পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৭ জুন, ২০১৮

স্যাটেলাইট


* বইটির পিডিএফ কপি পেতে ক্লিক করুন এখানে


স্যাটেলাইট

সম্পাদকীয় নোট:
হিল লিটারেচার ফোরামের পুরাতন প্রকাশনা স্যাটেলাইট আপলোড করা হলো। এটির একটি মাত্র সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালের ৬ অক্টোবর, ফোরামের আগেকার প্রকাশনা রাডার নিষিদ্ধ হওয়ার পর।
স্যাটেলাইট এর এই একটি সংখ্যা প্রকাশের পরই সরকার তার পরবর্তী সকল সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয়। ফলে এই নামে আর ফোরাম প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারেনি।

এই সংখ্যার লেখাগুলোর মধ্যে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে। একটি হলো ‘স্বায়ত্তশাসন মনে কি বিচ্ছিন্নতাবাদ?’ দ্বিতীয়টি ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠন: উচ্ছেদ নীতির এক নতুন কৌশল’। এছাড়া দৈনিক ভোরের কাগজ থেকে পুনঃমুদ্রিত সলিমুল্লাহ খানের ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সমাধান প্রসঙ্গে’ লেখাটি এখনও তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। এই নিবন্ধে তিনি ‘গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ  জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ নীতির ভিত্তিতে’  পাহাড়ি জাতিগুলোর সাথে বাঙালি জাতির ‘সম্পর্ক পাতার’ আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘১৯৭২ সনে শেখ মুজিবের কাছে মানবেন্দ্র লারমা যে চারটি মূল দাবি তুলে ধরেছিলেন সেগুলি স্বীকার করে নেয়াই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে এক সময় শাসকগোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে অপপ্রচার চালিয়েছিল। তাদের সেই বক্তব্য খণ্ডন করতেই ‘স্বায়ত্তশাসন মানে কি বিচ্ছিন্নতাবাদ?’ প্রবন্ধটি লেখা হয়। অপরদিকে তকালীন বিএনপি সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামে সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনের সিদ্দান্তকে জনগণের আন্দোলনের প্রেক্ষিত থেকে বিচার করা হয়েছে।

আশাকরি আজকের দিনের পাঠকরা স্যাটেলাইট পড়ে ৯০ দশকের আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবেন। ধন্যবাদ।



স্যাটেলাইট
১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা ৬ অক্টোবর’৯২
হিল লিটারেচার ফোরাম-এর একটি রাজনৈতিক প্রকাশনা

সূচিপত্র:
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও প্রাসঙ্গিক কথা
৭১ দিন কারাবাস এবং ৬ জনের একটি মূল্যায়ন
স্বায়ত্তশাসন মানে কি বিচ্ছিন্নতাবাদ?
সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনঃ উচ্ছেদ নীতির এক নতুন কৌশল
.................................

হতভাগ্য অমর কান্তির আর সন্তানের মুখ দেখা হলো না।
অমর কান্তি চাকমা দিঘীনালা উপজেলার বাঘাইছড়ি নোয়া পাড়া গ্রামের একজন দিন মজুর। সারা দিনের পরিশ্রমের বিনিময়ে দু-বেলা আহার যোগাচ্ছিলেন তার পরিবার পরিজনকে। যেদিন শ্রম দিতে পারবেন না, সেদিন না খেয়ে থাকতে হতো তাদের। এত কিছু আর্থিক টানাপোড়েনের পরও একটি সুখের সংসার গড়ে তোলার জন্য সেই অনাগত দিনের অপেক্ষায় অপেক্ষমান।

সে দিন ছিল ১৫ জুন ৯২। অমরকান্তি ও তার স্ত্রী বহুদিনের প্রতিক্ষিত সন্তান লাভ করবে। সেদিন সকাল থেকে অমরের স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হয়। এই অসহ্য যন্ত্রনার মাঝেও তারা উভয়েই খুশীতে গদগদ। কারণ আজই তারা এক ফুটফুটে সন্তান লাভ করবে। এত দিনের দুঃখ বেদনাকে ভূলে গিয়ে গড়ে তুলবে নতুন স্বপ্নের সংসার।

কিন্তু অমরের সেই স্বপ্নময় দিনগুলো তছনছ করে দেয় সেনাবাহিনী নামক নর-দানবরা। সেদিন সকাল আটটায় নোয়া পাড়া অদূরে সংঘর্ষ হয় শান্তিবাহিনীর সাথে সেনা বাহিনীর। এতে একজন সেনা সদস্য আহত হয় বলে জানা যায়। এই সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীর মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। পূর্বলব্দ অভিজ্ঞতা থেকে তার পরিণাম কি হতে পারে আঁচ করতে পেরে যে যেদিকে পারে পালিয়ে সেনা দানবের রোষানল থেকে প্রাণ বাঁচাতে সচেষ্ট। কিন্তু হতভাগ্য অমরকান্তি পালিয়ে যেতে পারলে না তার প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীকে রেখে। তাই অদৃষ্ট ভাগ্যের উপর নির্ভর করে স্ত্রীর পাশে বসে মিথ্যা সান্তনা দিচ্ছিলেন। ঠিক তখনই বাবু ছড়া জোনের জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল শাহাব উদ্দীন-এর নেতৃত্বে একদল সেনা দানব নিরস্ত্র অসহায় অমর কান্তির উপর ঝাপিয়ে পড়ে। প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীর সম্মুখে নির্মমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করলো। প্রসব বেদনায় কাতর ও দুর্বল স্ত্রী, স্বামীর এই করুণ পরিণতিতে কোন প্রতিবাদ করতে পারল না। দানবীয় হিং¯্রতার নীরব স্বাক্ষী অমরের স্ত্রী। কিন্তু সে দিন যে মানব শিশুটির জন্ম তাকে কি জবাব দেবে বিধবা মা ? পিতার রক্তের উপর যে শিশুটির জন্ম তার রক্তের দাগ কি মুছতে পারবে সেই শিশুটি ? নিশ্চয় পারবে। এবং পারতেই হবে। কারণ এমনি করে হাজারো শিশু বাপ, মায়ের রক্তের উপর জন্ম নিচ্ছে পার্বত্যকোলে, বাপ মায়ের রক্তের চিহ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছে বর্তমান ও আগামী দিনের প্রজন্ম। তাই বাপ মায়ের এই রক্তের প্রতিশোধ তাদের নিতে হবে। এবং নিতে বাধ্য। যেহেতু ইতিহাস তাদের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। তাই তারা এই ঐতিহাসিক দায়িত্বকে সামনে রেখে বেড়ে উঠবে প্রতিদিন। অপরিমেয় শক্তি বুকে ধারণ করে পার্বত্য এলাকার সকল অন্যায় অত্যাচারের কালো হাত ভেঙ্গে দিয়ে পাহাড়ি জনগণের হারিয়ে যাওয়া রক্তিম সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনবে। আমরাও সেই দিনটির অপেক্ষায়।
.....................


পৃষ্ঠা: ০২

ঘটনা প্রবাহ

প্রেস ক্লাবে নারী-সমাবেশ
গণআদালতের রায় বাস্তবায়ন এবং দেশের উপর্যুপুরি-সন্ত্রাস ও নারী-নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৫, সেপ্টেম্বর-’৯২ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বাংলদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জনপ্রিয় টি,ভি অভিনেত্রীরা বক্তব্য রাখেন। তারা অবিলম্বে গো, আযমের ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য সরকারকে আহ্বান জানান। এবং এর পক্ষে সকল নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন
১৭/৯/৯২ইং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক মিলনায়তনে গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের ১ম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের ১ম পর্যায়ে সভাপতি মন্ডলীর পক্ষ থেকে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি বেলাল চৌধুরী সভাটি পরিচালনা করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি নূর আহম্মেদ বকুল। গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ) এর সভাপতি মোখলেসুর রহমান মুক্তাদী। তিন ধাপে বিভক্ত করে অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ হয়। পরবর্তী কর্মসূচী হিসেবে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

মাও সেতুঙের ১৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন
গত ৯, সেপ্টেম্বর’৯২ বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণীর মহান নেতা এবং আধুনিক চীনের জনক কমঃ মাও সেতুং এর ১৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী টি, এস, সি সড়কে দ্বীপে পালিত হয়। কমঃ মাও সেতুং মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপন কমিটি কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন, গণ সংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ ম,নূরন্নবী। সভায় আলোচনা করেন, ডঃ সাইদুর রহমান, প্রখ্যাত লেখক আব্দুল মতিন খান, কমঃ হামিদুল হক সহ ছাত্র ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ, আলোচনার পূর্বে একটি বর্নাঢ্য মিশিল টি, এস, সি থেকে শুরু করে শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে এবং আলোচনার শেষে গণশিল্পী দলের একটি বিপ্লবী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উপহার দেয়া হয়।

পাহাড়ি ছাত্র-পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলার কাউন্সিল
১১ই সেপ্টেম্বর’৯২ইং শুক্রবার পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার বার্ষিক কাউন্সিল খাগড়াছড়ি টাউন হলে বোধি প্রিয় চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সারাদিন বৃষ্টির মাঝেও বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ছিল। বিভিন্ন শাখা কমিটির প্রতিনিধি এ কাউন্সিলে যোগ দেয়। সকাল নয়টায় জাতীয় সঙ্গীত ও দলীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অধিবেশন শুরু হয়। অতিথি হিসেবে পাহাড়ি গণপরিষদের পক্ষ থেকে সৌখিন চাকমা এবং কিরণ মারমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সভাপতি বিশ্বজি চাকমা, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা, সাধারণ সম্পাদক করুণাময় চাকমা এবং সাংঠনিক সম্পাদক কে এস মং উপস্থিত ছিলেন। ক্যাজরী মারমাকে সভাপতি, প্রদীপন খীসাকে সাধারণ সম্পাদক, রূপক চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক, বিজয়া খীসাকে মহিলা সম্পাদিকা নিযুক্ত করে ১৫ সদস্য সদস্যা বিশিষ্ট কমিটি নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলাশাখা গঠন করা হয়। নব নির্বাচিত কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা। অধিবেশনে বক্তাগণ জনগণকে হয়রানি করে যারা সদস্যাকে জিইয়ে রাখতে চাই, বিভিন্ন অপপ্রচারে যারা লিপ্ত, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ভাবমূর্তি যারা নষ্ট করছে তাদের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। এবং “স্বায়ত্ত শাসনই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান” বলে তুলে ধরেন। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝেও দুপুর বারটায় র‌্যালির মধ্য দিয়ে ১ম অধিবেশন সমাপ্ত হয়।
২য় অধিবেশন শুরু হয় বিকেল চারটায় খবং পুড়িয়া গ্রামে। উক্ত অধিবেশন পানছড়ি থানা কমিটির পক্ষে অনিমেষ চাকমা, রাঙ্গুনিয়া কলেজ শাখার পক্ষে দীাপ্ত শংকর চাকমা, ফেনী পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট শাখার পক্ষে পূর্ণ বিকাশ চাকমা, মহালছড়ি থানা শাখার পক্ষে দেবব্রত চাকমা এবং রাঙ্গামাটি কলেজ শাখার পক্ষে বোধিসত্ব চাকমা বক্তব্য রাখেন। বিভিন্ন কমিটির প্রতিনিধিদের বক্তব্যের শেষে নব নির্বাচিত সভাপতি ক্যাজরী মারমা খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সঠিক ও বলিষ্ট নেতৃত্ব দানের লক্ষ্যে সকলের সহযোগিতা কামনা করে বক্তব্য রাখেন। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা শাখা কমিটির বিভিন্ন কার্যক্রম এবং কলাকৌশল সম্পর্কে অবহিত করান। পরিশেষে অনুষ্ঠানের সভাপতি বোধি প্রিয় চাকমার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অধিবেশন সমাপ্ত হয়।
...............

পৃষ্ঠা: ০৩


সম্পাদক                 : মিঃ সুপ্রিয়
নির্বাহী সম্পাদক        : মিঃ মানবমিত্র
প্রধান প্রতিবেদক         : মিঃ সৌরভ সিজেল
সার্কুলেশন ম্যানেজার    : মিঃ পল্লব
অংকন                    : রসদ
শিল্প নির্দেশনা          : ধীবর

যোগাযোগ (বার্তা ও চিঠি)      : ৩২০ পূর্ব বাড়ী, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


স্যাটেলাইট

সম্পাদকের ডেস্ক থেকে

সুপ্রিয় পাঠক
আমাদের সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও উঞ্চ অভিনন্দন গ্রহণ করুন। পার্বত্য আকাশে বহু বছর ধরে বিরাজ করছে এক অশুভ কীট। প্রত্যেক জুম্ম জনগণকে আক্রান্ত করছে এই অশুভ কীটের বিষাক্ত লেলিহান শিখা। তাই আর কাল ক্ষেপণ নয়। আসুন, নির্মুল করে ফেলি এই অশুভ কীটকে। আবার আঘাত করা হলো ‘রাডার’কে। সেই ৭৪-এর স্বৈরাচারী কালো আইন ৯৯ (ক) ধারা দিয়ে। রাডারের উপর এই স্বৈরাচারী আক্রমণ, শুধু হিল লিটারেচার ফোরামের নয়, গোটা জুম্ম জনগণের প্রতি বাদী কন্ঠকে স্তব্ধ করা হলো। আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি।      

“হিল লিটারেচার ফোরাম” মনে করে একটি প্রকাশনাকে বন্ধ করে দিয়ে জুম্ম জনগণের কন্ঠকে কখনো স্তব্ধ করা যাবে না। একটি ‘রাডার’ বন্ধ করে দিয়ে জুম্ম জনগণের প্রতিবাদের ভিতকে কখনো গলা টিপে হত্যা করা যাবে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে পার্বত্য জনগণসহ দেশের সচেতন মহলের মতামত প্রকাশের মঞ্চ হিসেবে হিল লিটারেচার ফোরামের উদ্যেগে ‘স্যাটেলাইট’ প্রকাশ করা হলো।

‘স্যাটেলাইট’-এর সম্পাদনা, প্রকাশ, মতামত ইত্যাদির ব্যাপারে হিল লিটারেচার ফোরামের কোন দায় দায়িত্ব নেই। এই প্রকাশনা সকল নিপীড়িত ও গণতন্ত্রকামী জনগণের। তাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন।

‘হিল লিটারেচার ফোরাম’-এর পক্ষে স্যাটেলাইট প্রকাশনা কমিটি ও সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত
.......................


পৃষ্ঠা: ০৪ - ০৫


নিষিদ্ধ সংবাদ

[কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের যুগেও জনগণের ওপর ধর্ষণ,গুম, শারিরীক নির্যাতন, গ্রেফতার, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ, জমি বেদখল, গ্রেফতার, জোরপূর্বক উচ্ছেদ ইত্যাদি এখনও নিত্যদিনের ঘটনা। অথচ এই সব সংবাদ সমূহ একটি বিশেষ গোষ্ঠীর অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণে এদেশের সংবাদ মাধ্যমে আদৌ প্রচারিত হতে পারছে না। ফলে এদেশের প্রকৃত গণতন্ত্রকামী শান্তিপ্রিয় জনগণ জানতে পারে না পার্বত্য চট্টগ্রামে কি ঘটছে। আমরা এই কলামে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সব অপ্রকাশিত সংবাদ সমূহ ছাপানোর আয়োজন করেছি।]

ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হলে বাঁশের বর্শা নিক্ষেপ
মাটিরাঙ্গা, ২৭ শে জুলাই’৯২। মাটিরাঙ্গা উপজেলার সাপমারা ক্যাম্পের অধীন রোড প্রটেকশানরত ৪ জন আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্য ব্যাঙমারা গ্রামের বাসিন্দা মিসেস প্রমিলা ত্রিপুরাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলে একটা সূচালো বাঁশের বর্শা ছুঁড়ে মারে। এতে প্রমিলার পেটে আঘাত লাগে। চীকার শুনে নিকটবর্তী “জুম” কর্মরত স্বামী খগেন্দ্র ত্রিপুরা প্রমিলাকে দেখতে আসলে আনসার সদস্যরা তাকে ঘিরে ধরে। পরে খগেন্দ্রকে চল্লিশ টাকা দিয়ে কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি করে বলে যে, ঘটনাটি প্রকাশ হলে তাকে প্রাণে মারা হবে।’

সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণ ও নির্যাতন
মাটিরাঙ্গা, ১৮ জুন ’৯২ গুইমারা জোন হেড কোয়ার্টারের মেজর শহীদ-এর নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য গভীর রাতে দেওয়ান পাড়া নামক গ্রামে নিরীহ ঘুমন্ত গ্রামবাসীদের ওপর পাইকারীভাবে শারিরীক নির্যাতন ও ধর্ষণ চালায়। এতে অনেকে আহত হয়। জানা যায়, এক অসুস্থ শান্তিবাহিনী এই গ্রামে চিকিসা করছে বলে মিথ্যা সংবাদ পেয়ে অথবা নিজেরাই সংবাদ বানিয়ে সেনা জোয়ানরা উক্ত মারমা গ্রামে হানা দেয়। শান্তি বাহিনীর কোন হদিস না পেলে নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর এই নাটকীয় অত্যাচার চলে। উক্ত ঘটানায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা হচ্ছেন, (১) মিসেস ক্রইক্রো মারমা স্বামী মংথোয়াই মারমা (২) মিসেস ক্রাঞো মারমা স্বামী মংসা মারমা (৩) মিসেস অংক্রোমা মারমা স্বামী উগ্য মারমা (৪) মিসেস ক্রয়ঞো মারমা স্বামী উলা মারমা (৫) মিসেস ঐইঞা মারমা স্বামী পাইপ্রু মারমা (৬) মিসেস নাইবাই মারমা স্বামী মংহলাগ্য মারমা।
যাদেরকে মারধর করা হয়েছে তারা হলেন, মিঃ পাইপ্রু মারমা পীং রিগ্য মারমা, মিঃ সংঘা মারমা পীং কংজপ্রু মারমা ও চাইলা প্রু মারমা পীং মতুল্যে মারমা।
উল্লেখ্য, সাংঘাতিক দৈহিক নির্যাতন ও ধর্ষণের ফলে আট মাসের গর্ভবর্তী ক্রাইঞো মারমার গর্ভপাত ঘটে।

কুতবছড়িতে চার ব্যক্তি প্রহৃত
রাঙ্গামাটি সদর, ১১ জুন ’৯২। কৃঞ্চমা ছড়া গ্রাম থেকে কুতুবছড়ি বাজারে যাওয়ার সময় সেন্ট্রি পোষ্টে কর্মরত ঘিলাছড়ি ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর আহসান চার ব্যক্তিকে নির্মমভাবে মারধর করে। এরা হলেন, সমর বিজয় চাকমা (১৭) পীং ঈশান চন্দ্র চাকমা -১ম বর্ষ রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজ, অভিলাষ চাকমা (২৩) পীং গজেন্দ্রলাল চাকমা, প্রিয় রঞ্জন চাকমা (৩৫) পীং চিকন মোহন চাকমা এবং শান্তিময় চাকমা (৩২) পীং অজ্ঞাত।
উল্লেখ্য উক্ত চার ব্যক্তির বাড়ীতে শান্তিবাহিনী আসে কিনা মেজর আহসানের এই প্রশ্নের ‘না’ জবাব মিললে এই শারিরীক নির্যাতন চালানো হয়।

চার রাখাল প্রহৃত
রাঙ্গামাটি, ৩ জুলাই, ১৯৯২। কুতুবছড়ি আর্মি ক্যাম্পের আনসার (১৮ বেঙ্গল) আইয়ুব আলী কুতুব ছড়ি গ্রামের চার রাখালকে মারধর ও দেড় ঘন্টা যাবত বৃষ্টিতে ভিজিয়ে রাখে। এরা হলেন, পলমুনি চাকমা (১৩) পীং সোনাধন চাকমা, বুদ্ধ চাকমা (১১) পীং নয়ন ধন চাকমা, লক্ষীচন্দ্র চাকমা পীং বড় চোগা চাকমা এবং বুজুরুক্যা চাকমা চাকমা (৯) পীং পুন্যবান চাকমা।
জানা যায়, ঐদিন মাঠে গরু চড়াতে গেলে হামিদ টিলার সেন্ট্রি পোষ্টে কর্তব্যরত আনসার সদস্য আইয়ুব আলী উক্ত চার রাখাল বালকের কাছ থেকে ছাতাগুলো কেড়ে নেয় এবং দৈহিক নির্যাতন চালায়।
উল্লেখ্য, হাস্যকর হলেও সত্য, পার্বত্য এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা তথাকথিত সেন্ট্রি পোষ্টের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছাতা মাথায় দিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ।

সেনা বাহিনীর কাছ থেকে ছুটি না নেয়ায় স্কুল শিক্ষক প্রহৃত
বরকল, ১২ জুলাই ’৯২। সেনা ক্যাম্প কমান্ডারের কাছ থেকে ছুটি না নেয়ার অপরাধে বৈরাগী পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিঃ দুলাল বড়–য়াকে অমানুষিকভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মিঃ দুলাল কান্তি বড়–য়া বিধি মোতাবেক সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ী যান।  ছুটি শেষে যথাসময়ে কাজে যোগদান করতে এলে ক্যাপ্টেন খালেক তাঁকে ক্যাম্পে তলব করেন এবং সেনা ক্যাম্প থেকে অনুমতি না নিয়ে  ছুটিতে যাওয়ার কারণ জানতে চান। দুলাল বাবু যথার্থ উত্তর দিলে ক্যাপ্টেন সাহেব ক্ষেপে যান এবং শারিরীক নির্যাতন চালান। এই  নির্যাতনের খবর যাতে প্রকাশ না হয় সেজন্য জনাব ক্যাপ্টেন দুলালকে হুঁশিয়ার করে দেন।

শান্তিবাহিনী হামলার প্রতিশোধ: নিরীহ গ্রামবাসী প্রহৃত
নানিয়াচর, ২৯ জুন ’৯২। নানিয়াচর জোন হেড কোয়ার্টার থেকে (১৮ইঃ বেঙ্গল) ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে একটি দল চেঙ্গী নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত ফিরিঙ্গি পাড়া ও শন খোলা আদামে এক অপারেশনে যায় এবং উক্ত গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে নির্বিচারে অমানুষিকভাবে শারীরিক নির্যাতন চালায়। যুবতী মেয়েদেরকে পৃথক করে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ঐদিন নানিয়াচর উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট মাইল দূরে মহালছড়ি সড়কের এক টহলদারী চৌকিতে শান্তি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে উক্ত গ্রামদ্বয়ের নিরীহ জুম্ম জনসাধারণকে বর্বর অত্যাচার করা হয় বলে জানা গেছে।
ঘটনার পর উক্ত এলাকার আশেপাশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। জনমনে প্রচ- ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই অবস্থা বুঝে এক পর্যায়ে গত ৬/৭/৯২ ইং নানিয়াচর জোন কমান্ডার লেঃ কঃ ওয়াহাব ঘটনার শিকার চন্দ্রধর চাকমাকে ক্যাম্পে ডেকে উক্ত বর্বর ঘটনার জন্য সমবেদনা জ্ঞাপন করে ও ক্ষমা প্রার্থনা করে।

কুখ্যাত ক্যাপ্তেন শাকালীন কর্তৃক এলাকাবাসী প্রহৃত
নানিয়াচর, ৫জুলাই ’৯২ ইং। নানিয়াচর জোনের ক্যাপ্টেন কুখ্যাত শাকালীন (৪০ বেঙ্গল) তার দলবল নিয়ে মরাচেঙ্গী ও পশ্চিম জগনাতলী গ্রামে হানা দেয় এবং একজন মহিলাসহ পাঁচ ব্যক্তিকে সাংঘাতিকভাবে প্রহার করে। সেনা সন্ত্রাসীরা তল্লাশী করার নামে বাড়ীতে ঢুকে জিনিসপত্র ছত্রভঙ্গ ও ভাঙ্গচুর করে দেয়। এ সময় তারা এলাকায় এক ভয়ানক অরাজকতা সৃষ্টি করে।
উক্ত হামলায় প্রহৃত ব্যক্তিরা হলেন, মরাচেঙ্গী গ্রামের মনি শান্তি তালুকদার (২০) পীং দীনেশ চন্দ্র তালুকদার, জ্যোতি বিকাশ চাকমা (৩০) পীং সুবিশাল চাকমা, নতুন বিকাশ চাকমা (১৮) পীং বাত্যা চাকমা ও বাজা চাকমা (৪০) পীং কৈলাশ চাকমা। এছাড়া পশ্চিম জগনাতলী গ্রামের সোনাপুদি মা’র (৩৫) বাড়ীতে কোন পুরুষ না পেলে তাকে মারধর করা হয়। জানা যায়, সেনাসন্ত্রাসীরা উক্ত গ্রামে শান্তিবাহিনী খোঁজার নামে বাড়ী তল্লাশী করে এবং খুঁজে না পেলে নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়।

কমান্ডারের ডাক শুনতে না পাওয়ায় নির্যাতনের শিকার এক ছাত্র
নানিয়াচর, ১২ জুন ’৯২ ইং। জনৈক সেনা কমান্ডারের ডাক শুনতে না পাওয়ায় এক কিশোর ছাত্রকে বেদম প্রহার করা হয়েছে। ঐদিন শ্রক্রমণি চাকমা, ষেলঅ চাকমা নামে এক ছাত্র বাজার থেকে ফিরছিল। রাস্তার পাশে সেনা চৌকিতে প্রহরারত ক্যাপ্টেন জায়েদ তাকে তার কাছে যাওয়ার জন্য ডাক দেয়। শুক্রমণি প্রথমে ঠাহর করতে পারেনি তাকে ডাকা হচ্ছে। দ্বিতীয় ডাক শোনার পর চৌকিতে গেলে ক্যাপ্টেন বাহাদুর সাথে সাথে তাকে পার্শ্চবর্তী বড় মহা পুরুম নদীদে ডুবিয়ে রাখেন প্রথম ডাক না শোনার অপরাধে। এরপর শুক্রমনিকে ছেড়ে দেয় হয়। কিন্তু নির্যাতন নাটকের যেন শেষ হয় না। ঐ ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে কিছুদুর গিয়ে তার এক প্রতিবেশী মিঃ বীর কুমার চাকমার সাথে দেখা হয়। তার কাছে সে ক্যাপ্টেন সাহেবের অত্যাচারের কথা বলে। এই কথা নিকটবর্তী আর একটা চৌকিতে প্রচরারত জনৈক সৈনিক শুনতে পেলে বীর কুমার সহ দু’জনকে ধরে কতুবছড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এরপর সেখানে তাদের দ’জনকে বিনা কারণে বিভিন্ন কায়দায় শারিরীক নির্যাতন চালানো হয়। সারারাত অত্যাচারের পরদিন সকালে ছেড়ে দেয়া হয়।

সেনাবাহিনী কর্তৃক লুটপাট ৬ ব্যক্তি গ্রেফতার
নানিয়াচর, ১৫ জুন ’৯২ইং। নানিয়াচর জোনের অধীন (ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন) বুড়ি ঘাট আর্মি ক্যাম্পের জনৈক ক্যাপ্টেন মহিম-এর নেতৃত্বে এক দল সেনা সদস্য পশ্চিম হাতিমারা গ্রামে এক অপারেশনে গেলে শান্তিবাহিনীর সহযোগী সন্দেহে নিরীহ গ্রাম বাসীকে নির্বিচারে মারধর করা হয় এবং মূল্যবান জিনিষপত্র লুট করা হয়।
সেনা জোয়ানরা ফেরার সময় ছয়জনকে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা সকলে পশ্চিম হাতিমারা গ্রামের বাসিন্দা। এরা হলেন, গালা চাকমা (৩৮) পীং অমৃত লাল চাকমা, বৃষকেতু চাকমা (২৮) পীং দীন মোহন চাকমা, কিরন বিকাশ চাকমা (৩৫) পীং মৃত বিনয় কৃঞ্চ চাকমা, রবি চান চাকমা (৭৫) পীং অজ্ঞাত এবং দীন মোহন চাকমা (৭) পীং অজ্ঞাত।
গ্রেফতার কৃত ব্যক্তিদেরকে ৭ দিন ক্যাম্পে রাখার পর ছেড়ে দেয়া হয়।
এছাড়া সেনা সদস্যরা দীন মোহন চাকমার স্বর্ণনির্মিত দুই জোড়া কানের দুল ও চার হাজার টাকা, অমৃত লাল চাকমার পাঁচ হাজার টাকা এবং কিরণ বিকাশ চাকমার একটি তিন ব্যান্ডের রেডিও ও দুই হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
গ্রন্থনাঃ মানবমিত্র ও পল্লব
........................


পৃষ্ঠা: ০৬ - ০৭


স্বায়ত্তশাসন মানে কি বিচ্ছিন্নতাবাদ?
মিঃ সুরেশ

এদেশের শাসকগোষ্ঠী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৃহদাংশের একটি রোগ আছে। জলাতংক আক্রান্ত রোগীর মত এরা ‘স্বায়ত্তশাসন’ শব্দটা শুনলেই যেন ভয়ে আঁতকে ওঠেন। এই রোগ সংক্রামক এবং এই রোগের বিস্তারের কারণ যতটা না “স্বায়ত্তশাসন” কথার অর্থ বুঝে, তার চাইতে বেশী সরকারী প্রচার যন্ত্রের বিরামহীন ও অক্লান্ত অপপ্রচারের ফলে। এই “স্বায়ত্তশাসনাতংককে” দুই বসর আগের ঢোল কলমী পোকার আতংক’ এর সাথেও তুলনা করা যেতে পারে। ঢোল কলমী পোকার মধ্যে কোন বিষ না থাকা সত্ত্বেও গুজব প্রচারের ফলে অনেকের সরল মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, ঢোল কলমী পোকার মধ্যে বিষ রয়েছে এবং এই পোকা ছুঁলে বিষক্রিয়া হয়ে মানুষ মারা যায়। কেবল এই বিশ্বাসের ফলেই কেহ কেহ মারা গিয়েছিল সেবার। গুজব ও অপপ্রচারণার এমনই মহিমা! অবশ্য গুজব ও অপপ্রচারণা অনেকের কাছে সুস্বাদুও বটে।   

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবী ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও শাসক গোষ্ঠীর অব্যাহত হীন স্বার্থযুক্ত অপপ্রচারণার ফলে বিভ্রান্তির শিকার হয়ে অনেকের এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, ‘স্বায়ত্তশাসন’ মানেই বিচ্ছিন্নতাবাদ। স্বায়ত্তশাসন মানেই ‘স্বাধীনতা’ ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি ইত্যাদি, ইত্যাদি। এর ফলে যারা লাভবান হচ্ছে তারা হচ্ছে এদেশের মুষ্টিমেয় লুটপাটকারী গোষ্ঠী। এরা স্বায়ত্তশাসনের প্রকৃত অর্থকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’, ‘সন্ত্রাসবাদ, ‘স্বাধীনতা বিরোধী’, ‘সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখ-তার প্রতি হুমকি’- ইত্যাদি শব্দ জালের মাধ্যমে আড়াল করে পার্বত্য চট্টগ্রামে একচেটিয়া লুটপাট, শোষণ ও অরাজকতার রাজত্ব কায়েম করেছে এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে অথবা তথাকথিত উন্নয়নের নামে জনগণের কোটি কোটি টাকা হাতরে নিয়েছে।       

‘স্বায়ত্তশাসন’ শব্দটা অনেককে আতংকগ্রস্ত করার আরো একটা কারণ আছে। কেউ এটা স্বীকার করেন। তবে বেশীর ভাগই চাপা রাখতে ভালোবাসেন। এই আতংকিত হওয়ার কারণটা হচ্ছে এই যে, বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসনের দাবী যেভাবে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে পরিণতি লাভ করেছিল, পাহাড়ি জনগণের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীও হয়ত সেরূপ হতে পারে। তাই ভয়। পাহাড়ি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবী সম্পর্কে যাদের এই রকম অযৌক্তিক ভীতি রয়েছে তাদের এই ভয় সারাতে এদেশেরই স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। খেয়াল রাখা উচিত, স্বায়ত্তশাসন প্রদানে তকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বারংবার অস্বীকৃতিই বাঙালি জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কাজেই এর থেকে শিক্ষা নেয়া বিশেষ প্রয়োজন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবী সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ভীতি ও বিভ্রান্তি থাকলেও এই ব্যাপারে সবাই একমত যে, পাহাড়ি জনগণের আলাদা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা ও সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধন করা রাষ্ট্রের একটি জরুরী কর্তব্য। আমরা এই সাধারণ ঐক্যমত থেকে যাত্রা শুরু করতে পারি। বস্তুতঃ কোন কিছুর রক্ষা ও সংরক্ষণের কথা অথবা দাবী তখনই আসে যখন তার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি থাকে। এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রজাতির কথাও উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সহ দশ ভিন্ন ভাষা ভাষী পাহাড়ি জাতি গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর হুমকি আসার কারণেই এই সংস্কৃতির সংরক্ষণের কথা উঠেছে। পাহাড়ি জাতিসত্ত্বা সমূহের সংস্কৃতি তাদের নিজস্ব জাতিগত অস্তিত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের অস্তিত্ব না থাকলে তার স্বকীয় সংস্কৃতি বেঁচে থাকতে পারে না। এ জন্যই সংস্কৃতির প্রতি হুমকি মানেই  জাতীয় অস্তিত্বের হুমকি। তাই জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের অধিকার না দিয়ে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের স্বকীয় সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশ সাধন করা কখনোই সম্ভব নয়।

এখন দেখা যাক, পাহাড়ি জনগণের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর হুমকি সমূহ কী কী। অথবা অন্য ভাষায় বলতে গেলে পাহাড়ি সংস্কৃতির বিকাশে বাঁধা কোথায়? কোন প্রকার তত্ত্বালোচনায় না গিয়ে এক কথায় বলা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতিই পাহাড়ি জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব, স্বকীয়তা ও সংস্কৃতির ওপর চরম হুমকি। আরো সহজভাবে বলতে গেলে, মোটা দাগে যেসব বিষয়গুলো পাহাড়ি সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করা যায় সেগুলো হচ্ছে-(১) পাহাড়িদের ভূমি বেদখল (২) ব্যাপক হারে বাঙালি বসতি স্থাপন (৩) জন জীবনের সর্বত্র সামরিক নিয়ন্ত্রণ (৪) মূল স্রোতধারায় আনয়নের নামে পাহাড়ি সংস্কৃতির বাঙালীকরণ প্রচেষ্টা। এসব বিষয়গুলো একটির সাথে অপরটি এমন গভীরভাবে সম্পর্কিত যে একটি বিষয়ের ওপর আলোচনায় অপরটির কথা অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে। এদের পরস্পর শর্তযুক্ত উপস্থিতিই এর কারণ।           

পাহাড়ি জনসত্ত্বার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও পরিবেশের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এই মাটি ও পরিবেশই এখানকার মানুষের নিজস্ব জীবনধারা, আচার, প্রথা, রীতি, অভ্যাস, মূল্যবোধ ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। তাই স্বকীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ, লালন-পালন ও বিকাশ সাধনের জন্য প্রয়োজন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ওপর পাহাড়ি জনগণের অবাধ অধিকার। ১৯০০ সালের "Chittagong Hill Tracts Regulation"-এ পাহাড়ি জনগণের এই অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসনামল থেকেই এই অধিকার ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করে দেয়া হয়। তদুপরি এর পাশাপাশি ১৯৬০ সাল থেকেই পাহাড়ি জনগণকে তথাকথিত শিল্পায়নের নামে বনায়ন কিংবা উন্নয়নের নামে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হতে থাকে। ফলে পাহাড়ি জনগণ ভূমির ওপর তাদের অধিকার হারায়। স্বাধীনতার পর সরকারী উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি পুনর্বাসনের ফলে এই ভূমি বেদখলের মাত্রা আরো অনেক গুণ বেড়ে গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন ৫০৯৩ বর্গমাইল। সমগ্র বাংলাদেশের এক দশমাংশ। আয়তনের এই বিশালত্ব সত্ত্বেও পর্বতময় ভৌগলিক অবস্থার কারণে জনধারণ ক্ষমতা এখানে খুবই কম। প্রতি বর্গমাইল হিসাবে দেশের অন্যত্র যত লোক বাস করে, অনুপাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জমির পরিমাণ দিয়ে হিসেব করলে দেখা যাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখ্যার ঘনত্ব সমতলের চাইতে কোন অংশে কম নয়। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জমির পরিমাণ ৩২,৫৯,৫২০ একর হলেও নেট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ হচ্ছে মাত্র ১,৩০,০০০ একর। এর মধ্যে কাপ্তাই বাঁধের ফলে ৫৪,০০০ একর বা মোট আবাদী জমির ৪০% পানির নীচে ডুবে যায়। বাড়তি চাষযোগ্য জমির অপ্রতুলতার কারণে কাপ্তাই বাঁধের ফলে উদ্ভাস্তু এক লক্ষের মধ্যে ৬০ হাজার পাহাড়ি ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। বাকীদের জন্য কোন রকমের ২০,০০০ একর চাষযোগ্য জমির ব্যবস্থা করা হয়। এই হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট আবাদী জমির পরিমাণ হচ্ছে মাত্র ৯৬,০০০ একর। অর্থা মাথাপিছু জমির পরিমাণ হচ্ছে মাত্র .১৩৭ একর (শুধুমাত্র পাহাড়ি)।      

কাজেই দেখা যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ এতই কম যে পাহাড়িদের জন্যও তা অপ্রতুল। এজন্য সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সমতল এলাকা থেকে চার লক্ষাধিক অপাহাড়িকে অনুপ্রবেশ ঘটানোর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমাহীন সমস্যা সংকটের জন্ম দিয়েছে। সরকার বলপ্রয়োগ করে পাহাড়িদের তাদের জায়গা জমি থেকে উচ্ছেদ করছে এবং সেসব জায়গায় নতুন অপাহাড়িদের বসতিস্থাপন করাচ্ছে। এই বাঙালি বসতি স্থাপনের অনিবার্য পরিণামই হচ্ছে পাহাড়ি উচ্ছেদ। ফিলিস্তিনীদের জায়গায় যেমন ইহুদি পুনর্বাসন যতই বৃদ্ধি পায়, ফিলিস্তিনীদের উদ্বাস্তুর সংখ্যাও তত বেশী বৃদ্ধি পেতে থাকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায়ও ঠিক তাই ঘটেছে। বাঙালি পুনর্বাসনের ফলে পাহাড়িদের হাজার হাজার একর জমি বাঙালিদের হাতে চলে যাচ্ছে। এর ফলে একই সাথে বিপন্ন হচ্ছে পাহাড়ি সংস্কৃতি তথা জাতীয় অস্তিত্ব। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পাকিস্তান শাসনামলে যেভাবে শুধুমাত্র প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা যেতো, বর্তমানে নানা অবস্থার কারণে সেভাবে আর সম্ভব নয়। এখন এই প্রশাসনিক ক্ষমতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে সামরিক ক্ষমতা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশাল সামরিক উপস্থিতি ও প্রশাসন সহ জন জীবনের সর্বত্র সামরিক নিয়ন্ত্রণ তাই বাঙালি বসতি স্থাপনের সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। কাজে দেখা যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সমস্যার মূল উস হচ্ছে ভূমি। ভূমি অধিকার না দিয়ে পাহাড়ি জনগণের অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি রক্ষা কখনো সম্ভব নয়। অন্য কথায় পাহাড়ি জাতিসত্তার জাতীয় অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করতে হলে অবশ্যই ভূমি অধিকার দিতে হবে। এ ছাড়া কোন বিকল্প নেই। তাই অপাহাড়িদের দ্বারা বেদখলকৃত জমি ফিরিয়ে দিয়ে ভূমির ওপর পাহাড়িদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে দরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অপাহাড়িদের প্রত্যাহার করা। অপাহাড়িদের ফিরিয়ে এনে সমতল এলাকায় পুর্নবাসন করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশাল সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির প্রয়োজন হবে না এবং তার ফলে প্রতিদিন এই উপস্থিতির জন্য যে দেড় কোটি টাকা খরচ হয় তাও বেঁচে যাবে।

ভূমি অধিকার জাতীয় স্বকীয়তা ও সংস্কৃতি রক্ষা সহ নিজেদের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পাহাড়িদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন আঞ্চলিক কিছু ক্ষমতা। এর নামই স্বায়ত্তশাসন। দেশের ভেতরে সংখ্যালঘু বিভিন্ন জাতিসত্তার জাতীয় অস্তিÍত্ব সংরক্ষণ করার জন্যই এই স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘুরা স্বায়ত্ত্বশাসনর ভোগ করে। এখানে বিচ্ছিন্নতার কোন গন্ধ নেই। নেই স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখন্ডতার প্রতি হুমকি। স্বৈরাচারি এরশাদ সরকার তথাকথিত জেলা পরিষদকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান এবং “স্বায়ত্তশাসন” হিসাবে প্রচার করেছিল। এই প্রচারণার ফলে লেঃ জেঃ এরশাদ প্রকারান্তরে পাহাড়ি জনগণের স্বায়ত্তশাসনকেই এভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যদিও তার এই জেলা পরিষদ একটি রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বায়ত্তশাসনের পরিধি বিভিন্ন রকমের হতে পারে। তবে তা সব সময়ই একটি দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে। তাই স্বায়ত্তশাসনকে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখ-তার পরিপন্থি বলে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের এই অপপ্রচারণা পাহাড়ি জনগণকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়ারই সামিল।
...................


পৃষ্ঠা: ০৮


“দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাস” প্রেক্ষিত মূল্যায়নঃ
পারদর্শী

প্রতিদিন যে হারে সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে তাতে মনে হয়, সন্ত্রাস যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পুরো সমাজ দেহ যেন একটি সন্ত্রাসীদের কারখানা হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে সমাজদেহ হয়ে উঠবে বসবাসের অযোগ্য। প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসের কবলে ঢলে পড়ছে তাজা প্রাণ। অকাল মৃত্যু এখন আর যেন অবৈধ ও ঘৃণ্য নহে। রতন সেনের মত একজন প্রবীন রাজনীতিককে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে দিনের দুপুরে পুলিশ কর্মকর্তার সামনে। তাঁর রক্তের দাগ কাটতে না কাটতে গুলিবিদ্ধ হলেন সমসাময়িক বাংলাদেশের তুখোর রাজনীতিবিদ এবং সংসদের বিরোধী দলের অন্যতম নেতা ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক জন নেতা রাশেদ খান মেনন। এছাড়াও প্রতি দিন খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় একটা না একটা মৃত্যু সংবাদ। মারামারি, হানাহানি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে বৈ কমছে না। দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসের দুর্গে। অনির্দিষ্টকালের নোটিশে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক শিক্ষাঙ্গন। যার ফলে বিঘিœত হচ্ছে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন। পিতা-মাতার আদরের সন্তান লাশ হয়ে ফিরছে মায়ের কোলে। যার ফলে উচ্চ শিক্ষার প্রতি পিতা-মাতার অনীহা বেড়ে যাচ্ছে। জাতীয় জীবন পরিণত হচ্ছে পঙ্গুত্বে। সমাজের এ চিত্র অবলোকন করলে মনে হয় দেশে কোন সরকার নেই অথবা থাকলে সন্ত্রাস দমনে তার কোন ক্ষমতা নেই। সরকার নিজেই দোষ ঢাকবার চেষ্টা করছে। কিন্তুু এভাবে সন্ত্রাস দমন কোনমতে সম্ভব না। সন্ত্রাসের পিছনে সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদ থাকাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের ট্যাক্সে পালিত এই বাহিনী জনগণের যান মালের নিরাপত্তা দিতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে কার স্বার্থে এই বাহিনীকে নিয়োজিত রাখা হয়েছে ? কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে তারা ? জনগণের না জনগণের শত্রুদের? আর জনগণের শত্রুদের স্বার্থে যদি তারা কাজ করে থাকে তাহলে জনগণ তাদের লালন-পালনের ভার নেবে কেন ? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে হবে জনগণকে।

অবশ্য খালেদা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে চলেছে একের পর এক। অতি সম্প্রতি NAM (Nonalien movement)-এ যাবার প্রাক্কালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিরীহ ছাত্র প্রাণ হারানোর পর খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, তাঁর সরকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু তিনি ওখান থেকে ফিরে আসার পূর্বে একই ধরনের সংঘর্ষে সূর্যসেন হলে আরও দ’জন ছাত্র প্রাণ হারান। এ ঘটনার পর তিনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিল ঘোষণা করেছেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছেন। হলে হলে তল্লাসী করেছেন। রেডিও-টিভিতে ঘোষণা দিয়ে সন্ত্রাসীদের নাম ঠিকানা পুলিশ জমা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তুু তেমন ফল পাওয়া যায়নি। এরপরও প্রতিদিন জীবন হানি ঘটেছে। এর শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কারোর মন্তব্য করা দুঃসাধ্য।

এখন দেখা যাক, কারা সন্ত্রাস করছে অথবা একে মদদ দিচ্ছে এবং কি কারণে তারা তা করছে। এ যাব সংঘটিত সন্ত্রাসের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রধানতঃ দুটি কারণেই সন্ত্রাস হচ্ছে। প্রথমতঃ অর্থনৈতিক কারণে দ্বিতীয়তঃ রাজনৈতিক কারণে। এ দু’য়ের অর্থনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য লুটেরা শ্রেণী রাজনীতির লেবাস পড়ে অসচেতন জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছে। কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদের লেবাস পড়ে এবং কেউবা ধর্মীয় মৌলবাদের লেবাস পড়ে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করছে, সবার মূল লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। জনগণের উন্নয়ন বা দেশের উন্নন তাদের মূল লক্ষ্য নয়। উন্নয়নের নামে বিদেশী প্রভুদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য অথবা ঋণ এনে কল কাঠি নাড়িয়ে নিজের পকেট গরম করা। নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করা। পরিণতিতে জনগণের উন্নয়ন তো দুরের কথা কে কত বেশী পাবে তা নিয়ে হিংসা হানাহানি লেগেই রয়েছে। আর এ অবস্থায় সন্ত্রাস হতে বাধ্য। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে। কে, কার সন্ত্রাস দমন কিংবা নির্মূল করবে ? সন্ত্রাসের শিকড় এদের মধ্যে গ্রথিত। সন্ত্রাসের মূলোপাটন করতে গেলেই সবার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

বাংলাদেশের মাটি থেকে সন্ত্রাসকে নির্মূল করতে হলে সন্ত্রাসের উস মূল কোথায় গ্রথিত রয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। মুখে সবাই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার কন্ঠস্বর। কিন্তুু বাস্তবে তারা কি সন্ত্রাস দমন করতে পারবে ? আসলেই এই সন্ত্রাস সমাজের বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এদের জাল সমাজের গভীরে ছড়িয়ে আছে। এরা একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীটি সমাজের শিকড় গেড়ে বসেছে। এদের কেউ শাসক শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে আর কেউ শাসক শ্রেণীর বাইরে। তবে তারা যেখানে যেভাবে থাকুক না কেন তাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ আঁতাত রয়েছে। আসলে এই শ্রেণীটি দেশের পুরো সম্পদকে লুটেপুটে খাচ্ছে। দেশে একটি লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে। এই লুটপাটের উপসর্গ হিসেবে দেখা দিচ্ছে সন্ত্রাস, হিংসা হানাহানি, মারামারি, দলাদলি। আর এর কুফল ভোগ করছে দেশের সরল প্রাণ কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ। এই লুটপাটে যে যত বেশী শক্তিশালী এবং পারদর্শী তারাই আজ বাংলাদেশের অধিপতি। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের হাতের পুতুল। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের করায়ত্বে। যার ফলে এই বাহিনীর নাকের ডগায় খুন হচ্ছে প্রকৃত দেশ প্রেমিক ও সমাজ সেবকরা। দেশের এ অবস্থায় সরকার শুধু রেফারীর ভূমিকা পালন করতেছে। গালভরা বুলি আওড়িয়ে জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছে। কাজেই সন্ত্রাসকে নির্মূল করতে হলে এই সন্ত্রাসকারী শ্রেণীকে চিরতরে নির্মূল করা জরুরী। আর এদেরকে নির্মূল করতে হলে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। নিজে বেঁচে থাকার জন্য এবং সমাজকে সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নিপীড়িত ও নির্যাতিত মেহনতি জনগণকে লৌহ কঠিন দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণের ঐক্যদ্ধ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শোষক শ্রেণীকে পরাস্ত করে সন্ত্রাসের মূলোপাটন সম্ভব। ক্ষমতায় আসতে হবে জনগণের প্রকৃত বন্ধুদেরকে। অন্যথায় সন্ত্রাস নির্মূল করা কোন মতে সম্ভব না।
.......................

পৃষ্ঠা: ০৯ - ১০


সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠন: উচ্ছেদ-নীতির এক নতুন কৌশল
মিঃ মানবমিত্র

ভূমিকাঃ
সরকার সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্ত জুম্ম জনগণকে নতুনভাবে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ষড়যন্ত্র বুঝতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যেকটি সরকার ধারাবাহিকভাবে যে জুম্ম উচ্ছেদ নীতি কার্যকর করে আসছে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

জুম্ম উচ্ছেদ-নীতির ধারাবাহিক ইতিহাসঃ
পানছড়িতে এক জনসভায় ২৬ শে মে ১৯৭৯ইং তকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও রাঙ্গামাটি জেলার জেলা প্রশাসক আলী হায়দার খান পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সরকারের বীভস নীতি বেমালুম ফাঁস করে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন, ÒWe want only the land, not the people of the chittagong Hill tracts." এটাই হচ্ছে তকালীন পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের প্রত্যেক শাসক গোষ্ঠীর পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সকল নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর মর্ম কথা। সেজন্য দেখা যায় স্বাধীনতা পূর্ব এবং স্বাধীনতা উত্তর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিভিন্ন সরকারের আবির্ভাব ঘটলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে মৌলিক নীতির কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জুম্ম উচ্ছেদ অভিযানের নীতি শুরু হয়। এর পর প্রত্যেক সরকার বিভিন্নভাবে সেই নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছেন মাত্র। এই জুম্ম উচ্ছেদ নীতির বাস্তবায়ন হয় কখনো উন্নয়নের নামে কখনো জুম্ম জনগণকে তথাকথিত জাতীয় মূল স্রােতধারায় আনয়নের নামে। আবার কখনো বাঙালি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে কিংবা গণহত্যার পর গণহত্যা ঘটিয়ে, অথবা অব্যাহত সেনা সন্ত্রাস জারী রেখে পার্বত্য এলাকাকে বসবাসের অনুপযোগী করে এই জঘন্য জুম্ম উচ্ছেদ নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক কাপ্তাই বাঁধের ফলে ৫৪ হাজার আবাদী জমি ডুবে যায়। ৬০ হাজার লোক সর্বস্বান্ত হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

স্বাধীনতার পর জুম্ম উচ্ছেদের জন্য একের পর এক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে থাকে। প্রথমে তথাকথিত বিচ্ছিন্নতার গন্ধ পেয়ে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ত্ব ও জাতীয় অখন্ডতা রক্ষার নামে ক্যান্টনম্যান্টের পর ক্যান্টনম্যান্ট সৃষ্টি করা হয়। সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিণত হয় এক বিশাল সেনানিবাসে। এরপর রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে সমতল এলাকা থেকে বে-আইনীভাবে বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। তাদেরকে ব্যবহার করে জুম্ম উচ্ছেদ নীতি বাস্তবায়ন করা হয়। তকালীন জিয়া সরকারের শাসনামলে ১৯৮০ সালের কলমপতি গণহত্যা থেকে আজ পর্যন্ত ১৪/১৫ টি বড় বড় লোমহর্ষক গণহত্যা সংঘটিত হয়। যার ফলে হাজার হাজার জুম্ম তাদের জায়গায় জমি থেকে উখাত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ফেনী ভ্যালীতে যেখানে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত জুম্ম জনসংখ্যা ছিল ৯০ ভাগ, এখন কোন জুম্ম-এর অস্তিত্ত্ব নেই বললেই চলে। সব জায়গা-জমি এখন সেনাবাহিনীর সাহায্যে গণহত্যা চালিয়ে জুম্মদের উচ্ছেদ করে বেদখল করে নেয়া হয়েছে।

জুম্মদেরকে নিজেদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করার আরো একটা জঘন্য কৌশল হচ্ছে ভিয়েতনামে মার্কিন নির্মিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আদলে তথাকথিত গুচ্ছগ্রাম, শান্তিগ্রাম, যৌথ খামার নামক বন্দীশালা গঠন। যুগ যুগ ধরে বাস করা জায়গা জমি থেকে জোরপূর্বক বন্দুকের নলের মুখে উচ্ছেদ করে এই সব বন্দী শিবিরে স্থানান্তর করা হয়। গণহত্যার মাধ্যমে উচ্ছেদ করলে দেশের ও বিশ্বের গণতন্ত্রকামী, শান্তি প্রিয় ও মানবতাবাদী শক্তির সমালোচনা ও চাপের সম্মুখীন হতে হয়। সরকার এই অসুবিধা কাটানোর জন্য গুচ্ছ গ্রাম, শান্তি গ্রাম নামক এইসব মিষ্টি মধুর শব্দের আড়ালে জনগণকে উচ্ছেদ করে বন্দীকরণের কৌশল অবলম্বন করেছে।

বনায়ন: জুম্ম উচ্ছেদের নতুন কৌশলঃ
জুম্ম জনগণের অব্যাহত প্রচারণার ফরে বিশ্ববাসীর কাছে এই তথাকথিত গুচ্ছগ্রাম নামক বন্দী শিবিরের আসল রূপ উন্মোচিত হয়। ফলতঃ বর্তমান এই কৌশল দিয়ে সরকারের পক্ষে জুম্ম উচ্ছেদ নীতি কার্যকর করা আর কোন ক্রমেই সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই সে এখন আবার নতুন কৌশল নিয়ে নতুনভাবে আবির্ভাব হয়েছে। এই নতুন কৌশলের নামই হচ্ছে উন্নয়ন মার্কা যুক্ত তথাকথিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠন।

স্বাভাবিকভাবে বিশ্বব্যাপী পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার আন্দোলনের যুগে সরকারের এই তথাকথিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্তকে স মনে হতে পারে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যে কত অস এবং ধোঁকাবাজি পূর্ণ তা নিম্নোক্ত আলোচানা থেকে পরিস্কার বোঝা সম্ভব হবে।

কুপ্রভাবঃ
সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাঙ্গামাটিতে ছয়টি থানার অধীন ৩৫ টি মৌজার ৭৬ হাজারের অধিক একর, খাগড়াছড়িতে ৪টি থানার ৩৭,৩৮৭.৫ একর এবং বান্দরবানে ৭,৩৮৯,২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনজীবন ও পরিবেশের ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

প্রথমতঃ এর ফলে উক্ত এলাকাসমূহের অধিবাসী কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার পরিবার উচ্ছেদ হবে। কারণ এসব এলাকার অধিকাংশ পরিবারের জমির ওপর কোন মালিকানা স্বত্ত্ব নেই (প্রয়োজন নেই বলে)। তারা মূলতঃ জীবিকার জন্য বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। আবাদী জমির অভাবে অনেককে জুম চাষের ওপরও নির্ভর করতে হয়। সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠন করা হলে এরাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উল্লেখ্য, এদের অধিকাংশই ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে একবার জায়গা জমি হারিয়ে উচ্ছেদ হয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ উচ্ছেদ হওয়ার পর এ অঞ্চলের জুম্ম জনসাধারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে। জমিসহ সম্পদের ওপর আরো প্রবলভাবে চাপ পড়বে। এর ফলে জমি সংক্রান্ত বিরোধ প্রবল আকার ধারণ করতে বাধ্য।

তৃতীয়তঃ সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠন করা হলে পার্শ্ববর্তী ভারতে দেশান্তরী হতে বাধ্য হবে। কারণ উদ্বাস্তুদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে settle করার মতো আবাদী জমি এবং শিল্প কারখানা নেই।

চতুর্থতঃ এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষ বাড়বে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

পঞ্চমতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে এর ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। কারণ উদ্বাস্তু হওয়ার পর এই এলাকার জনসাধারণ যে এলাকায় যাবে সেগুলি ইতিমধ্যে জনবহুল। তাছাড়া এসব অঞ্চলে আরো ব্যাপকভাবে জুম চাষ করতে তারা বাধ্য হবে। যার পরিবেশগত প্রভাব হবে মারাত্মক।

তাই প্রতিরোধঃ
সরকারের এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়েছে। মিটিং, বিক্ষোভ, সমাবেশ চলছে। বিভিন্ন সংগঠন এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনের বিরোধীতা করে বিবৃতি দিয়েছে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গত ১২ইং আগষ্ট এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে ঢাকায় মিছিল ও সমাবেশ করেছে। তারা বনমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল-নোমানের কাছেও একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছে।

কারা বন ধ্বংসকারীঃ
দুর্নীতি পরায়ন সরকারী বন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মুনাফালোভী অস অসাধু ব্যবসায়ীদের যৌথ উদ্যোগে অবৈধভাবে অব্যাহত বন উজারের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ইতিমধ্যেই বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই বন উজারে সেনাবাহিনীর ভূমিকাও কম নয়। তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি বা সেনা সন্ত্রাসের জন্য তাদেরকেও যথেষ্ট সবুজ বন সাফ করে ফেলতে হয়। রাস্তার দু’ধারে গাছপালা, ঝোপঝাড় এবং ক্যাম্পের চারপাশের আধ মাইল ব্যাসার্ধের বন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নিয়মে সাবাড় হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে অনেক সেনা কর্মকর্তা কাঠ ব্যবসায়ী বনে যান। লাইসেন্স পারমিটের ওপর নিয়ন্ত্রণ করেও দু’পাইস কামাই হয়।

ইতিমধ্যেই পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্টঃ
এইভাবে অব্যাহত বন ধ্বংসের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিমধ্যেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে পড়েছে। পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। নদীর স্রােতের সাথে বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া মাটি সঞ্চালনের ফলে কাপ্তাই হ্রদটি ইতিমধ্যেই ভরাট হয়ে যেতে বসেছে। যার ফলে কাপ্তাই জল বিদ্যু প্রকল্পে বিদ্যুপাদনের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। বনাঞ্চল উজার হওয়ার ফলে অন্যান্য বন্য প্রাণীর অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। মানিকছড়ি ও গুইমারা এলাকায় বন্য হাতির উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। গত জুন/জুলাই মাসে তাদের আক্রমনে ১২ জন নিহত হয়েছে। বন্য হাতিরা তাদের আবাস বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলেই ক্ষেপে উঠেছে। তাদের সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে নিরীহ লোকদের ওপর।

জনগণ দায় নেবে কেনঃ
নিরীহ জুম্ম জনগণ, যারা প্রকৃতির মতোই নিরীহ এবং যারা বন ধ্বংসের মাঝে কোন ক্রমেই জড়িত নয়, তারা কেন দায় নেবে। তারা কেন উচ্ছেদ হবে নিজ আবাস স্থল থেকে ? বন ধ্বংসকারী অসাধু ব্যবসায়ী বন কর্মকর্তা ও অস সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বনাঞ্চল গঠন করে জুম্ম উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র সরকারের কিসের লক্ষণ বহন করে?

প্রস্তাবনাঃ
যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করেন অথবা যাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করার সৌভাগ্য হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই রাস্তার দু’পাশের ধূসর, রুক্ষ ও ন্যাড়া পাহাড়গুলো লক্ষ্য করে থাকবেন। চার পাঁচ বছর আগেও এসব পাহাড়গুলো সবুজে পরিপূর্ণ ছিল। ছিল বড় বড় গাছ ও বাঁশের বন। সেনাসন্ত্রাস এইসব পাহাড়ের সবুজ চামড়া খুলে ফেলে দিয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য যদি স হয় তাহলে এসব পাহাড়ের নতুনভাবে বনায়ন না করে জনসবসতি এলাকায় বনাঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্ত কেন ?

বস্তুতঃ ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় বনাঞ্চল গঠনের পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এসব ন্যাড়া পাহাড়গুলোতে অচিরেই সরকারী উদ্যোগে বনায়নের পরিকল্পনা নেয়া জরুরী। এতে আপত্তি করার কেউ থাকবে না ; উচ্ছেদ হওয়ারও কোন আশংকা থাকবে না।

“বিপরীত স্রোত”
বাঘাইছড়িতে ব্যাপক বৃক্ষ নিধন
শিজক মুখ ও চিন্তারাম ছড়া গ্রাম এখন যেন ধূসর মরুভূমি। আগের নয়ন ভোলানো সবুজ শ্যামল রং আর নেই। কোন এক দৈত্য যেন কেড়ে নিয়েছে তার রূপ।
ব্রাজিলের গত ৩রা জুন ’৯২ থেকে ১৪ই জুন ’৯২ পর্যন্ত রিওডি জেনিরোতে যখন ‘ধরিত্রী সম্মেলন’ এবং বাংলাদেশে সরকারী উদ্যোগে বৃক্ষ রোপন অভিযান চলছিল ঠিক সেই সময় বাঘাইছড়ি উপজেলায় চলে এক বৃক্ষ নিধন অভিযান। এই নিধন অভিযানের উদ্যোক্তারা হলেন ৪৬ ইষ্ট বেঙ্গল এর কতুকছড়ি ক্যাম্প কমান্ডার মেজর হাফেজ, চিন্তারাম ছড়া ক্যাম্প অধিনায়ক ক্যাপ্তেন নাদির এবং শিজক মূখ ক্যাম্প অধিনায়ক জনৈক সুবেদার।

তারা চিন্তারাম ছড়া, শিজক মূখসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের নিজ নিজ বাগানের যাবতীয় গাছ ২ দিনের মধ্যে কেটে ফেলার নির্দেশ দেন। এই আদেশ পালন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশী বিপাকে পড়েন চিন্তারাম ছড়া গ্রামের রত্নসেন চাকমা। কারণ তার প্রায় ৫ একর পরিমাণ জায়গায় রয়েছে সেগুন, কাঠাল, আম, নারিকেল ও বাঁশ বাগান। এত পরিমান এলাকার গাছ বাঁশ ২দিনে তিনজন দিন মজুর দিয়ে কেটে ফেলা সম্ভব না হওয়াই ক্যাপ্টেন নাদির তাকে ক্যাম্পে ডেকে পাঠান এবং কঠোর ভাষায় শাসান। তিনি দু’ঘন্টার মধ্যে বাগানের বাকী অংশ কেটে শেষ করার কঠোর নির্দেশ দেন। কিন্তুুু এই দু’ঘন্টার মধ্যে কেটে ফেলা কখনো সম্ভব নয়। তাই বেচারা নিরুপায় রত্নসেনকে ঘর থেকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। নিজের কঠোর শ্রমে তিল তিল করে গড়ে তোলা এই বাগানই তাকে শেষ পর্যন্ত বৈরাগ্য জীবন পরিয়ে দিয়েছে। যেন “সাধের বাগান বানাইলো মোরে বৈরাগী” অবস্থা।

উক্ত বন নিধন অভিযানে চিন্তারাম ছড়া গ্রামে যাদের বাগান ধ্বংস হয়েছে তারা হলেন, রত্নসেন চাকমা (৫একর) ও চিন্তারাম ছড়া বৌদ্ধ বিহাঙ্কর (৩ একর)। এ ছাড়া শিজক মূখ গ্রামে রোহিতাশ্বর চাকমার ২ একর, রাজ কুমার চাকমার ১-৫ একর, মঙ্গল শেখর চাকমার ১ একর, যুব নাশ্ব চাকমার ১ একর, শিজক মূখ বৌদ্ধ বিহারের ১.৫ একর এবং শিজক মূখ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩ একর এলাকার সমস্ত গাছপালা কেটে সাফ করা হয়েছে। ( নিজস্ব সংবাদ দাতা)
.......................

পৃষ্ঠা: ১১


দালালদের এখন বড়ই দুর্দিন
মিঃ চাইলা অং

দালালদের জাত কি ? দালালদের কোন জাত নেই। নেই দেশ, নেই মাতৃভূমি। তাই তাদের নেই দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। দালাল মানেই গণশত্রু। মানবতা বিবেকবর্জিত এক পাষ-। পৃথিবীর সব জাতির সব দালালের চরিত্র এক। তাদের কাজ জাতীয় ইজ্জত বিকিয়ে দেয়া, গণস্বার্থ পরিপন্থি অবস্থান গ্রহণ করা। যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে এই গণ দুশমন দালালদের আবির্ভাব ঘটে। গণ-প্রতিরোধের উত্থাল জোয়ারে এরা নিশ্চিহ্নও হয়ে যায়। জনতার বিপ্লবী উত্থান মানেই নিশ্চিত বিজয়। জনতার মহাজাগরণ মানেই দালাল শত্রুর চির মৃত্যু।
জুম্ম জনগণের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে গণ-দুশমন দালাল গোষ্ঠী এক মহাপ্রতিবন্ধক। এই জাতীয় বে-ঈমান কুলাঙ্গার শ্রেণী জাতির দুর্দিনে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে চায় জাতীয় বিবেক। এরা ব্যাপক জনতাকে অত্যাচার নির্যাতনের অন্ধকার গহবরে নিক্ষিপ্ত করে থাকতে চায় পরম সুখে। এরা জনগণের মুক্তির স্বপ্নে অনবরত ছড়ায় অশুভ কীট। জাতীয় অস্তিত্বের বুকে হানে অন্তর্ঘাত, জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে করে কলংকিত। এদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী সাহসী জনতার দুর্বার প্রতিরোধ সংগ্রাম ছাড়া জুম্ম জাতির মুক্তির সংগ্রাম অগ্রসর হতে পারে না। দালাল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই দালাল নির্মূল অভিযান চলে নিরন্তর। তাই রাজপথে মিছিলে উচ্চারিত হয় দুর্দান্ত শ্লোগান “দালালের আস্তানা বোমা মেরে উড়িয়ে দাও। দালালীর কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও।” সংঘবদ্ধ জনতার প্রতিরোধ আক্রমণে গণদুশমন দালালদের এখন বড়ই দুর্দিন চলছে। দিকে দিকে এরা হেনস্তা হচ্ছে। সামাজিকভাবে হচ্ছে অপদস্ত। এই কুলাঙ্গারের উপাত ও দৌরাত্ম্যে এখন জনগণের সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। জনগণ জেগে উঠছে এদের বিরুদ্ধে। দালালদের প্রতিরোধ করতে কৃঞ্চমাছড়া এলাকার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজার হাজার ছাত্র জনতার মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে দালালদের বিরুদ্ধে। রাঙ্গামাটি শহরে স্কুলের প্রাণতেজী ছাত্ররা কুখ্যাত দালাল সাধন মানিক কার্বারীর  (দেরেঙ)কে ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সময় বেশ কয়েক ঘন্টা নিজ গৃহে অন্তরীণ রাখে। ছাত্ররা সেখানে দালালদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়। পরে তারা উক্ত কুখ্যাত দেরেঙকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতাদের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করে।

খাগড়াছড়িতে দালাল ও গণদুশমনদের ওপর চলছে সবচেয়ে কঠোর আক্রমণ। গত ১২ ই জুন ’৯২ ছাত্র জনতার রুদ্রবোষের শিকার হয়েছে চঞ্চল বিহারী চাকমা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে ‘রাডারের’ বিরুদ্ধে অপপ্রচারণা ও কুসা রটনা করে বেড়াচ্ছে, চাকরী দেয়ার নামে জনগণের টাকা আত্মসা, ছাত্র পরিষদ ও গণপরিষদ নেতাদের খুন করার জন্য খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের সাথে চুক্তি করেছে, ছাত্র নেতাদের সম্পর্কে বিভিন্ন মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য গোপনে সেনা ক্যাম্পে সরবরাহ ইত্যাদি। সে এইসব অভিযোগ লিখিত স্বীকারোক্তিতে জনতার কাছে স্বীকার করেছে।

গত ১১ই জুলাই ’৯২ খাগড়াছড়ির সাহসী জনতা দিঘীনালার কুখ্যাত হেডম্যান দালাল দীপংকর তালুকদারকে সাংঘাতিকভাবে গণপিটুনী দিয়েছে। এই নরপশুটির অপকর্ম সুবিদিত। অনেক নিরীহ লোককে “শান্তিবাহিনী” বলে ধরিয়ে দিয়ে আবার নিজেই ক্যাম্প থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য জনগণের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতরিয়ে নিয়েছে এই কুখ্যাত হেডম্যান। অনেকের বিরুদ্ধে সেনা ক্যাম্পে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছে সে। তাছাড়া সে ক্যাম্পে যুবতী নারী সরবরাহও করে থাকে নিয়মিতভাবে। গণ-পিটুনীর খবর শুনে দিঘীনালাবাসীরা আনন্দ প্রকাশ করেছেন। ১৩ই জুলাই ’৯২ দিঘীনালার তথাকথিত কমান্ডার দুষ্কৃতিকারী খনি রঞ্জন ত্রিপুরাকে খাগড়াছড়ির ছাত্রজনতা অপদস্ত করে। সে জনতার কাছে তার সমস্ত দুষ্কর্মের কথা স্বীকার করেছে। জাতীয় ও গণস্বার্থ পরিপন্থি কোন অপকর্মে আর লিপ্ত হবে না বলে সে জনতার কাছে অঙ্গীকার করে ও কৃত দুষ্কর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।

দালাল ও গণশত্রুদের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ সংগ্রামকে আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত করা প্রয়োজন। দিকে দিকে একতাবদ্ধ হয়ে ঝাপিয়ে পড়তে হবে এদের বিরুদ্ধে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনতার পবিত্র ভূমিতে এই অশুভ বে-ঈমানদের স্থান হতে পারে না। স্বাধিকারের সংগ্রামে শহীদদের পবিত্র রক্তের মর্যাদা রক্ষা করতেই হবে।

জি, ও, সি’র দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে
মিঃ বিজগ

গত ৩০ শে জুলাই ৯২ /চট্টগ্রামের ২৪ তম পদাতিক ডিভিশনের জি,ও,সি মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান তার অফিসে এক সংবাদ-সম্মেলন করেন। উদ্দেশ্য পাহাড়ি জনগণের প্রতি সেনাবাহিনীর বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গী দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলে ধরা। উক্ত সম্মেলনে পার্বত্য এলাকায় মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনী দ্বারা নিরীহ ও নিরস্ত্র পাহাড়ি জনগণকে গ্রেফতার, নির্যাতন করা হবেনা বলে মতপ্রকাশ করেন।

জি, ও, সি সাহেবের এই কথাটি থেকে এটাই প্রমাণ হয়েছে যে, সুদীর্ঘ ১৭/১৮ বছর যাবত পাহাড়িদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়ন করেছিলেন। জি,ও,সি সাহেবের এই অপ্রিয় সত্য কথাটি স্বীকার করার জন্য ধন্যবাদ। কারণ দীর্ঘদিন যাবত সেনাবাহিনীর কমা-াররা এ কথা স্বীকার করেননি।

এখানে কথা হচ্ছে জি,ও,সি’র দেওয়া প্রতিশ্রুতি কি আদতে পালন করছেন তার সেনা সদস্যরা ? তার দেওয়া প্রতিশ্রুতির পর-ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরলাম, মহামান্য জি,ও,সি’র বুঝার সুবিধার্থে। তার সেনাবাহিনী পার্বত্য এলাকায় বর্তমানে কতটুকু ভদ্র হয়ে অবস্থান করছেন।

গত ৩১ শে জুলাই অর্থা জি,ও,সি সাহেবের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির পরদিন রাঙ্গামাটি জোনের নিয়ন্ত্রণাধীন মানিকছড়ি ক্যাম্পের কমা-ার -এক অপারেশনের মাধ্যমে চার নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে এসে বেদম প্রহার করার পর পার্শ্ববর্তী গভীর ঝর্ণার পানিতে ডুবিয়ে রাখে। তারা হচ্ছেন যথাক্রমে (১) আয়ুবখান চাকমা, পীং চিন্তহরন চাকমা গ্রামঃ কুজ্জাছড়ি পাড়া, বড়াদম মৌজা, (২) চিক্কো চাকমা পীং ঐ গ্রামঃ ঐ---- (৩) মুকুল কান্তি চাকমা পীং বিয়েদ চাকমা, গ্রাম, ঐ---- (৪) কুচবো চাকমা পীং মনিন্দ্র লাল চাকমা গ্রামঃ ঢেপ্পোয়াছড়ি পাড়া, বড়াদম মৌজা। একই ক্যাম্পের একই কমা-ার বড়াদম গ্রামের জনৈক ছাত্র সুপ্রিয় চাকমা রাঙ্গামাটি শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে আটকিয়ে পরিচয় পত্রটি চেয়ে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। বরং এ বলে হুশিয়ার করে দিয়েছে যে যাতে আর কোথাও ঘোরাফেরা না করে। অথচ পরিচয় পত্র না থাকলে বের হওয়াতো দূরের কথা সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচার থেকে কেউ রক্ষা পায়না। এভাবে অনেক ছাত্র/ছাত্রীর জীবন ধ্বংস করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। মাননীয় জি,ও,সি সাহেব ঐ ছেলেটির শিক্ষা জীবন কি হবে ? যদি বাড়ি থেকে বের হতে না পারে। খাগড়াছড়ি জেলাধীন লতিবানের শান্তি রঞ্জন কার্বারী পাড়াসহ আশে পাশে বেশ কয়েকটি গ্রামের গ্রামবাসীর এক বছর যাবত বিনা বেতনে প্রহরা দিতে হচ্ছে। সেখান থেকেও তো আজ পর্যন্ত ঐ গ্রামবাসীরা মুক্তি পাননি। গত ২৬ আগষ্ট কিনাধন কার্বারী পাড়ার জনৈক আনন্দ মোহন চাকমার মার রোগে মৃত্যু হলে সেখানে গ্রামের লোকজন মৃতদেহ রাত্রে রাখতে গিয়ে জড়ো হয়। পূজগাং মুখ আর্মি ক্যাম্পের সুবেদার মান্নান (৩৩ বেঙ্গল) শান্তি বাহিনী মিটিং-এ জড়ো হয়েছে বলে আখ্যায়িত করে এদেরকে অহেতুক হয়রানি করেন এবং অহেতুক গালিগালাজ ও ক্যাম্পে হাজির হতে নির্দেশ করেন। তাছাড়া এও জানিয়ে দেন যে, যদি কোন ব্যক্তি মৃত্যু বা অসুস্থ হলে ক্যাম্পে নাজানিয়ে এভাবে জড়ো হলে ভবিষ্যতে পরিনাম ভাল হবেনা। এরকম ঘটনা আরও বিভিন্ন জায়গায় ঘটেছে যা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।

মাননীয় জি,ও,সি সাহেব এত জাঁকজমকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে আপনার এই কথাটি ঘোষণা করার কারণ কি যদি পালন করা না হয়? এটা কি প্রতারণা নয় ?
...................
পৃষ্ঠা: ১২ - ১৩

হালচাল

একজন আর. পি. এর অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ঠ
জুরাছড়ি উপজেলার শিলছড়ি ক্যাম্পের আর. পি. আবুল কালাম আজাদ এর উপাতে ক্যাম্পের আশে পাশের গ্রামের জনসাধারণ অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন। সে প্রায়শ গ্রামে এসে বিনাকারণে ইচ্ছেমত লোকের ঘরে ঢুকে মানুষজনকে ত্যক্ত বিরক্ত করে। তাছাড়া সে এলাকাবাসীর কাছ থেকে কোন জিনিস কিনলে তার ন্যায্য দাম দেয় না। অনেক সময় মোটেই দেয়না। নিরীহ জনগণ এর প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না। যারা তার এই অন্যায় মেনে নিতে পারে না তাদের প্রাপ্য হয় কিল ঘুষি। এ ব্যাপারে এলাকার জনসাধারণ ক্যাম্প কমা-ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
- এস, কে চাকমা

একজন বাঙালির বদলা ১১ জন পাহাড়ি
কতুবছড়ি ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন কবির (১৮ বেঙ্গল) ২৬ শে জুন সংঘটিত হামিদ টিলার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে ৪নং কতুবছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মি. মানিক লালকে প্রশ্ন করেন, “চেয়ারম্যান সাহেব, আপনি পদত্যাগ করলেন না কেন” চেয়ারম্যান পদত্যাগ করার কারণ জানতে চাইলে তিনি উত্তরে বলেন, “শান্তি বাহিনীরা বাঙালি মেরেছে তাই।” তিনি চেয়ারম্যানকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “আমাদের কোরান শরীফ-এ উল্লেখ আছে একজন বাঙালি হত্যা করা হলে ১১ জন পাল্টা হত্যা করতে হয়।” এই কথোপকথনের সময় ক্যাম্পের আবাসিক স্কুলের আর.পি. চেকপোষ্টে আরও উপস্থিত ছিলেন ইউ পি সদস্য মিঃ দয়াল সুখ ও একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার।

‘রাডারের কথা সত্য’
প্রমেশ শেখরঃ রাঙ্গামাটি সদর জোনের (৭ ঈষ্ট বেঙ্গল) কমা-ার লেঃ কর্ণেল ফজলুর হকের সাথে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈকা ভদ্রমহিলার আলাপ হচ্ছিল। প্রসঙ্গঃ সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়। আলাপের এক পর্যায়ে জনাব হক উক্ত ভদ্র মহিলার কাছে স্বীকার করেন, “ছাত্ররা রাডারে যে কথাগুলো লেখে তা আসলে সত্য”। এ সত্যতা চট্টগ্রামের জি, ও, সি’ ও সাংবাদিক সম্মেলনে একভাবে স্বীকার করেছেন। আসলে সত্য ও ন্যায়কে বেশী দিন চাপা রাখা যায় না। সে অস্ত্রের মুখে হোক কিংবা গোয়েবলসের মিথ্যাকে সত্য বানানোর থিওরি দিয়ে হোক। সত্য ও ন্যায় সবার ওপরে। তাই সে আত্ম প্রকাশ করবেই।

“পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের শাখা আনলে গুলি করা হবে”
প্রমেশ শেখরঃ জুরাছড়ি উপজেলার বনযোগী ছড়া গ্রামের বাসিন্দা পলাশ দেওয়ান (টনা) রাঙ্গুনিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজ থেকে বাড়িতে গেলে স্থানীয় ক্যাম্পে (৩৭ ঈষ্ট বেঙ্গল) তাকে ডাকা হয়। কমা-ার সাহেব অভিযোগ করেন সে (টনা) নাকি তাদের বিরুদ্ধে রাডারে নানা রকম রিপোর্ট পাঠায়। টনা এ অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে মনে প্রাণে সমর্থন করে বলে জানায়। কমা-ার হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, “তুমি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কর বা নাই কর তাতে আমার কোন আসে যায় না। তবে এখানে ছাত্র পরিষদের কোন শাখা আনা চলবে না। আনলে গুলি করে মেরে ফেলা হবে।” তিনি স্বীকার করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলনের ফলে তাদের কুকীর্তি দেশবাসী তথা সারা বিশ্বের কাছে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে তারা আগের মত পাহাড়ি জনগণের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন (তাদের ভাষায় “কাজ”) চালাতে পারছে না। তারা অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

লক্ষীছড়িতে চিদোল অবরোধ : জনৈক কলেজ ছাত্র
লক্ষীছড়ি থেকে আগত লোকদের মাধ্যমে জানা গেছে যে, দীর্ঘ দিন ধরে সেনাবাহিনী জুম্মদের প্রধান ‘খাদ্য’ চিদোল’ এর ওপর অবরোধ চাপিয়েছে। ফলে লক্ষীছড়িতে এখন চিদোল-এর অভাব দেখা দিয়েছে। জুম্মদের অন্যতম প্রধান খাদ্য ‘চিদোল’। নিত্য প্রযোজনীয় জিনিসের মধ্যে এইটিই প্রধান। তাই ‘চিদোল’ কেনা বেচা বন্ধ হওয়াই লক্ষীছড়ি বাসীরা অত্যন্ত কষ্ট ভোগ করছেন।

পাহাড়ি ছাত্রীদের বোরখা পরতে হচ্ছে
বুলেটঃ খাগড়াছড়ি জেলাধীন মাটিরাঙ্গা পাইলট হাই স্কুলের পাহাড়ি ছাত্রীদেরকে এখন নিয়মিত বোরখা পরতে বাধ্য করা হচ্ছে। কয়েক মাস আগে প্রধান শিক্ষক পাহাড়ি ছাত্রীদের বোরখা না পরার অনুমতি দিয়েছিলেন। শপথ নেওয়র সময়ও স্ব স্ব ধর্ম বিধান মেনে চলার কথা বলা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও উগ্র ধর্মান্ধ শিক্ষক কাজী জিয়াউল হক পাহাড়ি ছাত্রীদেরকে বোরখা ছাড়া স্কুলে আসলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাছাড়া অন্যান্য মুসলিম শিক্ষকরাও বোরখা পরানোর পক্ষে বলে অভিযোগ। তাই পাহাড়ি ছাত্রীদেরকে এখন বাধ্য হয়ে বোরখা পরে স্কুলে আসতে হচ্ছে। অবশ্য এলাকার অনেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমান পাহাড়ি ছাত্রীদের বোরখা পরানোর ব্যাপারটিকে মুসলিম ধর্মের প্রতি অবমাননা বলে মন্তব্য করেছেন।

মেজর শাহাদা এর কান্ড
খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের মেজর শাহাদা বাড়ি, বাড়ি সফর করছেন। তার হাতে একটি ফটো এ্যালবাম। বুদ্ধলাল চাকমার সহযোগিতায় এই এ্যালবামটি যোগার করেছে বলে জানা গেছে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিভিন্ন মিছিল, মিটিং, সমাবেশ ইত্যাদির ছবি তার সেই এ্যালবামে রয়েছে। ছবিগুলো সনাক্ত করে তাদের বাড়ি গিয়ে কখনো অভিভাবক সেজে, কখনো পদবীর বাহার করে, কথনো বম্বে ফিল্মের নায়কের অভিনয় করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে যোগাযোগ না রাখার জন্য জানিয়ে আসে। কিন্তু দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথা কেইবা শুনবে। হায় ! কারো বাড়িতে গিয়ে তিনি নাকি অপমানিত-ও হয়ে ফিরছেন।

ক্ষতিপূরণ প্রদানে টালবাহানা
খাগড়াছড়ি সদরে ব্রিগেডের অধীনে বিস্তীর্ণ পাহাড় জুড়ে একটি কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির ট্রেনিং সেন্টারে পরিণত করা হয়েছে। প্রায় ১০০ পরিবারের ২০০ একরের অধিক পাহাড় ও সমতল ভূমি বন্দোবস্তি আছে বলে জানা গেছে। ব্রিগেড থেকে একর প্রতি তিন লক্ষ টাকা করে ১৫০ একরের ক্ষতিপূরণ দেবে আশ্বাস দিয়ে ৮৬ সালের দিকে পাহাড়গুলো জরিপ চালানো হয। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ ক্ষতিপূরণ পায়নি। মালিকেরা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য অনেকবার ব্রিগেড এবং জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানায়। তাদেরকে প্রতি বারই আশ্বাস দিয়ে বলা হয় এতটাকা ব্যাংকে নাই, ব্যাংকে টাকা এলে তোমাদের সবাইকে ক্ষতি পূরণগুলো দেয়া হবে। সেখানে ১৫০ একরের মত জরিপ করা হলেও আশে পাশে এলাকাগুলো প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। পাশে মহিষ চড়াতে গিয়ে চাইলাপ্রু নামে এক রাখাল গুলিবিদ্ধ হয়। কিছুদিন আগে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে সেনা কর্তৃক মহাজন পাড়ার এক মহিলাকে ধর্ষণ করার অপচেষ্টা চালানো হয়। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রীতিমতো সামরিক ট্রেনিং সেন্টার হয়ে যাওয়াতে বন্দোবস্তী ফের পাওয়ার কথাই আসে না আর ক্ষতিপূরণগুলো পাওয়ার জন্য এখন কি করতে হবে তাও তাদের জানা নেই।

রাঙ্গামাটি
কুতুবছড়ি ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জায়েদ তার আওতাধীন যত লোক আছে তাদেরকে নিয়ে ১৬/৬/৯২ইং মঙ্গলবার সকাল ১০ ঘটিকার সময়ে মিটিং এ আসার নির্দেশ করে। উক্ত মিটিং এ বলা হয় প্রত্যেকদিন ছয়জন করে তাদের সেন্ট্রি পোষ্ট গুলো চেক করে দিতে হবে। পরদিন হতে ছয়জনে সেন্ট্রি পোষ্টগুলো চেক করতে যায় এবং সেনারা নিরাপদ দূরত্বে থাকে। সেনাবাহিনীর এতদূর্ভোগ এলাকার জনগণকে কতদিন পোহাতে হবে কে জানে।

স্কুল শিক্ষক হয়রানী
বুলেটঃ মাটিরাঙ্গার সম্রাট জোন কমাণ্ডার এক আইন জারী করেন। তার রাজ্যের যত পাহাড়ি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক রয়েছেন সবাইকে জাহাপনার নিকট মাসিক রিপোর্ট পেশ করতে হবে। রিপোর্ট পেশ করতে ব্যর্থ হলে বেতন ঔণফট-লয আর কান বিদীর্ণ করা অশ্রাব্য গালিগালাজ। ফলে অসহায় পাহাড়ি শিক্ষকগণ এখন এই মাসিক রিপোর্ট -এর জ্বালাতনে অতীষ্ট হয়ে উঠেছেন।
 
 
সংবাদ দাতাদের প্রতি আহ্বান 
 
সংগ্রামী সাথী বন্ধুরা, এতদিন আপনাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলে পার্বত্য এলাকার জুম্ম জনগণের একমাত্র মুখ পত্র ‘রাডার’জুম্ম জনগণের দ্বারে দ্বারে পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছি। আপনাদের এই মহান সংগ্রামী ভূমিকার জন্য আপনাদের কে বিপ্লবী অভিনন্দন জানাই। আপনারা হয়ত এতদিন অবগত হয়েছেন যে, বর্তমান ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ‘রাডারের’ তীক্ষ্ণ লেখনী দ্বারা ভীত হয়ে গত ১৭/৭/৯২ তারিখে ৯৯ (ক) ধারার ক্ষমতা বলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তার পরও আমাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দিতে পারবে না। যদি আপনাদের ঐকান্তিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। তাই আমরা আবার নতুন আঙ্গীকে যাত্রা শুরু করেছি। সে কারণে আপনাদের নিকট আমাদের আহ্বান, আপনারা সংবাদ সংগ্রহ ও প্রেরণ অব্যাহত রাখবেন। পাঠনো সংবাদ গুলো যাতে বস্তু নিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক হয় সেদিকে নজর রাখার অনুরোধ রইল, পাঠানো সংবাদে যাতে বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ থাকে, সে দিকে নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে বিলম্ব হউক, তারপরও সঠিক সংবাদ প্রেরণ করা বাঞ্জনীয়।

সম্পাদক পরিষদ  
পৃষ্ঠা: ১৪ - ১৫

গণপ্রতিরোধ, সন্ত্রাস ও পার্বত্য চট্টগ্রাম
-মিঃ অর্ক

পার্বত্য চট্টগ্রামে দশ ভাষাভাষি ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নিজস্বঃ স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র এবং অস্তিত্ত্ব রক্ষার্থে আজ গণপ্রতিরোধে লিপ্ত। স্বাধীনতা উত্তর-কালে এ প্রতিরোধের সাংগঠনিক কাঠামো হিসেবে দেখা যায় কিছু অংশ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাধ্য হয়ে সরে গিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধে নিজের পথ খুঁজে নিতে। এর বেশ কিছু বছর পর Ivotitute ভিত্তিক জুম্ম ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন গুলো ৮৯ এর লংগদু গণহত্যার পর সার্বজনীন ছাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের চেষ্টা চালাতে। তাছাড়া বিক্ষুব্ধ গণমানসের চেতনা তো রয়েছেই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এই গণপ্রতিরোধ আন্দোলন কিংবা গণবিদ্রোহ ? যে কোন ধরনের গণবিদ্রোহের কারণ খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এসবের উপর ভিত্তি করে প্রফেসর সৈয়দ আনোয়ার হোসেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রবন্ধে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, অভ্যুত্থান ইত্যাদির কারণসমূহের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দানের জন্য যে মডেলটি নির্মাণ করেছেন তা নীচে হাজির করা হলো।

গণবিদ্রোহের কারণ:                
Intrusions
অভিঘাত
Cultural Cores Relative deprivation
মৌল সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ আপেক্ষিক বঞ্চনা

High intensity of Collective Violence
সমষ্টিগত প্রতিরোধের প্রচণ্ডতম সম্ভাবনা

Intrusion
অভিঘাত
Cultural Peripherals Relative deprivation
প্রান্তিক সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ আপেক্ষিক বঞ্চনা

Low intensity of collective
সমষ্টিগত প্রতিরোধের অপেক্ষাকৃত কম সম্ভাবনা

এখানে কেন্দ্রীয় বক্তব্য হলো- একটি সমাজে প্রতিরোধ বা বিদ্রোহের সূচনা হতে পারে দু ধরনের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। প্রথমতঃ বাইরের কোন শোষণকারী শক্তির নীতি ও কর্মকান্ডের ফলে সেই সমাজের মৌল সাংস্কৃতিক উপাদান সমূহের উপর অভিঘাত এলে প্রচ- সমষ্টিগত প্রতিরোধের সম্ভাবনা থাকে, দ্বিতীয়তঃ প্রান্তিক সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহের ক্ষেত্রে এমনই পরিস্থিতির সৃষ্টি যে প্রতিরোধ জন্ম নেবে তা তুলনামূলকভাবে খুব ব্যাপক হবে না বা দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া হিসেবে গোটা জনগোষ্ঠীকে সমান ভাবে আলোড়িত করে একটি মৌল পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে না। মৌল সাংস্কৃতিক উপাদান বলতে সমাজব্যবস্থার সেই উপাদানগুলোকে নির্দেশ করা হচ্ছে, যার উপর নির্ভর করছে একটি জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য এবং অস্তিত্ত্ব। অপরপক্ষে প্রান্তিক সাংস্কৃতিক উপাদান বলতে সে সব বৈশিষ্ট্য গুলিই বুঝায় যে গুলোর প্রকৃতি শোষণমূলক প্রক্রিয়ার কারণে বিকৃত হলে হয়তো একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে না কিন্তু চেতনালোক হবে বিক্ষুব্ধ। এবং উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ সৃষ্টিতে একটি অভিন্ন উপাদান সক্রিয়, এবং তা হলো আপেক্ষিক বঞ্চনা ঔপনিবেশিক কাঠামোতে কিংবা শোষণমূলক প্রক্রিয়ায় পরাধীন ও শোষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমান্বয়ে বঞ্চনার চেতনা গড়ে ওঠে। অর্থা আপেক্ষিক বঞ্চনা সৃষ্টি হয় তখন যখন গণমানসে সাংস্কৃতিক উপাদানভিত্তিক ন্যায় সংগত অধিকার ভোগের আকাঙ্খা ও বিরাজমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত অধিকারের মধ্যে ব্যবধান প্রকট হয়ে উঠে বা যদি তা ক্রমেই বেড়ে চলে।”

সাধারণ গণপ্রতিরোধের কারণ হিসেবে যে সব বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের গণপ্রতিরোধ আন্দোলনের কারণ হিসেবে ও সে সব বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। এ অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগুরুর শোষণ এমনই ঔপনিবেশিক পর্যায়ের।

আলজেরিয়ার বিপ্লবী ফাত্ততে-ফাননের তত্ত্ব অনুযায়ী ঔপনিবেশিকবাদের ভিত্তি শক্তি ও আপেক্ষিক বিজয় যার মূল হচ্ছে সন্ত্রাস। ঔপনিবেশিকবাদ রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রচ- সন্ত্রাস চালায়। এই অব্যাহত ঔপনিবেশিক সন্ত্রাস ব্যক্তিকে করে তোলে হীনমন্য, অধনস্তন, হতাশাগ্রস্ত, কর্মহীন ও আত্মমর্যাদাহীন। প্রচ- দমন পীড়ন, উপীড়নের মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মসচেতনার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়ে তাকে অথর্ব, কাপুরুষ করে তোলে; কিন্তু সেই আপেক্ষিক বঞ্চনা থেকে জন্ম নেয় এক বিদ্রোহের এক বিস্ফোরণের।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার ও তার কায়েমী স্বার্থবাদী মহল (সরকার পরিবর্তন হলেও যাদের পরিবর্তন নেই) এর সৃষ্ট রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রতিটি ক্ষেত্রে অব্যাহত সন্ত্রাসের নমুনা পূর্বেও এবং এখনও যা সংখ্যালঘু জনসত্তার মৌল এবং প্রান্তিক সাংস্কৃতিক উপাদান সমূহের উপর অভিঘাত সৃষ্টি করে আপেক্ষিক বঞ্চনার চেতনার জন্ম দিচ্ছে। এ চেতনাকে ধারণ করে ঐতিহাসিক অনিবার্যতার কারণে জন্ম হয়েছে পাহাড়ি গণ পরিষদ এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। গণপ্রতিরোধের বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ৭ দফা ও ৫ দফা দাবী বাস্তবায়নের কর্মসূচীতে।

প্রখ্যাত উপমহাদেশীয় বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ লিখেছেন-“ভারতবর্ষে প্রথম-কে সন্ত্রাসবাদ প্রবর্তন করিয়াছে ? বৃটিশ গভর্নমেন্ট শঠতা-কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতার দ্বারা অন্যায়ভাবে বল প্রয়োগ দ্বারা ভারতবর্ষ অধিকার করিয়া সন্ত্রাসবাদ দ্বারা ভারতবর্ষ শাসন ও শোষণ করিতেছে না কি? একটি শান্তি প্রিয় জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া রাখা সন্ত্রাসবাদ নয় কি ? হত্যা করা সন্ত্রাসবাদ নয় কি?”

সেই একই সুরে বলা যায় পার্বত্যঞ্চলে সন্ত্রাস প্রথম আমদানী করেছে কে ? স্বাধীনতা অব্যবহিত পরেই রক্ষীবাহিনী কর্তৃক পান ছড়িতে ব্রাশ ফায়ারে পাহাড়ি নিধন একি সন্ত্রাসবাদ নয় ? ১৯৮০ সালে কলমপতি ইউনিয়নে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিত পাহাড়ি গণহত্যা থেকে শুরু করে ১৯৯২ এর লোগাং এবং কাউখালির দুলুপাড়া গণহত্যা এসব সন্ত্রাসবাদ নয় ? রেকর্ড বিচারে দেখা যায় সরকারের সশস্ত্র বাহিনীরা সর্বপ্রথম গণহত্যার মাধ্যমে সন্ত্রাস কায়েম করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে উপীড়ন ও দমননীতি চালাচ্ছে। ১৯০০ ম্যানুয়েল অ্যাক্ট স্থগিত রেখে পার্বত্য জনগণকে স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে শঠতা কপটতার মাধ্যমে বল প্রয়োগে অঘোষিত সামরিক স্বৈরশাসন এসব সন্ত্রাসবাদ নয় কি ? বাঙালি অনুপ্রবেশের মাধ্যমে জীবন্ত বুলেট হিসেবে তাদের ব্যবহার করে পাহাড়িদের অস্তিত্বের বিলোপ সাধনের নীল নকশা এসব কি সন্ত্রাসবাদ নয় ? অনবরত ধর্ষণ, হুমকি, জেল জুলুম ধরপাকড়, বোমাবাজী, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টিতে মদদ দান, সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি, সত্য প্রচারে বাধা, মিথ্যে প্রচারে গোয়েবলসের থিওরী অবলম্বন, এসবকী সন্ত্রাসবাদ নয় ?

এই অব্যাহত ঔপনিবেশিক পর্যায়ের সন্ত্রাসকে প্রতিহত করতে পারে একমাত্র প্রতি সন্ত্রাস ফাননের মতে জনগণ ও মুক্তির মাধ্যম প্রতি সন্ত্রাস। প্রতি সন্ত্রাস জাতীয় পর্যায়ে সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে, ট্রাইবালিজম ও “আঞ্চলিকতাকে” প্রতিহত করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতি সন্ত্রাস এক শুদ্ধিকরন শক্তি। সন্ত্রাস হীনমান্যতা, অধস্তনতা, হতাশাগ্রস্ত, কাপুরুষতা থেকে রক্ষা করে ব্যক্তিকে আত্মসচেতন ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

প্রতি সন্ত্রাস-সন্ত্রাসের বিপরীতে সন্ত্রাস। জনতার ঐক্যবদ্ধতাই সন্ত্রাসকারীদের সবচে’ বড় শত্রু এবং বড় প্রতি সন্ত্রাস। এই প্রতি সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে হবে তেরটি ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বার একতাবদ্ধতার মাধ্যমে, পাহাড়ি গণপরিষদ এবং ছাত্র পরিষদকে শক্তিশালী করে যৌক্তিক দাবীর দৃঢ় ভাষায় নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে, দৃঢ় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে। এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আন্দোলন সন্ত্রাসের ফলে সৃষ্ট হীনমন্যতা, অধঃস্তনতা, হতাশাগ্রস্ততার হাত থেকে রক্ষা করে ব্যক্তি মানসকে করে তুলবে আত্মসচেতন, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন আত্মবিশ্বাসী। একই সাথে প্রতিক্রিয়াশীল দালালদের হটানোর মাধ্যমে করা যাবে সমাজ শুদ্ধিকরণ -একঢিলে দুই পাখি মারার সামিল – To destroy an opressor and the man he opresses at the same time.

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও গণপরিষদের আহবানে সুসংগঠিতভাবে তাদের কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধের পাহাড়, অধিকার ছিনিয়ে আনার মতো শক্তির; তখনই কেবল পারা যাবে মৌল পরিবর্তন সাধনে। নচে নয়। হুঁশিয়ার। শত্রু চারদিকে।
সহায়ক সূত্রঃ
১। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ - সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
২। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন (১৯০০-১৯১৮) - মনতাসীর মামুন 
৩। জগতের লাঞ্ছিত ও ভাগ্যাহত - ফাঞ্জ ফানন
৪। রাডার-
৫। বাংলাদেশের সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন।
৬। Why man rebels –Gurr.



রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় কেডাষ্ট্রাল সার্ভে
আরও একটি ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা
সরকার সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জটিলতা নিরসনের দোহাই দিয়ে কেডাষ্ট্রাল সার্ভে করার কর্মসূচী নিয়েছে। এই সার্ভে আগামী নভেম্বর মাস থেকে শুরু করার কথা ঘোষনা করা হয়েছে। পার্বত্য অধিবাসীদের জমির মালিকানা দেয়ার নামে বরং তাদের ভূমি সত্ব হরণেরই চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ সার্ভের ফলে প্রধানত পাহাড়ি মানুষগুলো অধিকাংশই উচ্ছেদ হবে নতুবা তাদের দখলাধীন জমি হ্রাস পাবে। যেহেতু পাহাড়িদের ঐতিহ্যগত ভূমি ব্যবস্থার ফলে কোন কাগজপত্র তাদের হাতে নেই। সুতরাং ভূমি মালিকানা পাওয়ার পরিবর্তে তারা ভূমি মালিকানা হারাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার কেডাষ্ট্রাল সার্ভের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় প্রতি ইঞ্চি খাস জমি উদ্ধার করবে এবং মানবাধিকার, ঘনবসতির দেশ ইত্যাদি অজুহাতে ঐ সমস্থ জায়গায় সমতল বাসীদের পুনর্বাসন করবে। এ-তে সমস্যা আরও জটিল আকার নেবে নিঃসন্দেহে। যে মুহুর্তে সরকার সমস্যা সমাধানের জন্য হাইফাই করছে ঠিক সেই মুহুর্তে ভূমি জরিপ দিয়ে সমস্যাকে মূলত তিমিরে রাখার অপচেষ্টাই চালাচ্ছে এ সরকার। আমরা আশা করবো জাতীয় স্বার্থে সরকার এ ষড়যন্ত্র থেকে বিরত থাকবেন এবং পার্বত্য সমস্যার একটি সন্তোষ জনক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভূমি জরিপ স্থগিত রাখবে।



পৃষ্ঠা: ১৬ - ১৭

পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সমাধান প্রসঙ্গে
সলিমউল্লাহ খান

পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের জ্ঞান আমার নেই। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়েদেয়া যায় এমন তুচ্ছ বিষয়ও নয়। রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে, তদুপরি, দরকার বিশেষজ্ঞের নয়, নাগরিক চেতনার। আগেই বলেছি পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পূর্বশর্ত ওখানকার যত জাতি আছেন তাদের জাতীয়তা স্বীকার করা এবং গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভজাতির আত্মনিয়ন্ত্রন নীতির ভিত্তিতে তাদের সাথে বাঙালি জাতির সম্পর্ক পাতা। ১৯৭২ সনে শেখ মুজিবের কাছে মানবেন্দ্র লারমা যে চারটি মূল দাবিতুলে ধরেছিলেন সেগুলি স্বীকার করে নেয়াই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ। এখনও সে সব দাবিকেই আলোচনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে
......................

বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি উপজাতি সমস্যা আছে; পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, তনচঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, পাহাড়ি ত্রিপুরা, মারমা, খুমি, চাক, ম্রো, বনযোগী, পাংকো, লুসাই এবং দুই রিয়াং তেরটি জাতির দৃষ্টিতে সেখানে যে সমস্যা আছে তার নাম ‘বাঙালি’ সমস্যা। আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার প্রত্যেক জাতির মৌলিক অধিকার হিসেবে বর্তমান দুনিয়ায় স্বীকৃতি লাভ করেছে। খোদ বাঙালিরা এই অধিকার বলে নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েম করেছে। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী, ভারতীয় এবং বর্মী শাসক শ্রেণীর সাথে সুর মিলিয়ে এইসব জাতিকে বলেন উপজাতি। অতএব আত্মনিয়ন্ত্রনের প্রশ্ন ওঠে না।
                   
‘উপজাতি’ কথাটার উপত্তি ইউরোপিয় উপনিবেশবাদীদের জবানে। উপনিবেশ বাদের অগ্রগতির সাথে সাথে তার অনুষঙ্গে বর্ণবাদী চিন্তার প্রচারের মুখে এশিয়া এবং আফ্রিকার কোন কোন অংশের জনগণকে উপজাতি (বা ট্রাইব) নাম দেয়া হয়। ভারতবর্ষে ইংরেজদের উপনিবেশ স্থাপনের যে সব জাতি সবচেয়ে বাধা দিয়েছিল, ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তাদেরকেই উপজাতি উপাধি দান করে। তার অনেক পরে খাদ্য সংগ্রাহী ও যাযাবর চাষীদের উপজাতির তালিকায় জায়গা দেয়া হয়। এসব তথ্য অভিজ্ঞ, শিক্ষিত জনমাত্রেই জানেন। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় জাতিগর্বে গর্বিত বাঙালি সমাজের শ্রেষ্ঠ বিদ্বানরা পর্যন্ত এ তথ্য ভুলে গেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পূর্বশর্ত এখানেই অপূর্ণ থেকে যায়।

বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী প্রথম দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটকে নিছক ল অ্যান্ড অর্ডার সমস্যা ধরে নিয়েছিলেন। শেষের দিকে কবি এরশাদের জঙ্গী শাসনামলে সমস্যার প্রকৃতি যে রাজনৈকি তা প্রথম সরকারীভাবে কবুল হয়। কিন্তু এরশাদ সরকার রাজনীতি বলতে বুঝেছিলেন জেলা পরিষদ নামে একটা ঠুটো জগন্নাথ সভা তৈরি করা। এর আগে জিয়া সরকারও “উপজাতীয় কনভেনশন” ডেকে আসল সমস্যার মুখদেখা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যার মুখ ব্যাদান করেই আছে। গত ২০ বছর ধরে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন সামরিক কায়দায়। এই লক্ষ্যেই তারা গুচ্ছ গ্রাম তৈরী করছেন, বসাচ্ছেন যৌথ খামার। একই লক্ষ্যে তারা নদী সিকন্তি বাঙালি পরিবার ডেকে বসাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। এতে করে আর যাই হোক, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আসেনি। যুদ্ধ জারি রয়েছে।

গত এপ্রিল মাসের লোগাং গণহত্যা এবং মে মাসের রাঙ্গামাটি জাতিদাঙ্গা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিরই সাক্ষা ফল। গণহত্যা ও দাঙ্গা যে আপতিক ঘটনা নয়, কিংবা নয় ঘটনাচক্র বরং একটি নির্ণয়যোগ্য পদ্ধতির অনিবার্য ফল তা গত ২০ বছরের ঘটনাবলীর সামন্যতম আলোচনায় ও স্পষ্ট হয়ে উঠে। দুর্ভাগ্যের কথা ফিলিস্তিনী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার নিয়ে যাঁরা মাঠ গরম করেন, কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যাঁরা কবিতা ও চিত্র প্রদর্শনী করেন-তারা পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার সম্পর্কে কথা বলার সাহস পাননি। এমনই মাহাত্ম্য জাতীয়তা বাদের। ফলে ইউরোপীয় কিছু সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি বিদেশে তুলে ধরেছেন। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, বিদেশীসাহায্য দাতাদের চাপ পাওয়ার আগে দেশের শাসক শ্রেণীর টনক নড়বে না।

১৯৮০ সালের মার্চ মাসে কাউখালি গণহত্যার পর খোদ ক্ষমতাসীন বিএনপি দলের সংসদীয় কমিটিকে পর্যন্ত না জানিয়ে দেখামাত্র গুলির ক্ষমতাযুক্ত “উপদ্রুত এলাকা বিল” পাসের চেষ্টা যারা করেছিলেন, তারাই এখনও পার্বত্য চট্টগ্রাম নীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। পার্থক্যের মধ্যে এইটুকু যে, এখন তাদের প্রতিনিধিরাও বলছেন সংলাপের কথা-রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধান কি বন্তু ? লোগাং গণহত্যার তদন্তের জন্যে সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন-ভালো কথা, কিন্তু যে সরকারী নীতির ফলে এই হত্যা ও দাংগা তা কি এ তদন্তের আওতায় পড়বে ? পড়বেনা, সে তো জানা কথা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের জ্ঞান আমার নেই। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় এমন তুচ্ছ বিষয়ও নয়। রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে, তদুপরি, দরকার বিশেষজ্ঞের নয়, নাগরিক চেতনার। আগেই বলেছি পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পূর্বশর্ত ওখানকার যত জাতি আছেন তাদের জাতীয়তা স্বীকার করা এবং গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ জাতির আত্মনিয়ন্ত্রন নীতির ভিত্তিতে তাদের সাথে বাঙালী জাতির সম্পর্ক পাতা। ১৯৭২ সনে শেখমুজিবের কাছে মানবেন্দ্র লারমা যে ৪টি মূল দাবী তুলে ধরেছিলেন সেগুলি স্বীকার করে নেয়াই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ। এখনও সে সব দাবিকেই আলোচনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহন করা যেতে পারে। লারমার প্রধান দাবি ছিল ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের অনুরূপ আইন সংবিধানে গ্রন্থিত করা। ঐ আইনের সারকথা পার্বত্য এলাকার জমির ওপর বাঙালি প্রশাসকদের বাইরে থেকে এনে লোক বসানোর যথেচ্ছ অধিকার বন্ধ করা। এ দাবির মধ্যে অতিন্দ্রীয় কোন ভাবাবেগ নেই, নেই কোন দেশবিরোধীতা। এদাবি ছিল ন্যুনতম গণতান্ত্রিক অধিকারের। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বাঙালী জনগণকে বোঝানো হবে ওরা উপজতি, ততক্ষণ এ অধিকার স্বীকারের মতো মানসিকতা গড়ে উঠবে না। যুদ্ধের এ মূল কারণ যত দিন না দূর করা হবে, যুদ্ধ ততদিনই চলবে।

১৯৪৭ সালে রাঙ্গামাটিতে ভারতের এবং বান্দরবানে বার্মার ঝান্ডা ওড়ানো হয়েছিল কয়েকদিনে। একই ভাবে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ও পাহাড়ি জনগণ বাঙালী জনগণের মতো স্বতস্ফূর্ত অংশ নেয়নি। রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষে গেছেন, মানবেন্দ্র লারমা যুদ্ধে বলা যাক নিরপেক্ষ ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানের আশ্রিত মিজো বিদ্রোহীদের সাথে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে এ রকম এক যুদ্ধে একজন অফিসার ক্যাপ্টেন কাদেরসহ অনেক বাঙালী মুক্তিযোদ্ধা মিজোদের হাতে মারা পড়েন। যুদ্ধের পর পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা পাকবাহিনীর দোসরদের সন্ধানে প্রথম বাংলাদেশী সামরিক অভিযান শুরু হলে পাহাড়ি জাতিগুলোর সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তদুপরি যুদ্ধের সময় থেকেই পাকবাহিনীর ছায়ায় যে সব সহযোগী বাঙালি ওখানে বসত গাড়তে শুরু করে, স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সরকার তাদের উচ্ছেদ তো করেইনি, বরং নতুন করে লোক এনে বসায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিদের চোখে, এটাই প্রধান রাজনৈতিক সমস্যা বাঙালি সমস্যা। লারমার চার দাবির এটাও ছিল অন্যাতম দাবি।

পাহাড়ি জাতিদের নেতারা দেখিয়েছেন যেখানে ১৯৪৭ সনের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি অধিবাসীর সংখ্যাছিল শতকরা ২ ভাগের মতো সেখানে বর্তমানে তাদের সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগের কোঠা ছুঁই ছুঁই করছে। এরশাদ আমলে যে নতুন জেলা পরিষদ করা হয়েছিল তাতে দেখা যায়, তিন জেলায় মোট বাঙালী সদস্য সংখ্যা ৩০; যা এককভাবে সেখানকার তিন বৃহত্তর জাতির যে কারও সংখ্যা থেকে বেশী (চাকমা সদস্য ২০ জন, মারমা ১৪ জন এবং ত্রিপুরা ৮ জন) ১৯৭১ সালের পর যত বাঙালি সেখানে স্থায়ীভাবে প্রবেশ করেছে, বিশেষতঃ সরকারীভাবে যাদের সেখানে বসানো হয়েছে তাদের ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধানের ২য় শর্ত পূর্ণ হবে না। রাজনৈতিক সমাধানের কথা এখন যারা বলছেন তারা অন্ততঃ শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ নতুন বসতি স্থাপন স্থগিত ঘোষনা করতে পারতেন। দৃশ্যতঃ মনে হয়, সে সদিচ্ছা বাংলাদেশর শাসকদের নেই।

মানবেন্দ্র লারমার আদি (১৯৭২) স্মারকলিপিতে ‘উপজাতীয়’ রাজাদের দফতর সংরক্ষনের দাবিটি ছিল। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষ নাগাদ এই দাবিটি জনসংহতি সমিতির নতুন দাবিনামা থেকে উঠে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে যে শ্রেণী-সংঘাত বিরাজ করে এই দাবির অন্তর্ভূক্তি ও পরিবর্তনের মধ্যে তার খানিকটা আভাস মেলে। এই সংঘাতের ইংগিত ১৯৪৭ সনেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতির এক অংশ “রাজা”র শাসন পদ্ধতির বিরোধীতা করেছিলেন। স্নেহকুমার চাকমার নেতৃত্বাধীন সে অংশ তখন পরাস্ত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালের জন সংহতি সমিতি আর ১৯৭৩ সালের গণমুক্তি ফৌজ, শান্তিবাহিনীর নেতৃত্বে বিকাশশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রাধান্য গড়ে উঠেছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে লারমা ত্রিদিব রায়ের সাথে আঁতাত করেছিলেন; তারপর হয়তো তার আর দরকার পড়েনি। শান্তিবাহিনী যদিও প্রধানত চাকমা জাতির যুব যোদ্ধাদের সংগঠন, এবং খোদ শান্তিবাহিনী যদিও এখন পরিস্কার দ্বিধাবিভক্ত তথাপি এ কথা শান্তিবাহিনীর হাতে। রাজনৈতিক সমাধানের কোন চেষ্টাই এই শক্তিকে পাশ কাটিয়ে সফল হতে পারে না। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী মাঠে যে রকম শান্তি বাহিনীকে স্বীকার করেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সেভাবে স্বীকার করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক রক্ত গড়িয়েছে। শান্তি আসেনি। লারমা নিহত হয়েছেন অন্তর্ঘাতী দ্বন্দ্বে। উপেন্দ্রলাল চাকমা বাধ্য হয়েছেন ভারতে পালিয়ে যেতে। সরকারের সাথে সহযোগীতাকারী হিসেবে চিহ্নিত রাঙ্গামাটির জেলা চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান পর্যন্ত পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির নাজুকতার এর চেয়ে তাপর্যময় অন্য কোন ইঙ্গিত কি হতে পারে ?

বাংলাদেশের সরকারগুলোর মধ্যে অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে কোন বড় মতভেদ এখনও দেখা দেয়নি। এরশাদ আমলে আন্দোলনকারী বিরোধীদল গুলো আন্দোলনের মুখে একবার দেশব্যাপী প্রস্তাবিত উপজেলা নির্বাচন বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৮৯ সনের জুন মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে এরশাদের নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো কিছু বলেনি। সরকারী দমননীতির বিরুদ্ধে প্রধান প্রধান বিরোধী দলের নীরবতা ও পরোক্ষ সমর্থন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন শুভ ইঙ্গিত বহন করেনি। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর পীড়ন ও দমন নীতি আর এক মাত্রা চড়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। শান্তিবাহিনীর সাথে বহু দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়করা। সরকারী কর্মচারীরা আর সামরিক কর্মচারীরা সমাধান করতে পারবেন এমন বিষয়ে সীমিত নেই ওখানকার সমস্যা। অনেকে মনে করেন প্রকাশ্য রাজনৈতিক বৈঠকে মিলিত হওয়াটা যেন পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া। এখন পরাজয় স্বীকারের সময় হয়েছে বাঙালি শাসক শ্রেণীর/জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভয়ে নয়, বিদেশী একটি শক্তির চাপে এবং দূরদেশী সাহায্যদাতাদের চোখ রাঙানিতে এই শাসক শ্রেণী পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথাবার্তা বলছেন। দুঃখটা এখানেই। সৌজন্যেঃ ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’ ১২ জুলাই ’৯২



জনসংখ্যা স্থানান্তর আন্তর্জাতিক আইনে
মানবাধিকার লংঘন
এবার জেনেভায় জাতিসংঘের সম্মেলনে জনসংখ্যা স্থানান্তর সম্পর্কে একটি খচরা প্রস্তাব প্রণীত হয়েছে। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে জনসংখ্যা স্থানান্তর একটি ক্ষতিকর পদক্ষেপ যা সংখ্যালঘুদের অনূভূতিকে আঘাত করে শান্তি বিঘ্নিত করে এবং জাতীয়ও আন্তর্জাতিকভাবে অবিচার মানবাধিকার লংঘনের সামিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই জনসংখ্যা স্থানান্তরের দৃষ্টান্ত আছে। সংশ্লিষ্ট দেশ বা সরকার সমূহ এই কৌশলের মাধ্যমে চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন করছে। ১৯৪৯ সালের ১২ই আগষ্ট ৪র্থ জেনেভা কনভেনশনের ৪৯ অনুচ্ছেদ এবং প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এই স্থানান্তর মারাত্মক মানবাধিকার লংঘন। সাম্প্রতিক এই খচরায় ৬টি প্রস্তাব রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সরকার বিশাল পরিত্যক্ত ভূমি এবং জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে যে রাজনৈতিক জনসংখ্যা স্থানান্তর করেছে তা শুধু মানবাধিকার লংঘন নয় রীতিমত অপরাধ।                                                                     

                                                      


পৃষ্ঠা: ১৮ - ২০

পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও প্রাসঙ্গিক কথা
পল্লব

প্রাক কথা
দশ-এপ্রিল লোগাং গণহত্যা, ২০মে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বর্ষপুর্তি উপলক্ষে সরকারী পেটুয়া বাহিনীর হামলা, অগ্নি সংযোগ, ৩০ মে কাউখালি উপজেলার ছোটডুলুর গণহত্যা, ও বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্ন ধর্ষন নির্যাতন পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে পার্বত্য এলাকায় বর্তমানে অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। দমন পীড়ন ও-যে কোন ধরনের নির্যাতনের মাধ্যমে যে কোন জাতি, জাতিসত্ত্বা বা ব্যাপক জনগণের ন্যায় সংগত আন্দোলন ও সংগ্রামকে কোন অবস্থাতে স্তব্ধ করা যায় না, এটা ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত। শাসক শ্রেণীর নির্যাতনের মাত্রা যতই বৃদ্ধি পাবে, আন্দোলনরত জনগণ ততই ঐক্যবদ্ধ ও সংগ্রামী হবে। হতে বাধ্য তাদের অস্তিত্ত্ব রক্ষার তাগিদে। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দিনের সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলেই তার প্রমাণ মেলে। এ যাবত শাসক দল পাহাড়ি জনগণের ন্যায় সংগত আন্দোলনকে যতই দমন পীড়নের মাধ্যমে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল পাহাড়ি জনগণ ততই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এবং আন্দোলনকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে ও হচ্ছে। এটা হচ্ছে দ্বন্দ্ব বাদের অনিবার্য নিয়ম। নিপীড়নকারী শাসক দল ও তার রাষ্ট্র এভাবে নিজের ধ্বংসকে ডেকে নিয়ে আসে। সে কারণে বৃহত্তর বাংলাদেশের শ্রমজীবী জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রামের সাথে পাহাড়ি জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রাম সম্পৃক্ত হতে সক্ষম হয়েছে। সক্ষম হয়েছে বিশ্বের প্রগতিশীল মানবতাবাদী শক্তি ও সংগঠনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। তাই আজ পাহাড়ি জনগণ তাদের অস্তিত্ত্ব রক্ষার সংগ্রামে একা নয়। সাথে রয়েছে দেশের সকল প্রগতিশীল শক্তি ও বিশ্ব বিবেক। একদিকে বৃহত্তর বাংলাদেশের শ্রমজীবী জনগণের বাঁচার লড়াই। অপরদিকে পাহাড়ি জনগণের অস্তিত্ত্ব রক্ষার মরণ পণ সংগ্রাম। সব মিলিয়ে বৃহত্তর বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের মহান আন্দোলনের ঊর্ধ্বগতি। অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী তাদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহ। তাই অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে ক্ষমতার বাহিরে ও ভেতরে এ শ্রেণীটি বড়ই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। যে কারণে এক দিকে তার রাষ্ট্র যন্ত্রের দ্বারা নিপীড়িত জনগণের উপর পীড়ন অব্যাহত রেখেছে। অপর দিকে সমস্যা সমাধানের নামে নতুন, নতুন অপকৌশল হাতে নিচ্ছে। সেই সাথে এসবের বিরুদ্ধে পাল্টা হিসেবে সকল গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহ নতুন কর্মসূচী হাতে নিচ্ছে। এ প্রবন্ধে এ সবের উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করব।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সরকারী কমিটিঃ- পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজিত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করার দাবী বহুদিনের। সম্প্রতি এ দাবীটি সকল প্রগতিশীল ও শান্তিকামী জনগণের কাছ থেকে আরও জোড়ালো ভাবে উত্থাপিত হওয়ায়, সরকার কিছু একটা করার প্রয়োজন মনে করলেন। তাই সংসদীয় কমিটির পরিবর্তে গঠন করলেন সরকারী কমিটি। যার নাম রাখলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিটি’, গত ৯ জুলাই ১৯৯২ এ কমিটি গঠন হওয়ারপর হতে বিতর্কিত। বিতর্কিত হওয়ার কারণ বহুবিধ। বিতর্কের প্রথম কারণ হচ্ছে পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধানের জন্য গঠিত কমিটিতে সে এলাকার একজন সংসদ সদস্যকেও নেয়া হয়নি। যদিও পরে বহু আলোচনা সমালোচনা ও প্রতিবাদের ফলে একজন সাংসদকে কমিটিতে নেয়া হয়। দ্বিতীয় বিতর্কের কারণ হচ্ছে, যেহেতু এ কমিটি সংসদীয় কমিটি নয় সুতরাং কমিটির কোন কার্যক্রমের জন্য সংসদের কাছে দায়ী থাকবেনা। সরকারের ইচ্ছামত কাজ করবে। যা তাদের সৃষ্ট গণতন্ত্রের বিপরীত। তৃতীয়ত, কমিটি সংসদ অধিবেশন চালকালীন সময় গঠন করা হলেও সম্পূর্ণ সংসদকে এক পাশে রেখে করা হয়েছে। চতুর্থ,অত্র এলাকার সমস্যা সমাধানের কথা বলা হলেও বিতর্কিত জেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করার প্রধান মন্ত্রীর স্ববিরোধী বক্তব্য জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। খালেদা সরকারের এই শিশু বোধ্য চালাকী তার নীতি নির্ধারকদের যতই উর্বর মস্তিকের ফসল হউকনা কেন জনগণ ঠিকই ধরতে পেরেছে। সুতরাং এসব ভন্ড চালাকী বাদ দিয়ে সমাধানের জন্য আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে, সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে জটিলতাই সৃষ্টি হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আঃ লীগের ভূমিকা
পার্বত্য এলাকার সমস্যা যদিও বহু পুরাতন কিন্তু এ সমস্যার স্বরূপ ও গভীরতা বৃদ্ধি পায় মূলত স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে। বিশেষ করে আঃ লীগ তথা শেখ সাহেবের শাসন আমলে। সেই অতীত ইতিহাস নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। ৭৫-এর পর হতে বর্তমান পর্যন্ত দেশের রাজনীতি ও সামাজিক অঙ্গনে অনেক রদবদল হয়েছে বাহ্যিক ভাবে। ক্ষমতার হাত বদলের মধ্য দিয়ে অনেক শাসক ক্ষমতার মসনদে আসল, বিদায়ও নিল। অবশেষে এরশাদ শাহীর নয় বছরের একক সা¤্রাজ্য পতনের পর সৃষ্টি হল বহুল কথিত ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচনের পরিবেশ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো রাস্তা ঘাটে ফেরী করতে লাগলেন তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আঃলীগ ভোট পাবার আশায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের গাল ভরা আশ্বাস দিলেন। অপর দিকে নির্বাচন পন্থী বাম দলগুলোও এলাকার সমস্যা সমাধানের কথা অনেক খোলামেলা ও আন্তরিকতার সহিত বললেও পার্বত্য এলাকায় নির্বাচনে দ্বার করাবে এরকম সাংগঠনিক ভিত না থাকায় পাহাড়ি জনগণ আঃ লীগদের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। কারণ পাহাড়ি জনগণের উপর ইতিমধ্যে নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই যে দিকে সে দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। যার কারণে পার্বত্য এলাকার তিনটি আসনই আঃলীগের ভাগে। পাহাড়ি জনগণের এই রায় আঃলীগকে আরও বেশী দায়িত্ব ছাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আঃলীগ এ দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে তা এখন বিচার্য বিষয়। কথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের বয়স প্রায় দু’ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। এ দু’ বছরে পাহাড়ি জনগণের অনেক তরতাজা প্রাণ দিতে হয়েছে-এই ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের হাতে। হত্যা, ধর্ষন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ এসবের প্রতিবাদে আঃলীগ দলীয় ভাবে কি করেছে ? হয়ত বলবে তারা ক্ষমতায় যেতে পারেনি সুতরাং করার কিছুই নেই। আঃলীগ সত্যি যদি তাই মনে করে থাকে তাহলে বড়ই ভুল করবে। কারণ আঃ লীগ বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান শরীক দল। তার ইচ্ছার অনিচ্ছার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তার প্রমাণ ইতিমধ্যে জনগণ পেয়েছে। ক্ষমতাসীন বি.এন.পি সরকারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আঃলীগের চাপের কারণে সংসদীয় সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়। সরকারী ভাবে দায়েরকৃত ২৪ জন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্যের মামলা তুলে নিতে সরকার রাজী হতে বাধ্য হয়। এসব গুলোর ব্যাপারে সংসদের বাহিরে ও ভেতরে আঃলীগ খুবই তপর ছিল। কিন্তু পার্বত্য সমস্যার ব্যাপারে কেমন যেন ‘ধরি মাছ না ছোই পানি’। পার্বত্য এলাকার কোন জনসভা ছাড়া’ দেশের অপরাপর এলাকায় জনসভায় আঃলীগ নেতাদের পার্বত্য সমস্যা ব্যাপারে কথা বলতে দেখা যায়নি। সংসদের ভেতর ও পার্বত্য এলাকার তিন, এম.পি বাদে দলের প্রথম সারির কোন নেতাকে গায়ে পড়ে কিছু বলতে দেখা যায় নি।অন্যান্য বিষয়ে সরকারী দল, আঃলীগের কোন সদস্যকে সংসদে বলতে বাধা প্রদান করলে দলীয়ভাবে প্রতিবাদ ও ওয়ার্ক আউট করেন। কিন্তু পার্বত্য সমস্যা ব্যাপারে সরকারী দলের মৃদু আপত্তির মুখে সুবোধ বালকের মত বসে পড়তে দেখা যায়। ওয়ার্ক আউটের তো প্রশ্নই আসেনা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হত্যা, ধর্ষন ও বিভিন্ন নির্যাতনের প্রতিবাদে দলীয়গত ভাবে কোন মিশিল, মিটিং, হরতাল সমাবেশ ডাকতে আঃলীগকে আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। আঃলীগ যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে তাদের কার্যক্রম শুধু মাত্র ভোট ঠিক রাখার লক্ষ্যে করে থাকে তা হলে বড়ই ভুল করবে। তাদের এই মনোভাব না পাল্টালে পূর্বে যে ভাবে পাহাড়িরা আঃ লীগকে পরিত্যাগ করেছে ভবিষ্যতে ও সেভাবে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। আঃলীগের প্রতি পাহাড়ি জনগণের সমর্থন কোন ব্যক্তি বিশেষকে দিয়ে নয়। এ সমর্থন দলীয় কর্মসূচীকে লক্ষ্য রেখে।

উপরোক্ত বিষয়াদি বিবেচনা করে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আঃলীগের মনোভাব বি.এন,পির চেয়ে তেমন মৌলিক পার্থক্য চোখে পড়ে না। আঃলীগ জাতিগত সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বেশী দুর এগিয়ে যেতে না পারার কারণ হচ্ছে তার শ্রেণীগত দুর্বলতা। সুতরাং আঃলীগের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশী আশা করাটাও ভুল হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটিঃ

গত ১১ জুলাই ৬৮/২ পুরানা পল্টনে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি উন্মুক্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় এ সম্পর্কিত বিভিন্ন দিক আলোচনা করে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির নাম করণ করা হয়, “পার্বত্য চট্টগ্রাম মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি।” এ কমিটির সব দিক বিচার বিবেচনা করলে নিঃসন্দেহে এটি একটি পার্বত্য সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক দিক। পাহাড়ি জনগণের দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামে নতুন সংযোজন। তারপরও কমিটি যে ছয় দফা দাবী নামা রেখেছে তন্মধ্যে ২ নং ও ৩ নং দাবীগুলোর ব্যাপারে আমার সামান্য দ্বিমত থাকায় তা নি¤œ আলোচনা করলাম।

২ নং দাবীর প্রথম বাক্যে উল্লেখ রয়েছে, “এ অঞ্চলের প্রশাসনকে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে আইন শৃংখলা, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কাজের দায়িত্ব বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে অর্পন।” আমার দ্বিমটি এখানেই। এখানে যদিও সকল স্তরে সামরিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার কথা উল্লেখ রয়েছে কিন্তু সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের কথাটি উল্লেখ নেই, তার অর্থ এই বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য পার্বত্য এলাকায় থেকে যাবে। এখানে উল্লেখ্য বিষয় হচ্ছে, সে দিনের আলোচনা সভায় খসড়া দাবী নামাতে ‘সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের’ কথাটি উল্লেখ ছিল। সে দিন একমাত্র আঃলীগের সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ছাড়া অন্য কেউ ‘সেনা প্রত্যাহারের কথাটি বিরোধীতা করেন নি। শুধু তাই নয়। মিঃ শম্ভু সেদিন, উক্ত কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিষ্টার লুফর রহমান শাহজানের “পাহাড়ি জনগণের স্বাধীকার আদায় সংগ্রাম- কমিটিরও প্রতিবাদ করেছিলেন। সেদিন তার ভূমিকা ছিল শুধু বিরোধীতা করা। যা সরকারী দলের সাংসদ শাহজাহান চৌধুরীও করেন নি। মিঃ শম্ভু যুক্তি দেখান, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় পার্বত্য এলাকায়ও নাকি সার্বভোমত্ব রক্ষার্থে সেনাবাহিনী থাকার প্রয়োজন। কিন্তু তিনি এমন কোন প্রমাণ দিতে পারবেন, পার্বত্য এলাকার মত লক্ষাধিক সেনাবাহিনী দেশের অপরাপর অঞ্চলে রয়েছে। এমন কি তার এলাকায় (বড়গুনায়) কত হাজার সেনা বাহিনী আছে সার্বভোমত্ব রক্ষার্থে ? নিশ্চয় পারবেন না। তাহলে সেনা বাহিনীর প্রত্যাহারের ব্যাপারে এত এলার-জিটিক কেন ? মিঃ শম্ভুর বিরোধীতার দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে ‘স্বাধীকার’ শব্দটি, স্বায়ত্ত্ব শাসনওতো শাব্দিক অর্থ স্বাধীকার। পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধান করতে হলে স্বায়ত্ত্ব শাসনইএকমাত্র উপযুক্ত সমাধান, সুতরাং স্বাধিকার শব্দটি মানতে না পারার অর্থ হচ্ছে পাহাড়িদের স্বায়ত্ত্বশাসন দাবীকে মানতে না পারা। তাহলে মিঃ শম্ভু ও তার দল পার্বত্য এলাকার সমস্যা কিভাবে সমাধান করতে চান ? মিঃ শম্ভু কি সুদীর্ঘ ১৮-১৯ বছরেও চৈতন্য ফিরে পান নি ? ১৯৭৩ সালে তারই রাজনৈতিক গুরু শেখ মুজিব পাহাড়িদের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীকে মেনে নেননি বলে পার্বত্য সমস্যা আজ এতদূর মোড় নিয়েছে। তা থেকে এখনও মিঃ শম্ভু তথা আঃলীগ শিক্ষা নিতে পারেন নি। এ ব্যাপার আঃলীগের কাছ থেকে দলীয়গতভাবে বক্তব্যের প্রত্যাশা রাখছি।

আমার দ্বিমতের দ্বিতীয়টি হচ্ছে ৪ নং দাবীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাক্য দ্বয়ে। এতে লেখা রয়েছে, “এখানে (পার্বত্য এলাকায়) থাকতে অনুনিচ্ছুক বাঙ্গালিদেরকে (অনুপ্রবেশকারী লেখক) অন্যত্র পুনর্বাসন করা। আর থাকতে ইচ্ছুক দেরকে দখলকৃত জমি থেকে সরিয়ে অকৃষি কাজে পার্বত্য এলাকায় পুনর্বাসন করা।” প্রথমে যদি ইচ্ছুক, অনিচ্ছুক ভাগ করা হয় তাহলে নগন্য সংখ্যক হবে ইচ্ছুক। সিংহভাগ থাকবে অনিচ্ছুকদের দলে। কারণ যে সব বহিরাগত বাঙ্গালীরা যারা পার্বত্য এলাকায় গিয়ে পাহাড়িদের জমিজমাতে এতদিন যাবত চাষাবাদ করে জীবন ধারণ করছে, অনেকেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্য বিত্তস্তরে উন্নীত করেছে। সুতরাং তাদের ইচ্ছার উপর যদি ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে পাঁচ লক্ষ বাঙ্গালী থেকে সাড়ে তিন হতে চার লক্ষ বাঙ্গালী থেকে যাবে। এতবড় সংখ্যক লোকজনকে সরকার কোথায় অকৃষিকাজে নিয়োগ করবে ? নেই কোন শিল্প কারখানা। হঠা করে শিল্প কারখানা তৈরি করে এতগুলো লোকের পুনর্বাসন করার মত ক্ষমতা সরকারের পক্ষে কতটুকু সম্ভব হবে ? সম্ভব হলেও তা কতটুকু করবে ? কারণ এ সরকার তো জনগণের সরকার নয়। সুতরাং জনগণ মরুক আর বাঁচুক তার দেখার দায়িত্ব নয়।

এখানে আরও লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ২নং দাবীতে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবীকে বাদ দেয়া ও দাবীতে অনিচ্ছুকদের পার্বত্য এলাকায় রাখা, এ দুয়ের মধ্যে একটি গভীর আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। সেনাবাহিনীরা যেহেতু চাইনা পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধান হউক। সেইহেতু পার্বত্য এলাকায় অবস্থানরত ঐ সব বাঙ্গালীদেরকে দিয়ে নিত্য নতুন কূটকৌশল চালাবে। যা পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার এক বিরাট প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করবে। সুতরাং এ দুটি অংশকে পার্বত্য এলাকায় রেখে পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা হবে নিরর্থক। আশাকরি এই কমিটির বিজ্ঞ নীতি নির্ধারকরা বিচার বিবেচনা করবেন। এবং আসল সমস্যাটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন।

ভারতে আশ্রিত পাঃ চঃ শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে
সম্প্রতি খালেদা ভারত সফর করে শরণার্থীদেরকে ফেরত নিয়ে আসার কথা ব্যক্ত করেছেন ভারতের প্রধান মন্ত্রী নর সিমা রাওর নিকট। তার এই কথার ভেতর কতটুকু আন্তরিকতা রয়েছে তা প্রকাশ পাবে এ সম্পর্কিত কার্যক্রমের মাধ্যমে। অতি সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জে-এন দীক্ষিত বাংলাদেশ সফরে এসে ঐ কথাটি আরও একবার আলোচনার বিষয় বস্ততে পরিণত হয়। শরণার্থীরা ফেরত আসুক তা আমরা একান্তভাবে কামনা করি। কারণ সুদীর্ঘ ৭/৮ বিদেশের মাটিতে যে তারা তেমন ভাল নেই তা সহজে অনুমেয়। বিশেষ করে যে সব ছেলে মেয়ে লেখা পড়া করার বয়স, সবচেয়ে তারাই বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এসব ভবিষ্যত প্রজন্ম সঠিক ভাবে গড়ে উঠতে না পারলে তার বোঝা বহন করতে সমগ্র জাতির এবং ক্ষতি হবে এই দেশ, এই জাতি। তা সরকারকে ভালভাবে অনুধাবন করতে হবে। শুধু মুখে ফেরত নিয়ে আসা হবে, বললে হবে না। সৃষ্টি করতে হবে তার উপযুক্ত পরিবেশ। উপযুক্ত পরিবেশ বলতে গুচ্ছ গ্রামে রাখা হবেনা, জায়গা জমিগুলো ফেরত দেওয়া হবে এসব পুরনো বুলি আওড়ালে চলবেনা। কারণ এসব মুখের বুলির উপর বিশ্বাস করে পূর্বে অনেকে স্বদেশে ফেরত এসেছিলেন। কিন্তু আসতে না আসতে পূর্বের চেয়ে আরও ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়ে অনেকের প্রাণ দিতে হয়ে ছিল। আর যারা প্রাণে বেঁচে ছিলেন তারা অতীতের এই ভয়াবহ স্মৃতি বহন করে বিদেশের শরণার্থী শিবিরে দুঃসহ জীবন অতিবাহিত করছেন। সুতরাং এসব শরণার্থীদেরকে দেশে ফেরত আনার উপযুক্ত পরিবেশ হচ্ছে বহিরাগত বাঙ্গালী ও সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার সহ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। অন্যথায় এ সমস্যা থেকেই যাবে। আর শরণার্থীরা ফেরত আসলে পূর্বের মত গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হবেনা, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। শরণার্থীদের ফেরত আনার উপযুক্ত পরিবেশ বলতে সরকার যদি রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে অন্য কিছুকে মনে করে তা প্রতারণা ছাড়া কিছুই হবে না।

জনসংহতি সমিতি অস্ত্রবিরতি, সরকার ও সেনাবাহিনীর পরস্পর বিরোধী বক্তব্য
গত ১০/৮/৯২ তারিখ জনসংহতি সমিতির অস্ত্র বিরতি ঘোষণা, আবার প্রমাণ করলো পার্বত্য সমস্যা সমাধানে তারা আন্তরিক। তাদের এই ঘোষণা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল এটাকে সমস্যা সমাধানের একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল (অবঃ) অলি আহম্মেদ তার তাক্ষণিক প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিবিসিতে দেওয়া সাক্ষাকারে সমিতির এই ঘোষণাকে স্বাগতম জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদাও অনাস্থা প্রস্তাবের বিপক্ষে সংসদে বক্তব্য রাখার সময় এটাকে ইতিবাচক দিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু খুশী হতে পারেন নি একটি গোষ্ঠী। আর সেটি হচ্ছে, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে পালিত দেশের সবচেয়ে ব্যয় বহুল প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনী। তাই তারা যোগাযোগ মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জমূলক ১৩/৮/৯২ তারিখে এই অস্ত্র  বিরতিকে প্রত্যাখান করে পার্বত্য এলাকায় সেনা সন্ত্রাস অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। ভুলে গেলেন তারা যে অন্যান্য দশ ব্যক্তির মত বেতন ভুগি চাকুরী জীবী ছাড়া কিছুই নয়। সরকার বর্তমান থাকতে রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার অধিকার তাদের নেই। কারণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনী থাকতে হবে রাজনীতির উর্ধ্বে। কিন্তু আমাদের বীর সেনা বাহিনীরা এ দিনের রাজনীতির স্বাদ সহজে ভুলতে পারেন নি। পারেন নি বলে সাধারণ একজন ব্রিগেডিয়ার পদবী প্রাপ্ত সেনা অফিসার দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও যোগাযোগ মন্ত্রীর বক্তব্যের বিপরীতে মত প্রকাশ করলেন। এটা থেকে প্রমাণ হয়, বর্তমান সরকার গণতান্ত্রিক না সামরিক তান্ত্রিক। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সরকার পার্বত্য সমস্যা সমাধানের কথা মুখে ঘোষণা করলেও আদতে পার্বত্য এলাকার সকল মৌলিক অধিকার গুলি খর্ব করে নিচ্ছে। এতদিন এ সরকার আসার পর হতে পার্বত্য এলাকায় মিশিল মিটিং করতে কোন পূর্ব অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। সম্প্রতি এতই স্বাভাবিক পরিস্থিতি সরকার সৃষ্টি করেছেন, মিশিল মিটিং করতে ২৪ ঘন্টার পূর্বে অনুমতি নিতে হয়। যদি স্থানীয় প্রশাসন  সেনাশাসন) তার মনের মত হয় অনুমতি দেবে অন্যথায় নয়। কি দারুণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ। যা দেশের অন্য কোথাও নেই। এটা থেকে কি সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপারে আঁচ করা যায় না?
.................

পৃষ্ঠা: ২১

রাডার’ এর উপর আবার সেই ৭৪-এর মরণাস্ত্র
মিঃ সুপ্রিয়

রাডার’ শব্দটি পাহাড়ি জনগণের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। কারণ রাডারই একমাত্র তাদের অব্যক্ত বেদনা, না বলার কথা ও মুক্তির সংগ্রামী বার্তা নিয়ে গিরি পর্বত অতিক্রমকরে পৌছে দিত। তাই তো অনেক পাঠক একে আখ্যায়িত করেছেন “জুম্ম জাতির মুক্তির পথ প্রদর্শক” হিসেবে। তবে এক শ্রেণীর লোক ‘রাডার’কে সহ্য করতে পারত না। তাই রাডারের আতংকে সদা সস্ত্রস্ত থাকত। কারণ ‘রাডার’ সে সব নির্যাতক, বদমাইশ, নিপীড়নকারী, দালালদের বিরুদ্ধে সব সময় আপোষহীন সংগ্রামের অবতীর্ণ ছিল। রাডারের তীক্ষè লেখনী পার্বত্য এলাকার নিপীড়নকারী সেনাবাহিনী ও দালালদের মুখোশ উম্মোচন করে অতি অল্প সময়ে ন্যাংটো করে ছেড়েছে। খালেদা সরকারের মুখোশধারী ‘গণতন্ত্র’কে তীব্রভাবে আক্রমণ করে নাজেহাল করেছে। তাইতো ‘রাডার’ বড়ই অসহনীয়। রাডারের বয়স খুব বেশী নয়। জন্ম হতে দ্বিতীয় বার নিষিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত ‘রাডার’ মোট পাঁচ সংখ্যা (সংকলন সহ) প্রকাশ হয়েছে মাত্র। কিন্তু এই পাঁচ সংখ্যার দেশের অন্যান্য পত্র-পত্রিকা যা করতে পারেনি ‘রাডার’ তা করেছে। কারণ ‘রাডার’ কারোর দালালী করেনি। নিঃস্বার্থ ভাবে নিপীড়িত জনগণের পক্ষে প্রতিবাদের খর্গ তুলে ধরেছে। তাইতো শুধু পাহাড়ি জনগণের নয়, সকল প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সাংবাদিক সকল স্তরে পরিচিতি লাভ করেছে। ইত্যাদি কারণে শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর রোধানলে পড়তে হলো। তাই গত ১৭/৮/৯২ তারিখ দ্বিতীয় বারের মতো রাডারের উপর প্রয়োগ করল সেই ’৭৪-এর কালো মরণাস্ত্র ৯৯ (ক) ধারা।

রাডারের উপর খালেদা সরকারের এই পদক্ষেপ আবারও প্রমাণ করল; তার সৃষ্ট গণতন্ত্র ও এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু আবরণে। এরশাদের স্বৈরতন্ত্র ছিল উলঙ্গ। আর খালেদার স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের আবরণে আবৃত। কিন্তু সেই আবরণ এতই পাতলা যা সামান্য ধাক্কায় ফুট হয়। যার কারণে খালেদার গণতন্ত্র এখন বে-আভ্রুভাবে জনগণের সামনে বীর দর্পে লাফাচ্ছে। রাডারকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে খালেদার স্বৈরাচারী রক্ষক সেই সেনাবাহিনী ও বিশ্ব বেহায়া জেলা পরিষদের সকল সদস্য এবং দালালরা আনন্দ উল্লাসে বিভোর।

মানবতাবাদ ও গণতন্ত্রের শত্রু পূর্বের চেয়ে এখন খুব বেশী সক্রিয়। খুনের উন্মুক্ত নেশায় এখন মত্ত্ব। জনতার কাতারে অনেক মুখোশধারী দালাল আত্মগোপন করেছে। অনেক দেশ প্রেমিক বুলি আওড়িয়ে জনগণকে ধোকা দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা রাস্তা ঘাটে দালালের চৌদ্ধ পুরুষ উদ্ধার করছে, আর রাতের অন্ধকারে দালালদের সাথে মলাকাত করে দালালীর একটা ভাগ পকেটস্থ করছে। সুতরাং জনগণকে আরো বেশী সচেতন, ঐক্যবদ্ধ, প্রতিবাদী হতে হবে। সকল প্রকার জনতার শত্রুকে নির্র্মূল করতে হবে। আঘাত করতে হবে স্বৈরাচারের মূলে। তার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট আদর্শ। বিজ্ঞান ভিত্তিক আদর্শ। যে আদর্শই একমাত্র নির্র্মূল করতে পারে নিপীড়িত জনতার শত্রুকে। প্রতিরোধ করতে হবে মিত্রবেশী সকল সা¤্রাজ্যবাদের কালো শক্তিকে। ছিনিয়ে আনতে হবে নিপীড়িত জনগণের অধিকার। তাই আসুন নিপীড়িত জনগণের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের নিপীড়িত এই অশুভ শক্তি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চির নির্বাসিত করি। উর্ধ্বে তুলি ধরি সেই সর্বহারা মেহনতি শ্রেণীর বিজয় পতাকা। ‘রাডার’ পাঠকদের শেষ আহবান জানাতে ‘স্যাটেলাইট’-এর আশ্রয় নিলাম। বিদায়ের সন্ধিক্ষণে, আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ‘রাডার’ এখন সেই দানবীয় আইনের কষাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। তাই তাকে মুক্ত করার দায়িত্ব আপনাদের উপর অর্পণ করে গেলাম। তা পালন করবেন কি?                        
আবারও দেখা হবে সেই দিন, যে দিন দেশ থেকে স্বৈরাচার চির নির্বাচিত হবে।
 
 
পাঠকদের প্রতি
বহু সংগ্রাম ও আন্দোলনের ফলে আজ পার্বত্য সমস্যা সমাধানের একটি ক্ষীণ পথ সৃষ্টি হয়েছে। দেশেল সকল শান্তিকামী জনগণের চাপের ফলে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও সমাধানের কথা মুখে তুলতে বাধা হয়েছে। যার কারণে বর্তমানে একটি সরকারী কমিটিও রয়েছে এ বিষয়ে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পার্বত্য এলাকার দীর্ঘদিনের এসব সমস্যাকে কিভাবে সমাধান করা সম্ভব? কোন ধরনের সমাধানের মধ্যে পাহাড়ি জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষিত হতে পারে? এ বিষয়ে পাঠকদের মতামত কি? তাই আপনাদের মতামত লিখিত আকারে আমাদের ঠিকানায় পাঠাবার আহবান জানাচ্ছি। আশাকরি আপনাদের মূল্যবান মতামত পাঠাবেন।

সম্পাদক পরিষদ  
 
 



পৃষ্ঠা: ২২


কমরেড গুজমান লাল সালাম
কমরেড গুজমানের গ্রেফতারের প্রতিবাদ
পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান এবং বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণীর অন্যতম নেতা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আতংক কমরেড ‘অ্যাবিম্যাল গুজমান’ ওরফে গণজালো গত ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী লীমার সার্কিলো অঞ্চলের ৪৫৯ নং একটি দোতলা বাড়িতে সাতজন সঙ্গী সহ গ্রেফতার হন। কমঃ গনজালো এমন সময় গ্রেফতার হন যখন সমগ্র দেশ ব্যাপী গণযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের দালাল পেরুর বর্তমান শাসক আলবার্তো ফুজিমুরি পেরুর শ্রমজীবী জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামের ফলে দিশেহারা। খোদ রাজধানী লীমাতে সাইনিং পার্থ গেরিলাদের আক্রমাণের ভয়ে আশে পাশে জারি করেছে জরুরী অবস্থা।
কমঃ গণজালোর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে পেরুর গণযুদ্ধ আজ প্রায় সাফল্যের দ্বার প্রান্তে। মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের সকল অপকৌশল আজ পেরুতে ব্যর্থ। সর্ব শেষ ফুজিমুরি ঘোষণা করেন গণজালোর মাথার দাম ১০ লাখ মার্কিন ডলার। সুতরাং এটা থেকে প্রমাণ হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ফুজিমুরির নিকট গণজালো কত টুকু আতংকের। তাই গণজালোকে ধরার এবং যে কোন ভাবে হত্যা করার জন্য সকল প্রকার শক্তি নিয়োগ করেছিল যা ১২ সেপ্টেম্বর সম্ভব হলো। গ্রেফতারের পর হতে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন তো রয়েছেই। তাছাড়াহত্যা করার জন্য চলছে নতুন নতুন অপকৌশল, আমরা “হিল লিটারের ফোরামের” পক্ষ থেকে কমঃ গণজালো সহ তার সহকর্মীদের উপর যে কোন ধরনের নির্যাতনের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ করি। সাথে সাথে বিশ্বের সকল বিপ্লবী জনগণও পার্টির প্রতি আহ্বান জানাই। আসুন বিশ্বব্যাপী একাধিপত্য বিস্তারকারী মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ ও দেশে দেশে তার দালাল প্রতিনিধির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলি। বিশ্বের অজেয় সর্বহারা শ্রেণীর মতবাদকে বুকে ধারণ করে সকল প্রকার সা¤্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিষ দাঁত ভেঙ্গে দিই।

কমঃ গণজালো সহ বিশ্বের সকল মেহনতি জনগণের বিপ্লবী বন্ধু; যারা আন্দোলন, সংগ্রামে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময় আত্মহুতি দিয়েছেন, অথবা ফ্যাসিবাদী সরকার কর্তৃক জেল, জুলুম শারীরিক নির্যাতন সম্মুখীন হয়েছেন বা হচ্ছেন তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মেহনতি জনগণের রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যে অগ্রসর হই। কমঃ গণজালো পেরুর জনগণের সঙ্গে আর প্রত্যক্ষভাবে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তার সঠিক দিক, নির্দেশনা। যার পথ বেয়ে পেরুর মেহনতি জনগণ তাদের অধিকার কায়েম করবেন। পেরুর মেহনতি জনগণের জয় হবে, হবেই। পেরুর মেহনতী জনগণের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক। কমঃ গণজালো লাল সালাম।

অবিলম্বে আবিমেল গুজমানে মুক্তি দিন
গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট
গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য বদরুদ্দীন উমর, ম, নুরুন্নবী, লুফর রহমান ও ফয়জুল হাকিম এক বিবৃতিতে পেরুর স্বৈরতন্ত্রী সরকার কর্তৃক পেরুর গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক আন্দোলনের নেতা আবিমেল গুজম্যান গ্রেফতার হওয়ায় ও তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদানের চক্রান্ত পরিচালনার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে আবিমেল গুজমানের মুক্তির দাবি জানান এবং গুজমানের মুক্তির দাবীতে দেশের সকল গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী শক্তির প্রতি সোচ্চার হবার আহবান জানান।
.........................


পৃষ্ঠা: ২৩

৭১ দিন কারাবাস এবং বন্দী ৬ জনের একটি মূল্যায়ন
প্রদীপন খীসা

সময়ের চক্রাবর্তনের ৭১ দিন আমাদের জীবন থেকে খসে গেলো সেই তালাবদ্ধ ছোট্ট কারা প্রকোষ্টের মধ্যে। জীবন ইতিহাসে রচিত হলো এক নব অধ্যায়। বৈচিত্র্যময় বিশাল পৃথিবীর ভিন্ন এক জগ সেই হাজত এবং কারাগার। বেদনাময় ও দুঃসহনীয় জীবনের বর্ণনা দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাস্তবে শিকার না হলে অনুভব করাও কঠিন। যারা হাজত এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন তারাই একমাত্র সেই বাস্তবতা উপলব্ধি ও অনুভব করতে পারেন। হয়ত অনেকেই উইনি মেন্ডেলার (দক্ষিণ আফ্রিকার কৃঞ্চাঙ্গ নেতার স্ত্রী) দুঃসহনীয় কারাজীবনী পড়েছেন ও শুনেছেন। আমরাও (৬ জন) সেইভাবে  (দোজক) নারকীয় বাস্তবতার শিকার হয়েছি। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসক গোষ্ঠীর দ্বারা যেভাবে কৃঞ্চাঙ্গরা বর্ণবৈষম্যের শিকার, নির্যাতন নিপীড়নের শিকার এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয় তা কারোর অজানা নয়। অনুরূপ ভাবে আজ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরাও কৃঞ্চাঙ্গদের মত শিকার হচ্ছে। আবাল, বৃদ্ধ বণিতা কেহই রেহায় পাচ্ছে না অবর্ননীয় পৈশাচিক নিপীড়ন নির্যাতন এবং লোমহর্ষক হত্যালীলা থেকে। তাই আমরাও রেহাই পাইনি সেই দেবতুল্য দানবদের কালো হাতের মহা সুশাসন থেকে। সমস্যা সমাধানের জন্য মাননীয় স্পীকারের নিকট স্মারকলিপি দেয়া কি অগণতান্ত্রিক ? নাকি দেশদ্রোহীতা ? আজ দিবালোকের মত সুস্পষ্ঠ যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের নামে সমস্যাকে কারা আরো জটিল করছে। এতে লাভবান হচ্ছে কে ? সরকার না দেবতুল্য দানবরা ? নাকি বাংলাদেশের গরীব জনগণ ? এ সমস্যা সমাধানের পাঠক মহলই প্রকৃত সমাধানের রাস্তা বের করবেন।

পাহাড়িদের রক্তে গড়া প্রাণ প্রিয়-সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ১৭ই ফেব্রুয়ারী /৯২ ঢাকায় এক বিশাল ছাত্র সমাবেশ ও স্পীকারের নিকট স্মারকলিপি প্রদান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজিত সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ঐ দিন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে মাননীয় স্পীকারের সমীপে ৫ দফা দাবী সম্বলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। মাননীয় স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং সমস্যা সমাধানার্থে একটি কমিটি গঠনেরও আশ্বাস দেন। সংবিধানুসারে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। তাই আমাদের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদও গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সরকারের নিকট বার বার দাবী উপস্থাপন করে আসছে। ১৭ই ফেব্রুয়ারীর অনুষ্ঠান তারই একটি। আমরা যথারীতি অনুষ্ঠান শেষে ঢাকা থেকে খাগড়াছড়িতে ফিরছিলাম। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের গণতান্ত্রিক শাসন বিচিত্র। দেবতুল্য ক্ষমতাবান সেনা দানবরা ১৮ই ফেব্রুয়ারী হাতিমুরার সেনা ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জাকির এর মাধ্যমে ৭৭ জনের মধ্যে আমাদের ৬ জনকে আটক করে। আটকের সেই দিন থেকে কারামুক্তি পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত জীবনের বিচিত্রময় অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।

১৮ই ফেব্রুয়ারী সকাল ৮ টার দিকে আমাদের গাড়ি চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। দ্রুতগতিতে গাড়ির চাকা ঘুরছে। এক সময় মানবাধিকারের স্বর্গপুরী পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার দিকে গাড়ি প্রবেশ করতে যাচ্ছে এমনি মুহুর্তে গাড়ি থামলো। সামনে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর একটি চেকপোষ্ট। ড্রাইভার সাহেব নির্বোধ বালকের মত আমাদের সবাইকে অনুরোধ করলেন, “গাড়ি থেকে আপনারা সবাই নিজ ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে পড়–ন চেক হবে।” গাড়ি, ব্যাগ এবং সবার দেহ তল্লাসী হলো। তারপর গাড়ি আবার দ্রুতগতিতে ছুটছে। রাস্তার দু-ধারে কোন গাছ পালা নেই। ছোট বড় মরুভূমির মত টিলা আর পাহাড় ন্যাড়া মাথায় সকরুণে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হাফ কিলোমিটার অন্তর, অন্তর ছোট, ছোট ঘরে বসে আর্মি, বিডিআর এবং আনসারের জোয়ানরা টহল দিচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে যেন মানবাধিকারের স্বর্গপুরি পার্বত্য চট্টগ্রাম এক রণক্ষেত্র, যেন ভিয়েতনাম, যে কোন মুহুর্তে আগ্নেয়াস্ত্রের রণ হুংকার দেবে। আবার চলন্ত গাড়ি হঠা থামলো। যান্ত্রিক গোলযোগ (?) কিন্তু না। সেনা বাহিনীর এক দানব ড্রাইভারকে চাইনিজ এস, এম, জি, তাক করে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। দানব প্রশ্ন করে “বেটা তোর গাড়িতে কেবল পাহাড়ি কেন ? গাড়িতে কি আছে, গাড়ি যেতে পারবে না। উপরের অর্ডার। শুনেছি বাঙালিরা নাকি সাহসী জাতি কিন্তু ড্রাইভার কিছুই বলতে পারলো না। তাই আমরা সাহস নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। অনেক কথোপকথন হলো। দানবটা চায় আমাদের ৭৭ জনের বিস্তারিত বায়োডাটা। কিন্তু সেই মুহুর্তে তা কি সম্ভব? তাই আমরা বললাম আপনাদের যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ব্রিগেড অফিসের সাথে যোগাযোগ করুন। আমরা ব্রিগেডে গিয়ে সবকিছু দিয়ে আসবো। সে সময় একজন দানব কোথায় যেন কি জানাচ্ছে ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে। এক ঘন্টার পর সেই দানবরা গাড়িসহ আমাদের ছেড়ে দিলো। যেতে পারো ব্রিগেডের অর্ডার। কিন্তু না। কিছুদূর এগুতেই আবার গাড়ি থামলো। সামনে রাস্তায় এবং রাস্তার দু পাশে ইউ আকৃতির সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দানবদের ব্যারিকেড। প্রায় ৬০/৭০ জন দানব জোয়ান সমরাস্ত্র সজ্জিত এবং গাড়ির দিকে তাক্করা-ট্রিগার টানলেই কাজ শেষ।

দেবতুল্য ক্যাপ্টেন মহাশয় গাড়ি থেকে দল নেতাকে নামালেন এবং দু-জনের মধ্যে কিছু কথোপথন হলো। আমাদের দল নেতা এসে বললেন “ক্যাপ্টেন মহাশয় গাড়ি চেক করবে সবাই নেমে যান।” কিন্তু না এবার মহাশয় ৭৭ জনের বিস্তারিত বায়োডাটা এবং ফটো উঠাতে চায়। বায়োডাটা দেয়া হলো কিন্তু কেউ ফটো উঠতে রাজী নয়। কারণ সবার ধারণা ফটোর মাধ্যমে পরবর্তীতে ধরপাকর বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত এবং বিভিন্ন মামলায় জড়াতে পারে। এ ধরনের বাস্তবতা এবং সত্যতা আগেও অনেক ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের ৭৭ জনকে জোর করে ফটো উঠায় সেই বিবেকহীন ক্যাপ্টেন দানবটা। ৬ জনকে বাচাই করলেন এবং বললেন এই ছয়জনে তোমাদের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে মানিক ছড়ি জোন কমান্ডারের সাথে কথা বলবে এবং আমাদের গাড়িতে করে আজকেই এদের ছয়জনকে খাগড়াছড়িতে পৌছে দেয়া হবে। বাকিদের চলে যাবার নির্দেশ। কিন্তু সহযাত্রী ছাত্রছাত্রীরা আমাদেরকে রেখে চলে যেতে রাজি নয়। তারা বলতে চায় আমরা এক সাথে এসেছি এক সাথে যাবো আর থাকলে এক সাথে থাকবো সবাই। অনেক বার্গেনিং আর যুক্তি কিন্তু দানবটার কিছুই কর্ণপাত হলো না। বরং সহযাত্রী ছাত্রছাত্রীদের গালিগালাজ এবং ছাত্রীদের প্রতি কুট বাক্য ও দুর্ব্যবহার করলেন। যা ঘৃণা করার কোন ভাষা নেই। এমন ন্যাক্কারজনক ভাষা ব্যবহার কোন বিবেকবান ব্যক্তির পরিচয় বহন করে না। অথচ তিনি একজন ক্যাপ্টেন, সেনাবাহিনীর অফিসার শ্রেণীর সদস্য।                                                                   
[চলবে]
.....................

পৃষ্ঠা: ২৪





পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, খাগড়াছড়ি জেলা শাখা কাউন্সিলের প্রস্তাবনা

গত ১১ সেপ্টেম্বর ’৯২ তারিখে খাগড়াছড়ি জেলা শাখার কাউন্সিল সম্পন্ন হয়। ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নব গঠিত কমিটিতে ক্যাজরী মার্মাকে সভাপতি ও প্রদীপন খীসাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। উক্ত কাউন্সিলে পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা ও সাধারণ সম্পাদক করুনাময় উপস্থিতছিলেন। কাউন্সিলে যে সব প্রস্তবনাবলী তুলে ধরা হয় তা নিম্নে দেয়া হলো :

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এই সম্মেলনে নিম্নোক্ত প্রস্তাব ঘোষণা করেছে।

১। জেলা পরিষদ বাতিল পূর্বক সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদানের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে।

২। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিরসনকল্পে অচিরেই জনসংহতি সমিতির সাথে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে।

৩। পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাসমূহের ভূমিসত্ত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে।

৪। বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারী উদ্যোগে পুনর্বাসিত সমতলবাসীদের ফিরিয়ে নিতে হবে। বান্দরবানসহ বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

৫। সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বেসামরিকীকরণ করতে হবে।

৬। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রিত শরণার্থদের আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে ফিরিয়ে আনতে হবে।

৭। মংথোয়াই ও কালাচান সহ আটককৃত সকল বন্ধীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ দ্ব্যর্থহীনভাবে মনে করে উপরোক্ত উত্থাপিত প্রস্তবনাসমূহ বাস্তবায়িত না হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় এবং এর ব্যতিক্রম পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের কাছে গ্রহণ যোগ্য হবে না।
--------------------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন