমস্ত বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি কথিত উপদ্রুত অঞ্চল হিসাবে আখ্যায়িত করে তুষার ধবলমনা অসহায় জনগণ - যারা সামাজিক নৃতাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন তাদেরকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করার সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করেছে।
আমাদের দেশের কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের নীতির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সমস্যার সমাধানের নৈতিক দায়িত্ব এ দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের হলেও তাহা মুলতঃ মৌখিক থেকে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা আমাদের দেশের জনগণের অন্যান্য সমস্যার মতই একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। কিন্তু তাকে হৃদয়ানুভুতি দিয়ে উপলব্ধি করার সীমাবদ্ধতা ছিল বলে পাহাড়ি সমস্যা অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি। পাহাড়ি অঞ্চলে যে অমানবিক ঘটনা ঘটেছিল তাকে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্রোধ এবং প্রকৃত বিরোধীতা করতে আমাদের দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো প্রয়োজনের তুলনায় বিশেষ কিছুই করেনি। অবশ্য এই দায় দায়িত্ব থেকে আমরাও মুক্ত নই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার জটিলতা গভীরতাকে উপলব্ধি করার ইচ্ছা থাকলেও তার সুযোগ ইতিপূর্বে আসেনি। এইবারের বৈ-সা-বি উসবে যোগদানের ভিতর দিয়ে কিছুটা উপলব্দি করার সুযোগ আসে। ১১ই এপ্রিল বিকাল ৩ঃ৩০টায় খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছার পর মনে হ’ল আমরা যেন একটি ভিন্ন জগতে এসেছি। দেশের সর্বত্র বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া চালু থাকলেও পাহাড়ি অঞ্চলে এর লেশমাত্র নেই। একজন নাগরিক হিসাবে মৌলিক অধিকার থেকে পাহাড়ি লোকেরা দারুণভাবে বঞ্চিত। এ যেন একদেশে দুই ব্যবস্থা। মনে হল চেঙ্গী ভ্যালির কোলে যেন বিরাজ করছে স্বৈরাচারের জঘন্য রূপ। এখানকার শ্যামল গিরিশৃংগ এবং উন্মুক্ত আকাশের নীচে এক সময় পরিবেশ উসব মুখর উচ্ছলতায় ভরপুর থাকলেও আমাদের মনে হল এখানকার হরিণের মত চঞ্চলা প্রকৃতির জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজ করছে ভীতি বিহবল এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। প্রশাসন বলতে সর্বত্র সামরিক কর্তাদের প্রধান্য। হত্যা, গুম, ধর্ষণ নিত্য দিনের সাথী। সর্বোপরি সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন এক মনন্তাত্ত্বিক নির্যাতনের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যাতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন আশার আলো দেখতে না পারে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় কোন বিবেকবান বাঙালি ও পাহাড়িদের ন্যায়সঙ্গত দাবী সম্পর্কে বল্লে তাকেও সামরিক কুচক্রীদের কোপানলে পড়তে হয়। রাজনৈতিক সমাবেশ ও চর্চা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ১২ই এপ্রিল বিকালে লোগাং -এ নিহতদের স্মরণে সভায় খাগড়াছড়ির ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক সভা এবং ১৩ই এপ্রিল ৫ সহস্রাধিক লোকের শোক মিছিল খাগড়াছড়ির ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক মিছিল। রাজনীতির নূন্যতম অধিকার বিবর্জিত এই জনপদে মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত হচ্ছে। জেলা পরিষদ নামে যে প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করানো হয়েছে তাহা প্রত্যেক বিগ্রেড কমা-ারের একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার। এইটি মুলতঃ সেনা প্রশাসনেরই ওরসজাত সন্তান। বর্তমান জেলা পরিষদের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অর্থনৈতিকভাবেও তাই পাহাড়ি জনগোষ্ঠী চরমভাবে নিগৃহীত। খাগড়াছড়ি জেলা সদরে কোন পাহাড়ির দোকান নেই। অর্থনৈতিক নিয়ামক শক্তি হিসাবে গড়ে উঠার আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই বরঞ্চ অস্তিত্ব বিপন্ন। ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতিতে স্থানীয় লোক নেই বললে চলে। গুচ্ছগ্রাম, শান্তিগ্রাম, বড়গ্রামগুলো করার মধ্য দিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবন জীবিকার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সামরিক প্রশাসনের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী হিসাবে তাদেরকে গড়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিকল্পিতভাবে তাদের মেরুদ- ভেঙ্গে দিচ্ছে। চাষাবাদ, পশুপালন, হাঁস মুরগী পালনের ব্যবস্থা, মাছ ধরা, পাহাড় থেকে গাছ ও বাঁশ কাটা পাহাড়িদের জন্য ক্রমশঃ কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে পাহাড়িদের নিজস্বভাবে বেঁচে থাকার কোন পথ থাকছে না।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। খাগড়াছড়ি কলেজকে পুর্ণাঙ্গ ডিগ্রী কলেজ করা হচ্ছে না। পার্বত্য অঞ্চলে লেখাপড়ার, তেমন কোন সুপরিবেশ নেই বললে চলে। তাছাড়া রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এক কালের উন্নত সাংস্কৃতি সম্পন্ন জনগোষ্ঠী নিজেদের সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে বিকশিত করার পরিবর্তে নিরুসাহিত হয়ে পড়েছে। আমরা জানি অর্থনীতি হল সমাজের মূল ভিত্তি। রাজনীতি হল তার ঘনীভূত প্রকাশ এবং সাংস্কৃতি হল অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রতিফলন। এই ভিত্তিতে বিচার করলে পাহাড়িদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তারা যেন নিজ গৃহে পরবাসী। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব, রাজনৈতিকভাবে অধিকারহীন এবং সাংস্কৃতিকভাবে নির্যাতিত। এরই ফলে তাদের স্বকীয় সত্ত্বার অস্তিত্ব বিপন্নের সম্মুখীন।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠী অত্যন্ত অতিথি পরায়ন। পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতল ভূমির কোন লোকের স্থায়ী বসবাসের বিরোধীতা পূর্বে তারা করেনি। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ হবার পর বহু বাঙালি স্বাভাবিকভাবে বসবাস করে আসছে। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদীরা পাহাড়ি বাঙালিদের মধ্যে বিভেদের নীতি চালু করে ও সমস্যাগুলোকে অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে সমতল ভূমির নিঃস্ব অসহায় ছিন্নমূল এবং সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীকে স্থায়ী পুনর্বাসনের নামে পাহাড়ি অঞ্চলে যখন নিয়ে আসে তখনই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মনে সংশয় সন্দেহ দেখা দিয়েছে। পুনর্বাসনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করা হয়েছে। উন্নয়নের গাল ভরা কথা বললেও পাহাড়িরা পূর্বের তুলনায় আরও গরীব হয়েছে । সমগ্র পার্বত্য এলাকার আয়তন আমাদের দেশের এক দশমাংশ হলেও কৃষিযোগ্য ভূমি খুবই নগণ্য। ফলে বাংলাদেশের ১১ কোটি লোকের মধ্যে যেখানে শতকরা ৬০%এর অধিক লোক ভূমিহীন সেখানে কয়েক লক্ষ লোককে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করেও বাঙালিদের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। বরঞ্চ ইতিমধ্যে উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের নামে যে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে তার মাধ্যমে সমতল ভূমিতে শিল্প কলকারখানা সৃষ্টি করে জাতীয় উন্নয়ন করা যেত। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে এই পুনর্বাসনের নামে তারা রামগড়সহ বিভিন্ন স্থায়ী বাসভূমি থেকে উখাত হয়েছে। তা ছাড়া এই পুনর্বাসনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। এই উদ্দেশ্য হচ্ছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে রূপান্তরিত করা এবং স্থানীয় লোকদেরকে শোষণ নিপীড়ন করার জন্য পুনর্বাসিত লোকদেরকে মনুষ্য ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা। অবশ্য পুনর্বাসিত লোকজনেরাও প্রতিকূল অবস্থা এবং নিয়ন্ত্রিত জীবন ধারাতে থাকতে চায় না। কাজেই রাজনৈতিক কুমতলবে ব্যবহৃত পুনর্বাসন কর্মসূচী পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সঙ্গত কারণে বিরোধীতা করছে।

উল্লেখিত অবস্থা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল কোটি কোটি সরকারী টাকা এবং বনজ সম্পদ লুটপাট করার লক্ষ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে চিরস্থায়ীভাবে জিগিয়ে রাখতে সচেষ্ট । তাছাড়াও পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাসমূহকে নিশ্চিহ্ন হরে ফেলার লক্ষ্যেই নীল নক্সা নিয়েই কায়েমী স্বার্থবাদীরা অগ্রসর হয়েছে। অবশ্য এই দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়ন হবার সম্ভাবনা খুবই কঠিন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ব্যতীত কোন জাতিসত্ত্বার উন্নতি হয় না। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী ছোট বড় প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা স্বীকৃত। আমাদের যেহেতু সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বা আছে তাদের জাতিসত্ত্বাসমূহকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদেরকে সচেষ্ট হতে হবে। সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাসমূহের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে শাসনতান্ত্রিকভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে রাজনৈতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যে কারণে ১৯৭১ সালে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সৃষ্টি হয়েছে ঠিক একই কারণে পাহাড়িদের সংগ্রামকে মূল্যায়ন করতে হবে। তবে নিপীড়ন নির্যাতন এবং বিপুল পরিমাণ সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির মধ্যদিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না।

দেরীতে হলেও বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পাহাড়িদের সমস্যাগুলোকে উপলব্ধি করছে। সম্প্রতি লোগাং হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি, বুদ্ধিজীবি, ছাত্র, সাংবাদিক, আইনজীবি, মানবাধিকার কর্মী সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। হত্যাকা-ের নিন্দা করে তারা ভয়াবহতা তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, ছাত্রনেতা, সাংবাদিক, আইনজীবি ও মানবাধিকার কর্মী লোগাং গিয়েছে। বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এই হত্যাকা-ের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে, অনেকে নিন্দা করেছে। সকলে লোগাং হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং রাজনৈতিক ভাবে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়েছে। সরকার একজন বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহলও বসে নেই। তারা বিভিন্ন কায়দা করে রাজনৈতিক সমাধানের বিরোধীতা করবে এবং তা বানচাল করতে সচেষ্ট হবে। রাঙ্গামাটির সাম্প্রতিক দাঙ্গা হাঙ্গাম, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট তার স্বাক্ষর বহন করে।

পাহাড়িদের আন্দোলনের পরিপূর্ণ সফলতা নির্ভর করছে বাংলাদেশের দরিদ্র নিপীড়িত ভাগ্যহত ব্যাপক জনগোষ্ঠীর যে অব্যাহত সংগ্রাম চলছে তার জয়লাভের ওপর। কোন বিদেশী শক্তির সাহায্যেও তাহা সম্ভব নয়। নিজেদের জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সাহসিকতার সহিত যে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করছে তার সাথে বাংলাদেশের শোষণ মুক্তির সংগ্রাম পরিপূরক। এই পরিপূরক সংগ্রামের বিজয়ের মধ্যদিয়েই পাহাড়িরা তাদের শান্তির নীড় খুঁজে পাবে এবং আমরাও একটি আধুনিক উন্নত জাতিতে রূপান্তরিত হবো।

২। আপনাদের সফরের একদিন আগে লোগাংগুচ্ছগ্রামে পাহাড়ি জনগণের ওপর এক বর্বরোচিত গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেনাবাহিনী আপনাদেরকে ঐ এলাকা সফর করতে দেয়নি। এ ব্যাপারটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
বিজু উসবে যোগদানের মধ্যদিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হবার উদ্দেশ্যে আমরা খাগড়াছড়িতে যাই। সার্কিত হাউসে পৌঁছার পর লোগাং -এর গণহত্যার খবর শুনে ভীষণভাবে সকলে মর্মাহত হয়ে পড়ে। সাথে সাথে মনে হ’ল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীর ছত্রছায়ায় রাজাকারদের হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন এবং ধর্ষণের কথা। স্বাভাবিকভাবে আমরা সকলে পরের দিন গণহত্যা সংঘটিত লোগাং -এ যাবার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ১২ই এপ্রিল খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি যাবার পর সেনাবাহিনীর লোকেরা আমাদেরকে লোগাং -এ যেতে দেয়নি। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে আমাদের দেশের মধ্যে সংঘটিত বাংলাদেশীদের হত্যাকা-ের ঘটনাতে যেতে না পারার বিষয়টি কত মর্মান্তিক এবং রহস্যপূর্ণ তাহা যে কোন বিবেকবান নাগরিকের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। বিষয়টি আরও হৃদয় বিদারক এই কারণে যে, নিহতদের লাশগুলোকে আত্মীয় স্বজনের নিকট ফের দেওয়া হয়নি এবং ধর্মীয় ভিত্তিতে সকার করা হয়নি। আমাদের সাথে রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, আইনজীবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রনেতা, মানবাধিকার কর্মী ছাড়াও ডেপুটি এটর্নী জেনারেল জনাব আরিফ সাহেবও ছিলেন। অনেক বুঝানোর পরও সামরিক কর্মকর্তারা আমাদেরকে হত্যাকা-ের ঘটনাস্থলে যেতে দেয়নি। কিন্তু অসত্য বক্তব্য প্রচার করলেও আসল সত্য খবর গোপন রাখতে পারেনি। ভিয়েতনামের মাইলাই, ইসরায়েল কর্তৃক প্যালেষ্টাইন ক্যাম্পে হত্যাকা-ের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের লোগাং সারা বিশ্বে মানবতা লংঘিত একটি নাম হিসাবে আত্ম প্রকাশ করেছে।     
লোগাং এর হত্যাকাণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাপ্রশাসনের অনুসৃত নীতিরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ভেবেছিল অতীতের মত এই হত্যাকা-ের ঘটনাকে বেমালুম চেপে যাবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর চৌহদ্দির মধ্যে এবং বিডিআর ক্যাম্প এর দুইশত গজের ভিতর এই নারকীয় ঘটনা সংঘটিত হওয়া খুবই রহস্যজনক। হত্যাকা-ের সাথে ভিডিপি এবং আনসার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে আইনের রক্ষক কেন ভক্ষক হলেন তাহাও বোধগম্য নয়। তবে পাহাড়ি অঞ্চলে লোগাং হত্যাকা-ের আর পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তজ্জন্য হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।

৩। পাহাড়ি জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের আন্দোলনকে কিভাবে দেখেন?
পাহাড়ি জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের আন্দোলনের জয় পরাজয়ের উপর নির্ভর করছে পাহাড়ি জনগণের অস্তিত্বের প্রশ্ন। জাতিগত নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য যে কোন ধরনের সংগ্রাম করার অধিকার অন্যান্য জাতিসত্ত্বাগুলোর মত পাহাড়ি জনগণেরও আছে। আমরা নিপীড়িত পাহাড়ি জনগণের এই সংগ্রামের সাথে আছি। পাহাড়ি জনগণের তাদের নিজস্ব জাতিসত্ত্বাগুলোর বিকাশের মধ্যদিয়ে আমাদের দেশের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব।

আমরা মনে করি এই জাতিসত্ত্বার আন্দোলন বিচ্ছিন্নভাবে জয়লাভ করতে পারবে না। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শোষণমুক্তির সংগ্রামের লক্ষে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের বিজয়ের উপরই নির্ভর করছে পাহাড়ি জনগণের জাতিসত্ত্বার আন্দোলনের সার্বিক মুক্তি। পার্বত্য জাতিসমূহ জাতিগত শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। অন্যদিকে সমগ্র বাঙালি জাতি শ্রেণী শোষণ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। উভয়ের মূল শত্রু বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে রক্ষাকারী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। বাঙালি জাতি ও সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের মধ্যেই বাঙালি জাতি ও সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার মুক্তি নিহিত।

৪। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কি ভূমিকা রাখা উচিত বলে আপনি মনে করেন? 
সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার পাহাড়ি জনগণ জন্মসূত্রে আমাদের দেশের নাগরিক। কিন্তু বাঙালিদের এক ধরনের উগ্র উদ্ভত জাতীয়তাবাদী মানসিকতার ফলশ্রুতিতে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার পাহাড়ি জনগণের সমস্যা সমাধানে তাহারা উদাসীন। এর ফলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের পাহাড়ি জনগণের সমস্যাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার পরিবর্তে দায়সাড়া কিছু কথা বলা ছাড়া এতদিন কিছুই করা হয়নি। একজন সচেতন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার কায়েমী স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। তাদের অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে নৈতিক, কায়িক সহ যেভাবে হোক সমর্থন করা। সাম্প্রতিক কালে লোগাং হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জাতীয় ভিত্তিতে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলো এগিয়ে এসেছেন এবং পাহাড়িদের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য কথা বলেছেন।
পাহাড়ি জনগণের মৌলিক এবং সুনিদির্ষ্ট দাবীগুলো অর্জনের লক্ষ্যে আমরা যদি সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান না করি তবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন তথা বিপ্লবী আন্দোলনকে সংগঠিত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এর কারণ হল পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে বাঙালিদের প্রকৃত মুক্তির সংগ্রাম, শোষণ নির্যাতনের সংগ্রাম পাহাড়ি জনগণের প্রকৃত মুক্তির সংগ্রাম ও শোষণ নির্যাতনের সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালি উগ্র জাতীয়বাদের বশবর্তী হয়ে পাহাড়ি জনগণের জাতিসত্ত্বার বৈশিষ্ট্যগুলোকে অস্বীকার করে তাদের উপর শোষণ নির্যাতন অব্যাহত রাখলে তাদের দ্বারা বাঙালি জনগণের নূন্যতম স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব নয়।

------------------------------
ভুল সংশোধন
[ রাডারের গত বৈ-সা-বি সংখ্যায় সাক্ষাতকার কলামে কবি শামসুর রাহমানের নাম ভুলক্রমে শামসুর রহমানের ছাপা হয়েছে এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে ঢাকা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে জনাব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষক এবং লেখক শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি। এই অনিচ্ছাকৃত ভূলের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

                                                                                                - সম্পাদনা পরিষদ ]
-----------------------------------


-------------------------------------------
আইন সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিবেদন
-------------------------------------------

রাডারের বৈ-সা-বি সংখ্যায় প্রকাশিত মহামান্য হাই কোর্টে তসময়ে যাদের রীট আবেদন বিবেচনাধীন ছিল, তম্মধ্যে নিম্নলিখিত ৭ জনের আটকাদেশ মহামান্য হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন।

নং          নাম                     পিতার নাম          ঠিকানা          রীট পিটিশন  
১। সুভাষ জ্যোতি চাকমা    অক্ষয় মুনি চাকমা         দিঘীনালা       ৩৫৫/৯২                                   
২। নতুন নাগর চাকমা     মৃত কালাচান চাকমা                      ৩৫৬/৯২                                 
। অজিতেশ্বর চাকমা     পান কুমার চাকমা                           ৩৫৭/৯২                                        
৪। কগো চন্দ্র চাকমা         নাওসা চাকমা                          ৩৫৮/৯২                                  
৫। পরিমল চাকমা           লালন চন্দ্র চাকমা                       ৩৫৯/৯২                                  
৬। বিনতা রঞ্জন চাকমা       মৃত পূর্ণমাসি চাকমা                  ৩৬০/৯২                                   
৭। অর্ধেন্দু বিকাশ চাকমা      বরুন চাকমা                          ৩৬১/৯২        

যে সমস্ত বন্দীর রীট পিটিশন বিবেচনায় রয়েছে তাদের নাম নিম্নে দেয়া গেল :
         নাম                          পিতার নাম                       ঠিকানা                                         
১। দেবসিন্দু চাকমা                 তালুক চন্দ্র চাকমা                পানছড়ি                                              
২। কেহলা চাই মারমা              কৈ ইচাই মারমা                    কাউখালি                                       
৩। হৃদয় কুমার চাকমা               জয়ন্ত কুমার চাকমা              বেতছড়ি                                       
৪। অযোদ্ধা চাকমা                    চন্দ্র মোহন চাকমা               পানছড়ি
৫। শশী রঞ্জন চাকমা                 সভা ধন চাকমা                  বরকল                                                 
৬। ধীমান চাকমা                    আদিত্য চন্দ্র চাকমা        পশ্চিম জগনা তলী                                      
৭। চক্কুয়া চাকমা                   গোপাল চন্দ্র চাকমা               মনারটেক                                                   
৮। ধন মনি চাকমা                মৃত দিলী কুমার চাকমা             বড়াদম

উল্লেখ্য উপরোক্ত রীট পিটিশনগুলো পরিচালনা করেছেন বা করছেন এডভোকেট নিজামুল হক নাসিম ও এডভোকেট আদিলুর রহমান খান। এদিকে এ মাসের মধ্যে আরো ৩০ জনের আটকাদেশের বিরুদ্ধে রীট পিটিশন দাখিল হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১০ জনের রীট পিটিশন পেশ করেন উপরোক্ত দুজন আইনজীবী। তাদের নাম ও পিতার নাম নিম্নে দেয়া হল।

     নাম                                       পিতার নাম                                    
১। মানিক রতন চাকমা                     চন্দ্র সেন চাকমা                                  
২। সুরেশ চাকমা                            গুন সিন্ধু চাকমা                               
৩। প্রতিময় চাকমা                           সেম রঞ্জন চাকমা                             
৪। যুদ্ধ মোহন চাকমা                       ভাগ্যি চাকমা                                     
 ৫। জগদীশ চন্দ্র চাকমা                     সুরেশ চাকমা                                       
৬। বসন্ত কুমার চাকমা                      সুন্দর কুমার চাকমা                                        
৭। শান্তি মাধব চাকমা                      মৃত রাম চন্দ্র চাকমা                                         
৮। অশ্বিনী কুমার চাকমা                    কাবুল্যা চাকমা                                    
৯। ললিত রঞ্জন চাকমা                     তরুনী সেন চাকমা                                
১০। জগদীশ্বর চাকমা                      আনন্দ মোহন চাকমা

অধিকন্তু এই আইনজীবীদ্বয় মিঃ চক্কুয়া চাকমা পীং গোপাল চন্দ্র চাকমাকে চট্টগ্রাম কমিশনার কোর্টে (Ex-officio Sessions Judge) ১০ বছর কারা দ-ের বিরুদ্ধে একটি আপীল দায়ের করেছেন। অন্যদিকে ব্যারিষ্টার আমীর-উল ইসলামের পরিচালনায় নিম্ন লিখিত বন্দীদের রীট পিটিশনগুলো দায়ের হতে যাচ্ছে -

            নাম                                         পিতার নাম                                       
১। জ্যোতি চাকমা                                  পূর্ণ কুমার চাকমা                                   
২। চন্দ্র কমল চাকমা                               রঞ্জন মোহন চাকমা                               
৩। নতুন বিকাশ চাকমা                            মন কুমার চাকমা                                    
৪। নিস্কৃতি চাকমা                                   মৃত সত্য বান চাকমা                               
৫। রবি চন্দ্র চাকমা                                 দীন বন্ধু চাকমা                                     
৬। রাংগাবরন চাকমা                               চন্দ্র সেন চাকমা                                    
৭। জয় কেতু চাকমা                               চন্দ্র মোহন চাকমা                                   
 ৮। ললিত কুমার চাকমা                           রয়স্যা চাকমা                                        
৯। অমলেন্দু চাকমা                                 আশাপূর্ণ চাকমা                                     
১০। আশাপূর্ণ চাকমা                               রোহিনী কান্ত চাকমা                             
১১। বিকাশ চাকমা                                 সুয়ামনি চাকমা                                           
১২। লাল কুমার চাকমা                             অক্ষয় রাজ চাকমা                                
১৩। জিতেন্দ্র চাকমা                                ললিত মোহন চাকমা                               
১৪। আনন্দ বিকাশ চাকমা                          দয়াময় চাকমা                                     
১৫। সভা নন্দ চাকমা                               মনায়া চাকমা                                        
১৬। মং থোয়াই মারমা                        পংহলা প্রু মারমা (ডি,সি, রাঙ্গামাটি-কে ৬ সপ্তাহের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে।)

উপরোক্ত খ্যাতিমান আইনজীবী টুলু, সুজন ও আরাইচি মারমার দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধেও আপীল করবেন। উল্লেখ্য তিনি ৬ জন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নেতার বিরুদ্ধে দায়ের কৃত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার বৈধতা নিয়ে মহামান্য হাই কোর্টে Quashing মামলা করেন। উক্ত মামলার রায়ে বলা হয় “পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ৫ দফা দাবী স এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক দাবী।” ছাত্র নেতাদের অবিলম্বে মুক্তি দানের নির্দেশ দেয়া হয়। ছাত্র নেতারা ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছেন।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় হতে এ পর্যন্ত ৮১ জন পাহাড়ি বন্দীর আটকের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে বিচার প্রার্থনা করা হয়েছে বা হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে ৩৯ জনের রায় বেরিয়েছে। এই সব কয় জনের আটক অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং যাদের অন্য কোন মামলা নেই তারা মুক্তি পেয়েছেন।
সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে মহামান্য হাইকোর্ট পাহাড়ি গণ পরিষদের অর্থ সম্পাদক মিঃ মনতোষ দেওয়ানকে জামিনে মুক্তি দানের নির্দেশ দিয়েছেন।
                                                                             -রাডারের নিজস্ব প্রতিবেদক



----------------------------------
চা ল চি ত্র

----------------------------


এই অন্যায় মেনে নিয়েই বাঁচতে হবে
গত ২৯ শে এপ্রিল ’৯২ খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি সাহেব ডলফিন চেয়ার কোচে করে প্রায় ৮০,০০০ টাকা মূল্যের সেগুন কাঠের আসবাবপত্র পাচার করছিলেন।
এজন্য গাড়িটাকে বনবিভাগের কর্মচারীদের পাওনা (ঘুষ) মেটাবার জন্য প্রত্যেক বনবিভাগের চেকপোষ্টে অন্ততঃ ১৫/২০ মিনিট করে থামতে হচ্ছিল। এতে বিরক্ত হয়ে জনৈক যাত্রী অন্যান্যদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “দেখেন তো পুলিশের কাছ থেকে বনবিভাগের লোকেরা ঘুষ খায়।” এই কথা সহ্য করতে না পেরে একই বাসের যাত্রী খাগড়াছড়ির ডিজিএফআই -এর জনৈক মেজর হান্নান বললেন, “এটা (ঘুষ) সব জায়গায় আছে। আপনারা পুলিশ হলে আপনারাও তাই করবেন।”
তার এই কথায় একজন সাংবাদিক, যিনি লোগাং পদযাত্রায় অংশ গ্রহণ শেষে ফিরছিলেন, প্রতিবাদ করে বললেন, “পুলিশের চাকরী করলে এ রকম হতে হবে এমন কোন আইন আছে নাকি?” অতঃপর মেজর সাহেব বলেন, “এসব অন্যায় চিরন্তন। এই অন্যায়গুলো মেনে নিয়েই বাঁচতে হবে।” তখন সাংবাদিক বন্ধুটি তাকে প্রশ্ন করলেন, “সেজন্য বুঝি আপনারা পাহাড়িদের ওপর এমন অন্যায় অত্যাচার চালাচ্ছেন?” এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া ঐ মেজরের সাধ্য ছিল না। তাই তিনি চুপ করে রইলেন।

আশ্চার্য্য ধরনের সম্মান প্রদর্শন এবং অহেতুক জিজ্ঞাসাবাদ
বর্তমানে নানিয়ারচর জোন হেডকোয়াটার অতিক্রম করার সময় কারো মাথায় ছাতা থাকলে তা নামাতে হয়। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ সবকিছু অগ্রাহ্য করে জনসাধারণকে জোন কমা-ার লেঃ কর্ণেল আবদুল ওয়াহাব -এর এই অদ্ভুদ নির্দেশ পালন করতে হচ্ছে। এ ছাড়া রাস্তার সেন্ট্রি পোষ্টে কর্তব্যরত আর,পি সদস্যরা মহিলাদেরকে থামিয়ে অযথা হয়রানিমূলক ও অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

ক্যাপ্টেন মকিমের আদেশ
বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের খারিক্ষং ক্যাম্পের কমা-র ক্যাপ্টেন মকিম (৮ম ইষ্ট বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর) নানিয়ারচর জোন। তিনি বন্দুক ভাঙ্গার জনসাধারণের প্রতি একটি মৌখিক আইন জারি করেন যে, কেউ বাজার থেকে ১০ সেরের অতিরিক্ত চাউল কিনতে পারবে না। বিগত ৬/৫/৯২ইং রোজ বুধবার বাজার থেকে আধা সের চাউল বেশী কিনার জন্য চন্দ্র দেব চাকমা, পীং ভগবান চাকমা, গ্রামঃ- ত্রিপুরা ছড়া -কে পথিমধ্যে ক্যাপ্টেন মকিম কান ধরে ১০০ বার উঠা বসা করান এবং সমস্ত চাউল বাজেয়াপ্ত করেন।

গৌতম বাবুর অভ্যর্থনা
বিগত ৮ই মে ’৯২ তারিখ বিকাল ৪ ঘটিকায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান ট্রাইবেল আদামস্থ “পিপল্স ক্লাব” উদ্বোধন করতে গেলে স্থানীয় ছাত্র যুবকরা সম্পূর্ণ নতুন এক নিয়মে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। তারা “গৌতমের চামড়া তুলে দেবো আমরা”, “পার্বত্য জেলা পরিষদ মানি না, মানব না” বলে শ্লোগান দেয়। এতে গৌতম বাবু দারুনভাবে অপমানিত হন। কিন্তু তবুও তিনি দালালী কায়দায় নির্লজ্জভাবে মুচকি হেসে অভ্যর্থনা গ্রহণ করেন। গৌতম বাবুর এই নির্লজ্জতা রাঙ্গামাটি শহরে দারুণ হাসির খোরাক যুগিয়েছে।

সমীরনের GIVE &TAKE ফর্মূলা
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সমীরন দেওয়ান একটি অভিনব ফর্মূলা বের করেছেন। এর নাম  "GIVE & TAKE" ফর্মূলা। অর্থা জেলা পরিষদের অধীনে কারো যদি সমীরন দেওয়ানের দস্তখতে কিছু মেওয়া ফলে তাহলে তার একটি আনুপাতিক অংশ সমীরনকে দিতে হবে। এব্যাপারে সমীরনের বক্তব্য নাকি এরকম - তাকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বানানোর আগে তিনি বেশ কয়েকটি নির্বাচনে হেরে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কাজেই এই ফর্মূলার মাধ্যমে তিনি তার ঘাটতি পূরন করতে চান। জানা গেছে যে, মৃত শিক্ষকের পেনশনের টাকা উঠাতেও তিনি এই ফর্মূলা খাটাতে চেয়েছেন।

গৌতমের জনপ্রিয়তা লাভের কৌশল
গৌতম জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য বাজারে একটা গুজব ছড়িয়ে দিয়েছেন, গুজবটা হলো কোন এক সাদা পোষাকধারী (যাকে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন ডি.জি.এফ.আই -এর লোক) লোক নাকি তার বেড রুমে একটি বোমা রাখার জন্য তার বাড়ির কাজের মেয়েকে প্ররোচিত করেছেন- ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) টাকার বিনিময়ে। কিন্তু কাজের মেয়েটি রাজী না হওয়াতে ঐ সাদা পোষাকধারীর অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই গুজব বাজারে ছড়িয়ে গৌতম বুঝাতে চাচ্ছেন যে তার ধারণা এতে তার প্রতি পাবলিকের কিছু সহানুভূতি জন্মাবে। তাকেও সরকার ভালো চোখে দেখছেন না। কিন্তু তার এই বানোয়াট গুজবে কেউ কান দেয়নি।

খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম উধাও
খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে প্রেরিত সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মের সমস্ত কপি বাজারে বেরুবার আগেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। ক্রেতারা দোকানে গেলে প্রিয় প্রজন্ম পায় না। কারণ খোঁজা খোঁজির পর জানা গেলো যে সমস্ত কপিই এখন ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ অগ্রিম কিনে নেয়। তার কারণ কি ? জানা গেছে, বর্তমান সংখ্যা গুলোতে ধারাবাহিকভাবে CHT কমিশনের Report "Life is not Ours" এর দ্বিতীয় সংস্করণের অনুবাদ, এবং লোগাং গণহত্যা সম্পর্কিত খবরাখবর পরিবেশিত হচ্ছে। তাই হিল এর পাঠকরা যাতে এ সম্পর্কে জানতে না পারে তারই ব্যবস্থা হিসাবেই সব কপিই কিনে নেয়া হচ্ছে।

শশী কান্তির মতলব
শশী কান্তি তালুকদার নামক এক ব্যক্তিকে ইদানিং মাঠে এবং ক্যান্টনমেন্টে প্রায়শঃ দেখা যাচ্ছে। তাকে দেখা যায় সাইফুল ইসলাম দিলদার নামক জনৈক ব্যক্তির সাথে তিনি মানবাধিকারের ধ্বজা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু পাহাড়ি জাতিসত্ত্বা সমূহের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা চিরস্থায়ী করার পক্ষপাতী।) তাকে আরো দেখা যায় ক্যান্টনমেন্টের কর্তাদের সাথে। জানা গেছে তার মতলব নাকি আগামীতে খাগড়াছড়ি সমীরন দেওয়ানের পদটি দখল করা। আর এজন্যে সে এখন থেকেই সেনাকর্তাদের লেজুরগিরি করা শুরু করে দিয়েছে।

পদ ত্যাগ তো নয় .......... বরং .........
ইতিপূর্বে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান লোক দেখানো তথাকথিত দশ দফা দাবী জানিয়ে সরকারকে দাবী পূরনের সময়সীমা হিসেবে ৩১ শে ডিসেম্বর স্থির করে দিয়েছিলেন এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে দাবী পূরন না হলে পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছিলেন। সরকার তাদের দাবীর প্রতি কর্ণপাত করেনি এবং চেয়ারম্যানরাও পদত্যাগ করেনি। বরং গত ২২ ও ২৩ শে এপ্রিল বান্দরবানে তিন চেয়ারম্যান মিলিত হয়ে আবার লোক দেখানো ১২ দফা দাবী পেশ করে জেলা পরিষদের মেয়াদ ৩ বছর থেকে ৫ বছর করার দাবী জানায়। তিন চেয়ারম্যানের এই স্ববিরোধীতায় রসিক জনেরা মন্তব্য করেছেন, “দালালরা গদিতে থাকার জন্য আবার বিড়ালের মত মিউ মিউ শুরু করছে।”

আমাদের ব্যাপারে কথা বললে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়া হবে
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িতে সমাবেশ হবে প্রচার হলে লেপ্টেনেন্ট, ক্যাপ্টেন ধরনের সামরিক কর্তাব্যক্তিরা নেতাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাকদের শাসিয়ে আসেন, “আপনাদের ছেলেরা আমাদের ব্যাপারে কথা বললে তাদের ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়া হবে এবং আপনাদের চাকুরী থাকবে না।” অবস্থা বিশেষে তারা আবার ছেলেদেরকে সমাবেশে যোগদান থেকে বিরত রাখার জন্যও হুমকি দিয়ে আসেন।

বাজার করতে গিয়েই পাইকারীভাবে পুকুরে সাতার কাটতে হলো
রাঙ্গামাটি জেলাধীন কাউখালি উপজেলার বাসিন্দারা কাউখালি বাজারের দিনে সবাই বিভিন্ন মাল পত্র নিয়ে বাজারে যায়। কিন্তু তাদের আর বাজার করতে হল না। কাউখালি এলাকার সম্রাট এবং ১৮ ইষ্ট বেঙ্গল ও কাউখালি ক্যাম্পের মেজর তারেক আহম্মেদ সেদিন বাজারে পদধুলি দেন এবং বিভিন্ন পাহাড়ি গ্রাম থেকে আসা পাহাড়িদেরকে একস্থানে জড়ো করেন। তারপর বলেন, “তোমরা সবাই শান্তিবাহিনীকে চাঁদা দাও এবং বাজার সরবরাহ কর। এই প্রমাণ আমার আছে।” তাই শাস্তি স্বরূপ বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা নারী পুরুষ সবাইকে পার্শ্ববতী পুকুরে সাতার কাটতে হলো। এবং সাতার কাটা শেষে জানিয়ে দেওয়া হলো ক্যাম্পের অর্ডার ছাড়া গাছ বাঁশ কাটা ও বাজার থেকে জিনিসপত্র কেনা যাবে না।

ভবিষ্যতে তোমাদেরকে রক্ষা করা আমাদের সম্ভব হবে না
গত ৫/৫/৯২ তারিখে খাগড়াছড়ি বাজারের বাজার দিন ছিল। স্বাভাবিক নিয়মে সেদিনও হরিনাথ পাড়া ও রাঙাপানি ছড়া গ্রামের লোকজন বাজারের দিকে আসছিলেন। কিন্তু এ,পি, ব্যাট্যালিয়ন ক্যাম্পের সম্মুখে ব্যাট্যালিয়ন কমা-ার সবাইকে গেটের সম্মুখে জড়ো করে এবং সবাইয়ের উদ্দেশ্যে ব্যাট্যালিয়ন কমা-ার বলেন কোন কারণে যদি একজন অনুপ্রবেশকারী বাঙালি ভবিষ্যতে মারা যায়, তাহলে তোমাদেরকে রক্ষা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এই হুশিয়ারী উচ্চারণ করে কমা-ারের বক্তব্য শেষ হয়।

“আপনাকে হারিয়ে দিতে ম্যাডামের কিছুই যায় আসে না” - লেঃ কর্ণেল গোমেজ
অনেকটা দেরীতে হলেও গত ১৩ই মে প্রধানমন্ত্রী ১০ই এপ্রিল লোগাং -এ সংঘটিত বর্বরোচিত গণহত্যার ঘটনাস্থল দেখতে যান। ঐ দিন তিনি খাগড়াছড়িতে নবনির্মিত জেলা পরিষদ ভবন উদ্বোধন এবং এক বিশাল সমাবেশে বক্তব্য দান করেন। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে ভাষণ দিতে খাগড়াছড়ি স্থানীয় সরকার পরিষদ চেয়ারম্যান মিঃ সমীরন দেওয়ান মাইক্রোফোনের সম্মুখে যেতেই সমবেত শ্রোতারা জুতো দেখিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং জেলা পরিষদ বাতিল সহ সমীরন দেওয়ানের বিরুদ্ধে ধ্বনি তোলে। এর পরই প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতে গেলে তাকে শুভেচ্ছা স্বাগতম শ্লোগান দিয়ে অভিনন্দন জানায় উপস্থিত জনতা। কিন্তু যেই মুহুর্তে তিনি জেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করার কথা বলেন সে মুহুর্তেই শত শত ছাত্র জনতা সমাবেশ থেকে বেরিয়ে আসে এবং জেলা পরিষদ বাতিলের শ্লোগান দেয়। ভাষণ মঞ্চে গিয়ে সমবেত সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপিও প্রদান করেন জনৈক স্থানীয় এক নেতা।
উক্ত স্থানীয় নেতাকে পরবর্তীতে তলব করেন জোনাল কমা-ার লেঃ কর্ণেল জন গোমেজ। গোমেজ সাহেব ভদ্রভাবে উক্ত ব্যক্তিকে সতর্ক করিয়ে দেন এবং বলেন, ভারতে শরনার্থী হয়ে কি লাভ ? আমরা ঐ সমস্ত খালী জায়গায় বাঙালি পুনর্বাসন করবো। আপনি কম ঘোরাফেরা করবেন। আপনাকে মেরে ফেললে খালেদা জিয়ার কিছুই আসে না।”

লোগাং হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে লণ্ডনে বিক্ষোভ
লোগাং হত্যাকা- ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রতিবাদে সম্প্রতি বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ (যুক্তরাজ্য শাখা) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন সারভাইভেল ইন্টারন্যাশনাল, পার্বত্য চট্টগ্রাম ইনফরমেশন ও ক্যাম্পেইন কমিটি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দুতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে। সংগঠনগুলো বিক্ষোভ শেষে পৃথকভাবে বাংলাদেশ হাই কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে।
ঐক্য পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল লিবারেল ডেমোক্রেট দলীয় পরিবেশ বিষয়ক মুখপাত্র সাইমন হিউস এমপি’র সঙ্গেও সাক্ষাত করেন।সৌজন্যে - দৈনিক সংবাদ/২৭-৫-৯২ইং 
----------------------


----------------------------------------------------------------------
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমূহ বিপদ সংকেত
বেপরোয়া বন ধ্বংস ও পরিবেশ দুষণের চক্রান্ত রুখো
চাই চিরহরি বনাঞ্চল ঢাকা ছায়া সুনিবিড় নির্মল পরিবেশ

নির্বিচার বৃক্ষ ও বন নিধন, কলকারখানা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং বিবিধ বর্জ্য, গ্যাস পৃথিবীকে করছে ক্রমশঃ বিষাক্ত। নিয়ত ভারসাম্য হারিয়ে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। উত্তপ্ত হয়ে আসছে ভূ-ম-ল। বন্যা, খরা, জলোচ্ছাস আঘাত হানছে বার বার। চরম সংকটাপন্ন আমাদের জীবনের অস্তিত্ব, বিপন্ন আমাদের এই প্রিয় ধরিত্রী।
তাই পরিবেশ রক্ষায় আজ সারা বিশ্বে তোলপাড় আন্দোলন শুরু হয়েছে।

৩রা জুন ব্রাজিলে শুরু হয়েছে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন বিশ্ব সম্মেলন।

৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস।

পার্বত্য চিরহরি বনাঞ্চলে আজ আগুন জ্বলছে। এ আগুন সেনা সন্ত্রাসের।

গাছ কেটে উজার করছে অসাধু ব্যবসায়ী আর প্রশাসনের আমলা লুটেরা বাহিনী সবুজ আবরণ নখর সামরিক আক্রমণে উপড়ে যাচ্ছে।

পরিবেশ নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।

এর বিরুদ্ধে সোচ্চার জনমত গড়ে তুলুন। নিজে গাছ লাগান এবং অন্যকে লাগাতে উসাহিত করুন। আমাদের প্রিয়তম পৃথিবীতে আগামী প্রজন্মের নির্মল জীবন নিশ্চিত করুন।

হিল লিটারেচার ফোরাম
------------------------------------------------------------------------------


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন