পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২১

জুম্মকণ্ঠ

* বইটির পিডিএফ কপি পেতে ক্লিক করুন এখানে


সম্পাদকীয় নোট:

হিল লিটারেচার ফোরামের পুরাতন প্রকাশনা ‘জুম্মকণ্ঠ’ অবশেষে আপলোড করা হলো। ফোরামের অপর দু’টি প্রকাশনা রাডার ও স্যাটেলাইট সরকার কর্তৃক পর পর নিষিদ্ধ হওয়ার পর এটি প্রকাশ করা হয়েছিল। এর একটি মাত্র সংখ্যা প্রকাশের পর আর ছাপা হয়নি। তবে হিল লিটারেচার ফোরামের সাথে জড়িতরা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে তাদের প্রকাশনার কাজ চালিয়ে যান।

“হিল লিটারেচার” নামে হিল লিটারেচার ফোরাম থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক একটি প্রকাশনাও ছাপা হয়েছিল। তবে এটিও একটি মাত্র সংখ্যা প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে যায়। এই সংখ্যাটিও পরবর্তীতে এখানে তুলে দেয়ার চেষ্টা করা হবে।

মূলত: হিল লিটারেচার ফোরামের পুরাতন প্রকাশনাগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সবার কাছে সহজলভ্য করে দেয়ার উদ্দেশ্যে আমাদের এই উদ্যোগ।

আশাকরি গত শতকের ৯০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে বর্তমান প্রজন্মকে হিল লিটারেচার ফোরামের প্রকাশনাগুলো কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।

আমাদের উদ্যোগ ও প্রকাশনাগুলো সম্পর্কে কোন মতামত, সমালোচনা ও পরামর্শ থাকলে তা জানানোর অনুরোধ থাকলো।

২৬ নভেম্বর ২০২১

....................................

জুম্মকন্ঠ

সংখ্যা : ১. ২০ নভেম্বর ’৯২ ইং

১০ই নভেম্বর ’৮৩ স্মরণে

*বহির্বিশ্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম *সাক্ষাতকার: পংকজ ভট্টাচার্য্য, সভাপতি, ন্যাপ

*ডেট লাইন জুরাছড়ি *দীঘিনালার ঘটনা *আইন সংক্রান্ত প্রতিবেদন

লোগাং তদন্ত রিপোর্ট :

পাকিস্তান কি বাংলাদেশের চেয়ে বেশী গণতন্ত্রী?

জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও তার নেতৃত্ব

 

লও লও লও লাল সালাম


অতি শোক আর গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সারম্ভরে পালিত হল এম, এন, লারমার নবম মৃত্যু বার্ষিকী। জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে সংগ্রামের অগ্নি মশাল হাতে যে অগ্রদূত এগিয়ে এসে আত্মোসর্গ করলেন তার অবদান সকল বিতর্কের উর্ধ্বে। এমন কি তার হন্তাকারী কুচক্রীদের প্রধান অবলীলায় স্বীকার করে ইতিহাসের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা জানিয়ে বলেছে, “ইট ওয়াজ এন এক্সিডেন্ট”। ইতিহাস এই হত্যাকারীদের ক্ষমা করলেও নব প্রজন্ম ক্ষমা করতে পারে নি যুগে যুগে। তাই শোকস্মৃতি থেকে জন্ম নিয়েছে প্রতিবাদ। অঙ্গীকার। লারমার স্মৃতিস্তম্ভে ফুলের অর্ঘ্য দিয়ে শপথ নিয়েছি বারে বার তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের। আজকের এদিনে আমাদের শ্রদ্ধেয় লিডারের স্বপ্ন চেতনা ধারণ করে আসুন আমরা সর্বোতভাবে নিবেদিত হই, ভাগ্যাহত জুম্ম জনগণের ন্যায্য অধিকার অর্জনের গৌরবোজ্জ্বল লড়াইয়ে।

 


এই তো সেদিন চৌদ্দই অক্টোবর মাইনী নদীর ধারে চিতাগ্নির লেলিহান শিখায় ছাই হয়ে গেল ভরদাস মনির নিষ্প্রাণ দেহ। অগুনতি অগ্নিমশাল প্রজ্জ্বলিত হয়ে একটি নিষ্পাপ জীবনের মৃত- দেহ নিঃশেষ করে মাইনী উপত্যকায় একরাশ আতঙ্ক আর শোকের পাহাড় গড়ে যায় এই দুঃসময়। লক্ষ জুম্ম জনতার মনের গভীরে সতত জেগে উঠে চেতনার শহীদ মিনার। আন্দোলনে উত্তাল প্রজন্মের অনুভূতির দেয়ালে ছুঁয়ে যায় প্রতিবাদের অমোঘ নেশা। ক্রমধাবমান এ নেশা সংগ্রামের ডাক দিয়ে যায় গণমানসে। শোকাবহ নির্মম হত্যার স্মৃতিরা এক এক করে নির্মাণ করে দেয় বারুদের স্ফুলিঙ্গ। চোখ বুজে বলে দেয়া যায় তেজোদীপ্ত এ স্ফুলিঙ্গকে শত সহস্র নিপীড়ক সামরিক স্থাপনাও নেভাতে পারবে না সেদিন। এ সাদামাথা সত্যটি বুঝতে কেন এত কষ্ট হয় সেনা শাসকদের?

আমরা জানিই একদিন অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে প্রতিটি জীবনের। কিন্তু কোন দিন মৃত্যু নেই একটি শোকার্ত চেতনার। রক্তপাত, নির্যাতন, হত্যা আর গ্রেফতারের নৈমিত্তিক অপকৌশলগুলো অব্যাহত প্রয়োগ করবেই ঐ কুচক্রী সেনা সন্ত্রাসীরা। তবুও আমাদের মা শহীদ ভরদ্বাজ মনির বিধবা স্ত্রী আর সহযোদ্ধা চয়নদের মত লক্ষ তরুণের সুযোগ্য পিতারা সাহস যুগিয়ে যাবে তারুণ্যকে। তাদের আশীর্বাদ আর সাহসের মন্ত্রে বলিয়ান হয়ে দুর্বার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই অগ্নিযুগের সূর্য সন্তানরা। তাই বন্ধুরা এসো সংগ্রামের ডাক দিয়ে যাই। শহীদ ভরদ্বাজ মনির রক্ত কোনদিন বৃথা যেতে দেব না। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে জুম্ম জনতার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করবোই।

 

সম্পাদনা পরিষদঃ                                                                                          

সভাপতি : অপ্রিয়                                                                         

সদস্য : শ্যামল বিকাশ

           রাজেন্দ্র কুমার

সম্পাদক : সমর জ্যোতি                                                                  

নির্বাহী সম্পাদক : চাইলা অং                                                                                       প্রধান প্রতিবেদক : সুকুমার                                                                                            সার্কুলেশন ম্যানেজার : দুর্জয়                                                                                 
অংকন : রসদ                                                                                                           শিল্প নির্দেশনা : ধীবর

যোগাযোগঃ                                                                                                          জগন্নাথ হল, পূর্ব বাড়ী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়                                                                                                  ঢাকা

প্রাপ্তিস্থান :                                                                                                           

* পাঠক সমাবেশ,                                                                                                
১৭, এ আজিজ মার্কেট,                                                                                      
শাহবাগ, ঢাকা।

* দীপ্র প্রকাশনী, ৬৮/২,
পুরানা পল্টন,
বা স স-এর নীচে

 

জুম্মকন্ঠ

সম্পাদকের পাতা

অবশেষে গণতন্ত্রের খোলস থেকে বেরিয়ে পড়েছে স্বৈরতন্ত্রের ড্রাকুলার। আক্রান্ত হয়েছে জুম্ম জনতার কন্ঠস্বর। নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে রাডারের বিচরণ। সময়ের দাবী মেটাতে “স্যাটেলাইট” আবিস্কৃত হয় নির্ভীক প্রজন্মের হাতে। সন্ত্রস্ত হয় ভীরু সরকার। ‘গণতন্ত্রের’ নাক দিয়ে তারা রাষ্ট্রদ্রোহীতার গন্ধ পায় “স্যাটেলাইট-এ”। সুতরাং ফোজদারী দণ্ডবিধি ৯৯ক ধারা প্রয়োগে বানবিদ্ধ হয় স্যাটেলাইটও। আমরা আমাদের সমস্ত সত্তা দিয়ে নিন্দাবাদ ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা বলি, জুম্ম জনতার বাকশক্তি কেড়ে নেয়ার অধিকার কারোর নেই।

তাই তারুণ্যের অদম্য শক্তিতে ভরপুর এ প্রজন্ম থেমে থাকে না। যেখানেই বাধা সেখানেই ভাঙ্গার সংগ্রাম - এই সংগ্রাম চলে নিরন্তর। তাই স্বৈরাচারের কালো থাবায় জর্জরিত হতে পারে ‘রাডার, ‘স্যাটেলাইট”, কিন্তু স্তব্ধ হয় না জুম্ম জনতার প্রতিবাদী কন্ঠ। পার্বত্য কোলের নিপীড়িত জনতার কথা বলতে, পার্বত্য চট্টলার সঠিক চিত্র তুলে ধরতে আর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এগিয়ে নিতে “জুম্ম কন্ঠ” আবির্ভূত হয় সে কারণেই।

আমরা কোন রাষ্ট্রবিরোধী নই। আমরা জনতার কথা বলতে চাই। সংবিধানের মৌলিক অধিকার আমাদেরও প্রাপ্য। সেনানিয়ন্ত্রণহীন শোষণ-নিপীড়ন মুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামই আমাদের কাম্য ও লক্ষ্য। আমরা সকলের সহযোগিতা কামনা করি।

“জুম্মকন্ঠে” প্রকাশিত সকল বক্তব্য ও মতামতের দায়-দায়িত্ব একমাত্র “জুম্মকন্ঠ” সম্পাদনা পরিষদ ও সম্পাদকের।

 

পাহাড়িদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না

গত ১৩ই অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রামে জেকে বসা শাসক শোষকের কালো হাতে দিঘীনালায় আরও একটি বিয়োগান্তক প্রাণনাশ সংঘটিত হল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নাতিদীর্ঘ ইতিহাসের পাতায় প্রথম নাম লেখালেন শহীদ ভরদ্বাজ মনি। ২০শে মে রাঙ্গামাটি ষড়যন্ত্রেরই ধারাবাহিকতা এই পরিকল্পিত খুনের কোন ক্ষমা নেই। পাহাড়ি ছাত্র সমাজ বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলেছে “খুনের বদলায় স্বায়ত্তশাসন আনবোই। তাই রক্ত দিয়ে যে আত্মাহুতি দিলেন তার রক্ত কোন দিন বৃথা যেতে পারে না।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান সরকারের হাতে

বর্তমান সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যকার প্রথম বৈঠকের মধ্যদিয়ে উভয়ের আন্তরিকতা এবং সর্বোপরি জনসংহতি সমিতির অস্ত্র বিরতির মেয়াদ বৃদ্ধিতে যে ইতিবাচক ভূমিকা পরিলক্ষিত হল তাতেই সুস্পষ্ট হয়ে গেল গোটা ব্যাপারটি এখন সরকারী সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তবে যোগাযোগ মন্ত্রী অলি আহমেদের “স্বায়শাত্তসন কোনভাবেই মেনে নেয়া হবে না” ধরনের বক্তব্যে আশ্বস্ত হওয়ার পুরো ব্যাপারটি ঘোলাটে হয়ে গ্যাসে। তবুও আমরা আলোচনার অগ্রগতি কামনা করে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করছি। একই সাথে শান্তি, স্থিতিশীলতাসহ জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে যাবার আহবান জানাই। 

[হিল লিটারেচার ফোরামের পৃষ্ঠপোষকতায় জুম্মকন্ঠ প্রকাশনা কমিটি ও সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত।]


সংবাদ পরিক্রমা

পাহাড়ি গণ-পরিষদের সভা

গত ১৯শে অক্টোবর খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি গণ-পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন এবং পর্যায়ক্রমে শাখা কমিটি গঠনের জন্য সাংগঠনিক সফর সংক্রান্ত বিশদ আলাপ করা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন শক্তিপদ ত্রিপুরা, বিশ্বজি চাকমা, কিরণ মারমা, সৌখিন চাকমা। এতে সংগঠনের বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন প্রধীর তালুকদার। সভায় সভাপতিত্ব করেন চাথোয়াই মারমা।

হিল উইমেন ফেডারেশনের কর্মতপরতা

গত ১০ ই অক্টোবর মাটিরাঙ্গায় সফর করেন। মাটিরাঙ্গায় তারা অনেক মহিলা কর্মীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়ে সাংগঠনিক কর্মসূচী সম্পর্কে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে ১৩ই অক্টোবরের দিঘীনালা ছাত্র গণ সমাবেশে যোগ দিতে আরও সফর সঙ্গী হন উর্মী চাকমা। আশা করা হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ হিল উইমেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সম্মেলন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও পাহাড়ি গণ-পরিষদের যৌথ সাংগঠনিক সফর

দিঘীনালাতে ১৫ই অক্টোবর থেকে ১৭ই অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাপক গণ সংযোগ কর্মকা- পরিচালিত হয়। এ পর্যায়ে প্রথমে বাবুছড়ায় এক ছাত্র গণসমাবেশ হয়। ঐ দিন অর্থা ১৫ই অক্টোবর রাত সাতটায় উদল বাগান এবং ১৬ই অক্টোবর বরাদামে পর পর দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বরাদাম সমাবেশে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক কে এস মং বানছড়া গ্রামের নাম এবং মাইনী ব্রীজের নাম ভরদ্বাজ মনি গ্রাম বা ব্রীজ নামে ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য ভরদ্বাজ মনিকে ১৩ই অক্টোবর সেনা বাহিনীর লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসবাদীরা খুন করে। এই ভরদ্বাজ মনিই পাহাড়ি জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রথম শহীদ। তার স্মৃতি রক্ষার্থে দিঘীনালায় স্মৃতিফলক স্থাপনের সিদ্ধান্তও কে এস মং বলেন। বরাদাম সভার পর নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে ৪৫ জনের একটি কর্মী বাহিনী বানছড়া অর্থা ভরদ্বাজ মনি গ্রামে যান এবং শহীদ পরিবারের সাথে সাক্ষা করে আরও দুটি সমাবেশ হয়। প্রত্যেকটি সভায় বক্তব্য রাখেন, গণ-পরিষদের প্রধীর তালুকদার। ছাত্র পরিষদের করুনাময় চাকমা, কে এস মং ও রূপক চাকমা।

হিল লিটারেচার ফোরামের কমিটি গঠিত

গত ২৩ শে অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের একমাত্র রাজনীতি সচেতন সাহিত্য গোষ্ঠী “হিল লিটারেচার ফোরামের” এক সভা হয়। সভায় ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। শশাংক চাকমাকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত সভায়, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম, কাউখালিসহ বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য সাময়িকভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়েছে। এই কমিটি আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য কনভেনশন পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবে।

সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত

গত ৫ নভেম্বর ’৯২ খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচ ঘন্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত উক্ত বৈঠকে আগামী এক মাসের মধ্যে আরেক দফা বৈঠক অনুষ্ঠানে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। জনসংহতি সমিতি তাঁদের আন্তরিকতার নিদর্শন স্বরূপ আগামী ৩১ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ বিরতির মেয়াদ বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। ইতিপূর্বে সমিতি ১০ই আগষ্ট থেকে ১০ই নভেম্বর ’৯২ পর্যন্ত একতরফা যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দিয়েছিল।

উক্ত বৈঠকে জনসংহতি সমিতির পক্ষে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এবং সরকার পক্ষের নয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটির নেতৃত্ব দেন যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল (অবঃ) অলি আহমেদ।

জনসংহতি সমিতির পক্ষে অপর প্রতিনিধিরা হচ্ছেন রক্তোপল ত্রিপুরা, রূপায়ন দেওয়ান, সুধাসিন্ধু খীসা, ও গৌতম চাকমা। সরকার পক্ষের সদস্যরা হচ্ছেন শাহজাহান চৌধুরী এম পি (বি,এন,পি), সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম এম, পি (বি,এন,পি) মোঃ শাহজাহান এমপি (বিএনপি), বরকত উল্লাহ এমপি (বিএনপি), কল্পরঞ্জন চাকমা এমপি (আওয়ামী লীগ), মোশতাক আহমদ চৌধুরী এমপি (আওয়ামী লীগ), শাহজাহান চৌধুরী এমপি (জামায়াত) ও রাশেদ খান মেনন এমপি (ওয়াকার্স পার্টি)। এদের মধ্যে অসুস্থতার কারণে রাশেদ খান মেনন ও অজ্ঞাত কারণে জামায়াত সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী উক্ত বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া যোগাযোগ কমিটির আহ্বায়ক হংসধ্বজ চাকমাসহ কমিটির অপর ৫ সদস্য পর্যবেক্ষক হিসাবে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

যুদ্ধবিরতির সুযোগে নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপিত

জনসংহতি সমিতির একতরফা যুদ্ধ বিরতির সুযোগ নিয়ে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাছাউনির বিস্তার ঘটানোর প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ইতিমধ্যে নানিয়ারচর জোনের অধীনে জগনাতলী ও তৈচাকমা জুরিপ্যা পাড়া নামক স্থানে এবং লক্ষীছড়ি থানাধীন শুকনাছড়ি গ্রামে একটি করে মোট তিনটি নতুন সেনাছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে।

জগনাতলীতে সেনাছাউনি নির্মাণের জন্য জনৈক গ্রামবাসীর ৩/৪ একরের বাশ বাগান ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। এই বাগান থেকে তার বাসরিক ১৮,০০০/২০,০০০ টাকা আয় হতো। উক্ত ব্যক্তিকে এর ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে কিনা জানা জায়নি।

যে মুহুর্তে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া চলছে তখন এই ধরনের সেনাছাউনি বিস্তারের মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনা বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

 

নিষিদ্ধ সংবাদ

জনসংহতি সমিতির যুদ্ধ বিরতি, সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লংঘনে নতুন গতি

[জনসংহতি সমিতির একতরফা যুদ্ধবিরতি এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো মানবতা বিরোধী কর্মকা- ঘটে চলেছে। অথচ এইসব সংবাদ সমূহ একটি বিশেষ গোষ্ঠীর অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণে এদেশের সংবাদ মাধ্যমে আদৌ প্রচারিত হতে পারে না। আমরা এই কলামে এই সব অপ্রকাশিত সংবাদসমূহ ছাপাবার আয়োজন করেছি]

সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক তল্লাশী অভিযান

দিঘীনালা : ১৫ অক্টোবর ’৯২ লেঃ শফিক শাহাব আহমেদ (টুফিল্ড আর্টিলারী) এর নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য বাঙালীচান কার্বারী পাড়ায় (৫ নং বাবুছড়া ইউনিয়ন) প্রবেশ করে গ্রামবাসীদের বাড়িতে তল্লাসী অভিযানের নামে এক ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। এ সময় বাড়ির সব টাকা-পয়সা সোনা অলংকার ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নেয়া হয়।

মাটিরাঙ্গায় বৌদ্ধ মন্দির অবমাননা                                                                              মাটিরাঙ্গা : ১২ ই অক্টোবর ’৯২ ইং অশোকরামা বৌদ্ধ বিহারে আশ্বিনী পূর্ণিমা (প্রবারনা উসব) চলাকালে মাটিরাঙ্গা জোনের ৪৪ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল সেনা জুতা পায়ে বৌদ্ধ মন্দিরে প্রবেশ করে মাইক বন্ধ রাখার জন্য বিহারের ভান্তেকে নির্দেশ দিয়ে আসে। ফলে গোটা অনুষ্ঠানটা মাইক ছাড়াই সম্পন্ন হয়। দায়িত্বরত সেচ্ছাসেবকরা জুতা পায়ে প্রবেশ না করার অনুরোধ করলে তাদের কোন কথায় সেনারা কর্ণপাত করেনি। উল্লেখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে জুতা পায়ে প্রবেশ নিষেধ।

দুই নিরীহ ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ

দিঘীনালা : ১লা নভেম্বর ’৯২। খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের অধীন এক দঙ্গল সৈন্য তথাকথিত অপারেশন চালানোর সময় দিঘীনালা উপজেলাধীন বেদাকীছড়া নামক স্থানে রাত আনুমানিক আটটায় দু’ব্যক্তিকে গুলি করে জখম করে। আহতবস্থায় সৈন্যরা তাদেরকে প্রথমে বাবুছড়া জোনে নিয়ে আসে এবং পরদিন খাগড়াছড়ি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে।

ঘটনার সময় উক্ত ব্যক্তিদ্বয় বন্য শুকরের উপদ্রব থেকে পাকা ধানক্ষেত রক্ষার জন্য রাতে পাহাড় দিচ্ছিলেন। আহত ব্যক্তিরা হলেন, লক্ষ চাকমা পীং শান্তি চাকমা এবং নিশি রঞ্জন চাকমা পীং বিগুন্যা চাকমা।

জনসংহতি সমিতির এক তরফা যুদ্ধবিরতি এবং আলোচনার প্রক্রিয়া অব্যহত থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর এ রকম অপতপরতার ফলে সমস্যা সমাধানে তাদের সদিচ্ছা সম্পর্কে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে।

ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হলে কুপিয়ে হত্যার প্রচেষ্টা                                                                বরকল : ৮ই আগষ্ট ’৯২ ইং দেলোয়ার নামে এক বিডিআর সেনা কর্তৃক মিসেস আলপুদি চাকমা স্বামী আনন্দ মনি চাকমা-কে ধর্ষনের চেষ্টায় ব্যর্থ হলে দা দিয়ে নির্মমভাবে কুপানো হয়।

জানা যায়, বরকল বিডিআর জোন হেড কোয়াটারের ৯ডি কোম্পানির লেঃ ফারুকে নেতৃত্বে একদল বিডিআর সেনা পার্শ্ববতী গুচ্ছ গ্রামে প্রবেশ করে। তখন রাত প্রায় ৮টা। উক্ত ঘটনার সময় তার স্বামী আনন্দ মনি চাকমা তখন যক্ষা বাজারে ছিল। আলুপদি চাকমাকে বাড়িতে একা পেলে উক্ত সৈনিকটি তাকে ধর্ষনের চেষ্টা করে। কিন্তু আলুপদির চীকারে ও প্রবল বাধায় ব্যর্থ হলে সৈনিকটি তাকে দা দিয়ে আঘাত করে।

ধষর্ণের চেষ্টা ব্যর্থ, দু’ব্যক্তি প্রহৃত

থানচি : ৭ই অক্টোবর ’৯২ ইং বান্দরবান জেলাধীন বলিপাড়া জোনের মেজর শাহিদ (৬ষ্ঠ রাইফেলস্ ব্যাটালিয়ন) ফুলুক্কদেবী চাকমা (১৯) পীং চন্দ্র কুমার চাকমা-কে প্রকাশ্যে দিবালোকে ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর প্রতুল চন্দ্র চাকমা (প্রাক্তন ইউপি মেম্বার) ও বিজয় চাকমাকে সংজ্ঞাহীন না হওয়া পর্যন্ত প্রহার করে।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত ২৯শে এপ্রিল ’৯২ উপরোক্ত মেজর শাহিদ তার সশস্ত্র দল নিয়ে অনিল মেম্বার পাড়ায় অপারেশনে গেলে পার্শ্ববর্তী গ্রামে (প্রফুল্লপাড়া) থেকে ফুলুক্কদেবী চাকমাকে ডাকার নির্দেশ দেয়। মেয়েটি এসে পৌছলে এক বাড়ির লোক জন (অনিল মেম্বারের বাড়িতে) সবাইকে বের করে দিয়ে (অনিল মেম্বার অনেকটা স্ব-ইচ্ছায় বের হয়ে যায়) সেখানে ধর্ষণ করার জন্য নানা প্রলোভন দেখাতে থাকে। এতে ব্যর্থ হলে জোর পূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করতে গেলে ততক্ষণে সেখানে পাড়ার লোকজন জড়ো হয়ে যায়। এতে বড়ভাই বিজয় চাকমা এবং ভগ্নি জামাতা প্রতুল চন্দ্র চাকমাও ছিলেন। ঘটনা সমস্ত এলাকায় জানাজানি হলে মেজর শাহিদ উক্ত দু’জনকে শাসায় যে-তাদেরকে না পিটিয়ে ছাড়বে না।

তাই সে দীর্ঘদিন ধরে তাদের পিছনে উপায় খুঁজতে থাকে। কোন উপায় না পেয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে শান্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করার অভিযোগ করে ৭ই অক্টোবর ’৯২ দু’জনকে ক্যাম্পে ডেকে পাঠায়। ভীষণ শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে প্রতুল চন্দ্র চাকমা এবং বিজয় চাকমা দু’জন ক্যাম্পে গেলে মেজর শাহিদ তাদের উপর বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। বেদম মারধর সহ্য করতে না পেরে মারাত্মক আঘাতে মাটিতে লুটে পড়েন প্রতুল চন্দ্র চাকমা। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাকে বাড়িতে পাঠানো হয়। উল্লেখ্য, দুর্নীতি পরায়ন অনিল মেম্বার এ কাজে মেজর শাহিদকে সহযোগিতা করেছে বলে জানা যায়।

উক্ত কুখ্যাত মেজর শাহিদ এই এলাকায় জুম্ম নারীদেহ লোভী হিসেবে চিহ্নিত। সেনা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী জুম্মদের গুচ্ছগ্রাম থেকে তরুণীদের ক্যাম্পে ডেকে দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে টাকার বিনিময়ে কিংবা জোর পূর্বক ধর্ষণ করার প্রবণতা এলাকার লোকেরা অনেকদিন থেকেই জানে। কিন্তু তার ক্ষমতার দাপটে এলাকার লোকজন ভীত সন্ত্রস্ত, প্রতিবাদ করার মতো সাহসও কারোর নেই।

কালাতুঙ্যা প্রহৃত, নিখোঁজ                                                                                 

পানছড়ি, ৬ অক্টোবর ’৯২ইং। পুজগাং মুখ আর্মি ক্যাম্পের সুবেদার মোঃ মান্নান (৩৩ বেঙ্গল) ঐ দিন রাত আট ঘটিকার সময় কালাতুঙ্যা চাকমা (২৫) পীং সুবল মণি চাকমা, গ্রামঃ পুজগাংমুখ বড়গ্রাম বিজয় লক্ষ কার্বারী পাড়া, থানাঃ পানছড়ি-কে একই গ্রামের বাবু মদরো চাকমার বাড়ি থেকে জোর পূর্বক ধরে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে মিথ্যাভাবে শান্তিবাহিনীর চাঁদা আদায়কারী হিসাবে আখ্যায়িত করে সাংঘাতিকভাবে মারধর করা হয় এবং সুবেদার সাহেব তাকে পরদিন অর্থা ৭ অক্টোবর ’৯২ ইং ভোর ৬ টায় ক্যাম্পে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দেন বলে ক্যাম্প সূত্রে জানানো হয়েছে। অথচ ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হলেও ৬ তারিখ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কালাতুঙ্যা এখনো বাড়ি ফেরেনি। তার পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনরা কালাতুঙ্যার জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন এবং বিনীদ্র রাত্রি যাপন করছেন।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের শ্লোগান লেখায় তিন ছাত্র প্রহৃত                                                          দিঘীনালা, ৯ নভেম্বর ’৯২ইং সোমবার। গোলাকামা পাড়া এপি ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের সুবেদার মোঃ সোলায়মান তিনজন পাহাড়ি ছাত্রকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে বেদম প্রহার করে। ঐ ছাত্ররা দিঘীনালা রোডস্থ পাঁচ মাইল নামক স্থানে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের শ্লোগান সম্বলিত চিকা লেখার সময় উক্ত সোলায়মান এসে তাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং দু’ঘন্টা ধরে গালে, চোখে, মুখে, পেটে, বুকে এলোপাথারি কিল, ঘুষি ও লাথি মারতে থাকে। পরে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। ঘটনার শিকার ছাত্ররা হলেন প্রদীপ কুমার ত্রিপুরা (২২) পীং কিশোর কুমার ত্রিপুরা, জমীন্দ্র ত্রিপুরা (১৩) পীং মম কুমার ত্রিপুরা এবং বসন্ত ত্রিপুরা (১৩) পীং আলোক কুমার ত্রিপুরা।

নিরীহ গ্রামবাসীদের বিনে পয়সায় ক্যাম্পে কাজ করতে হচ্ছে

পানছড়ি, নালকাটা, কুড়াদিয়াছড়া, রজনী পাড়া ইত্যাদি গ্রামের নিরীহ দরিদ্র অধিবাসীদেরকে প্রতিদিন নিজের কাজ ফেলে নালকাটা আর্মি ক্যাম্পে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হচ্ছে। ক্যাম্পে বেগার খাটতে অস্বীকার করলে মারধর করা হয়। ফলে এলাকাবাসীদেরকে বড়ই দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে। তারা তাদের দুরাবস্থার প্রতি গণতান্ত্রিক সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন


বিজ্ঞপ্তি

আপনার এলাকায় কি হত্যা, গুম, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, গ্রেফতার, শারীরিক নির্যাতন, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করণ, ভূমি বেদখল, ধর্মীয় পরিহানি, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, জোপূর্বক উচ্ছেদ ইত্যাদি মানবতা বিরোধী ঘটনা ঘটছে ? তাহলে কে, কি, কখন, কোথায়, কিভাবে, কেন ইত্যাদির ভিত্তিতে বিস্তারিত লিখুন আমাদের ঠিকানায়। প্রয়োজনে আপনার নাম গোপন রাখা হবে।

 

১০ই নভেম্বর ’৮৩ স্মরণে

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংক্ষিপ্ত জীবনী

- হরিচন্দ্র

ক্ষমা গুণ, শিক্ষা গ্রহণের গুণ, পরিবর্তিত হওয়ার গুণ-এই তিন গুণের অধিকারী না হলে প্রকৃত বিপ্লবী হওয়া যায়না। -এম, এন, লারমা

রাংগামাটি শহরে অনতিদূরে মহাপুরম একটি বর্ধিঞ্চু গ্রাম। গ্রামের মধ্য দিয়েই ছোট নদী মহাপুরম প্রবাহিত। কিন্তু আজ সেই কর্মব্যস্ত বর্ধিঞ্চু গ্রাম মহাপুরম কাপ্তাই হ্রদের অথৈ জলে বিলীন হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তার স্মৃতি ও গৌরব। এই মহাপুরম গ্রামেই জুম্ম জাতির জাগরণের অগ্রদূত, মহান দেশপ্রেমিক, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের ঘনিষ্ঠ বিপ্লবী বন্ধু, কঠোর সংগ্রামী, ক্ষমাশীল, চিন্তাবিদ, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লার্মা (মঞ্জু) ১৯৩৯ সালে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শ্রী চিত্ত কিশোর চাকমা সেই গ্রামেরই জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, ধার্মিক ও সমাজসেবী। স্নেহময়ী মাতা পরলোকগতা শুভাষিনী দেওয়ানও একজন ধর্ম্মপ্রাণ সমাজ হিতৈষিনী ছিলেন। এম, এন, লারমার দুই ভাই ও এক বোন। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে জন্ম স্থানের বাস্তুভিটা জলে মগ্ন হলে পানছড়িতে নব বসতি স্থাপন করেন। এম, এন, লারমা মাতা-পিতার তৃতীয় সন্তান। তাঁর একমাত্র বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা (মিনু) সবার বড়। তিনিও বেশ শিক্ষিত। বড় ভাই শুভেন্দু প্রবাস লারমা (বুলু) ১০ই নভেম্বরের মর্মান্তিক ঘটনায় শহীদ হন। শহীদ শুভেন্দু লারমা রাজনৈতিক জীবনে একজন সক্রিয় সংগঠক, বিপ্লবী ও একনিষ্ঠ সমাজ সেবক ছিলেন। ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু)। তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান।

এম, এন, লারমা যৌবনকালে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। বিপ্লবী জীবনের কঠোর পরিশ্রমের ফলে পরবর্তীকালে তাঁর স্বাস্থ্য কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে। তাঁর কথাবার্তা মৃদু কন্ঠস্বর গম্ভীর, আচার ব্যবহার অমায়িক, ভদ্র ও নম্র। তিনি স, নিষ্ঠাবান ও সুশৃঙ্খল ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই সাদাসিদেভাবে জীবন যাপন করতেন। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল তীক্ষ্ণ। তিনি সৃজনশীল মেধার অধিকারী ছিলেন। কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। অসীম ধৈর্য্য, সাহস, মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও কষ্টসহিঞ্চুতার অধিকারী ছিলেন। এসমস্ত গুণাবলী অর্জনে তিনি তাঁর পিতা-মাতার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। এবার কর্মজীবনের পরিচয়ে আসা যাক। ১৯৬৬ সালে তিনি দিঘীনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেন। এরপর তিনি ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামে এক প্রাইভেট বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। তাঁর সুদক্ষ কলাকৌশলের ফলে ঐ বিদ্যালয়টি উচ্চ বিদ্যালয় উন্নীত হয়। একজন শিক্ষক হিসাবে তিনি যথেষ্ট সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি ছিল খুবই আকর্ষণীয়। অতি সহজে তিনি কঠিনতম বিষয়বস্তু সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিতে পারতেন। শিক্ষকতার জীবনে তিনি ছাত্র সমাজকে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেতেন।

তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এর পর তিনি চট্টগ্রাম সরকারী মহাবিদ্যালয়ে আই, এ, ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে আই, এ, পাশ করেন। আই, এ, পাশ করার পর একই কলেজে বি, এ, তে ভর্তি হন। তখন অধ্যায়নরত অবস্থায় রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত করে পাকিস্তান সরকার তাঁকে নিরাপত্তা আইনের অধীনে ১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৩ সালে গ্রেফতার করেন এবং প্রায় দীর্ঘ দুই বসরের অধিক কারাবরণ করার পর শর্ত সাপেক্ষে ৮ই মার্চ ১৯৬৫ সালে মুক্তি পান। সমাজ কল্যাণ বিভাগের অধীনে থেকে একই বসরে বি,এ, পাশ করেন। ১৯৬৮ সালে বি,এড পাশ করেন ও ১৯৬৯ সালে এল.এল.বি. পাশ করে একজন আইনজীবী হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে চারু বিকাশ চাকমা বাংলাদেশ সরকারের হাতে গ্রেফতার হলে ঐ মামলার আইনজীবী হিসেবে যথেষ্ট দক্ষতা ও মহানুভবতার পরিচয় দেন।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল হতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সহ সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য থাকার সময়ে সরকারী প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৯৭৪ সালে লণ্ডনে যান।

এবার আসা যাক রাজনৈতিক জীবনের পরিচয়ে। শ্রদ্ধেয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবনটাই হচ্ছে আগাগোড়া রাজনৈতিক মহান কর্মকাণ্ডে বিজড়িত। তিনি পরিবারের পরিবেশ থেকেই রাজনীতির হাতেখড়ি নেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি অধিকার হারা জুম্ম জনগণের মর্মবেদনা অনুভব করতে পেরেছিলেন। প্রজা শ্রেণী যখন অভিজাত শ্রেণীর নিপীড়ন নির্যাতনে ও শোষনের আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা ছিল তখন নেতার পিতামহ এই সব নির্যাতন নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে সেই যুগে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর পিতাও একজন প্রগতিবাদী হিসেবে সামন্ত শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আজীবন একজন সংগ্রামী হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। সর্বোপরি তাঁর জেঠা কৃঞ্চ কিশোর চাকমা যিনি মহান শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী হিসাবে সর্বপ্রথম জুম্ম জনগণের মধ্যে শিক্ষার আলো দিয়ে জাতীয় চেতনার উন্মেষ সাধনে ব্রতী ছিলেন, সেই মহান ব্যক্তি থেকেও তিনি রাজনীতির অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই স্বীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করার সময় একদিন জনৈক শিক্ষক মহোদয় ইসলামিক ইতিহাসের উপর পাঠদানের সময় জুম্ম জাতির জাতীয় ইতিহাসের সম্পর্কে পক্ষপাত দুষ্ট কথা বললে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড়িয়ে শিক্ষক মহোদয়ের উক্তির প্রতিবাদ করেন। এবং শেষ পর্যন্ত মাননীয় শিক্ষক তা সংশোধন করে নিতে বাধ্য হন। এইভাবে তিনি ছাত্র জীবন থেকে স্বকীয় জাতীয় বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামমুখর ছিলেন।

১৯৫৬ সালেই তিনি সর্বপ্রথম জুম্ম ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫৭ সালের পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলনে তিনি এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তিনি তখন থেকেই সকল অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে উঠতে থাকেন। নিম্নোক্ত ঘটনার মাধ্যমে তাঁর পূর্ণ স্বাক্ষর মেলে। তিনি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের মাননীয় সুপার ছাত্রাবাসের পরীক্ষার্থীদেরকে সুবিধামতভাবে আহারের সময় নির্ধারণ করে দিতে অনুমতি প্রদান না করলে পরীক্ষার্থীরা তারই নেতৃত্বে অনশন ধর্মঘট করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ অনুমতি প্রদানে বাধ্য হন।

কলেজ জীবনে তিনি রাজনীতির বৃহত্তর চত্বরে প্রবেশ করেন। এই সময়ে তিনি আগের চেয়ে আরো অধিক পরিমাণে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। ১৯৬০ সাল জুম্ম জাতির ভাগ্যাকাশে এক কালো মেঘ। কাপ্তাই জল বিদ্যু প্রকল্পের বাস্তবায়নে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্ত করণে উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তান সরকারের এই হীন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ১৯৬০ সাল থেকে পাহাড়ি ছাত্র সমাজের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলন তারই নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়।

কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করার পর তিনি গ্রামে ফিরে আসলেন এবং একদিকে জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন, আর অপরদিকে পাহাড়ি ছাত্র সমাজকে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে থাকেন। অপরদিকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনেও পদচারণা করতে থাকেন। আর স্বজাতিকে কিভাবে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করা যায় তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকেন। এইভাবে ষষ্ঠ দশক পর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণভাবে জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে ঐক্যব্ধ ও সচেতন করার কার্যে নিয়োজিত থাকেন।

প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ত সমাজ যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম সমাজকে অক্টোপাশের মতো আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে সামনে অগ্রসর হতে দিচ্ছিলোনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতি যখন আপন জাতীয় সত্তা ও বৈশিষ্ট্য হারাতে বসলো, উগ্র ইসলামিক ধর্মান্ধ স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার যখন জুম্ম জাতিকে ধ্বংস করার জন্য একটার পর একটা হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো, ঠিক সেই সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পাকাপোক্ত ভাবে ১৯৭০ সালে আবির্ভূত হলেন এম,এন, লারমা। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল চিন্তাধারা মানবতাবাদ নিয়ে লুপ্ত প্রায় জুম্ম জাতির রক্ষা কবচ হিসাবে।

বিলুপ্ত প্রায় জুম্ম জাতির ভাগ্যাকাশে দেখা দিল একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। দেখতে পেল জাগ্রত ঘুমন্ত শিশুর চোখে আধুনিক জগতের সভ্যতার আলোক দিশা। চিনতে লাগলো নিজ জাতীয় সত্তাকে। খুঁজতে লাগলো আপন জাতীয় সত্তা ও বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা করার মুক্তির পথ। ঠিক এমনি সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুরু হলো মুক্তি যুদ্ধ। এই মুক্তি যুদ্ধে এম,এন,লারমা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ গহণ করতে থাকেন। কিন্তু উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সু-কৌশলে তাঁকে মুক্তি যুদ্ধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ১৯৭১ সালে, ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে জন্মলাভ করলো। কিন্তু জুম্ম জনগণের ভাগ্য পরিবর্তিত হলো না। শুরু হলো উগ্র বাঙালি মুসলমান জাতীয়তাবাদের  নির্মম শোষণ ও নিপীড়ন। মুক্তি বাহিনী ও সরকারী বাহিনীর অত্যাচার আর নির্যাতনে ক্ষত বিক্ষত হলো অক্ষম ও দুর্বল জনগণ। বহু ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই করে দিল; শত শত মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করে দিল, রাইফেলের গুলিতে হত্যা করলো শত শত লোককে। কত অশ্রু ঝরলো চোখে, কত রক্ত ঝরলো বুকে। হায়রে, হতভাগ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম। এইভাবে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, হত্যা, ডাকাতি, লুটতরাজ ও সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছিল তখন জুম্ম জাতিকে রক্ষা করার জন্য তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে আসলেন শিক্ষিত, প্রগতিশীল ও সচেতন জুম্ম সমাজ। দেশ, সমাজ ও দেশ রক্ষার ডাক দিলেন প্রিয় নেতা এম,এন,লারমা।

১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী এম,এন,লারমার নেতৃত্বে গঠিত হলো “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি”। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র ও প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন। জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষি দশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি। সমিতির কাজ এগিয়ে চললো দুর্বার গতিতে। তার গতি অপ্রতিরোধ্য। সে চললো রাইফেলের বেয়নটের মাথায়; সে চললো মেশিন গানের গুলির মুখে। কোন কিছু রোধ করতে পারলো না সমিতির মহান কর্মকা-।

১৯৭৩ সাল। শুরু হলো নিয়মতান্ত্রিক লড়াই। ৭ই মার্চ নির্বাচন হলো। বিপুল সংখ্যাধিক্যে জয়লাভ করলো এম,এন,লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল থেকে। দক্ষিণাঞ্চল থেকে জয়লাভ করলো চাথোয়াই রোয়াজা চৌধুরী। বিজয় উল্লাসে নেচে উঠল জুম্ম জনগণ। খুশীতে আত্মহারা জনগণের মুখে ধ্বনিত হলোঃ-

এম,এন,লারমা জিন্দাবাদ

জনসংহতি সমিতি জিন্দাবাদ

এই শ্লোগানে মুখরিত হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের আকাশ বাতাস। পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী পুরুষ শিশু আবাল বৃদ্ধ বনিতা মনে করলো তাদের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার প্রস্তুত হলো। সুদৃঢ় ও সুগম হলো নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সংগ্রামের পথ।

বাংলাদেশের গণ পরিষদের অধিবেশন বসলো। অধিবেশনে যোগদান করার জন্য গেলেন জনগণের দুই প্রতিনিধি। শুধু প্রতিনিধি নয় তাঁরা গেলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ভাগ্য নিয়ন্তা হিসেবে। শুরু হলো অধিবেশন যথা নিয়মে। এই অধিবেশনে জুম্ম জনগণের একমাত্র আশা ভরসা গণ প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত জুম্ম জনগণের বাঁচার দাবী উত্থাপন করলেন। তিনি দাবী জানালেন-জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের একমাত্র চাবিকাঠি হচ্ছে- নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। তিনি আবেগময়ী ও অনলবর্ষী ভাষায় তুলে ধরলেন-বৃটিশ ও পাকিস্তান সরকারের আমলে নিপীড়ন নির্যাতন ও শোষণের কথা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আলাদা জাতি সত্তার কথাও দাবী করলেন। তিনি আশা করেছিলেন যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারও বাঙালি জাতির অস্তিত্বের জন্য ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছে সুতরাং জুম্ম জনগণের শোষণ ও বঞ্চনার মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।  

কিন্তু ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস, যে বাঙালিরা অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, সেই বাঙালিরাই আজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জুম্ম জনগণের ন্যায় সঙ্গত দাবীকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করলো। উগ্র বাঙালি জাতিয়বাদী বাংলাদেশ ওখানেই ক্ষান্ত হয়নি। গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের মুখোশ পড়ে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানে এক কলমের খোঁচাতেই জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব লুপ্ত করে দিয়ে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করলো-বাংলাদেশে যারা বাস করে তারা সবাই বাঙালি নামে পরিচিত হবে। আজীবন সংগ্রামী গণ প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই সংবিধানের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানালেন। তিনি সংযত ও দৃপ্ত কন্ঠে জানালেন-“একজন বাঙালি কোন দিন চাকমা হতে পারে না, অনুরূপ একজন চাকমা ও বাঙালি হতে পার না।” - এই বলে তিনি প্রতিবাদস্বরূপ সংসদ কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন।                  

তারপর অধিবেশন শেষ করে তিনি তাঁর কর্মস্থলে ফিরে আসলেন। এদিকে তাঁর সহকর্মীরা অধিবেশনের ফলাফল শুনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ফিরে এসে রাগে ও ক্ষোভে বললেন-‘না, এভাবে আর হবে না। অন্যপথ ধরতে হবে।’ তিনি বাংলাদেশ সরকারের হীন কার্যকলাপের চিত্র তুলে ধরলেন। এরপর অনেক আলাপ আলোচনা হলো। আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে পুনরায় ডেপুটেশন দেয়া হবে স্বয়ং শেখ মুজিবর রহমানের নিকট। এই ডেপুটেশনেও তিনি নেতৃত্ব দিলেন। যথাসময়ে ১৯৭২ সালে প্রধান মন্ত্রীর সাথে বৈঠক বসলো। এখানেও দাবী করা হলো জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা ও অধিকার। কিন্তু প্রধান মন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের প্রত্যুত্তরে এম,এন,লারমাসহ ডেপুটেশনের সকল সদস্য হতবাক ও স্তম্ভিত না হয়ে পারেন নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান বললেন-“লারমা তুমি কি মনে কর। তোমরা আছ ৫/৬ লাখ। বেশী বাড়াবাড়ি করোনা, চুপচাপ করে থাক। বেশী বাড়াবাড়ি করলে তোমাদেরকে অস্ত্র দিয়ে মারবো না (হাতের তুড়ি মেরে মেরে তিনি বলতে লাগলেন) প্রয়োজনে ১,২,৩,৪,৫,-দশ লাখ বাঙালি অনুপ্রবেশ করে তোমাদের উখাত করবো, ধ্বংস করবো।” এই ভাবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অধিকার আদায়ের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেলো। বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে যখন আর কোন কিছু আশা করতে পারা গেল না তখন নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পাশাপাশি অনিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের কথাও এম,এন,লারমা ভাবলেন অর্থা সশস্ত্র সংগ্রামের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। অবশেষে ১৯৭৩ সালে গড়ে উঠলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে “শান্তি বাহিনী”। পাশাপাশি মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গড়ে উঠলো গ্রাম পঞ্চায়েত, মহিলা সমিতি, যুব সমিতি ও মিলিশিয়া বাহিনী।

১৫ই আগষ্ট, ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাকশালী সরকারের পতন হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার আন্দোলনের স্বার্থে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা অভ্যুত্থানের পর পরই আত্মগোপন করেন এবং তখন থেকেই সরাসরি আন্দোলনের দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিলেন।

যুগে যুগে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আন্দোলনে কখনো হয়েছিল বিপ্লবী সংগ্রামী, আবার কখনো হয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী ও আপোষ পন্থী। কিন্তু এম,এন,লারমা অতি দক্ষতার সহিত সুকৌশলে এসবের মোকাবিলা করে আত্মনিয়ন্ত্রানাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।

১০ই নভেম্বর-১৯৮৩ সাল ছিল জুম্ম জনগণের এক চরম-দুর্দিন। বিশ্বাস ঘাতক ও জাতীয় শত্রুরা মহান নেতা এম,এন,লারমাকে শুধু হত্যা করেনি। তার সাথে গোটা জুম্ম জাতিকে হত্যা করার অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু যে ব্যক্তি একটি জাতিকে অন্ধকার থেকে তুলে এনে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকার প্রেরণা দিয়েছিলেন, যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে যে জাতি দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে, সে জাতি তাকে কোন দিন ভুলবে না। তাই আমাদের মহান নেতা আমাদের মাঝে না থাকলেও তার আদর্শ আজ প্রতিটি মুক্তিকামী জুম্ম জনগণের আদর্শ হয়ে রয়েছে এবং আগামীতেও থাকবে। এই মহান নেতাকে যারা হত্যা করে গোটা জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এম,এন,লারমা শুধু পাহাড়ি জনগণের বন্ধ ুনয়। বাংলাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের মেহনতি জনগণের বন্ধু।

 

যে মৃত্যু নৃশংস অথচ হিমালয়ের
চেয়েও ভারী

-সমর জ্যোতি

১০ই নভেম্বর ’৮৩ এর ভয়াল দুঃস্বপ্নের রাত্রে জুম্ম জাতির ইতিহাসে রচিত হয় এক মর্মস্তুদ নৃশংস হত্যাকা-। পার্বত্য চট্টলার ভাগ্য বিড়ম্বিত সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগণের অধিকার আদায়ের আমৃত্যু সংগ্রামে বলিষ্ঠ নেতা এম এন লারমা সহ আরও আট জন উচ্চ পদস্থ সহযোদ্ধাকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। মধ্যরাতের পৃথিবীর নিঃশব্দতাকে টুকরো টুকরো করে ঝাঁকে ঝাঁকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি বর্ষণে পার্বত্য মায়ের উত্তর সীমান্তে গ্রাস করে বসে ভয়ংকর প্রেতপুরী। গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চার কুচক্রীর লেলিয়ে দেয়া জল্লাদ বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে তরল তাজা রক্ত স্রোত বইয়ে যায় ছায়া সুনিবিড় গিরি কোলে। দিকচক্রবাল বিদীর্ণ করে হাহাকার নেমে যায়, বিবেক স্তম্ভিত হয়ে যায় এই বর্বরোচিত নৃশংসতায়। দক্ষিণ পূর্ব ও মধ্য বঙ্গোপ সাগরে সৃষ্ট প্রবল নিম্ন চাপের ঘূর্ণি ঝড়ে তখন আকাশ বাতাস ভারী হ’য়ে যায়। অতিকায় শোকের হিমালয় ভারে মেঘ বদলে যেতে থাকে মুষল বরষায়। একটি তুখোড় সাহসী যোদ্ধার মহা প্রয়াণের সাথে প্রকৃতির কি অদ্ভুত যোগাযোগ।

তার পর মহাকালের রথচক্রে আবর্তিত হয়ে গৃহযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী রনাঙ্গন। ঘাতক চক্রের শয়তানদের শায়েস্তা করতে পাহাড়ের অলিতে গলিতে বিদ্যু গতিতে ছুটে যায় জ্বলন্ত বুলেটের ঝাঁক, জুম্ম জাতির স্বাধিকার অর্জনের লড়াইয়ে সর্বাধিক নিবেদিত প্রাণ নির্ভীক সৈনিকেরা রক্ত শপথ নিয়ে বেরিয়ে যায় গেরিলা ছাউনীর ভেতর থেকে। পর্বতের আনাচে কানাচে পলায়নরত কুচক্রী বেঈমান নরঘাতকদের খুঁজতে থাকে অসংখ্য উত্তপ্ত ব্যারাল। মরিয়া হয়ে প্রাণ রক্ষার কাপুরুষিক নাটকীয়তায় পালিয়ে যেতে থাকে ঘাতক। অবশেষে শত্রুর খোয়ারে নিজেদের প্রাণভিক্ষে চেয়ে আত্মবন্ধক দেয়। গলায় গলা মিলিয়ে করুণা প্রার্থনা করে সমগ্র ভেজাল বিপ্লবীর জীবন বিকিয়ে দেয়। রাঙ্গামাটির এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে সেনাসন্ত্রাসীদের বিউগুলের ধ্বনি বেজে উঠে একদিন। নিষ্পাপ জুম্মবীরা ফুলের তোড়া দিতে যায়। মুখে তাদের কৃত্রিম হাসি, প্রাণে আক্রোসের আগ্নেয়গিরি। তারুণ্যের চোখে ঘৃণার বহ্নি শিখা জ্বলে উঠে সহসা। যে অস্ত্রের গর্জনে রাত্রের সূচিভেদ্য অন্ধকার প্রকম্পিত করে আমার জুম্ম মায়ের প্রশান্তির কোল খালী করে আমাদের প্রাণ প্রিয় নেতাদের বুক বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করল সে অস্ত্র সমর্পন করল তারা সেদিন। হাজার হাজার টাকা, চাকুরীর সুবিধা উপহার পেল খুনীরা তাদের ধর্ম পিতার অকৃপন হাত থেকে। কি জঘন্য এই যাত্রার রঙ্গমঞ্চ। বিস্ময় শুধু বিস্ময়। স্থবির হ’য়ে প্রত্যক্ষ করল এ যুগের তগবগে যৌবন। বিস্ময়ে বিমূর হয়ে গেল গোটা জুম্ম জাতি। কি অমোঘ নিয়তি ধুকড়ে ধুকড়ে কেঁদে উঠার মত ইতিহাস পেলাম আমরা।

আজ দীর্ঘ ন’টি বছর গড়িয়ে গেছে সময়ের ঢালু সিড়ি পথ ধরে। প্রজন্ম গভীর শোক, শ্রদ্ধাভরে লালন করে যায় এম এন লারমার স্মৃতি। প্রতি বছর জলপাই গোষ্ঠীর চিরুনী সতর্কতার মধ্যেও স্মরণ সভা হয় পর্বতচূড়ায় উপত্যকায় অববাহিকায়। শোক সভা জমে গাছ তলায় সন্তর্পনে। খালি পায়ে শ্রদ্ধা জানায় হাজার হাজার ছাত্র জনতা। শ্রদ্ধার্ঘ্যরে পুষ্প মাল্যে ভরে যায় এম এন লারমার প্রতিকৃতি। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে জেলখানা পর্যন্ত সাড়ম্বরে পালিত হয় মৃত্যু বার্ষিকী। নেতার তিরোধানের বেদনাকাতর স্মৃতিগুলো নাড়া দিয়ে যায় সব জুম্ম নারীপুরুষের হৃদয়ে। নেতার মৃত্যু হয়। নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠে যুগের প্রয়োজনে। সংগ্রাম এগিয়ে যায়। নতুনের সাহসী পাদশব্দে জেগে ওঠে আন্দোলনের রাঙা রাজপথ-গিরিপথ। প্রতিবাদ তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়। হতে বাধ্য।

লারমার নবম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

বিপুল উসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রতি বছরের মত এবারেও সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নবম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হলো। ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও জুম্ম ছাত্র-ছাত্রীরা মহান নেতার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছেন। ১০ই নভেম্বর নেতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচীর মধ্যে ছিল প্রভাতফেরী, আলোচনা সভা, সেমিনার ও প্রদীপ জ্বালানো।


চোখের দেখা ও কানে শোনা রক্তাক্ত দিঘীনালা

দিঘীনালায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সমাবেশে হামলা
সাম্প্রদায়িক উস্কানীর ধোঁয়া তুলে এখনো ষড়যন্ত্র সেনা সন্ত্রাসীদের হাতে

-সুপ্রিয়

যেভাবে শুরুঃ- ১২ই অক্টোবর দিঘীনালা থানা বিএনপি শাখা হঠা ১৩ তারিখ হরতাল আহবান করে মিছিল করে। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর ঔরসজাত একক বাংলা ত্রিপুরা গণ-পরিষদ নামে একটি ভুঁইফোড় জারজ সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচীর বিরোধীতা করতে থাকে। ১৩ই অক্টোবর অর্থা যেদিন ছাত্র পরিষদের গণসমাবেশ সেদিন সকাল থেকে স্থানীয় কিছু বাঙালি বেতনভুক্ত নেতা থানা বাজারে দোকানপাট বন্ধ করার চেষ্টা করে। ক্ষেত খামারে যে বাঙালিরা কাজে নেমেছিল তাদেরও কাজ বন্ধ করে লাঠি সোঠা নিয়ে প্রস্তুত হ’য়ে যেতে বলে। তারা বাস চালকদেরও হুমকি দিয়ে যানবাহন না চালাতে বাধ্য করতে থাকে। থানা বাজার সেদিন হাটের দিন। স্বাভাবিকভাবে যে লোকজন বাজার অভিমূখে আসছিল তারা যাতে আসতে না পারে তার জন্য ফেরীঘাট বন্ধসহ রাস্তার মোড়ে মোড়ে ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পথ রোধ করে রেখেছিল। অন্য দিকে বাবুছড়া থেকে থানা বাজারে আসার পথে প্রত্যেক আর্মি চেকপোষ্টে পাহাড়িদের আটকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিল যাতে করে সাধারণ মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হ’য়ে সমাবেশে যোগ দিতে না পারে। সকাল সাড়ে আটটায় খাগড়াছড়ি জেলাসদর থেকে এ ডি এম, এ এস পি একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনী নিয়ে দিঘীনালায় যান। উদ্দেশ্য অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করা।

সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা এবং গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। ফেরীঘাট বন্ধ থাকাতে মাইনী নদীর পূর্ব পাড়ে প্রায় হাজার তিনেক আবাল বৃদ্ধ বণিতা জড়ো হয়ে যায়। ইতিমধ্যে হাজার হাজার বাঙালি দা, খন্তা, বল্লম, লাঠি, সাইকেলের চেইন সহ আরও বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র নিয়ে ভাঙা বিল্ডিং নামক আর্মি চেকপোষ্টে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অবস্থান নেয়। আমরা ক’জন থানায় গিয়ে ব্যাপারটি এ এস পিকে অবগত করাই এবং তার সহায়তা কামনা করি। এ এস পি সহসা ওসি এবং টি এন ও সাহেবকে ভাঙ্গা বিল্ডিং চেকপোষ্টের দিকে পাঠান। টিএনও বাঙালিদের জটলায় গিয়ে তাদের শান্ত থাকতে বলেন। তিনি তাদের আরও বোঝাতে থাকেন যে “পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কোন শান্তিবাহিনী নয়। তারা গণতান্ত্রিকভাবে এখানে সমাবেশ করছে। এতে কারোর ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। তাদের শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে দিন।” মেজর হায়দারকেও নাকি একি কথা বলতে শুনা যায়। প্রথম দিকে তারা রাজিও হয়ে যায় টিএনও সাহেবের বক্তব্যে। কিছুক্ষণ পর বাঙালিদের মধ্যে আরও উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তারা উস্কানীমূলক শ্লোগান দিতে থাকে। বাঙালিদের মধ্যে থেকে কিছু আজগুবি খবর ছড়াতে থাকে। এমন সময় সমাবেশে যোগ দিতে আসা পাহাড়িদের একটি মিছিল মাইনী ব্রীজ অতিক্রম করলে সাথে সাথে আর্মি পোষ্ট থেকে রাস্তা ব্লক করা হয়। অন্যদিকে জাকির আহম্মেদ (স্থানীয় বিএনপি নেতা), মাসুদ রানা (ফটোগ্রাফার), তরুণ বিশ্বাস, ইলিয়াস সহ আরও কিছু বাঙালি পাহাড়িদের দিকে এগুতে থাকলে পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হয়ে উঠে। ঘটনাস্থলে তামাসা দেখছিল তখন লেঃ কর্ণেল ফরিদ। আক্রমণ শুরু হবার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে তিনি মেজর হায়দারকে অন্যত্র সরে যেতে ইঙ্গিত দেন। বাঙালিরা যখনি ইটপাটকেল ছোঁড়া শুরু করবে ঠিক তখনই আর্মি পোষ্ট থেকে একটি হুইসেল বেজে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার বাঙালি পাহাড়িদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম দিকে পাহাড়িরা আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। অবস্থা নাজুক আকার নিলে টি এন ও পুলিশকে ফাঁকা গুলির নির্দেশ দেন। গুলির শব্দ হওয়ার সাথে সাথে পাহাড়িরা দৌড়ে পালাতে থাকে। এ সময় বাঙালিরা ব্যাপকভাবে আক্রমণ করতে থাকে।

আউটকাম অব দি এ্যাকশনঃ- মূল এ্যাকশন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয় মাত্র বিশ মিনিটের মাথায়। এর পর বাঙালি আক্রমণকারীরা শান্ত ছেলে হয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। আহত পাহাড়িরা ধানের ক্ষেতে রক্তে রক্তে ভিজতে থাকে। কেউ কেউ রক্ত ঢালতে ঢালতে  পালিয়ে যেতে থাকে বিক্ষিপ্ত। বত্রিশ জনের মত আহত হাসপাতালে আশ্রয় নেয়। এই পরিস্থিতিতে সামরিক ভ্যান গুলো বেশ তপর হয়। আহতদের সি, এম, এইচ (কম্বাই- মিলিটারী হাসপাতাল) নিয়ে যেতে একটি সামরিক ভ্যান সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত হয়। তারাই উদ্ধারকারীর ভূমিকায় চলে আসে। রাতের বেলা জানতে পারলাম একজন মারা গেছে। এলাকায় শোকের ছায়া নামতে থাকে। নিহত ও আহতদের তালিকা হল :-

নিহত:                                                                                                                

মিঃ ভরদ্বাজ মনি চাকমা (৬০)
পিং কুমুজ্যা চাকমা
বানছড়া, ৫১ নং দিঘীনালা মৌজা।

আহত ব্যক্তিরা হলেনঃ                                                                                           

১। মিসঃ চিত্রালতা চাকমা 
স্বামীঃ লাবেচন্দ্র চাকমা                                                                                         
গ্রামঃ পাবলাখালী।

২। মিঃ নাগারা চাকমা (৫০)
পিতা : তমরু চাকমা
বানছড়ামুখ।                                                                                                      

৩। চন্দ্রমনি চাকমা (৩০)
পিতা : শককধন চাকমা
তেবাংছড়া।

৪। মি: পুণ্যস্মৃতি চাকমা (১২)
পিতা: পতিচন্দ্র চাকমা 
শান্তিপুর।  

৫। মিসেস: বিরহীনী চাকমা (৫০) 
স্বামী: গুনধর চাকমা 
পাবলাখালী।   
৬। মিঃ সুকৃতি চাকমা (৮) 
পিতা: দয়াল চাকমা 
রাঙ্গাপানিছড়া।   
৭। মিসঃ চম্পা চাকমা (১৪)
পিতাঃ হৃদয় রঞ্জন চাকমা 
নুনছড়ি। 
৮। মিসেসঃ স্বর্ণলতা চাকমা (৫৫)
স্বামীঃ কুঞ্চলোচন চাকমা 
বাবুছড়ামুখ। 
৯। মিস. চন্দা চাকমা (১৫)
পিতাঃ বাত্ত্যা চাকমা
বানছড়ামুখ।  
১০। মিসঃ চিত্রা চাকমা (২০)
পিতাঃ কিনারাম চাকমা 
কবাখালী।
১১। মিঃ বীরেন্দ্র চাকমা (৬৮)
পিতাঃ কান্ত চাকমা  
পাবলাখালী।

১২। মিঃ মোসান চাকমা (৪০)
পিতাঃ কান্দারা চাকমা 
পাবলাখালী। 
১৩। মিঃ বিশ্বনাথ চাকমা  (৩৬)
পিতাঃ ব্রজেন্দ্র চাকমা 
উঃ পাবলাখালী। 
৪। মিঃ প্রতাপ চন্দ্র চাকমা (৫৫)
পিতাঃ নিরাচন্দ্র চাকমা 
পাবলাখালী।    
 ১৫। মিসেসঃ লালমতি চাকমা (৩৫)
স্বামীঃ ইদ্রজয়চাকমা  
ধনপাতা।                                                                                                  

১৬। মিঃ কৃঞ্চ মোহন চাকমা
পিতাঃ বীরেন্দ্রলাল চাকমা
বানছড়া।

১৭। মিসেসঃ কমলাদেবী চাকমা (৪৫)
স্বামীঃ নীলাচন্দ্র চাকমা
ধনপাতা।

১৮। মিসেসঃ দেবলতা চাকমা (৫০),
স্বামী-
  দীনরঞ্জন চাকমা                                                                                    
ডি পি পাড়া।

১৯। মিঃ রেবুতী মোহনদ চাকমা (২০)
পিতাঃ রাধাধন চাকমা                                                                                                   রিজার্ভছড়া।

২০। মিঃ বাবুল চাকমা (২৫)                                                                                       পিতাঃ যতীন্দ্রলাল চাকমা                                                                                              শান্তিপুর গুচ্ছগ্রাম।

২১। মিঃ কৃপাচন্দ্র চাকমা                                                                                              পিতাঃ ধীরেন্দ্র চাকমা                                                                                                    ডি পি পাড়া।

২২। শান্তি বিকাশ চাকমা 
পিতাঃ পূর্ণ কুমার চাকমা
পাবলাখালী। 
২৩। মিসেসঃ চন্দ্রতারা চাকমা
স্বামীঃ খরেন্দ্রলাল চাকমা 
দঃ বড়াদাম।                                                                                                        
২৪। মিসেসঃ চিত্রাঙ্গদা চাকমা (৮০)
স্বামীঃ লারুচন্দ্র চাকমা
পাবলাখালী।                                                                                                           

২৫। মিঃ বীরলক্ষ্য চাকমা (৬০)                                                                                          পিতাঃ ভক্ত চাকমা                                                                                                     পাবলাখালী।

২৬। মিঃ রাঙ্গামুয়া চাকমা (৬২)

পিতাঃ বিদ্যাধর চাকমা

দঃ বড়াদাম।

২৭। মিঃ সুনীল জ্যোতি চাকমা (১২)

পিতাঃ সুধীর চন্দ্র চাকমা
রাঙ্গাপানিছড়া।

২৮। মিঃ নিরঞ্জন চাকমা (৪০)
পিতাঃ বীরেন্দ্র চাকমা                                                                                                    পাবলাখালী।

২৯। মিঃ ফনিন্দ্রলাল চাকমা (৬৫)
পিতা মৃতঃ ধৃতমনি চাকমা
কবাখালী।

৩০। মিসেসঃ মিলেবো চাকমা (২২)
স্বামীঃ পঞ্চমজয়                                                                                                          ডি পি পাড়া।

৩১। মিঃ যামিনী কুমার চাকমা (৬৬)
পিতা মৃতঃ মহেন্দ্র চাকমা
পাবলাখালী।

৩২। মিসেসঃ সেফালি চাকমা(১৪)                                                                                     পিতাঃ বিমল কুমার চাকমা
পুকুর ঘাট বড়াদাম
৩৩। মিঃ জয়ন্ত কুমার চাকমা 
পিতাঃ বীনাধন চাকমা কার্বারী
বানছড়া।
৩৪। মিঃ ভদ্রসেন চাকমা (৩৫)                                                                                       পিতা মৃতঃ হোঙ্গ্যা বৈধ্য                                                                                                 পাবলাখালী।

৩৫। মিঃ আনন্দ কুমার চাকমা 
পিতা মৃতঃ ফুল চন্দ্র চাকমা
কাঁঠাল তলি পাড়া।
 ৩৬। মিঃ সূর্য মোহন চাকমা (৭৫)
পিতাঃ থেমু চাকমা পুকুরঘাট, বড়াদাম।
৩৭। মিঃ রিটেন চাকমা
 পিতাঃ শান্তিকুমার চাকমা
নৌকাছড়া।

৩৮। মিঃ মোহন্যা চাকমা (৮৫) 
পিতাঃ বন্যাকান্ত চাকমা 
বসুকুমার কার্বারী পাড়া, মধ্য বানছড়া।
৩৯। মিঃ বব্র বাহন চাকমা (২৬)
পিতাঃ সূর্যচন্দ্র চাকমা 
ভাইবোনছড়া (বাঘাইহাট) বাঘাইছড়ি থানা।
৪০। মিঃ জ্ঞান বিকাশ চাকমা (২৫)
পিতাঃ কমাচ্ছে চাকমা 
বড়াদাম।         
                                                                         

জামতলাতে ব্যারিকেড : দিঘীনালা সমাবেশে যোগ দিতে খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সকাল সাতটায় পাঁচ শতাধিক পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের একটি পদযাত্রা অভিযান শুরু হয়। মাঝপথ থেকে দু’টি সহযোগী ট্রাক তাদের তুলে নেয়। সকাল বেলা জামতলাতে আনসার চেক পোষ্টের সামনেই বাঙালিরা ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের দু’টি ট্রাক জামতলাতে এসেই বাঁধার সম্মুখীন হয়। ব্যারিকেড সৃষ্টি কারীরা ট্রাকের গ্লাস ভেঙ্গে দেয় এবং পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের উপর চড়াও হয়। আশ্চার্যের বিষয় সেখানে আনসার বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। পরে দিঘীনালা থেকে এ এস পির নির্দেশ পেয়ে আরও একদল পুলিশ জামতলাতে চলে যায়। ততক্ষণে পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ট্রাক দু’টো খাগড়াছড়িতে ফিরে যায়। ফিরে এসেই খাগড়াছড়িতে তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করে।

সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের পুরনো কায়দায় : খনি রঞ্জন দিঘীনালা এলাকায় এক অখ্যাত কুখ্যাত সেনাবাহিনীর দালাল। সাধারণ মানুষরা তার উপাতে অস্থির। যত্রতত্র যাকে তাকে শান্তি বাহিনী বা শান্তি বাহিনীর কর্মী বা সমর্থক বানিয়ে ধরিয়ে দিতে তার জুড়ি নেই। যখন তখন সে সেনা বাহিনীর ভয় দেখিয়ে এলাকা বাসীদের হয়রানি ও বিরক্ত করত। তার নেতৃত্বে কিছু দুষ্ট গোবেচারা মানুষ দিয়ে সেদিন আন্তঃ সাম্প্রদায়িক ক্লেশ সৃষ্টি করার পুরনো কায়দা প্রয়োগ করেছে দিঘীনালার সেনা অফিসাররা। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম ঘটনাটি। দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়ার অল্পক্ষণ পরেই একক বাংলা ত্রিপুরা গণ-পরিষদ নামে একটি ভূঁইফোর সংগঠনের ব্যানার নিয়ে ডজন খানেক ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোক মিছিল সহকারে থানার কাছাকাছি আসছিল। মিছিলের আগে আগে মেজর হায়দারকে দেখা গেল বেশ উফুল্লভাব। তিনি কিছুদুর এগিয়ে এসে মিছিলের গতি রোধ করলেন। আমরা ফ্যাল ফ্যাল করে দেখলাম কিছু সেনা বাহিনীর লেজুর ফটোগ্রাফার মিছিলের ছবি নিচ্ছে। মিছিল শেষ হলেই দেখা গেল মিছিলকারীদেরকে ভাঙ্গা বিল্ডিং আর্মি চেকপোষ্টে জনপ্রতি ৫০ টাকা দেয়া হচ্ছে। কি উলঙ্গ এ ষড়যন্ত্র।                              

তামাসা শেষ, এখন বাড়ি যান :- বেলা তখন প্রায় ২টা। ব্রিগেড কমা-ার কর্ণেল মাহবুব হাসান হন্তদন্ত হয়ে ওসির অফিসে ঢুকলেন। আমরা তখন সবাই বিষণ্ণ হয়ে বসেছিলাম সেখানে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বললেন, সমাবেশ করতে অনুমতি নিয়েছেন কিনা। আমরা বললাম কার অনুমতি ? কেন অনুমতি ? সংবিধানের ধারা ও অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলা হল যে বাংলাদেশী নাগরিক হয়ে যে কোন সময় যে কোন জায়গায় আমাদের সমাবেশ করার অধিকার আছে। এর জন্য কোন অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। আমরা আরও বললাম আমাদের ছেলেরা এর পরও সামরিক বেসামরিক উভয় প্রশাসনের কাছে বিষয়টি অবগত করেছে। অথচ সামরিক কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। আপনাদের সহযোগিতা থাকলে আজ এ ষড়যন্ত্র মূলক হামলা হত না। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে চেয়েছি। আপনারা সবই দেখলেন। তিনি আরও বললেন এক বাঙালি যুবককে গুলি করা হয়েছে। অর্থা তিনি বলতে চাচ্ছিলেন গুলিটা পাহাড়িদের দিক থেকে গিয়ে বাঙালির হাতে লেগেছে। হায় ষড়যন্ত্র ? আমরা টি এন ও কে উদ্দেশ্য করে বললাম যে উনিই গুলির অর্ডার দিয়েছেন। টি এন ও সাহেব স্বীকার করলেন যে তিনি পাঁচ রাউন্ড ফায়ারের নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং গুলি কার সে ব্যাপারে আর কর্ণেল সাহেব কথা বাড়ালেন না। অবশেষে বললেন তামাশা তো শেষ। এবার কি করবেন করেন। আমার তো কিছুই করার নেই সবই এ এস পি, ওসি সাহেবরা দেখবেন। আমরা দেখলাম তিনি হন্ হন্ করে চলে গেলেন। আমরা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্নে আটকে গেলাম।

চক্রান্তের অংশ বিশেষ :- পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ছাত্র গণসমাবেশের খবর পাওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় কিছু নেতৃবৃন্দকে ক্যান্টনমেন্ট-এ ডেকে পাঠানো হয়। আলাদা আলাদা ভাবে বিষয়টি আলোচনা হতে থাকে। সমাবেশ প- করে দেয়ার জন্য বিশেষ পরামর্শ চাওয়া হয় অনেকের কাছে। এ সময় বরাদামের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কালীজয় এবং স্থানীয় পরিষদ (জেলা পরিষদ) সদস্য বিবেকানন্দকে ক্যান্টনমেন্টে ঘোরাফিরা করতে দেখা যায়। তবে স্থানীয় বাঙালি নেতৃবৃন্দের সাথে গোপনীয়ভাবে মিটিং করতে থাকে ৯ই অক্টোবর থেকে। এ গোপনীয় সভাগুলোতে যারা বিশেষ ভূমিকা পালন করে তারা হলেন:-                                                                  

১। So (Second officer) আব্দুল হাই।                                                                                ২। জাপর আহম্মেদ (বিএনপি সভাপতি দিঘীনালা শাখা)
৩। মাসুদ রানা, শাপলা ষ্টুডিও ( বিএনপি সাধারণ সম্পাদক)
৪। মোঃ ইলিয়াস চৌধুরী (সভাপতি ছাত্রলীগ)
৫। জাহাঙ্গীর আলম (বার্তাবাহক, পাক্ষিক মাইনী)
৬। সোনা মিয়া (৩নং মেরুং ইউপি চেয়ারম্যান)
৭। তরুন বিশ্বাস                                                                                                          ৮। লে, কর্ণেল ফরিদ

দিঘীনালা অঞ্চলে এস, ও আব্দুল হাই একজন জঘন্য পুলিশ অফিসার। আইন শৃঙখলা রক্ষার নামে এই হাই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। স্থানীয় কিছু টাউট, স্পাইদের নিয়ে হাই সাধারণ মানুষকে অহরহ গ্রেফতার করে এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। নিরীহ লোকদের বিনা অজুহাতে আটক করে শান্তিবাহিনীর মামলা পড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে দালালদের মাধ্যমে আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তির আশাবাদ শুনিয়ে হাজার হাজার টাকা নিচ্ছে। শান্তিবাহিনী সাজিয়ে মিথ্যা মামলা টুকিয়ে দিয়ে এই অস পুলিশ অফিসার এক মহা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। এই হাই-এর বিরুদ্ধে শুধু পাহাড়িরা নয় স্থানীয় বাঙালিরাও অতিষ্ঠ হয়ে মিছিল করেছে। জানা যায়, দু’বার বদলীর আদেশ পেয়েও সে স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের আশীর্বাদে আজও দিব্যি বহাল তবিয়তে। কতিপয় মহলের ধাারণা এই কুখ্যাত আব্দুল হাইয়ের প্রধান আশীর্বাদ লেঃ কর্ণেল ফরিদ।

গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে প্রথম অম্লান শহীদ ভরদ্বাজ মনি :- ১৩ তারিখ গভীর রাতে দিঘীনালা সেনানিবাস-এর সি এম, এইচ থেকে জলপাই রংয়ের পীক আপে ভরদ্বাজ মনির মৃতদেহ থানায় নিয়ে আসা হয়। পরদিন মৃতদেহ সনাক্তকরন এবং পোষ্টমর্টেম। বিকেল বেলা মাইনী নদীর ধারে তার মৃতদেহ দাহকৃত্য। সারা বেলা প্রচণ্ড বৃষ্টি। তার পরও আগুনে আগুনে ছাই করা হল একটি রক্ত মাংসের মানুষ। কিন্তু নিঃশেষ হতে পারে না একটি চেতনার আত্মা। এ যুগের প্রজন্মের প্রতিটি হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায় একটি আত্মত্যাগের কাহিনী। একটি মৃত্যুহীন মৃত্যু। গভীর দুঃখ, প্রতিবাদ বাসা বাধে আমাদের মনে। দিনে দিনে ঘটবে এর ব্যাপ্তি। এভাবে আরও হয়ত শোক দুঃখের অম্লান স্মৃতি জড়ো হবে কিছু দিন। অতপর আমরা অন্ধ হবো প্রতিবাদে।

যেভাবে শেষ :- ১৫ই অক্টোবর থেকে ১৭ ই অক্টোবর অবধি বাবুছড়া, উদল বাগান, বড়াদাম, বুদ্ধপাড়া ও পোবাং পাড়ায় ৫টি জনসভা হয়। ইতিমধ্যে ভরদ্বাজ মনির নিবাস বানছড়া গ্রামের নাম বদলে রাখা হয় শহীদ ভরদ্বাজ মনি গ্রাম। মাইনী ব্রীজের নামকরণও শহীদ ভরদ্বাজ মনি স্মরণে রাখা হল। ১৭ অক্টোবর বুদ্ধ পাড়া ও পোবাং পাড়ায় মিটিং শেষ করে বিকেল বেলা ফিরছিলাম। পথিমধ্যে দিঘীনালা থানার বদমাইশ সেকে- অফিসার আব্দুল হাই ডেকে নিয়ে গেল আমাদের এবং পাঁচ জনকে গ্রেফতার করল। সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল বেরুল। দিঘীনালা ইতিহাসে প্রথম বিক্ষোভ মিছিল। হুমকি দেয়া হল আগামী কালের মধ্যে আমাদের বন্ধুদের নিঃশর্তমুক্তি না দিলে সারা পার্বত্য এলাকায় হরতাল পালিত হবে। রাতেই প্রশাসন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারী করতে বাধ্য হয়। পরদিন আমরা জামিনের আবেদন করলাম এবং বেলা ১টা নাগাদ বন্ধুদের মুক্তি করে আনলাম। ফুলের মালা পড়িয়ে দিলো তাদের সহযোদ্ধারা। অতঃপর অবিভাবক মহলের আশীর্বাদ কামনা করে দিঘীনালা প্রস্থান।

 

সেনাদের ক্যান্টিন : যাত্রীদের দূর্ভোগ

নির্মল জ্যোতি

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাদের সুযোগ সুবিধার কোন ঘাট্তি নেই। কিন্তু তাতেও তাদের তৃপ্তি হয় না। তাই শুরু করে দেয় ঠিকাদারী, ব্যবসা ইত্যাদি। তেমনি একটি ব্যবসা কেন্দ্র মানিকছড়ি জোনের সেনাদের ক্যান্টিন। যা ইদানিং যাত্রীদের দুর্ভোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক পথে খাগড়াছড়ি ঢুকে জেলা সীমানা নোয়াবাজার এসেই বাস, ট্রাক, জীপগুলোকে অপেক্ষা করতে হয় সেনাদের অনুমতির জন্য। সেনাদের ভাষায় রাস্তা চেক করা শেষ হলে গাড়িগুলো ছেড়ে দেয়া হবে। অনুমতি পাওয়ার জন্য প্রায় দু’আড়াই ঘন্টা যাত্রীদের বসে থাকতে হয়। তারপর এক সময় অনুমতি আসে। স্বস্তি পাই যাত্রীরা। গাড়িগুলো শুরু করে দেয় প্রতিযোগিতা। কে আগে পৌঁছাতে পারে খাগড়াছড়ি বা গন্তব্যস্থানে। কিন্তু না, তারপরেও যেন দুর্ভোগের সীমা নেই। মানিকছড়ি জোনের চেক পোষ্টের সামনে এসেই গাড়িগুলোকে আবারও আটকিয়ে রাখা হয়। অনন্যপায় হয়ে যাত্রীদের বসে থাকতে হয় প্রায় আধঘন্টার মত। সেনাদের জীপগুলোর কথা বাদ দিলেও অনেক সরকারী জীপ, কাকুতি মিনতি করলে অনেক সময় দু’একটা ট্রাকও ছেড়ে দেয়া হয়। অথচ বলা হয় রাস্তা চেক করা শেষ হয়নি। গাড়িতে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়। পাশেই সেনাদের ক্যান্টিন এবং বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র নামক ব্যবসা কেন্দ্র। যাত্রীরা ভীড় জমায় সেখানে, ব্যবসা জমে ভালো। এটা শুধু চট্টগ্রাম থেকে আসা গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে নয়। খাগড়াছড়ি থেকে যেই গাড়িগুলো আসে সেই গাড়িগুলোও আটকিয়ে রাখা হয়। ড্রাইভার গাড়ি না থামিয়ে আসতে চাইলে সেন্ট্রিপোষ্ট থেকে হুইসেল বাজিয়ে থামানো হয়। এখানে বলা হয় প্রশ্রাবের জন্য। অথচ সেনাদের এই ক্যান্টিন নামক ব্যবসা কেন্দ্রটা যখন ছিল না তখন এখানে চেক পোষ্টও ছিল না, খাগড়াছড়িগামী যাত্রীদেরও আটকানো হতো না। চট্টগ্রামগামী যাত্রীদেরও প্রশ্রাবের জন্য নামানো হতো না। শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর ক্যান্টিনের ব্যবসা চালু রাখার জন্য যাত্রীদের এই দুর্ভোগ আর ক’দিন পোহাতে হবে। কে জানে ?

 

ডেট লাইন জুরাছড়ি
যেখানে অনুমতি নিয়ে বাঁচতে হয়

-চন্দ্র কুমার

আপনি একজন চাষাভূষা মানুষ। সামান্য জমি। সারা বছর হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে বিরাট সংসারের ঘানি টানতে টানতে কুঁজো হয়ে গেছেন। মোরগ-ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে হালের জোড়া নিয়ে মাঠে দৌড়ানো আপনার রেওয়াজ। কিন্তু আপনি তা আর পারবেন না। কারণ আপনি এখন গুচ্ছগ্রামে। এখানে আপনি নিয়ন্ত্রিত ও বন্দী। যা খুশী আগে যা করতেন, তা করা এখন অপরাধ। কোন কিছু করবেন, পাশের ক্যাম্পের কমান্ডারের অনুমতি নিতে হবে। মাঠে যাওয়ার অনুমতির জন্য আপনাকে ক্যাম্পে দৌঁড়াতে হবে।

আপনি কি একজন ছাত্র? রাঙ্গামাটি, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকা বা অন্য কোথাও পড়াশুনা করেন। ছুটির সময় বাড়ি এসেছেন তো। যান, ক্যাম্পে আপনার এই আসার সংবাদটা জানিয়ে আসেন। না হলে ওরা বেজার হবে। ছুটি শেষে ক্লাশে ফিরবেন এবার। তাতেও অনুমতি পত্র লাগবে। এটাই নিয়ম। গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকারের কথা কর্তাদের কাছে বলেও কোন লাভ নেই। তারা আপনার চাইতে এসব বেশী জানে। কাজেই ভেতরে ভেতরে রাগে অপমানে ফেটে গেলেও সেনাকর্তাদের কিছু যায় আসে না। আপনাকে আবার যেতে হবে কমান্ডার বা সম্রাটের কাছে। (কমাণ্ডার হচ্ছে সম্রাটের আধুনিক নাম)। তবে খেয়াল রাখবেন, ঐ কোনো রকমে দস্তখত দিতে জানা সৈনিক থেকে আরম্ভ করে বড়বাবু পর্যন্ত সবাইকে অনবরত ‘স্যার” বলে সম্বোধন করতে হবে। একবার মুখ ফসকে ‘ভাই’ বলে ফেলেছেন তো বিপদে পড়েছেন। তাদেরকে ‘ভাই’ বলা খুব অন্যায়। তারা এসব একদম অপছন্দ করেন। এই ‘ভাই’ ডাকার শাস্তি বেত্রাঘাত থেকে জেল-হাজতের ডাল-ভাত পর্যন্ত হতে পারে। তাই সাবধান।

যাহোক গুচ্ছগ্রামের কথাইতো বলছি। আরো আছে। আপনি বাজারে যাবেন। পাস লাগবে। তাই ক্যাম্পে যান। ছড়ায় মাছ ধরতে যাবেন। তাতেও পাশ লাগবে। দূর গ্রামের নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। ক্যাম্প সম্রাটের কাছ থেকে অনুমতি যোগাড় করে নিন। আপনার একমাত্র নৌকাটা হারিয়ে গেছে। খোঁজ করতে হবে। অনুমতি নিন। অনুমতি, শুধু অনুমতি। সব খানেই, সব ক্ষেত্রেই এই অনুমতি। এই অনুমতি বা পাস নেয়ারও অনেক আমলাতান্ত্রিক নিয়ম কানুন। প্রথমে এলাকার কার্বারী, মেম্বার, হেডম্যান অথবা চেয়ারম্যান সাহেবের সুপারিশ লাগবে। তারপর আর, পি, সাহেব কর্তৃক নথিভুক্ত ও দস্তখত করার পর ক্যাম্প বাহাদূরের কাছে অনুমতির জন্য যেতে হবে।

বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিন্ন এক জগত। এই জগতের ভেতর আরো অন্য এক বিচিত্র জগতের নাম হচ্ছে জুরাছড়ি। জীবন মানে এখানে অনুমতি। জীবন মানে এখানে সেনা-নিয়ন্ত্রণ। অনুমতি না নেয়া মানেই দেশদ্রোহীতা, রাষ্ট্রদ্রোহীতা। অনেক ভণ্ড পণ্ডিত বলেন, ঈশ্বর নাকি মানুষের গতিবিধি, আচার-আচরণ ও চিন্তা-চেতনা নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব পণ্ডিতগণ যদি জুরাছড়ির গণমানুষের শৃংখলিত ও নিয়ন্ত্রিত জীবন দেখতেন, তাহলে ওভার সিওর, তারা চিতা উর্দিওয়ালাদেরকে জ্যান্ত ঈশ্বর জ্ঞান করতেন।

জুরাছড়ির এই বিচিত্র জগতের নিয়ন্ত্রণের চিত্র চিত্রায়িত হয় কিন্তু অনেক আগে থেকে। ৮৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে স্বপ্নিল সবুজ ছায়াঢাকা গ্রামগুলো ভেঙ্গে দিয়ে গ্রামের শান্ত-নিরীহ লোকগুলোকে সেনাক্যাম্পের পাশে জড়ো করা হয়। এরই নাম গুচ্ছগ্রাম। গুচ্ছগ্রামবাসীরা একে ‘বন্দীশিবির’ বলে অলংকৃত করেন। নাকের ডগায় গজে ওঠা বিষফোঁড়ার মত সেনাক্যাম্পের সংখ্যা আর এই গুচ্ছগ্রামের সংখ্যা প্রায় এখানে সমান। অর্থা অনেক। যেমন বনযোগীছড়া, চকপতিঘাট, হাজাছড়া, ফকিরাছড়ি, জুরাছড়ি সদর, থাছি, কুসুমছড়ি গুচ্ছগ্রাম ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্দী হওয়ার পর চাষের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম প্রথম জেলা পরিষদ থেকে সীমিতভাবে রেশনিং এর ব্যবস্থা করা হয়। (এই রেশনিং-এর মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই জেলা পরিষদের তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম দেখিয়ে পরিষদের হোতাদের পকেট স্ফীত করা) এখন তাও নেই। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে চট্টগ্রামের জিওসি এসব গুচ্ছগ্রাম ভেঙ্গে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। অথচ গুচ্ছ গ্রামবাসীদেরকে এখনো তাদের নিজ নিজ গ্রামে যেতে দেয়া হচ্ছে না। বিশেষ দু’একজন যাদেরকে দেয়া হচ্ছে তাদেরকেও সেইভাবে রাস্তার পাশে বাড়ি করে থাকতে হচ্ছে, যেসব রাস্তায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত যাতায়াত করেন।

এই বছরের প্রথম দিক থেকে চাষ করার জন্য সীমিতভাবে অনুমতি দেয়া শুরু হয়। তা সত্ত্বেও, বন্য প্রাণীর উপাতের কারণে গুচ্ছগ্রামবাসীদের এখন কঠোর পরিশ্রমে উপাদিত শস্য ভোগ করতে না পারার মত অবস্থা। কারণ গুচ্ছগ্রাম থেকে তাদের জমি অনেক দূরে।

তা ছাড়া, নিজের কাজ ফেলে রেখেও প্রায় সময় সেনা ক্যাম্পে বেগার খাটতে হয় গুচ্ছগ্রামের নিরীহ জুম্মদের। নির্দেশ না মানলে শাস্তি অনিবার্য। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও রাতে একটু শান্তিতে ঘুমোবার যো নেই। অখ-তার প্রহরীরা ঘুমোবেন। তাই সারা রাত পালা করে গ্রামবাসীদেরকে প্রহরা দিতে হবে। শান্তিসেনারা যদি আসে তাহলে সহসা খবর দিতে হবে ক্যাম্পে। তারা নাকি শান্তিসেনাদের খুব ভয় পায়। অবশ্য ইদানিং নাকি তারা শুধু ‘শান্তি’ শব্দটা শুনলেও ভয়ে আতকে ওঠেন।

কাপ্তাই ব্রিগেডের অধীন ২৫ ও ৩৭ বেঙ্গলের দ্বৈত শাসন ও নিয়ন্ত্রণে জুরাছড়ি এলাকার জনজীবন বর্তমানে বিষিয়ে উঠেছে। তারা জানেনা এর শেষ কোথায়। তাদের প্রশ্ন, তারা কি এদেশের স্বাধীন নাগরিক? সুরম্য সংসদে বসে যারা বিকলাঙ্গ শিশু গণতন্ত্রের পরিচর্যা করেন, তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন-জুরাছড়িতে সেনাকর্তারা যা করছেন তা কি গণতান্ত্রিক? সেনাবাহিনীকে জুরাছড়ি এলাকা কি লিজ দেয়া হয়েছে ?

                                                                                                         

সেনাবাহিনীর পেশাগত দায়িত্ব, সন্ত্রাস দমন এবং উন্নয়ন

“এখন আমাদের দায়িত্ব শুধুমাত্র সন্ত্রাসদমন ও উন্নয়ন”, বললেন দিঘীনালা ক্যান্টনমেন্ট সেকেন্ড-ইন-কমাণ্ড । একই মন্তব্য করেছেন সম্প্রতি মাটিরাঙ্গা জোনের এক সামরিক অফিসার। স্থানীয় পাহাড়ি ছাত্ররা সমাবেশ করার অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে যখন সংশ্লিষ্ট সেনা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করছিলেন তখন তাদের বলা হয়েছিল এসব অনুমতি দেয়ার দায়িত্ব এখন টিএনও বা ডিসি সাহেবের। অথচ ভাবতেও অবাক লাগে কিছুদিন আগেও এমন কোন কাজ ছিলনা পার্বত্য এলাকায় যা তাদের অনুমতি ছাড়া করা যেত না। বাজারে যেতে, মাছ ধরতে যেতে, বাড়িতে অথিতি রাখতে, সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতে কিংবা মাইক বাজাতে পর্যন্ত সেনা কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়। সম্প্রতি সামরিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব খর্ব হওয়াতে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। আরও আশ্চার্য্যরে বিষয় যে তাদের বর্তমান দায়িত্বের কথা দেশের প্রতিরক্ষা বা সার্বভৌমত্ব রক্ষা। অথচ একি বলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের রাজস্বভোগী সেনাবাহিনীরা ? তাদের পেশাগত দায়িত্বের সাথে কাজ কর্মের এমনকি কথাবার্তার মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। পার্বত্য জেলাগুলোতে যে সমস্ত বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তারা বদলী হয়ে দায়িত্ব পালনে আসেন তারা হাড়ে হাড়ে টেরপান যে এখানে তাদের ভূমিকা খুবই নগন্য। সামান্য মেজর বা ক্যাপ্টেন পর্যায়ে অফিসাররাও জেলা প্রশাসকদের ধমক দেন। অন্যান্য জুনিয়র অফিসারদের অবস্থাতো আরও সঙ্গীন। দূরবর্তী থানাগুলোতে থানা লেবেলের অফিসারদের ছুটি মঞ্জুর করেন জোন কমা-ার। এমন নজির অনেক। ঘটনাটি ঘটেছিল বরকল উপজেলায়। সেখানের পোষ্ট মাষ্টারের মা এক সময় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি ছুটির জন্য তার বিভাগীয় কর্তাব্যক্তির কাছে আবেদন জানালে তা মঞ্জুর হয়ে যায়। কিন্তু বাঁধ সাধলেন স্থানীয় জোন কমান্ডার শেষ পর্যন্ত সেই পোষ্ট মাষ্টার ছুটি পান নি।

এমন কোন কাজ নেই যা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা কর্তাব্যক্তিরা করেন না বা করতে পারেন না। গাছ কাটার পারমিট দেয়ার ব্যাপারেও জেলা প্রশাসককে বিভিন্নভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। জোন কমাণ্ডারের অনুমতি ছাড়া জেলা প্রশাসক গাছ কাটার পারমিট দিতে অপারগ। অথচ Forest Act অনুসারে ডিসি সাহেব Reserved Forest সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু না, তা হয় না। চট্টগ্রামের জিওসি যা নির্দেশ দেন তাই এখানে নিয়ম। কিছু দিন আগেও গাছ বা বাঁশ কাটা বন্ধের জন্য নোটিশ জারী করেন জিওসি। নোটিশে বলা হয় পরিবেশ রক্ষার্থে গাছ কাটা বন্ধ করা হল। এক্ষেত্রে ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্ট বা ডিসি নেহায়েত গৌণ কর্তৃপক্ষ।

মাস তিনেক আগে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাঙ্গামাটি গিয়ে বললেন, “শান্তিবাহিনী এক তরফা অস্ত্র বিরতি দিয়েছে। কার সাথে অস্ত্র বিরতি ? কার সাথে কার যুদ্ধ?” প্রশ্ন জাগে তাহলে সেনাবাহিনী এখানে করছেটা কি? আমরা যদি এভাবে তাদের কাজে কর্মের হিসেব মিলাই। যেমন:

(ক) তারা সন্ত্রাস দমনের নামে নিরীহ মানুষদের নির্যাতন চালাচ্ছে।

(খ) বোমা, বিস্ফোরক থেকে যাত্রীদের বাঁচানোর দোহাই দিয়ে তারা নিজেরাই লঞ্চ বা বাসে বোমা ফোটাচ্ছে। আর Road Protection -এর নাম করে লাখ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছে।

(গ) সন্ত্রাস দমনের নামে স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে জিম্মি বানিয়ে সামরিক আইন চালাচ্ছে।

(ঘ) স্বাভাবিক জনজীবনে বিবিধ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে হয়রানি চালাচ্ছে।

(ঙ) গাছ কাটা বন্ধের নামে নিজেরাই বন উজার করে গাছ পাচার করছে ঢাকা, চট্টগ্রামে।

(চ) প্রত্যাগত শান্তি বাহিনী দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসা করছে।

(ছ) শান্তকরণ প্রকল্প নামে অশান্তির গুচ্ছগ্রাম বানিয়ে লক্ষ লক্ষ মন গম, চাল চুরি করছে।

(জ) বাঙালি ও পাহাড়ি শরনার্থীদের দেখিয়েও জমজমাট ব্যবসা করছে।

(ঝ) উপজাতীয়দের কোটা, চাকরী দেয়ার ক্ষমতা পেয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপরি হিসেবে লুফে নিচ্ছে সরল প্রাণ পাহাড়িদের কাছ থেকে।                                                                                          

এভাবেই সেনাবাহিনীর পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে বহুবিধ ব্যবসার স্বর্গরাজ্য। উদ্বাস্ত পাহাড়িদের ধান্য জমি চাষ করেও হাজার হাজার টন ধান জমা করা হয় সেনা ক্যাম্পের গোডাউনে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানে কিনা কে জানে, শুধু মাত্র দিঘীনালাতে ৫৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ২৯টি চলছে। বাকীগুলো সামরিক কর্তাদের নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে আজ হতে ৬ বছর আগে। দিঘীনালায় এখনো অসংখ্য চেক পোষ্টে ব্যাপক তল্লাসী করা হয়। মেয়ে যাত্রীদের মহিলা ভিডিপিদের মাধ্যমে সেনা জোয়ানদের সামনে এমনভাবে চেক করা হয় যা অসভ্যতার চুড়ান্ত পর্যায়ের। অসংখ্য চেকপোষ্টে অহেতুক হয়রানি চালানোর রেওয়াজ সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে।

তবে একথা এখন বলা যায় যে, সেনাবাহিনীর কাজ প্রায় সীমিত হয়ে আসছে। তাদের সামনে একটিই পথ খোলা আছে। তা হচ্ছে ষড়যন্ত্র। বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে কালো টাকা ছিটিয়ে চক্রান্ত চালানো। তাদের দ্বারা দীর্ঘ ২০ বছরে সন্ত্রাস দমনের সামান্যতম কাজ হয়নি। আর যে উন্নয়নের কথা তারা বলে তা হচ্ছে নিজেদের উন্নয়ন। গুলশান, বারিধারা, ধানমন্ডি, বনানীতে সুরম্য অট্টালিকার উন্নয়ন। দেশের জনগণের টাকায় যে বাহিনী পোষা হচ্ছে তা যদি এমন হয় তবে জনগণের উচিত এর জবাব চাওয়া। সরকারের উচিত (যে দুটি দায় দায়িত্বের দোহাই তারা আজ দিচ্ছে সেই সন্ত্রাস দমন আর উন্নয়ন) তাদের কর্তৃত্ব শেষ করে দেয়া। গণতান্ত্রিক সরকারকে এভাবেই এগুতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানে সামরিক বাহিনীর ব্যারিকেড ভাঙতেই হবে।                                   

-মংহলা প্রু

 

লোগাং তদন্ত গণহত্যা তদন্ত কমিশন নাকি সেনাবাহিনীর গুণকীর্তন কমিশন?

রিপোর্টের বিপক্ষে

- মানব মিত্র

গত ১০ এপ্রিল ’৯২ খাগড়াছড়ি জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার (বর্তমানে থানা) লোগাং গুচ্ছগ্রামে সংঘটিত হয় এক লোমহর্ষক, বিভীষিকাময় ও বর্বরতম গণহত্যা। পরদিন অর্থা ১১ এপ্রিল দেশের জাতীয় দৈনিক গুলোতে এই ঘটনায় ১ জন বাঙ্গালি ও ১০ জন পাহাড়ি নিহত হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য সরকারীভাবে একজন বাঙালিসহ মোট ১৩ জন নিহত হয়েছেন বলে স্বীকার করা হয়েছে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণপরিষদ, খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত সাংসদ কল্প রঞ্জন চাকমা, বৈ-সা-বি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে সফররত ২৩ জন রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, লেখক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা, মানবাধিকার কর্মী এবং দেশ বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনসমূহ সরকারের এই তথ্য ভাষ্যকে প্রত্যাখান করেন। তারা লোগাং এর গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা সরকার প্রদত্ত হিসাব থেকে অনেক বেশী বলে উল্লেখ করেন। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মুখপত্র কেউক্রাডং এবং হিল লিটারেচার ফোরামের অনিয়মিত প্রকাশনা রাডারে (যা বর্তমানে নিষিদ্ধ) প্রাথমিকভাবে ১৩৮ জন মৃত ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয়। ঘটনার শিকার ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী এবং নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়ের কাছ থেকে সাক্ষাকার গ্রহণ করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও রাডার এই তালিকা প্রকাশ করেছিল।

লোগাং এর উক্ত গণহত্যা সুপরিকল্পিতভাবে ভিডিপি, আনসার, বিডিআর ও বে-আইনী অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা এমন সময়ে সংঘটিত করানো হয় যখন পাহাড়ি জনগণ মহান জাতীয় উসব বৈ-সা-বি (ত্রিপুরাদের বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিঝু) উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই প্রস্তুতির অংশ হিসাবে খাগড়াছড়ি বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটি বৈ-সা-বি উপভোগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ঢাকা থেকে ২৮ জন রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীকে আমন্ত্রণ জানায়। গণহত্যার ফলে আনন্দোসব বাতিল হয়ে যায়। শোক ও কান্নায় ছেয়ে যায় সমগ্র পার্বত্য জনপদ। গণহত্যার পর পরই লোগাং এলাকা সেনাবাহিনী কর্তৃক ঝযরবষফ করে দেয়া হয়। বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত সেনাবাহিনী এবং তাদের দালাল দোসরদের ছাড়া কোন সাধারণ নাগরিককে উক্ত এলাকায় যেতে দেয়া হয়নি। ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত সম্মানিত অথিতিবৃন্দকে সেনাবাহিনী উক্ত গণহত্যা সংঘতিত লোগাং এলাকায় যেতে দেয়নি। পানছড়িতে তাদেরকে আটকানো হয়।

লোগাং গণহত্যা দেশে বিদেশে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই বর্বরতার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাতে মুখর হয়ে উঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও দেশ বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। দাতা দেশসমূহের বৈঠকেও লোগাং গণহত্যা আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী ২৫ এপ্রিল, আওয়ামী লীগ সভানেন্ত্রী ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ২৭ এপ্রিল এবং প্রধানমন্ত্রী ১৩ই মে’৯২ লোগাং পোড়াভিটা পরিদর্শন করেন। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ২৮ শে এপ্রিল খাগড়াছড়ি থেকে পদযাত্রা করে লোগাং পোড়াভিটায় নিহতদের উদ্দেশ্য পুষ্পমাল্য দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পন করে। বিভিন্ন মহলের চাপ এবং দাবীর প্রেক্ষিতে ঘটনার একমাস পর সরকার Commission of Enquiry Act 1956 ১৯৫৬ মোতাবেক প্রাক্তন বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হন।

দীর্ঘ পাঁচ মাস পর গত ১৭ অক্টোবর ’৯২ সরকার এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। বস্তুতঃ সরকার কর্তৃক কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ যে দেশে বিরল ঘটনা সে দেশেই পার্বত্য চট্টগ্রামের লোগাং গণহত্যার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু যেহেতু শুধুমাত্র সরকার ও সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য এবং লোগাং গণহত্যা সম্পর্কে তাদের বক্তব্যকে সমর্থন করার জন্য এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে সেহেতু তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশে সরকারের আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। লোগাং তদন্ত রিপোর্ট পড়লে যে কোন সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন লোকের এই বোধ না হয়ে পারে না। তাই এই রিপোর্ট দেশে ও বিদেশে সমালোচিত, নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং পুনঃতদন্তের দাবী জানানো হয়েছে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এই রিপোর্টের সত্যতা ও নিরপেক্ষতা সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। হিল লিটারেচার ফোরামও পক্ষপাতদুষ্ট ও বেঠিক বলে এই রিপোর্ট সরাসরি প্রত্যাখান করে বিবৃতি দিয়েছে। ফোরাম আবারও এই পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্টকে প্রত্যাখান করে নিম্মোক্ত বক্তব্য তুলে ধরছে:

জনাব সুলতান হোসেন খানের তদন্ত রিপোর্ট এতই পক্ষপাতদুষ্ট, ভিত্তিহীন এবং পাহাড়ি বিদ্বেষ প্রসূত যে তার এই রিপোর্ট আগাগোড়াই প্রত্যাখান এবং সমালোচনাযোগ্য। যেহেতু রিপোর্টের সব বক্তব্যই সরকার ও সেনাবাহিনী কর্তৃক গালভরা অপপ্রচারণার পুনরুক্তি তাই এখানে শুধুমাত্র মূল বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হল।

(১) প্রথমেই সবচেয়ে বিতর্কিত মৃতে্যুর সংখ্যা নিয়ে আলোচনায় আসা যাক। লোগাং-এ ১০ এপ্রিল ’৯২ ভি.ডি.পি, আনসার ও অনুপ্রবেশকারী বাঙালিদের আক্রমণে কত ব্যক্তি নিহত হয়েছেন সে সম্পর্কে বিভিন্ন মহল, ব্যক্তি ও সংগঠন কমিশনের কাছে নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করেন। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মুখপত্র “কেউক্রাডং” এবং হিল লিটারেচার ফোরামের অনিয়মিত প্রকাশনা “রাডার” লোগাং গণহত্যায় নিহত ব্যক্তির আত্মীয়, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অথবা ঘটনার শিকার এমন ব্যক্তির সাক্ষাতকার গ্রহণ করার পর প্রাথমিকভাবে ১৩৮জন নিহতের তালিকা প্রকাশ করে এবং তা কমিশনের কাছে সরবরাহ করে। অপরপক্ষে সেনাবাহিনী, বিডিআর, আনসার, ভিডিপি এবং উচ্ছিষ্টভোগী জনবিরোধী কিছু দালাল সরকারের বক্তব্যকেই অন্ধ সমর্থন করে। এ পরিস্থিতিতে বিচারপতি সুলতান সাহেব শুধুমাত্র সাক্ষীদের বক্তব্য কোনপ্রকারে মাপ-ঝোক করে (তার ভাষায় "anxiously"  বিবেচনা) এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বলেন যে, "In these view of evidence and circumstances, I have no hesitation to hold that the number or deaths did not exceed more than 12 tribals and the number of huts burnt were admittedly about 550."

জনাব সুলতান হোসেন খাঁন এতবড় একটি বিতর্কিত বিষয়ে এত সরলভাবে উক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে নির্লজ্জ ও চরম পক্ষপাতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে, প্রশাসন তার কাছে ২২ ব্যক্তিকে হাজির করেছে যাদের নাম রাডারে মৃত হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মৃত হিসাবে প্রকাশিত ১৩৮ জনের মধ্যে পরে ২২ জনকে জীবিত সন্ধান পেলে কি করে মৃতের সংখ্যা ১২ ঘোষণা করা যায়? সুলতান হোসেন খানের এ কোন ধরনের বোকামিপূর্ণ যুক্তি। ১৩৮ জনের মধ্যে জীবিত ২২ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমে কখনো প্রমান করা যায় না যে মৃতের সংখ্যা ১২। এই অংক এবং যুক্তি বুঝতে বিচারপতি হওয়ার দরকার নেই। সাধারণ যোগ বিয়োগ অংকের জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট। সুলতান হোসেন খানের সমীকরণ হচ্ছে যেহেতু মৃতের সংখ্যা ১৩৮ অপ্রমাণিত, সেহেতু সঠিক মৃতের সংখ্যা হচ্ছে ১২ প্রমাণিত। মৃতের সংখ্যা এর মধ্যবর্তী বা বেশী কোনকিছু হওয়া যেন সম্ভব নয়। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কি এতই সহজ ও সোজা?

তাছাড়া হিল লিটারেচার ফোরাম এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কখনো দাবী করেনি যে রাডার এবং কেউক্রাডং-এ প্রকাশিত ১৩৮ জন মৃত ব্যক্তির তালিকা চূড়ান্ত। বরং এই তালিকাকে প্রাথমিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই সংখ্যা এবং নামের কিছুটা হেরফের হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঘটনার দিন যখন একই সময়ে বুলেট বৃষ্টি আর দা, বর্শা, খন্তা, ইত্যাদি নিয়ে আক্রমণ এবং সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখা সবকিছু গ্রাস করে চলছিল তখন অসহায় গুচ্ছগ্রামবাসীরা জীবনের জন্য যে যেদিকে পারে পালিয়ে জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করে। সে সময় কেউ কারো খবর জানে না। একই পরিবারের লোকজন পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দীর্ঘদিন। বাবা মনে করে ছেলেমেয়ে, বৌমারা সবাই মারা গেছে। আর ছেলে বা মেয়েরা ১০/১৫ দিন পরেও যখন পিতার খোঁজ পাওয়া গেলনা, তখন ধরে নিয়েছে যে বৃদ্ধ পিতা তাহলে আগুনে জীবন্ত দাহ হয়ে গেছেন। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই রাডারের প্রতিনিধিগনকে লোগাং গণহত্যায় শহীদদের আত্মীয় এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে নিহত ও আহত ব্যক্তির তালিকা সংগ্রহ করতে হয়। তাছাড়া সেখানে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের কথাতো কারোর অজানা থাকার কথা নয়। এমনিই কঠোর সামরিক নিয়ন্ত্রণ, তার এলাকা পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিকে সামরিক বাহিনী ঢুকতে দেয়নি। সেই কারণে হিল লিটারেচার ফোরাম রাডারে প্রকাশিত নিহত ও আহত ব্যক্তির তালিকাকে পূর্নাঙ্গ ও চূড়ান্ত না বলে প্রাথমিক বলে উল্লেখ করেছে।

জনাব সুলতান হোসেন খানের যদি পক্ষপাতহীন, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত করার মানসিকতা থাকতো তাহলে তিনি অবশ্যই রাডারে প্রকাশিত নিহতের তালিকা নিয়ে লোগাং গুচ্ছগ্রামে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধান চালিয়ে প্রকৃত নিহতের সংখ্যা জেনে নিতে পারতেন। গণহত্যার পর কেউ ভারতে শরণার্থী হয়নি এবং যারা বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন তারাও পরে গুচ্ছগ্রামে ফিরে এসেছেন অথবা আশে পাশে রয়ে গেছেন। কাজেই গুচ্ছগ্রামে গিয়ে রাডারে প্রকাশিত নিহতের মধ্যে কারা বেঁচে আছেন এবং তালিকায় নেই এমন যারা মারা গেছেন তার হিসাব নিলেই প্রকৃত মৃতের সংখ্যা বের করা যেতো। এটা করা কোন কঠিন কাজ নয়। অথচ তিনি তা না করে নির্লজ্জভাবে সেই সব খুনী বিডিআর, আনসার, ভিডিপি এবং অনুপ্রবেশকারী বাঙালিদের সাফাই গাইলেন এবং তাদের বক্তব্যকেই পরম সত্য বলে গ্রহণ করলেন যারা সেদিন ১০ এপ্রিল ’৯২ নির্বিচারে পাহাড়িদের হত্যা করে প্রচার করেছিল ১২ ব্যক্তিকে তারা হত্যা করেছে, "In these view of evidence and circumstances, I have no hesitation to hold that the number or deaths did not exceed more than 12 tribals and the number of huts burnt were admittedly about 550."

জনাব সুলতান হোসেন খানকে প্রশ্ন রাখতে চাই, উভয়েই ঘটনার প্রত্যক্ষ শিকার ব্যক্তির সাক্ষাতকার গ্রহণ করা সত্ত্বেও মৃতের সংখ্যা এবং অন্যান্য বিষয়ে আপনার এবং আমাদের এত ব্যবধান হলো কেন? আপনার কাছে “১২ জন পাহাড়ি মারা গেছে” বলে সেই পাহাড়িরাই এসেছে যাদেরকে সেনাবাহিনী এই মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছে। যাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই, জীবন যাদের সেনাবাহিনীর হাতে এবং যাদেরকে সেনাবাহিনী, আনসার, বিডিআর, ভিডিপি ও অনুপ্রবেশকারীদের বেষ্টনীতে সবসময় গণহত্যার ভয়ে অসহায় ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বন্দী থাকতে হয় তাদের কাছে সত্য উচ্চারণ করা মানেই হয় মৃত্যু নয় পাশবিক শারীরিক নির্যাতন। তাছাড়া সেনাবাহিনী যে সাক্ষীদের ওপর ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে তার অনেক প্রমাণ আছে। ছাত্র পরিষদ ১০ জুন’৯২ এক বিবৃতিতে এই কারণে সুষ্ঠু তদন্তের ব্যাপারে আশংকা প্রকাশ করেছিল।

সুলতান হোসেন খানকে মৃতের সংখ্যা যে ১২, তা যেন যে কোন মূল্যেই প্রমাণ করতে হবে। এজন্য তিনি তার নিজের অভিমত না দিয়ে ছাড়লেন না, Besides the direct evidence about the number of deaths, in my view, it is impossible to dispose of such a large number of dead bodies and/or to remove them and/or to hide them in any place because such a large number of dead bodies can not be removed except by vehicles and they are to be disposed of near the road and that any such disposal of dead bodies can not be conceald.”

ঘটনার পর পরই লোগাং এলাকা ৮/১০ দিন ধরে কড়া সেনাবেষ্টনী দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। কোন সাধারণ নাগরিককে ঐ এলাকায় যেতে দেয়া হয়নি। এই সময়ে কি ১৩৮ জন মৃত ব্যক্তির লাশ সরিয়ে ফেলা অসম্ভব ?

গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর পরই ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজ তার পঙ্গপালসহ (জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার ওসি, এসপি ইত্যাদি) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। অথচ বৈ-সা-বিতে আমন্ত্রিত ডেপুটি এটর্নি জেনারেল হাসান আরিফসহ আইনজীবী, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রনেতা, মানবাধিকার কর্মীদেরকে ঐ এলাকায় যেতে দেয়া হয়নি তথাকথিত নিরাপত্তার অজুহাতে আসলে নিরাপত্তা নয়, ১২ তারিখের মধ্যেও নিহতদের লাশ সরানো সম্ভব হয়নি বলেই তাদেরকে যেতে দেয়া হয়নি। ঐ সময়ে লোগাং এর পোড়া ভিটায় গেলে তারা আসল অবস্থা দেখতে পেতেন এবং ফলে সবকিছু ফাঁস করে দিয়ে সেনাবাহিনীর ১২ জন নিহত হওয়ার অপপ্রচারনাকে ধুলোর মতো উড়িয়ে দিতেন। এই ভয়েই সেনাবাহিনী তাদেরকে উক্ত এলাকায় যেতে দেয়নি। আশংকা হয়, এই আলামত সুলতান সাহেবকে বুঝেও না বোঝার ভান করতে হয় কিনা।

জনাব সুলতান হোসেন খান তার রিপোর্টে যেসব সাক্ষীর সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করেছেন তা সুষ্ঠ মস্তিস্কে পরীক্ষা এবং বিচার বিশ্লেষণ করলেও কোন অবস্থাতেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে, লোগাং ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১২ জন।

(২) ঘটনার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে জনাব সুলতান হোসেন খান যতদূর এবং যথাসাধ্য সম্ভব শান্তিবাহিনীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী, আনসার, ভিডিপি এবং অনুপ্রবেশকারীদের অপরাধ হালকা ও পানসে করতে চেষ্টা না করে ছাড়েন নি। তিনি লোগাং গণহত্যাকে “Result of the planned objective of the insurgents” বলে উল্লেখ করেছেন। এই planned objective হচ্ছে, তার ভাষায়, “to take tribals to base and operate in Hill Tracts”.

সুলতান হোসেন সাহেব যে সেনাবাহিনীর ও সরকারী অপপ্রচারনায় বিভ্রান্ত হয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। উপরোক্ত বক্তব্যের পরিবর্তে তার বলা উচিত ছিল "the massacre at Logang is the result of the planned objective of the military to annihiliate the Hill people."

সুলতান সাহেব কিসের ভিত্তিতে বা কি প্রমাণ পেয়ে বলতে পারেন যে লোগাং গণহত্যা শান্তিবাহিনীর "planned objective"? অপরপক্ষে, শুধু লোগাং ঘটনার নয় সেনাবাহিনী নিজেরাই বা তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় বাঙালি অনুপ্রবেশকারীরা পাহাড়ি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে অনেক বড় ধরনের গণহত্যা সংঘটিত করেছে। আশাকরি সুলতান সাহেব রাডারের “লোগাং গণহত্যা সংখ্যায়” তা পড়ে থাকবেন। তাই সে সব গণহত্যা সমূহ উল্লেখ করে বিরক্তি উপাদন করতে চাই না। সেনাবাহিনী ও বাঙালি অনুপ্রবেশকারী কর্তৃক সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত এইসব একের পর এক গণহত্যার ফলেই পাহাড়িরা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তাই সুলতান হোসেন খানের ঐ ÒPlanned objective of the insurgents" এর কথার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। এ যাবত তার কোন নজিরও পার্বত্য চট্টগ্রামে নেই।

(৩) কবির হোসেনের মৃত্যু সম্পর্কে সুলতান হোসেন খানের বক্তব্য হচ্ছে "it was done deliberataly by Shanti Bahini so as to create a situation of attacking the tribals."  জনাব সুলতান হোসেন খান কি করে নিশ্চিত হলেন যে কবির হোসেনকে শান্তিবাহিনী হত্যা করেছে। তার এই নিশ্চিত হওয়ার কোন কারণ কিন্তু খান সাহেব দেখাতে পারেননি।

এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, কবির হোসেনকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এযাব শান্তিবাহিনী দা দিয়ে হত্যা করেছে বলে কোন নজির বা জনশ্রুতি নেই। তাই শান্তিবাহিনীরা যে কুপিয়ে কবির হোসেনকে হত্যা করেছে এই বক্তব্যের কোন সমর্থন মেলেনা।

সুলতান হোসেন খান এই প্রসঙ্গে তার রিপোর্টের ২০ পৃষ্ঠায় আরো কিছু কথা বলেছেন। তা হচ্ছে "Ansars and members of V.D.P fired from their rifles out of fear and panic caused by killing of Kabir Hossain by Shanti Bahini who might not be armed with fire arms."

শান্তিবাহিনী ভরব ধসং ছাড়া শত্রু পরিবেষ্টিত এলাকায় আসবে-তা বিশ্বাস করা দূরের কথা কল্পনা করাও রীতিমত দুঃসাধ্য। তাই কবির হোসেনকে শান্তিবাহিনী দ্বারা নিহত হয়েছে বলে সুলতান হোসেন খানের রায় জঘন্য মিথ্যাচার, কল্পনাপ্রসূত ও আজগুবি ছাড়া আর কিছু নয়।

আসল ঘটনা হচ্ছে নিম্নরূপ:

ঐদিন অর্থা ১০ই এপ্রিল ’৯২ কবির হোসেনসহ অন্য দুজন বালক গুচ্ছগ্রাম থেকে অনতিদূরে গরু চড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে মার্বেল খেলছিল। কবির হোসেনের মাথায় একটু ছিট ছিল বলে জানা যায়। এই খেলাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায় এবং এক পর্যায়ে দা দিয়ে কোপাকুপি শুরু হয়। কবির হোসেনের দায়ের কোপে অন্য দু’জন সামান্য আহত হয়। এই দু’জন এক পক্ষে ছিল এবং তারা দু’জনে কবির হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করে। তাদের এই অপরাধটি ঢাকার জন্য বালকদ্বয় কবির হোসেনকে শান্তিবাহিনী হত্যা করেছে বলে প্রচার করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে অরাজক পরিস্থিতির কারণে যে কোন ঘটনা শান্তিবাহিনীর ঘাড়ে চাপানো খুব সহজ হয়। এবার দিঘীনালায় বাঙালিদের হামলায় নিহত ভরদ্বাজ মুনি চাকমার মৃত্যুকেও শান্তিবাহিনীর ঘাড়ে চাপানোর কম চেষ্টা হয়নি। কিন্তু শান্তিবাহিনী একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে বলে তাদের এই অপচেষ্টা হালে পানি পায়নি।

(৪) সুলতান হোসেন খান পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য কোন সুপারিশ না করে তিনি সরকারকে কয়েকটি অবাস্তব, উদ্ভট ও কান্ডজ্ঞানহীন পরামর্শ দিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামকে সম্পূর্ণ সামরিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ না করে বরং তিনি সেনাসন্ত্রাস জারী রাখার সুপারিশ করেন।

(৫) সুলতান হোসেন খান পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত পরিস্থিতির জন্য ভূমি জটিলতাকে দায়ী করে অচিরেই ভূমি জরিপের সুপারিশ করেন। এই সুপারিশের সাথে তেমন দ্বিমত নেই। কারণ এই দাবী পাহাড়ি জনগণেরও। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী সমাধান ছাড়া সার্ভে হাতে পারে না। আর যে সময় হাজার হাজার জুম্ম শরণার্থী ভারতে অবস্থা করছেন, তখন Land survey এর কথা উঠতেই পারে না। অথচ সরকার জুম্মদেরকে চিরদিনের জন্য উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নভেম্বর থেকে পধফধংঃধষ সার্ভে করার কথা ঘোষণা করেছেন। আমাদের এক কথা, ভূমি জরিপ হওয়ার সময় যেসব খাস জমি পাওয়া যাবে তা অবশ্যই ভূমিহীন জুম্ম এবং জুম চাষীদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। 

(৬) সুলতান সাহেব ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত কত বাঙালি মারা গেছেন তার উল্লেখ করলেন সোসাহে। অথচ ১৯৮০ সালের নৃশংস কলমপতি গণহত্যা থেকে এযাবত ১৪/১৫ টি বড় মাপের গণহত্যায় (ছোট ছোট হত্যাকা-ের কথা বাদই দিলাম) যে শত শত পাহাড়ি নরনারী শিশু বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন তার উল্লেখ করেন নি কেন ? এইসব বিভীষিকাময় গণহত্যাগুলো আপনার বিবেকের স্পন্দনকেও স্তব্দ করেছে বলেই কি?

(৭) লোগাং এর মত গণহত্যায় নিরীহ পাহাড়িদের করুন মৃত্যুর পরও তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য এক বিন্দু সুপারিশ করেননি। তিনি তাদের নিরাপত্তা প্রশ্নে টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি। বরং তিনি আশ্চার্য্য জনকভাবে বলছেন, "the safty of Bangalee community is in danger." অর্থা যারাই লোগাং এর মতো গণহত্যা ঘটায় সুলতান হোসেন খানের ভাষায়, তাদের জীবনেরই নিরাপত্তা বিঘিœত। আর যারা গণহত্যার শিকার হয় তাদের জীবন নিরাপদ। এজন্য তিনি সুপারিশ করে বলেন, "They (Bangalee) must raise their own security force namely village Defence party who should be given arms and training for protection of the village in case of any attack by Shanti Bahini." কত বড় অস, বিকৃত ও নীচু মানের মানসিকতার অধিকারী হলে এ রকম ধ্বংসাত্মক সুপারিশ করা যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন বিচারপতি জনাব সুলতান হোসেন খান। তার এই সুপারিশের উদ্দেশ্য হচ্ছে খাঁচার পাখির মত বন্দী পাহাড়িদেরকে বাঙালিরা ১০ এপ্রিল গণহত্যার মত ধরে ধরে যখন ইচ্ছে তখন জবাই করুক।

(৮) সুলতান হোসেন সাহেবের আরো সুপারিশ : “I want to put on record the presence of Army Unit in the Hill Tracts would be necessary as long as the insurgency of Shanti Bahini continues.”  আগাগোড়া না বুঝে মন্তব্য করা ঠিক নয়। আসল কথা হচ্ছে যতদিন সেনাবাহিনী থাকবে ততদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা জিইয়ে থাকবে। আর সমস্যারই সৃষ্টি হচ্ছে বিদ্রোহ, আন্দোলন, সংগ্রাম ও রক্তপাত। এবারের দিঘীনালার ঘটনায় সেনাবাহিনী তারই প্রমাণ দিয়েছে।             

(৯) তিনি এতদূর নীচে নামলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী পাহাড়ি জনগণের ওপর শারিরীর নির্যাতন থেকে শুরু করে গণহত্যা পর্যন্ত যে সমস্ত দুষ্কর্ম চালিয়েছে তিনি তাকে commendable job বলে তার প্রশংসা না করে পারলেন না।

(১০) তিনি সেনাবাহিনীকে ধ্বংসযজ্ঞে উসকে দিয়ে বলছেন, "I may also put on record that the level of casuality in the Hill Tracts at the hands of the Army in counter insurgency operation is very low compared to the situation in some parts of the sub-cotinent or else where in the world."

অর্থা তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির জন্য সেনাবাহিনীর হাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে প্রাণহানি, ধ্বংসযজ্ঞ ও সম্পদের অপচয় ঘটেছে তা উপমহাদেশ এমনকি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় খুবই নগন্য। তার মানে হচ্ছে, সেনাবাহিনী প্রাণহানি ঘটাতে পারবে, অত্যাচার নির্যাতন চালাতে পারবে এবং কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নামে কোটি কোটি টাকা হাতরে নিয়ে পকেটস্থ করতে পারবে। কিন্তু কিছু চরিত্রহীন, লম্পট, মাস্তান ইদানিং সেনাবাহিনীর গুণকীর্তন করে বেশ কামাই করছে। সুলতান হোসেন খানও যেভাবে সেনাবাহিনীর সাফাই গাইছেন, তাতে মনে হয় তিনিও এই দলে আছেন কিনা তা যাচাইয়ের জন্য পাবলিক অচিরেই আর একটা তদন্ত শুরু করে দেবে।

(১১) সেনাবাহিনীর পক্ষে উলঙ্গভাবে ওকালতি করে তিনি আরো বলেছেন, “Not a single case of extra-judicial execution as done else where in some countries in the name of integrity of the country or suppression of terrorism, or extra-legal detention, has been brought to the notice of the Commission.”

এতো জলন্ত মিথ্যাবাদীতা। রাডারের প্রত্যেকটি সংখ্যা এবং সিএইচটি কমিশন-এর রিপোর্ট "Life is not ours: Land and Human Rights in the Chittagong Hill Tracts" তো আপনাকে দেয়া হয়েছে। তাহলে কী সেগুলো একটুও উল্টিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন নি? না হলে এ কথা বলতে পারেন কি করে। আর এগুলো আপনার নজরে আনার প্রয়োজন পড়ে না। যে কোন চোখ কান সচল থাকা মানুষ জানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসলে কি ঘটছে।

সর্বশেষ কথা সুলতান হোসেন খানের লোগাং তদন্ত রিপোর্ট সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর। তার রিপোর্টে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়াই সেনাবাহিনীর উলঙ্গ গুণকীর্তন করা হয়েছে। উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও চরম পাহাড়ি বিদ্বেষী মনোভাব রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সুলতান হোসেন খানের এই তদন্ত রিপোর্ট লোগাং গণহত্যার মতোই বর্বর। তাই তার এই রিপোর্ট ইতিহাসে একটি কালো দলিল হিসাবে থাকবে।

এই পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট দেশে বিদেশে প্রত্যাখাত হয়েছে। আমরা হিল লিটারেচার ফোরামের পক্ষ থেকে লোগাং গণহত্যার পুনঃ তদন্তের জন্য সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছি।

 

লোগাং তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে ৯টি প্রশ্ন

(একতা রিপোর্টার)

চলতি বছরের ১০ এপ্রিল খাগাড়ছড়ির পানছড়ি থানাধীন গুচ্ছগ্রামে সংঘটিত অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকা- সম্পর্কে সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পর বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাসহ দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক মহলে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। লোগাং ঘটনা সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাখবর এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যাদির কথা বাদ দিয়েও কেবলমাত্র প্রকাশিত রিপোর্টটি বিশ্লেষণ করলেও এসকল প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

প্রথম প্রশ্ন হলো : সরকার কর্তৃক দেশী-বিদেশী মহলের কাছে সরবরাহকৃত ইংরেজীতে লেখা ২০ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এই রিপোর্টটিতে তদন্ত কমিশনের প্রধান বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের কোনো স্বাক্ষর নেই কেন ? এ ধরনের রিপোর্টে তদন্তকার্যে অংশগ্রহণকারী সকল কর্মকর্তার নাম পরিচয় থাকার যে সাধারণবিধান রয়েছে এক্ষেত্রে তা নেই।

দ্বিতীয়ত, তদন্ত কমিশনের সামনে উপস্থিত সকল সাক্ষীর সাক্ষা লেখা হয়েছে বাংলায়। কোনো কোনো সাক্ষী তাদের নাম ইংরেজীতে লিখতে গেলে তাদেরকেও বাংলায় লিখতে বলা হয়। সেক্ষেত্রে রিপোর্টটি ইংরেজীতে লেখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে কি? হতে পারে, আগ্রহী বিদেশীদেরকে দেবার জন্য মূল রিপোর্টটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। তাহলে মূল রিপোর্টটি কোথায় ? দেশবাসীর অবগতির জন্য সেটি প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয় নয় কি?

তৃতীয়ত, যে বাঙালি তরুণটির (কবির হোসেন) হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে লোগাংয়ের এত বড় ঘটনা, তার সঙ্গী অন্য যে তরুণেরা আহত হয়েছিল (তারা কজন ছিল)? তাদের কোনো সাক্ষ্য রিপোর্টে নেই কেন? ঘটনার পর বলা হয়েছিল, কবীর হোসেনের আহত সঙ্গী দু’জন খাগড়াছড়ি হাসপাতালে চিকিসাধীন আছে। ঢাকা থেকে সেখানে যাওয়া একটি অতিথিদলের সদস্য মানবাধিকার কর্মী রোজলিন কস্তাসহ কয়েকজন আহতদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও অনুমতি দেওয়া হয়নি। এসব তথ্য তদন্ত কমিশনকে জানানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কমিশন ঐ আহতদের সঙ্গে কথা বললেন না কেন?

চতুর্থত, নিহত কবীর হোসেন এবং তার আহত সঙ্গীদের কোনো বিস্তারিত পরিচয় তদন্ত রিপোর্টে না থাকা কি স্বাভাবিক?

পঞ্চমত, পূর্বোক্ত রোজলিন কস্তা কমিশনের সামনে সাক্ষ্য প্রদানকালে লোগাং ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা নিরূপনের জন্য ঐ গুচ্ছগ্রামের রেশন তালিকা, ভোটার তালিকা পরীক্ষা করার কথা বলেছিলেন, কিন্তু কমিশন তা করেন নি কিংবা এ সম্পর্কে কোনোরূপ মন্তব্যও করেনি কেন?

ষষ্ঠত, লোগাং ঘটনার পর ঐ গুচ্ছগ্রামের অন্ততঃ দুহাজার অধিবাসী ভারতে পালিয়ে গেছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়েও কমিশনকে জানানো হয়। কিন্তু কমিশন বিষয়টি যাচাই করেছিলেন কি? এ সম্পর্কেও নীরব কেন?

সপ্তমত, পূর্বোক্ত রোজালিন কস্তা কমিশনের কাছে বলেছিলেন যে, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তাঁকে বলেছিলেন----ঘটনার পর তিনি লোগাং যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে সেখানে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পরদিন তিনি লোগাং যান এবং ২৩৮ টি মৃতদেহ গুনে দেখেন। এ সম্পর্কে কোনো কথা রিপোর্টে নেই কেন?

অষ্টমত, কমিশন বলেছে, লোগাং ঘটনায় বাঙালি তরুণটিসহ মৃতের সংখ্যা ১৩ জন। কিন্তু তারা কিভাবে নিহত হলো? আগুনে পুড়ে ? ছুড়িকাঘাতে, নাকি বুলেটের আঘাতে ? মৃতদেগুলোর কোনো পোষ্টমর্টেম হয়েছিল কি? এ সকল বিষয়ে বিচারপতির রিপোর্টে কিছু খুঁজে পাওয়া যায়না কেন?

নবমত, বিচারপতি সুলতান হোসেন খান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তদন্ত রিপোর্ট উপস্থাপন করেন ২০ আগষ্ট। কিন্তু তা প্রকাশ করা হয় এর প্রায় দেড় মাস পর। এরই বা কারণ কি?

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন লোগাং ঘটনা সম্পর্কে তাদের “ফলোআপ রিপোর্ট’-এ গত মার্চ মাসে বলেছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলীর উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই তদন্ত রিপোর্টেও কি তারই প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে’?

এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ একে পক্ষপাতদুষ্ট ‘অসত্য’ বলে আখ্যায়িত করে রিপোর্টটি প্রত্যাখান করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। সৌজন্যে সাপ্তাহিক একতা, ৬-১২ নভেম্বর’৯২।

 

লোগাং তদন্ত কমিশন রিপোর্ট :

পাকিস্তান কি বাংলাদেশের চেয়ে বেশী গণতন্ত্রী ?

বিপ্লব রহমান

 

ফ্লাশব্যাক : এক                                                                                                        খাগড়াছড়ি সদরে ফেরার সময় কথা হয় লোগাং গ্রাম থেকে ৩ শিশু সন্তানসহ পালিয়ে আসা বৈশিষ্ট মুনি চাকমার (৩৮) সাথে। বৈশিষ্ট মুনির তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার সময় জঙ্গলে অবস্থান করছিলেন। গ্রামে আগুন জ্বলছে দেখে তিনি দৌঁড়ে এসে দেখতে পান যুগদও (তার ছেলে) ২ ভাই বোনকে নিয়ে পালাচ্ছে। বৈশিষ্টমুনি ৩ সন্তান নিয়ে পালিয়ে যান। পরদিন গ্রামে ফিরে দেখতে পান ১৮ টি লাশ পোড়ানো হচ্ছে। ৫০০ টি ঘরের মধ্যে অধিকাংশ ঘরেই অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, লোগাং গুচ্ছ গ্রামে একেকটি ঘরে ১টি পরিবার বাস করে। তার ভাষা অনুযায়ী, স্থানীয় সূর্য তরুণ উদয় ক্লাবে আরো ১৪৭ টি লাশ সরকারী হেফাজতে রাখা হয়েছে। তিনি তার স্ত্রীর লাশ হস্তান্তরের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তার আবেদনে কর্ণপাত করা হয়নি’ [দ্রঃ সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম ২৬ এপ্রিল’৯২ পৃ-২২]

ফ্লাশব্যাক : দুই

‘ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ঐদিন খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাং গ্রামে ১ জন বাঙালি কিশোর হওয়ার সূত্র ধরে আনসার, ভিডিপি (গ্রাম প্রতিরক্ষা দল) ও কিছু গ্রাম্য টাউট মাস্তান বাঙালি যৌথভাবে পাহাড়ি চাকমা ও ত্রিপুরাদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে। সেখানে নূন্যতম ৪ শতাধিক ঘরে অগ্নিসংযোগ ও ২ শতাধিক দরিদ্র পাহাড়িকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রিয় পাঠক, ঘেরাও করে পাইকারী হারে পাহাড়ি নিধন যজ্ঞের এই ঘটনা আমাদের বাধ্য করে ভিয়েতনামের মাহলাই গ্রামের সেই বর্বরোচিত গণহত্যার কথা স্মরণ করতে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত লোগাং-এ কার্ফ্যূ চলছে পানছড়িতে প্রবেশের উপর কড়া সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে’ [দ্রঃ সাপ্তাহিক প্রয়োজন / ১ মে’৯২ পৃ , ৬]

ফ্লাশব্যাক : তিন

‘পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রত্যাগত ২৩ জন রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, লেখক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা, মানবাধিকার কর্মীর যুক্ত বিবৃতিঃ .....আমরা গত ১১ এপ্রিল খাগড়াছড়ি যাই। ঐদিন দেশের সকল জাতীয় দৈনিক একটি খবর প্রকাশিত হয় এই মর্মে যে, “শান্তিবাহিনীর হামলায় লোগাং গ্রামে ১জন বাঙালি ও ১০ জন উপজাতীয় নিহত হয়েছেন।’ খাগড়াছড়ি গিয়ে আমরা স্বভাবতঃই ঐ অঞ্চলে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করি, ঘটনার সত্যাসত্য জানার দায়িত্ববোধ থেকে। কিন্তু পরের দিন ১২ এপ্রিল লোগাং যাবার পথে পানছড়িতে আমরা বাধাপ্রাপ্ত হই এবং আমাদের নিরাপত্তার কথ বলে নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের ঘটনাস্থলে যেতে বাঁধাদান করে। ফেরার পথে এবং খাগড়াছড়িতে বহু সংখ্যক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনার শিকার ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আমাদের সাক্ষা হয়। কর্তৃপক্ষীয় বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গেও এনিয়ে আমাদের কথা হয়। এ সব কিছু থেকে আমরা এই স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, লোগাং গ্রামে ১টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। ১ জন বাঙালি কিশোর নিহত হওয়ার সূত্র ধরে সেখানে চাকমা ও ত্রিপুরা গুচ্ছগ্রামে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ভিডিপি ও আনসার বাহিনী কিছু বাঙালি দুস্কৃতিকারীর সহযোগীতায় হামলা চালায়। ৪শ’রও বেশী ঘর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় এবং নারী শিশু-বৃদ্ধসহ ২ শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়’। [দ্রঃ পূর্বোক্ত/পৃঃ ৭]

ফ্ল্যাশব্যাক : চার                                                                                                      ‘খাগড়াছড়ি জেলার লোগাং গ্রামে গত ১০ এপ্রিল ১টি ভয়াবহ গণহত্যা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকার প্রথমে ঘটনা ও মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছিল। একে শান্তিবাহিনীর কাজ বলে চেষ্টা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে পত্র-পত্রিকায় ভিন্ন তথ্য প্রকাশিত হয়। .......... তারা ঘটনার যে সব বিবরণ দিয়েছেন তাতে ১০ এপ্রিলের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা অনেক বেশী বলে মনে হয়। এরপর লোগাং ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার ১টি কমিশন গঠন করেন। এবং সর্বশেষ গত ১৩ মে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া লোগাং পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মৃতের সংখ্যা ১৩ জন, কিন্তু এটা কি করে ১৩শ’ হলো ? লোগাং ঘটনা সম্পর্কে যদি জেনে অতিরঞ্জিত প্রচারণা হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য মূলত দায়ী সরকারের তথ্য গোপনের প্রচেষ্টা। লোগাং এ মৃতের প্রকৃত সংখ্যা যে কয়জনই হোক না কেন সেই হত্যাকা- যে শান্তিবাহিনী ঘটায়নি এটা এখন পরিস্কার। কিন্তু সরকার প্রথম থেকেই এই ঘটনায় শান্তিবাহিনীকে জড়াতে গিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া লোগাং গিয়ে ঘটনাকে দুঃখজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এটা করতে তিনি এত বিলম্ব করলেন কেন ? কেনই বা এমন ‘দুঃখজনক’ ঘটনা ঘটে যাওয়ার ১ মাস পর তদন্ত কমিশন গঠন করা হল ? [দ্রঃ সাপ্তাহিক যায় যায় দিন/১৯ মে ৯২/পৃঃ ৭]

 

বাস্তবতা এক : অবিশ্বাস্য                                                                                            ‘পাস্তিানের ১টি সামরিক আদালত সিন্ধুর ৯ জন গ্রামবাসীকে হত্যার অভিযোগে সেনাবাহিনীর ১ জন মেজরকে মৃত্যুদ- এবং ১৩ জন জওয়ানকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে। ............... প্রথমে এক সরকারী বিবৃতিতে এই গ্রামবাসীদের সন্ত্রাসী হিসাবে আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছিল যে, এরা গুলি বিনিময়ের সময় প্রাণ হারায়। কিন্তু সংবাদ পত্রে একাধিক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর তদন্তে এই বিবৃতি অসত্য প্রমাণিত হয় এবং সামরিক বাহিনীর এই লোকদের গ্রেফতার করা হয়’ [দ্রঃ দৈনিক বাংলা বাজার পত্রিকা/১ নভেম্বর ’৯২]

বাস্তবতা দুই                                                                                                    ‘লোগাং ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ লোগাং ঘটনা তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি সুলতান হোসেন খান এ প্রসঙ্গে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, লোগাং ঘটনা তথাকথিত শান্তিবাহিনীর সুপরিকল্পিত আচরণের দুঃখজনক প্রকাশ। যার ফলে কবির হোসেন নামক ১ জন বাঙালি ছেলেসহ ১২ জন উপজাতীয় নিহত হয় এবং ২জন মারাত্মকভাবে আহত হয়’ [দ্রঃ সাপ্তাহিক প্রয়োজন/২৩ অক্টোবর ’৯২ পৃঃ ৫]

বাস্তবতা তিন : জাতীয়তাবাদী অশ্বডিম্ব

প্রিয় পাঠক। কথিত গণতন্ত্রী (!) খালেদা জিয়া সরকারের ১ সদস্য বিশিষ্ট সাধের তদন্ত কমিশন লোগাং গণহত্যার দীর্ঘ ১ মাস পর গঠিত এবং প্রায় ৫ মাস (মাত্র) পর প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্ট থেকে কয়েকটি বিষয় দিবালোকের মত পরিস্কার যে, ক: এখানে উল্লেখিত সরেজমিন প্রতিবেদন-অনুসন্ধানমূলক বিশ্লেষণসমূহ, এমন কি অনুল্লেখিত প্রায় ডজন খানেক দেশী-বিদেশী সাপ্তাহিক ও দৈনিকের অনুপরিমাণ প্রতিফলন ঘটেনি। খ: এটি মূলতঃ ১১ এপ্রিল ’৯২ এর সরকারী প্রেসনোটের চর্বিত চর্বন। গঃ এটি একটি জাতীয়তাবাদী অশ্বডিম্ব।

বাস্তবতা চার: প্রাসঙ্গিক কথন

লোগাং তদন্ত কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি, পাহাড়ি গণপরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, ৫দল, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন সহ প্রগতিশীল মহল তার প্রতিবাদ ও প্রত্যাখ্যান করে।

কিন্তু পাঠক, সংসদীয় গণতন্ত্রের ‘জাতীয়বাদী’ বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের উল্লেখিত অবিশ্বাস্য বাস্তবতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ তো দূরের কথা, সত্য প্রকাশের স সাহস পর্যন্ত দেখায়নি। তাহলে কি হিন্দু মুসলিম বা শিয়া - সুন্নী বা মৌলবাদী-কাদেয়ানী দাঙ্গা এবং সর্বোপরি সামরিক - বেসামরিক যাঁতাকলে পিষ্ট স্বৈরতন্ত্রের দেশ পাকিস্তান কি বাংলাদেশ সরকারের চে’ বেশী গণতন্ত্রী ? না। বিষয়টা তা নয়। বস্তুতঃ পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্র সরকারগুলি ক্ষমতায় এসেই সে দেশে কিছু কিছু বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনগণের কাছে এটা প্রচার করার চেষ্টা করেছিল যে, তারা ঝটপট সব কিছু করে ফেলতে পারে। সিন্ধুর ঘটনা তেমনি ১টি উদাহরণ মাত্র। খবর নিলে দেখা যাবে যে, এখানেও হয়তো মৃতের সংখ্যা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে এবং প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের অনেকেই হয়তো উচ্চমহলীয় কানেকশনের জন্য ছাড়া পেয়ে গেয়েছেন। অন্যদিকে বর্তমান স্বৈরতন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকার যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ‘জন প্রতিনিধি’ সেজে বসে আছেন, সেহেতু তারা হয়তো ভেবে থাকবেন যে, নির্বাচনে তো জনগণ আমাদের রায় দিয়েছে, অতএব আমরা যা বলিব তাহাই জনগণ সত্য জানিবে, সুতরাং মা ভৈ !

এখানেই বড়লোকদের রাজনৈতিক দলের বিশ্বাসঘাতকতা, নির্বাচনী রাজনীতির সরলতা ও বিদ্যমান শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলার যৌক্তিকতা পুনর্বার প্রমাণিত হয়েছে। তাই পার্বত্য সমস্যা সমাধানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনসহ সারা দেশে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তীব্রতর করা আমাদের আশু কর্তব্য। (৪-১১-৯২)

 

প্রবন্ধ

জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও তার নেতৃত্ব

পল্লব


পূর্বকথা:-                 

বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে পা দিয়েছি। মানব সভ্যতা এখন চরম উন্নতির শিখরে। জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষের জীবন যাত্রার মান বহুগুণে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার-আধুনিকায়নের ফলে একদেশ থেকে আর এক দেশ, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পাড়ি জমানো আর কোন কল্পনার বস্তু নয়। মানুষ পৃথিবীকে জয় করে পাড়ি জমাচ্ছে মাহাকাশের রহস্য অনুসন্ধানে। এত কিছু পরিবর্তন কিন্তু পৃথিবীর সকল মানব সদস্যদের নিকট সুফল বয়ে আনতে পারেনি। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গুটিকয়েক মানুষের দ্বারা চরম ভাবে নির্যাতিত। এ সকল নিপীড়িত জনগণ ঐ সব সভ্যতার সুফল তো ভোগ করতেই পারছে না বরং সেই সভ্যতাই তাদের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে আছে। এই সভ্যতার জগদ্দল পাথরে চাপা পড়া বিরাট মানব গোষ্ঠির এক সামান্য অংশ হচ্ছে বাংলাদেশর পার্বত্যঞ্চলের জুম্ম জনগোষ্ঠী। আজ তারা সেই সভ্যতার জগদ্দল পাথরকে ছড়ানোর সংগ্রামে অবতীর্ণ। এসব কুসিত সভ্যতার হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে কোন ধরণের সংগ্রামের প্রয়োজন, তা এই প্রবন্ধে অতীতের ইতিহাসের আলোকে আলোচনা করতে চেষ্টা করবো।

জাতীয় আন্দোলন কি:-                                                                                               জাতীয় আন্দোলন হচ্ছে একটি বুর্জোয়া আন্দোলন, যাকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও বলা যায়। এ জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য মূখ্যত সামন্ততান্ত্রিক উপাদন পদ্ধতি বাতিল করে পুঁজিবাদী উপাদন পদ্ধতি চালুকরা এবং জাতিতে জাতিতে সম্মিলন ঘটিয়ে একটি একক ভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করা। এই আন্দোলন দেশীয় সামন্ত ও ভূস্বামী তথা অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণীর আন্দোলন, যা ইউরোপে ষোল শতকে সংগঠিত হয়েছিল। যার ঐতিহাসিক নাম হচ্ছে ‘শিল্প বিপ্লব’। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে সাধারণত বুর্জোয়ারা থাকে। বুর্জোয়াদের এই আন্দোলনের ফলে গড়ে উঠে শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতি। যার কারণে গুটিকয়েক সংগঠন ও ট্রাষ্টের হাতে দেশের সকল অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়। অর্থনীতির এই কেন্দ্রীভবনের ফলে এক বিরাট সংখ্যক জনসমষ্টি ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে শিল্প শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়। অর্থ কেন্দ্রীভবনের সাথে সাথে জনশক্তি নির্দিষ্ট কয়েকটি শিল্প কারখানায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত এই সমন্বিত জনশক্তি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। সে কারণে জাতীয় আন্দোলন সামন্তবাদকে ধ্বংস করার মূল উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক শ্রেণীর ভয়ে জাতীয় আন্দোলন একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এলে বুর্জোয়ারা সামন্তবাদের সাথে আপোষ করে, সামন্তবাদের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। ইত্যাদি কারণে বুর্জোয়ারা জাতীয় আন্দোলন সফল ভাবে সমাপ্ত করতে পারে না।

জাতীয় আন্দোলন থেকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন :-

ষোল শতকে-ইউরোপের শিল্প বিপ্লব তথা বুর্জোয়া বিপ্লবের ফলে উপাদন পদ্ধতির এক আমূল পরিবর্তন আসে। পণ্য উপাদন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকায় উপাদিত পণ্য দেশীয় বাজারে ধারণ করতে পারে না। পুঁজিপতিরা দেশীয় বাজারে সন্তুষ্ট থাকতে না পেরে ভিনদেশে এসব উদ্বৃত্ত পণ্যের বাজার সৃষ্টি করার প্রয়োজন অনুভব করে। যার কারণে পণ্যের বাজার দখল ও কাঁচামালের যোগানদানকারী উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয় অপেক্ষাকৃত পশ্চাপদ দেশ গুলিকে। তার পর শুরু হয় পর রাজ্য গ্রাস করার প্রতিযোগিতা। শুধুমাত্র এই প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে ১৯১৪ সাল হতে ১৯৪৫ সালের ভেতরে পৃথিবীর বৃহ দুটি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যাকে আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে চিনি। পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদে উত্তীর্ণ হয় তখন থেকে অর্থা ১৮৭৬ সাল থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ইউরোপের মোট আয়তনের আড়াই গুণের সম পরিমাণ ভূমি-দখল করে পঞ্চাশ কোটির অধিক জনগণকে উপনিবেশিক শৃংখলে আবদ্ধ করে। এবং ঐ সব দখল কৃত দেশসমূহের সকল প্রকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভাগ গুলি দখল করে ফেলে। উপনিবেশিক জনগণের উপর চালাতে থাকে নিষ্ঠুরতম জাতীয় নিপীড়ন। এই নিষ্ঠুর উপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত জনগণ গড়ে তোলে সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বদেশ ও স্বজাতিকে মুক্ত করার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে মূলত নেতৃত্বে থাকে নিপীড়িত জাতির উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণী। এই আন্দোলন প্রধানত পরিচালিত হয় বিদেশী শাসক সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় সামন্তবাদের বিরুদ্ধে। জাতীয় আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ভিন্নতা এখানে।

নব্য জাতীয় মুক্তি আন্দোলন:-
সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা বৃহ জাতীয় মুক্তি আন্দোলন চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে আপাত সমাধান হয়েছিল। কিন্তু তার পর পরই অর্থা পঞ্চাশ দশকের প্রথম থেকে নতুন করে যে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়, তার প্রকৃতি পূর্ববতী সময়ে চলে আসা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। ভিন্ন এই অর্থে; চলতি শতাব্দির প্রথম থেকে পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত যে সব জাতীয় মুক্তি আন্দোলন চলেছিল, সে গুলো হচ্ছে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বৃহ জাতির আন্দোলন। আর পঞ্চাশ দশক হতে বর্তমান পর্যন্ত যে সব জাতীয় মুক্তি আন্দোলন গুলো চলছে সে গুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের দালাল আমলা মুসুদ্দী শ্রেণী যারা সাম্রাজ্যবাদের তাল্পিবাহক হিসেবে রাষ্ট্র যন্ত্রের ক্ষমতায় রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সমূহের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। এই সব ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বা সমূহ পঞ্চাশ দশক বা তার আগে ছিল সম্পূর্ণ ভাবে অবিকশিত বা সামন্ত নিন্দায় আচ্ছন্ন। এই সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সমূহ সা¤্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শাসনের করাল থাবাতেও জেগে উঠেনি। না উঠার কারণ ও রয়েছে। সেই কারণ গুলো হচ্ছে, সে কালের সাম্রাজ্যবাদের করাল থাবা তখন তাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। না পারার কারণ হচ্ছে তখনকার উপনিবেশিক শাসকদের জন্য এসব জাতিসত্তাসমূহ তেমন কোন সমস্যা ছিল না। সে কারণে তাদের উপর ঐ শাসকরা সরাসরি তেমন নিপীড়ন চালাইনি যাতে সহজে ঘুম ভাঙে। পারত পক্ষে এসব ডামাডোল পরিস্থিতি থেকে দূরে ছড়িয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিল। উদাহরণ স্বরূপ পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৯০০ সালের Hill Tracts Regulation  এই অধ্যাদেশ জারী করে বাঙালি সম্প্রসারণের হাতকে বন্ধ করে দিয়েছে বটে, তার সঙ্গে সঙ্গে বহির্বিশ্বের সকল প্রকার জ্ঞান, বিজ্ঞান থেকেও দূরে সরিয়ে রেখেছে। পাহাড়িদেরকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখাটা যতটা পাহাড়িদের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রেখে করা হয়েছিল তার চেয়ে বেশী তাদের (সাহেব) স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রেখেছিল। কারণ সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী গড়ে উঠা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের হাওয়া যদি এসব সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের উপর পড়ে, তাহলে তারাই (সংখ্যালঘুরা) আর এক সমস্যা সৃষ্টি করবে। এ সব কিছুর ভয়ে তাদের এই পদক্ষেপ। সুতরাং পঞ্চাশ দশকের পূর্বে ও পরে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পার্থক্যটা মোদ্দা কথায় প্রথমটা হচ্ছে উপনিবেশিক যুগের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, দ্বিতীয়টা হচ্ছে নয়া উপনিবেশিক যুগের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। প্রথমটা করতে হয়েছে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের আমলা মুসুদ্দী শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে।

জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব:-

পঞ্চাশ দশকের পূর্বে যে সকল জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হয়েছিল, সে সব আন্দোলনে দু’ধরনের নেতৃত্ব ছিল এবং দু’ভাবেই সমাধান হয়েছিল। যে সব আন্দোলনে বুর্জোয়ারা নেতৃত্বে ছিল সে সব দেশ পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্কগুলি ছিন্ন করতে পারেনি। কারণ বুর্জোয়া নেতৃত্ত্বে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন যেহেতু জাতীয়বাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠে সেই হেতু এসব আন্দোলন পূর্ণভাবে বিজয় লাভ করতে পারে না। তাই একটি পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের সহিত আপোষ করে এক প্রকার জগাখিচুরী ইতিটানে। এসবের ফল দাঁড়ায় প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় বটে, কিন্তু পরোক্ষ উপনিবেশিক শাসন তথা নয়া উপনিবেশিক শাসনে থেকে যায়। যার কারণে এসব দেশে জাতীয় নিপীড়ন অব্যাহত থাকে। এরই ফলে আবারও নতুন ভাবে জাতিগত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। যেমন আজকের ভারত, পাকিস্তান, বার্মা ও বাংলাদেশ।

অন্যদিকে যে সব দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন শ্রমজীবী জনগণের নেতৃত্বে সফল হয়েছিল সে সব দেশ সম্পূর্ণভাবে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে সক্ষম হয়। এবং জাতীয় সমস্যাগুলো পুরোপুরি সমাধান করতে সক্ষম হয়। জনসাধারণের ভেতর অর্থনৈতিক তথা জীবন যাত্রার মানের পার্থক্য কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এসব দেশ হচ্ছে, চীন, উঃ কোরিয়া, কমিউনিষ্ট পিির্ট ক্ষমতায় থাকাকালীন ভিয়েতনাম সহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক দেশসমূহ। এসব দেশ সমূহে বিভিন্ন জাতি বা জাতিসত্তার সংমিশ্রণ থাকা সত্বেও জাতিগত সমস্যা সৃষ্টি বা উদ্ভব হয়নি, যতদিন প্রকৃত কমিউনিষ্টরা ক্ষমতায় ছিল। উপরের আলোচনায় এবং ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন জাতি বা জাতিসত্তা সমন্বিত জাতীয় আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব বা সা¤্রাজ্যবাদের শৃংখল থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পারে একমাত্র শ্রমজীবী জনগণের নেতৃত্ব ঐ সব আন্দোলনে থাকলে। অন্যথায় সাময়িকভাবে জাতীয় দ্বন্দ্বগুলো চুপসে গেলেও কিছু দিনের পর তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে একেবারে আরও এক নতুন আঙ্গিকে। কারণ জাতীয়তাবাদ যেখানে থাকে সেখানে জাতিগত নিপীড়নও থাকে। জাতিগত নিপীড়ন থাকলে জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে বাধ্য। আজকের নয়া উপনিবেশিক যুগে বুর্জোয়ারা পূর্বে যতটুকু দায়িত্ব পালন করতো, এখন তাও পারছে না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে আরও বেশী এ কথাটি প্রয়োজন।

ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জাতীয় আন্দোলনের মিত্র শক্তি:-

উপনিবেশিক আমলে জাতীয় মুক্ত আন্দোলন ছিল সংখ্যালঘু শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত জনগণের আন্দোলন। কিন্তু নয়া উপনিবেশিক শাসনামলে ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আন্দোলন হচ্ছে বৃহ শাসক জাতির বিরুদ্ধে। সে কারণে উপনিবেশিক শাসনামলের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ভিত্তির চেয়ে নয়া উপনিবেশিক শাসনামলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আন্দোলনের ভিত্তি আপত দৃষ্টিতে অনেকটা নড়বড়ে মনে হয়। কিন্তু এসব বৃহ জাতির শাসক দলের ভিত্তিটা ভালোভাবে তলিয়ে দেখলে আদতে অতটা শক্ত নয়। তার কারণ হচ্ছে, শাসক জাতির যে শ্রেণীটি রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে বা থাকে সে শ্রেণীটা শুধু মাত্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগণের উপর নিপীড়ন নির্যাতন করেনা। একই সাথে তাদের স্বজাতির শ্রমজীবী জনগণের উপরও শোষণ নির্যাতন চালায়। তাই এই সকল শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে স্বীয় জাতির শ্রমজীবী জনগণও আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলে। সুতরাং বৃহ জাতির শ্রমজীবী জনগণের আন্দোলনের শত্রু ও নিপীড়িত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মুক্তির আন্দোলনের শত্রু অভিন্ন। উভয়েই একই অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে অবতীর্ণ। সে কারণে শাসক জাতির শ্রমজীবী জনগণ যারা আন্দোলন সংগ্রামে নিয়োজিত তারাই হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মিত্র শক্তি। সুতরাং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মুক্তি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে ঐ সব শ্রমজীবী জনগণের সংগ্রামের সাথে সম্পর্ক রেখে। এবং তা সম্ভব হবে যদি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মুক্তির আন্দোলনে শ্রমজীবী জনগণের নেতৃত্ব থাকে। উপরোক্ত উভয় প্রকার আন্দোলন যুগপভাবে গড়ে তুলতে পারলে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিটি যতটুকু মজবুত বা শক্ত মনে হয় তত টুকু শক্ত থাকতে পারে না।

এ সকল প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী দুর্বল হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে তাদের ভিত্তি জনগণের গভীরে প্রোথিত নয়। তারা বেঁচে থাকে সাম্রাজ্যবাদের খুঁটির উপর। অনেকটা পরগাছার মত। সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদ না পেলে তারা একদিনও বেঁচে থাকতে পারে না। অর্থা সাম্রাজ্যবাদের লগ্নী পুজির উপরই তাদের টিকে থাকা না থাকা। সাম্রাজ্যবাদের লগ্নি পুঁজি (তাদের ভাষায় সাহায্য) ততদিনই এসব দেশে অব্যাহত থাকে, যতদিন লাভের পরিমাণ নিশ্চিত থাকে। লাভের পরিমাণ নিশ্চিত রাখতে হলে সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক থাকতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ যদিও লাভের জন্য সে সব দেশের ন্যূনতম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আশা করে কিন্তু তাদের লগ্নি পুঁজি সে ভাবে থাকতে দেয় না। যার কারণে নিপীড়িত জনগণের আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে যা সাম্রাজ্যবাদের জন্য মোটেই সুখকর নয়। এসব অসুখকর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সে সব দেশের ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন করে। কিন্তু এক সময় এসকল কিছুতেই কাজ না হলে ধীরে ধীরে তাদের পুঁজি প্রত্যাহার করতে শুরু করে। যার কারণে ঐ পরগাছা আমলা মুসুদ্দী শ্রেণীর অধঃপতন শুরু হয়। এটা হচ্ছে এসকল শাসক শ্রেণীর দুর্বলতার দ্বিতীয় কারণ।

সুতরাং আজকের প্রেক্ষাপটে জনগণকে ঠিক করতে হবে আমরা কোন ধরনের নেতৃত্বের দ্বারা আমাদের সংগ্রাম এগিয়ে নেবো, এবং কোন ধরনের মুক্তি আমরা কামনা করি। আমরা তথা জনগণ যদি চাই সমাজের সকল শ্রেণীর মুক্তির জন্য লড়বো, তাহলে শ্রমজীবী জনগণের নেতৃত্বে আমাদের আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। নতুবা অনেক কিছু আত্মত্যাগের পর যদি কিছুটা অর্জন করা যায়ও তাহলে ঐ অর্জিত সুফল জনগণ ভোগ করতে পারবে না। নিরীহ জনগণ রক্তের বিনিময় আন্দোলন সংগ্রাম করবে আর সুফলের থলেট গিয়ে পড়বে, গৌতম দেওয়ান, সমীরণ দেওয়ানের মত প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীটির হাতে। যেভাবে একাত্তর সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর বাংলাদেশে হয়েছে বা হচ্ছে। একাত্তর সালে শ্রমজীবী বাংলার জনগণ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করলো আর সেই রাষ্ট্র ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে পার্লামেন্ট ও রাষ্ট্রপতির মত উচ্চ পোষ্টগুলোতে বসে আছে সে সময়ের বিরোধীতাকারী জামাত-শিবির চক্র, আর জনগণ মরছে না খেয়ে। এই হচ্ছে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের মাহাত্ম্য। আমাদের পার্বত্য এলাকার আন্দোলন যদি ঐ একাত্তোর সালের শ্রেণীটির নেতৃত্বে চলে তাহলে কোন দিন মুক্তি আসলেও তা হবে বাংলাদেশের মত। সুতরাং জনগণের এখন থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কোন ধরনের মুক্তি অর্জন করতে চাই।

 

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ৬ জন ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার রায় 
                              অনুবাদঃ - অলীক                                 

১৭ ফেব্রুয়ারি’৯২ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমধানের দাবীতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি ঢাকায় এক ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশ শেষে সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ৫ দফা দাবী সম্বলিত একটি স্মারকলিপি জাতীয় সংসদের স্পীকারের কাছে পেশ করেন। বিকেলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক সম্মেলনেরও আয়োজন করেন। তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনাপূর্বক দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে একটি প্রচার পত্র বিলি করা হয়।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উক্ত কর্মসূচী সফল করার পর খাগড়াছড়ি থেকে আগত পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দকে একটি ভাড়া করা বাসে বাড়ি ফেরার পথে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ’৯২ মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্পে আটকানো হয়।

৬ জন ছাত্রীসহ মোট ৭৭ জনের এই দল থেকে এক রাত্রির পর ৬ জনকে আটক রেখে বাকীদের ছেড়ে দেয়া হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারি মানিকছড়ি জোন কমান্ডারের পক্ষে মেজর আশফাকুর রহমান বাদী হয়ে এই ৬ জন নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার এজাহার দায়ের করেন। এই ৬ জন ছাত্র নেতার জন্য প্রথমে মানিকছড়ি উপজেলা মেজিষ্ট্রেট আদালতে জামিনের আবেদন করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞ মেজিষ্ট্রেট মামলার ধারা জামিনযোগ্য নয় বিধায় জামিন না মঞ্জুর করেন। তারপর ১৪ই মার্৬ চট্টগ্রামের উপবিভাগীয় কমিশনারের আদালতে ছাত্রনেতাদের পক্ষে খ্যাতনামা আইনজীবী ব্যরিষ্টার আমীর-উল-ইসলাম জামিনের প্রার্থনা করেন। এই আদালতের বিজ্ঞ-বিচারক জামিনের আবেদন সরাসরি না মঞ্জুর করে ২৮শে মার্চ জামিনের আবেদন শুনানীর দিন ধার্য করে। কিন্তু ২৮ তারিখ আসামী পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত থাকলেও আদালত বসেনি বিধায় জামিনের শুনানী হয়নি।

পরে ব্যারিষ্টার আমীর-উল-ইসলাম এই ৬ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬১ ক ধারা মোতাবেক মহামান্য হাইকোর্টে ছঁধংযরহম মামলা দায়ের করেন। মহামান্য হাইকোর্টের প্রদত্ত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা নাকচ (ছঁধংযবফ) হয়ে যায় এবং ৬ জন ছাত্র নেতা মুক্তি পান। মহামান্য হাইকোর্টের এই রায় ইংরেজি থেকে বাংলাং অনুবাদ করে ছাপানো হলো।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট 
হাইকোর্ট বিভাগ,                                                                                                         ঢাকা                                                                                                               
ফৌজদারী রিভিশনাল-এখতিয়ার

তারিখ-২১ শে এপ্রিল, ৯২    
                                                                                         
বিচারপতি উপস্থিত জনাব আনোয়ারুল হক চৌধুরী

এবং

বিচারপতি জনাব মোঃ আব্দুল করিম                                                                                          
ফৌজদারী রিভিশন নং ৪১৭/৯২ (জি.আর, মামলা নং ৩/৯২

উপজেলা মেজিষ্ট্রেট আদালত মানিকছড়ি,                                                                                          
জেলা-খাগড়াছড়ি                                                                                                               মোতাবেক মানিকছড়ি থানা-মামলা নং ৩ তারিখ ২০/২/৯২ হতে উদ্ভুত

অনিমেশ চাকমা ওরফে রিংকু এবং অন্যান্য আবেদনকারী      
                                                             
বনাম

রাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিরুদ্ধ পার্টি

মিঃ আমীর-উল-ইসলাম

মিস শিরিন আহমদ চৌধুরী .......... আবেদনকারীদের পক্ষে

সহকারী এটর্নী জেনারেল                                                                                                     

...... রাষ্ট্রের পক্ষে

শুনানী ২০ শে এপ্রিল ১৯৯২ইং

রায় - ২১ শে এপ্রিল ১৯৯২ ইং

আনোয়ারুল হক চৌধুরী, বিচারপতি

মানিকছড়ি থানা মামলা নং ৩ তারিখ ২০/২/৯২ইং জি, আর, মামলা নং ৩/৯২ ধারা ১২১ ক/১২৪ খ বাংলাদেশ দন্ডবিধির বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬১ ক ধারার অধীনে মামলা নাকচের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রুল উদ্ভুত।

সংক্ষেপে বিষয়বস্তু হলো এই, মানিকছড়ি জোন কমান্ডারের পক্ষে মেজর আশফাকুর রহমান একটি এজাহার দায়ের করেন। অভিযোগ হলো ১৮/২/৯২ইং আনুমানিক সকাল ১১ ঘটিকায় চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়িগামী একটি বেসরকারী বাস যাচ্ছিল। এবং ইহা হতে পাম্পলেট বিলি করা হচ্ছিল এবং বাসের যাত্রীরা প্রধান রাস্তায় হৈচৈ করে রাষ্ট্র বিরোধী শ্লোগান দিচ্ছিল। এই সময় এক ধোপা কন্ট্রাক্টর জনাব হারুনুর রশীদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি লিফলেট গুলো পড়েন। সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য ছিল। উক্ত কন্ট্রাক্টর লিফলেট জোন কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করেন। জোনাল প্রধান দপ্তর পর্যালোচনা করে দেখতে পান যে লিফলেটটি ও স্মারক লিপিতে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য রয়েছে যা পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকীস্বরূপ। তখন জোনাল কমান্ডার গাবমারা ক্যাম্প-এ বাসটি থামানোর এবং তল্লাসীর নির্দেশ দেন। বাসটি থামিয়ে তল্লাশী চালানো হলে আবেদনকারী আসামীদের নিকট থেকে ৪০০ লিফলেট ও ১০০ স্মারকলিপি উদ্ধার করা হয়। ঐ দিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা আবেদনকারী আসামী অর্থা অনিমেশ চাকমা, তকলু চাকমা, পুলক বরন চাকমা, সাধন চাকমা, প্রদীপন খীসা, মনোপল চাকমা কে রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের জন্য গ্রেফতার করেন। আবেদনকারীর আসামীদের ১৮-২-৯২ইং তারিখ গ্রেফতার করা হয়। আর এজাহার দায়ের করা হয় ২০-২-৯২ ইং এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১২১ক/১২৪ক ধারার অধীনে একটি ফৌজদারী মামলা আরম্ভ হয়। আবেদনকারী অনিমেশ ও অন্যান্যরা কারাগারে আছেন। ইহা যুক্তি দেখানো হয় যে, আবেদনকারী আসামীরা সকলেই এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সদস্য। এই পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রদের একটি ফোরাম, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং অধিকতর সমন্বয় ও বর্তমান সরকারের উদার মনোভাবের অঙ্গীকার লাভ করার জন্য গঠিত হয়েছে। পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার জন্য আয়োজন করে এবং ১৭-২-৯২ইং তারিখে তারা মাননীয় স্পীকারের সমীপে পাঁচ দফা দাবী বাস্তবায়নের দাবীতে স্মারকলিপি প্রদান করে। দাবীগুলোর মধ্যে ঐ জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ বাতিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য পার্লামেন্টারী সাব কমিটি গঠন এবং প্রত্যাগতদের পুনর্বাসন দাবী অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরিষদ ১৭-২-৯২ তারিখে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এবং ঢাকায় একটি মিছিল বের করে এবং তাদের পাঁচ দফা দাবী প্রচার করে। আবেদনকারীদের বিষয় হলো যে, স্পীকারকে স্মারকলিপি প্রদান ও সংবাদ সম্মেলন শেষ করে আরো ৭৫ জন ছাত্রের সাথে বাড়ি ফেরার পথে এই ছাত্র নেতাদের খাগড়াছড়ি হতে ১৮-২-৯২ তারিখ গ্রেফতার করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ৭০ জন ছাত্রকে মুক্তি দেয়, যারা তাদের সাথে ছিল কিন্তু মাত্র আবেদনকারীদের জেলে নিয়ে যায়। ইহা যুক্তি দেখানো হয় যে বিক্ষুব্ধ (ওসঢ়ঁমহবফ) মামলার কার্যধারা আইন প্রক্রিয়ার অপব্যবহার এই কারণে যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯৬ ধারা মোতাবেক সরকার অথবা সরকারের পক্ষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন অফিসার কোন অভিযোগ দায়ের করেননি। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১২১ক/১২৪ক ধারার অধীনে কোন মামলার কার্যধারা আরম্ভ করার ক্ষেত্রে ১১৬ ধারা একটি কর্তৃত্বমূলক বিধি এবং এ জন্য বর্তমান মামলার কার্যধারা আইনের কর্তৃত্বমূলক বিধি লংঘন করেছে বিধায় বাতিল যোগ্য।

বিজ্ঞ আইনজীবী মিঃ আমীর-উল-ইসলাম আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে বর্তমান মামলার কার্যধারার মূল ভিত্তি লিফলেটটির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে যুক্তি দেখান যে, উক্ত পাম্পলেট পাঠ করিলে ইহা দেখা যায় যে, বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১২১ ক/১২৪ ক ধারার কোন উপাদান পরিলক্ষিত হয় না। যুদ্ধ সংগঠিত করা কেবলমাত্র সুখের কথায় করা যায় না। বরং কিছুটা ভিন্ন অর্থে প্রকৃত যুদ্ধ বা ইহার জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন হইবে। তিনি আরো যুক্তি দেখান যে, পাম্পলেট গুলো বাংলাদেশ সরকারের উচ্চতর কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করা হয়েছিল এবং ইহাতে গোপন কিছু ছিল না। ইহা কেবলমাত্র পাহাড়ি জনগণের একটা দাবী এবং এখানে রাষ্ট্রদ্রোহীমূলক বিষয় নাই। এই দাবীগুলো তাহাদের দীর্ঘদিনের দাবী এবং পাহাড়ি জনগণ কর্তৃক দীর্ঘদিন যাব এই দাবী উচ্চারিত হয়ে আসছে এবং এই দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এইগুলো উচ্চারিত হইতে থাকিবে এবং এখানে রাষ্ট্রদ্রোহীতা মূলক বিষয় নাই। মিঃ আমীর-উল-ইসলাম বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১২৪ ক ধারার ব্যাখ্যা নং ২ ও ৩ এর উল্লেখ পূর্বক দেখান যে, সরকারের বিধান সমূহের প্রতি অসমর্থন সূচক মন্তব্য, ঘৃণা, অবনতি বা বিদ্বেষ জাগ্রত না করিয়া বা করার চেষ্টা না করিয়া ইহাদের পরিবর্তন লাভের জন্য ব্যক্ত করা হইলে এই ধারার অন্তর্গত কোন অপরাধ গঠিত হইবে না এবং তিনি যুক্তি দেখান, এই লিফলেট পাহাড়ি জনগণের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রচারণা চালিয়েছিল। পাহাড়ি জনগণ স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশী জাতীয়বাদে উদ্ধুদ্ধ হয়ে তারা বাংলাদেশী জাতীয়বাদ থেকে বিপথে যেতে চায়না, তবে এক ধরনের স্বায়ত্ত্বশাসন দাবী  করেছিল। পাঁচ দফা দাবী স্বভাবে কেবল মাত্র রাজনৈতিক দাবী এবং এমন কি অন্যান্য রাজনৈতিক দল যা সচরাচর করে থাকে সেরূপ কোন খারাপ নাম বা কোন পক্ষকে অপবাদ না দিয়ে এই পাঁচ দফা অত্যন্ত নিরীহ ও স অভিমত প্রকাশ বলে প্রতীয়মান হয়।

বিজ্ঞ আইনজীবীর যুক্তিতে তাপর্য আছে এবং ইহা হ্যাঁ বাচক হিসেবে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বর্তমান মামলায় তাহারা বাংলাদেশ দন্ড বিধির ১২১ ক/ ১২৪ ক ধারায় অভিযুক্ত হইয়াছে। দন্ড বিধির ১২১ হইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। এই ধারায় বলা হয় যে, যে কেহ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধাইবে বা এরূপ যুদ্ধ ঘটাইবার প্রয়াস পাইবে বা এরূপ যুদ্ধ বাধাইতে যোগ থাকিবে, সে মৃত্যুতে কিংবা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত হইবে। দণ্ডবিধির ১২১ ক বিধান করা হইয়াছে, যে কেহ বাংলাদেশের ভিতর বা বাহিরে ১২১ ক ধারায় দণ্ডনীয় কোন অপরাধ সংঘটনের কিংবা বাংলাদেশকে ইহার অধিকার ভূক্ত কোন ভূ-ভাগ বা তদীয় কোন অংশের সার্বভৌমত্ব হইতে বঞ্চিত করণের ষড়যন্ত্র করিবে কিংবা অপরাধ জনক বল প্রদর্শন সমেত সরকারকে অভিভূত করার ষড়যন্ত্র করিবে সে যাবজ্জীবন বা স্বল্পতর মেয়াদে দ্বীপান্তরে অথবা দশ বসর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইতে পারিবে এমন উভয় ধরনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে এবং অর্থ দণ্ডেরও দায়ী হইবে। ১২৪ ক ধারায় বিধান করা হয় যে, কেহ কথা দ্বারা মৌখিক বা লিখিতভাবে কিংবা চিহ্ন দ্বারা কিংবা দৃশ্য প্রতিরূপ দ্বারা কিংবা অন্যবিধভাবে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা বা অবমতি আনয়ন করিবে বা আনয়ন করার প্রয়াস পাইবে অথবা বিদ্বেষ জাগ্রত করিলে বা জাগ্রত করার প্রয়াস পাইলেও সে দণ্ডিত হইবে। পাম্পলেট পাঠ করিয়া ইহাই প্রতীয়মান হয় যে সেখানে কোন কথা নাই যার দ্বারা আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগ্রত করিবার প্রয়াস পাইবে। বরং তাহারা সবাই এই প্রচেষ্টা করিয়াছে যাহাতে কতগুলো বিষয় যা দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের দাবী বাংলাদেশ সরকারের গোচরে আনিয়াছে। ইহা গত নয় বছরে এরশাদের শাসনকে অবৈধ শাসন বলে সংজ্ঞায়িত করিয়াছে কিন্তু ইহা কখনোই বলে নাই যে, বর্তমান সরকার অবৈধ। ইহা বলিয়াছে যে বর্তমান সরকার আসার পর যাবতীয় সমস্যা সমাধান হইবার কথা কারণ বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান করা হইবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, পূর্ববতী কৌশল বলব রাখা ছাড়া কিছুই করা হয়নি যা পার্বত্য চট্টগ্রামের ৬ লাখ জনগণকে হতাশ করিয়াছে। এবং এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের এমপি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সম্পর্কে সংসদে কোন আলোচনা করিতে পারেন নাই। কেবল মাত্র দেশের রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে পরিবর্তন আসলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার কোন পরিবর্তন আসে নাই এবং ইহা দুইটি ঘটনার উল্লেখ আছে এবং ইহা মন্তব্য করিয়াছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি জাতীয় সমস্যা এবং প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান। কিন্তু সমাধান প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে বিধায় বিষয়টি জঠিল রূপ ধারণ করিতেছে। এই বিষয়গুলো রাজনৈতিক দাবী ছাড়া আর কিছুই নয়। পাহাড়ি জনগণ অর্থা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পাঁচ দফা দাবী বাস্তবায়ন করিতে হইবে, সীমাবদ্ধতা সাপেক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম কাপ্তাই একটি প্রদেশ হইবে এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হইবে (Some of the Pahari people namely, that the Pahari Chattra Parishad 5 points be implemented that they should be a Prodesh of the Chittagong Hill Tracts Kaptai with limit and the political prisoners be released. . .)। পাম্পলেটটি বাহির করা হয়েছে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নামে এবং অন্য লিফলেটগুলো বাহির করা হইয়াছে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক করুণাময় চাকমার স্বাক্ষরে। ঐ দাবীগুলোর মধ্যে এবং ঐ বিষয় গুলোর বর্ণনায় এমনকি জোর নির্দেশের কথাও ছিল না। বরং ইহারা স্বভাবে স এবং আমরা ইহাদের মধ্যে এমন কিছু পাই নাই যা পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ জাগ্রত করিবার মনোভাব সৃষ্টি করবে অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এবং দেশের অন্যান্য জনগণের মধ্যে ঘৃণার উদ্রেক হইবে। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংগঠিত করা বা সেই রকম কোন উপাদান বা যার দ্বারা বলা যায় যে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা সেই রকম কোন সন্দেহ যার মধ্যে সরকার তার রাষ্ট্রীয় সীমানায় এবং তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হইবার ভয় রয়েছে। বর্তমান মামলায় মানিকছড়ি জোনের একজন মেজর কর্তৃক এই মামলা দায়ের করা হয়, যার জি, আর, মামলা নং ৩/৯২। মানিকছড়ি এবং উক্ত এজাহার হতে ইহা দেখা যায় যে, বাদী বর্ণনা করিয়েছেন যে রাষ্ট্রদ্রোহীতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হইবে এবং এক কপি লিফলেট হস্তান্তর করা হইয়াছে। ফৌজদারী কার্য বিধির ৯৬ ধারার বিধানে বলা হইয়াছে, “যে অপরাধ দণ্ড বিধির ৬ষ্ঠ অধ্যায় ৯ম অধ্যায় ইত্যাদি মোতাবেক দণ্ডনীয় যে অপরাধ তাহা সরকার কর্তৃক কোন আদেশ বা কোন প্রাদিকার গ্রামে ফরিয়াদ অথবা এই পরিপ্রেক্ষিতে রুজু করা অভিযোগ ছাড়া কোন আদালত গ্রাহ্য করিবেন না”। উক্ত অভিযোগ একজন আর্মি অফিসার কর্তৃক দায়ের করা হইয়াছে এবং ইহার মধ্যে বলা হয় নাই যে তিনি এই এজাহার দায়ের করার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে এই বিষয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। কাজেই সরকার কর্তৃক স্বয়ং অভিযোগ না করিলে এই ধরনের ঘোরতর প্রকৃতির অপরাধের এখতিয়ার নেয়া মেজিষ্ট্রেটের বাধা রহিয়াছে। অভিযোগ এখতিয়ারে নেয়া যাইতে পারে যদি ধারায় উল্লেখিত মোতাবেক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক হয় এবং নির্ধারিত ফরমে অনুমোদিত হয় এবং অন্যভাবে অথবা এই ধরনের অভিযোগ গুলো মামলার সমস্ত কার্যধারা দুষিত করিতে পারে।

বিজ্ঞ আইনজীবী মিঃ আমীর-উল-ইসলাম ৩৫ ডি, এল, আর (ঢাকা) ৪০৪ এ বর্ণিত ওবাইদুল্লাহ বনাম রাষ্ট্র মামলার একটি সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেন। সেখানে স্থির হয় যে ১২১ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করিতে হইলে অবশ্যই প্রমাণ করিতে হইবে যে আসামাী বৈধ সরকারকে আইন অনুযায়ী চলিতে অস্ত্রের জোরে বাধা সৃষ্টি করার পদক্ষেপ নিয়াছিল। কিন্তু কেবল মাত্র ভীতি ১২১ ধারাকে আকর্ষণ করিতে পারে না যদি সেখানে বাড়াবাড়ি না থাকে এবং ৩৪ ডি, এল, আর (ঢাকা) ৪০৪ এ বর্ণিত মুজিবর রহমান বনাম রাষ্ট্র মামলার উল্লেখ পূর্বক মিঃ ইসলাম আরো যুক্তি দেন যে দ-বিধির ১২১ ধারা মোতাবেক যুদ্ধ সংঘটন কেবল মাত্র মুখের কথার দ্বারা কোন ভাবে হবেনা এবং করা যাবে না। অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলিয়াছে দেখানো যথেষ্ট নয় বরং অবশ্যই প্রমাণ দেখাতে হবে যে, আসামী বৈধ সরকারকে আইনত চলতে অস্ত্রের জোরে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করার কোন পদক্ষেপ নিয়াছিল। এই মামলার নথিপত্রে এমন কিছু দেখা যাই নাই যে, ঐ ছাত্র গুলো লিফলেট বিতরণ ছাড়া অন্য কিছু করিয়াছে, এবং ইহার দ্বারা কোন যুদ্ধ প্রস্তুতি সংঘটিত হয় না এবং ইহার উদ্দেশ্য আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা উদ্রেকও নয়। বর্তমান মামলায় আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়েছি যে, সমস্ত মামলার কার্যধারা ভুলুণ্ঠিত হইয়াছে। কারণ অভিযোগটি ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯৬ ধারার বিধান মোতাবেক সরকার কর্তৃক তা করিবার বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক করা হয় নাই। এবং আমরা দেখিনা যে দ-বিধির ১২১-এ/১২৪-এ ধারা মোতাবেক আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে এই মামলা কোন ভিত্তি পূর্ণ হইবে এবং যদি ইহা গঠন হয় তাহা হইলে ইহা পরিশেষে ভুলভাবে সাজানো বিচারের কারণ হইয়া প্রহসন বিচারে পরিণত হইবে।       

এই আদালত তার মামলা বাতিল করিবার জন্য তাহার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে তিনটি বিষয় বিবেচনার্য। আর্থ নথিতে এমন কিছু আছে কিনা যাহাতে দেখানো যায় এজাহারে এই বর্ণিত অভিযোগসমূহ এবং যদিও ধরিয়া নেওয়া হয় এজাহারটি সত্য তথাপিও ইহা আইনের অধীনে ফৌজধারী অপরাধ সংঘটিত হয় না। যদি না মামলাটি বাতিল করা হয় এবং যদি ইহা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ না হয় অথবা আবেদনকারীদেরকে পদ্ধতির বিড়ম্বনা করার্থে যদি ইহা কোরাম অনজুডিস হয় তাহা হইলেও মামলাটি বাতিল হইবে এবং এর অন্যথা হইবে না। হাই কোট বিষয়ের ধারাবাহিকতায় মামলার ভিতরে প্রবেশ করিয়া মামলা পরিচালনার কার্যধারা বাতিল করেনা এবং বিচার্য বিষয়ের বিবেচনা বিচার্য আদালতে কর্তব্য। বর্তমান মামলায় বিচার্য আদালতে কর্তব্য গ্রহণ ব্যতিরেকে মামলার মূল ভিত্তি পাম্পলেট গুলো পাঠ করে এই আদালত কর্তৃক সিদ্ধান্ত করা হইতেছে যে লিফলেটটি দ-বিধির ১২১ এ ধারার বিধানকে আকর্ষণ করার মত অপরাধের কথা বলে নাই এবং মামলার কার্যধারা চালুরাখা বিপথগামী হইবে এবং আরো কারণ এই যে, ইহা ফৌজধারী কার্য বিধির ১৯৬ ধারা মোতাবেক সরকারের পক্ষে ইহা করার জন্য বিশেষ ভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নয় এমন ব্যক্তি কর্তৃক অবৈধভাবে সূত্রপাত করা হইয়াছে।

এই বিষয়ের ভিত্তিতে আমরা মনে করি যে, আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার কার্য ধারা (যারা সংখ্যায় ৬ জন) বাতিল করার যুক্তি রহিয়াছে এবং এই জন্য ইহা বাতিল করা গেল।

তাহারা কারাগারে এবং এইজন্য অন্য কোন মামলায় আটক রাখার প্রয়োজন না থাকিলে তাদেরকে শীঘ্রই মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেয়া গেল। মামলার কার্যধারা যা তাহাদের বিরুদ্ধে মূলতবী অবস্থায় ছিল তা এত দ্বারা বাতিল করা গেল।

ফলে এই রুল চূড়ান্ত করা হইল। এই আদেশ অতিসত্বর নিম্ন আদালতে প্রেরণ করা হোক।                                                         

মোঃ আব্দুল করিম বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী আমি একমত।

এম, এ, করিম

 

আইন সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিবেদন

-আইন বিষয়ক প্রতিবেদক

ইতিপূর্বে মহামান্য হাইকোর্ট যে সকল বন্দীর রীট পিটিশন বিবেচনায় রয়েছে বলে প্রকাশ করা হয়েছিল তন্মধ্যে নিম্ন লিখিত বন্দীদের আটকাদেশ মহামান্য হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে যাদের কোন সুনির্দিষ্ট মামলা (কেইস) নেই তারা মুক্তি পেয়েছেন।

নং      নাম                পিতার নাম            ঠিকানা                                                           
১। দেবসিন্দু চাকমা      তালুকচন্দ্র চাকমা     পানছড়ি

২। অযোদ্ধা চাকমা         চন্দমোহন     চাকমা    পানছড়ি                                                       ৩। কেহলা চাই মারমা    কৈইচাই মারমা        কাউখালি

৪। হৃদয় কুমার চাকমা    জয়ন্ত কুমার  চাকমা    বেতছড়ি                                                      ৫। শশী রঞ্জন চাকমা          সভাধন চাকমা         বরকল

৬। ধনুমনি চাকমা       মৃত দিল্লীকুমার চাকমা   বড়াদাম               

উক্ত রীট পিটিশনের আবেদনকারীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছেন এডভোকেট নিজামুল হক নাসিম এবং তাকে সহায়তা করছেন এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন, এডভোকেট ইদ্রিসুর রহমান ও এডভোকেট আদিলুর রহমান খান।

পরবর্তীতে আরো যে সমস্ত বন্দীর আটকাদেশের বিরুদ্ধে রীট পিটিশন ফাইল করা হয়েছে তন্মধ্যে নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ মুক্তি পেয়েছেন :

নং      নাম                     পিতার নাম             ঠিকানা                  রীট পিটিশনের নং

১।      দীপ্তিময় চাকমা         বদনমোহন চাকমা     গোলকনা পাড়া         ১৮৩৮/৯২

২।     জ্যোতি বিকাশ চাকমা  পূর্ণ কুমার চাকমা      উলুছড়ি                      ১৮৩৯/৯২                       

৩।    নতুন বিকাশ চাকমা     মনকুমার চাকমা  শান্তিরঞ্জন কার্বারী পাড়া        ১৮৪০/৯২    

৪।     অমলেন্দু চাকমা        আশাপূর্ণ  চাকমা        বড়াদাম                    ১৮১১/৯২                      ৫।     আশাপূর্ণ চাকমা        রজনী কান্ত চাকমা     মনাটেক                 ১৮৪২/৯২                       

৬।    জয়কেতু চাকমা       ইন্দ্র মোহন চাকমা  প্রাণ মোহন কার্বারী পাড়া    ২১৯৪/৯২                       ৭।     রাংগা বরন চাকমা     ইন্দসেন চাকমা             বাবুছড়া               ২২১৮/৯২                      ৮।     লক্ষীরঞ্জন চাকমা       জগারাম চাকমা         নুনছড়ি                  ২০৬০/৯২                        ৯।   বাদক্যা চাকমা          নীলকান্তি চাকমা       বানছড়া                 ২৩৭২/৯২

১০।    মনি বিকাশ চাকমা     লারু চাকমা            বাঘাইছড়ি              ২৩৭৩/৯২                         ১১।   জ্ঞান রঞ্জন চাকমা      বৃষ সেন    চাকমা        ধনপাতা                 ২২১৬/৯২                      ১২। আনন্দ বিকাশ চাকমা  দয়াময় চাকমা          বাবুছড়া                 ২২১২/৯২

১৩।    বৃদ্ধ রঞ্জন চাকমা       কামিনী কুমার চাকমা  হাজাছড়া               ২১৯৬/৯২

১৪।    পূর্ণ কুমার চাকমামৃত সুরেন্দ্র চাকমা            চিনালছড়া              ২১৯৫/৯২

১৫।    অরুণ জ্যোতি চাকমা  রেবতী চাকমা          ধন্যামাছড়া              ২১৯৯/৯২        

১৬।    তরুণ জ্যোতি চাকমা  রেবতী চাকমা          ধন্যামাছড়া              ২১৯৮/৯২

১৭।    গোপাল চাকমা         রেবতী চাকমা          ধন্যামাছড়া              ২২০০/৯২

১৮।    সুবল চাকমা            রেবতী চাকমা          ধন্যামাছড়া              ২২১৫/৯২

১৯।    শোভানন্দ চাকমা       মনায়া    চাকমা           বানছড়া               ২২১৭/৯২                      ২০।   কিরন জয় চাকমা      হরেন্দ্র  চাকমা           তারাবনিয়া               ২২১৯/৯২                      ২১।  সোনারাম চাকমা       গোপাল চন্দ্র চাকমা ধন্যামাছড়া              ২২০৪/৯২                     

যাদের রীট পিটিশন মহামান্য হাইকোর্টে বিবেচনাধীন আছে

 নং     নাম                     পিতার নাম                 ঠিকানা          রীট পিটিশনের নং                
১। চন্দ্রকমল চাকমা       রঞ্জন মোহন চাকমা        মধ্যবানছড়া                ২০৬৩/৯২                   
২। জীতেন্দ্র কুমার চাকমা  ললিত কুমার চাকমা          হেদারমারা                ২০৬২/৯২  

৩। লাল কুমার চাকমা     অক্ষয় কুমার চাকমা        ফকিরাছড়া                ২০৬১/৯২

৪। রবিচন্দ্র চাকমা         দীনবন্ধু চাকমা              লাম্বাছড়া                 ২০৫৯/৯২                      

৫। বিকাশ চাকমা          সুয়ামনি চাকমা             রবিচন্দ্র কার্বারী পাড়া     ২০৬৪/৯২

৬। মংথোয়াই মারমা      পংহলাপ্রু মারমা             রাজস্থলী                  ১৮৫৭/৯২        

৭। নিস্কৃতি চাকমা        মৃত সত্যবান চাকমা          দিঘীনালা                  ২০৭৫/৯২        

৮। অনিল কুমার চাকমা   মিজ্যি চাকমা                বাকছড়ি পাড়া          ২২১১/৯২                      
৯। ললিত কুমার চাকমা   রইস্যামনি চাকমা          পাবলাখালী                 ২১৯৩/৯২                    

১০। শান্তিরঞ্জন চাকমা           রাঙাপুনা চাকমা       বীরলক্ষন কার্বারী পাড়া  ২২১৩/৯২                    

১১। সুশীল কুমার চাকমা  কামিনী মোহন চাকমা   বর্মাছড়ি                 ২২২০/৯২   

১২। হরেন্দ্র চাকমা        জগ চন্দ্র    চাকমা            দিঘীনালা               ২২২১/৯২                     ১৩। ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা   মাউচ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা            রাজস্থলী                   ২৩৬৮/৯২                     

১৪। শুধাংশু চাকমা    শরকুমার চাকমা                 বাঘাইছড়ি              ২৩৬৯/৯২

১৫। নিবারণ চাকমা   কামিনী রঞ্জন চাকমা           তেজড়ী পাড়া           ২৩৭০/৯২        

১৬। মানব জ্যোতি চাকমা  হীরুলাল চাকমা            তুলাবান               ২৩৭১/৯২        

১৭। প্রিয়দর্শী চাকমা   প্রফুল্ল কুমার চাকমা           রাংগাদুরছড়ি            ২৫৫৪/৯২                      

 ১৮।  অনিল চাকমা  কিনাধন  চাকমা                  চিল্লাতলা                 ২৮৩৩/৯২                      
১৯। কিনাধন চাকমা  মৃত তরুণ্যা চাকমা                 চিল্লাতলা                ২৮৩৪/৯২                    

 ২০। রূপতি চাকমা         অশ্বিনী কুমার চাকমা           মাস্টার পাড়া            ২৮৩৫/৯২

২১। জামাচরন চাকমা  তেরু চাকমা                শান্তি নিবাস গুচ্ছ গ্রাম        ২৯৩৯/৯২                    

২২। প্রীতিরাজ চাকমা        তেজেন্দ্রলাল চাকমা            ভাইবোন ছড়া          ২৯৪০/৯২                

২৩। প্রশান্ত চাকমা         জামিনী মোহন চাকমা          হাজাছড়া                ২৯৪১/৯১

২৪। পূর্ণ কুমার চাকমা  বুদ্ধ মনি চাকমা                পাবলাখালী             ২৯৪২/৯২                       

২৫। নিউমং মারমা   উমচাই মারমা                   মরাটিলা                 ২৯৪৩/৯২                      
২৬।   হেমন্তময় চাকমা  রাংগাচান চাকমা                  বরকল                  ৩৫৯/৯২

২৭। উজ্জ্বল চাকমা    মারা চাকমা                      দুলুছড়ি                 ৪৫৫/৯২                         

২৮। জগদিশচন্দ্র চাকমা  বড়দাস চাকমা            হাজাছড়া                 ৪৫৬/৯২                           

২৯। সুনীল কান্তি চাকমা  কিশ্যামোহন চাকমা             বানছড়া                 ৪৫৭/৯২

৩০।   আয়ন চাকমা   মৃত রত্নসেন চাকমা             বেতছড়ি                ৪৬০/৯২

৩১।    প্রদীপ চাকমা   মনচরন চাকমা                  চাদকছড়া               ৪৬১/৯২

৩২।   অজিত কুমার চাকমা  ভত্তা চাকমা              রূপকারী ছড়া           ৪৬২/৯২

৩৩।   কালাচান চাকমা      বীরসেন চাকমা           পুজগাং                  ৪৬৩/৯২                         

৩৪।   মংহলা মারমা অগ্যজাই মারমা                 মহামুনি পাড়া           ৪৬৪/৯২

৩৫।   সুবিনাষ্য চাকমা  মতিলাল চাকমা              কাঠাল বাগান           ৪৬৫/৯২

৩৬।   বিজয় চাকমা   বীরেন্দ্র চাকমা                  হাজাছড়া                 ৪৬৬/৯২

৩৭।   সুরবিন্দু চাকমা  বসন্ত কুমার চাকমা           বাবুছড়া

৩৮।   সুনীতি বিকাশ চাকমা  সোনাধন চাকমা        দিঘীনালা

গত ৪/১১/৯২ তারিখ মহামান্য হাইকোর্ট হেমন্তময় চাকমা পীং রাংগাচান চাকমা-এর আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করেছেন। উপরোক্ত রীট পিটিশন গুলোর আবেদনকারীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ব্যারিষ্টার আমীর-উল-ইসলাম। তাকে সহায়তা করছেন এডভোকেট নূরুল হুদা, এডভোকেট জুলফিকার আলী বুল বুল ও এডভোকেট শিরিন আহম্মেদ চৌধুরী।

অন্যদিকে এডভোকেট নিজামুল হক নাসিম এবং তার সহযোগী এডভোকেট আদিলুর রহমান খান নিম্নলিখিত বন্দীদের রীট পিটিশন গুলো পরিচালনা করছেন।

নং      নাম                     পিতার নাম             ঠিকানা                  রীট পিটিশন নং                            
১। মানিক রতন চাকমা   চন্দ্রসেন চাকমা              লংগদু                   ২৪৫২/৯২                       
২। শান্তি মাধব চাকমা    মৃত রামচন্দ্র 
চাকমা          বেতছড়ি               ২৪৫৩/৯২                       

৩। যুদ্ধ মোহন চাকমা           বাঘা চাকমা          পাইডং পাড়া            ২৪৫৪/৯২                        

৪  ।প্রীতিময় চাকমা                 শ্যাম রঞ্জন চাকমা      পাইডং পাড়া       ২৪৫৫/৯২                      ৫। বসন্ত কুমার চাকমা               সুন্দর মনি চাকমা      বেতছড়ি               ২৪৫৬/৯২

৬। ললিত রঞ্জন চাকমা        তরুনীসেন চাকমা      খ্রীষ্টান পাড়া            ২৫১৯/৯২                         ৭। জগদিশ্বর চাকমা           আনন্দমোহন চাকমা   উল্টাছড়ি                 ২৫২০/৯২                       

৮। সুরেশ চাকমা              গুনসিন্দু চাকমা দিঘীনালা                     ২৫২২/৯২                        

৯। অশ্বিনী কুমার চাকমা          কাবুল্যা  কার্বারী         উল্টাছড়ি           ২৫২৩/৯২                    

১০। অমিয় কান্তি চাকমা    নিলধ্বজ চাকমা        শাক্যমনি বৌদ্ধ বিহার ২৮৪০/৯২                         

১১। বুদ্ধ জয় চাকমা          পিচ কালা চাকমা       দিঘীনালা                  ৩১৪৪/৯২                      ১২। মিতন চাকমা             কালাচান চাকমা  দিঘীনালা                     ৩১৪৫/৯২                       

১৩। মোহিনী মোহন চাকমা          ভারত চন্দ্র চাকমা      কাউখালী         ৩১৪৬/৯২                         ১৪। হেমন্ত কুমার চাকমা      ইন্দ্রবান চাকমা         দিঘীনালা               ৩১৪৭/৯২        

১৫। কিনেন্দ্র চাকমা            মৃত ভীম চাকমা        তুলবান                 ৩১৪৮/৯২                        ১৬। পুলিন বিহারী চাকমা     ইত্তুক্যা চাকমা          মহালছড়ি                 ৩১৪৯/৯২                       

১৭। পল্টু চাকমা              জাঙ্গাল্যা চাকমা লক্ষীছড়ি                    ৩১৫০/৯২                        

১৮। শান্তা মোহন চাকমা         খোইল্যা চাকমা        লক্ষীছড়ি         ৩১৫১/৯২                         

১৯। সুরেশ চন্দ্র চাকমা        সুরেন্দ্র চাকমা          দিঘীনালা               ৩১৫৪/৯২                               

২০। জীবন শান্তি চাকমা   সুরেন্দ্র চাকমা          - - - - -                 ৩১৫৩/৯২                      

২১। কুমুত্তলাল চাকমা     মৃত দয়াময় চাকমা          দিঘীনালা               ৩১৫৪/৯২                      

২২। তপন কুমার চাকমা   সমমুনি চাকমা          মহালছড়ি               ৩১৫৫/৯২                        

২৩। মাগানা চাকমা             চন্দ্র কুমার চাকমা      দিঘীনালা               ৩১৫৬/৯২                       ২৪। নীল চাকমা             - - - - - -             - - - - -                 ৩১৫৭/৯২                      

২৫। সেনারাম চাকমা বৃষকেতু চাকমা                  - - - - -                ৩১৫৮/৯২                    

২৬। পলাচ্ছ্যা চাকমা           ধনমনি চাকমা          - - - - -              ৩১৫৯/৯২                       

উল্লেখ্য মহামান্য আদালত নি¤œলিখিত বন্দীদের জামিনে মুক্তি দানের নির্দেশ দেন। এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ দেয়া হয়েছিল।

১। হৃদয় রঞ্জন চাকমা          দিঘীনালা

২। পরিমল চাকমা              দিঘীনালা

৩। অচিন্ত্য চাকমা              দিঘীনালা

৪। অধেন্তু চাকমা               দিঘীনালা

এদের মামলা পরিচালনা করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিষ্টার আমীর-উল-ইসলাম ও তার সহযোগী আইনজীবীগণ। আমরা আরও আনন্দের সাথে উল্লেখ করছি যে, শীঘ্রই আরও অনেক বন্দীর জন্য মহামান্য আদালতে আইনগত আশ্রয় লাভের প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সকল মহল, আত্মীয় স্বজনকে তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করতে আইনজীবীরা পরামর্শ দিয়েছেন।

সবশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে মাহামান্য হাইকোর্ট গত ৮/১১/৯২ ইং তারিখে মংহলা মারমা, কালা চান চাকমা ও অজিত কুমারের আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করেছে।

 

সাক্ষাকার

লোগাং তদন্ত কমিশন রিপোর্টটি স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অসত্য বক্তব্যকে তদন্তের ষ্ট্যাম্প মেরেছে মাত্র

- পংকজ ভট্টপার্য্য, সভাপতি, ন্যাপ।

প্রঃ ১। সরকার সম্প্রতি লোগাং গণহত্যা তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। এতে দেখা যায়, সুলতান হোসেন খান সরকার ও সেনাবাহিনীর বক্তব্যকেই হুবহু তুলে ধরেছেন, যা আপনাদের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এ সম্পর্কে মন্তব্য করবেন কি?

উঃ লোগাং গণহত্যা তদন্ত কমিশন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে নিয়ে গঠন করা হয়েছিল। অথচ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সকল মহল দাবী তুলেছিলেন মাইলাই সদৃশ এই গণহত্যার তদন্ত হাইকোর্টের একজন জজের উপর অর্পণ করা হোক। কিন্তু সচেতন দেশবাসীর এই ন্যায্য দাবী অগ্রাহ্য করে সরকার তাদের পছন্দসই অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতিকে বেছে নেন এবং তদন্তের দায়িত্ব তার হাতে দেন। লক্ষণীয় যে, মাত্র কিছুদিন আগে সাংবাদিকদের উপর পুলিশের বর্বরোচিত নির্যাতনের ঘটনায় যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে তার রিপোর্ট এবং এ পর্যন্ত প্রায় সকল তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় নাই। কেবলমাত্র সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রকাশযোগ্য হয়েছে লোগাং হত্যার তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট। কারণ রিপোর্টটি সরকারের প্রেস নোট ও বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছে মাত্র। এই কমিশন রিপোর্টটি স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসত্য বক্তব্যকে তদন্তের ষ্ট্যাম্প মেরেছে মাত্র। যা একান্তই দুর্ভাগ্যজনক।

১১ই এপ্রিল, ১৯৯২ তারিখে অর্থা ঘটনার পরদিন লোগাং-এর হতভাগ্য বাসিন্দা উপেন চাকমার সাথে আমি কথা বলে জেনেছি, তার ৯ সদস্যের পরিবারের ৫ জনই নিহত হয়েছে, বৈশিষ্ট্য মুনীর স্ত্রী নিহত হয়েছে, চন্দ্র সাগর চাকমার ভাইপো ও ভাইজিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বৈশিষ্ট্যমুনি ও চন্দ্র সাগর চাকমা জানিয়েছেন যে, নিহতদের সংখ্যা তারা গুনেছেন তা দেড় শতকের মত। অথচ কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী ১৩ জন নিহত বলা হয়েছে - যা সত্যের অপলাপই শুধু - প্রকৃত গণহত্যাকে আড়াল করার মানবতা বিরোধী ও নৈতিকতাবিরোধী অপচেষ্টা বিশেষ।

প্রঃ ২। এই রিপোর্ট কি আপনাদের কাছে গ্রহণযোগ্য?

উঃ এই রিপোর্ট প্রকৃত হত্যাকা-ের কারণ, ঘটনাবলী, মৃতের সংখ্যা আড়াল করা ও চাপা দেয়ার এক অমানবিক অবিবেকী দলিল বিধায় তা আমাদের কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই রিপোর্ট তাই আমরা প্রত্যাখ্যান করি।

প্রঃ ৩। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য গত ৫ নভেম্বর জনসংহতি সমিতি ও সরকারী পক্ষে অলি আহমদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই যে আলাপ আলোচনার প্রক্রিয়া চলছে-এ ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী?

উঃ সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে যে আলোচনা সূচনা হয়েছে সে বিষয়ে আমরা সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করছি। শুভ কামনা জানাচ্ছি। দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারতাম একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটিটি যদি যথার্থ সংসদীয় কমিটি হোক এবং সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হতো। বিশেষতঃ কমিটিতে ১ জন পাহাড়ি গণপ্রতিনিধি বা এম,পি থাকতো এবং জাতীয় সংসদের অন্যান্য দলের প্রতিনিধিত্বশীল এম,পি-রা ও যদি থাকতো তাহলে কমিটি যথাযথই অধিকতর শক্তিশালী ও কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতো।

তবুও এই আলোচনা তথা রাজনৈতিক সমাধানের প্রক্রিয়া রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার মাধ্যমে অগ্রসর করে নেওয়ার জন্য উভয় পক্ষের প্রতি আহবান জানাই। একথা স্বতঃসিদ্ধ যে সামরিক পদক্ষেপে নয়, রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান সম্ভব-এর বিকল্প নেই।

প্রঃ ৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে বিবেচিত। আপনি কি মনে করেন সরকারী দল হিসেবে বিএনপির এই জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট সমূহের মতামত, পরামর্শ ও সুপারিশ গ্রহণ করা প্রয়োজন?

উঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা দীর্ঘকাল ঝুলিয়ে রেখে এবং বিভিন্ন সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক কায়দায় মোকাবেলার চেষ্টা করে সমস্যাকে আজকের জটিল অবস্থায় দাঁড় করানো হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটির জন্য গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিএনপি-কে দায়ী কেউ করেনি। বিএনপি-র একার সমস্যা নয়, একা সমাধান করতে পারবে এরকম বিষয়ও নয়। এই সমস্যার ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান খুঁজতে হবে সকল গণতান্ত্রিক শক্তির মতামত; পরামর্শ ও সুপারিশের ভিত্তিতে জাতীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐক্যমতের মাধ্যমে জাতীয় এই সমস্যার সমাধান বের করা সম্ভবপর।

প্রঃ ৫। আমরা জানি, অনেক জাতীয় রাজনৈতিক প্রশ্নে সরকার বিরোধীদলের সমর্থন ও সহযোগীতা কামনা করেন। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বিপরীত মনোভাব কেন?

উঃ কিছু কিছু বিষয়ে সরকার বিরোধীদলের সহযোগীতা কামনা করেন - ইতঃস্তত কিছু উদ্যোগও নিয়েছেন একথা সত্য কিন্তু কতটা দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে তা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু একথা সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যার ব্যাপারে সরকার ও পর্যন্ত বিরোধীদলের সহযোগীতা ও সাহায্যের কোন কথা বলে নি। বরং এই সমস্যাটি সমাধানের ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলি যাতে কোন ভূমিকা নিতে অসমর্থ হয় সেইরূপ সরকারী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে-এই জাতীয় সমস্যাটিকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের আওতামুক্ত করার ক্ষেত্রেও সরকারের অনীহা রয়েছে। ফলে জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক এক জাতীয় প্রক্রিয়া গ্রহণে বিএনপি সরকার এখনও আগ্রহী উদ্যোগী হয়ে উঠেনি।

প্রঃ ৬। কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?

উঃ প্রস্তাবিত সমাধানের সুপারিশ 

(১) সংখ্যালঘু পাহাড়ি জাতিসত্তাসমুহের সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ স্থানীয় স্বশাসন প্রদান, ভূমিস্বত্ব প্রত্যার্পন, জুম্ম চাষাবাদ ও জুম্ম সংস্কৃতি সংরক্ষণের নিশ্চয়তা; (২) পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জনসংহতি সমিতির সাথে অর্থপূর্ণ ও যুক্তি সংগত আলোচনা এবং আলোচনার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান নিষ্পন্নের ধারাবাহিক উদ্যোগ গ্রহণ; (৩) বিশেষতঃ ৮০-র দশকে বিশেষ কূট উদ্দেশ্যে সরকারী উদ্যোগে পুনর্বাসিত সমতল অঞ্চলের মানুষদের তাদের পুর্বতন অঞ্চলে ফেরত নেয়া এবং যথাযোগ্য পূনর্বাসন করা ; (৪) প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী পাহাড়ি জনগণকে জাতীয় নেতৃবৃন্দ সমবায়ে কমিটির মাধ্যমে আলোচনাক্রমে নিরাপত্তা ও যথার্থ পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা; (৫) সর্বোপরি, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে বেসামরিক প্রশাসনের আওতায় এবং দেশের স্বাভাবিক আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন ব্যবস্থা চলতে দেয়া; (৬) ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ নিজ নিজ ভাষা-সংস্কৃতি উন্নতি সাধন করে দেশের সকল মৌলিক অধিকার প্রয়োগে সক্ষম পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসাবে বসবাস করতে পারে তার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা এবং দীর্ঘকালব্যাপী পাহাড়ি জনগণের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণসহ - অবস্থান করেছে যে সকল বাঙালিরা উভয়ের মধ্যে সম্প্রতি ও সৌভ্রাতৃত্বের সুরক্ষা করা।

 

“পার্বত্য জেলাসমূহের তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম”

-লোটাস

স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠিত হওয়ার পর দেখা গেছে যে, অনেক বিদেশী দূতাবাসের প্রতিনিধি এবং স্ব-দেশীয় ছাত্র, শিক্ষক প্রতিনিধি ও সাংবাদিক প্রতিনিধি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় পার্বত্যঞ্চল অনেকবার পরিদর্শনে এসেছেন। তারা সবাই পার্বত্যঞ্চলে গঠিত স্থানীয় সরকার পরিষদ ও সেনা প্রশাসনের সহায়তায় ও নির্দেশিত জায়গাসমূহে পরিদর্শন করেন। ব্যাপক উপজাতীয় এলাকা পরিদর্শন করেন নাই। তদুপরি উনারা স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন থেকে আরাম-আয়েশ, নাচ-গান উপভোগ ও রাজকীয় আপ্যায়নের মাধ্যমে দিন রজনী কাটিয়েছেন। তাই তাদের দৃষ্টি পার্বত্যঞ্চলের উন্নয়ন ও শান্তির পক্ষে রায় দিচ্ছে। স্বীকার করি পার্বত্যঞ্চলে সকল প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা, দালান-কোঠা, গাড়ি-ঘোড়ার যথেষ্ট উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কিন্তু এতদাঞ্চলের জনগণের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয় নাই, বরং তা দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা মনে করি জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত অন্য সব উন্নয়নই নিরর্থক। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, পার্বত্যাঞ্চলে পরিদর্শনকারী প্রতিটি প্রতিনিধি দলই পাহাড়িদের পূর্বের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার মূল্যায়নে পাহাড়ি জাতিসত্তা অধ্যুষিত দূরবতী গ্রাম পরিদর্শন করেন নাই। এমনকি পার্বত্য জেলা সদরে অবস্থিত পাহাড়িদের গ্রামগুলোতেও তাঁরা পরিদর্শনে যান নাই। তাই পার্বত্য এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে তাঁরা সম্পূর্ণ অবহিত নন। স্বীকার করি পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়িদের মধ্যেও ছিন্নমূল মানুষ আছে এবং তাদেরকে সরকারীভাবে গুচ্ছগ্রাম, বড় গ্রাম, শান্তি গ্রাম নামক বন্দী শিবিরে পুর্নবাসন করা হচ্ছে, পুর্নবাসনের পরিবর্তে তাদের উপর চালানো হচ্ছে নিপীড়ন। কিন্তু তার পাশাপাশি অবস্থাপন্ন ও সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত পাহাড়ি পরিবার সমূহকেও কেন এ-বন্দী শিবিরে পুর্নবাসন করা হচ্ছে ? অবস্থাপন্ন ও পারিবারিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের বন্দী শিবিরে পুর্নবাসন করার অর্থ এই যে, উন্নয়নের মিথ্যা অজুহাতে জুম্মদের -কে আর্থÑসামাজিক ভাবে পঙ্গু করা। যা পরিদর্শনকারী প্রতিনিধিদের দেখানো হচ্ছে তারা সবাই ছিন্নমূল এবং তাদের পুর্নবাসন করা হচ্ছে। আসলে পরিদর্শনকারীরা শুধু বর্তমানের পুনর্বাসনের কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে পার্বত্যাঞ্চল সম্পর্কে উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছেন।

পরিদর্শনের পর পত্রিকায় যে বিবৃতি প্রচার করা হয়, তা সম্পূর্ণরূপে পার্বত্য জেলা সমূহের স্ব-ঘোষিত, গণ-ধিকৃত পাহাড়ি হোমরা-চোমরা এবং সেনা প্রশাসনের শিখানো ভাষা। কারণ তারা মোটা অংকের “সিক্রেট মানি’র সাহায্যে সন্তুষ্ট। তাই তারা মূল সমস্যার সৃষ্টি’ ও উপত্তির কারণসমূহ কোনদিনই খুঁজে দেখেননি। তারা শুধু সরকারী উন্নয়ন কাজের বাহবা দিয়েছেন, কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে চেষ্টা করেন নি। এই হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শনের নমুনা।


বহির্বিশ্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম

গ্রন্থনাঃ  প্রবীর

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয় গত ১৬ই সেপ্টেম্বর ’৯২। নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট বাংলাদেশে মানবাধিকারের উপর একটি যুক্ত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব দেয়া হয়।

মিসেস পোল্লাক- সমাজতান্ত্রিক গ্রুপের পক্ষে

মি. টেলকাম্পার, ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের সবুজ গ্রুপের পক্ষে

মি. ডি লা মালেনে আরডিই গ্রুপের পক্ষে

মি. ভান্ডেমেউলেব্রুক রেইনবো গ্রুপের পক্ষে

মি. ওয়ার্টজ এবং মি. মিরান্ডা ডা মিলভা ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট

এ. বাংলাদেশের উপর পূর্বের সিদ্ধান্ত সমূহ বহাল রাখা

বি. বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০ই এপ্রিল ১৯৯২ লোগাং এ শত শত নিরস্ত্র জুম্ম জনসাধারণকে গণহত্যা সম্পর্কে সতর্ক করা

সি. যেহেতু ১৯৮০ সালের কাউখালি এবং ১৯৮৯ সালের লংগদু গণহত্যার পূর্বেকার তদন্ত কমিটি সমূহের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় নি।

ডি. যেহেতু জুম্মদের ভূমি বাঙালি দখলকারীদের দেয়ার জন্য অনেক গুচ্ছ গ্রামে জুম্ম জনগণকে জোরপূর্বক স্থানান্তর করা হয়।

১. লোগাং গণহত্যাকে কঠোরভাবে নিন্দা করা

২. বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত ফলাফল প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করা

৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব অবসানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহবান করা।

৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকারকে সম্মান করা এবং সরকারের আদিবাসী জনগণকে জোড় পূর্বক স্থানান্তর নীতি অবসান করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহবান করা।

৫. পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য একজন বিশেষ পর্যবেক্ষক নিয়োগ করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে আহবান করা। 

৬. মানবাধিকারের সংসদীয় সাব-কমিটিকে তদন্ত এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি সম্ভব হয় একটি মিশন সফরের আহবান করা।

৭. ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট, ই পি সি ও ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের কমিশনকে আহবান করা যাতে বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে অবগত করা হয়।

ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইনডিজেনাস পপুলেশন-এর সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ

গত জুলাই মাসের ২৩ তারিখ থেকে সুইজারল্যা-ের জেনেভা শহরে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইনডিজেনাস পপুলেশন-এর সম্মেলন হয়ে গেল। উক্ত সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বক্তব্য রাখেন কানাডার ভ্যাংকুভারের ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের প্রফেসর ডগলাস সেন্ডার্স। ২৪শে জুলাই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি চারটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। যেমন :

(১) অউপনৈবেশিকতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ক্রম উন্নতির জন্য আদিবাসী জনগণের আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

(২) “আন্ত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার” বলতে এখন যা প্রায়ই বুঝায় তাই হচ্ছে আদিবাসী জনগণের অধিকার।

(৩) স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের জনগণ হিসেবে উন্নয়ন ও অস্তিত্বের অধিকার সহ আদিবাসী জনগণকে সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু হিসেবে দেখা উচিত। এর জন্য আবার প্রয়োজন বাস্তব সত্য বিকেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা যা আদিবাসী জনগণকে স্বায়ত্তশাসন বা আত্মনিয়ান্ত্রণাধিকার অনুমোদন করে।

(৪) চতুর্থ অবস্থাটি প্রথমোক্ত তিনটি অবস্থাকে সমন্বিত করে। উপরোক্ত তিনটি অধিকারের আলোকে আদিবাসী জনগণের রাষ্ট্রের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার অধিকার আছে।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা প্রসঙ্গে জাতিসংঘের সাব-কমিশনে ডগলাস সেন্ডার্সের সুপারিশ

আগষ্ট মাসের প্রথমার্ধে ইন্টারন্যাশন্যাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইনডিজেনাস এফেয়ার্স এবং এন্টি শ্লেভারি ইন্টারন্যাশন্যাল কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির উপর জাতিসংঘের প্রিভেনশন অব ডিসক্রিমিনেশন এ- প্রটেকশন অব মাইনোরিটিস এর সাব-কমিশনে বক্তব্য রাখা হয়। এখানেও প্রফেসর ডগলাস সুপারিশ পেশ করেন। যেমনঃ-

(১) পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবশ্যই বেসামরিকীকরণ করতে হবে। সরকারকে সামরিক সমাধান না করে অবশ্যই ঘোষিত রাজনৈতিক সমাধান করতে আন্তরিক হতে হবে।

(২) একজন দক্ষ এবং নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যাকে সমাধান করতে দিতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত শরণার্থীরা নিজেদের ভূমিতে পুনর্বাসিত হতে পারছে না ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ভারত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরবে না। বাঙালি শরণার্থীরা এই প্রক্রিয়ায় চলে যাবে যেহেতু তারা দখল কৃত ভূমিতে বসবাস করছে। ঐ শরণার্থী পরিবার গুলোকে অন্যত্র পুনর্বাসন করতে বিদেশী সাহায্য বরাদ্দ করতে হবে।        

(৩) বাংলাদেশের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামে যথেষ্ট স্বায়ত্ত্বশাসন দিতে হবে।

(৪) পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিস্থিতি দেখার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক প্রয়োজন।

[উল্লেখ্য যে এবার জেনেভাতে জাতিসংঘের এই সম্মেলনে আরও লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন রামেন্দু শেখর দেওয়ান এবং আনফোতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি চন্দ্রা রায়]

 

বৃটেন বাংলাদেশ হাই কমিশনের সম্মুখে Monthly Vigil পালিত

গত অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ লন্ডনে সারভাইভ্যাল ইন্টারন্যাশন্যালের উদ্যোগে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সম্মুখে লোগাং গণহত্যা ও পার্বত্য এলাকায় অব্যাহত মানবাধিকার লংঘনের প্রতিবাদে মাসিক ঘেরাও (গড়হঃযষু ঠরমরষ) কর্মসূচী পালন করা হয়। এই কর্মসূচী প্রতিমাসের শেষ বৃহস্পতিবার আয়োজন করা হয়। তারা প্রত্যেক মাসে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে স্মারকলিপি প্রদান করেন।

 

নেদারল্যান্ডে ÔCHT Activist' কনফারেন্স

এ মাসের ১৩ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত নেদারল্যা-ের হেগ শহরে সি এইচ টি এ্যাকটিভিষ্ট কনফারেন্স হচ্ছে। এখানে যোগ দিতে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে দু’জন প্রতিনিধি গিয়েছেন। সম্মেলনে পরবর্তী কর্মসূচীর কৌশল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জুম্ম শরণার্থীদের ত্রিপুরা থেকে ফেরত না পাঠানোর আহবান

(প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে অর্গানাইজিং কমিটি চিটাগাং হিলট্রাক্টস কেম্পেইন-এর চিঠি)

প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া

প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়                                                                                                  

ঢাকা                                                                                                                

বাংলাদেশ ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৯২                                                                                               

ডিয়ার বেগম খালেদা জিয়া,

এ বছরের মে মাসে আপনি যখন দিল্লী সফরে যান তখন আপনি প্রায় (৫৮০০০) আটান্ন হাজার বাংলাদেশী জুম্ম শরনার্থীদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ভারত সরকারের সাথে একটি চুক্তি সম্পন্ন করেছেন। ৩১ শে ডিসেম্বর ’৯২ -এর মধ্যে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা আছে এবং ভারত সরকারও ঘোষণা করেছিল যে এ বছরের শেষে শরণার্থীদের রেশন দেওয়া বন্ধ করবে। ১৯৮৬ সাল থেকে ত্রিপুরায় বসবাসরত অধিকাংশ শরণার্থীই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতিস্থাপনকারী ও আধাসামরিক বাহিনী কর্তৃক অব্যাহত গণহত্যা ও আক্রমণের ফলে পালিয়ে যায়।

জুম্ম শরণার্থীরা দেখেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং তাদের ভূমি বাঙালি বসতিস্থপনকারীরা দখল করে নিচ্ছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রনাধীন, যদিও বাংলাদেশের বাকী অংশে গণতান্ত্রিক সরকার ফিরে এসেছে, এবং সেনাবাহিনী সাধারণ জুম্ম জনগণের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ, গণহত্যার সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে আসছে।

সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত গুচ্ছগ্রামে তাদের আটক রাখার জন্য শরণার্থীদের ফেরত আনতে পারাটা একমাত্র কল্পনাসাধ্য। এটিকে কোন ক্রমেই পুনর্বাসন বলে বিবেচনা করা যায় না। গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত মানুষগুলো কাজ এবং খাদ্যের জন্য সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল এবং তাদের পৈতৃক ভূমিতে যাওয়ার কোন স্বাধীনতা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আগত শরণার্থীদের যেকোনভাবে পুনর্বাসনের আগে অবশ্যই এলাকার সমস্যার একটি সন্তোষজনক নিষ্পত্তি করতে হবে। এই পুনর্বাসনকে সফল করার লক্ষ্যে জুম্ম রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি জন সংহতি তবে অর্গানাইজিং কমিটি স্বীকার করে যে, জুম্ম শরণার্থীরা ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ও দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয়ই সমস্যা সৃষ্টি করছে, কিন্তু জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন কোন সমাধান হতে পারে না। যদি বাংলাদেশে জুম্মদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়, তবে তারা আবার পাড়ি জমাবে।

নিতান্ত মানবিক কারণে অর্গানাইজিং কমিটি অনুরোধ এবং দাবী করছে যে, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জুম্ম শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়া না হোক এবং একমাত্র জাতিসংঘের মত আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃত তত্ত্বাবধানে তাদের ফেরত পাঠানো হোক।

আপনারই

স্বাঃ অস্পষ্ট                                                                                                    

অর্গানাইজিং কমিটি চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস কেম্পেইন।

বিঃ দ্রঃ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও-এর কাছেও অর্গানাইজিং কমিটি চিটাগাং হিলট্রাক্টস ক্যাম্পেইন অনুরূপ বিষয়ে একটি চিঠি প্রেরণ করে।

 

অর্গানাইজিং কমিটি চিটাগাং হিল ট্রাক্টস- এর আবেদন

[ভারতের ত্রিপুরা আশ্রয় শিবির থেকে ৫৬০০০ জুম্ম শরণার্থীকে জোরপূর্বক এবং পার্বত্য সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ফেরত না পাঠানোর জন্যে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে “অর্গানাইজিং কমিটি চিটাগাং হিল ট্রাক্টস কেম্পেইন” একটি আবেদন জানিয়েছে। এখানে তা হুবহু অনুবাদ করা হল।]

 

পিওবক্স-১১৬৯৯

১০০১ জি আর আমষ্টারডাম

নেদারল্যান্ডস                                                                                                            ফোনঃ ৩১ ২০ ৬৬২৮৮৫৩

একটি আবেদন

সেপ্টেম্বর ১২’১৯৯২                                                                                                  

প্রিয় বন্ধুরা,

বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভারত সফরের সময় ত্রিপুরা শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে ভারত সরকারের সাথে একটি চুক্তি করেছেন। ১৯৮৬ সালে ত্রিপুরায় পালিয়ে আসা ৫৬০০০ শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর জন্যও বর্তমান ভারত সরকার দৃঢ় প্রতীজ্ঞ। ভারত সরকার ঘোষণা করেছে যে ১৯৯২ এর ৩১ শে ডিসেম্বররের মধ্যে শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন করতে হবে। ঐ দিনের পর থেকে তারা আর কোন খাদ্য পাবে না। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম যে এখনো সম্পূর্ণ ভাবে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এবং পূর্বের মত মানবাধিকার লংঘন অব্যাহত রয়েছে এই সত্যটিকে অবজ্ঞা করছে।

আমরা আপনাকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এবং একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সংস্থা যেমন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধান ব্যাতিরেকে জুম্ম শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানোর দাবী জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঠানো প্রতিবাদ লিপিগুলো প্রেরণ করলাম।

আমরা আপনাকে সর্নিবন্ধ অনুরোধ করি একই ভাবে আপনিও যাতে খালেদা জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওকে চিঠি লেখেন। আপনি আমাদের চিঠির নমুনা ব্যবহার করতে পারেন, আপনাদের নিজস্ব ধারনায় পরিবর্ধন বা আপনার নিজের চিঠি সংযুক্ত করতে পারেন। আপনি যদি আরও তথ্য জানতে চান তবে উপরের ঠিকানায় এবং ফোন নম্বরে সর্বদা যোগাযোগ করতে পারেন।

অনুগ্রহপূর্বক এই আবেদন অপর সংস্থা এবং আপনার বন্ধুদের কাছেও বিলি করুন।

আমরা আরও খুশী হব যদি আপনার চিঠির এক কপি আমাদের পাঠান যাতে করে কত সংখ্যক লোক এই পরিকল্পিত প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে কর্মসূচী নিয়েছে এই মর্মে বাংলাদেশের জনগণের সাথে যোগাযোগ করতে পারি।

আমরা আপনার প্রত্যুত্তর আশা করছি।

 

শুভেচ্ছা

জেনেকি অ্যারেনস

অর্গানাইজিং কমিটি চিটাগাং হিল ট্রাক্টস কেম্পেইন- এর পক্ষে।

 

৭১ দিন কারাবাস এবং বন্দী ৬ জনের একটি মূল্যায়ন

-প্রদীপন খীসা

(পূর্ববর্তী অংশ স্যাটেলাইট-এ প্রকাশিত হয়েছিল)

সেই দিন আমাদের অনাহারে থাকতে হলো। এমনকি পানি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। দুপুরের খর রৌদ্রে বসিয়ে রেখেছিল সবাইকে। তৃঞ্চার্থ এক ছাত্রী এক সেনাজোয়ানের কাছে পানি চাইলে, অন্য এক সেনা দিতে নিষেধ করে। আর বলে, “ওরা উপজাতি, ওদের পানি দিও না’। অন্যটি বললো, “এরাতো মানুষ”। অন্যরা ধমক দিয়ে বলে-“এত দরদ? বেশী বুঝ, কম বুঝা ভালো।” সাথে পানি থাকা সত্বেও পানি দিতে পারল না। ছাত্রীটিও তৃঞ্চার্থ হৃদয়ে বিংশ শতাব্দীর সভ্যসমাজের উপহার দেওয়া ‘উপজাতি’ নামক বর্বর শব্দটির অর্থ বুঝতে পারল। তথকথিত সভ্যসমাজের অসভ্য ব্যবহারে ক্ষুব্ধ, এবং ক্রোধের অনলে দগ্ধ হয়ে চোখের জল বিসর্জন দিল। এ হচ্ছে সভ্য দুনিয়ার সভ্য সমাজের অভদ্র ব্যবহার। দোকানে বিস্কুট, কলা, মুড়ি কিনতে গিয়েও একই অবস্থা। সেনারা দোকানদারদের সবার সামনে নিষেধ করলো আমাদের নিকট কোন কিছু বিক্রি না করতে। এটাও হচ্ছে ১৮ ফেব্রুয়ারীর বাস্তবতা। মানবাধিকার (লঙ্ঘনের) স্বর্গপূরি পার্বত্য চট্টগ্রামের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনার কিছু বাস্তব চিত্র যা পাহাড়িদের প্রতিদিন শিকার হতে হচ্ছে।

বিকাল পাঁচটার দিকে আর্মীদের দু’খানা পিকআপ এলো। জোর করে গাড়িতে উঠানো হলো আমাদের ছয়জনকে। ক্যাপ্টেন জহির সহযাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা যেখানে খুশী যাও। ক্যাম্পের ধারে, পাশে থাকলে ছয়টার পর দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করা হবে। এখন আমাদের দায়িত্ব ছয়জনকে খাগড়াছড়িতে পৌঁছে দেওয়া। তোমরা বিশ্বাস না করলে লিখিত নিতে পার।” তারপর হাওয়ার গতিতে গাড়ি চালিয়ে আমাদের ছয়জনকে মানিকছড়ির সেনাবাহিনীর জোন অফিসে পৌঁছানো হলো। তারপর জনৈক লেঃ এর সাথে অনেক কথোপকথন। কথায় ও যুক্তিতে পেরে না উঠলে তাদের সেই ক্ষমতা ও শক্তির এবং মহীসুশাসনের আষাঢ়ের গল্প। শেষান্তে বললেন, “তোমরা এত ছোট থাকতে রাজনীতি বুঝেছ। স্কুলের ছাত্রীদেরকে ও রাজনীতিতে নামিয়েছ। তোমাদেরকে গুলি করে হত্যা করলে আমাদের কিছু হবে না, এবং পদবী বৃদ্ধি পাবে-।” এ ধরনের কতকিছু যে বকে গেলেন তার ইয়ত্তা নেই। এবার আসলেন জনৈক মেজর, তার সাথেও অনেক যুক্তি, পাল্টা যুক্তি হলো। তিনি বললেন, “সেনাবাহিনী পাহাড়িদের নিরাপত্তার জন্য, শান্তিবাহিনীদের দমন করার জন্য এবং রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে। সেনাবাহিনী কোনদিন পাহাড়িদের ক্ষতি করেনি এবং করবেও না। মারিশ্যায় লঞ্চে বোমা বিস্ফোরণের কাজটা সন্ত্রাসবাদী শান্তিবাহিনীরাই করেছে। গতকাল (১৭ই ফেব্রুয়ারী) এখানে পার্শ্ববতী গ্রামে শান্তিবাহিনীরা ১৩জন বাঙালিকে মেরেছে (কিন্তু আসল ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন, ক্যাপ্টেন হামিদই জনৈক নিরীহ ৪০ বসরের এক মার্মাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। কারণ ১৬/১৭ বসরের যুবতী কন্যাকে ঐ ক্যাপ্টেনের সাথে রাত্রি যাপন করতে না দেওয়া।)” সেনাবাহিনী পাহাড়িদের ক্ষতি করেছে এমন ঘটনার প্রমাণ মেজর জানতে চাইল। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার শিকার এক সহবন্দী ১লা মে ১৯৮৬ ইং পানছড়ির পাহাড়ি গণহত্যার কথা বর্ণনা দিলেন। উল্লেখ্য যে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে গুলি করে এবং দা দিয়ে অনেক পাহাড়িকে হত্যা করেছে এবং অনুপ্রবেশকারীরাও বাড়িঘরে আগুন লাগিয়েছে। এবং বহু লোককে হত্যা করেছে। পাহাড়িরা বাধ্য হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছে, যারা এখনও ফিরেনি। মেজর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলে, তাদের বীরত্বের গাথা ইতিহাস শুনে। তারপর মুখ খুললেন, বললেন, ‘ঢাকায় তোমাদের নেতারা লাখ লাখ টাকা নিচ্ছে সরকারের কাছ থেকে। আর তোমরা কি পাচ্ছ “আমাদের প্রশ্ন” এখানে ত সে কথা আসছে না। আমরা কি দেশের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলছি? পাহাড়িরা ছাত্র পরিষদ কি অগণতান্ত্রিক? আপনাদের কি ক্ষতি হচ্ছে” মেজর কিছুই উত্তর দিলেন না। আবার নিশ্চুপ। একটু পরে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন, যতসব নিজের মনগড়া আজে বাজে কথাবার্তা। যেন দুধের শিশুকে ঘুম পারানীর ছড়া শুনাচ্ছেন। মেজর আমাদেরকে ঘুম পারাতে চাইলেও আমরা কি ঘুমাবো? কারণ আমরা শিশুতো নয় বটে মেজর থেকে হয়ত কম বুঝি ?-? কারণ ১৭/১৮ বছরের সামরিক শাসন ও শোষণ তো আমাদের মাথার উপর বয়ে গেছে। এখনও যার কোন শেষ নেই। সুতরাং এসব ঘুম পারানির ছড়া শুনে পাহাড়িদের ঘুমাবার সময় অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে অথচ তা এসব সেনাদের অজানা। এবার মেজর কোথায় যেন টেলিফোনে নির্দেশ দিচ্ছেন-ছয়টা বালিশ, ছয়টা লেপ, ছয়টা বেডসীট, এবং ছয়টা মশারী পাঠাও” বলে টেলিফোন রাখলেন। এরপর জনৈক সিপাহীকে ডেকে কড়া গলায় নির্দেশ করলেন- “তাড়াতাড়ি এদের খানা তৈরি করো।” তারপর আমাদের উদ্দেশ্যে কথা- “তোমরা আজ এখানে অথিতি হিসেবে থাকবে, খাবে, ঘুমাবে। কোন অসুবিধা হবে না। আজতো সম্ভব নয়। কাল অবশ্যই তোমাদেরকে খাগড়াছড়িতে পৌছে দেওয়া হবে। নিশ্চয় ক্ষুধা পেয়েছে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, খানা আসবে,” এবার এলো সেই লেপ্টেনেন্ট। শুরু হলো আবার আজগুজি গল্প। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনতে হলো। হঠা জনৈক সিপাহী সালাম দিয়ে বললো খানা রেডী। কিন্তু না। রাত ৮টা ১৫ মিনিটে খানার বদলে হলো থানা। অতিথির পরিবর্তে আসামী এবং সুবিধার পরিবর্তে অসুবিধা। রুমের যে কি অবস্থা। এক জায়গায় খাওয়া ঘুমানো এবং রুমের এক পাশে পায়খানা প্রস্রাব করা। যেন উন্নত সেন্টের গন্ধ। সেই রাতেও (১৮ ফেব্রুয়ারি) কোন খানা নেই। এইতো সেই স্বর্গপুরী পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পাহাড়িদের দিনকাল।

১৯ ফেব্রুয়ারি সহযাত্রী বন্ধুরা এলো দেখা করতে, ফলে ২৪ ঘন্টার পর কিছু পেটে পড়লো। বন্ধুরা বললো যে রাত্রে তাদেরকে খোলা মাঠে, খোলা আকাশের নীচে থাকতে বাধ্য করেছে সেনাবাহিনীর লোকেরা। তারাও অনাহারে রাত্রিযাপন করেছে। কারণ সেনারা সব দোকানদারকে নিষেধ করে দিয়েছে তাদের (সহযাত্রীদের) নিকট কোন কিছু বিক্রি না করতে। আশে পাশে পাহাড়ি লোকেরা লেপ, কম্বল, চাদর এবং ভাত ইত্যাদি ইত্যাদি দিতে চেয়েছিল, কিন্তু কঠোরভাবে নিষেধ ও হুমকি দেওয়াতে সেই সাহায্যও পাওয়া যায়নি। এসব হচ্ছে সুশাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজিত গণতন্ত্র, তথা সেনাবাহিনীর মহা গৌরবোজ্জল শাসন। সে সপ্তাহে ‘সাপ্তাহিক পার্বতী’তে প্রকাশিত হলো, “মানিকছড়ি থানার পুলিশ ছয়জন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে।” মানিকছড়ি থানার ওসি জামাল সাহেব এ খবরের প্রতিবাদ করবেন বলে আমাদেরকে জানান। ‘পার্বতী’ নামক এক কলংকিত পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হওয়ায় জনগণ তেমন আশ্চার্য হয়নি। কারণ এসব মিথ্যা ও আজগুবি খবর নিয়ে প্রতি সপ্তাহে বের হয়। তবে প্রশ্ন হলো এতবড় একটা মিথ্যা ও বানোয়াট খবর পরিবেশন করার মত সাংঘাতিক (সাংবাদিক) ব্যক্তিটি কে ? তবে সবাই নিশ্চিত যে এই সাংঘাটিটাই সেনা সদস্য ছাড়া অন্য কেহ হতে পারে না। সেই দিন ওসি সাহেব আমাদেরকে জানান, তিনিও আমাদের মত বন্দী আসামী। নিজস্ব দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা তার নেই। তাই তিনি বারংবার বললেন, “আমার করার কিছুই নেই। কারণ ওরাতো (সেনাবাহিনী) পার্বত্য এলাকার রাজা, মহারাজা, সৃষ্টিকর্তা সবকিছু।” আসলে সত্যি ওসি সাহেবকে এদের সেনাদের) আঙ্গুলী নির্দেশে উঠাবসা করতে হয়।

 

মোরা পাহাড়ি

-চাইলা অং

মোরা পাহাড়ি

মোরা ঐক্য গড়ি

ভিন্ন ভাষাভাষী দশ জাতির

মোরা হাতে হাত ধরি

মোরা ন্যায় সংগ্রামে লড়ি

মোরা অবিচল পথিক প্রগতির।

মোরা মানিনা বাঁধা

রবনা অধীন

মোরা শৃংখল ভেঙ্গে

হব মুক্ত স্বাধীন।

মোরা পাহাড়ি ঝর্ণার মতো

বয়ে চলি দুর্বার

মোরা ভাসাইয়ে নিই সব

অন্যায় অবিচার।

মোরা দুরন্ত সন্তান অরুণ রবির।

মোরা অবিচল পথিক প্রগতির।।

মোরা ভাঙবো এ সমাজ

গড়বো নতুন

মোরা জঞ্জাল-ঘুনে

জ্বালবো আগুন।

মোরা পাহাড়ি চূড়ার মতো

রব চির উন্নতশীর

মোরা জীবন দিয়ে রেখে মান

হয়ে রব মহাবীর।

মোরা রচিব পাহাড়ে এক শান্তি নীড়।

মোরা অবিচল পথিক প্রগতির।।

 

(সমাপ্ত)

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন