পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৮

রাডার (বৈসাবি সংখ্যা), পাতা: ৫ - ১৪

রাডার
হিল লিটারেচার ফোরামের একটি অনিয়মিত প্রকাশনা
১৩ই এপ্রিল ’৯২
বৈসাবি সংখ্যা

পাতা: ৫ - ১৪

মানবাধিকার
অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম
                   মানবাধিকার লংঘনের শেষ কোথায়?                                                       ...............................................................

[এক ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। ক্ষমতায় আসীন হয়েছে বহুল কথিত একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। তারপর এক বসরাধিক কাল অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু তবুও পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। জেল-জুলুম, হত্যা, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্মীয় পরিহানি ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ আগের মতোই বর্তমান কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও অহরহ ঘটে চলেছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের খবরগুলো এই কলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি- সম্পাদনা পরিষদ]                 

দীঘিনালা
(১)
ভি, ডি, পি, কর্তৃক প্রহৃত      
১২ই ডিসেম্বর ১৯৯১ ইং, বৃহস্পতিবার। তখন সন্ধ্যে প্রায় সাতটা। “শান্তি নিবাস” নামক গুচ্ছগ্রামবাসী মিঃ মণি চাকমা তার বন্ধু মিঃ সুকুমার চাকমার বাড়ী থেকে ফিরছিলেন। পথে টহলরত দীপায়ন চাকমা নামক জনৈক ভি,ডি,পি গু-া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তাকে আটক করে ও অযথা হয়রানিমূলক নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে। ভিডিপি গু-ারা মনি চাকমাকে শান্তিবাহিনীর সহযোগী সন্দেহে বেদম প্রহার করে ও মিঃ ক্রিনটেন্দ্র -এর দোকানের খুটিতে উলঙ্গ অবস্থায় সারা রাত বেঁধে রাখে। পরের দিন তাকে এই শর্তে ছেড়ে দেয়া হয় যে, (১) সে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গুচ্ছগ্রামের বাইরে যাবে না, (২) সে শান্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখবে না, (৩) সে তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করবে এবং (৪) সে পরবর্তী দশদিন ধরে ভিডিপি ক্যাম্পে হাজিরা দেবে।                                                                              উল্লেখ্য মিঃ মনি চাকমার পিতা ভেজাল্যা চাকমাকে এক বছর আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক করা হয় এবং তিনি এখনো খাগড়াছড়ি জেলে অন্তরীণ আছেন।  
জানা গেছে সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট এই তথাকথিত ভিডিপি আঙ্গুলবাহিনী আখ্যাত গ্রাম্য মস্তানদের উপাতে গুচ্ছগ্রামবাসীদের জীবন বর্তমানে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। একে খাদ্য সংকট, অসুখ-বিসুখ ও নিয়ন্ত্রিত জীবন; তার উপর এই ভিডিপি ও আঙ্গুলবাহিনী নামক গু-াদের দৌরাত্ম্য- গুচ্ছগ্রামবাসীদের যেন মরার উপর খারার ঘা।

(২)
বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ : দুইজন প্রহৃত 
গত ১৩/১২/৯১ইং বাবুছড়া সাব-জোন কমা-ার মেজর নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী দিঘীনালা উপজেলার হংসজয় কার্বারি পাড়ায় হানা দেয়। তারা তিন ব্যক্তির ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায় এবং অন্য দুই জনের বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়। যাদের বাড়ীগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয় তারা হলেন (১) ভারতচন্দ্র চাকমা, পিতা হিরণ মোহন চাকমা এবং (২) ভারতমনি চাকমা পিতা উদয়মনি চাকমা। তাছাড়া, সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে জটিলা চাকমা পিং বাঙাল্যা চাকমা, জগদীশ মনি চাকমা ও বাচ্যু মনি চাকমা নামে তিনজন নিরীহ ব্যক্তিকে অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত বেদম প্রহার করে।                    
জানা গেছে, বাবুছড়ায় অবস্থিত শান্তিনিবাস গুচ্ছগ্রাম নিবাসী মিঃ সুজেন্দ্র চাকমার পুত্র মিঃ বাচ্যুমনি চাকমাকে সেনা সদস্যরা পথ প্রদর্শক হিসাবে সেখান থেকে জোরপূর্বক নিয়ে গিয়েছিল।

(৩)
সেনাবাহিনী কর্তৃক কিশোরী ধর্ষিতা 
২২/১২/৯১ইং রবিবার, বৌদ্ধপাড়া গ্রাম দিঘীনালা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সড়ক টহলদান সেনাবাহিনীর প্রাত্যহিক কাজ। ঐ দিন টহলদানরত আলীগড় টিলা ক্যাম্প কমা-ার (৮ম বেঙ্গল রেজি) তার চার জন সৈন্যসহ দুপুর একটার সময় টহল পোষ্টের অনতিদূরে বৌদ্ধপাড়া গ্রামে যায় এবং মিঃ রতন কুমার ত্রিপুরার ১৯ বছরের সুন্দরী কিশোরী কন্যা অঞ্জলী ত্রিপুরাকে বলপূর্বক উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। উক্ত ঘটনার পর এলাকায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক চাপা ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বর্বরোচিত ঘটনার যথার্থ বিচার পাওয়ার কোন উপায় না দেখে এলাকাবাসীরা ক্ষোভে-দুঃখে শুধু অশ্রুপাত করতে থাকে।

(৪)
সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়ি গ্রামে হানা, বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ   
২২/১২/৯১ইং, রোজ রবিবার, দুপুর ২টা। ঐ দিন পানছড়ি জোন-এর একদল আর্মি বাবুছড়া ইউনিয়নের শুকনাছড়ি গ্রামে অতর্কিত হানা দেয় এবং গ্রামবাসীদের উপর বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করে। ঐ সময় গ্রামবাসীরা প্রাণের ভয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে এবং অনেকে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে আশ্রয় নিতে সমর্থ হয়। উক্ত ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। কারণ ঐ এলাকাকে সেনাবাহিনী কর্তৃক বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। তবে পালিয়ে আসা একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সেনাবাহিনীরা সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৯ জনের বাড়ি-ঘর ভস্মিভূত হওয়ার খবর প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তারা হলেনÑ (১) অক্ষয় চন্দ্র চাকমা পিতা চুচ্যাং চাকমা, (২) জুক্যা চাকমা পিতা মধুচন্দ্র চাকমা, (৩) দিল্লীজয় চাকমা পিতা Ñ জানা যায় নি, (৪) মিত্রময় চাকমা পিতা Ñ উত্তুচ্যা চাকমা, (৫) বীরকর চাকমা পিতা মিত্রজয় চাকমা, (৬) প্রভাতচন্দ্র চাকমা পিতা জমাদিরন চাকমা (৭) জচিন্যা চাকমা পিতা রাঙ্যা চাকমা, (৮) বীরসেন চাকমা পিতা রাঙ্যা চাকমা এবং (৯) যুধিষ্টির চাকমা পিতা অজানা চাকমা।

(৫)
সাইকেল চালানোর জন্য দশম শ্রেণীর ছাত্র প্রহৃত
২৩ শে ডিসেম্বর ১৯৯১ ইং। “শান্তিনিবাস” গুচ্ছগ্রাম ও বাজারের পরিচালক লেন্স নায়েব বেলায়েত দশম শ্রেণীর ছাত্র ইরিস কান্তি চাকমাকে বিনা কারণে বেদম প্রহার করে। জানা গেছে, “শান্তিনিবাস” গুচ্ছগ্রামবাসী বিমল কান্তি বাপের ছেলে মিঃ ইরিস কান্তিকে গুচ্ছগ্রাম এলাকার বাইরে সাইকেলে চড়ায় জনাব বেলায়েত কোন জিজ্ঞাসাবাদ না করে অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত তাকে নাকে মুখে বেপরোয়াভাবে কিলঘুষি লাঠি মারতে থাকে।

(৬)
এক বছরের শিশু সোহেল-এর কি অপরাধ ? 
পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভিন্ন ভাষাভাষী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার-নির্যাতন পৃথিবীর সমস্ত বর্বরতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মায়ের কোলের ছোট ছোট শিশুরাও এই বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। গত ৬/১/৯২ ইং শান্তিপুর গ্রামের জাঙ্গাল্যা চাকমার এক বছরের শিশুপুত্র সোহেল চাকমাকে সেনাবাহিনীর জনৈক সদস্য তার মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে লাঠি মারে এবং আছার দেয়। এর ফলে শিশুটি প্রায় আট ঘন্টার মতো অচেতন অবস্থায় থাকে।

(৭)
সেনাবাহিনী কর্তৃক ভোট বাক্স দখল 
৪ঠা ফেব্রুয়ারি ’৯২ দিঘীনালা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অত্র এলাকার জনগণ সুষ্ঠুভাবে স্ব স্ব ভোট প্রদান করেন। কিন্তু ভোট গণনার সময় বড়াদম সাব-জোনের সেনা অধিনায়কের নির্দেশক্রমে ভোট বাক্সসহ ভোট গ্রহণকারী কর্মচারীদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশ^স্ত সূত্রে জানা যায়, প্রিজাইডিং অফিসার বীরেন্দ্র কুমার চাকমা (প,প,অফিসার) এবং সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার জীবন চন্দ্র দে (সহকারী শিক্ষক, বড়াদম উচ্চ বিদ্যালয়)-কে ভোট বাক্সসহ জোরপূর্বক ক্যাম্পের এক গোপন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ভোট বাক্স খুলতে বাধ্য করা হয়। এরপর আর কি করা হয় তা জানা যায় নি। তবে সেনাবাহিনী কালিজয় চাকমা পাশ করেছে বলে ঘোষণা দেয়। উল্লেখ্য, এই কালিজয় চাকমাকে সেনাবাহিনীর গুপ্ত সহযোগী বলে মনে করা হয়।
(৮)
সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রচারাভিযানে বাধা দান    
১লা ফেব্রুয়ারি ’৯২ ইং রোজ শনিবার ডি,পি, পাড়ার ক্যাম্প অধিনায়ক লেঃ তারেক ৪ নং দীঘিনালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী চিত্তকিশোর চাকমাকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেয়নি। তার সমর্থকদের প্রচার মিছিল ঐদিন উদল বাগানে পৌঁছলে সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধা দেয়া হয় এবং চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী চিত্তকিশোর চাকমা সহ তার সমর্থকদের প্রাণনাশের হুমকী দেয়া হয়। অপর এক ঘটনায় উক্ত সেনা অফিসার ২নং বোয়ালখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ফণি রঞ্জন ত্রিপুরাকে ডি,পি, পাড়ায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেয়নি।

বরকল
(১)
জোরপূর্বক গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তরকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত   
বরকল উপজেলার জোন কমা-ার (১৬ নং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) মরা উজ্যাংছড়ি, লতিবাঁশ ছড়া, সুয়ারী পাড়া, বৈরাগী পাড়া, বাঘছড়ি, আইমা ছড়া - এসব এলাকার নিরীহ পাহাড়ি জনগণকে তাদের স্থায়ী আবাসভূমি থেকে জোর করে গুচ্ছগ্রামে বসবাস করতে বাধ্য করছে। কিন্তু তাদের জমিজমা গুচ্ছগ্রাম থেকে অনেক দুরে পড়ে যাবে এবং চাষ হবে না বিধায় তারা এর প্রতিকারের জন্য জিওসি-এর কাছে ধর্ণা দিলেও তাতে কোন ফল হয়নি। এদিকে স্থানীয় জোন কমা-ার জানুয়ারি ১০/১৫ তারিখের মধ্যে নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে গুচ্ছগ্রামে চলে আসার জন্য উক্ত এলাকাবাসীদেরকে পুনর্বার কড়া নির্দেশ জারী করেছে। উক্ত তারিখের মধ্যে স্ব ইচ্ছায় গুচ্ছগ্রামে না আসলে সে তাদেরকে জোর করে নিয়ে আসবে বলে হুমকি দিয়েছে বলে জানা গেছে।

(২)
জনগণের ভোগান্তির বিনিময়ে বাজার জমজমাট করার খায়েশ                                                                                       বরকল বাজারকে জমজমাট করার সেনাবাহিনীর (১৬ নং ইষ্ট বেঙ্গল) খায়েশ মেটাতে বর্তমানে বরকল উপজেলাধীন হালাম্বা, বাঘাছলা, ভুরবানিয়া, কুসুমছড়ি, বিল্লাছড়া, ইত্যাদি এলাকার অধিবাসীদের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। সেনাবাহিনীর নির্দেশে উক্ত এলাকার নিরীহ জনসাধারণকে নিকটবর্তী সুবলং বাজারে না গিয়ে ৩/৪ ঘন্টার পানিপথ অতিক্রম করে বরকল বাজারে তাদের উপাদিত সামগ্রী (কলা, আদা, হলুদ ইত্যাদি) পানির দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে নতুন সিও আসার পর থেকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

(৩)
একই সাথে দুই বোন ধর্ষিতা                                                                                                               
১৬ই মার্চ ১৯৯২ ইং বরকল সদর জোনের ১৬ ইষ্ট বেঙ্গলের অধীন মাইচছড়ি নামক আর্মি ক্যাম্পের ৪ (চার) জন জোয়ান সহোদর দুই বোনকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষিতা সহোদর দুই বোনের নাম হলো যথাক্রমে Ñ মিস অনিকা চাকমা এস,এস,সি পরীক্ষার্থীনি এবং তার ছোট বোন অঞ্জনা চাকমা নবম শ্রেণীর ছাত্রী, পিতা ধর্ম ধন চাকমা, গ্রামঃ সুবলং হাজাছড়া। জানা যায় উক্ত দুই বোন জমিতে ধান রোপন শেষে বাড়িতে ফেরার পথে বরকল সদর জোনের ১৬ ইষ্ট বেঙ্গলের অধীন মাইচছড়ি ক্যাম্পের ৪ (চার) জন জোয়ান অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দুই বোনকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে তাদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করে। এখনও পর্যন্ত অপরাধী এ সেনাদের বিরুদ্ধে কোন রকম আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

(৪)
সেনাবাহিনী কর্তৃক নববধু ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ স্বামী ছুরিকাহত                                                                           
গত ১২ই মার্চ ৯২ইং রোজ বৃহস্পতিবার বরকল সদর জোনের অধীন বেতছড়ি ক্যাম্পের কয়েকজন জোয়ান (১৬ বেঙ্গল) খামার বাড়িতে অবস্থানরত বিনয় কান্তি চাকমার নবপরিণীতা স্ত্রীকে বলপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটির প্রবল বাধা দানের ফলে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হলে সেনা জোয়ানরা বিনয় কান্তি চাকমাকে ছুরিকাঘাত করে। এতে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়। বিনয় কান্তি মাইচছড়ি গ্রামের বিজু চন্দ্র চাকমার পুত্র।

(৫)
গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত, একজন নিহত
বর্তমানে বরকল জোনের (১৬ বেঙ্গল) অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল ইকবাল করিম ভুঁইয়া হালাম্বা, বেগেনাছড়ি, দেওয়ান চর, ওজ্যাংছড়ি ইত্যাদি এলাকার জনসাধারণকে জোরপূর্বক গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তরিত করার জন্য জোর প্রয়াস চালাচ্ছে। এজন্য এখন এসব গ্রামে সেনা অভিযান চালানো হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ৪/৩/৯২ইং রোজ বুধবার ওজ্যাংছড়ি গ্রামে হানা দেয়। মিঃ জয়চন্দ্র চাকমা পীং পাগোয্যা চাকমা গুচ্ছগ্রামে যেতে অস্বীকার করলে তাকে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই দিন সেনারা আরো একজনকে একই কারণে হত্যা করে। যার নাম এখনো পাওয়া যায়নি। এলাকাবাসীদেরকে গুচ্ছগ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। কৃষকদেরকে কৃষিঋণ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সরকারী আদেশ নির্দেশ এবং কার্যক্রমের ওপর আর্মিরা হস্তক্ষেপ করছে। বিলছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য সরকার কর্তৃক মঞ্জুরীকৃত চল্লিশ হাজার টাকা উক্ত জোন কমা-ার বন্ধ করে দেন। তা ছাড়া সুবলং এলাকার সরকারী প্রাইমারী বিদ্যালয়সমূহ পুনঃনির্মাণ বা মেরামত বাবদ যে কয়েক লক্ষ টাকা সরকার বরাদ্দ করেছেন, তাও সেনারা গুচ্ছগ্রাম খাতে ব্যয় করছে। বর্তমানে অত্র এলাকার জনসাধারণ খুবই ত্রস্ত জীবন যাপন করছে। গুচ্ছগ্রাম নামক বন্দী শিবিরে যেতে অস্বীকার করলেই মারধর করা হচ্ছে। আবার গুচ্ছগ্রামে গেলেও কোন চাষবাস হবে না। কারণ জমিগুলো অনেক দুরে পড়ে থাকবে এবং তা বাঙালিরা দখল করে নেবে।

বাঘাইছড়ি
(১)
বাঘাইছড়িতে শিক্ষক হয়রানি   
“আমরা সেনাবাহিনী কর্তৃক এই রকম অযথা হয়রানি হওয়া থেকে মুক্তি পেতে চাই” Ñ এই কথাগুলো বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঘাইছড়ি উপজেলার একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। উল্লেখ্য, রাঙ্গামাটি জেলাধীন উক্ত উপজেলার প্রায় ৩০০জন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষককে প্রত্যেক মাসে বেতন তোলার আগে স্থানীয় জোন কমা-ার লেঃ কর্ণেল হারুনুর রশীদ (৪৬ নং ইষ্ট বেঙ্গল রেজি) -এর কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হচ্ছে। উক্ত ক্লিয়ারেন্স বা ছাড়পত্র ব্যতীত সোনালী ব্যাংক কাউকে বেতন দেয় না। এর ফলে শিক্ষক/শিক্ষিকারা যেমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তেমনি এলাকার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরও পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে। কারণ এ ছাড়পত্র নিতে প্রত্যেক মাসে ১ দিন করে উক্ত উপজেলার স্কুলগুলি বন্ধ রাখতে হয়। বলাবাহুল্য ৮ম ব্যাটেলিয়ন থাকাকালীন ১৯৭৯ সাল থেকে এ হয়রানিমূলক ব্যবস্থা চালু হয়, যা অন্য অঞ্চলে নেই। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকগণ অনেক আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত লেখালেখি ও তদবির করেছিলেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি। তারপর গত বসরের ডিসেম্বর মাসে ২৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট Ñএর সিও জনাব ফাতেমী আহম্মদ রুমী তার বদলীর সময় বিদায় অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, প্রাইমারী শিক্ষকদের এ ব্যবস্থা মাফ করে দেয়া হবে। কিন্তু ২৮ বেঙ্গল বদলীর পরও ৪৬ বেঙ্গল এসে উক্ত কালো ব্যবস্থা পুনর্বহাল রাখেন। একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক বলেন, “অন্যায় কাজ করেন তারা, অপরাধ হয় আমাদের। তারপরেও মাফ চেয়েছি এবং রুমী সাহেবের কাছ থেকে মাফ পেয়েছি। কিন্তু মাফ পেলাম না ৪৬ বেঙ্গল এর কাছ থেকে।” বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩০০ জন শিক্ষক জানেন না তাদের ওপর এই হয়রানি ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার শেষ কোথায় ?

(২)
কাচালং কলেজের তিন জন ছাত্র গ্রেফতার
গত ২রা মার্চ ’৯২ ইং বাঘাইছড়ি বি,ডি,আর সেনা জোয়ানরা বাবুপাড়া গ্রামের রিপল চাকমা পীং সুনেন্দু চাকমা এবং তালুকদার পাড়া গ্রামের মিঃ লোকবল চাকমা পীং মেম্বার দীপংকর তালুকদার -নামে কাচালং কলেজের দুই জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। সেনারা রিপল চাকমাকে মারিশ্যা বাজার লঞ্চঘাট থেকে এবং লোকবল চাকমাকে নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। বাঘাইছড়ি থেকে আমাদের সংবাদদাতা কর্তৃক এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের ওপর অমানুষিক শারিরীক নির্যাতন চালানো হচ্ছিল বলে জানা গেছে।                                        এছাড়া গত ৩রা মার্চ ’৯২ আদিত্য চাকমা নামক কাচালং কলেজের আরো একজন ছাত্রকে উক্ত সেনা সদস্যরা ধরে নিয়ে যায় এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে তার কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয়। উল্লেখ্য, উক্ত তিন ছাত্রসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আরো অন্যান্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারকৃত মোট ৯ জন ছাত্রের মুক্তির দাবীতে গত ১২/৩/৯২ ইং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ঢাকা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে একযোগে প্রতীক অনশন ধর্মঘট পালন করে। তাদেরকে এখনো ছেড়ে দেয়া হয়নি।

নানিয়াচর
(১)
মার্মা পাড়ায় ভি,ডি,পি কর্তৃক বাড়ি-ঘর ভাঙচুর, লুটপাট একজন গুম  
৭ই নভেম্বর ’৯১, নানিয়াচর উপজেলার বুড়িঘাট এলাকায় পলিপাড়া মারমা সম্প্রদায় অধ্যুষিত এক শান্ত-¯িœগ্ধ গ্রাম। অবশেষে ভি,ডি,পি দের হামলায় সেই পলিপাড়াও এক বিরানভূমিতে পরিণত হলো। জানা যায়, ঐ দিন (৭/১১/৯১) বুড়িঘাটে অবস্থানরত অনুপ্রবেশকারী ভি,ডি,পি সদস্যরা পলিপাড়ায় এক অতর্কিত হানা দিয়ে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালায়। তারা আহ্লা মার্মা নামক জনৈক ব্যক্তির এক জোড়া হালের গরুও নিয়ে যায়। মিঃ আহ্লা মার্মা (৭০) পীং ক্যাজাই মার্মা তার হারানো গরু জোড়াটি অনুপ্রবেশকারীদের পাড়ায় খোঁজ করতে গেলে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। পলিপাড়ার মার্মা অধিবাসীরা মনে করে আহ্লা মার্মা অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা গুম হয়েছেন।
উল্লেখ্য, একই দিন অনুপ্রবেশকারী ভি,ডি,পি সদস্যরা উত্তর মঙ্গলা, দক্ষিণ মঙ্গলা, হাতিমারা, তংতুল্যা, কেরেটছড়ি, রামহরি পাড়া ও কৃঞ্চমা ছড়া গ্রামের জুম্ম অধিবাসীদের পাইকারীভাবে মারধর করে এবং প্রচুর টাকার সম্পত্তি তছনছ ও লুট করে নিয়ে যায়। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, উক্ত ঘটনায় উদ্বাস্তু হওয়া পলিপাড়ার মার্মাজুম্ম ও অধিবাসীরা এখন তাদের নিজ নিজ বাড়ি-ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। তবে এলাকায় এখনো আতংক বিরাজ করছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মিঃ আহ্লা মার্মাÑএর (জ্যান্ত/মৃত) কোন হদিস পাওয়া যায় নি।

(২)
বিজয় দিবসে ধর্ষণের চেষ্টা ও মারধর
১৬ই ডিসেম্বর যখন সারা দেশ ২০ তম বিজয় বার্ষিকীতে আনন্দে মাতোয়ারা, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের নানিয়াচর উপজেলার দক্ষিণ হাতিমারা নামক অখ্যাত এক গ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পৈশাচিক হামলার মাধ্যমে বিজয় দিবস পালনে ব্যস্ত-যা ১৯৭১ সালের হানাদার পাকবাহিনীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।                                                                                              
আমাদের রাডার সংবাদদাতা জানান, ঐ দিন (১৬/১২/৯১) বুড়িঘাট আর্মি ক্যাম্প -এর মেজর মুনির -এর (৮ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন নানিয়াচর জোন) নেতৃত্বে ১১ জনের একটি সেনাদল দুটি জেট বোটে করে টহল দেওয়ার সময় দক্ষিণ হাতিমারায় এসে নারী ধর্ষণের চেষ্টা চালায় এবং মারধর করে। উক্ত ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের নাম ঠিকানা ও অত্যাচারের বিবরণ নিম্নরূপ ঃ-
১। মিসেস ধনপতি চাকমা (২৩) স্বামী - সুশীল জীবন চাকমা, গ্রাম দক্ষিণ হাতিমারা, ৭০ নং হাজাছড়ি মৌজা, নানিয়াচর উপজেলা-কে জনৈক মেঘনাথ -এর বাড়িতে ঢুকিয়ে বলাকারের চেষ্টা করলে মেয়েটির চিকারের ফলে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পরে সেনারা বন্দুকের বাট দিয়ে যৌনাঙ্গে আঘাত করে। মিসেস ধনপতিকে নৌকাযোগে পানি আনতে গিয়ে ফেরার পথে জোর করে ঐ মেঘনাথ এর বাসায় জনৈক আর্মি নিয়ে যায়।
২। মিস্ অমলিকা চাকমা (১৫) পীং - রবি চাকমা, গ্রামঃ কেরেটছড়ি, ৭০ নং হাজাছড়ি মৌজা, নানিয়াচর - কে ধষণের চেষ্টা করলে জনৈক সাধন মাষ্টারের বৃদ্ধা মা তক্ষণা ঝাঁপিয়ে ধরে অমলিকাকে উদ্ধার করেন। ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হলে সেনা জোয়ানরা (নাম-আজিজ, জোনেল, নজরুল, সিরাজ) মেয়েটির বুকে বোমা লুকানো আছে - এই অজুহাতে মেয়েটির ব্লাউজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ন্যাক্কারজনকভাবে শ্লীলতাহানি করে। পরে টাকার লোভ দেখানো সত্ত্বেও যৌনসঙ্গমে রাজি না হওয়ায় সেনা জোয়ারা অমলিকাকে মারধর করে।
তাছাড়াও (১) মিস্ আলোরাণী চাকমা (১৫) পীং- চারু মোহন চাকমা (২) মিস্ সুচরিতা চাকমা (১২) পীং- আনন্দ শেখর চাকমা (৩) মিসেস প্রণীতা চাকমা (২২) স্বামী- পংকজ চাকমা (৪) মিস্ বসুন্ধরা চাকমা (১৩) পীং- বিরাজমুনি চাকমা (৫) মিসেস রূপালি চাকমা (৪৫) স্বামী- পুলিন্যা চাকমা ও (৬) মিসেস সাধনাদেবী চাকমা (২৮) স্বামী- শান্তনু চাকমা -কেও ঐ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হলে মারধর করে। তারা কাউকে যৌনাঙ্গে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করে, কাউকে ব্লাউজ ছিড়ে দিয়ে উলঙ্গ করে। 
জানা গেছে, সেনা জোয়ানরা একই গ্রামের মিঃ রমণী রঞ্জন চাকমা (৩৪) পীং- মৃত প্রভাত চন্দ্র চাকমা, মিঃ বাত্যা চাকমা (৩৫) পীং- জুগরাম চাকমা এবং মিঃ দেবেন্দ্র চাকমা (৫০) পীং- পরশচন্দ্র চাকমা নামক তিনজন নিরীহ ব্যক্তিকেও অমানুষিকভাবে প্রহার করে। সেনারা রমণী রঞ্জন চাকমাকে নাকে-মুখে পানি ঢেলে নির্যাতন করে এবং শান্তিবাহিনী ও চাঁদা আদায়কারী বলে মিথ্যাভাবে অভিযুক্ত করে বুড়িঘাট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে তার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানা যায় নি।

(৩)
গুলিতে নিরীহ জুম্ম মাছ ব্যবসায়ী আহত
২৪শে নভেম্বর ১৯৯১ ইং, রাত আনুমানিক ১১ঃ০০ টার সময় নানিয়াচর জোন (৮ নং ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন) হেড কোয়াটার থেকে একদল আর্মি তৈচাকমা মুখ গামারী বাগান নামক জায়গায় মিঃ নন্দ বিলাস চাকমা (২৭) পীং-শারদা চাকমা ও মিঃ ভুত্তুঙ্যা চাকমা (৩৫) পীং- করি রঞ্জন চাকমা নামে দুইজন মাছ ব্যবসায়ীকে গুলি করে আহত অবস্থায় ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আহত ব্যক্তিরা সাবেক্ষং ইউনিয়ন, ৬২ নং সাবেক্ষং মৌজার অন্তর্গত জগনাতলী গ্রামের অধিবাসী বলে জানা গেছে।
উক্ত ঘটনার সূত্রে জানা যায়, রাধা নাথ বহদ্দার নামে একজন হিন্দু জেলে মাছ ধরার জন্য ঐ স্থানে (তৈচাকমা মুখ গামারী বাগান) একটা জায়গা পরিস্কার করলে উহাতে বল বহদ্দার নামে অপর একজন হিন্দু জেলে মাছ ধরতে এলে দুইজনের মধ্যে তুমুল বাকবিত-া হয়। এই ঘটনার জের হিসেবে বল বহদ্দার নানিয়াচর আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে শান্তিবাহিনীরা কালেকশানে আসবে বলে খবর দেয় এবং সঙ্গে একদল আর্মি নিয়ে আসে। ঘটনার ঠিক কয়েক মিনিট আগে ২ জন জুম্ম মাছ ব্যবসায়ী মাছ কেনার জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছলে আর্মিরা তাদেরকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ব্যবসায়িদ্বয় সাংঘাতিকভাবে আহত অবস্থায় কোন রকমে তীরে ওঠে। আর্মিরা সারা রাত ঐ স্থানটি ঘেরাও করে রেখে পরদিন ভোরে আহত অবস্থায় তাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

(৪)
সেনাবাহিনী কর্তৃক ২জন যুবতী অপহৃত
৫ই ডিসেম্বর ’৯১ ইং ডাক বাংলো আর্মি ক্যাম্প (৮ম ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন, নানিয়াচর বড় জোন) -এর সেনা সদস্যরা টহলরত সামরিক যানে করে মিস্ সোনালী চাকমা ওরফে সোনাপুদি (১৯) পীং-বসন্ত কুমার চাকমা এবং মিস বাদনী চাকমা ওরফে চম্পা (১৭) পীং- সিদোল মুনি চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। জানা গেছে, নিজেদের খামার বাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডাক বাংলো বগাছড়ি আর্মি ক্যাম্প সংলগ্ন রাস্তার মোড়ে পৌছলে সেনা সদস্যরা উক্ত যুবতীদ্বয়কে সামরিক যানটিতে জোরপূর্বক তুলে ডাক বাংলো ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। উক্ত যুবতীদ্বয় নানিয়াচর উপজেলার বুড়িঘাট অঞ্চলের অন্তর্গত নানাক্রুম গ্রামের অধিবাসী। গোপন সূত্রে জানা গেছে, যুবতী নারীদেরকে ছলেবলে কৌশলে অপহরণ করে নিয়ে বিয়ে করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত সেনাবাহিনীদের উপর গোপন নির্দেশ রয়েছে।

(৫)
সুবেদার তফাজ্জলের যৌন উন্মাদনায় যুবতী নারীরা সস্ত্রস্ত, একজন কিশোরী ধর্ষিতা  
সমস্ত প্রকার বস্তুগত সম্পদ-বঞ্চিত পার্বত্য চট্টগ্রামের অসহায় অবলা নারী সমাজকে সতীত্ব নামক যে সম্পদ দিয়ে রাখা হয়েছে, বর্তমানে কতিপয় দুশ্চরিত্র লম্পট সেনাসদস্য তাও বর্বরভাবে হরণ করতে উদ্যত।
গত ১২ই ডিসেম্বর ১৯৯১ ইং মিস ঝর্ণাদেবী চাকমা-কে (১৪) জুরাছড়ি আর্মি ক্যাম্প কমা-ার (৮ম ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন, নানিয়াচর জোন) সুবেদার তফাজ্জল বর্বরভাবে ধর্ষণ করে। সে খাগড়াছড়ি জেলার ইটছড়ি গ্রামের অধিবাসী মিঃ কান্দারা চাকমার কন্যা। উল্লেখ্য, উক্ত পাশবিক ঘটনার কিছুদিন আগে ঝর্ণাদেবী তার দাদু মিঃ রত্নধর চাকমার (গ্রাম-মাইচছড়ি, ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন, নানিয়াচর উপজেলা) বাড়িতে বেড়াতে আসে। কয়েকদিন সেখানে থাকার পর সে তার দাদুকে নিয়ে নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য মহালছড়ি-মানিকছড়ি রাস্তায় জুরাছড়ি আর্মি ক্যাম্পের নিকটে পাবলিক বাস অপেক্ষা করছিল। ঠিক সেই মুহুর্তে সুবেদার তফাজ্জল ঝর্ণাদেবীকে জোর পূর্বক ক্যাম্পের গোল ঘর-এ নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করে। ঐ সময় ৬৫ বছর বয়স্ক দাদু ঝর্ণাদেবীর ‘আজু আজু’ চিকার শুনে গোল ঘরের দিকে যেতে চাইলে অন্য একজন আর্মি তাকে বাধা দেয়। কিছুক্ষণ পরে অসুরিক চাহিদা মেটার পর তফাজ্জল ঝর্ণাদেবীকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনার পর সে শারিরীক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার গালে ও বুকে এখনো তফাজ্জলের হিংস্র লোলুপ কামড়ের দাগ রয়েছে। এলাকায় এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উক্ত পৈশাচিক ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের কোন উপায় না দেখে তাদের মনে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ আরও দ্বিগুণ বাড়তে থাকে।
তফাজ্জলের কুকীর্তি এখানে শেষ নয়। ঝর্ণাদেবীকে ধর্ষণের পর তার অসুর-সত্ত্বা আরো দ্বিগুণ প্রবল হয়ে ওঠে। উক্ত ঘটনার পর সে আরো দুজন কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। গত ১৩-১২-৯১ইং তফাজ্জল ১৭ বছরের আরেক যুবতী মিস্ আনন্দ মালা চাকমা পীং বেরগুয়া চাকমা, গ্রামঃ কাঠালতলী, ৭২নং বুড়িঘাট মৌজা, নানিয়াচর উপজেলা-কে ক্যাম্পের একই গোলঘরে বলপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু প্রবল বাধা দান ও চিকারে শেষ পর্যন্ত তফাজ্জলের ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঐ দিন আনন্দ মালা তার ভগ্নিপতি অজিত কুমার চাকমার সাথে কুতুকছড়ি বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল।     
জানা গেছে, আনন্দ মালাকে এ দিন ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ছেড়ে দেয় এবং পরের দিন একা একা আসার জন্য নির্দেশ দেয়। তফাজ্জল আনন্দ মংালাকে তার কাছে পাঠাতে ব্যর্থ হলে অজিতকে মারধর ও জেলে পুরে রাখবে বলেও হুমকি দেয়।                 
এরপর গত ১৬-১২-৯১ইং সেনাবাহিনীর কলংক সুবেদার তফাজ্জল মিস্ কালাবি চাকমা নাম্রী ১৬ বছরের আরো এক যুবতীকে একই স্থানে বলাকার করার চেষ্টা করে। কালাবী চাকমা নানিয়াচর উপজেলার ৪নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন ও ৭১নং ছোটমহাপুরম মৌজার অন্তর্গত মাইচছড়ি গ্রামের অধিবাসী পরানকিষ্ট চাকমার কন্যা। জানা যায়, উক্ত ঘটনার একদিন আগে তফাজ্জল কালাবী চাকমাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসার জন্য মাইচছড়ি নিবাসী মিঃ শান্তিময় চাকমাকে নির্দেশ দেয়। কারণ কালাবীর বিরুদ্ধে নাকি তাদের কাছে অভিযোগ আছে। তার পরের দিন (১৬-১২-৯১) শান্তিময় বাবু কালাবিকে নিয়ে ক্যাম্পে যায়। তফাজ্জল তাকে কিছু দুরে রেখে কালাবীকে গোলঘরে বসিয়ে অহেতুক নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে এক পর্যায়ে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু প্রবল চিকার ও ধস্তাধস্তির পর কালাবী গোলঘরের বাহিরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।                          
সেনাবাহিনীর কলংক এই সুবেদার তফাজ্জলকে বর্তমানে জেলে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। তাকে রাঙ্গামাটি ব্রিগেড কমাণ্ডা গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন। এখন নানিয়াচর এলাকার বাসিন্দারা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে।

(৬)
শান্তিবাহিনীর সহযোগী সন্দেহে মারধর দুগ্ধ-শিশুও বাদ যায়নি  
গত ৩রা ডিসেম্বর ’৯১ইং নানিয়াচর জোন-এর আমীর (৮ম ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন) শান্তিবাহিনীর সহযোগী সন্দেহে বেতছড়ি দ্বজর পাড়া ও জগনাতলী গ্রামের একজন দুগ্ধ-শিশুসহ ৬ ব্যক্তিকে অমানবিকভাবে মারধর করে। এই হতভাগ্যরা হচ্ছেন, নানিয়াচর উপজেলার ৭৫ নং বেতছড়ি মৌজার অন্তর্গত বেতছড়ি দ্বজর পাড়া গ্রামের মিঃ ইন্দ্রমুনি চাকমা (৫৫) পীং পাক্যা চাকমা, মিসেস মনতা চাকমা (২৬) স্বামী- সোনাময় চাকমা ও তার ২ বসরের শিশুপুত্র নবেন্দু চাকমা এবং একই উপজেলার সাবেক্ষং ইউনিয়নের অন্তর্গত জগনাতুলী গ্রামের মিঃ মেদেরা চাকমা (১৩) পীং- পদ্ম চাকমা, অমর বিকাশ চাকমা (১৫) পীং- নীলমোহন চাকমা এবং মিঃ শুভজি চাকমা (১২) পীং- কালাবুয়া চাকমা।

(৭)
গুলিতে একজন নিহত, লাশ ফেরত দেয়া হয়নি
গত ১২/২/৯২ইং রোজ বুধবার বেতছড়ি ক্যাম্প কমা-ার মেজর মাহবুবুল আনাম (৮ম বেঙ্গল) এর নেতৃত্বে তার সেনারা একদল লোকের ওপর বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করলে এতে চেরেত্তো চাকমা (২৬) পীং- নেপাল চন্দ্র চাকমা নামে এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। ধর্মীয়ভাবে দাহ কার্য সম্পন্ন করার জন্য নিহত ব্যক্তির লাশ ফেরত দেয়া হয়নি এবং সেনাকর্তারা পিতাকে  লাশ দেখতে দেয়নি। 
ঘটনার খবরে প্রকাশ, উক্ত দিন সকালে লক্ষী বিলাস চাকমা পীং সুর্য্যমনি চাকমা, অনাদি রঞ্জন চাকমা পীং বুকুন্দু বিকাশ চাকমা, বড়চোগা চাকমা পিং মঙ্গল চন্দ্র চাকমা, চেরেত্তো চাকমা পীং নেপাল চন্দ্র চাকমা সানাই বাজারে মাছ বিক্রি করার পর নৌকা যোগে বাড়ি ফিরছিল। তারা বেতছড়ি ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌছলে সেনা সদস্যরা তাদের ওপর এলোপাথারি গুলি বর্ষণ করে। এতে বাকী তিনজন পানিতে ঝাঁপ দিয়ে রক্ষা পেলেও চেরেত্তো চাকমা ঘটনাস্থলে নিহত হন। এরপর গুলি থেকে রক্ষা পেলেও উক্ত তিন জনকে পানি থেকে তুলে বেপরোয়া মারধর করা হয় এবং এলাকার আরো দুই ব্যক্তিসহ তাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।                            
উল্লেখ্য, ঘটনার চারদিন পর নানিয়াচর জোনের সি,ও,সাহেব নিহত ব্যক্তির পিতাকে পাঁচ শত টাকা ক্ষতিপূরণ দেন এবং এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করার জন্য হুমকি দেন।

(৮)
ধর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হলে .......           
গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ৯২ইং শশী রাণী চাকমা, স্বামী রবি কুমার চাকমা, গ্রামঃ কৃঞ্চমা ছড়া, নানিয়াচর উপজেলা-কে ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হলে তাকে কুপিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়।                                                                                            
জানা যায়, ঐ দিন সকাল বেলা একজন বাঙালী অনুপ্রবেশকারীসহ পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পের মেজর আহসান এবং সুবেদার তোফাজ্জল রবি কুমার চাকমার বাড়ি যায়। ঐ সময় সে বাসায় অনুপস্থিত ছিল। রবি কুমার চাকমার অনুপস্থিতির খবর জেনে তারা ফিরে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই উক্ত বাঙালী অনুপ্রবেশকারী লোকটি পুনরায় রবি কুমারের বাড়িতে ফিরে আসে এবং শশী রাণী চাকমাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। শশী রাণী চাকমার প্রবল চিকার এবং বাধা দানের দরুণ ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হলে উক্ত লোকটি তাকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করে। এতে শশী রাণী মারাত্মকভাবে জখম হয়। পরে তাকে রাঙ্গামাটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

(৯)
পাহাড়ি গ্রামে হানা তিনজনকে মারধর                                                                                                        
গত ২ শে জানুয়ারী ’৯২ রাতে নানিয়াচর জোনের সেনা সদস্যরা (৮ম বেঙ্গল) মেজর ফিরোজের নেতৃত্বে উত্তর মরা চেঙ্গী গ্রামে হানা দেয় এবং তিন ব্যক্তিকে অমানুষিকভাবে প্রহার করে। এরা হলেন, অনাদী রঞ্জন চাকমা (৩৫) পীং আনন্দ মোহন চাকমা, সুশীল রঞ্জন চাকমা (৩৩) পীং গোলক বাঁশী চাকমা এবং প্রদীপ চন্দ্র চাকমা (৩৮) পীং শুক্রচার্য্য চাকমা।

(১০)
তফাজ্জল কর্তৃক কিশোরী ধর্ষিতা                                                                                                                            ৯ই জানুয়ারী ৯২ইং। জুরাছড়ি আর্মি ক্যাম্পের কুখ্যাত সুবেদার তফাজ্জল পুকুরছড়ি গ্রামের জয়মোহন চাকমার স্ত্রী মিসেস জুরাহেলা চাকমা এবং কন্যা মিস্ বনদেবী চাকমাকে জোরর্পূবক বাড়ি থেকে ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং বনদেবী চাকমাকে ধর্ষণ করার পর ছেড়ে দেয়। উল্লেখ্য, এই কুখ্যাত দানব তফাজ্জল ইতিপূর্বে আরো অনেক মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছে।

(১১)
শান্তিবাহিনী সন্দেহে একজন প্রহৃত
৩রা জানুয়ারী ’৯২ইং মেজর ফিরোজের নেতৃত্বে (৮ম বেঙ্গল) নানিয়াচর জোন থেকে একদল সেনা গভীর রাত্রে যাদব ছড়া গ্রামের মিঃ মঙ্গল চাকমা (৬৯) পীং পেত্তো চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং শান্তিবাহিনী সন্দেহে তাকে সাংঘাতিকভাবে প্রহার করে।

(১২)
শ্লীলতাহানির চেষ্টা ব্যর্থ
বিনতা রাণী চাকমা (২৫) স্বামী সাধনা কুমার চাকমা গ্রামঃ চৈছড়ি, ৪নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন, উপজেলাঃ নানিয়াচর। গত ৫/৩/৯২ইং তারিখে কলকপাড়া ক্যাম্পের রাস্তায় কর্তব্যরত দুইজন সৈনিক কুতুকছড়ি বাজার থেকে ফেরার পথে বিনতা রাণী চাকমাকে ঝাপতে ধরে রাস্তার পাশে নিয়ে যায়। এসময় হাঠ একটা জীপগাড়ি আসায় শ্লীলতাহানির চেষ্টা থেকে তিনি রক্ষা পান। কিন্তু টাকা পয়সা যা ছিল সব কেড়ে নেয়া হয়। এই অভিযোগ ঘিলাছড়ি ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর আহসানুল হককে জানালে তিনি বিনতা রাণী চাকমাকে ১০০ টাকা দিয়ে বিদায় করেন।

মহালছড়ি
(১)
গুলিতে নিরীহ জুম্ম নিহত, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীকে কি খুন করার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে?    
২০শে ডিসেম্বর ১৯৯১ইং ২৬ বেঙ্গল মানিকছড়ি জোন-এর অধীন বাজার পাড়া ক্যাম্প অধিনায়ক ক্যাপ্তেন হামিজ শান্তিবাহিনীর কট্টর সহযোগী আখ্যায়িত করে নিশি কুমার চাকমাকে (৪৫) পীং মঙ্গল চাকমা, গ্রামঃ চংড়াছড়ি মুখ, ২১৬নং গোয়াছড়ি মৌজা, সিন্দুকছড়ি ইউনিয়ন, মহালছড়ি উপজেলা-কে নিজ বাড়ির উঠানে রাত ১০.০০ টায় নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে লাশটি দাহ করার জন্য তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদেরকে অনুমতি দেয়া হয়নি। ক্যাপ্তেন হামিজ নিহত ব্যক্তির পকেটের ৭৯০ টাকা সহ লাশটি ক্যাম্পে নিয়ে যান।
উক্ত হত্যাকা- পূর্বপরিকল্পিত ও প্রতিশোধমূলক বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, উক্ত ঘটনার পুর্বে স্থানীয় বাজার পাড়া ক্যাম্পের আর্মিদের প্রচ- উপদ্রব সহ্য করতে না পেরে নিহত নিশি কুমার চাকমাসহ মি. কিনাধন কার্বারী ও মি. মুই থোয়াই মেম্বার এই তিন ব্যক্তি গত ৪/১১/৯১ইং মানিকছড়ি জোন-এর ঈঙ লেঃ কর্ণেল হানিফ ইকবালের কাছে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্তেন হামিজ এই আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে না পেরে নিশি কুমার চাকমাকে খুন করে। এই নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা সম্পর্কে মানিকছড়ি ঈঙ অবগত হলে ক্যাপ্তেন হামিজ-এর উপর চাপ আসতে থাকে। ঈঙ সাহেব তাকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। ফলশ্রুটিতে ক্যাপ্তেন হামিজ ২৩/১২/৯১ইং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাধ্য হয়ে “বাজার ফা- দেয়া হবে” এই অজুহাতে গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ স্থানীয় গ্রামবাসীদের ক্যাম্পে আসতে নির্দেশ দেয়। ঐ দিন প্রায় ৪৮ জন জুম্ম উপস্থিত হয়। উপস্থিত জুম্মদেরকে নানা ধরনের হুমকি ও কড়া ভাষায় শাসানোর পর নিহত নিশি কুমার চাকমার বিরুদ্ধে ৩টি অভিযোগ (১. শান্তিবাহিনীর কট্টর সহযোগী, ২. শান্তিবাহিনীর কট্টর সহযোগী বিধায় পকেটে রসিদসহ নগদ ৭৯০ টাকা পাওয়া গেছে এবং ৩. তার কাছে বন্দুক ছিল) আনয়ন করে এবং তার সমর্থনে জোরপূর্বক ৭ জনের স্বাক্ষর নেয়া হয়। এরা হচ্ছেন চংড়াছড়ি মুখ গ্রামের অধিবাসী সুজিত কুমার চাকমা, রাজমুনি চাকমা, ব্রতমুনি চাকমা, ইন্দ্রমুনি চাকমা, ধন কুমার চাকমা, কদরাম চাকমা এবং নিক্যা চাকমা।
নিশি কুমার চাকমার হত্যাকা-ের পর গত ২৭-১২-৯২ইং ক্যাপ্তেন হামিজ চংড়াছড়ি গ্রামের নন্দী কুমার চাকমার পুত্র প্রসন্ন কুমার চাকমা (৩২) নামক আরো একজন নিরীহ জুম্মকে রাত ৯.০০ টায় নিজ বাড়ির উঠানে কোন প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা হরে। অথচ ঘটনার পরদিন উক্ত ঘটনাকে বিকৃত করে “বিদ্রোহী শান্তি বাহিনীর সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে একজন শান্তিবাহিনী নিহত হয়” - বলে বিসিবি থেকে প্রচার করা হয়। 
উক্ত দুই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর চংড়াছড়ি ও পার্শ্ববতী গ্রামের অধিবাসীরা সস্ত্রস্ত ও নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করছে। জনমনে এখন স্বাভাবিক প্রশ্ন সরকার কি পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনীকে নির্বিচারে মানুষ খুন করার লাইসেন্স প্রদান করেছেন ?

(২)
পরিচয় পত্র না থাকায় মারধর
সঙ্গে পরিচয় পত্র না থাকায় গত ২৮সে জানুয়ারি ৯২ইং মহালছড়ি জোনের লেঃ কঃ আব্দুল কাদের (২৩ বেঙ্গল) এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে জখম করেছে। উক্ত ঘটনার শিকার ব্যক্তির নাম হচ্ছে - বানু কুমার চাকমা (৩৫) পীং তরণী সেন চাকমা, গ্রামঃ যন্ত্রনাথ পাড়া (পাকুয্যাছড়ি) ২৫০ নং লেমুছড়ি মৌজা। ঐ দিন মহালছড়ি বাজারে যাওয়ার সময় তাকে বাজারের প্রবেশ পথে চেক পয়েন্ট থামানো হয় এবং পরিচয় পত্র না পেলে মারধর করা হয়। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাজারে প্রবেশ করার সময় সকল পাহাড়িকে তন্নতন্ন করে তল্লাশী করা হয়।

মানিকছড়ি

শান্তিবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে বেদম প্রহার                                                                                                     গত ১৮-১২-৯১ইং মানিকছড়ি জোন-এর অধীন ২৬ বেঙ্গল-এর বাজার পাড়া আর্মি ক্যাম্প কমা-ার ক্যাপ্তেন হামিজ চংড়াছড়ি গ্রামের ভাগ্যমুনি চাকমার পুত্র ধন্যমুনি চাকমা (৩৫) কে শান্তিবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে মারাত্মকভাবে প্রহার করে। ক্যাপ্তেন হামিজ তাকে কিল-ঘুষি-লাঠি ও ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করে।

(২)
সেনাকর্তার প্রমোশনের বলি দুই জন নিরীহ পাহাড়ি 
 মানিকছড়ি জোনের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য জনৈক মেজর শহীদ প্রমোশন পাওয়ার আশায় একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। পরিকল্পনা মোতাবেক সে আমিন মিঞা (একজন মেম্বার, মানিকছড়ি) এবং গোলাপ মিঞা নামক দুই ব্যক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে দুইটি বন্দুক ক্রয় করে। অতঃপর সে ৪/৩/৯২ইং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। ঐ দিন উক্ত মেজর তার দলবল নিয়ে বেত্মাতলী গ্রামে হানা দেয় এবং ধানক্ষেতে কর্মরত দুইজন নিরীহ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। এরা হলেন প্রাক্তন ইউ,পি, চেয়ারম্যান মিঃ আধু মারমা পীং মৃত মুইল্যা মারমা এবং আথোয়াই মারমা (৩০) পীং চেইল্যা মারমা। অতঃপর মেজর শহীদ পূর্বে ক্রয় করা বন্দুক দুটি ধানক্ষেতের পাশের ঝোপ থেকে বের করে ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং সে দুইজন শান্তিবাহিনীকে হত্যা করে দুইটি বন্দুক উদ্ধার করেছে বলে বীর দর্পে ঘোষণা করে।
উক্ত ঘটনার পর সেনাসদস্যরা আরো তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এবং তাদের ওপর শারীরিক অত্যাচার চালায়। এরা হলেন বেত্মাতলী গ্রামের (১) শাই খুয়াই চৌধুরী পীং উগ্য জাই চৌধুরী (২) অং থোয়াই মারমা পীং মোন মারমা এবং (৩) রামপ্রু মারমা পীং চোইল্যাপ্রু মারমা। আরো জানা যায়, উক্ত মেজর যাতে তার পরিকল্পনা ফাঁস না হয় সেজন্য আমিন মিঞাকে কৌশলে থানায় ঢুকিয়ে রেখেছে।

(৩)
সেনাবাহিনীর গুলিতে একজন নিহত
গত ২৭/১২/৯১ইং রাতে ক্যাপ্তেন হামিদের নেতৃত্বে মানিকছড়ি জোনের অধীন বাজার পাড়া আর্মি ক্যাম্প থেকে ২৬ বেঙ্গলের একদল সদস্য লক্ষীছড়ি ইউনিয়নের চংড়াছড়ি গ্রামে হানা দেয়। তারা ঐ সময় প্রসন্ন কুমার চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হুকুম দেয়। প্রসন্ন কুমার বাড়ির বাইরে আসলে সেনা সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা হরে। নিহত ব্যক্তির লাশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরিবারের সদস্যদের অনুরোধ সত্ত্বেও লাশটি দাহ করতে দেয়া হয়নি।
কাউখালি

(১)
স্বপরিবারে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত                                                                                                                        পার্বত্য চট্টগ্রামে অভাব-অনটনের সুযোগে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে জুম্মদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করণ প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। গত ১৭ই ডিসেম্বর ৯১ইং ৬৯ বসর বয়স্ক মিঃ মনোরাম চাকমা ও তার পরিবারকে কাউখালি উপজেলার ম্যাজিষ্ট্রেট সিদ্দিকুর রহমান-এর কোর্টে লেঃ কঃ দেলোয়ার হোসেন মিঞা (৫ম ঈষ্ট বেঙ্গল, ঘাগড়া জোন)-এর উপস্থিতিতে ধর্মান্তরিত করা হয়। মিঃ মনোরাম চাকমার নিবাস গ্রামঃ উগলছড়ি, ৯৭নং মুবাছড়ি মৌজা, ৩নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন কাউখালি উপজেলা, রাঙ্গামাটি। উল্লেখ্য, অভাব অনটনের কারণে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন প্রলোভনের শিকার হয়ে মিঃ মনোরাম চাকমা দীর্ঘদিন ধরে গোপনে স্থানীয় সরলপ্রাণ নিরীহ এলাকাবাসীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে সরবরাহ করে আসছিল। পরে খবর পেয়ে এলাকাবাসীরা তাকে সমাজচ্যুত করে এবং সে সেনাবাহিনীর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে। এই সুযোগে সেনাবাহিনীরা তাকে ও তার পরিবারের অন্য সাত সদস্যকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে। জানা যায়, মনোরাম চাকমা (৬৯) পীং বেগেনা পেদা চাকমা ও তার স্ত্রী মঙ্গল মুনি চাকমার (৬০) ধর্মান্তরিত নাম যথাক্রমে মোঃ আব্দুল রহিম ও সাহেরা বেগম দেওয়া হয়। তার দুই পুত্র নিশি কুমার চাকমা (৩৫) ও শেষ কুমার চাকমা (৩২) এর নাম ধর্মান্তরিত করে যথাক্রমে আব্দুল মালেক ও আব্দুল খালেক এবং শেষ কুমার চাকমার স্ত্রী সূর্যদেবী চাকমার (২৭) ধর্মান্তরিত নাম নুরজাহান রাখা হয়। তাছাড়া শেষ কুমার চাকমার ৭ বছরের ছেলে নব কুমার চাকমা, ৩ বছরের ছেলে সক্রিয় চাকমা ও ৭ মাস বয়সী মেয়ে বাসনাদেবী চাকমার নাম যথাক্রমে সোরাব হোসেন, আব্দুল সোবহান ও রীনা আক্তার রাখা হয়।

(২)
হত্যা যেন ওদের হাতের মোয়া এবং একটি লাশের বৃত্তান্ত 
নাম অবিরন চাকমা। পিতার নাম কিনাচন্দ্র কার্বারী। গ্রামঃ শুকনাছড়ি, উপজেলাঃ কাউখালি, জেলাঃ রাঙ্গামাটি। ফটিকছড়ি ইউনিয়নের অন্যতম চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এবং একজন সম্ভাব্য চেয়ারম্যান। বর্তমানে পশুপক্ষীর মত একটি লাশ মাত্র। এই হলো অবিরন চাকমার সংক্ষিপ্ত পরিচয়। তাকে গত ১৪ই জানুয়ারী ৯২ নির্বাচনী প্রচারণায় কিছু সংখ্যক সমর্থক নিয়ে বর্মাছড়ি নতুন বাজারে গেলে নবপ্রতিষ্ঠিত বড়ইতলী আর্মি ক্যাম্প কমা-ার জনাব নুরুল কবীর ধরে নিয়ে যান জোরপূর্বক। সেখানে তাকে অমানুষিকভাবে প্রহার করে অথবা গুলি করে লাশ বানানো হয়। তা তখনো কেউ জানতে পারেনি। পরদিন ১৫ই ফেব্রুয়ারী অবিরন চাকমার হতভাগ্য জন্মদাতা কিনাচন্দ্র কার্বারীকে ক্যাম্পে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ক্যাম্পে গিয়ে তিনি পুত্রের বিশ্রী লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শত অনুরোধ-আবদার সত্ত্বেও নিজের পুত্রের লাশকে বাড়িতে নিয়ে যেতে দেয়নি ঐ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য জনাব নুরুল কবীর। ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিকে লংঘন করে ক্যাম্পের নিকটবর্তী জঙ্গলে পিতার উপস্থিতিতে লাশকে কবর দেয়া হয়। আনন্দ প্রকাশের জন্য সৈন্যরা কবর দেয়ার আগে কয়েক রাউ- শুন্যে গুলি ছোড়ে। এইভাবে একটি লাশের সংক্ষিপ্ত কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু পুত্রহারা কিনাচন্দ্র সহ আরো অনেকে লাশ হওয়ার প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে। কারণ একমাত্র লাশ হতে কোন অনুমতি নিতে হয় না।

(৩)
মধ্যযুগীয় বর্বরতা: নাকে মুখে গরম পানি ঢেলে দিয়ে অত্যাচার   
১০ই ফেব্রুয়ারী ৯২ইং ঘাগড়া জোনের অধীন কাউখালি ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর তারেক আহমেদ (১৮ বেঙ্গল) তালুকদার পাড়া নিবাসী মেরেয়্যা চাকমা নামক জনৈক নিরীহ কৃষককে শান্তিবাহিনী সন্দেহে গ্রেফতার করে। তাকে সেনা সদস্যরা সাংঘাতিকভাবে মারধর করে এবং নাকে-চোখে-মুখে ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দেয়। ফলে তার নাক ও মুখ থেকে রক্ত বের হতে থাকে। পরে তাকে ঘাগড়া জোন হেড কোয়াটারে চালান দেয়া হয় এবং সেখান থেকে কয়েকদিন পর ছেড়ে দেয়া হয়।

(৪)
চৌদ্দ বছরের কিশোরী ধর্ষিতা, বহু ব্যক্তি প্রহৃত   
২২শে ফেব্রুয়ারী ৯২। হাটবার। কাউখালি উপজেলাধীন লেভাপাড়া আর্মি ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জাহিদের (১৮ বেঙ্গল) নেতৃত্বে একদল আর্মি সকালে উল্টাপাড়া নামক গ্রাম ঘেরাও করে এবং গ্রামের উপর বৃষ্টির মত এলোপাথারি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। এতে ভয় পেয়ে লোকজন এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। যারা পালিয়ে যেতে পারেনি তাদেরকে দৈহিকভাবে নির্যাতন করা হয়। ক্যাপ্টেন জাহিদ নীরবালা নামক চৌদ্দ বছরের একা কিশোরীকে বলপূর্বক ধর্ষণ করে। সে ললিত মোহনের কন্যা বলে জানা গেছে। যারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন তারা হলেন- (১) ফন চোগী চাকমা (৭৫) স্বামী বীর কুমার চাকমা, (২) জ্যোতিলা চাকমা (৪০) স্বামী ললিত মোহন চাকমা এবং (৩) সাধন দেব চাকমা (১৫) পীং সুখেশ্বর চাকমা।

(৫)
তিন জন শান্তিবাহিনী গ্রেফতার                                                                                                                              গত ২৯শে জানুয়ারী ৯২ইং ঘাগড়া জোনের অধীন কাঁশখালী আর্মি ক্যাম্পের অধিনায়ক লেঃ সাব্বিরের (১৮ইঃ বেঙ্গল) নেতৃত্বে এক দল সৈন্য ভোর রাত্রিতে শুকনাছড়ি গ্রামে গিয়ে তিনটি বাড়ি ঘেরাও করে রাখে এবং বাড়ির পাশে গোপনে তিনটি দেশীয় গাদা বন্দুক লুকিয়ে রাখে। পরে ভোর হলে বন্দুকসহ তিন ব্যক্তিকে কাঁশখালী আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। একইদিন গিরিদর্পন, বনভূমি ও রেডিওতে প্রচার করা হয় যে, সেনাবাহিনী অস্ত্রসহ শুকনাছড়ি থেকে তিনজন শান্তিবাহিনী গ্রেফতার করেছে। এই তিন জন হলেন, মথুর চাকমা (৭০) পীং মৃত বালি চাকমা, প্রদীপ কুমার চাকমা (৪০) পীং মথুর চাকমা এবং জ্বালিয়া চাকমা পীং মৃত বইলাম চাকমা। তাদেরকে পরে ঘাগড়া ক্যাম্পে পাঠানো হয় এবং সেখানে ১৭/১৮ দিন যাবত মাটির নীচের অন্ধকার গর্তে রাখা হয়। তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন করার পর ছেড়ে দেয়া হয়।

লংগদু
(১)
সেনাবাহিনী কর্তৃৃক নতুন কায়দায় ডাকাতি     
গত ২রা জানুয়ারী ১৯৯১ইং করল্যাছড়ি ক্যাম্প কমা-ার ক্যাপ্টেন নাসির মি. বাজি মোহন চাকমা ও দুলাল্যা চাকমা নামে দুইজন ব্যবসায়ীকে আটক করে। সে তাদেরকে সাংঘাতিকভাবে মারধোর করে এবং শান্তিবাহিনী কর্তৃক নিযুক্ত ট্যাক্স কালেক্টর বলে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে। আটক করার সময় তাদের দুজনের কাছে মোট ৪১০৫ টাকা ছিল, যা ক্যাপ্টেন নাসির বাজেয়াপ্ত করে নিজের পকেটস্থ করেছেন বলে জানা গেছে। উক্ত ঘটনার পর এলাকাবাসীদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, “এ এক নতুন কায়দায় ডাকাতি।”     
লংগদু উপজেলাধীন বামের আটরকছড়া গ্রাম নিবাসী মিঃ বাজি মোহন চাকমা ও দুলাল্যা চাকমাকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এখনো ছেড়ে দেয়া হয়নি।

(২)
দুই ব্যক্তি প্রহৃত    
গত ২রা জানুয়ারী ৯২ইং করল্যাছড়ি সাব জোনের অধিনায়ক মেজর লুফর দুই ব্যক্তিকে বন্দুকের বাট ও লাঠি দিয়ে জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত মারধর করে। এরা হলেন, আটরক ছড়া গ্রামের মিঃ নাগর বাঁশী চাকমা (৪০) পীং গুনরূপ চাকমা এবং আনন্দ ময় চাকমা (৩২) পীং কালী কুমার চাকমা। ঐ দিন উক্ত দু’ব্যাক্তিকে বাজারে যাওয়ার পথে করল্যাছড়ি সাব জোনের চেকপোষ্টে আটক করা হয়। তাদেরকে সেনা সদস্যরা শান্তিবাহিনীকে সাহায্য করে কিনা জিজ্ঞেস করলে তারা না বলে উত্তর দেয়। এর পর তাদের উপর চলতে থাকে কিল, লাথি ইত্যাদি।

(৩)
নিরীহ ব্যক্তি প্রহৃত
গত ৭ই জানুয়ারী ৯২ইং পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর করিম রাঙ্গাপানি ছড়া গ্রামের মিঃ জুরনী সেন চাকমাকে (৪২) পিটিয়ে জখম করে। জানা যায় জুরানী সেনের সাথে সুসম্পর্ক থাকার জন্য একজন বাঙালি ব্যবসায়ী প্রায়শঃ তার বাসায় আসা-যাওয়া করত। উক্ত দিনও উক্ত বাঙালি ব্যবসায়ী ভদ্রলোক জুরানী সেনের বাসায় বেড়াতে যায়। গল্প গুজব শেষে ভদ্রলোকটি চলে যাওয়ার পর পরই সেনা সদস্যরা হঠা জুরানী সেনের বাসায় আসে। তারা সঙ্গে সঙ্গেই জুরানী সেনকে আটক করে এবং উক্ত ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি কেন তার বাসায় এসেছে তা জিজ্ঞেস করে। জুরানী সেন সত্য কথা বললেও তারা বাঙালি ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি জুরানী সেন চাকমার মাধ্যমে শান্তিবাহিনীকে চাঁদা দেয় বলে সন্দেহ করে। এই সন্দেহই অতঃপর রূপান্তরিত হয় শারীরিক নির্যাতনে।

রাঙ্গামাটি সদর
(১)
একজন ধর্ষিতা, দুই ব্যক্তি প্রহৃত  
গত ১০ই ফেব্রুয়ারী ৯২ইং খারিক্ষ্যং আর্মি ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন মকিম সরকার (৮ ইঞ্জিঃ) রাঙ্গামাটি সদর উপজেলাধীন বন্দুকভাঙ্গা খারিক্ষ্যং এলাকার দুই ব্যক্তিকে নির্দয়ভাবে প্রহার করে এবং মিঃ বিরিত্তং চাকমার চৌদ্দ বছরের কিশোরী কন্যা মিস তাত্তরাং চাকমাকে ধর্ষণ করে। প্রহৃত ব্যক্তিদ্বয়ের নাম মিঃ ঘুশান মনি চাকমা (৩২) পীং মিঃ আনন্দ কুমার চাকমা এবং মিঃ মিহির লাল চাকমা, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, ৩নং ওয়ার্ড।

(২)
ক্যাপ্টেন মকিমের বেপরোয়া মারধর    
গত ১লা জানুয়ারী ৯২ইং ৫৯ বন্দুকভাঙ্গা মৌজার অধীন কুমার পাড়া গ্রামের মিঃ কল্পতরু চাকমা (২৮) পীং শুক্রমনি চাকমা খারিক্ষ্যং আর্মি ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মকিম কর্তৃক সাংঘাতিকভাবে প্রহৃত হয়েছেন। ঐ দিন তিনি কর্ণফুলি হৃদে মাছ ধরতে গেলে মকিম তাকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যায় এবং শান্তিবাহিনীকে চাঁদা প্রদানকারী আখ্যায়িত করে বেপরোয়া মারধর করে। তার নাকে মুখে গরম পানি ঢেলে দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন মকিম তার মাছ ধরার জালসহ সবকিছু আটক করেছে। এছাড়া গত ২/১/৯২ইং উক্ত ক্যাপ্টেন আরো তিন ব্যক্তিকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে প্রহার করে। এরা হলেন, মিঃ রঞ্জন কুমার (৩০) পীং বিন্দুনাথ চাকমা গ্রামঃ মুবাছড়ি, মিঃ উদয়ন চাকমা (১৭) পীং নতুন চন্দ্র চাকমা, গ্রামঃ লেখ্যংছড়ি এবং মিঃ শান্তিময় চাকমা (১৮) পীং সুর্য্য চন্দ্র চাকমা, গ্রামঃ লেখ্যংছড়ি। শেষোক্ত দুই ব্যক্তি যথাক্রমে রাণী দয়াময়ী স্কুলের দশম শ্রেণী এবং রাঙ্গুনিয়া কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র।

(৩)
চার ব্যক্তি আটক
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা (১৭ বেঙ্গল) গত ৯ই মার্চ ৯২ ঘাগড়া ক্যান্টনমেন্টে দুই ব্যক্তিকে আটক করেছে। এরা হলেন, সুকেন চাকমা ও অনিল চাকমা (শিমুল)। এছাড়া গত ৮ই মার্চ প্রবীন খীসাকে এবং ২৮শে ফেব্রুয়ারী মিঃ শান্তিজয় চাকমাকে আটকাবস্থায় রাঙ্গামাটিতে রাখা হয়েছে। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি।

[সংবাদ পাঠিয়েছেন- দিঘীনালা থেকে স্বচল, দিলীপ, লংগদু থেকে সজীব খীসা, নানিয়াচর থেকে প্রসেনজি, মহালছড়ি থেকে নেশান, অঘ্যজাই, কাউখালি থেকে প্রীতিকুমার (দ্বীপ্য), খাগড়াছড়ি থেকে রনবীর এবং বাঘাইছড়ি থেকে সুভাষ।]
                                                                                               গ্রন্থনা : মানবমিত্র।
--------------------------------
বিজ্ঞপ্তি
[মানুষের অধিকার মানেই মানবাধিকার। নিজস্ব চিন্তা, চেতনা, ভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার। নিজের মতামত ব্যক্ত করার, প্রতিবাদ করার, সংগঠন করার ও চলাফেরা করার অবাধ অধিকার। এই অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত। অথচ আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামে কি আপনার এমন অধিকার ভোগ করছেন ? খর্ব করা হচ্ছে কি আপনার অধিকার ? মানবাধিকার লংঘনের প্রত্যক্ষ শিকার অথবা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থাকলে লিখুন আমাদের ঠিকানায়। কে, কি, কখন, কোথায়, কিভাবে, কেন ইত্যাদির ভিত্তিতে বিস্তারিত লিখুন। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন এবং এই অধিকারের জন্য সংগ্রাম করুন। - রাডার সম্পাদনা পরিষদ]


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন